বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবনাদর্শ নিয়ে আলাপের সময় ঐতিহাসিকভাবে বঙ্গবন্ধুর আবির্ভাবের ব্যাপারগুলিকে অনেকেরই চোখে পড়ে না । অথচ আমাদের যেসব দিকে লক্ষ্য রাখা দরকার তার একটি তালিকা থাকা আমাদের জন্য খুবই দরকার । নিচে আমি কতগুলো ক্রাইটেরিয়া দাঁড় করাচ্ছিঃ
১। বঙ্গবন্ধুর সেক্যুলার রাষ্ট্রের নয়া ডিসকোর্সঃ
বঙ্গবন্ধু যে সেক্যুলার রাষ্ট্র গড়তে চেয়েছেন তা মেজরিটির ধর্মকে অস্বীকার করে নয় । বরং মেজরিটির কনসেন্ট নিয়ে ধর্মকে ব্যক্তিক জীবনে রাখতে চেয়েছিলেন। একই সাথে মেজরিটির ধর্ম বা ইসলামের স্পিরিটকে তিনি ভুলে যান নাই । ফলে, ঐতিহাসিকভাবে ঔপনিবেশিকতার বিরূদ্ধে আমাদের এখানে [অর্থ্যাৎ পূর্ববঙ্গ এবং বর্তমান বাংলাদেশে] যে প্রজা আন্দোলন , কৃষক আন্দোলন বা ফকির/সন্ন্যাসী বিদ্রোহ গড়ে উঠেছিল তাকে তিনি ভুলে যান নাই । তিনি এর সমস্ত কন্ট্রিবিউশনকে স্বীকার করেই সেক্যুলার বাংলাদেশের গোড়াপত্তন করেছিলেন। এর পেছনে রয়েছে তাঁর সুদীর্ঘ রাজনৈতিক সংগ্রামের ইতিহাস। বঙ্গবন্ধু মুসলিম লীগ করেছেন । কিন্তু এ কথা বলা সত্যের অপলাপ মাত্র। আমাদের বলা উচিৎ বঙ্গবন্ধু মুসলীম লীগের প্রগতিশীল অংশের রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্ব করেছেন ।মুসলিম লীগের সবচেয়ে প্রগতিশীল অংশ অর্থ্যাৎ হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী এবং আবুল হাশিমের ঘনিষ্ঠ সাহচর্য তিনি পেয়েছিলেন। এই দুই ব্যক্তিত্ব মুসলীম লীগের জমিদার অংশের সংকীর্ণতায় আটকে ছিলেন না । তারা বরং মুসলিম মেজরিটি পূর্ববঙ্গের জমিদারী উচ্ছেদের জন্য কৃষকের যে ধর্মীয় ফরমেটের সংগ্রাম [ অর্থ্যাৎ মুসলীম লীগের পাকিস্তান আন্দোলন] তাকে সমর্থন করেছিলেন। তাই তো তিনি বলতে পেরেছিলেন নির্ধিদ্বায়ঃ ‘আমি বাঙ্গালী , আমি মুসলমান , এক বার মরে , দুই বার মরে না।’ এই ঐতিহাসিক উক্তিকে বলা যেতে পারে সোশ্যাল কন্ট্রাক্টের ফলে যে জাতিরাষ্ট্র গঠিত হতে যাচ্ছে এই ভূমিতে তার নয়া ডিসকোর্স , যে ডিসকোর্স আমাদের জাতি গঠনের মূল কনসেনশাস হিসেবে কাজ করেছে ।
২। বঙ্গবন্ধু সময়ের জন্মদাতা, সময়ের ফলাফল ননঃ
বঙ্গবন্ধু হিস্ট্রীক্যাল ইভেন্টের জন্ম দিয়েছিলেন। অথচ, কিছু কিছু বুদ্ধিজীবী [ বিশেষত আহমদ ছফা ] তাঁর সংগ্রামকে ডিসক্রেডিট করার জন্য বলেছিলেন, বঙ্গবন্ধু সময়ের স্রষ্ট নন, সময় তাঁকে তৈরি করেছে। বলা বাহুল্য , আমরা এ কথার ঘোরতর বিরোধী। আমরা বরং বলতে চাই, বঙ্গবন্ধুর মধ্য দিয়েই ঐতিহাসিক সময় নিজের পরিপূর্ণতা দেখতে পেয়েছে। বঙ্গবন্ধু ঐতিহাসিকতাকে অর্থবহ করে তুলেছেন ।আমরা বলতে পারি, একটি লিনিয়ার বা সরলরৈখিক সময়কাঠামোতে তিনি আবির্ভূত হয়ে সেই নির্দিষ্ট সময়কে ঐতিহাসিক স্পেস দিয়েছেন। তাঁর আবির্ভাব না হলে হয়তো ঝঞ্ঝামুখর থাকত পাকিস্তানের বিরূদ্ধের আন্দোলনগুলি, কিন্তু দেশ স্বাধীন হতো কিনা তা নিশ্চিত করে বলা যায় না । কেননা , দেশের স্বাধীনতার জন্য অর্থ্যাৎ সময়কে ঐতিহাসিক স্পেস দেয়ার জন্য যে ধরণের সাবজেক্টিভিটির আবির্ভাবের প্রয়োজন পড়ে, যে ধরণের ঐতিহাসিক ব্যক্তির মধ্য দিয়ে সময় নিজের নতুন জন্ম দেখতে পায় তা সম্ভব হতো না কখনোই যদি বঙ্গবন্ধু সে সময়ে না থাকতেন। আমরা যদি ঐতিহাসিক ৬ দফা থেকে তাঁর সংগ্রামের নতুন ডাইমেনশনের দিকে লক্ষ্য রাখি তাহলেই ব্যাপারটি পরিষ্কার হয় । ৬ দফার আন্দোলন থেকে তিনি ধীরে ধীরে যে তুমুল আন্দোলন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে আমাদেরকে স্বাধীনতার দিকে নিয়ে গেছেন , তা কেবল সময় নামক একটা এবস্ট্রাক্ট জিনিসের কৃতিত্ব হতে পারে না।
৩। বঙ্গবন্ধু ও বাংলা ভাষার বিউপনিবেশীকরণঃ
বঙ্গবন্ধুর অনন্য ঐতিহাসিক কৃতিত্বসমূহের মধ্যে অন্যতম হল বাংলা ভাষার অউপনিবেশিক ব্যবহার । অর্থ্যাৎ কলকাতার সাংস্কৃতিক ডমিনেশনে আবদ্ধ না থেকে তিনি রাজনৈতিকভাবেই ভাষা প্রশ্নকে ডিল করেছেন এবং পূর্ববঙ্গ বা বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ভাষায় তাদের সাথে কম্যুনিকেট করেছেন । এ এক অসাধারণ বিপ্লব। সাধারণ মানুষের যে মুখের ভাষাকে যুগ যুগ ধরে নিষ্পেষণ করা হয়েছে, অসংস্কৃত হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে, তিনি সেই ভাষাতেই মানুষের সাথে কথা বলেছেন, ভাষণ দিয়েছেন। বর্ণবাদী অভিজাত বাংলার ঘেরাটোপ ছিন্ন করে রাজনৈতিকভাবে বাংলাভাষার এ ব্যবহার তাঁর অনন্য কৃতিত্ব।
৪। বঙ্গবন্ধু যেভাবে নব্য স্বাধীন বাংলাদেশকে own করতেন:
বঙ্গবন্ধু লন্ডনে মেডিক্যাল চেকাপ করতে গিয়ে সেখানকার এক সাংবাদিককে সাক্ষাৎ দেন। সেই সাংবাদিকের প্রশ্নের উত্তরে তিনি অসাধারণ কিছু কথা বলেন। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য যে কথাটি তিনি বলেন তা সরাসরি ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকতার বিরূদ্ধে। তিনি বলেন, আপনাদের ইংল্যান্ড সম্পদশালী হয়ে উঠার পেছনে বাংলাদেশের ঐতিহাসিক অবদান রয়েছে। ফলে আজ যখন বাংলাদেশের মানুষ না খেয়ে আছে, যখন তারা দারিদ্র্যের কষাঘাতে লিপ্ত তখন ইংল্যান্ডের জনগণ ও রাষ্ট্রের উচিৎ তাদের পাশে দাঁড়ানো । তাদের উচিৎ কিছুটা হলেও পে ব্যাক করা। নব্য স্বাধীন দেশের এক নেতা হিসেবে এরকম সাহসী উক্তি আর অন্য কেউ করেছে কিনা তা আমার জানা নেই। স্বাধীনতার এতো বছর পরও এরকম সাহসী এবং স্মার্ট উক্তি আর কেউ করেছে বলে শুনা যায় না।
বঙ্গবন্ধু ও তাঁর ঐতিহাসিকতা, তাঁর আবির্ভাব এবং রাজনৈতিক দর্শন ইত্যাদির ব্যাপারে আমাদের পূর্ণ সচেতনতা না থাকলে আমরা আমাদের দেশকে কী করে গড়তে চাই, কি ধরণের শেইপ দিতে চাই তা বুঝতে পারবো না । আমরা আরো বুঝতে পারবো না কি করে একজন মহান ব্যক্তি সময়ের ভেতরে প্যাসিভ না থেকে একটিভলি সময়ের স্ট্রাকচারকে ভেঙ্গে চুরে নতুনভাবে গঠন করে একটি স্বাধীন দেশ উপহার দিতে পারে । ( চলবে)
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই জুন, ২০১৬ সকাল ১০:৩৪