somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বোধের পাঠশালা : পর্ব : ৩

১৮ ই মার্চ, ২০২২ রাত ১১:১১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



২০০৪ সালের কথা। সবেমাত্র অনার্সে ভর্তি হয়েছি। ওরিয়েন্টেশন ক্লাসের পর প্রায় দীর্ঘ ছয়মাস পর নিয়মিত ক্লাস করার সুযোগ হয়েছিল। ছয়মাস বিসর্জনের গল্প আরেকদিন বলা যাবে। শহুরে জীবনে অভ্যস্ত হতে আমার তেমন একটা বেগ পেতে হয়নি। কেননা, সময়ের প্রেক্ষাপটে আমি মানিয়ে নিতেও এবং মেনে নিতেও জানি। প্রায় শতভাগই আমি টিউশনি নির্ভর ছিলাম। একবার এক শিল্পপতির ছেলেকে পড়ানোর অফার পেলাম। বয়স সাড়ে চার কি পাঁচ হবে। ছেলেটি ইংলিশ মিডিয়ামে পড়ে। চঞ্চল বা দুরন্ত কাকে বলে এই ছেলেকে না দেখলে আপনার ধারণাই পালটে যাবে।

এক মাসে ৮ থেকে ১০ বার শিক্ষক পরিবর্তন ঘটে। কোনো শিক্ষককেই সে পাত্তা দেয় না। কাজেই শঙ্কাটাকে মোটেও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। প্রথম দিন ছেলের মা হাসিমুখে কুশলাদি জিজ্ঞেস করার পর বললেন—কোনো শিক্ষকই তাকে বাগে আনতে পারে না। ছেলেটি পড়তে বসতে চায় না… ইত্যাদি। আমি তার অভিযোগগুলো খুব মনোযোগ দিয়ে শুনলাম। তারপর তাকে অভয় দিয়ে বললাম—আমাকে স্বাধীনতা দিতে হবে। আমি আমার মতো করে পড়াতে চাই। সপ্তাহখানেকের মধ্যে উন্নতি না করতে পারলে আমি নিজ থেকেই বিদায় নেব। বিষয়টা সত্যিই চ্যালেঞ্জিং!

যাইহোক, শিশু ছাত্রের সঙ্গে পরিচিত হলাম। পড়ার টেবিলে বসে তার সঙ্গে গল্প করছি। গল্পে গল্পে জেনে নিলাম তার কখন কী করতে ভালো লাগে। এই মুহূর্তে তার খেলতে ইচ্ছে করছে। আমি বললাম—কী খেলতে ইচ্ছে করছে? সে বললো—বল। আমি বললাম—ওকে। শুরু হলো বল খেলা। এই ফাঁকে ছাত্রের মা এসে একবার উঁকি দিয়ে দেখে গেল। খুব যে খুশি হয়নি তা তার মুখ দেখেই বুঝতে পেরেছিলাম। আমি খেলাচ্ছলে ছাত্রটিকে জিজ্ঞেস করলাম—আমরা কী খেলছি? সে বললো—বল। তোমার কি বল খেলতে খুব ভালো লাগে? —হ্যাঁ। ভীষণ ভালো লাগে। —তোমার বইয়ে কি বল আছে? —হ্যাঁ আছে। —একটু দেখাতে পারবে? —হ্যাঁ পারব। এই বলেই সে তার বই বের করল। ছবি দেখিয়ে বললো—এটা হলো বল। বলের নিচের শব্দটি দেখিয়ে বললাম—এই বর্ণগুলো কি চিনো? সে একটু থেমে গেল। আমি বললাম এটার নাম হলো ‘ব’ আর এটার নাম হলো ‘ল’। তুমি যদি একসাথে পড়ো তা হলে উচ্চারণ হয় ‘বল’। সে মুগ্ধ হয়ে শুনছে। বুঝলাম ম্যাথডে কাজ হচ্ছে।

ছাত্রটির পরনে সুপারম্যানের গেঞ্জি। বোঝার অপেক্ষা রাখে না সে সুপারম্যানকে খুব পছন্দ করে। আমি কলম নিয়ে তার খাতায় বড়ো করে ‘বল’ লিখলাম। তারপর তাকে সুপারম্যানের গল্প বললাম। সারাংশ হলো—সুপারম্যান সবকিছুই নিখুঁতভাবে করে। তারপর তাকে বললাম তুমি কি এই লেখার উপর দিয়ে এমনভাবে হাত ঘুরাতে পারবে যাতে কোনোটিই দাগের বাইরে না যায়? সে খুবই উৎফুল্ল হয়ে বলল। অবশ্যই পারব। আমি তার চোখেমুখে আত্মবিশ্বাসের ঝিলিক দেখতে পেলাম। অতপর একগাল হেসে বললাম—তাহলে দেখিয়ে দাও তো সুপারম্যান!

মুহূর্তেই সে শুরু করে দিল। তার কাজ দেখে সত্যিই আমি মুগ্ধ হলাম। আমি বললাম—তুমি কি এবার নিজ থেকে লিখতে পারবে?সুপারম্যানরা কিন্তু সব করতে পারে। সে আত্মবিশ্বাসের সাথে বললো—স্যার, আমিও পারব। বলেই সে একটানে ‘বল’ লিখে ফেলল। তার প্রতিটি বর্ণের ওপর দেওয়া মাত্রাগুলো ছিল খুবই পরিমিত। তার পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা আমাকে ভীষণভাবে মুগ্ধ করল। এভাবে ধীরে ধীরে তার সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব হয়ে গেল।

সে ড্রইং করতে খুবই পছন্দ করত। আমি তাকে একটি ‘মই’ এঁকে দিলাম। ছবির নিচে বড়ো করে লিখলাম—‘মই’। সূর্যোদয়ের ছবি এঁকে নিচে লিখে দিলাম ‘উষা’। সে দুটো শব্দই খুব মনোযোগ দিয়ে দেখল। তারপর সক্রেটেসীয় ভঙ্গিতে বললো—স্যার, তোমার দুটি বর্ণই ভুল হয়েছে। আমার চোখ তো তখন চড়ক গাছ! শিশু ছাত্র বলে কী! ছাত্রটি আমাকে তুমি করে বলায় খারাপের চেয়ে ভালোই বেশি লাগত। বিশেষ করে তার শুদ্ধ উচ্চারণগুলো আমার ভীষণ ভালোলাগত। বলতে দ্বিধা নেই, আমার শুদ্ধ ভাষা রপ্ত করার পেছনে সেও একাংশ প্রেরণা।

ছোটো ছেলে, বলতে গেলে প্রায় দুধের শিশু আর সে কিনা অনার্স পড়ুয়া স্যারের ভুল ধরে! তাও যে কিনা বাংলা বিষয় নিয়ে অনার্স করছে! আমি খুব বিস্মিত হয়ে বললাম—কোন বর্ণগুলো ভুল হয়েছে? সে তখন তার বই বের করল। বই বের করে ‘ই’ এবং ‘উ’ দেখাল। বর্ণের উপরের অংশটি (টিকি) মাত্রার একেবারে প্রায় শেষ অংশ থেকে শুরু করতে হয়। মধ্যভাগ থেকে নয়। আমি ভালো করে খেয়াল করলাম। হ্যাঁ, তাই তো।

আমি তো একেবারে থ হয়ে গেলাম। এই দুধের শিশু আমাকে যেভাবে ভুল ধরিয়ে দিল, বিশ্বাস করেন—আমার প্রাথমিক, মাধ্যমিক বা উচ্চমাধ্যমিকের কোনো শিক্ষকই এভাবে ভুল ধরেনি বা শুদ্ধরূপ শেখাননি। পথের পাঁচালী উপন্যাসের একেবারে শেষের দিকে চমৎকার একটি কথা আছে—"পথের দেবতা প্রসন্ন হাসিয়া বলেন—মূর্খ বালক, পথ তো আমার শেষ হয়নি তোমাদের গ্রামের বাঁশের বনে, ঠাঙাড়ে বীরু রায়ের বটতলায় কি ধলচিতের খেয়াঘাটের সীমানায়? […] পথ আমার তখনো ফুরোয় না… চলে… চলে… চলে… এগিয়েই চলে…”। অর্থাৎ পথের কি আর শেষ আছে? বিভূতিভূষণের এই আপ্ত বাক্যের মতো আমারও মাঝে মাঝে মনে হয় শেখার কি আর শেষ আছে?

বোধের পাঠশালা
১৭ই মার্চ ২০২২ খ্রিষ্টাব্দ
উপশহর, সিলেট
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই মার্চ, ২০২২ রাত ১১:১৭
২টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

এশিয়ান র‍্যাংকিং এ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান !!

লিখেছেন ঢাবিয়ান, ০৭ ই মে, ২০২৪ রাত ৮:২০

যুক্তরাজ্যভিত্তিক শিক্ষা সাময়িকী 'টাইমস হায়ার এডুকেশন' ২০২৪ সালে এশিয়ার সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকা প্রকাশ করেছে। এশিয়ার সেরা ৩০০ তালিকায় নেই দেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়।তালিকায় ভারতের ৪০, পাকিস্তানের ১২টি, মালয়েশিয়ার ১১টি বিশ্ববিদ্যালয়... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঢাকা শহর ইতিমধ্যে পচে গেছে।

লিখেছেন নাহল তরকারি, ০৭ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:৫৫



স্থান: গুলিস্থান, ঢাকা।

ঢাকার মধ্যে গুলিস্থান কোন লেভেলের নোংড়া সেটার বিবরন আপনাদের দেয়া লাগবে না। সেটা আপনারা জানেন। যেখানে সেখানে প্রসাবের গন্ধ। কোথাও কোথাও গু/পায়খানার গন্ধ। ড্রেন থেকে আসছে... ...বাকিটুকু পড়ুন

রাজত্ব আল্লাহ দিলে রাষ্ট্রে দ্বীন কায়েম আমাদেরকে করতে হবে কেন?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ০৮ ই মে, ২০২৪ ভোর ৬:০৬



সূরাঃ ৩ আলে-ইমরান, ২৬ নং আয়াতের অনুবাদ-
২৬। বল হে সার্বভৈৗম শক্তির (রাজত্বের) মালিক আল্লাহ! তুমি যাকে ইচ্ছা ক্ষমতা (রাজত্ব) প্রদান কর এবং যার থেকে ইচ্ছা ক্ষমতা (রাজত্ব) কেড়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তির কোরাস দল

লিখেছেন সেলিনা জাহান প্রিয়া, ০৮ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:২৫



ঘুমিয়ে যেও না !
দরজা বন্ধ করো না -
বিশ্বাস রাখো বিপ্লবীরা ফিরে আসবেই
বন্যা ঝড় তুফান , বজ্র কণ্ঠে কোরাস করে
একদিন তারা ঠিক ফিরবে তোমার শহরে।
-
হয়তো... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাইডেন ইহুদী চক্তান্ত থেকে বের হয়েছে, মনে হয়!

লিখেছেন সোনাগাজী, ০৮ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:৪৮



নেতানিয়াহু ও তার ওয়ার-ক্যাবিনেট বাইডেনকে ইরান আক্রমণের দিকে নিয়ে যাচ্ছিলো; বাইডেন সেই চক্রান্ত থেকে বের হয়েছে; ইহুদীরা ষড়যন্ত্রকারী, কিন্তু আমেরিকানরা বুদ্ধিমান। নেতানিয়াহু রাফাতে বোমা ফেলাতে, আজকে সকাল থেকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×