এ বছরের ১৯শে এপ্রিল তারিখে দেশের গ্রামের বাড়িতে আমার আব্বা মারা যান। খবর পেয়ে ১০ দিনের জরুরী ছুটি নিয়ে সেদিন রাতেই আমি ও আমার স্ত্রী দেশের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়ে যাই, অন্যদিকে ইংল্যান্ড থেকে ছোট ভাইদের একজন দেশে আসে।
১৯ তারিখ ভোর ৪টার দিকে দেশ থেকে প্রথম ফোন আসে যে আব্বার সারা শরীর ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে এবং ডাকাডাকিতেও উনি কোন সাড়া দিচ্ছেন না, গ্রামের ডাক্তারও এই ভোররাতে ফোন ধরছে না। বাড়ির মুরুব্বীদের সিদ্বান্তে পরে গাড়ী ডেকে আব্বাকে পার্শ্ববর্তী দেবীদ্বার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যাওয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত বলে ঘোষণা করেন। নিয়মানুযায়ী সেখানকার জরুরী বিভাগ থেকে একটি টোকেন / স্লিপ দেয়া হয় এবং বলা হয় যে এটি দেখিয়ে পরে যে কোন সময়ে এসে BROUGHT DEAD লেখা ডেথ সার্টিফিকেট উঠানো যাবে। মৃত্যু সংবাদ শোনার পর দেশে জানিয়ে দেই আমাদের জন্য অপেক্ষা না করে লাশ দাফন করে ফেলার জন্য।
ডেথ সার্টিফিকেট তোলার জন্য কুলখানির পরের দিন, ২৪শে এপ্রিল ছোট ভাই ও এক চাচাকে নিয়ে আমি নিজে সকাল দশটায় দেবীদ্বার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে যাই। উল্লেখ্য, প্রথমবার আব্বাকে ওখানে নিয়ে যাওয়ার সময়ও ওই চাচা সাথে ছিলেন। জরুরী বিভাগে গিয়ে স্লিপটি দেখিয়ে ডেথ সার্টিফিকেট চাইলে কর্তব্যরত চিকিৎসক বললেন যে আমাদেরকে দুপুর একটার পরে আসতে হবে; কারণ দেখালেন যে জরুরী বিভাগের প্রধান চিকিৎসক কুমিল্লা জেলা সদরে গেছেন আর ডেথ সার্টিফিকেটে উনার দস্তখত লাগবে। অনেকভাবে অনুরোধ করার পরও জানালেন যে তিনি ডেথ সার্টিফিকেট ইস্যু করতে পারবেন না, আমাদেরকে অপেক্ষা করতে হবে। অন্যদিকে সাদা প্যান্ট-শার্ট পরা জরুরী বিভাগের এক কর্মচারী, সম্ভবত কম্পাউন্ডার, খুব রুক্ষভাবে আমাদেরকে বলতে থাকে যে কেন আমাদের ডেথ সার্টিফিকেট লাগবে, সাধারণ মানুষের তো সেটা লাগে না। আমাদের সাথে যাওয়া চাচা তখন বলে বসেন যে মৃত ব্যাক্তি বৃটিশ নাগরিক ছিলেন, কাজেই ওনার পেনশন সংক্রান্ত ব্যপারে আমাদের ওই ডেথ সার্টিফিকেটটি দরকার। আমি তখন চাচাকে একটু দূরে ডেকে নিয়ে বলি যে বৃটিশ নাগরিকত্বের ব্যাপারটি উনি যেন ওখানে আর না উল্লেখ করেন। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর আবার জরুরী বিভাগে গিয়ে কর্তব্যরত সেই চিকিৎসককে না পেয়ে তাকে DOCTORS’ ROOM (ডাক্তারদের বিশ্রাম কক্ষ) থেকে খুঁজে বের করি এবং আবারো বিনীতভাবে অনুরোধ করি, কিন্তু তার একই জবাব যে ওই স্যারের দস্তখত ওটাতে লাগবে। তাকে বললাম ওই স্যারকে ফোন করে বুঝিয়ে বলতে যে হাতে অন্য আরো কাজ থাকাতে আমাদের পক্ষে অপেক্ষা করা বা পরে আবার আসা সম্ভব না, কাজেই ওনার অবর্তমানে ওনার অধনস্তঃ যে কেউ স্বাক্ষর করলেও আমাদের চলবে। জবাবে ওনি বললেন যে স্যার একটা মিটিঙে আছেন কাজেই এখন ওনাকে ফোনও করা যাবে না। কি আর করা, আমরা বাইরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে লাগলাম।
আমি তখন পার্শ্ববর্তী দাউদকান্দি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে কর্মরত আমার এক ডাক্তার বন্ধুকে ফোন করে সব কিছু খুলে বলায় সে আমাকে জানাল যে THO যদি কুমিল্লা জেলা সদরে গিয়েও থাকে, ওনার অনুপস্থিতিতে ডিউটিরত মেডিক্যাল অফিসার আমাদেরকে ডেথ সার্টিফিকেট ইস্যু করতে পারবেন যেহেতু আমাদের কাছে ঘটনার দিন ইস্যুকৃত টোকেন/স্লিপ রয়েছে। কোন অসুবিধার সম্মুখীন হলে রেসিডেন্ট মেডিক্যাল অফিসারের (RMO) সাথে দেখা করার পরামর্শ দেয় বন্ধুটি।
তখন হঠাৎ দেখি যে হাসপাতালের বারান্দায় দুটি গাড়ী এসে থামে এবং হাসপাতালে উপস্থিত সবার ভিতর কেমন যেন একটা সন্ত্রস্ত ভাব। একজনকে জিজ্ঞাসা করে জানতে পারলাম যে ইউ, এন, ও সাহেব এসেছেন হাসপাতালে। ছোট ভাই আমাকে বলতে থাকে ইউ,এন,ও’র সাথে দেখা করে অভিযোগ জানানোর জন্য। আরো কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর বিরক্ত হয়ে আমিও ভাবলাম যে এবার বোধ হয় তাই করতে হবে। কিছুক্ষণ খোঁজাখুঁজি করে দেখতে পেলাম যে ইউ,এন,ও সাহেব হাসপাতালে চলমান একটি কর্মশালায় বক্তব্য রাখছেন। ওই অবস্থায় ওনাকে বিরক্ত করা ঠিক হবেনা ভেবে অপেক্ষা করছি ইউ,এন,ও সাহেব কখন বের হয়ে আসেন। অপেক্ষা করতে করতে এক পর্যায়ে তখন RMO’র অফিস খুঁজে বের করি। ওনার অফিসে অন্য লোক থাকাতে আমরা দরজার বাইরে অপেক্ষা করছিলাম। ওই সময়ে আমার শারীরিক গঠন বা পোষাক আশাকের কারণে কি না জানিনা, হাসপাতালে আসা গ্রামের এক সাধারণ লোক আমাকে সরকারী কর্মকর্তা ভেবে কি একটা অভিযোগ জানতে আসলে দুখঃ করে ওনাকে বলি যে আমিও ওনারই মতন একজন ভুক্তভুগী।
RMO’র অফিস থেকে অন্য লোকেরা বেরিয়ে গেলে আমি ভিতরে ঢুকে সালাম দিয়ে আমাদের সমস্যার কথা ওনাকে বলাতেই ওনি বললেন যে ডিউটিরত ডাক্তারইতো আমাদের কাঙ্ক্ষিত ডেথ সার্টিফিকেট ইস্যু করতে পারে। ওনাকে তখন অনুরোধ করলাম কষ্ট করে একটু উঠে এসে ওনি নিজেই যদি এই কথাটা মেডিক্যাল অফিসারকে বলে দেন এবং ভদ্রলোক তখনই আমাদের সাথে জরুরী বিভাগে এসে ডাক্তারকে বলে যান। কিছুক্ষণ পরে ডেথ সার্টিফিকেট লিখে আমাকে দেয়ার পর দেখলাম যে ওটাতে BROUGHT DEAD এর বদলে BROUGHT “DEATH” লেখা। তখন খুব বিনীতভাবে ওই কর্তব্যরত ডাক্তারকে বললাম যে ডাক্তার সাহেব, আমরা মেধাবী ছাত্র না হওয়ার কারণে মেডিক্যালে পড়ার সুযোগ পাইনি, আর আপনারা ভাল রেজাল্ট করে, ডাক্তারি পাশ করে এবং কয়েক বছর প্র্যাক্টিস ও সরকারী চাকুরী করার পরেও death আর dead এর তফাৎটা জানেন না। ডাক্তার আমাকে বলে যে brought death লেখার কারণে কোন অসুবিধা হবে না। আমি তখন জোর দিয়ে বললাম যে এই ভুল লেখা ডেথ সার্টিফিকেট আমি নিব না, আমাকে নতুন একটা সার্টিফিকেট লিখে দিতে হবে। ডাক্তার তখন বলতে থাকে যে তারা কখনো সখনো brought death লেখা সার্টিফিকেট দিলেও সেটাতে কোন অসুবিধা হয় না। যাই হোক শেষ পর্যন্ত আমার অনড় মনোভাবের কারণে ওই সার্টিফিকেটটিতেই death কেটে dead লিখে প্রতি-স্বাক্ষর করে দেয়।
ডেথ সার্টিফিকেটটি হাতে পাওয়ার পর শুরুতে যে কম্পাউন্ডার আমাদেরকে খুব ঝাড়ি মারছিল তার রুমে ঢুকে তার এক সহকর্মীর সামনেই বেশ নরম সুরে ও ভদ্রভাবে তাকে বললাম যে, আমার এবং তার নিজের বাপ ভাইয়ের পরিশোধ করা ট্যাক্সের টাকায় সরকার তার বেতন দেয়। কেউ যখন ডেথ সার্টিফিকেট নিতে আসে সেটা প্রয়োজন বিধায়ই তারা আসে, কি কারণে ডেথ সার্টিফিকেট লাগবে সেটা যেখানে ডিউটিরত মেডিক্যাল অফিসার এমনকি RMOও জিজ্ঞাসা করেননি, যারা তার চাইতেও আরো দায়িত্বশীল ও বড় পদে নিয়োজিত, সেখানে তার সেটা জিজ্ঞাসা করা অবান্তর। গ্রামের সহজ সরল মানুষেরা স্বাস্থ্য সেবা নেওয়ার জন্য উপজেলা স্বাস্থ্য কেন্দ্রে আসে, হাইকোর্ট না দেখিয়ে বরং তাদের সাথে একটু সহযোগিতা করলেই সে তাদের দোয়া পাবে।
আমাদের যে কাজটা বড়জোর দশ থেকে পনেরো মিনিটের ভিতর শেষ হবার কথা কর্তব্যরত কিছু সংখ্যক কর্মকর্তা/কর্মচারীর খামখেয়ালীপূর্ণ আচরণের কারণে সেটাতেই প্রায় তিন ঘন্টা সময় ও অহেতুক বিরাম্বনার শিকার হতে হয়েছে।
এই হচ্ছে আমাদের দেশের সরকারী হাসপাতালে সেবার নমুনা!

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।


