ব্লগে লিখিছিলাম শেষ বার জুলাই মাসের ৩ তারিখ ২০২০ সালে। এর পর অনেক জল গড়িয়েছে। পরিস্থিতি এমন যে ব্লগে ফিরে আসবো তা আর ভাবি নি। কারণ ২০১৭ এর পর থেকে প্রতিদিন ই কথা দিচ্ছি ফিরে আসবো। কিন্তু কেউ কথা রাখেনির মতো আমিও আমার কথা রাখিনি।
"এই পালটানো সময়ে তারা ফিরবে কি ফিরবে না জানা নেই"
প্রেক্ষাপট ২০১৩ সাল। একটি রাজনৈতিক মাস্টার স্ট্রোক কিংবা একটি বিশাল রাজনৈতিক ভুল সিদ্ধান্ত। যাঁদের ফিল্ড পলিটিক্স সম্পর্কে বিন্দু মাত্র আইডিয়া নেই সেই সকল মানুষেরা নেমে এলেন একটা দাবিকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য "রাজাকারের ফাঁসি চাই"। এই দাবি যেমন আমাদের প্রাণের দাবি তেমনি প্রশ্ন আসে সরকারী দলের অবস্থান নিয়ে। কারণ বিচার বিভাগ কাগজে স্বাধীন হলেও নির্বাহী বিভাগের প্রভাব যে বিচার বিভাবের উপর খুব সূক্ষ্ম ভাবে এবং সঠিক জায়গায় আঘাত করে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। আধা সামন্ত্রতান্ত্রিক কিংবা এক ছদ্ম একনায়ক নিয়ন্ত্রিত রাষ্ট্রে এমন টাই হয়। সুতরাং গণ প্রতিরোধ থেকে নিজের রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের জন্য সরকার যখন রায় পাল্টানোর জন্য আপিল বিভাগে যায় এবং এ্যামেন্ডেন্টের মাধ্যমে আইন পরিবর্তন করে তখনই প্রশ্ন জাগে। সরকার কি চেয়েছিলো এই আন্দোলন হোক যাতে পরের বছর সাধারণ নির্বাচনের মাধ্যমে আবার মাখনের মতো কোমল ভাবে ক্ষমতায় আসা যায়? শুধুমাত্র রাজনৈতিক দূরদর্শিতার অভাবে এবং ফিল্ডের বাস্তবতা অনুধাবন করতে না পারার জন্যই আমাদের ব্লগারেরা এমন কি আমিও মাটি কামড়ে পরে রইলাম রাজপথে। ফলাফল, কিছু মানুষের রাজনৈরিক ফয়দা লোটার বলি হলো ব্লগারেরা। কিছু মানুষের জীবনে খুলে গেলো ইউরোপের অবারিত দ্বার। এর পরের ইতিহাস আমাদের সবার জানা। একের পর এক ব্লগার খুন হলেন। কেউ গেলেন জেলে। আর সাধারণ শিক্ষাহীন মানুষের সামনে ব্লগাররা প্রতিয়মান হলেন ধর্ম বিদ্বেষী মানুষ হিসেবে। অনেকটা মধ্যযুগের উইচ হান্টিং এর মতো অবস্থা। সুতরাং সেই পালটানো সময়ে ব্লগাররা ফিরবে কি ফিরবে না জানা নেই। আসলেই আমাদের কাছে কোন জানা পথ ছিলো না।
"কালের যাত্রার ধ্বনি শুনিতে কি পাও। জাগাইছে অন্তরীক্ষে হৃদয়স্পন্দন, চক্রে-পিষ্ট আঁধারের বক্ষ-ফাটা তারার ক্রন্দন"
এর পর সময়টা ২০১৫ থেকে ২০২১ এই দীর্ঘ সময়ে একের পর এক ঘটেছে আমাদের নৈতিক স্খলন। যে জায়গাটি ছিলো আমাদের প্রাণের সেখানে আশ্রয় নিলো বেনিয়ারা। বইমেলা এমন একটা জায়গা ছিলো যেখানে আমরা যেতাম একটু অক্সিজেন গ্রহণের জন্য। সাহিত্য চর্চা আমাদের দেশে কখনো উচ্চমার্গীয় মানের হয়নি। এটা মেনে নিয়েও নতুন বন্ধু ব্লগারদের বই এ খুজে নিতাম একটা পরিবর্তনের চেষ্টা। কিন্তু সেই পালটানো সময়ের প্রভাবে ব্লগ যেহেতু পুরোপুরি ব্যাকফুটে চলে গেল সেই সাথে আত্মপরিচয় ভুলে ব্লগাররা চলে এলেন ফেসবুকে। এখানে সস্তা জনপ্রিয়তা পাওয়াটা খুব সহজ। কেউ যদি বলে দেয় "কিছু হীনতায় ভুগছি" সেই সময়ের ক্রেজ সময়ের পথ প্রদর্শক। কারণ টা কি জানেন? ব্লগে সুন্দরী নারীদের ক্লিভেজ আর সাহিত্য বা এই চর্চাটা এক সাথে যায় না। এখানে চর্চাটা একেবারে পরিষ্কার ও স্বচ্ছ। আপনার রাজনৈতিক মতাদর্শ লুকোতে হলে এখানে আপনাকে জানতে হবে শব্দের মারপেচ। লেখায় থাকতে হবে মুন্সিয়ানা। কিন্তু ফেসবুকে সে সবের বালাই নেই। ব্লগে হিরো আলমরা আসে না, এখানে সেফুদাদের জায়গাটাও বেশ কম। কারণ হলো; আপনি যেই হোন না কেন, একটা ব্লগ প্ল্যাটফরমে লিখতে গেলে নূন্যতম কিছুটা রুচিবোধ থাকতে হয়। যিনি পড়তে আসছেন সম্ভবত তিনি আমার বাড়ির সামনে ফুচকা বেঁচেন না। এখানে আমি কোন ভাবেই নিন্মবিত্তদের অপমান করছি না। বরং ক্লাস কনফ্লিক্টটাকেই আবার দেখিয়ে দিচ্ছি। হ্যাঁ ব্লগার হতে গেলে বা এ ধরণের প্ল্যাটফরমে কিছু লিখতে গেলে আপনাকে মননে অন্তত কিছুটা হলেও অভিজাত হতে হবে। যারা ব্লগে গালিগালাজ করেন তাঁদের ক্ষেত্রেও কথাটা সত্য। কারণ এখানে আপনি মিলিয়ন মিলিয়ন লাইক শেয়ার আশা করতে পারেন না। আপনার পাঠক সীমিত আপনার লেখার জায়গাতাও সীমিত। তাই লিখতে গেলে একটু মান সম্মতই লিখতে হবে। আর আজকের এই সস্তা জনপ্রিয়তার অত্যাচারে সাহিত্যের জায়গা টা দখল করে নিচ্ছে ইংরেজী শিক্ষার বই, ফ্রি ল্যান্সিং শিক্ষার বই, মোটিভেশনার স্পিকারের ফেসবুক স্ট্যাটাস সমগ্র এবং সর্বোপরি কিছু সস্তা দরের লেখকের হুমায়নীয় কপি এবং পেস্ট। তাই বলছি হে ব্লগার, হে পুরোনো বন্ধু "কালের যাত্রার ধ্বনি শুনিতে কি পাও। জাগাইছে অন্তরীক্ষে হৃদয়স্পন্দন, চক্রে-পিষ্ট আঁধারের বক্ষ-ফাটা তারার ক্রন্দন"
"এবার ফিরাও মোরে"
এই পরিস্থিতি চলছে, এর বিস্তৃতি আরো বাড়বে। কিন্তু এর জন্য চাই সম্মিলিত প্রতিবাদ প্রতিরোধ। আর প্রতিরোধের জন্য দরকার প্রচুর আন্দোলন। অবশ্যই রাজপথে নয়। কারণ আমরা রাজপথের সৈনিক নই। ঐ মাঠের পাকা খেলোয়াড়ের সাথে লড়তে গেলে যে বাহুবল আমাদের দরকার তার শিকিভাগ ও আমাদের নেই। আমাদের হাতে যা আছে তা হলো কলম কিবোর্ড। ২০০৯ সালে যে ব্লগারেরা কিবোর্ডের যুদ্ধে প্রশ্ন করেছিলো বিডিআর বিদ্রোহের নেপথ্যের গল্প জানার জন্য, তারা কি মরে গেছেন? তারা কি প্রশ্ন তুলতে পারেন না এই গণতন্ত্রের হত্যার বিরুদ্ধে? এই সাহিত্যের নামে চলা ফটকাবাজির বিরুদ্ধে! এই কর্পোরেট দুনিয়ার সবকিছু শুষে নেবার ইচ্ছের বিরুদ্ধে?
আমি জানি না। আমার জানা নেই। সত্যিই আমার জানা নেই। কিন্তু এটা জানি আমাদের ব্লগ নামের জংধরা অস্ত্রাগারে এখনো দুই একটি শান দেয়া তীর রয়েছে। আমরা এখনো আবার লিখতে পারি। সাহিত্য ও রাজনীতি বৃত্তিক সাহিত্যের হাত ধরে প্রতিবাদ করতে পারি চলমান পরিস্থিতির। বলতে পারি হে মহাবিশ্ব 'এবার ফিরাও মোরে' এই ধ্বংসের দ্বার প্রান্ত থেকে। ভবিষ্যত কি হবে জানি না। কে পড়বেন জানি না। তবে আবার লিখতে হবে। প্রতিবাদ করতে হবে বেনিয়াদের বিরুদ্ধে।
আসুন আবার ফিরিয়ে আনি ব্লগ আন্দোলন। আওয়াজ তুলি। ছোট মাছের ঝাঁক আওয়াজ তুলুক। আবার ঝড় আসুক। গণতন্ত্র, সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠা হোক
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই জুন, ২০২১ ভোর ৪:৪৬