somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

নূঢ়ার আয়নাটা

০৫ ই নভেম্বর, ২০১৫ বিকাল ৩:৪৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

সাতসকালে ডাক্তার নূঢ়া চৌধুরী যত্ন করে
গোঁফটা ছাঁটছিলেন। গোঁফ ছাঁটা কঠিন
কাজ। দুইদিকেই খেয়াল রাখতে হয়।
একদিকে ছোট করলেন তো আরেকদিকে বড়
হয়ে গেল! খুব যত্ন নিয়ে দুইদিকেই সমান
রাখতে হয়।
নূঢ়া সেটা ভালোই পারেন। দুইদিক সমান
রাখার ক্ষেত্রে তার জুড়ি নাই।
গোঁফটা ছেঁটে নিজের চেহারাটা ঘুরিয়ে
ফিরিয়ে ছোট্ট আয়নার মধ্যে দেখছিলেন।
তিনি রূপবান পুরুষ, তেল চুকচুকে চেহারা,
শরীরটা নধর। বয়স হয়েছে, চুলে গোঁফে পাক
ধরেছে, কিন্তু মেয়েরা এখনো আড়চোখে
তার দিকে তাকায়। তিনি সেটা উপভোগ
করেন, এবং সময়মতো চান্স মিস করেন না।
তরুণী রোগীর খবর পেলে দেরি না করে
ক্যাম্বিসের ব্যাগটা বগলে নিয়ে দৌড়
দেন। রোগীর হাতের নাড়ি টিপে চোখ
বুঁজে বসে থাকেন, কল্পনায় তার হাত নাড়ি
টেপা বাদ দিয়ে রোগীর শরীরের আরো
বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে বিভিন্ন জিনিস
টিপেটুপে তার কাছে ফেরত না আসা
পর্যন্ত ঝিম মেরে বসেই থাকেন।
এবং মাশাল্লা এমন বিনোদনের সুযোগ তার
জীবনে অঢেল। তিনি গ্রামের একমাত্র
এন্ট্রান্স ফেল ব্যক্তি এবং একমাত্র
ডাক্তার (হোমিওপ্যাথি)। যেমন তার
সম্মান, তেমনি তার কদর। গঞ্জের সবচে বড়
রাস্তার মোড়েই তার চেম্বার। বিশাল বড়
বড় করে লেখা : নূঢ়া হোমিও হল।
দুপুরের পর থেকেই তার সেই চেম্বারে
সারি সারি পাতা বেঞ্চে ভিড় বাড়তে
থাকে। রোগী যত না আসে, তারচে বেশি
আসে তার চামচাবৃন্দ। বিনা পয়সার চা
খায়, রোগীরা টাকার বদলে কলাটা মূলাটা
নিয়ে এলে তার ভাগ পায়, বিনিময়ে নূঢ়া
চৌধুরীকে তেল মারতে মারতে পিছলা করে
ফেলে!
গ্রামে কোথায় কার কী সমস্যা, কোন
বাড়িতে কী ঘটে, সব আলাপ সেখানে হয়।
সব আলাপ শুনে নূঢ়া একটা গলাখাঁকাড়ি
দেন, মানে এবার তিনি একটা কিছু বলবেন।
সবাই তখন চুপ হয়ে যায়, নূঢ়া তার মধুঢালা
গলায় তখন একটা নিদান দেন, তাই শুনে
সবাই বলে ওঠে, বাহবা বাঃ, এই না হলে
আমাদের নূঢ়া চৌধুরী!
এই যেমন গতকাল সকালে আলাপ হচ্ছিল
সগির মিয়ার মেয়েকে নিয়ে। সগির মিয়ার
মেয়ে ক্লাস ফাইভ পাস দিয়েছে, আরো
পড়তে চায়। কিন্তু সগির মিয়া চায় মেয়ের
বিয়ে দিতে। এই নিয়ে পক্ষে বিপক্ষে বেশ
খানিকক্ষণ আলাপ চলল, নূঢ়া আলাপ শুনতে
শুনতেই একে তাকে ওষুধ দিলেন, একটা
কমবয়সী মা জ্বরে ভোগা ছোট বাচ্চা
নিয়ে এসেছিল, ‘দেখি তোমার বাচ্চাটা
শক্তি দিয়া দুধ টানতে পারে কিনা’ বলে
আঁচল তুলে ভালোমতো মেয়েটার বুক দেখে
নিলেন। তারপর সবার আলাপ যখন শেষের
দিকে, তখন একটা গলাখাঁকাড়ি দিলেন!
সবাই চুপ করে গেল। এবার নূঢ়া চৌধুরী কিছু
বলবেন। নূঢ়া শুরু করলেন চিনিমাখা গদগদে
গলায়, তোমাদের সবার কথাই শুনলাম।
সবার কথাতেই যুক্তি আছে। মাইয়ার
পড়াশোনা করা দরকার, অবশ্যই দরকার।
শিক্ষিত মানুষ সবার উপরে, তারা গঞ্জের
অ্যাসেট, দেশের গৌরব। কিন্তু বেশি
শিখলে কী হবে জান? উল্টা পণ্ডিত হবে!
সবাইরে জ্ঞান দিবে, বাপের মাথার উপ্রে
ছড়ি ঘুরাইবে! বেয়াদব হবে। তারপর ধর,
বয়সটাও কম। বাসা থেইকা বাইর হবে,
বাইরে বাইরে থাকবে, কে কখন কোন
ফাঁন্দে ফেলবে, মাইয়া হাসিমুখে সেই
ফাঁন্দে পড়বে। সব মাস্টর তো আর সমান না,
কেউ হয়ত একলা মাইয়া পাইয়া ইস্কুলঘরের
কোনায় তার কচি বুকে হাত দিবে! (এই সময়
জমায়েতের অধিকাংশ লোকের নিঃশ্বাস
ঘন হয়ে গেল, তারা মনে মনে সগিরের
মেয়ের কচি বুকে হাত রাখতে কেমন লাগবে,
সেটা আন্দাজ করতে গিয়ে তাদের মুখ শক্ত
হয়ে গেল!)
সেদিকে তাকিয়ে পাতলা হাসি হেসে
নূঢ়া চৌধুরী বললেন, তাই বলে কি
লেখাপড়া বন্ধ থাকবে? মোটেই না! কখনোই
না! একটা বয়ান বলি শুন... (এই সময় বয়ান
শুনে সবার চেহারায় একটা আধ্যাত্মিক
ভাব চলে আসল। নূঢ়া চৌধুরী যে খালি
হানিম্যানের বই ছাড়াও আরো কত
পড়াশোনা করা লোক, সেটা দেখে সবার
চেহারায় একটা সম্ভ্রমের ছাপ পড়ে!)
সেদিকে তাকিয়ে নূঢ়া চৌধুরী আরো
একবার পাতলা হাসি হাসলেন। বললেন,
আমার কথা হইল, মাইয়ারে বিয়া দিয়া
দ্যাও। বিয়ার পর পড়াশোনা করুক! জামাই
থাকলে মাইয়ার মাথায় মালও উঠবে না,
অন্য কেউও বিয়াইত্যা মাইয়ার গায়ে হাত
দিতে সাহস দেখাইবে না!
কথা শেষ করে তিনি বিজয়ীর ভঙ্গিতে
তার বিখ্যাত চিনিমাখা ঘন মিষ্টি
হাসিটা দিয়ে সবার দিকে তাকালেন।
সবাই তার দিকে মুগ্ধ হয়েই তাকিয়ে ছিল।
রবিউল একটা বয়স্ক স্কুলে পড়ে, সেখানে
শুদ্ধ বাংলা শিখছে, সে বলে উঠল, যথার্থ
বলেছেন স্যার!
হেদায়েত গদগদ গলায় বলল, আপনারা আছেন
বলেই আমরা পথ হারাই না না স্যার!
কালাম বলল, আপনে ঠিক আমার মনের
কথাগুলাই বলে দিছেন!
মোদাচ্ছের এককালে কবিতাটবিতা লেখার
চেষ্টা করত, সে কবিতা থেকে উদ্ধৃতি দিল,
তোমারেই করিয়াছি জীবনের ধ্রুবতারা...
নূঢ়া তৃপ্তিভরা চোখে তাকিয়ে সবার
তারিফগুলো মাখনের মতো গায়ে
মাখছিলেন। এমন সময় মজনু মিয়া বলল,
স্যার, বাসায় জানে?
নূঢ়া চমকে লাফ দিয়ে উঠলেন, বাসায়
জানবে? কোনটা? কিসের কথা জানবে?
মজনু মিয়া সরল গলায় বলল, না স্যার, বললাম
আমরা আপনেরে যে এত সম্মান করি,
আপনের ওপর ভরসা করি, বাসায় ভাবি
সেইটা জাইনা খুশি হয় না?
নূঢ়া বিরক্ত গলায় বললেন, আচমকা ছাগলের
মতো আজব কথা বলবি না! ফাত্রা
কোনখানকার! পরিবেশ বুঝস না?
সবাই ঝাড়িঝুড়ি দিয়ে মজনুকে তামা
বানিয়ে এক কোনায় বসিয়ে দিল। বেচারা
মনে হয় না আর কোনোদিন আলাপের মধ্যে
কথা বলার সাহস পাবে।
তো যাই হোক, গোঁফ ছাঁটা শেষে করে মুখটুখ
ধুয়ে সাজগোজ করে প্রতিদিনের মতোই নূঢ়া
চৌধুরী চেম্বারে গিয়ে বসলেন। একটু পরেই
লোকজনের আনাগোনা শুরু হল। বিকেলের
দিকে আসল খালেক ব্যাপারী। বলল, স্যার
ঘটনা শুনছেন নাকি?
নূঢ়া বিরস গলায় বললেন, কী ঘটনা?
আমগো গঞ্জের গাতক সিধু বৈরাগীরে
কাটমোল্লার দল হুমকি দিসে! কইসে যে
কোনোদিন পাছার চামড়া তুইলা গঞ্জের
মোড়ে বাঁশে ঝুলায়া রাখব!
কও কী? কী করছিল সে?
গান বানছিল নাকি। গানের কথা হইল, যে
আমার ভগবান, সেই আমার আল্লাহ, যে
আমার অবতার, সেই আমার নবী...
কাটমোল্লারা কইছে, আল্লানবীরে নিয়া
গান লিখছস ক্যান?
নূঢ়া চৌধুরী বললেন, ঠিকই তো, আল্লানবী
কি গানবাজনার বিষয় রে? তার মধ্যে তুই
আবার হিন্দু! কাটমোল্লারা তো চেতবই!
জমায়েতের মধ্যে হিন্দু যারা তাদের মুখ
শক্ত হয়ে গেল। সেদিকে আড়চোখে
তাকিয়ে নূঢ়া তাড়াতাড়ি দরাজ গলায়
বললেন, কিন্তু এই দেশটা তো হিন্দু-মুসলমান
সবার! আমগো গঞ্জে যারা হিন্দু আছে,
আমরা তো তাগোরে সবসময় সিরকুটি দিয়া
রাখি! তারা তো আমগোরই ভাই!
হিন্দুদের মুখ নরম হয়ে গেল। সেটা খেয়াল
করে আসল কথা পাড়লেন নূঢ়া, কিন্তু কেউ
যদি আগবাড়ায়া এইসব গানবাজনা কইরা
নিজের সিরকুটি নষ্ট করে, তাইলে আমাদের
কি করার আছে? গানবাজনা তো হারাম
জিনিস!
জমায়েতের ভেতর একদলের মুখ শক্ত হয়ে
গেল। এরা যাত্রাপালা দেখে, শখের গান
গায়। সেদিকে আড়চোখে তাকিয়ে নূঢ়া
চৌধুরী বললেন, কিন্তু হারাম হইলেও
এইদেশে গানের একটা চল সবসময় আছে।
এইটা আমাগো উৎসবের একটা পার্ট।
লোকজন গানবাজনা ভালোবাসে। তবে
আমার কথা যদি বল, হামদ-নাতের মতো
মিষ্টি সুরেলা জিনিস শোনার পর কোনো
গানই আসলে ঠিক কানে লাগে না!
গানের দলের মুখ এবার নরম হয়ে আসল।
সেটা দেখে পাতলা হাসি হাসলেন নূঢ়া
চৌধুরী। তারপর বললেন, বৈরাগী মানুষ,
একটা দোষ নাহয় কইরাই ফেলসে, তাই বইলা
পাছার চামড়া না তুললেই ভালো হইত!
আরো কত জায়গার চামড়াই তো আছে!
আলাপটা ঐদিনের মতো শেষ হয়ে গেল।
দুদিন পর খালেক ব্যাপারী এসে বলল, ঘটনা
শুনসেন? সিধু বৈরাগীরে মাইরা পাছার
ছাল তুইলা গঞ্জের মোড়ে বাঁশে ঝুলায়া
রাখছে!
নূঢ়া বললেন, ইশ! মাইরাই ফেলল! কাজটা
ঠিক করে নাই! কিন্তু বৈরাগীটাও এমন
একটা গান বানল...!
খালেক বলল, আরো ঘটনা আছে।
কাটমোল্লারা চায়ের দোকানদার
খন্দকাররে কইসে যেকোনোদিন পাছার
ছাল তুইলা ফেলবে!
খন্দকার আবার কী করসে?
খন্দকারের চায়ের দোকানের মোড়ে বইসাই
তো সিধু বৈরাগী গান গাইত! এর লাইগা
হুমকি দিসে!
এইটা তো খন্দকার একটা ভুল কইরা ফেলসে!
একটু সর্তক হইব না! ভাবনাচিন্তা কইরা
কাজ না করলে ক্যামনে কী? আর তার
দোকানে বইসা লোকজনরে গান শুনতে
দেয়ারই বা দরকারটা কী?
জমায়েতের ভেতর একদল মুখ কালো করে
ফেলল। এরা খন্দকারের দোকানে নিয়মিত
চা-পান-বিড়ি খায়। সেটা আড়চোখে সরেস
গলায় বলল, কিন্তু খন্দকার লোকটা খুব
ধর্মকর্ম করে, নামাজ মিস করে না, রোজা
রাখে, ইশ এরকম এরকম একটা ভালো মানুষ
বিপদে পড়ল! আরেকটু সতর্ক হইলেই পারত...
কালো মুখ করে রাখা লোকজনের চেহারা
আবার নরম হয়ে গেল। সেদিকে তাকিয়ে
পাতলা হাসি হাসলেন নূঢ়া।
কয়দিন পর খন্দকারের ছালতোলা লাশ
ঝুলতে থাকল গঞ্জের মোড়ে। খালেক
ব্যাপারী এসে বলল, কাটমোল্লারা এবার
পানের ব্যাপারী, বিড়ির ব্যাপারী আর
চায়ের ব্যাপারীগোরে হুমকি দিসে। ওরা
খন্দকারের দোকানে জিনিস চালান দিত...
নূঢ়া বলল, ইশ আবার হুমকি? আবার লাশ?
একটা ভুলের মাশুল কোথায় গিয়া ঠেকবে।
এই লোকগুলার তো সরাসরি কোনো দোষ
নাই। যদিও এরা খারাপ জিনিস বেচত, চা-
পান-বিড়ি এগুলা তো শরীলের জন্য
খারাপ...
জমায়েতের ভেতর একদলের মুখ থমথমে হয়ে
গেল। এরা নিয়মিত চা-পান-বিড়ি খায়।
সেটা আলগোছে দেখে নূঢ়া তাড়াতাড়ি
বললেন, তবে অল্প পরিমাণে চা সকালে
খাইলে শরীরে কাজের তেজ আসে, এইটা
দরকারি! আর পান তো হজমে সহায়ক!
শক্ত মুখগুলো নরম হয়ে গেল। তাই দেখে
পাতলা হাসি হাসলেন নূঢ়া।
কদিন পর খালেক এসে কাঁপা কাঁপা গলায়
বলল, এইবার তো আমারে হুমকি দিসে!
খন্দকারের দোকানের টিন আমার দোকান
থেইকা কিনছিল...
নূঢ়া বলল, ইশ, তোমার আক্কেল কবে হইব
খালেক? যারতার কাছে টিন বেচ কেন? একটু
কম বেচলে কী হয়? যাই হোক সাবধানে
থাক, কী আর কমু?
কয়দিন পর খালেকের ছালতোলা লাশও
ঝুলতে থাকল।
চেম্বারে এখন আর লোকজন তেমন আসে না।
রাস্তাঘাটেও খুব একটা কাউরে দেখা যায়
না। সবার মনে আতঙ্ক।
কয়দিন বাদে পাংশু মুখে এল মজনু মিয়া।
বলল, স্যার ঘটনা শুনছেন?
আবার কী?
খন্দকারের দোকানে যারা পান-বিড়ি-চা
খাইতে যাইত, তাগো সবাইরে হুমকি দিসে।
আমাগো পরিচিত অনেকেই আছে ঐখানে!
নূঢ়া শুধু মনে মনে আত্মতৃপ্তির হাসি
হাসলেন, তিনি জীবনেও খন্দকারের
দোকানে যান নাই। তার আর ভয় কি!
বললেন, যাইত ক্যান ওরা? মাথায়
বুদ্ধিজ্ঞান নাই?
মজনু মুখ কালো করছে দেখে বললেন, অবশ্য
আড্ডা মারবই বা আর কই? ওগো দোষ কি!
আহা রে, তুচ্ছ আড্ডার জন্য জীবনটা
হারাইল...
কয়দিন পর মজনু এসে বলল, এইবার হুমকি
দিছে, যারা যারা চা-পান-বিড়ি খায়,
সবাইরে মারব! স্যার আমি তো আপনার
এইখানে বইসা দুই একবার চা খাইছি! সবসময়
তো আর ভাগে পাই নাই! আমার কি এতে
অপরাধ হইছে?
নূঢ়া বললেন, একবার-দুইবারে মনে হয় না
দোষ হইব! তুই কাউরে কইস না যে তুই
এইখানে চা খাইসস!
নূঢ়া মনে মনে হাসলেন। তিনি চা-পা-
বিড়ি কোনোটাই খান না। হু হু বাবা,
আমারে কারো হুমকি দেয়ার কিছু নাই!
আমি সবদিক সমান রাখি!
কয়দিন পর মজনু মিয়া আর তার মতো আরো
অনেকেরই পাছার ছালতোলা লাশ ঝুলতে
থাকল। গ্রামের জমিদার এসব দেখেও না
দেখার ভান করেন। পাইক-বরকন্দাজরা
উদাস মুখে নানান ব্যাখ্যা দিতে থাকে,
খুজতেসি... পায়া যামু... ধরমুই ধরমু...
ইত্যাদি! তাদেরও তো ভয় আছে! আর যাই
হোক, ধর্ম নিয়া যেখানে বিতর্ক,
সেইখানে মুখ খোলা তো বুদ্ধিমানের কাজ
না। ধর্ম যার যার, পাছার ছাল সবার। সেই
ছাল তুলে ফেললে তো আর করার কিছু নাই!
গ্রামে এখন পুরুষ মানুষ নাই বললেই চলে। যে
কয়জন অবশিষ্ট ছিল, সব অন্য গ্রামে
পালিয়ে গেছে। সারা গ্রামে নূঢ়া চৌধুরীই
এখন বলতে গেলে একমাত্র পুরুষ। তার ফূর্তি
দেখে কে! কারো জামাইকে মেরে
ফেলেছে, কারো ভাইকে তুলে নিয়ে গেছে,
কারো বাবাকে মেরে ফেলেছে এমন শত শত
মেয়েরা, বোনরা, বউরা শয্যাশায়ী। নূঢ়া
ঝড়ের গতিতে সবার নাড়ি টিপে বুকে
স্টেথিস্কোপ ঠেসে বেড়াচ্ছেন।
সবদিক সমান রাখার জন্য গোঁফের নিচে
থুতনিতে একঝাঁক দাড়িও রেখেছেন এই
ফাঁকে। আর মাথায় একটা কিস্তি টুপি।
মুখে আত্মবিশ্বাসের হাসি। কিস্তি টুপি
দিয়েই কিস্তিমাত করে ফেলবেন তিনি।
রাতেরবেলা বাসায় ফিরে দেখেন দরজার
নিচে একটা চিঠি। খুলে দেখেন, সেখানে
লেখা: মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত হ রে নালায়েক!
তোর চেম্বারে বসে বসে অনেক মানুষকে চা
খাইয়ে বিপথে নিয়ে গেছিস, তাই এবার
তোর পাছার ছাল ছাড়ানো হবে!
নূঢ়া চৌধুরীর গোঁফ ঝুলে পড়ল। এতই ঝুলে পড়ল
যে, দাড়ির সাথে গিঁট লেগে গেল। এরকমটা
তো তিনি ভাবেন নাই। শুকনো মুখে দৌড়ে
গেলেন জমিদারের বাড়ি। জমিদারকে
জানালেন সব। জমিদার গোমস্তাকে
ডাকালেন। গোমস্তা বলল, অসুবিধা নাই,
আপনি একটা লিখিত দরখাস্ত দিয়া যান।
আপনার বাসার সামনে দুটো পাইক থাকবে
এখন থেকে!
নূঢ়া চৌধুরী পাংশু মুখে বেরিয়ে আসছেন,
শুনলেন জমিদার বলছেন গোমস্তাকে, ইশ...
লোকটা একটু সতর্ক থাকলেই পারত! কী
দরকার ছিল লোকজনরে চা খাওয়ানোর!
এইভাবে উসকে দিলে তো আসলে করার
কিছুই নাই...
নূঢ়া চৌধুরী বাসায় ফিরে আসলেন।
পরেরদিন আর বেরোলেন না। সারাদিন
বাসায় বউবাচ্চার সাথে সময় কাটালেন।
তার বাসার সামনে গাদা বন্দুক হাতে দুই
পাইক পাহারা দিচ্ছে। মাঝে মাঝে
জানলা দিয়ে তাদের দেখেন।
মাঝরাত্রে হঠাৎ শুনতে পেলেন দৌড়ের
আওয়াজ। জানলা দিয়ে তাকিয়ে দেখেন
বন্দুক হাতে নিয়ে পাইক দুটো দৌড়ে
পালাচ্ছে। একজন আরেকজনকে বলছে, আমার
বন্দুকে গুলি নাই তোরটায় তো ছিল, গুলি
করলি না কেন?
দ্বিতীয়জন বলল, আরে ব্যাটা, আমাদের তো
শুধু পাহারা দিতে বলছে, গুলি করার অনুমতি
তো দেয় নাই!...
নূঢ়া চৌধুরী শুনতে পেলেন একতলায়
জানালার শিক কাটা হচ্ছে যন্ত্র দিয়ে।
বুঝলেন, সময় এসে গেছে। লোকাল
অ্যানেসথেশিয়ার ইঞ্জেকশনটা নিলেন
হাতে, পাছায় পুশ করলেন। মরণ তো এমনিই
হবে, পাছার ছাল তোলার যন্ত্রণা থেকে
অন্তত বাঁচা গেল!
একটু পরেই মুখে কাপড় বাঁধা কাটমোল্লারা
এসে দাঁড়াল সামনে। নূঢ়া চৌধুরী কাঁদো
কাঁদো গলায় বললেন, দেখেন আপনেরা
যেটা করতেছেন, সেটা ঠিক না!
একজন হিংস্র গলায় বলল, কী বললি?
নূঢ়া খাবি খেয়ে দুইদিক সমান রাখা সুরে
বললেন, অবশ্য আমার আরো সর্তক হওয়া
দরকার ছিল। যদিও আমি নামাজ পড়ি,
রোজা রাখি, হাদিসের বয়ান দেই, তবু,
কিন্তু, তবে...
পরদিন সকালে বিশিষ্ট ডাক্তার নূঢ়া
চৌধুরীর ছালতোলা বডি ঝুলতে থাকল
গঞ্জের মোড়ে।
আর নূঢ়ার আয়নাটা এখনো পড়ে আছে
চেম্বারে। যে কেউ চাইলেই সেখানে
নিজের চেহারা দেখতে পারেন...
২টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

একাত্তরের সংগ্রামী জনতার স্লুইস গেট আক্রমণ

লিখেছেন প্রামানিক, ০৯ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৩:২১


(ছবির লাল দাগ দেয়া জায়গাটিতে গর্ত করা হয়েছিল)

শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

২৩শে এপ্রিল পাক সেনারা ফুলছড়ি থানা দখল করে। পাক সেনা এলাকায় প্রবেশ করায় মানুষের মধ্যে ভীতিভাব চলে আসে। কারণ... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাড়ির কাছে আরশিনগর

লিখেছেন রূপক বিধৌত সাধু, ০৯ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৩:৫০


বাড়ির কাছে আরশিনগর
শিল্পকলা একাডেমির আশেপাশেই হবে চ্যানেলটার অফিস। কিছুক্ষণ খোঁজাখুঁজি করল মৃণাল। কিন্তু খুঁজে পাচ্ছে না সে। এক-দু'জনকে জিগ্যেসও করল বটে, কিন্তু কেউ কিছু বলতে পারছে না।

কিছুদূর এগোনোর পর... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমি ভালো আছি

লিখেছেন জানা, ০৯ ই মে, ২০২৪ রাত ৮:৪৯



প্রিয় ব্লগার,

আপনাদের সবাইকে জানাই অশেষ কৃতঞ্গতা, শুভেচ্ছা এবং আন্তরিক ভালোবাসা। আপনাদের সবার দোয়া, সহমর্মিতা এবং ভালোবাসা সবসময়ই আমাকে কঠিন পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে শক্তি এবং সাহস যুগিয়েছে। আমি সবসময়ই অনুভব... ...বাকিটুকু পড়ুন

স্বাধীনতার সুফল কতটুকু পাচ্ছে সাধারণ মানুষ

লিখেছেন এম ডি মুসা, ০৯ ই মে, ২০২৪ রাত ১১:২৮

(১) আমলা /সরকারের কর্মকর্তা, কর্মচারীর সন্তানদের জন্য আলাদা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করার প্রস্তাব হতাশাজনক। মুক্তিযুদ্ধের ১৯৭১ সালের রক্ত দেওয়া দেশের এমন কিছু কখনো আশা কি করছে? বঙ্গবন্ধু এমন কিছু কি আশা... ...বাকিটুকু পড়ুন

এলজিবিটি নিয়ে আমার অবস্থান কী!

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১০ ই মে, ২০২৪ সকাল ৮:১৫

অনেকেই আমাকে ট্রান্স জেন্ডার ইস্যু নিয়ে কথা বলতে অনুরোধ করেছেন। এ বিষয়ে একজন সাধারণ মানুষের ভূমিকা কী হওয়া উচিত- সে বিষয়ে মতামত চেয়েছেন। কারণ আমি মধ্যপন্থার মতামত দিয়ে থাকি। এ... ...বাকিটুকু পড়ুন

×