আমি অনেক ভেবেছি। দিন-রাত। সকাল-সন্ধ্যা। দুপুর। বিকেল। অনবরত। একটানা। নিরবিচ্ছিন্ন। অনেক ভেবেছি আমি। আমার মাথায় ছিলো জমাট বাঁধা ভাবনার কাঁচামাল। তা থেকে প্রতিনিয়ত তৈরি হয়েছে একেকটি চিন্তা। চিন্তার রেখা অস্পষ্ট আর ঝাপসা হয়েছে। ক্রমে ক্রমে আমার ভাবনার দড়িগুলো ওলোট পালোট হয়ে জট পাকিয়েছে। এবং শেষমেষ তা রূপ নিয়েছে দুশ্চিন্তায়।
তখন আমার দুশ্চিন্তার দিন। আমি এটা সেটা ভাবতে ভাবতে কাটিয়েছি অজস্র নির্ঘুম রাত। ভাবতে ভাবতেই আবার ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়েও পড়েছি কোনো কোনো রাতে। দুঃস্বপ্ন অথবা স্বপ্নহীন ঘুম। অগভীর অতৃপ্তির ঘুম। সময় সময় ঘুমের ভেতরই আঁতকে উঠেছি। আমার দুশ্চিন্তার কোনো শেষ ছিলো না তখন। যে কোনো কিছু নিয়েই ভীষণ দুশ্চিন্তা হতো আমার। কুঁকড়ে যেতাম। নিজেকে পরাজিত ভাবতাম। কাল্পনিক ভয়াবহতার কথা স্মরণ করে ডুকরে কেঁদেও উঠতাম কখনো কখনো।
আমার যন্ত্রণা হতো। ভীষণরকম। অদ্ভুতরকম। জটিল আর অসহ্য যন্ত্রণা। কাউকে বলা যায় না এমন যন্ত্রণা। বললেও কেউ বুঝবে না এমন যন্ত্রণা। নিজের ভেতর নিজেকে আবিষ্কার করলাম সঙ্গীহীন বিবর্ণ পাণ্ডুর একা।
মাথা দিনে দিনে ভারী হয়ে উঠতে থাকলো। নিজের মাথাকে নিজেই আর বহন করতে পারছিলাম না। আমার ঘাড় নুয়ে পড়ছিলো। আমার শরীর হয়ে উঠছিলো ক্লান্ত বিধ্বস্ত রোগা। চোখ দুটো কোটরের ভেতরে পালিয়ে যাচ্ছিলো। আয়নায় চোখের নিচে কালি দেখে নিজেই একদিন চমকে উঠেছিলাম। কিন্তু তবুও দুশ্চিন্তা আমাকে ছেড়ে যাচ্ছিলো না। আষ্টেপৃষ্টে বেঁধে নিয়েছিলো আমার মস্তিষ্ক। অধিকার করে বসেছিলো আমার সমস্ত সময় হৃদয়। আমি ক্ষয় হয়ে যেতে থাকলাম ভেতরে ভেতরে। কেউ জানলো না। জানতে চাইলোও না।
আমার প্রিয়মানুষ আমাকে ছেড়ে গেল। সামান্য অজুহাতে আমাকে একেবারে একা করে দিয়ে গেল। উফ, সেইসব দিন আমি অনেকবার ভেবেছি গোটা বিশেক ঘুমের বড়ি মুখে পুরে দিয়ে নির্জীব হয়ে পড়ে থাকবার কথা। ভেবেছি, আট-দশটা প্যাথেড্রিন ইনজেকশন নিয়ে এইবার যাত্রা শেষ করি। আমাকে বোধহয় আর প্রয়োজন নেই পৃথিবীর। হতাশা, অবসাদ আর অবহেলায় আমার ভেতরের আমি একেবারে শুকিয়ে মরে যেতে থাকলো। নিজেকে গুরুত্বহীন ভাবতে শুরু করলাম। কেউ মূল্য দিলো না এমন ভাবনায় আমার আকাশ ভারী হতে হতে আচমকা মাথায় ভেঙে পড়লো।
পরিবারে আমার কথার কোনো গুরুত্ব রইলো না। আমি যে একজন পরাজিত তা আমাকে আকারে ইঙ্গিতে সবসময় বুঝিয়ে দিতে শুরু করলো আমারই আপন মানুষেরা। যাদের সাথে থাকবো বলে ঈশ্বর নির্দিষ্ট করে দিয়েছিলেন জীবনসীমা, তারাও আমার যন্ত্রণার কথা না জেনে আমাকে আরো পৃথক করে দিতে শুরু করলো। আমার মূল্য নিরূপিত হলো আমারই সমবয়সী অন্য সফল মানুষদের মানদণ্ডে।
আমার একজন বাল্যবন্ধু সরকারী উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। কেউ কেউ ডাক্তার। কেউ ইঞ্জিনিয়ার। ডিফেন্স আর মেরিনেও আছে কেউ কেউ। কেউ আবার খুব বড়ো সাহিত্যিক বা কবি হয়ে গেছে। কেউবা সফল ব্যবসায়ী। কেউ ব্যাংকার। কিন্তু আমি ছাপোষা একজন; ওসব সফল আর খ্যাতিমান পেশার একটিও নিজের অধিকারে নিতে পারিনি। অতএব আমার জীবন ব্যর্থ হয়ে গেলো। যাও বা একজনকে ভালোবাসলাম সেও চলে গেল ওই সামান্য অজুহাতেই। আমার সাথে তার মেলে না। আমি অন্যরকম একজন।
আমি অসফল একজন। আমার প্রিয় মানুষ থাকতে নেই। থাকতে নেই পরিবারের কাছে কাছে স্নেহ-মমতা-সহমর্মিতা-সমবেদনা, বন্ধু বান্ধবের কাছে গুরুত্ব। এমনকি অপরিচিত জনেরাও আমার প্রতি একটি কটাক্ষ নিক্ষেপ করে অমনি মুখ ফিরিয়ে নিতে লাগলো। আমি একেবারে একা হয়ে গেলাম। আমার অস্তিত্বের কোনো অর্থ খুঁজে পেলাম না পৃথিবীতে।
পৃথিবী আমার জন্য নয়। আমি আপাদমস্তক অসফল অপ্রয়োজনীয় মানুষদের একজন - এ কথাটাই হাতুড়িপেটা করে সবাই আমাকে বুঝিয়ে দিলো। দুশ্চিন্তায় পঁচে যেতে থাকলো আমার অন্তকরণ। অগ্রজের তাচ্ছিল্য আর অনুজের অসম্মানে আমি মধ্যমমানের মানুষ একেবারে নিম্নমানের একটি সিদ্ধান্তে আসার কথা ভাবতে থাকলাম। ভাবলাম একটা চলন্ত ট্রেনের নিচে আমার যন্ত্রণার চিরসমাপ্তি টেনে দেই। কিংবা বহুতলের উপর থেকে নিজেকে শূন্যে ভাসিয়ে দিয়ে দুম করে চলে যাই ভূ-গর্ভে। সত্যিই আমি আর পারছিলাম না বেঁচে থাকার ভার বইতে।
একদিন মধ্যরাতে বের হলাম মৃত্যুর দিকে। ভ্রু কুচকাবেন না প্লিজ। আমাকে এ জীবনে একবারও ভালোবাসলেন না। উপেক্ষা করলেন। অবহেলা করলেন। দিলেন অসীম যন্ত্রণা। আর আমি তার ভার সইতে না পেরে নিজেকে সরিয়ে নিলেই - তা হয়ে যাবে আত্মহত্যা?
আপনারা সফল মানুষের গুহ্যদ্বার চুম্বন করুন। তাদের টাকে আরো তেল ঢেলে দিন। তাদের স্ত্রীদের শপিং ব্যাগ বহন করুন। তাদের সন্তানদের অত্যাচার সহ্য করুন। ঘুষ দিন। তোষামোদ করুন। উপার্জন করুন। সফল হোন। খ্যাতি অর্জন করুন। কিন্তু দয়া করে আমার মতো অধমের মৃত্যুতে ‘উহু আহা’ করবেন না।
আর হ্যাঁ, নরকের ভয় আমাকে দেখাবেন না। আমি আপনার মতো পরজীবনের হাতি-ঘোড়া-উটে বিশ্বাসী নই। জীবনটাই যে একটা ভরপুর নরক সে জ্ঞান আমার হয়েছে। আপনারাই আমাকে বাধ্য করেছেন। আমার প্রিয় মানুষ আমাকে সে জ্ঞান দিয়েছে। আমার পরিবার আমাকে সে উপলব্ধি দিয়েছে। আমার বন্ধু এমনকি অপরিচিতজনেরাও ... না থাক। ওসব বলে লাভ নেই।
হাঁটতে হাঁটতে আমি পৌঁছে গেলাম রেললাইনের ধারে। ট্রেন আসতে কতো দেরি - জানিনা। অপেক্ষা করছি। উপরে অসীম আকাশ। চন্দ্রতারকাখচিত। বাতাসে শীতল আবহ। যাক, জীবনের শেষ ক্ষণে তাও কিছুটা ভালো লাগা কাজ করছে। একটা দীর্ঘশ্বাসে পিছনের সব হিসাব-নিকাশ আর সম্পর্কের টানাপোড়েনকে আড়াল করে আমি রেললাইনের পাতের উপর দৃষ্টি নিক্ষেপ করলাম।
আচমকা একটা শীতল শিহরণে শরীরটা কেঁপে উঠলো। আমার মতো পরাজিত মানুষ তো শুধু আমি একা নই। এই ট্রেন লাইনের দুই পাতের মাঝে কতো অবহেলিত, উপেক্ষিত, অত্যাচারিত, বিপর্যস্ত মানুষ আমারই মতো নিজেকে নিঃশেষ করে দিয়েছে মৃত্যুতে। একটু পরিত্রাণ লাভের আশায় কতো প্রাণ অকালে ঝরে গিয়েছে আমারই মতো। ইশ, তাদের যদি একটু ভালোবাসা যেতো। একটু মমতার হাসি নিয়ে কাঁধে একবার হাত রাখা যেত। তাদের কপালের ঘাম মুছে দিয়ে যদি বলা যেত, আরে ধুর, কি হয়েছে? সবাইকে সফল হতে হবে কেন? তুমি থাকো না নিজের মতো - তাহলে হয়তো তারা বেঁচে যেতো।
নাহ, এসব আমি কি ভাবছি। ওই তো ট্রেন এগিয়ে আসছে। মধ্যরাতের নিস্তব্ধতাকে হাজার লোহার চাকার নিচে দুমড়ে মুচড়ে ট্রেনটা ছুটে আসছে আমার দিকে। কিছুক্ষণ পরই আমি আর থাকবো না। হে পৃথিবী তুমি তোমার তোষামুদে সফল মানুষগুলোকে নিয়ে আরো কিছুকাল বেঁচে থাকো। আমি চললাম। আমাকে বিদায় দাও।
একি? ওটা আবার কি?
দৌড়ে গেলাম। একটুর জন্য বাঁচানো গেল। উফ, এক্ষুনি মারা পড়তো পাখিটা। এখানে এলো কোত্থেকে? একটা ডানা ভেঙ্গে গেছে দেখছি। এজন্যই হয়তো উড়তে না পেরে রেললাইনের পাতের উপর আছড়ে পড়েছে। আর আমারও ট্রেনটা মিস হলো। আবার পরবর্তী ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করতে হবে।
পাখিটার ডানায় রক্ত। এতো দেখছি একটা কাক। যাহোক, আমি শার্টের কোণা খানিকটা ছিঁড়ে রক্ত মুছে দিলাম। পাশ থেকে কিছুটা দূর্বা হাতে ডলে নিয়ে ভাঙা পাখাটার উপর চেপে ধরলাম। ছেঁড়া কাপড়টুকু দিয়ে বেঁধে দিলাম ডানাটা। রক্ত পড়া বন্ধ হয়েছে। কিন্তু এতো রাতে কাকটার এ অবস্থা হলো কি করে? যাকগে আজ আর ভালো লাগছে না। পাখিটাকে একটা নিরাপদ ঝোপে রেখে দিয়ে বাড়ির দিকে পা বাড়লাম। পাখিটার কষ্টে এক মুহূর্তের জন্য নিজের দুঃখের কথা আর মনেই রইলো না।
পরদিন সকালে আবার বেরিয়ে পড়লাম। দুইঘন্টা বাসে চেপে গেলাম শহরের সবচেয়ে বড়ো ভবনের সামনে। সিকিউরিটির চোখ ফাঁকি দিয়ে উঠে গেলাম বহুতলের ছাদে। আর কোনো ভয় নেই। এইবার শূন্যে ভাসবো আমি। একেবারে রেলিং ঘেষে দাঁড়ালাম। একবার আকাশের দিকে তাকালাম। একবার জগতের দিকে।
নিচে একটা ডাস্টবিন দেখা যাচ্ছে। অনেক ছোট ছোট ছেলে সেখান থেকে কি যেন কুঁড়িয়ে নিয়ে মুখে পুরে দিচ্ছে। আশ্চর্য তো! ও কি? ওই লোকটা আচমকা ছেলেগুলোকে পেটানো শুরু করলো কেন? পরিত্যাক্ত জিনিসেও কি সে নিজের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে চায়? তাহলে এই অনাথ শিশুগুলো কি খাবে? ওদের বেঁচে থাকার কি মানে?
রাগে ঈশ্বরের মুখে থু থু দিতে ইচ্ছে হলো। সমাজে এমন বৈষম্য তৈরি করে রেখেছেন তিনি অথচ তিনি প্রচার করেন তিনি নাকি অসীম দয়ালু। কি নিষ্ঠুর কৌতুক! তাই যদি হবেন তবে জগত এতো দুঃখময় কেন?
উফ, আমার বিরক্ত লাগছে। রাগে, ক্ষোভে এবং দুঃখে চোখে জল এলো আমার। আমি নেমে আসলাম বহুতল থেকে। আমার চেয়ে দুঃখী মানুষের কোনো অভাব পৃথিবীতে নেই। আমি কেন মরবো? আমি এই দুঃখ আর উপেক্ষার শেষ দেখবো।
আমি মরবো না। কিন্তু তাই বলে বাড়িতেও ফিরে যাবো না। আমি আমার এ অসফল জীবন নিয়ে অন্য কোথাও যাবো। যেখানে কেউ আমাকে চিনবে না সেখানেই আমি রচনা করবো একটি নতুন জীবন। হয়তো অসফল হবো। কিন্তু তবুও আমি আত্মহত্যা করবো না। কারণ আমার চেয়ে অসফল মানুষ পৃথিবীতে আছে। আমার চেয়ে দুঃখী আর অবহেলিত মানুষে পৃথিবী পরিপূর্ণ। আমি তাদেরকে ভালবাসবো।
এখন আমি জানি, বেঁচে থাকাটাও একটা দারুণ ব্যাপার। আর এও জানি, আপনারা যতোই সফল মানুষদের গুহ্যদ্বার চুম্বন করে তৃপ্ত হোন না কেন, আপনারা একেকজন মৃত মানুষ। আমি আর কখনোই মৃত মানুষ হবো না। সফল মানুষও না। আমি শুধুই মানুষ হবো। একজন সামান্য মানুষ। কেননা জনসংখ্যার বৃদ্ধি যতোই উর্ধোমুখি হচ্ছে পৃথিবীতে মানুষের সংখ্যা ততই কমে আসছে।
(২৭/০৬/২০১৪)
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে জুন, ২০১৪ সন্ধ্যা ৭:২১