somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

শিশুতোষ ছোটগল্প ''সর্দার ব্যাঙ''

১৫ ই নভেম্বর, ২০১৪ সন্ধ্যা ৬:১৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


এক
কুসুমপুর এলাকা জুড়ে বেশ কয়েকটি ছোটবড় পুকুর আছে। সবচেয়ে বড় পুকুরের নাম ‘ঠনঠনি’ পুকুর। এই পুকুরেই বাস করত ‘টিউটিউ’ ব্যাঙেরা। ‘ঠনঠনি’ নামটি অবশ্য পুকুরের মালিক অরবিন্দ তালুকদার রাখে নি, রেখেছে এলাকার দুষ্টু যুবকেরা। এই নামকরণের নেপথ্যে কারণও আছে। সে অনেক দিন আগের কথা। তখন এই এলাকার মধ্যে তিনিই ছিলেন সবার চেয়ে ধনী ব্যক্তি। এলাকার সকল অনুষ্ঠানেই তিনি প্রধান অতিথি থাকার চেষ্টা করতেন, কিন্তু কোন অনুষ্ঠানেই তিনি কোন প্রকার চাঁদা-টাদা দিতেন না। তিনি এমনই কঞ্জুস ছিলেন যে, ভিক্ষুক, হত দরিদ্র কিংবা প্রতিবন্দীদের কল্যানেও কখনো দুই চার টাকা খরচ করেছেন বলে শোনা যায় নি। নিজে সব সুবিধাই নিবে অথচ অন্যের বেলায় তিনি ঠনঠন বলে এলাকার দুষ্টু যুবকেরা তার নামকরই করে ফেলেছে ‘ঠনঠনি তালুকদার’। আর সে নামকরণের সূত্র ধরেই তার পুকুরের নামও রাখা হয়েছে ‘ঠনঠনি’ পুকুর!

এই পুকুর আয়তনে ছিল বেশ বড়। দীর্ঘকাল ধরে অযতœ আর অবহেলায় এই পুকুর শেওলা আর কুচুরিপানায় পরিপূর্ণ হয়ে গেছে। এই পুকুরেরই উত্তর দিকে বাস করত ’টিউটিউ’ ব্যাঙেরা। এরা যখন পুকুরে সাঁতার কাটত, তখন সকলেই একসাথে সাঁতার কাটত; আবার যখন ডাকাডাকি শুরু করত তখন সকলেই একসাথে ডাকত। তাদের সবার সাথেই ছিল গলায় গলায় ভাব। অরবিন্দ তালুকদার অন্যের বিপদে সহযোগিতার জন্য এগিয়ে না এলেও তারা কিন্তু একে অপরের বিপদে নিজের জীবন কুরবানি করতেও দ্বিধাবোধ করে না!
সেদিন ছিল খুব বৃষ্টি। টিউটিউ ব্যাঙের সর্দার গঞ্জ থেকে মাত্রই ফিরে এসেছে। সর্দারের আসার খবর শুনেই বাচ্চা ব্যাঙাচিরা লেংটি পড়ে দলবেঁধে এসেছে। মৃদু স্বরে সর্দারের স্তব মূলক ব্যাঙ্গীয় সঙ্গীত পরিবেশন করতে থাকে। সর্দার তো বুঝে ফেললেন বাচ্চারা কী চাচ্ছে। এরপর আর দেরি করলেন না। নিজের ঝুলা থেকে গঞ্জ থেকে আনা মিষ্টি বের করে দিলেন। গঞ্জের মিষ্টি পেয়ে তারা খুশিতে বাকবাকুম করতে করতে চলে গেল।

অরবিন্দের ছেলে টুকুর সাথে সর্দার ব্যাঙের ছিল বেশ ভাব। টুকু সর্দার ব্যাঙকে কাছে ডাকতইে সে তার কাছে ছুটে যেত। তারপর দুজনে ইচ্ছে মতো খেলত। টুকু আজ সকালে ঘুম থেকে ওঠেই সর্দারকে বলল- সর্দার কাল আমার জন্মদিন। তোমার সকল সদস্যদের নিমন্ত্রন রইল। সর্দার তো মহা খুশি। খুশিতে কয়েক লাফেই চলে গেল নিজের বাড়িতে। ছোট-বড় সকলকেই ডেকে জড়ো করে বললেন- কাল আমার দুপেয়ে বন্ধু টুকুর জন্মদিন। সেখানে তোমাদের সকলের নিমন্ত্রন। ভাল ভাল কাপড়-চোপড় পড়ে তোমরা সেখানে যাবে। সেই সাথে ছোট ব্যাঙাচিদের সাবধান করে দিলেন- যাতে করে কেউ সেখানে ল্যাঙটা হয়ে না যায়!

সর্দারের কথা শেষ হওয়া মাত্রই তরুণ ব্যাঙেরা খুশিতে মৃদঙ্গ বাজাতে শুরু করলো। কেউ কেউ আবার সর্দারের নামে ছড়া কাটতে থাকে-
“সর্দারের বন্ধুর জন্মদিনে যাব
সবাই মিলে পোলাও খাব”।
গাইব মোরা টিউটিউ গান
জুড়াইয়া দিব টুকুর প্রাণ!

দুই
পরদিন। সকালবেলা। ব্যাঙ রমণীরা সেই সকাল থেকেই সাজগোজ শুরু করেছে। সর্দারের বন্ধুর জন্মদিন বলে কথা! একটু সাজগোজ না করে গেলেই যে নয়! অবিবাহিত তরুণী ব্যাঙেরা সেই যে সাত সকালে পার্লারে সাজগোজের জন্য বেরিয়েছে দুপুর হয়ে এল এখনো আসার নামগন্ধও নেই। সর্দার ব্যাঙ বিকেল ৪টার সময় সবাইকে জারুল তলায় একত্রিত হওয়ার জন্য নির্দেশ দিলেন। যেই কথা সেই কাজ। যথাসময়ে সকলেই হাজির হল।
মহাসমারোহে ব্যাঙ সর্দার চললেন বন্ধু টুকুর জন্মদিনে দাওয়াত খেতে। কিছুদূর যাওয়ার পর তারা হিজল তলায় বসে একটু জিরিয়ে নিল। মূলত প্রবীণ ব্যাঙেরা একটু জিরিয়ে নেওয়ার জন্য আবদার করেছিল। সর্দার বলে তাকে অনেক কিছুই মানতে হয়, বুঝতে হয়, বিবেচনা করতে হয়। অবশ্য সর্দার হিসেবে তার সেরকম সকল গুণই ছিল। টিউটিউ গোত্রভূক্ত সকল ব্যাঙই তাকে শ্রেষ্ঠ সর্দার হিসেবে মানত।

তারা যেখানে বিশ্রাম নিচ্ছিল তার একটু দূরেই টুকুর বাড়ি। বাড়িতে বেশ সাজসাজ রব। দলবেঁধে দুপেয়ে দৈত্যরা বাড়ির ভিতর প্রবেশ করছে। সর্দারের অবশ্য বাড়ির ভিতরে যাওয়ার অনুমতি নেই। তাদের নিমন্ত্রন জানানো হয়েছে শান বাঁধানো পুকুর ঘাটের দক্ষিণ ভিটিতে।

একটু পর সব টিউটিউ ব্যাঙেরা পুকুর ঘাটের দক্ষিণ ভিটিতে উপস্থিত হল। ব্যাঙাচিদের তখন ক্ষুধা যেন পেট চুচু করছে। তাদের যেন আর তর সইছে না। সবাই সর্দার ব্যাঙকে বলতে লাগলো- সর্দার, আর কত দেরি?
সবার চাপে পড়ে সর্দার লাফাতে লাফাতে বন্ধু টুকুর বাড়ির রাস্তায় গেল। যাওয়া মাত্রই দেখল টুকু আকাশের মত বড় বাটিতে করে যেন কী আনছে! টুকু সর্দারের সাথে কুশল বিনিময় করলো। তার সাথে হ্যান্ডসেকও করল।
টুকুর পাশেই ছিল তার আরেক বন্ধু জিকু। সে ছিল খুবই দুষ্টু। ব্যাঙদের দুই চক্ষে দেখতে পারতো না। টুকু ব্যাঙের সাথে হ্যান্ডসেক করেছে দেখে ঘৃণায় তার শরীর ঘিন ঘিন করছে। বন্ধুকে শিক্ষা না দিতে পারলেও ব্যাঙকে একটা উচিত শিক্ষা দেওয়া চাই-ই চাই। সে নিজের মধ্যে কি যেন একটা ফন্দি আঁটলো।

ব্যাঙের পথ ধরে টুকু ও জিকু দুজনেই গেল পুকুর ঘাটের দক্ষিণ ভিটিতে। সেখানে যাওয়া মাত্রই জিকুর চোখ যেন কপালে ওঠার মত অবস্থা। পুকুর ঘাটের দক্ষিণ ভিটি ছোটবড় কয়েক হাজার ব্যাঙে পরিপূর্ণ হয়ে গেছে। একসাথে এত ব্যাঙের উপস্থিতি তার জীবনেও দেখে নি। তাছাড়া টুকু ব্যাঙের সাথে বন্ধুত্ব রাখুক এটা সে কোনভাবেই মেনে নিতে পারছে না। কিন্তু তার মনের এই গোপন কথাটুকু সে প্রকাশ করল না। কেবল মনে মনে একটা দুরভিসন্ধি আঁটলো।
জিকুর হাতে অনেকগুলো গ্যাসের বেলুন ছিল। সেগুলো দেখতেও ছিল বেশ চকচকে। পড়ন্ত বিকেলে সূর্যেও আলোয় সে বেলুনগুলো যেন আরও আকর্ষণীয় হয়ে ওঠেছে। মুখে বেশ প্রসন্নতা এনে জিকু সর্দারকে বলল- এই বেলুনগুলো নিয়ে টুকুকে আশীর্বাদ কর। সাথে সাথে তোমার সদস্যদেরকেও বল আশীর্বাদ করতে। কী বলে আশীর্বাদ করতে হবে তাও বলে দিল সে। “হ্যাপি বার্থ ডে টুকু”। ইংরেজি শব্দ শুনে সব ব্যাঙেরা একে অপরের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করতে লাগলো। জিকু বুঝতে পারলো ইংরেজি তাদের মোটেও পছন্দনীয় নয়। এতে করে তার রাগের পরিমাণ আরও বেড়ে গেল, কিন্তু তা প্রকাশ করল না। তখন সে আরেকটু কৌশলী কণ্ঠে বলল- বল - “শুভ জন্মদিন টুকু”। এবার সব ব্যাঙ নড়েচড়ে বসল। সবাই সর্দারের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। সর্দার বলার সাথে সাথেই তারাও বলবে।
জিকু সর্দার ব্যাঙের হাতে বিশটি গ্যাস বেলুনের একত্রিত করা সুতা এগিয়ে দেয়। সর্দার ব্যাঙ সুতা ধরতেই জিকু বলে- দুহাত দিয়ে শক্ত করে ধর। সর্দার ব্যাঙ সরল চিত্তে তাই করলো। যেই না মাত্র সর্দার ব্যাঙ সুতাটি ধরেছে অমনিই বেলুনগুলো সর্দারকে নিয়ে আকাশের দিকে দিল ছুট। কিছুটা উপড়ে উঠতেই সর্দার ব্যাঙের মুখ ভয়ে পাঙশুটে হয়ে গেল। সর্দার ব্যাঙ সুতা ছাড়তে খুব চেষ্টা করল কিন্তু পারল না। সুতার মধ্যে খুব আঁঠালো জাতীয় কী যেন দেওয়া। এদিকে জিকু সব ব্যাঙদের বলতে থাকে- দ্যাখ, তোমাদের সর্দার জাদু জানে! জাদু বলে আকাশে ওড়ছে! উড়তে উড়তে সে স্বর্গের দিকে যাবে। প্রথম প্রথম সব ব্যাঙই বিশ্বাস করল। কিন্তু যতই সে উপরে উঠতে থাকে ততই যেন তারা ভয় পেতে থাকে। সর্দার ব্যাঙ উপর থেকে চিৎকার করতে থাকে। বাঁচাও! বাঁচাও!! বাঁচাও!!! তা শুনে জিকুর হাসি আর দেখে কে!

টুকু তার বাটির খাবারের তালা খুলতে খুলতেই এই কাণ্ডটি ঘটেছে। সর্দারের চিঁকার শুনে সে বাটি ফেলেই সে বেলুনটি ধরার জন্য লাফ দেয়। কিন্তু ততক্ষণে বেলুনসহ সর্দার ব্যাঙ অনেক উপরে ওঠে গেছে। ঠিকানাহীন উড়ন্ত সর্দারের দিকে তাকিয়ে টুকুর চোখ ছলছল করে ওঠে। অস্ফুট স্বরে বলে- মাফ করো বন্ধু, যেখানেই যাও, ভাল থেকো, ভালো থেকো।


----------------------
১৫.১১.২০১৪
মুনশি আলিম
জাফলং, সিলেট





০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আগামী নির্বাচন কি জাতিকে সাহায্য করবে, নাকি আরো বিপদের দিকে ঠেলে দিবে?

লিখেছেন জেন একাত্তর, ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৮:১২



আগামী নির্বচন জাতিকে আরো কমপ্লেক্স সমস্যার মাঝে ঠেলে দিবে; জাতির সমস্যাগুলো কঠিন থেকে কঠিনতর হবে। এই নির্বাচনটা মুলত করা হচ্ছে আমেরিকান দুতাবাসের প্রয়োজনে, আমাদের দেশের কি হবে, সেটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

ফেসবুক বিপ্লবে সেভেন সিস্টার্স দখল—গুগল ম্যাপ আপডেট বাকি

লিখেছেন মহিউদ্দিন হায়দার, ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৯:৩০




কিছু তথাকথিত “বাংলাদেশি বিপ্লবী” নাকি ঘোষণা দিয়েছে—ভারতের সেভেন সিস্টার্স বিচ্ছিন্ন করে ফেলবে! সহযোগী হিসেবে থাকবে বিচ্ছিন্নতাবাদী সন্ত্রাসী আর পাকিস্তানি স্বপ্ন।শুনে মনে হয়—ট্যাংক আসবে ইনবক্সে। ড্রোন নামবে লাইভ কমেন্টে। আর... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাঙ্গু এনালিস্ট কাম ইন্টারন্যাশনাল সাংবাদিক জুলকার নায়েরের মাস্টারক্লাস অবজারবেশন !

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ১৮ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:২৬

বাংলাদেশের দক্ষিণপন্থীদের দম আছে বলতে হয়! নির্বাচন ঠেকানোর প্রকল্পের গতি কিছুটা পিছিয়ে পড়তেই নতুন টার্গেট শনাক্ত করতে দেরি করেনি তারা। ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহ ঘিরে নতুন কর্মসূচি সাজাতে শুরু করেছে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ক্ষমতাচ্যুত ফ্যাসিবাদ: দিল্লির ছায়া থেকে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র

লিখেছেন কৃষ্ণচূড়া লাল রঙ, ১৮ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ ভোর ৫:৫৭

একটা সত্য আজ স্পষ্ট করে বলা দরকার—
শেখ হাসিনার আর কোনো ক্ষমতা নেই।
বাংলাদেশের মাটিতে সে রাজনৈতিকভাবে পরাজিত।

কিন্তু বিপদ এখানেই শেষ হয়নি।

ক্ষমতা হারিয়ে শেখ হাসিনা এখন ভারতে আশ্রয় নিয়ে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র... ...বাকিটুকু পড়ুন

Grameen Phone স্পষ্ট ভাবেই ভারত প্রেমী হয়ে উঠেছে

লিখেছেন অপলক , ১৮ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ২:৪৯



গত কয়েক মাসে GP বহু বাংলাদেশী অভিজ্ঞ কর্মীদের ছাটায় করেছে। GP র মেইন ব্রাঞ্চে প্রায় ১১৮০জন কর্মচারী আছেন যার ভেতরে ৭১৯ জন ভারতীয়। বলা যায়, GP এখন পুরোদস্তুর ভারতীয়।

কারনে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×