somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আমাদের একাকীত্ব

০৩ রা ফেব্রুয়ারি, ২০০৯ রাত ৩:৪৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


'আমাদের একাকীত্ব,' কথাটি স্ববিরোধী৷ 'একাকীত্ব' কখনও বহুবচন পদ 'আমাদের' হয় না৷ অথচ আমাদের রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় 'একাকীত্ব' নিয়েই 'আমাদের' স্ববিরোধী জীবনযাপন চলছে৷ তারই দৃষ্টান্ত, একটি ব্যক্তিগত বাস্তব ছোট্ট ঘটনা নিয়ে এই লেখা৷
ঈদুল ফিতরের আগের শুক্রবার৷ সকাল দশটার দিকে একজন হিতৈষী ডাক্তারকে ফোন করি৷ বলাবাহুল্য, চিকিত্‍সা পরামর্শের প্রয়োজনেই৷ কিন্তু ফোন ধরেই প্রয়োজনের কথাটা বলি কি করে? তাই জিজ্ঞেস করি, 'কেমন আছেন?' তিনি উত্তরে বললেন, 'আছি! খুব একটা ভাল নেই৷' তাঁর কণ্ঠ দুর্বল৷ আমি আগ্রহ দেখালাম৷ ভাল না-থাকার কারণ জানতে চাইলাম৷ যে-কারণটা বেরিয়ে এলো সেটা এরকম : তাঁর পুরোনো গাড়িটা দুদিন আগে চুরি হয়ে গেছে, অফিসের সামনে থেকে৷ প্রতিদিনকার অভ্যাসমত গাড়ি রেখে তিনি অফিসে ঢুকেছেন৷ কিছুণ পরে বেরিয়ে দেখেন গাড়ি নাই৷ পর্যাপ্ত সিকিউরিটি ছিল৷ অথচ কেউ কিছু বলতে পারে না৷
গাড়িটা পুরাতন৷ কিন্তু সেটা তাঁর বন্ধুর মতো৷ এটি ছিল বলেই তিনি তাঁর পেশাগত কাজের অতিরিক্ত কিছু পারিবারিক, সামাজিক কাজ স্বচ্ছন্দে করতে পারেন৷ সেজন্যই গাড়িটা কেনা৷ এই ডাক্তার ঢাকার একটি বড় হাসপাতালের চিকিত্‍সক৷ হাসপাতালটি দেশের শীর্ষস্থানীয় পাবলিক হাসপাতাল৷ দেশের উচ্চতম পর্যায়ের, একনম্বর পাবলিক মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়৷ এটি চিকিত্‍সক তৈরির অন্যতম কারখানাও বটে৷ আমার শুভাকাঙ্ী ডাক্তার এই প্রতিষ্ঠানের সহযোগী অধ্যাপক৷ প্রাইভেট প্র্যাকটিস করে বাড়তি উপার্জনও করেন৷ গাড়িটাও কিনেছেন এই বাড়তি উপার্জনের টাকায়৷
ছাত্র-পড়ানো, হাসপাতালে রোগীর চিকিত্‍সা, প্রাইভেট প্র্যাকটিস, এতো কিছু করেও তাঁর বিবেকদংশন কমে না, সন্তুষ্টি নাই৷ মনে করেন, কাজ করার মতো আরও কিছু অ-ব্যয়িত শক্তি তাঁর রয়েছে৷ সে-শক্তিকেই তিনি সমাজের কাজে ব্যয় করতে চান৷ সেজন্য গড়ে তুলেছেন চিকিত্‍সা বিষয়ক একটি সামাজিক সংগঠন, সমাজসেবা কেন্দ্র৷ মানুষকে সম্পৃক্ত করছেন৷ নিজে সেবা দিচ্ছেন৷ প্রতিনিয়ত মানুষকে উদ্বুদ্ধ করছেন তাঁর প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে অন্যকে সেবা দিতে৷ যে যেখানে অবসর আছে, যার মধ্যেই অ-ব্যয়িত শ্রম, শক্তি, অধ্যবসায়, এবং এ-বিষযে ঝোঁক ল্য করছেন তাকেই ধরে এনে কাজে লাগাচ্ছেন৷ নিজে খাটছেন৷ অন্যকে খাটাচ্ছেন৷ ঊদ্দেশ্য হলো, বিপর্যস্ত, অসহায় মানুষকে চিকিত্‍সা সহায়তা দেওয়া৷ পাশে দাঁড়ানো৷ এ সব কাজে তাঁর বন্ধু, একান্ত সহায়ক, সেই পুরানো গাড়ি৷ সেটাই চুরি হয়ে গেছে৷ তাই তাঁর কণ্ঠ পীড়িত৷ প্রকাশ করার ইচ্ছা নাই৷ তবু প্রকাশিত হয়ে যাচ্ছে৷
এই গাড়িতে আমিও চড়েছি৷ প্রায়ই চড়ি৷ নিজেই ড্রাইভ করেন৷ সযত্নে ড্রাইভ করে বাসার সামনে নামিয়ে দিয়েছেন, বহুদিন৷ নিজের যাত্রাপথ দীর্ঘায়িত করে আমাকে সুবিধা দিয়েছেন৷ শুধু আমাকে নয়, আমার মতো আরও অনেককে তিনি এরকম লিফ্ট দিয়েছেন৷ এটাও যেন তাঁর সেবারই অঙ্গ৷ তাই, গাড়িটি কেবল তাঁর নয়, হয়ে উঠেছিল আমাদেরও৷ হয়তো এজন্যই চুরি যাওয়ার সংবাদ শুনে তাত্‍ণিকভাবে মনে হলো, আমারও যেন একটা গাড়ি চুরি গিয়েছে৷ আমিও যেন আমার পথচলার সঙ্গী হারিয়েছি৷
ফোনের ওপারে তিনি, এপারে আমি৷ কীভাবে এগোবো বুঝতে পারলাম না৷ আমরা দুজনেই জানি, 'আমার পুরানো গাড়িটা চুরি হয়ে গেছে,' বাক্যটি যত সরল, ঘটনাটি তত নয়৷ এর সুদূরপ্রসারী প্রভাব রয়েছে৷ এই তি সহ্য করা এবং কাটিয়ে ওঠা খুব সহজসাধ্য ব্যাপার নয়, অন্তত তাঁর মতো একজন মানুষের প৷ে তাই, তাঁর ও আমার মুখে কথা ছিল না কয়েক সেকেণ্ড৷ একসময় জিজ্ঞেস করলাম 'খোঁজাখুজি করেছেন?' জানালেন দীর্ঘ বয়ানে, 'আমার যতটুকু করার ততটুকু করেছি৷ থানায় জিডি করেছি৷ এর চেয়ে বেশি করার মতা আমার নাই৷ অথচ আত্মীয়-স্বজনরা অনেক কিছুই করেছেন৷ পুলিশের বড়াকর্তা, র্যাব, এসবি, ইন্টেলিজেন্স, প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয়, কোনো জায়গায় বাদ নেই৷ কিন্তু ফল হয় নি৷ এই সময়ে [আগেই বলেছি, সময়টা ঈদুল ফিতরের আগে আগে] আমার মতো একজন ছোট্ট ডাক্তারের একটা গাড়ি চুরি যাবার মতো নগণ্য ঘটনায় মনোযোগ দেওয়ার সময় নিশ্চয়ই কারো হাতে নেই৷' থামলেন তিনি৷
'বিশেষত আমরা সবাই যখন আমাদের নিজেদের চুরি নিয়ে ব্যস্ত,' বললাম আমি৷ কথাটা আমার মুখ ফসকে বেরিয়ে গেল৷ বলতে চাই নি৷ এরপর তিনি আমার প্রয়োজনের কথা জিজ্ঞেস করলেন, জেনে নিয়ে পরামর্শ দিলেন৷ যখন ফোন ছাড়লাম তখনও তার কণ্ঠ দুর্বল৷ তাঁকে বড় বেশি একা, অসহায় এবং বিপর্যস্ত মনে হলো৷



এই ঘটনা সারাদিন ধরে আমার মনে নানা প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে চলে৷ বহু প্রশ্নের জন্ম দেয়৷ দোষটা কার? ডাক্তারের? তিনি কেন গাড়ি রেখে অফিসে গেলেন? কিন্তু, এ ছাড়া তাঁর কী-ই-বা করার ছিল৷ গাড়িতো আর স্ট্যাথোস্কোপ নয় যে, গলায় ঝুলিয়ে নেবেন৷ এ ছাড়া গাড়িটা রেখেছেন হাসপাতালের ভিতরে, নির্ধারিত জায়গায়৷ দেশের একনম্বর মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে নিশ্চয়ই সিকিউরিটি সিস্টেম আছে৷ এই সিস্টেম ভেঙ্গে কি করে চোর ঢুকলো? গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে গেল? আর, সবাই নির্বাক থাকলো? কিন্তু বাইরে? সেখানেওতো ন্যাশনাল সিকিউরিটি সিস্টেম রয়েছে৷ সরকারি প্রহরা৷ এজন্য সুনির্দিষ্টভাবে দায়িত্বপ্রাপ্ত বিভিন্ন বিভাগ৷ পুলিশ, র্যাব, কত কী৷ চুরি যাওয়ার পর ডাক্তার সাহেব থানায় জিডি করেছেন৷ তাঁর আত্মীয়স্বজন উচ্চতম পর্যায় পর্যন্ত আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে অবগত করেছেন৷ তবুও তাঁর কণ্ঠ বিমর্ষ কেন? তাঁকে অসহায় মনে হয় কেন? কেন তিনি মনে করেন, 'আমার মতো একজন ছোট্ট ডাক্তারের একটা গাড়ি চুরি যাবার মতো নগণ্য ঘটনায় মনোযোগ দেওয়ার সময় নিশ্চয়ই কারো হাতে নেই৷'
উচ্চারিত বাক্যটি তাঁর হতাশার প্রকাশ৷ এটি তাঁর একাকীত্ব এবং অসহায়ত্ব নির্দেশক৷ বোঝা যায়, তিনি নিজেকে উপেতি মনে করছেন৷ মনে করছেন, এই সংকটে কেউ তাঁর সঙ্গে নেই৷ আমার মনে হলো, যখন তাঁর গাড়ি ছিল তখন সকলেই তাঁর সঙ্গে ছিল৷ গাড়ির সাথে সম্পর্কিত সরকারের নানাবিধ সংস্থা, যেখানে তিনি গাড়ি নথিভুক্ত করেছেন৷ তাঁকে ড্রাইভিং লাইসেন্স নিতে হয়েছে, প্রতিবছর ফিটনেস সার্টিফিকেট নিতে হয়েছে, গাড়ির জন্য আয়কর দিতে হয়েছে, আরও কত কী করতে হয়েছে; এসব বিভাগকে সন্তুষ্ট করেই তিনি গাড়ি চালনার ছাড়পত্র নিয়েছেন৷ সরকারের সংশ্লিষ্ট প্রতিটি বিভাগ তাঁর নিকট থেকে অর্থ গ্রহণ করেছে৷ রাজস্ব খাতকে তিনি সমৃদ্ধ করেছেন৷ কিন্তু গাড়িটা চুরি হয়ে যাওয়ার সাথে সাথেই সবাই যেন তাঁকে ত্যাগ করেছে৷ তিনি একাকী হয়ে গেলেন৷
কিন্তু সরকারী বিভাগ কি করেছে? গাড়ি কি খুঁজে পেয়েছে, বা আদৌ খুঁজেছে? চোর ধরা পড়েছে? তাঁর তি কি পূরণ হয়েছে? বিশ্ববিদ্যালয়ের সিকিউরিটির দায়িত্বে যারা ছিল তাদের কি কারও চাকরি গেছে? মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপ তাঁর নিরাপত্তা কতটুকু নিশ্চিত করেছেন? তিনিতো সেখানেই তাঁর মেধা ও শ্রম ব্যয় করেন৷ সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থা এই সংকটের দিনে তাঁর পাশে কি দাঁড়িয়েছে? তিটা যে তাঁর একার নয়, বরং বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপরেও, সরকারের যেসব বিভাগকে তিনি সমৃদ্ধ করেছেন সেসব বিভাগেরও, তাঁরাও যে এই সংকটে তাঁর সমব্যথী_এ কথাটা কি তাঁকে তাঁরা বোঝাতে পেরেছেন? যদি পারতেন তাহলে নিশ্চই ডাক্তার একা বোধ করতেন না৷ তাঁর কণ্ঠস্বর বিমর্ষ হতো না, উচ্চারিত বাক্যে হতাশা প্রকাশিত হতো না৷
তিনি যে চিকিত্‍সা-সেবা প্রতিষ্ঠানটি গড়ে তুলবার চেষ্টা করছেন এর কাজ হলো, নিরাময়-অযোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত মানুষ যাতে আমৃতু্য নিজেকে একা মনে না করে, অসহায় না ভাবে সে জন্য তার পাশে দাঁড়ানো৷ রোগীকে সাহস দেওয়া, সঙ্গে থাকা৷ শারীরিক-মানসিক চিকিত্‍সা-সেবার পাশাপাশি তাকে সামাজিক সহায়তা দেওয়া৷ কাজটি যতটা চিকিত্‍সাসেবার, ঠিক ততটাই সামাজিক সেবারও৷ এ রকম সেবা আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত প্যালিয়েটিভ কেয়ার বা প্রশমন সেবা নামে পরিচিত৷ সঠিকভাবে প্রশমন সেবাপ্রাপ্ত একজন রোগী মৃতু্য মুহূর্তেও কষ্টমুক্ত থাকে, বেদনাহীন থাকে, প্রশান্ত থাকে, সাহসী থাকেন৷ কারণ, তিনি জানেন এই পৃথিবী থেকে বিদায় মুুহূর্তে তার হাত ধরে রাখার মতো আন্তরিক মানুষ পাশে রয়েছেন, যাঁরা তাকে বলবেন, 'আপনার যা-ই ঘটুক না কেন, আমরা আপনার সঙ্গে থাকবো৷ আমরা আপনাকে ত্যাগ করবো না৷' অর্থাত্‍ রোগী জানেন তিনি একা নন, অসহায় নন৷
এ রকম সেবার প্রয়োজনীয়তা কতটুকু তা কেবল ভুক্তভোগীরাই জানেন৷ এই সেবা নিশ্চিত করা খুব সহজ নয়৷ এ কাজ যান্ত্রিক নয়৷ এর জন্য আন্তরিকতা প্রয়োজন৷ আমি দেখেছি, এই ডাক্তার কত বেশি উদ্যম নিয়ে প্রশমন সেবা প্রতিষ্ঠানটি গড়ে তুলছেন, কত গভীর আন্তরিকতা নিয়ে ব্যক্তিগতভাবে মানুষকে প্রশমন সেবা দেওয়ার চেষ্টা করছেন৷ আমার মনে হয়েছে, তিনি যে রোগীর সাথে থাকেন সে কখনও একা বা অসহায় বোধ করতে পারে না৷ অথচ এ রকম একজন চিকিত্‍সকের, একজন উত্‍ফুল্ল উদ্যমী, উদ্যোক্তার একখানা 'পুরানো গাড়ি' চুরি যাওয়ায় তিনি অসহায় বোধ করেছেন! বিশেষত গাড়িটা যখন তাঁর নিজের উপার্জিত অর্থেই কেনা, ভবিষ্যতে তিনি এর অভাব দ্বিতীয়বারের মতো হয়তো পূরণ করতে পারবেন, এ প্রত্যাশা অবাস্তব নয়৷
অসুস্থতার কারণে অসহায় মানুষের জীবনের শেষ দিনগুলোর একাকীত্ব ও অসহায়ত্ব থেকে মুক্তি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি যে-চিকিত্‍সক দিয়েছেন সেই চিকিত্‍সকের একটি ছোট্ট সাময়িক তির সময় আমাদের রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা তাঁকে একাকীত্ব এবং অসহায়ত্ববোধের হাত থেকে নিষ্কৃতি দিতে পারলো কি? কত অন্তঃসারশূন্য আমাদের এই রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা ব্যবস্থা, একখানা পুরানো গাড়ি পাহারা দেওয়ার যোগ্যতাও এর নেই৷ একটি চোর ধরার কি মুরোদ নেই এই ব্যবস্থার?
আমি বা আমার মতো যারা ডাক্তারের গাড়ি ব্যবহার করেছি, তারাই বা কী করতে পেরেছি? আমাদের দায়িত্ব কতটুকু, মতাই বা কতটুকু? যদি কিছু থাকে তা কেবল ব্যক্তিগত দায়বদ্ধতা, সামাজিক দায়বদ্ধতা৷ কিন্তু কেবল ব্যক্তিগত বা সামাজিক দায়বদ্ধতাজাত ভূমিকা একজন তিগ্রস্থকে কতটুকু সহায়তা দিতে পারে, যদি রাষ্ট্রের বিশাল ব্যবস্থার মধ্যে তাঁকে বাস্তব সহায়তা দেওয়ার নিশ্চয়তা না থাকে?
আমার শংকা হয়, যদি এই উদ্যোগী মানুষটি ভাবেন, বিপদের দিনে তাঁর পাশে দাঁড়াবার মতো কেউ থাকে না, রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা এর নির্ধারিত দায়িত্বটুকু পর্যন্ত পালন করে না, তবে তিনি কেন সমাজের জন্য অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করতে যাবেন? তাঁর পরিবার-পরিজন, আত্মীয়স্বজন যদি তাঁকে 'ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো'র মতো কাজ করতে বারণ করেন? নিরুত্‍সাহিত করেন? তিনি যদি ভাবেন, তিনি নিরাপদ নন৷ কখনো যদি শংকিত হয়ে পড়েন? আর এই শংকা থেকে যদি গুটিয়ে নেন নিজেকে? উদ্যম হারান? কী গতি হবে প্রশমন সেবা প্রত্যাশী শত-সহস্র মানুষের? একটি সম্ভাব্য প্রতিষ্ঠান নিশ্চয়ই মুখ থুবড়ে পড়বে৷ তাই এই ডাক্তারকে শঙ্কার হাত থেকে মুক্ত করা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব৷ কিন্তু কে নেবে দায়িত্ব? আমরা কি এই দায়িত্ব সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্ত বিভাগগুলোর উপর ছেড়ে দিতে পারি, যাদেরকে তিনি সমস্ত ঘটনা অবগত করেছেন, এবং হতাশ হয়েছেন?



সন্ধ্যার পর এই লেখার প্রথম অংশ আমার ৮ বছর বয়সী শিশু সন্তানকে পড়ে শোনাই৷ ঘটনাটি সে বুঝতে পারে৷ এরপর তাকে জিজ্ঞেস করি, 'এই যে ডাক্তার আঙ্কেলের গাড়ি চুরি গেল, বলতো দোষটা কার?' সে তখন আগ্রহ সহকারে ঘটনাটি ব্যাখ্যা করে: 'দোষটা কার? ডাক্তারের? কিন্তু তিনি-তো অফিসে যাবেন৷ তার গাড়িটা বাইরে রাখতেই হবে৷ চোর-তো চুরি করবেই৷ এটা চোরের কাজ৷ সেই জন্যই তো আমাদের বাসায় যাতে চুরি না-হয় সে-জন্য করিম ভাই দারোয়ান পাহারা দেয়৷ তারপরও চুরি হলে দোষটা করিম ভাইয়ের৷ কারণ, সে ভাল করে পাহারা দেয় নি৷ তাহলে গাড়িটা চুরি হলে দোষটা পাহারাদারের৷ তারা গাড়িটা দেখে রাখে নি৷ আহ্-হা! ডাক্তার আঙ্কেলের কতগুলো টাকার তি হয়ে গেল৷ তা হলে তো সবই শেষ হয়ে গেল৷'
বাক্যগুলো সে এমনভাবে উচ্চারণ করছিল, যেন স্বগতোক্তি৷ এরপর আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো, 'আচ্ছা বাবা, চোরটা গাড়ি নিয়ে পালিয়ে যাবার সময় দারোয়নগুলো দেখেনি কেন?' প্রশ্নটা করেই সে আবার নিজেই উত্তর দেয়, 'ও, বুঝেছি, দারোয়ানগুলো বোধ হয় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গল্প করছিল৷' সে বলতেই থাকলো, 'আমি যদি স্কুলে গিয়ে পড়াশুনা না করে বন্ধুদের সাথে গল্প করতে থাকি তাহলে-তো ভাল রেজাল্ট হবে না, প্রাইজও পাবো না৷' এবার তার কথা ফুরালো৷ পুরো ঘটনার ব্যাখ্যায় সে নিজের অজান্তেই অত্যন্ত সরলভাবে সাদৃশ্যানুমান পদ্ধতির ব্যবহার করে৷ আমি তার দিকে তাকিয়ে থাকি, আর শিশু মনস্তত্ত্বের রহস্য উপলব্ধির চেষ্টা করি৷ তার একটি কথা আমাকে অবাক করে, 'চোর-তো চুরি করবেই৷ এটা চোরের কাজ৷' এই ছোট্ট বালক এতো নির্জলা সত্য উপলব্ধি করে কী ভাবে? সত্যিই তো, চোরেরা চুরি করবে৷ এটা তাদের কাজ৷ চোরেরা আছে, তারা তাদের কাজ করছে, এই সত্যকে আমরা রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকার করে নিয়েছি৷ আর, স্বীকার করে নিয়েছি বলেই পুলিশ, বিডিআর, এসবি, স্থল, জল ও বিমান বাহিনী থাকার পরেও তৈরি করেছি র্যাব_র্যাপিড এ্যাকশন ব্যাটেলিয়ন৷ এই সবই-তো চোরকে প্রহরা দেওয়ার জন্য৷ তথাপি চুরি হচ্ছে নিরাপদে, নিয়ত_অহরহ৷ চোর আর পাহারাদার মিলেমিশে এতো বেশি একাকার হয়ে গেছে যে, চুরি ঠেকানোর জন্য প্রহরা না-কি নিরাপদে চুরি করার জন্য প্রহরা, বোঝাই মুশকিল৷ আমাদের রাষ্ট্রীয় কাঠামোতে আমরা কি চোর আর পাহারাদারে কোনো পার্থক্য দেখি?
আমার জিজ্ঞাসা, ৮ বছর বয়সী আমাদের একটি সন্তান 'তাহলে-তো সবই শেষ হয়ে গেল'-কে যেটুকু উপলব্ধি করে, আমরা বড়রা কি সেটুকু উপলব্ধি করি? না-কি করি, কিন্তু শেষ রা'র দায়িত্বটুকু নিতে চাই না? এভাবে আমরা প্রত্যেকে আমাদের দায়িত্ব পালন না-করে অন্যকে একাকী করে দেই, অসহায় করে ফেলি৷ এবং ক্রমে আমরা প্রত্যেকেই একাকীত্ব এবং অসহায়ত্বের অনতিক্রান্ত বৃত্তে আবদ্ধ হয়ে পড়ি৷
আজ এই ডাক্তার তাঁর চুরি যাওয়া গাড়ি অনুসন্ধানের বিষয়ে যেমন একা এবং অসহায়, আমাদের অতিকায় রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় একজন রোগীও তাঁর বিশ্বস্ত চিকিত্‍সক এবং বিশ্ব্বস্ত চিকিত্‍সা অনুসন্ধানের বিষয়ে তেমনি একা এবং অসহায়৷ একজন পিতা বা মাতা তার সন্তানের বিশ্বস্ত শিক এবং শিা অনুসন্ধানের ব্যাপারে তেমনি একা এবং অসহায়, একজন ুধার্ত মানুষ তাঁর দুপুরের খাবার গ্রহণের জন্য স্বাস্থ্যসম্মত নিরাপদ হোটেলে খাবার অনুসন্ধানের ব্যাপারে তেমনি একা এবং অসহায়৷ এভাবেই আমরা প্রত্যেকে অন্যের জন্য এবং নিজের জন্য একাকীত্ব তৈরি করছি৷ আমরা কি আমাদের ভবিষ্যত্‍ প্রজন্মকে এ রকম একা এবং অসহায় অবস্থার মধ্যেই রেখে যাবো? তাহলে কি 'সবই শেষ হয়ে গেল' না?

০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শ্রান্ত নিথর দেহে প্রশান্তির আখ্যান..... (উৎসর্গঃ বয়োজ্যেষ্ঠ ব্লগারদের)

লিখেছেন স্বপ্নবাজ সৌরভ, ০৯ ই মে, ২০২৪ রাত ১:৪২



কদিন আমিও হাঁপাতে হাঁপাতে
কুকুরের মত জিহবা বের করে বসবো
শুকনো পুকুর ধারের পাতাঝরা জামগাছের নিচে
সুশীতলতা আর পানির আশায়।

একদিন অদ্ভুত নিয়মের ফাঁদে নেতিয়ে পড়বে
আমার শ্রান্ত শরীর , ধীরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আজকের ব্লগার ভাবনা: ব্লগাররা বিষয়টি কোন দৃষ্টিকোন থেকে দেখছেন?

লিখেছেন লেখার খাতা, ০৯ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:৪১


ছবি- আমার তুলা।
বেলা ১২ টার দিকে ঘর থেক বের হলাম। রাস্তায় খুব বেশি যে জ্যাম তা নয়। যে রোডে ড্রাইভ করছিলাম সেটি অনেকটা ফাঁকা। কিন্তু গাড়ির সংখ্যা খুব কম।... ...বাকিটুকু পড়ুন

সাপ, ইদুর ও প্রণোদনার গল্প

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ০৯ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:৪৪

বৃটিশ আমলের ঘটনা। দিল্লীতে একবার ব্যাপকভাবে গোখরা সাপের উৎপাত বেড়ে যায়। বৃটিশরা বিষধর এই সাপকে খুব ভয় পেতো। তখনকার দিনে চিকিৎসা ছিলনা। কামড়ালেই নির্ঘাৎ মৃত্যূ। বৃটিশ সরকার এই বিষধর সাপ... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাড়ির কাছে আরশিনগর

লিখেছেন রূপক বিধৌত সাধু, ০৯ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৩:৫০


বাড়ির কাছে আরশিনগর
শিল্পকলা একাডেমির আশেপাশেই হবে চ্যানেলটার অফিস। কিছুক্ষণ খোঁজাখুঁজি করল মৃণাল। কিন্তু খুঁজে পাচ্ছে না সে। এক-দু'জনকে জিগ্যেসও করল বটে, কিন্তু কেউ কিছু বলতে পারছে না।

কিছুদূর এগোনোর পর... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমি ভালো আছি

লিখেছেন জানা, ০৯ ই মে, ২০২৪ রাত ৮:৪৯



প্রিয় ব্লগার,

আপনাদের সবাইকে জানাই অশেষ কৃতঞ্গতা, শুভেচ্ছা এবং আন্তরিক ভালোবাসা। আপনাদের সবার দোয়া, সহমর্মিতা এবং ভালোবাসা সবসময়ই আমাকে কঠিন পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে শক্তি এবং সাহস যুগিয়েছে। আমি সবসময়ই অনুভব... ...বাকিটুকু পড়ুন

×