১৯৭৩ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান ঘোষণা দিয়েছিলেন-‘নকশাল দেখা মাত্র গুলি করা হবে।’ তার এ ঘোষণার পর মজলুম জননেতা মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী শেখ মুজিবকে উদ্দেশ করে বলেছিলেন-‘মজিবর, নকশাল কারো গায়ে লেখা থাকেনা। কাকে গুলি করবা তুমি?’ সে সময় ওই ঘোষণার জন্য শেখ মুজিবুর রহমান ব্যাপকভাবে সমালোচিত হয়েছিলেন।
দীর্ঘদিন পর মরহুম শেখ মুজিবুর রহমানের সেই দম্ভোক্তির প্রতিধ্বনি শোনা গেলো একজন পুলিশ কর্মকর্তার কণ্ঠে। গত ২৮ জানুয়ারি সকালে রাজধানীতে জামায়াতে ইসলামীর হঠাৎ মিছিল, সে মিছিলের শুরুতেই পুলিশের হামলা, গাড়ি ভাংচুর, পুলিশের গাড়িতে আগুন, শিবিরকর্মীদের পুলিশকে প্রহার, পুলিশের গুলি বর্ষণ ইত্যাদি ঘটনার পর ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার বেনজীর আহমেদ এই বলে হুংকার দিয়েছেন যে, জামায়াত-শিবির দেখা মাত্র গুলি করা হবে। বেনজীর আহমদের এই নজির বিহীন ঘোষণার পর সর্বত্র নিন্দা-সমালোচনার ঝড় উঠেছে। বিবেকবান মানুষেরা প্রশ্ন তুলেছেন,প্রজাতন্ত্রের একজন কর্মকর্তা হয়ে এ ধরণের স্বৈরতান্ত্রিক ঘোষণা দেয়ার আইনগত কোনো অধিকার তার আছে কী না।
কেন ডিএমপি কমিশনার হঠাৎ এতোটা উত্তেজিত হয়ে উঠলেন এ প্রশ্ন উঠেছে বিভিন্ন মহলে। এটা ঠিক যে, রাজধানী ঢাকার আইন-শৃংখলা রক্ষার দায়-দায়িত্ব ডিএমপি কমিশনারের। সে হিসেবে কোনো বিশৃংখলা কিংবা জননিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়ার মতো ঘটনা ঘটলে বা ঘটার আশঙ্কা দেখা দিলে তিনি প্রয়োজনীয় আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার অধিকার সংরক্ষণ করেন। যে কাউকে আটক কিংবা গ্রেফতার করার আইনগত ক্ষমতাও তার আছে। কিন্তু দেশের একটি বৈধ রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীদের দেখা মাত্র গুলি করার নির্দেশ দেয়ার ক্ষমতা তাকে কে দিলো, এ প্রশ্ন সঙ্গত কারনেই উঠছে।
২৮ জানুয়ারি ঢাকার মতিঝিল থেকে বাংলা মোটর পর্যন্তযেসব ঘটনা ঘটেছে, প্রত্যক্ষদর্শীদের কাছ থেকে তার বিবরণ পাওয়া গেছে। সকাল সাড়ে দশটার দিকে মতিঝিলের শাপলা চত্ত্বর এলাকা থেকে জামায়াত-শিবির কর্মীরা মিছিল শুরু করে। প্রথমে মিছিলটি ছিল শান্তিপূর্ণ। মাত্র কয়েক মিনিটের মধ্যে পুলিশ ঝাঁপিয়ে পড়ে মিছিলে ওপর। বেঁধে যায় সংঘর্ষ। দ্রুত তা ছড়িয়ে পড়ে গুলিস্তান, প্রেস ক্লাব, হাইকোর্ট, শাহবাগ এমনকি বাংলা মোটর পর্যন্ত। প্রত্যক্ষদর্শীরা আরো জানিয়েছেন, এসব এলাকার বিভিন্ন রাস্তায় পুলিশের রায়টকার থেকে অনবরত গুলি চালানো হয়েছে। ছোড়া হয়েছে টিয়ার শেল। পুলিশের আক্রমণে ক্ষুব্ধ শিবির কর্মীরাও সহিংস হয়ে ওঠে। তারা গাড়ি ভাংচুর এবং একটি পুলিশ ভ্যানে আগুণ ধরিয়ে দেয়।
এখানে লক্ষণীয় হলো-জামায়াত-শিবিরের মিছিলটি ছিল শান্তিপূর্ণ। কিন্তু পুলিশ আক্রমণ করার পরই তা সহিংস হয়ে ওঠে। পুলিশ যদি মিছিলে বাধা না দিতো, আক্রমণ না করতো তাহলে জামায়াত কর্মীরা হয়তো সহিংসতার দিকে নাও যেতো না। কিন্তু এক্ষেত্রে এটা প্রতীয়মান হয় যে, জামায়াত কর্মীরা যাতে রাজপথে বিশৃংখলা সৃষ্টি করে সহিংসতায় লিপ্ত হয়, সেজন্য তাদেরকে উত্যক্ত করা হয়েছে। পুলিশী হামলা তাদেরকে প্ররোচিত করেছে বিশৃংখলা সৃষ্টিতে। তাছাড়া জামায়াত-শিবিরের মিছিলকে ছত্রভঙ্গ করার নামে বায়টকার থেকে যেভাবে অনবরত গুলি ও টিয়ার শেল নিক্ষেপ করা হয়েছে তাতে মনে হয়েছে, দেশে বোধকরি ভয়াবহ কোনো যুদ্ধ বেঁধে গেছে। বলাটা অযৌক্তিক হবে না যে, পুলিশের অতি উৎসাহী কর্মকান্ডই সেদিনের সহিংস ঘটনার জন্য দায়ি।
এই মেয়াদে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করার পর দেশের বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর গণতান্ত্রিক অধিকার বহুলাংশে খর্ব হয়েছে। সরকারবিরোধী রাজনৈতিক কর্মসূচীতে অহেতুক বাধা সৃষ্টি করে পরিস্থতিকে জটিল করা হয়েছে। হরতাল ডাকলে প্রধান বিরোধী দল বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয় পুলিশ অবরুদ্ধ করে রাখছে। নেতা-কর্মীদের রাস্তায় বের হতেই দেয়না। সরকারের এ আচরণ যে কোনোভাবেই গণতন্ত্র সম্মত নয়, সে বিষয়ে সবাই একমত। একটি সরকার, যারা নিজেদেরকে নির্বাচিত ও গণতান্ত্রিক বলে দাবি করে, তারা এ ধরণের স্বৈরতান্ত্রিক আচরণ কীভাবে করে এ প্রশ্ন সবার।
জাময়াতে ইসলামী দেশের একটি বৈধ ও নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল। সংবিধান সম্মত এবং দেশের স্বার্থ পরিপন্থী না হলে যেকোনো রাজনৈতিক কর্মসূচী পালনের অধিকার দলটির রয়েছে। কোনো ইস্যুতে নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের অধিকারও তাদের আছে। তাহলে কেন তাদের কর্মীরা মিছিল শুরু করলেই পুলিশ ঝাঁপিয়ে পড়ছে ? কেন তাদের সাংবিধানিক অধিকার খর্ব করা হচ্ছে? দেশের রাজনৈতিক পরিবেশ-পরিস্থতি সুস্থ ও স্থিতিশীল রাখার ক্ষেত্রে সরকারের ভূমিকাই মূখ্য। সরকার যদি গণতন্ত্রকে সঠিকভাবে চলতে দেয়, রাজনৈতিক দলগুলো যদি নির্বিঘ্নে তাদের কর্মসূচী পালন করতে পারে, তাহলে পরিস্থিতি সাংঘর্ষিক হওয়ার কোনো আশংকা থাকে না।
কিন্তু লক্ষ্য করা যাচ্ছে, সরকার পায়ে পা দিয়ে ঝগড়া বাঁধানোর ন্যায় বিরোধী দলগুলোকে সহিংসতার দিকে ঠেলে দেয়ার চেষ্টা করেছে। সরকারের আচরণ ও ‘দায়িত্বশীল’ ব্যক্তিদের কথাবার্তায় বিষয়টি প্রতিভাত হয়ে উঠায় প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, এ ধরণের অপরিনামদর্শী কাজ সরকার কেন করছে। তাহলে কি কোনো মহল মাছ শিকারের জন্য পানি ঘোলা করার চেষ্টা করছে? আর সে পানি ঘোলা করার দায়িত্ব ডিএমপি কমিশনার বেনজীর আহমেদের মতো কতিপয় অতি উৎসাহী ব্যক্তি পেয়েছেন ?
বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ্য করা যচ্ছে যে, বেনজীর আহমেদ তার এখতিয়ার বর্হিভূত ও বেআইনী একটি ঘোষণা দিলেও সরকার এখনো তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। এ থেকে এটা অনুমান করা যায় যে, বেনজীর আহমেদের কথাবার্তা, কাজকর্মের প্রতি সরকারের উর্ধ্বতন মহলের অনুমোদন রয়েছে। বলা বাহুল্য, প্রজাতন্ত্রের একজন কর্মকর্তার মানুষ হত্যার এমন ঘোষণা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক এবং দেশ যে এখন ‘পুলিশি রাষ্ট্রে’ পরিণত হয়েছে তারও প্রমাণ।
ডিএমপি কমিশনারের হুঙ্কার দেশবাসীকে শঙ্কিত না করে পারে না। কেননা, শান্তি শৃংখলা রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত বাহিনী যদি প্রাণসংহারি ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়, তাহলে শান্তি-স্থিতিশীলতা উধাও হওয়ার পাশপাশি ভয়াবহ দুর্যোগ দেশকে ঘিরে ধরতে পারে। ডিএমপি কমিশনার বেনজীর আহমেদের জামায়াত-শিবির দেখামাত্র গুলি করার ঘোষণায় যারা আনন্দিত-উচ্ছ্বসিত এবং যারা এই অতি উৎসাহী পুলিশ কর্মকর্তাকে প্রশ্রয় দিচ্ছেন, তারা নিজেদের জন্যই গভীর কুয়া খনন করে রাখছেন বলে অনেকে মন্তব্য করছেন। স্মরণ রাখা দরকার, এ ধরণের কর্মকর্তারা রাষ্ট্র বা সরকারের ‘সম্পদ’ নয়, বরং শেষ হিসেবে ‘দায়’ হিসেবেই চিহ্নিত হয়। আর সে দায় পুরোটাই বহন করতে হয় এ ধরণের লোকদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দানকারীদের।
সূত্র ও কৃতজ্ঞতায়:http://www.justnewsbd.com/index.php