somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ত্রিশূল

০৫ ই অক্টোবর, ২০১৪ রাত ১২:১৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

দুপুর বেলা ভাত খেয়ে ঘুমিয়েছিলাম। ঘুম ভেঙ্গে দেখি তিনটা চুয়ান্ন বাজে। ভয়ে আমার হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে গেল। কোরবানীর ঈদের আগে আজকে আমাদের শেষ রিহার্সাল। সুবাস দা গতদিন চোখ লাল করে বলে দিয়েছে- শেষদিন যারা রিহার্সালে দেরি করে আসবে তাদের কে প্রোগ্রাম থেকে বাদ দেয়া হবে! ঈদের এক সপ্তাহ পরে পাবলিক লাইব্রেরী তে দল যে প্রোগাম নামাবে সেখানে তারা থাকবে না। পাবলিক লাইব্রেরী পর্যন্ত যেতে জোর পা চালিয়ে হাঁটলেও পঁচিশ মিনিট লাগে। রিহার্সালে পৌঁছানোর টাইম দেয়া আছে বিকাল সোয়া চার টায়।

যে হাফ শার্ট টা পরে শুয়েছিলাম সেটা জায়গায় জায়গায় কুঁচকে গেছে। সেটার নিচেই কোনমতে জিন্সের প্যান্ট টা পরে নিয়ে বাথরুমে ঢুকে একটু কুলি করে নিলাম, চোখে মুখে পানির ঝাপটা দিলাম। তারপর পাথরের মত ভারী পা টেনে টেনে আম্মার কাছে গেলাম। আম্মা শুকনা মুখে নাইলনের সোফার উপর বসে তসবি জপছে । নাইলনের সোফার এক কোনার নাইলন ছিঁড়ে যাবার কারনে সোফাটা বসার ঘর থেকে আব্বা আম্মার রুমে এনে রাখা হয়েছে। এরশাদ সরকার কোর্ট ডি সেন্ট্রিলাইজেশন না কি যেন একটা করেছে।এটা করার ফলে আব্বার মত যারা শহরের উকিল তাদের কেস টেস গুলো হঠাৎ করে সব গ্রামে চলে গেছে। আমরা আট ভাইবোনের পরিবার মধ্যবিত্ত থেকে হঠাৎ করে অসম্ভব গরিব হয়ে গেছি। আম্মার কাছে পাঁচ টাকা চাইতে গেলেও নিজেকে সাঙ্ঘাতিক অপরাধী লাগে। বুকের মধ্যে অসম্ভব ব্যথা হয়। আমি কোনমতে দাঁতে দাঁত চেপে আম্মাকে বললাম- আম্মা পাঁচ টা টাকা দেন! পাবলিক লাইব্রেরি তে যাব।

আম্মার হাতের তসবি থেমে গেছে। আম্মা আমার দিকে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। আমি স্পষ্ট বুঝতে পারছি আম্মার কাছে কোন টাকা নাই।
আমি চরম লজ্জার মাথা খেয়ে আচমকা বলে ফেললাম- আম্মা মাটির ব্যাঙ্কেও টাকা নাই?

আম্মা চাবি দিয়ে স্টিলের আলমারির তালা খুলছে। কঁকিয়ে উঠা তালা খোলার শব্দ টা শুনে আমার মনে হল তালাটা যেন আম্মার কলিজা। আর সামান্য কটা টাকার জন্য আমি সেটা খুবলে বের করে আনছি।

স্টিলের আলমারির ভেতর রাখা মাটির ব্যাঙ্ক থেকে অনেক কৌশলে বের করা চকচকে পাঁচ টাকার নোট টা আমার হাতে দিতে দিতে আম্মা অস্ফুট স্বরে বলল- ওখানে ত নাকি অনেক হিন্দু মেয়েটেয়ে আসে। গোনাহ হয় এরকম কিছু করিস না বাবা। দোজখের আগুন!

আমি আম্মার কথার জবাব না দিয়ে দৌড়ে বাসা থেকে বের হই। সবুঝ ঘাসে ঢাকা ছোট্ট উঠান পার হয়ে বের হবার গেট। ছোট্ট উঠানে আমাদের কোরবানির গরু টা ঘাস খাচ্ছে। গরু আমাদের একার না। আব্বা ব্যাঙ্ক থেকে সব টাকা তুলে অত্যন্ত লজ্জিত মুখ করে তুলনামূলক গরিব প্রতিবেশীদের থেকে সাত ভাগের দুই ভাগ জোগাড় করেছে। আমাদের উঠানের ঘাস গুলো নাকি ভাল সেজন্য ওরা গরু আমাদের উঠানে রাখতে দিয়েছে। বুকের হাড় বের হয়ে আসা গরুটার দিকে তাকিয়ে আমার বুকের ভেতর হঠাৎ ব্যাথায় মোচড় দিয়ে উঠল। ইস বেচারা এত রোগা না হয়ে যদি আরেকটু মোটাতাজা হত তাহলে নিশ্চয় ছবুর সদাগর বা ডিসি সাহেবের মত বড় লোকরা তাকে আট নয় হাজার টাকা দাম দিয়ে কিনে নিত। আমাদের মত গরিব রা চার হাজার টাকা দিয়ে হাট থেকে কিনে আনতে পারত না।

সকালে যখন হক স্যারের কাছে পড়তে গেছি তখন গরু নিয়ে কথা হচ্ছিল। সবাই নিজেদের নিজেদের গরুর দাম বলতেছিল। আমি হঠাৎ করেই গ্রামার বই খুলে খুব মনোযোগ দিয়ে পড়তে শুরু করেছিলাম! স্যার রুমে ঢুকাতে মনে মনে হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছিলাম।এবার নিশ্চয় গরুর আলোচনা বন্ধ হবে। কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে স্যার একজন একজন করে সবাই কে গরুর দাম জিজ্ঞেস করতে লাগলেন। আমার বুকের ভেতর হাতুড়ি পিটার শব্দ হচ্ছে। আমি মিথ্যে কথা বলার সাহস ও হারিয়ে ফেলেছি! আমার মুখে ‘গরুর দাম চার হাজার টাকা’ শুনে স্যার সবাই কে শুনিয়ে বললেন- চার হাজার টাকা! চার হাজার টাকায় ত আজকাল মরা গরু ও পাওয়া যায় না!

আমি স্যারের বেতন কখনোই সময়মত দিতে পারি না। স্যার সুযোগমত একহাত নিলেন।

রিকশা নিয়ে বাটার দোকানের সামনে আসতেই দূবার রিকশার চেন পড়ল। আমি জানি পাবলিক লাইব্রেরি পর্যন্ত যেতে যেতে আরো অন্তত দূ বার রিকশার চেন পড়বে। আমার পৌছতে দেরি হয়ে যাবে। কিন্তু চক্ষু লজ্জার কারনে আমি ঝট করে আরেকটা রিকশায় উঠে যেতে পারলাম না। কারন রিকশাওয়ালা রশিদ আমার পরিচিত। ছোটবেলায় রশিদের মা আমাদের বাসায় কাজ করত। রশিদ ও মায়ের সাথে আমাদের বাসাতেই থাকত। আমরা ভাইবোন রা রশিদ কে আমাদের সাথে মার্বেল খেলায় নিতাম।

রিহার্সাল রুমে ঢুকে দেখি সবাই রিহার্সালের জন্য দাঁড়িয়ে গেছে। প্রোগ্রামের কোরিওগ্রাফি র আইডিয়া কোয়েল ভাই এর। কোরিওগ্রাফিতে ছোট ছোট দৃশ্যকাব্যের সাহায্যে বাঙ্গালীর বড় বড় ধর্মীয় এবং সামাজিক অনুষ্ঠান যেমন ঈদের অনুষ্ঠান, দূর্গা পূজার অনুষ্ঠান, বিয়ের অনুষ্ঠান ইত্যাদি দেখানো হবে।

শুরুতেই দূর্গা পূজার সেট। হিমানী আমাদের গ্রুপের সবচেয়ে সুন্দর মেয়ে। হিমানী ত্রিশূল হাতে দূর্গা বেশে সবার মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে।হিমানীর দুই হাত। দশ ভুজা দূর্গার আরো আট টা হাতের জন্য হিমানীর পিছনে দাঁড়াবে আরো চার টা মেয়ে। তাদের চেহারা দেখা যাবে না। শুধু হাত দেখা যাবে।দৃশ্যকাব্যে আমার ভূমিকা অসুরের।ঢাক বেজে উঠলে আমি হিমানীর পায়ের নিচে গিয়ে শুয়ে পড়ব। হিমানী আমার বুকে বিঁধিয়ে দেবে ত্রিশূল!

মঞ্চে সব নির্ধারিত চরিত্রের সাথে একপাশে দেখি দুলাল দাঁড়িয়ে আছে। দুলাল আমাকে দেখেই দাঁত বের করে হাসল। আমি বুঝতে পারলাম দেরি করে আসার কারনে অসুর চরিত্র থেকে সুবাস দা আমাকে বাদ দিয়েছেন। আমার বদলে অসুর করবে দুলাল। ত্রিশূল হাতে দুর্গা বেশে দাঁড়িয়ে থাকা হিমানীর দিকে তাকিয়ে আমার মনে হল- যদি এমন কিছু একটা ঘটত, দুলাল এখুনি মরে যেত!

আমার মনের অবস্থা টের পেয়েই সম্ভবত দুলাল অতি উৎসাহী হয়ে সুবাস দার সামনেই হিমানীর পাশে দাঁড়ানো শিবানীর সাথে কি একটা রসিকতা করে বসল! সুবাস দা দুলাল কে কান ধরে মঞ্চ থেকে নামিয়ে দিলেন। আমি আবার অসুর চরিত্রে বহাল হলাম।

হিমানীর ত্রিশূল বুকে পেতে শুয়ে আছি। নাটকের রুল মেনেই আমি হিমানীর চোখে চোখে তাকিয়ে আছি।হিমানীর চোখের দরজা দিয়ে আমি হঠাৎ করে অতিক্রম করে ফেলেছি আমার সমস্ত পারিবারিক এবং সামাজিক শিক্ষার দেয়াল। আমার মনে হচ্ছে- এতদিন পর্যন্ত আমি পৃথিবীর নিয়ম কানুন যা যা জেনেছি সব ভুল! হিমানীর পরিচয় সে পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর মেয়ে এবং সব নিয়ম কে কাঁচকলা দেখিয়ে, সমস্ত বাঁধা ভেঙ্গে গুড়িয়ে দিয়ে হিমানী কে পাওয়া টাই হচ্ছে এই পৃথিবীর শুদ্ধতম নিয়ম!

রশিদ কে রিকশা ভাড়া তিন টাকা দিয়েও আমার কাছে আরো দূ টাকা ছিল। রিহার্সাল শেষ করে হেঁটে হেঁটে ফেরার সময় কানুর দোকান থেকে আমি একটা সিগারেট কিনে ফেললাম। কালকে কোরবানী’র ঈদ। আমি শুনেছি কোরবানী’র ঈদের আগের রাতে নাকি গরু স্বপ্ন দেখে যে তাকে কোরবানী দেয়া হচ্ছে। স্বপ্ন দেখে সে কান্না করে। আমাদের বেড়ার ঘরের পেছন দিকে র বারান্দায় রাতে গরু রাখা হবে। টিনের বেড়া থাকায় ওই জায়গাটা তুলনামূলক ভাবে নিরাপদ। গরু যাতে আরাম করে শুতে পারে সেজন্য আব্বা ওখানে খড় বিছিয়ে দিয়েছেন।ওদিকের বাথরুমের চল্লিশ ওয়াটের বাল্ব টাও সারারাত জ্বালানো থাকবে। আমি ঠিক করেছি আজকে সারা রাত ওখানে দাঁড়িয়ে থাকব। গরুকে যদি সত্যি সত্যি কান্না করতে দেখি তাহলে নিজেকে সামলানোর জন্য আমার সিগারেট টানা দরকার হবে। এখন খুব সামান্য কিছুতেও আমি নিজের মন কে সামলাতে পারি না। হিমানী কে দেখার পর থেকে আমার মনের সমস্ত কোমল বোধ গুলো জেগে উঠে আমার মনটাকে অসম্ভব দুর্বল করে দিয়েছে।
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই অক্টোবর, ২০১৪ রাত ১২:৫৩
৫টি মন্তব্য ৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

তোমাকে লিখলাম প্রিয়

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ০২ রা মে, ২০২৪ বিকাল ৫:০১


ছবি : নেট

আবার ফিরে আসি তোমাতে
আমার প্রকৃতি তুমি,
যার ভাঁজে আমার বসবাস,
প্রতিটি খাঁজে আমার নিশ্বাস,
আমার কবিতা তুমি,
যাকে বারবার পড়ি,
বারবার লিখি,
বারবার সাজাই নতুন ছন্দে,
অমিল গদ্যে, হাজার... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছাঁদ কুঠরির কাব্যঃ মিসড কল

লিখেছেন রানার ব্লগ, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ৯:৫৫



নতুন নতুন শহরে এলে মনে হয় প্রতি টি ছেলেরি এক টা প্রেম করতে ইচ্ছে হয় । এর পেছনের কারন যা আমার মনে হয় তা হলো, বাড়িতে মা, বোনের আদরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

হিটস্ট্রোক - লক্ষণ ও তাৎক্ষণিক করণীয়

লিখেছেন ঢাকার লোক, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:০৭

সাধারণত গরমে পরিশ্রম করার ফলে হিটস্ট্রোক হতে পারে। এতে দেহের তাপমাত্রা অতি দ্রুত বেড়ে ১০৪ ডিগ্রী ফারেনহাইট বা তারও বেশি হয়ে যেতে পারে।

হিটস্ট্রোক জরুরি চিকিৎসা প্রয়োজন। চিকিৎসা... ...বাকিটুকু পড়ুন

আল্লাহকে অবিশ্বাস করার সংগত কোন কারণ নাই

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:৪৩



সব কিছু এমনি এমনি হতে পারলে আল্লাহ এমনি এমনি হতে সমস্যা নাই। বীগ ব্যাং এ সব কিছু হতে পারলে আল্লাহও হতে পারেন। সব কিছুর প্রথম ঈশ্বর কণা হতে পারলে আল্লাহও... ...বাকিটুকু পড়ুন

যুক্তরাষ্ট্রে ইসরাইল বিরোধী প্রতিবাদ বিক্ষোভ

লিখেছেন হাসান কালবৈশাখী, ০৩ রা মে, ২০২৪ সকাল ৮:০২

গাজায় হামাস উচ্ছেদ অতি সন্নিকটে হওয়ায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নিউইয়র্ক ও লসএঞ্জেলসে কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পরেছিল। আস্তে আস্তে নিউ ইয়র্ক ও অন্যান্ন ইউনিভার্সিটিতে বিক্ষোভকারীরা রীতিমত তাঁবু টানিয়ে সেখানে অবস্থান নিয়েছিল।


... ...বাকিটুকু পড়ুন

×