somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

শেক্সপিয়ারের ডুগডুগি

১৭ ই জুন, ২০১৬ সন্ধ্যা ৭:২৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

প্রথমত, প্রিয় পাঠিকা, আপনাকে বুঝতে হবে, শেক্সপিয়ার পড়ার জন্য কোন সদর দরজা খোলা নেই । অবশ্য যেকোন টেক্সট,বয়ান ও আলাপের ক্ষেত্রেই একথা খাটে । ফলে, আমি যখন এই আলোচনায় নানা প্রশ্ন ও সমস্যা নিয়ে আলোচনা করতে যাচ্ছি তখন আমি আসলে কোন সুনিশ্চিত নির্ধারক উত্তর দিতে যাচ্ছি না । কেননা, এর কোন উত্তর আমার বা কারো কাছেই নেই । এ কথার মানে হল , আমি যেটা করব তা হল প্রশ্নগুলোকেই আরো ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখার চেষ্টা করব এবং এ বিষয়ে যারা পন্ডিতি আলাপ করেছেন তাদেরকে হাজির করব ।
দ্বিতীয়ত , আমার উপরের কথাগুলো দেরিদার আলাপ দ্বারা জারিত । এর পেছনে আছে হেইডেগারের অনুপ্রেরণা । হেইডেগার বলেছেন , কোন কিছুকেই পরিপূর্ণ ভাবে জানা ( ওরফে exhaust করা ) যায় না । exhaust এর ভাল বাংলা – এ ক্ষেত্রে – আমি প্রস্তাব করব- ‘খাওয়া’ । আপনি কোন কিছু বুঝেন মানে আপনি ঐ ব্যাপারটাকে আপনার দেহ ওরফে চিন্তার ভেতর নিয়ে গেছেন । এ প্রক্রিয়াকে খাওয়ার সাথে তুলনা করা যেতে পারে । এক্ষেত্রে তাই আমি হেইডেগারের মতোই কার্টেসিয়ান বৈপরীত্যের ( যেখানে দেহ ও মন আলাদা ব্যাপার ) ঘোর বিরোধী । তো , হেইডেগার আলাপ তুলেছেন যে, আপনি আসলে কোন কিছুকে পরিপূর্ণ ভাবে খেয়ে হজম করতে পারবেন না । বুঝাবুঝির ক্ষেত্রে কোন না কোন কিছু উদ্বৃত্ত থেকেই যাবে । এটা মার্ক্সীয়ান উদ্বৃত্ত নয়- পাঠিকা লক্ষ্য রাখবেন যেন । যাই হোক , আমাদের কপালে আরো দুঃখ যা আছে তার সার কথা হল এই যে, দর্শনের ভূত-তাড়ানিয়া ওঝা ফরাসী দার্শনিক জ্যাক দেরিদা মহাশয় আমাদের জানিয়েছেন , পরিপূর্ণ বুঝাবুঝি বা ‘খেয়ে ফেলা’ বলতে কিছু তো নাই-ই ,তার উপর গোঁদের উপর বিষফোঁড়ার মত আপনি যা বলবেন তার একেবারে ১৮০ ডিগ্রী উলটা ব্যাখ্যাও জগতে ঘটতে পারে । সুতরাং আমি যখন শেক্সপিয়ার নিয়ে আলাপ করব , তখন যেন পাঠিকা এ-কথাও মনে রাখেন , আমার বা অন্য কারো কথাই ফাইন্যাল কথা নয় । ফাইন্যাল বলে কিছু নাই । ফলে, সব কথাই আসলে ফাইন্যাল কথা । এ অর্থে সব ফাইন্যালই আসলে ‘শুরু’ মাত্র ।
তৃতীয়ত, আমি জানি যে, উপরের কথাগুলো প্যারাডক্সিক্যাল বা বিরোধাভাসে পূর্ণ । আপনাদেরকে দুঃখের সাথে জানাতে চাই , এই বিরোধাভাস-ই আমার প্রক্রিয়া । এই দিক থেকে আমি দার্শনিক এরিস্টটল মহাত্নার পিঠে ছুরি চালানোর দায়েও অভিযুক্ত হতে চাই । এরিস্টটল তার যুক্তিবিদ্যার আলাপে আমাদের জানিয়েছেন – আপনারা জানেন- যে, কোন কিছুই একসাথে সত্য বা মিথ্যা হতে পারে না । জায়গা স্বল্পতার অভাবে, ব্যাখ্যা না করেও , আমি দাবি করতে চাই , যেকোন কিছুই একই সাথে সত্য ও মিথ্যা হতে পারে। এ ক্ষেত্রে আমি আমার পক্ষে মার্ক্স হতে শুরু করে মহাত্না ফ্রয়েড ,দেরিদা ও ফুঁকোকেও স্বাক্ষী মানতে রাজি আছি ।
চতুর্থত, এইসব প্রাথমিক আলাপের পর আমি ফরাসী দর্শনের গুরুজীদের অন্যতম মিশেল ফুঁকোর দ্বারস্থ হতে চাই । তিনি ‘ইতিহাস’কে গুরুত্ব দিয়েছেন । এবং বলতে চেষ্টা করেছেন , যেকোন বয়ানই আসলে শেষ পর্যন্ত ইতিহাসের ভেতরে বা নির্দিষ্ট স্পেস-টাইমের ভেতরে অর্থবহ, উৎপাদিত ও পুণরুৎপাদিত হয় । এ নিয়ে আমেরিকান ভাষাবিদ চমস্কির সাথে তার বিতর্ক পুরনো,কিন্তু সেসব ব্যাখ্যা করা এ প্রবন্ধের উদ্দেশ্য নয়। যাই হোক ফুঁকো যা বলেছেন তার একটা অংশ অবশ্য পুরনোই। মার্ক্সবাদীরা এ ধরণের আলাপ তুলে গেছে। কিন্তু তিনি নতুন যা যুক্ত করেছেন তার মধ্যে এ আলোচনার জন্য প্রাসঙ্গিক হলো ‘ক্ষমতা’র ধারণা। পুরানা মার্ক্সবাদীরা – খোদ মার্ক্স হতে শুরু করে হালের আলথুসার পর্যন্ত – যেখানে ‘ক্ষমতা’কে রিপ্রেসিভ বা দমনমূলক দেখিয়েছেন , সেখানে ফুঁকো ‘ক্ষমতা’কে ক্রিয়েটিভ বা সৃষ্টিশীল হিসাবেও দেখিয়েছেন । আপনার চারপাশে লক্ষ্য করলেই তা বুঝবেন । ক্ষমতা যদি শুধুই দমনমূলক হতো এবং ক্রিয়েটিভ না হতো তাহলে বিদ্যমান প্রতিষ্ঠান –প্রতিষ্ঠানাদি ও জ্ঞানতত্ত্বের উদ্ভব সম্ভবপর হত না । ফুঁকোর এইসব আলাপ- আমরা দেখতে পাই- হাল আমলের রেঁনেসাস ও শেক্সপিয়ারের সমালোচক স্টিফেন গ্রিনব্লাট, জোনাথন ডলিমোর , এলান সিনফিল্ড প্রভৃতি ভাবুককে বেশ ভাবিয়েছে। এইসব নয়া-ইতিহাসের ও কালচারাল পোয়েটিকসের তাত্ত্বিকেরা আমাদের জানিয়েছেন , ‘অতীত’ বলে যে ‘মাল’ হাজির আছে তা আসলে বর্তমান চিন্তা-পদ্ধতি ওরফে ক্ষমতা-কাঠামোরই রিফ্লেকশন । নিখাদ ‘মাল’ হিসেবে ‘অতীত’ বলে কিছু নেই । এই কথার অপর মানে , অবজেক্টিভ ‘অতীত’ একটা ভূত। সে আছে আবার নাই ।
পঞ্চমত, উপরের আলোচনার সমস্ত প্যারাডক্স, কনফ্লিক্ট ও ছদ্ম-যুক্তিপদ্ধতি ওরফে ফ্যালাসির দায় মাথায় নিয়ে আপনাদের সাথে শেক্সপিয়ারের আলাপ তুলতে চাচ্ছি । আবারও স্মরণ করিয়ে দিতে চাই , ফ্যালাসি ও অযুক্তি বা কুযুক্তিই আমার ভরসা। তাহলে, আসুন শুরু করি ।
শেক্সপিয়ারের সাইকোএনালিসিস বা মতিভেদঃ
জগতে মহামতি ফ্রয়েডের আবির্ভাবের শতাধিক বছর পাড় হয়েছে । তিনি যে চিন্তার-কারবারি তাকে বলা হয় সাইকোএনালিসিস বা মনঃবিশ্লেষণ বা মতিভেদ । মজার ব্যাপার হল কোন কোন সাহিত্যতাত্ত্বিক দাবী করেছেন , শেক্সপিয়ারই আসলে মনঃবিশ্লেষণের আধুনিক উদগাতা । নইলে তিনি হ্যামলেটের মত চরিত্র তৈরি করলেন কি করে ! আমি জানি , আপনারা অনেকেই শেক্সপিয়ার ও অন্যদের বয়ানের ‘মতিভেদ’ করতে সদা তৎপর থাকেন । আমিও সে আলোচনায় যাব । তবে তার আগে ফুকোল্ডিয়ান ডিসকোর্স এনালিসিসের দ্বারস্থ হয়ে বাগড়া দিয়ে নেই । বাগড়া দেয়াই যেহেতু আমার কাজ । বাগড়াটা হলোঃ মহামতি ফ্রয়েড সাহেব যে ‘মতিভেদ’ তত্ত্বের উদগাতা তা হাজির হওয়ার প্রেক্ষাপট রূপে কাজ করেছে শিল্প-বিপ্লবোত্তর পাশ্চাত্যের একক পরিবারের ধারণা। শিল্পবিপ্লবোত্তর পাশ্চাত্যের একক পরিবারের মা, বাবা ও ছেলে সন্তানের সম্পর্কের গতি প্রকৃতি নির্ধারণ করেছেন ফ্রয়েড সাহবে । তিনি মেয়ে সন্তান ও প্রাচ্যদেশীয় বা প্রাক-শিল্পবিপ্লব যুগের যৌথ পরিবার বা অনাথ হিসেবে বড় হওয়া সন্তানাদির ব্যাপারে ঠিকমত কিছু বলতে পারেন নাই । এর সমাধান বহু পড়ে করে গেছেন মহাত্না জ্যাক লাঁকা। দুঃখের বিষয় , এ সমাধানের মূল্য তিনি দিয়েছেন আন্তর্জাতিক মনোবিশ্লেষণ সমিতি হতে বহিষ্কৃত হয়ে । সে যাই হোক । আমার বাগড়া দেয়ার কাজ যেহেতু শেষ , ফলে, শেক্সপিয়ারের মতিভেদ নিয়ে আলাপ তোলা যেতে পারে , কি বলেন ? ধরুন , বহুল আলোচিত ‘হ্যামলেট’ সাহেবের কথা । বেচারা তার পিতৃহত্যার প্রতিশোধ নিতে বদ্ধ পরিকর ( তাই কি ? ) । সে জানে তার পিতৃদেবকে হত্যা করেছে তারই আপন চাচা ক্লডিয়াস। এই ক্লডিয়াস মহাশয়ের আরো এক পাপ হল সে নিজ ভাইকে হত্যা করেই শুধু ক্ষান্ত হয় নাই , হত্যার কিছুদিনের মধ্যেই আপন ভাইয়ের স্ত্রী অর্থ্যাৎ হ্যামলেটের মাতৃদেবীকে তিনি বিয়ে করেছে । আমরা সাধু ভাষায় বলি , ‘তাহারা বিবাহ-বন্ধনে আবদ্ধ হইয়াছেন’ । এই ‘আবদ্ধ’তা নিয়েই মহাত্না ফ্রয়েড প্রথম আলাপ তুলেছেন । হ্যামলেটের মাতৃদেবী এখন ‘আবদ্ধ’ বা ‘বদ্ধ’ হয়ে আছে ক্লডিয়াসের ঘরে। হ্যামলেটের পক্ষে সেই শরীরে আর প্রবেশাধিকার নাই । রাস্তা বদ্ধ বা আবদ্ধ । কিন্তু , এই যে আমরা বলি ‘আবদ্ধ হওয়া’ এই কথার অপর একটা unconscious বা অজ্ঞানীয় মানেও তো আছে । ‘আবদ্ধ’ কথাটা মেটাফোর বাদে আর কি ! আর অ-জ্ঞানের কাজ তো মেটাফোর আর মেটোনিমির মাধ্যমে ‘সত্য’কে দূর্বোধ্য করে তোলা। এই দিক থেকে অ-জ্ঞানের বিশ্লেষণে আমরা পাই, আবদ্ধ মানে যা বদ্ধ নয় – অর্থ্যাৎ, খোলা। এই খোলা পথের সন্ধান চায় হ্যামলেট। কিন্তু তা কিভাবে সম্ভব ? মনোবিশ্লেষণ বলে যে , তা সম্ভব । পিচ্চি বাচ্চা মায়ের উপর দাবী ছাড়ার মাধ্যমে বাবার সাথে বন্ধুত্ব করে বা বাবার কাছে নতি স্বীকার করে । একে ফ্রয়েডীয় ভাষায় বলে, Oedipus complex resolution আর লাঁকানিয়ান পরিভাষায় বলে, Process of symbolization । কিন্তু বাচ্চা তার মায়ের উপর দাবী ছেড়ে দিয়ে বিনিময়ে পায় কি ? ফ্রয়েড বলেন , বাচ্চা পায় মহামূল্যবান আদিম প্রমিজ বা শপথ । এই শপথের মূল কথা হল, মায়ের বদলে উপযুক্ত সময়ে সে পাবে অন্য নারী-শরীর। মেয়ে সন্তানের ক্ষেত্রে ব্যাপারটি অন্যভাবে ঘটে, তা এখানে প্রাসঙ্গিক নয় । অন্যদিকে জাঁক লাঁকা বলতে চান , বাচ্চা আসলে প্রবেশ করে ভাষার জগতে । আর ভাষার জগত বড়ই রহস্যময় । তিনি সস্যুর আর রোমান জ্যাকবসনকে অবিনির্মান করে বলেন , ভাষা বাস্তবিক পক্ষে কোন কিছু এনে দিতে পারে না । সে বাস্তবতার প্রতিরূপ আকারে হাজির হয় মাত্র। ফলে ভাষায় থাকে সত্যিকার বস্তুর অভাব। পরিপূর্ণ মানুষ নানা কিছু দিয়ে এ অভাব পূরণ করতে চায় । কিন্তু অভাব পূরণ হয় না । আর এই অভাব থেকে শুরু হয় ডিজায়ার ওরফে বাসনার খেলা। এই খেলা শেষ হয় মৃত্যুর মধ্য দিয়ে , যখন আমরা ভাষার জগতকে অতিক্রম করে ফেলি । কঠিন ভাষায় বলা যাক , এই খেলা শেষ হয় সিগনিফিকেশনের দৌঁড় শেষ হওয়া মাত্র । এই অর্থে, মানুষের ভেতর কাজ করে মৃত্যুর বাসনা।এই মৃত্যুর বাসনার খবর আমরা পাই হ্যামলেটের পরতে পরতে । হ্যামলেটও পরিপূর্ণভাবে পেতে চায় তার মাতৃদেবীকে। কিন্তু তার সামনে ( মানে তার অজ্ঞানের সামনে ) বাঁধা হয়ে আছে তার পিতৃদেব। পিতৃহত্যার ব্যাপারে হ্যামলেট কি তাহলে খানিকটা কৃতজ্ঞও হয়ে উঠেছিল তার পিতার হত্যাকারী চাচা ক্লডিয়াসের প্রতি ? এ জন্যই কি ক্লডিয়াসকে হত্যা করতে এতো দ্বিধা হয়েছিল তার ? আমরা ধারণা করতে পারি , অজ্ঞানের এই দ্বিধার খেলা ক্লডিয়াসকে এমনকি একলা পেয়েও হত্যা না করার পক্ষে নানা যুক্তি-তর্ক সাজিয়েছিল । ফ্রয়েড বলতে চান , আমরা মূলত দ্বিধার ফসল । একদিকে অ-জ্ঞান আরেকদিকে সজ্ঞানের মধ্যে পড়ে কাটা মুরগির মোট ছটফট করি আমরা। এই দিক থেকে , মানুষ তা-ই যা আসলে দুই ভাগ হয়ে আছে। আমরা দেখতে পাই , হ্যামলেটে এ দ্বিধার ভাগ পাড় হয়ে অজ্ঞানের জয় হয় , কিন্তু তা ঘটে অনেক পরে যখন তার মাতৃদেবী গারট্রুডও ক্লডিয়াস দ্বারা হত্যাকান্ডের শিকার হয় এবং হ্যামলেট তার মায়ের বন্ধন হতে মুক্তিপ্রাপ্ত হয় । এ কথাকে ইগো-সাইকোলজিস্টরা বলে , fixation হতে মুক্তি । কিন্তু জ্যাক লাঁকা আরো কিছু প্রশ্নের উত্তর চান । তিনি মায়ের শরীর নিয়ে সন্তুষ্ট নন । তার বদলে তিনি ধারণা আনেন imaginary order বা আরামদেশের । লাঁকা বলেন, শিশুকে বড় হতে গেলে অর্থ্যাৎ ভাষার জগতে প্রবেশ করতে হলে আরামদেশের বিসর্জন দিতে হয় । এই আরামদেশকে লালনের ভাষা ধার করে বলা যেতে পারে , আয়নাঘর । আয়নাঘরে শিশু নিজের প্রেমে নিজেই মশগুল থাকে । অর্থ্যাৎ শিশু মাত্রই নার্সিসিস্ট। ইনোসেন্ট কিছু না। ভয়ঙ্কর শয়তান । সে যাই হোক , লাঁকা বলেন , হ্যামলেট মূলত obsessional neurosis এর রোগী । neurotic হলো সেই ব্যক্তি যে কিনা ভাষায় প্রবেশ করেছে কিন্তু ভাষা পূর্ববর্তী আরাম ভুলতে পারে নাই । আর অন্যদিকে আছে psychosis . psychosis রোগী ভাষায় প্রবেশ করতে ব্যর্থ হয়েছে । এর একটি অতিপরিচিত উদাহরণ হল অটিস্টিক রোগীরা। আর এ দু’ইয়ের মাঝে আছে বিখ্যাত Pervert. Pervert হলো সেই রোগী যে ভাষার জগত অর্থ্যাৎ অ-ভাব বা অ-জ্ঞানের জগতকে চেনে কিন্তু একইসাথে সে ভাষা-পূর্ব জগতেও আবদ্ধ হয়ে থাকে । লাঁকার মতে, হ্যামলেট আমাদের মতই ভাষা-পূর্ব জগতে হাজির হতে চায় । কিন্তু , তার ডিজায়ার বা বাসনা নির্ধারিত হয়ে যে বড় Other বা ওপর দ্বারা তার নাম গারট্রুড; অর্থ্যাৎ তার মা’য়ের দ্বারা। এই দিক থেকে হ্যামলেটের ডিজায়ার চালিত হয়ে যে বড় Other দ্বারা তা আসলে তার নিজ (m)Other ছাড়া আর কে ! কিন্তু তার মাতৃদেবীর ডিজায়ার কি ? আমরা জানি তার মাতৃদেবীর বাসনার দিক হলো তার দ্বিতীয় স্বামী অর্থ্যাৎ হ্যামলেটার চাচা ওরফে নতুন-বাবা ক্লডিয়াস । কিন্তু এই ক্লডিয়াস আবার একইসাথে তার বাবার হত্যাকারীও বটে । এই দুই দু’টানায় পড়ে হ্যামলেট দ্বিধায় পড়ে যায় – নড়তে পারে না, অনবরত প্রলাপ বকতে থাকে। যাক, যথেষ্ট হয়েছে। এই আলাপের এখানে সমাপ্তি ঘোষণা করতে চাই আমি , যদিও Jungian psychoanalysis দ্বারা কিভাবে Othello’র মতিভেদ করা যেতে পারে তা নিয়ে আলাপ করতে ইচ্ছুক ছিলাম আমি । কিন্তু সে আরেকদিন ।
নয়া-ইতিহাসের মুখে শেক্সপিয়ার:
আমি New-Historicism এর বাংলা নয়া-ইতিহাস করতে চাই না। আমি এর বাংলা করতে চাই নয়া-ক্ষমতার বয়ান । ক্ষমতা- আমি আগেই আলোচনা করেছি- কেবলই ধ্বংসাত্নক নয় ; ক্ষমতা সৃজনশীলতার কারিগরও বটে । তবে ক্ষমতার এক অদ্ভূত বৈশিষ্ট্য আছে ।‘ক্ষমতা’ নিজেকে টিকিয়ে রাখার জন্য কিছুটা ‘বিরোধীতা’র জন্ম দিয়ে থাকে । আর এ ‘বিরোধীতা’টুকু পরবর্তীতে ক্ষমতা-কাঠামোকে আরো বেশি সুসংহত করার কাজেই লাগে। Stephen Greenblatt এসব আলাপের উদগাতা ।তিনি তার বই ‘Invisible Bullet’-এ এই দুটো প্রক্রিয়ার একটির নাম দিয়েছেন – ‘Subversion’ এবং অপরটির নাম দিয়েছেন- ‘Containment’ । এ কথার সপক্ষে Henry IV থেকে নায়ক Hal এর আলাপ টেনেছেন । Prince Hal নিচু স্তরের লোকদের সাথে বন্ধুত্বের সম্পর্ক তৈরি করে। কেননা , এর মধ্য দিয়েই সে তাদের সমন্ধে অধিক তথ্য ও জ্ঞান অর্জন করতে পারবে । এই জ্ঞান পরবর্তীতে রাজ ক্ষমতায় আসীন হবার পর তাকে এইসব লোকদের নিয়ন্ত্রণ ও দমন করতে সাহায্য করবে । ফুঁকো একেই Power/Knowledge হিসেবে চিহ্নিত করেছেন এবং বেকনের ‘Knowledge is power’ কথাটিকে উলটে দিয়ে বলেছেন, ‘Power is Knowledge’. এখন কথা হল , শেক্সপিয়ার এই আলাপ জানেন কিভাবে ? Greenblatt বলেন , সেই ষোড়শ-সপ্তদশ শতাব্দীর ইউরোপীয় রাজতন্ত্র ও রাষ্ট্রব্যবস্থা যার চিন্তা দ্বারা প্রভাবিত ছিল তাদের একজন হল ম্যাকিয়াভেলী । আমরা প্রিন্স হালের চরিত্রে ম্যাকিয়াভেলীর রাষ্ট্র-নিয়ন্ত্রণের বয়ান খুঁজে পাই । এইভাবে মার্ক্সীস্টদের আলাপ উলটে দিয়ে গ্রিনব্লাট ও ডলিমোরেরা আমাদের জানান, টেক্সট সমাজের প্রতিফলন কেবল নয় , টেক্সট নিজেও সমাজে ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া তৈরি করে ডমিন্যান্ট চিন্তাকে উৎপাদন ও পুনরুৎপাদন করে । তবে এর মধ্য দিয়ে সে আবার তার নিজস্ব বয়ানের ভেতর যে চরিত্রগুলোকে দমন করতে চায় তারাও এক ধরণের ভাষা পেয়ে যায় । ধরা যাক , Falstaff এর কথা । Falstaff এর রাজবিরোধী কথাবার্তা সমূহও নাটকটির প্রতিটি পাঠ ও মঞ্চায়নের সময়ও একইসাথে উৎপাদিত ও পুণরুৎপাদিত হতে থাকে, থাকবে । এদিক থেকে ক্ষমতা সবসময়ই পালটা ক্ষমতার বয়ানের চ্যালেঞ্জের মুখে কাঁপতে থাকে। Michael Foucault একেই বলেছেন- ‘ Where there is power, there is resistance’.
লুই মন্ট্রোজঃ নয়া-ইতিহাসের খপ্পড়ে অজ্ঞান
অ-জ্ঞান মানে জ্ঞানের অভাব নয় । অভাবের জ্ঞান । একথা আগেই বলেছি । অর্থ্যাৎ আপনি যা হারিয়েছেন , যাকিছু আপনার ভেতর দমিত হয়েছে তাই অ-জ্ঞান বা Unconscious । নয়া ইতিহাস বা নয়া-ক্ষমতার বয়ান সাধারণত অজ্ঞানের ধার ধারে না । কিন্তু লুই মন্ট্রোজ এ ধারায় ব্যতিক্রম । তিনি অ-জ্ঞানকে ইতিহাসের নানা পরতে নানাভাবে দেখতে পান । অ-জ্ঞানকে ইতিহাসের ফ্রেমে ফেলে তার স্বরূপ বুঝতে চান এবং প্রায় দাবিই করে বসেন যে, ইতিহাসই সেই অ-জ্ঞান যাকে আমরা খুঁজে ফিরি বা যা আমাদের সচেতন চিন্তার ব্যাকগ্রাউন্ডে ভূতের মতো হাজির থাকে । লুই মন্ট্রোজ আমাদেরকে এক এলিজাবেথীয় ওঝার খবর দিয়েছেন । এই ওঝার নাম Simon Forman । এই ফোরম্যান সাহেব এক রাতে রাণী এলিজাবেথকে নিয়ে একখানে সেমি-ইরোটিক স্বপ্ন দেখে ফেললেন । ব্যাপারটা জনসমক্ষে প্রকাশ করা বিপদজনক ভেবে তিনি তার সেই স্বপ্নের বিবরণ( অর্থ্যাৎ রাণীর সাথে যৌন সংসর্গের বিবরণ ) তার নিজস্ব ডায়েরীতে লিখে রাখলেন ।লুই মন্ট্রোজ সেই ডায়েরী পড়ে মন্তব্য করেন, সম্ভবত স্বপ্নের ভেতর তৎকালীন ইংল্যান্ডের রাজনৈতিক ‘মাতা’ হিসেবে হাজির রাণী এলিজাবেথ আসলে সাইমন ফোরম্যানের মায়ের জায়গা-ই নিয়েছেন । মায়ের সাথে মিলিত হওয়ার যে অ-জ্ঞান ইচ্ছা তা ইতিহাসের ফ্রেমওয়ার্কের খপ্পড়ে পড়ে প্রতিস্থাপিত হয়ে গেছে রাণী এলিজাবেথের সাথে । আর কে না জানে অ-জ্ঞানের কাজ হল ‘আসল’ বস্তুকে সরিয়ে দিয়ে অন্য কিছু দ্বারা তাকে প্রতিস্থাপিত করা। ফ্রয়েড এ ঘটনাকে বলেন- displacement . displacement কথাটি রোমান জ্যাকবসন ওরফে ইয়াকুবসনের ভাষাতত্ত্বে হাজির Metonymy’র ধারণা থেকে মনোবিশ্লেষণ তত্ত্বে এসেছে । লুই মন্ট্রোজ শেক্সপিয়ারের Midsummer Night’s Dream নিয়ে বিশদ আলোচনা করেছেন । তার আলোচনায় দু’ধরণের অন্তর্দৃষ্টি হাজির হয়েছে। এক ) এই নাটকে শেষ পর্যন্ত এলিজাবেথীয় পিতৃতন্ত্র রি-ইনফোর্সড হয়েছে। আমরা দেখতে পাই , Oberon তার অবাধ্য স্ত্রীকে বশীভূত করে নাটকের শেষে তারই অধীনে নিয়ে আসতে সক্ষম হয় ।এর মধ্য দিয়ে এলিজাবেথীয় সমাজের পিতৃতন্ত্র উৎপাদিত ও পুণরুৎপাদিত হয়ে ( আলথুসারের ভাষায় ) ক্ষমতা কাঠামোকে আরো শক্তিশালী করে তোলে । পাঠিকা মনে রাখবেন , এ নাটক যখন রচিত হচ্ছে তখন ইংল্যান্ডের ক্ষমতায় আসীন রাণী এলিজাবেথ । সাইমন ফোরম্যান তার প্রাইভেট স্বপ্নে যেমন রাণীকে ( অর্থ্যাৎ নারীকে ) বশীভূত করেছেন , তেমনি শেক্সপিয়ারও এই নাটক সহ আরো অন্যান্য নাটকেও স্ত্রী প্রজাতিকে বশীভূত করেছেন । এই নাটক- মন্ট্রোজের ভাষায়- মূলত প্রাইভেট বা ব্যক্তিগত স্বপ্নেরই পাবলিক প্রদর্শনী মাত্র । আমরা বলতে পারি , নাটক বা সাহিত্য হল, সেইহেতু, সামাজিক অ-জ্ঞান বা Social Unconscious . দ্বিতীয়ত, Midsummer Night’s Dream কি একখানা কমেডি মাত্র ? আমাদের সাধারণ বয়ানে অবশ্য তাই । কিন্তু একটু খেয়াল করলেই দেখা যাবে এ নাটক মূলত অন্য এক গভীর ও বিষাদময় কালো ট্র্যাজেডির Prologue বা উপক্রমণিকা বা প্রারম্ভ মাত্র । নাটকের দুই চরিত্র Theseus ও Hippolyta । শেক্সপিয়ার চরিত্র দুটোকে নিয়েছেন গ্রীক ট্র্যাজেডি Phaedra’র সূত্র ধরে । আমরা জানি থিসিউস আর হিপ্পোলিটার সন্তান হিপ্পোলিটাস । হিপ্পোলিটা মারা গেলে থিসিউস দ্বিতীয় বিয়ে করে ঘরে আনেন ফেড্রা নাম্নী এক নারী’কে । এই নারী তারই সৎ সন্তান হিপ্পোলিটাসকে প্রেম নিবেদনে ব্যর্থ হয়ে তার বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ আনে যা শেষ পর্যন্ত হিপ্পোলিটাসের হত্যাকান্ড ও তৎপরবর্তী হত্যাকান্ড ও আত্নহননের মধ্য দিয়ে ট্র্যাজেডিতে রূপান্তরিত হয় । সুতরাং আমরা কি সুনিশ্চিত দাবী করতে পারি যে, এলিজাবেথীয় দর্শক এই নাটক দেখে কেবলই মিলনাত্নক রসে জারিত হয়ে থিয়েটার থেকে সন্তুষ্ট চিত্তে বের হয়েছেন ? নাকি, এ-ও সম্ভব যে, তারা মিলনাত্নক এই নাটকের পরবর্তী ঘটনাসমূহের বিষাদের কথা চিন্তা করে শংকিত চিত্তে প্রেক্ষাগৃহ থেকে বের হয়েছেন ? এলিজাবেথীয় পিতৃতন্ত্র কি একইসাথে এই নাটকে ফেড্রা নাটকের ছায়া দেখতে পান নি ? এই পিতৃতন্ত্র কি নারী-জাতি দ্বারা প্রতারিত হওয়ার ভয়ে কেঁপে উঠে নি? লুই মন্ট্রোজ আমাদের জানান, এ নাটক দেখে তার পরবর্তী ঘটনাসমূহ স্মরণ করে এলিজাবেথীয় পুরুষ নিশ্চয়ই নারী জাতির তথাকথিত অকৃতজ্ঞতা ও কৃতঘ্নতা নিয়ন্ত্রণ ও দমনের উপায় খুঁজে বেরিয়েছে মরিয়া হয়ে । মজার ব্যাপার হলো এতোকিছুর পরও এলিজাবেথের ক্ষমতার বিরুদ্ধে বা নারী-কুইনের বিরুদ্ধে আমরা দৃশ্যমান তেমন কোন পাবলিক রিয়েকশন দেখতে পাই না । এর কারণ হিসেবে বিবেচনায় নেয়া যেতে পারে Spenser এর Faerie Queene নামক মহাকাব্যকে । এ কাব্যে ইঙ্গিত করা হয়েছে রাণী এলিজাবেথ নারী ; কিন্তু তিনি এমন নারী যিনি ঠিক নারী নন, তিনি মূলত পরী । তিনি নিষ্পাপ এবং পবিত্র ; তিনি কুমারী এবং নারী সুলভ দূর্বলতায় আক্রান্ত নন । তিনি আবার মায়ের মতনও । ফলত এর মধ্য দিয়ে রাণী এলিজাবেথের উপর অযৌনবাচক অভিধা আরোপিত হয়েছে যার ফলে তিনি এমন সত্ত্বা হয়ে উঠেছেন যাকে আর যৌনতার মধ্যে দমন করা যায় না । তিনি হয়ে উঠেছেন প্রায়-পুরুষ । আর পুরুষের বিরূদ্ধে পিতৃতন্ত্রের সাধারণত কোন অনুযোগ বা ক্ষোভ নেই । এদিক থেকে আমরা বুঝতে পারি কেন এলিজাবেথীয় বয়ানে নারীকে বারবার দমন ও নিয়ন্ত্রণের উপায় হাজির থাকলেও রাণীর শাসনের বিরূদ্ধে পিতৃতন্ত্র ততটা উচ্চকিত হয় নি ।
আবারো হ্যামলেটঃ প্রোটেস্টান্ট না ক্যাথলিক ?
মোটা দাগে খ্রিস্টান সমাজের দুই অংশ- প্রোটেস্টান্ট ও ক্যাথলিক । পাঠিকা নিশ্চয়ই অবগত আছেন , এই দুই অংশের মাঝে আছে নানা ফারাক । ফারাকের মাত্রা এতোটাই যে একে ভিত্তি করে কয়েক শতাব্দী ব্যাপী ইউরোপকে প্রত্যক্ষ করতে হয়েছে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ । এ দুটো অংশের নানা পার্থক্যের মধ্যে একটি হলো ‘পারগেটরী’ বা ‘মৃত্যু পরবর্তী সংশোধানাগার’ নিয়ে বয়ান বিষয়ক । ক্যাথলিক সমাজে পারগেটরীর ধারণাকে গুরুত্ব দেয়া হয় কিন্তু প্রোটেস্টান্ট বিশ্বাসে পারগেটরীর ধারণাকে অ-ধর্মীয় ব্যাপার হিসেবে খারিজ করে দেয়া হয় । মজার ব্যাপার হলো , তীব্র প্রোটেস্টান্ট উন্মাদনার সময় হ্যামলেট যখন মঞ্চস্থ হল তখন আমরা দেখতে পাই ক্যাথলিক বিশ্বাসের পারগেটরী সে নাটকে হাজির হয়েছে। আমরা দেখতে পাই , হ্যামলেটের পিতা সিনিয়র হ্যামলেট সে নাটকে পারগেটরী থেকে হ্যামলেটের কাছে হাজির হয়েছেন তার মৃত্যুর কারণ সম্পর্কে তাকে অবিহিত করতে। শেক্সপিয়ার – আমরা জানি – নিজেও ছিলেন প্রোটেস্টান্ট । পুরোদস্তুর প্রোটেস্টান্ট না হলেও তাকে অন্তত দমন করতে হয়েছে তার ক্যাথলিক বিশ্বাসাদি । কেননা তখন গোটা ইংল্যান্ড জুড়ে চলছিল ক্যাথলিকদের উপর ভয়াবহ দমন পীড়ন । তাহলে প্রোটেস্টান্ট শেক্সপিয়ারের পক্ষে কি করে সম্ভব হল পারগেটরীর ধারণা মঞ্চে প্রবিষ্ট করাতে ? এমন কি হতে পারে যে পারগেটরী থেকে হ্যামলেটের পিতার ভূতকে উঠিয়ে এনে তিনি আসলে হ্যামলেটের ইল্যুশন বা অধিভাসের দিকেই ইঙ্গিত করেছেন ? নাকি শেক্সপিয়ারের চাপা পড়া ক্যাথলিক বিশ্বাস তার অবচেতনে মঞ্চে প্রবাহিত হয়ে গেছে ? আমাদের মনে রাখা দরকার, হ্যামলেট এবং তার বন্ধু হোরাশিও হল সেই বিখ্যাত উইটেনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র যে উইটেনবার্গেরই কোন এক চার্চের দরজায় প্রোটেস্টান্ট মতবাদের প্রবক্তা মার্টিন লুথার কিং তার বিখ্যাত ‘ পঁচানব্বইটি থিসিস’ গেঁথে দিয়ে পুরো ইউরোপ জুড়ে আলোড়ন তুলেছিলেন । আমাদের আরো মনে রাখা দরকার , হ্যামলেট নাটক রচনার বেশ কয়েক বছর আগে শেক্সপীয়ারের ছেলে ‘হ্যামনেট’ মারা যায় এবং প্রোটেস্টান্ট দমন পীড়নের ভয়ে ক্যাথলিক বিশ্বাসের সাথে জড়িত মৃত্যু পরবর্তী Feast এর আয়োজন করা হয় নি । এসবই কি হ্যামলেট রচনার সময় শেক্সপিয়ারের মনে ভেসে উঠেছিল ? পুত্রহারা পিতার আবেগের বহিঃপ্রকাশ কি এভাবেই উপস্থিত ক্ষমতা-কাঠামোকে চ্যালেঞ্জ করতে উদ্যত হয়ে উঠেছিল ? আমরা জানি না । আমরা যা জানি তা হল , এই নাটকটির ব্যাখ্যা এবং অর্থ যুগ যুগ ধরে নির্মীত হতে থাকবে পাঠিকাদের প্রোটেস্টান্ট বা ক্যাথলিক বিশ্বাসের উপর ভর করে ।
কিং লিয়ারঃ প্রকৃতির সাথে সংঘাত ?
এ প্রশ্নের উত্তর নির্ভর করবে ‘প্রকৃতি’ বলতে আমরা কি বুঝি তার উপর। নিখাদ ‘অবজেক্টিভ’ প্রকৃতি বলে কিছু আছে কি ? নাকি প্রকৃতি বলে যা বুঝি আমরা তা মানুষেরই সৃষ্টি ?অর্থ্যাৎ মানুষের আবির্ভাব হওয়ার আগে ‘প্রকৃতি’ নামক কোন ধারণার উৎপত্তি হতে পারে কি ? আমাদের মনে রাখতে হবে এসব প্রশ্নের উত্তরের উপরও টেক্সটের ব্যাখ্যা নির্মীত হতে থাকে। কিং লিয়ারের কথাই ধরি। লিয়ার তার সমস্ত রাজ্য তার তিন কণ্যার মাঝে ভাগ-ভাটোয়ারা করে দিতে চায় । প্রকৃতিকে ভাগ করা যায় কিনা বা প্রকৃতির মালিক থাকতে পারে কিনা তা আজকের যুগের প্রাণ প্রকৃতি ও পরিবেশ আন্দোলনের এক গুরুতর প্রশ্ন । সে যাই হোক । আমরা দেখতে পাই লিয়ারের কণিষ্ঠা কণ্যা কর্ডেলিয়া পিতার প্রতি তার ভালোবাসার জবাবদিহি করতে গিয়ে প্রথমে নিশ্চুপ থাকে এবং পরবর্তীতে সে জানায় তার আসলে কিছুই বলার নেই । লিয়ার কর্ডেলিয়ার মুখে শুনতে পায় ‘nothing’ কথাটি । আমাদের আলোচনা এই নাথিংকে নিয়ে । No-thing কি এমন Something যার কোন essence নাই ? সেহেতু কি আমরা বলতে পারি বিয়িং ( সামথিং ) এমন কিছু যা আসলে নাথিং এরই সমান ? অন্টোলজির এই প্রশ্নে না গিয়েও আমরা বলতে পারি , প্রকৃতি হলো সেই নাথিং – কর্ডেলিয়ার মতোই – যা নির্বাক , নিষ্পলক কিন্তু একইসাথে যা আবার অর্থবহ । কেননা , মানুষ প্রকৃতিরই অংশ । হেগেলের মতো বলা যেতে পারে প্রকৃতি মানুষের মধ্য দিয়েই নিজের ব্যাপারে সচেতন হয়ে উঠে । কিং লিয়ার কর্ডেলিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করতে চায় । কিন্তু কর্ডেলিয়া বা প্রকৃতিকে নিয়ন্ত্রণ করা যায় না । যেমন যায় না তাকে ভাগ করে ফেলাও । প্রকৃতি অবিচ্ছেদ্য , একে কেকের টুকরোর মত ভাগ ভাটোয়ারা করতে হলে রক্তা ঝরাতে হয় । লক্ষ্য করলে দেখা যায় , রাজনৈতিকতার এক বড় উপাদান এই প্রকৃতির উপর মানুষের আধিপত্য বিস্তারের ব্যাপারসমূহ । লিয়ারও রক্তাক্ত হয় এবং অবশেষে রাজ্য হারিয়ে বোবা প্রকৃতির কাছেই সে সমর্পিত হয় । যদিও লিয়ার শেষ পর্যন্ত আশ্রয় গ্রহণ করে প্রকৃতি বা কর্ডেলিয়ার কাছেই , কিন্তু এ নাটক সেই সাথে প্রকৃতির ব্যাপারে আরো কিছু ডিসকোর্স বা কমেন্ট তৈরি করে যায় যা শেষ পর্যন্ত প্রকৃতির ব্যাপারে ঘৃণা বা শত্রুতামূলক ধারণা পুনরুৎপাদন করতে সাহায্য করে। কর্ডেলিয়া বা প্রকৃতিকে দমন করার পথে যে ডিসকোর্স তৈরি হয় তা আমাদেরকে দুটি প্রধান ধারণায় উপনীত হতে বাধ্য করে । এক ) প্রকৃতি বধির ও বোবা বা জড় আর দুই ) প্রকৃতি নৃশংস । আর এ থেকেই তৈরি হয় প্রকৃতিকে দমন ও নিয়ন্ত্রণ করার কলাকৌশল আবিষ্কারের বাসনা ।
শেক্সপিয়ারের উপনিবেশ:
হা হা । শেক্সপিয়ারও উপনিবেশ সৃষ্টি করেছেন । বিজ্ঞ পাঠিকা জানেন যে, The Tempest নাটকের আনাচে কানাচে এ উপনিবেশের রক্তাক্ত ইতিহাস লেখা আছে । টেমপেস্ট এর প্রসপারো কৌতূহলোদ্দীপক নায়ক । সে নিজে বিতাড়িত হয় তার নিজ দেশ থেকে এবং , পরে, আশ্রয় নেয় যে দ্বীপে তার অধিবাসী বা আদিবাসী ক্যালিবানকে উৎখাত করে দাসে পরিণত করে । ঔপনিবেশিক ক্ষমতা-কাঠামো যে বয়ান তৈরি করে এই নাটকে তাতে ক্যালিবানের প্রতিরোধকেই চিহ্নিত করা হয় কৃতঘ্নতা বা নিমকহারামি হিসেবে । এমনকি এ নাটকের অন্য ধরণের পাঠেও যেখানে ক্যালিবানের প্রতি সহানুভূতি তৈরির চেষ্টা চালানো হয় সেখানেও তাকে দেখানো হয় অসভ্য এবং জ্ঞান-বিজ্ঞান হতে বিচ্যুত দানব হিসেবে । জ্ঞান বিজ্ঞান এবং অসভ্যতার দোহাই ক্যালিবানের প্রতি ঔপনিবেশিক দমন পীড়ন ও ক্ষমতা-কাঠামোর বয়ানকেই আসলে শেষ পর্যন্ত শক্তিশালী করে । কারণ এর মধ্য দিয়ে আমরা মেনে নেই , ক্যালিবান যতোই নিষ্পেষণের শিকার হোক না কেন , সে তো আসলেই মূর্খ । অতএব তার মূর্খতা গোচানোর দায়িত্ব এসে পড়ে দখলদার ক্ষমতার উপরই । আর এভাবেই ঔপনিবেশিক ডিসকোর্স তৈরিতে এ নাটক বিশেষ অবদান রেখেছে বলে তা আরো বিশ্লেষণের দাবী রাখে ।
পরিশেষে
শেক্সপিয়ারকে কীভাবে পড়া যেতে পারে তার থেকেও আরো বড় প্রশ্ন উপনিবেশোত্তর দেশগুলোতে শেক্সপিয়ার কী ভূমিকা পালন করে তা খতিয়ে দেখা । কেননা, আমরা বিশ্বাস করি যেকোন টেক্সট , বয়ান বা আলাপ সমাজে ক্রিয়া প্রতিক্রিয়ার পরিবাহক ও এজেন্ট । ফলে শেক্সপিয়ারকে আমরা কীভাবে মোকাবেলা করব তার উপর আমাদের এখানকার বিদ্যমান ক্ষমতা-বিন্যাসের বিশ্লেষণও নির্ভর করবে ।
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে মে, ২০১৬ সকাল ৯:১১
এডিট করুন
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই জুন, ২০১৬ সন্ধ্যা ৭:২৭
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

একাত্তরের এই দিনে

লিখেছেন প্রামানিক, ০১ লা মে, ২০২৪ বিকাল ৫:৩৬


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

আজ মে মাসের এক তারিখ অর্থাৎ মে দিবস। ১৯৭১ সালের মে মাসের এই দিনটির কথা মনে পড়লে এখনো গা শিউরে উঠে। এই দিনে আমার গ্রামের... ...বাকিটুকু পড়ুন

হুজুররা প্রেমিক হলে বাংলাদেশ বদলে যাবে

লিখেছেন মিশু মিলন, ০১ লা মে, ২০২৪ রাত ৯:২০



তখন প্রথম বর্ষের ছাত্র। আমরা কয়েকজন বন্ধু মিলে আমাদের আরেক বন্ধুর জন্মদিনের উপহার কিনতে গেছি মৌচাক মার্কেটের পিছনে, আনারকলি মার্কেটের সামনের ক্রাফটের দোকানগুলোতে। একটা নারীর ভাস্কর্য দেখে আমার... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইসলামের বিধান হতে হলে কোন কথা হাদিসে থাকতেই হবে এটা জরুরী না

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ০১ লা মে, ২০২৪ রাত ১০:৫৫



সূরাঃ ৫ মায়িদাহ, ৩ নং আয়াতের অনুবাদ-
৩। তোমাদের জন্য হারাম করা হয়েছে মৃত, রক্ত, শূকরমাংস, আল্লাহ ব্যতীত অপরের নামে যবেহকৃত পশু, আর শ্বাসরোধে মৃত জন্তু, প্রহারে মৃত... ...বাকিটুকু পড়ুন

লবণ্যময়ী হাসি দিয়ে ভাইরাল হওয়া পিয়া জান্নাতুল কে নিয়ে কিছু কথা

লিখেছেন সম্রাট সাদ্দাম, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ১:৫৪

ব্যারিস্টার সুমনের পেছনে দাঁড়িয়ে কয়েকদিন আগে মুচকি হাসি দিয়ে রাতারাতি ভাইরাল হয়েছিল শোবিজ অঙ্গনে আলোচিত মুখ পিয়া জান্নাতুল। যিনি একাধারে একজন আইনজীবি, অভিনেত্রী, মডেল ও একজন মা।



মুচকি হাসি ভাইরাল... ...বাকিটুকু পড়ুন

জীবন চলবেই ... কারো জন্য থেমে থাকবে না

লিখেছেন অপু তানভীর, ০২ রা মে, ২০২৪ সকাল ১০:০৪



নাইমদের বাসার ঠিক সামনেই ছিল দোকানটা । দোকানের মাথার উপরে একটা সাইনবোর্ডে লেখা থাকতও ওয়ান টু নাইন্টি নাইন সপ ! তবে মূলত সেটা ছিল একটা ডিপার্টমেন্টাল স্টোর। প্রায়ই... ...বাকিটুকু পড়ুন

×