এই প্রমত্তা নদীটাকে বুকের মাঝে কিভাবে যে লুকিয়ে রাখি! হৃদয়ের দুকূলে উচ্ছ্বসিত ঢেউগুলোর অবিরাম আছড়ে পড়া। এ এক মধুর পীড়ন !
পৃথিবীর সবচেয়ে ক্লান্তিকর মানসিক কাজ নাকি অপেক্ষা করা?
আমার উপলব্ধিতে তো সেই ক্লান্তিটা একেবারে অদৃশ্য।
একে যদি বলি আসক্তি, ভুল নেয়। যদি বলি উন্মাদনা অশুদ্ধ হবে না।
যদি বলি ছেলেমানুষী,
-আশ্চর্য!! মনের বয়স কি বছর গুণে বাড়ে?
যেদিন জাপানের হিরোশিমাতে এটোম বোমার বিস্ফোরণ হয়। ঠিক তার ৬৫ বছর পর একই দিনে আমার হৃদয়েও একটা এটোম বোমার বিস্ফোরণ ঘটে। আমার পৃথিবী বদলে যায়। একটা অপেক্ষার জপমালা আমার হাতে এসে পড়ে। আর আমি জপতে থাকি এক একটা অপেক্ষার প্রহর। অনন্ত অপেক্ষা, বহু বর্ণের অপেক্ষা।
ও অনেক ভেবেছে। অনেকটা পথ পাড়ি দিয়েছে। তারপর এসেছে।
আমিও অনেক সয়েছি। বুকের ভেতর নিভৃত পাথরে খোদাই করেছি কখনো বর্ণিল, কখনো সাদাকালো স্মৃতি।
আমরা অনেক অপেক্ষা করেছি।
তারপর,
ভোরের রবি উদার হাতে আমাদের শরীরে যখন কিরণ ছিটিয়ে দেয়। আমরা আড়মোড়া ভাঙ্গি। মহৎ মাধুর্যময় একটা ছন্দ ওঠে, আমাদের ঘরে।
আমি ওকে বলি, “শোনো”
ও উত্তর দেয় “বলো”
আমি চেয়ে থাকি নিশ্চুপ, কিছু কথা বলব বলে। ও চেয়ে থাকে নিশ্চুপ, কিছু কথা শুনবে বলে।
পার্থিব ব্যস্ততায়, রৌদ্রের প্রখরতায় কিভাবে যেন সেই ছন্দের পতন হয়। অপার্থিব সম্পদ টুকু হাত ফসকে চলে যায়।
তারপর আমি অপেক্ষা করি। আমরা অপেক্ষা করি। নাগরিক কোলাহলে ছন্দটা দূরে চলে যায়! দূর থেকে বহুদূর!
আমাদের ঘরে, অলস দুপুরে, ভ্রমর আসে। মোহনীয়, মাতাল করা সুর তোলে। গুনগুন গুনগুন।
আমি ওকে বলি, “শোনো”
ও উত্তর দেয় “বলো”
সাংসারিকতায়, সামাজিকতায় সেই সুর কেটে যায়। ভ্রমর সভয়ে লুকিয়ে ফেলে প্রেম বিতরণী সুকোমল ডানা। ভ্রমরটাকে আর দেখি না।
তারপর আমি অপেক্ষা করি। আমরা অপেক্ষা করি সুর জোড়াবার। অনন্ত অপেক্ষা।
শুক্লা পক্ষের রাতে জানলার গরাদ বেয়ে জ্যোৎস্না নামে, আমাদের ঘরে। জ্যোৎস্নার ধমনী থেকে রূপালী কনিকাগুলো মর্মমূলে তীব্র ঢেউ তোলে। মুগ্ধতায় মুখর এক রঙিন পানসী ভাসিয়ে দেয় আমরা। মোহাবিষ্ট পালে হাওয়া দেয় সোনালী সময়।
বৈষয়িক সাফল্য ব্যর্থতা, স্বার্থোদ্বারের নানান কথকতার কর্কশ হস্তক্ষেপে হঠাৎ মোহভঙ্গ হয়। পাল ছিড়ে যায়। পানসী হারিয়ে যায় দূরে ।দূর থেকে বহুদূরে।
আমাদের মাঝখানে নিষ্পাপ, নিস্পন্দ একটা শূণ্যতা আসে।
এপার থেকে আমি ওকে বলি, “শোনো”
ওপার থেকে, ও উত্তর দেয় “বলো”
আমাদের কিছু বলা হয় না। কিভহু শোনা হয় না।
আমি সেই শূন্যতা পেরুতে চাই। আমরা সেই শূন্যতা পেরুতে চাই।
আমরা অপেক্ষা করি শূন্যতা পেরুবার। অপেক্ষা করি রঙিন পানসী ভাসাবার।
অনন্ত অপেক্ষা, বহু বর্ণের অপেক্ষা।