শুভ্র কাকাতুয়াকে বুকে পেয়ে আনন্দের আতিশয্যে? নাকি বসন্তের আগমনে কচিপাতার উপস্থিতিতে, অশ্বথ গাছটি অমন রক্তিম হয়েছিল, জানা নেই। তবে এটুকু জানা, কাকাতুয়ার আগমণে অশ্বথের পাতারা আর কচি থাকে না। তারা গাঢ় সবুজ বর্ণ ধারণ করে। আর আশ্রয়ের নিশান হয়ে জানান দেয় কাকাতুয়াকে। “নির্ভার থাকতে পারো”।
অশ্বথ প্রজাতির বট নাকি রাতেও অক্সিজেন দেয়। বাংলাতে এর নামের প্রতিশব্দ ছায়াতরু। ছায়াতরুই বটে! নামের পূর্ণ প্রতিফলন কাজে!
দিন যায়। মাস যায়। পৃথিবীও গতিশীল। কিন্তু অশ্বথ কাকাতুয়াকে বুকে নিয়ে ঠাই দাঁড়িয়ে থাকে। ঝড়ে, নড়ে না। বৃষ্টিতে দমে না। রোদে? অশ্বথ এক আকাশ মেঘ হয়ে থাকে কাকাতুয়ার উপরে। অশ্বথের বড় আদুরে, কাকাতুয়া।
স্নেহের দোলায় দুলে আর মমতার স্রোতে ভেসে ভেসে ,এক সুখের সমুদ্রে কাকাতুয়া নিজেকে আবিষ্কার করে।
সুন্দর এক পরিণতি নিয়ে গল্পের সমাপ্তি এখানেই হতে পারত। কিন্তু নাহ। এখানে গল্পের শুরু।
প্রকৃতির অব্যর্থ নিয়মে কাকাতুয়া আর কাকাতুয়া থাকতে পারে না। সে হতে থাকে কামিনী ফুল। অন্তরে মাধুরী আর বাহিরে অপূর্ব শোভা নিয়ে গহন অন্তঃপুরে গড়ে কোন এক প্রছন্ন মূর্তি। অবশ্য দেবতার মূর্তি পূজারীই গড়ে। একটা ফুল জীবনে কামিনী বেশি কিছু চায়নি কিন্তু। শুধু মমত্ব আর আত্তিতে বাধানো একটা বেদি চেয়েছে। প্রবল সুষমা নিয়ে যার আশ্রয়ে ঝরে পড়তে পারে। যে বেদিতে অর্ঘ্য হতে পারে তার পুরো কামিনী জীবন।
সময়ের ইশারায় জীবনের রাস্তায় বাঁক আসে। নিয়তি মাফিক জীবনের গতি বদলও হয়ে যায়। এ তো নতুন কোন ঘটনা নয়।
দক্ষিণ সমীরণের গায়ে সুবাসিত পর্দা দিয়ে যখন জ্যোৎস্নার নির্জনতায় শুভ্রতার ওড়াউড়ি। ঠিক তখন কামিনীর ফুল সত্তার স্থিতি ঘটে বলে ধরে নেওয়া যায়।
সৌরভময়ী সে কামিনী ফুলের মাদকতায় এক শান্ত বালক আসক্ত হয়ে পড়ে। দিন গিয়ে রাতে লুকায়। রাত অদৃশ্য হয় ভোরে। কিন্তু বালকের আসক্তি কাটে না। তবে আসক্তিতে মত্তও হয় না বালক। তার মুখে বিরাজ করে শান্ত সকাল, আর বুকে তোলপাড় ঝড়! ভাবনার চাকাও ঘুরতে ঘুরতে একসময় অবসন্ন হয়। সে চাকাকে সিদ্ধান্তে দাঁড়াতে হয়। বালকের ভাবনার ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম ঘটে না । সেও সিদ্ধান্তে পৌঁছায়। সে কামিনীর সুবাসে সুবাসিত হতে চায়। সারাজীবন।
সুন্দর পরিণতি নিয়ে গল্পের সমাপ্তি এখানেও হতে পারত। কিন্তু নাহ। গল্প এখনও বাকী।
মানুষ হল দুঃখপ্রিয় প্রাণী। মানব মনের শিরা উপশিরায় দুঃখই প্রবাহিত হয়। সেখানে যদি হয় সুখের আধিক্য! তবে তা ভারসাম্যহীনতার আরেক নাম।
বালক ফুলের সুবাসে না মেতে, তাতে কীট খুঁজতে থাকে। কোথায় আছে এবং কোথায় থাকতে চায় এর পার্থক্য মানুষ সাধারণত নির্দেশ করতে পারে না। অথবা এই থাকতে চাওয়ার রূপ বদল হয় প্রতিনিয়ত। “ইট ইজ প্লে ফর ইউ বাট ডেথ ফর আস” নীতিবাক্যটি যে গল্প থেকে এসেছে সেই গল্পের বালকদেরর মত নির্মম খেলায় মাতে সে বালক। নিষ্ঠুর আঘাতে আঘাতে অভিমানী কামিনী ঝরে পড়ে একদিন মাটিতে।
তারপর? তারপর,
ঝরে পড়া কামিনী ফুল থেকে বেঁচে ওঠে এক কাক। অভিমান আর বিষাদে উন্মাদ কাক, কা কা শব্দ করে আর্তনাদ করে আর অবর্জনা ঘাটে। গত ফুল জন্মের সুরভীতে যে সুশীল গোত্র উদাসীন ছিল। এক কা কা শব্দে সকলে আগ্রহী হয়। দৃষ্টি দেয় কাকের প্রতি। সে ছিল নিন্দুকের দৃষ্টি। নিন্দার তীর আসে, “তবে কামিনীর মাঝে কাক লুকিয়ে ছিল এতদিন! কাক একটা কুৎসিত পাখি”!
এই হয়ত নিয়ম। সুশ্রী এর চেয়ে শ্রীহীনতা সমাজকে বেশি আকর্ষণ করে। সভ্যতার অলি গলি ঘুরে কাক শুধু অন্ধকার হাতে নিয়ে ফিরে আসে। কাকের মগজ থেকে হতাশাও পালিয়ে যায়। সেখানে অবশিষ্ট থাকে শুধু ক্লান্তি। কাক ঝিমায় আর কা কা করে।
নিয়তি হয়ত কাককে নিরীক্ষণ করে আর অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে। কাকের গলাও বিরোধিতা করে তার। শব্দ বের হয় না কোন। দূরন্ত বালকের মূর্তি স্মৃতিপটে ভাসে। বাস্তবতার পাশবিকতা সম্পর্কে পূর্ণ জ্ঞানার্জন করে কাক একদিন কুলিতে পরিণত হয়।
নিন্দার বস্তা আর অভিযোগের বাক্স সে দক্ষ কুলির মত বইতে থাকে। মোট বইতে বইতে তার নিহত আবেগরাও মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। জিজ্ঞেস করে। এ কোন সাধনার ফল?
সূর্য আর মেঘের খেলায়। একদিন মেঘ হেরে যায়। সময়ের ঘূর্ণনে, সেই কুলি থেকে কান্তা নামের একটি মেয়ের জন্ম হয়।
তবে, বাতিঘরে কোন বাতি জ্বলে না। আকাশ থেকে খসে পড়ে না কোন তারা, ইচ্ছা পূরণের পতাকা নিয়ে। অতটা চায়নি কান্তা। শুধু কামনা করত আধার ঘরে একটা মায়ার প্রদীপ অন্তত সলজ্জ ভঙ্গিমা নিয়েই জ্বলতে থাকুক।
ওর দগ্ধ চোখে কখনও ঘুম নামে না। হয়ত তাতে ঘোর ভর করে। অথবা সে চোখ অপলক সন্ধ্যাতারা হয়ে জ্বলে।
রাতের পিছু নিয়ে কান্তার চোখে স্বপ্ন আসে। বালকের মুখচ্ছবি ভাসে। ধীরেধীরে আধার ঘরে পুরোপুরি আবির্ভাব হয় তার।
বর্ণিল ঘোর আর বাস্তবের মিলন রেখায় কান্তা অস্পষ্ট কিছু মুহুর্ত ব্যয় করে। কান্তা স্পষ্ট দেখে দশটি সাদা গোলাপ নিয়ে, হাত বাড়িয়ে আছে সে বালক। কান্তাও হাত বাড়ায়।
এক ছটা আলো যেন কোলাহল করে ওঠে। প্রত্যাশা আর পূর্ণতার বদ্ধ দুয়ার হয়ত খুলে যায়।
মুহূর্ত ব্যয়ে কান্তা ভীষণ মিতব্যয়ী হয়ে ওঠে। দগ্ধ চোখ জোড়া নিষ্কম্প হয়ে বুজে থাকে মেলে যাওয়ার ভয়ে।
হঠাৎ ভোরের কল্লোল কানে আসে। মুহুর্তটাকে সে বন্দী করতে পারে না। শিশির পতনের চেয়ে মৃদু লয়ে কান্তার ঘোর কেটে যায়। বালকও অদৃশ্য হয়।
বিষণ্ণতারও প্রাণ আছে। সেও ক্লান্ত হয়। দীর্ঘ সময়ের জন্য জিরিয়ে নিতে পারে কোন মানুষের মনে। তখন হয়ত জিরিয়েছিল কান্তার মনে।
খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে কান্তা। গভীর বিষাদ অথবা বিদ্রুপে। হাতে একপাতা শুভ্র ঘুমের ওষুধ পেয়ে!
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৮ বিকাল ৪:১৬