somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গল্পঃ উড্ডয়ন

১৩ ই জানুয়ারি, ২০১৬ রাত ১০:২৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



এখন বরফের মত শীতকাল। বাসেদের ছোট্ট ঘর শব্দহীন। ঘরঘর শব্দওয়ালা ফ্যানটা হাইবারনেশানে। ভালো লাগে না শব্দহীন জগত। নিস্তব্ধতা মৃত্যুর মত।

বহুতল মেসের যে কামরায় ও থাকে, তার সামনে ছোট্ট একটা করিডোর। ব্রাশে দাঁত ঘষতে ঘষতে বাসেদ করিডোরে দাঁড়িয়ে বাইরে তাকায়। কিছুই দেখা যাচ্ছে না। কুয়াশার পুরু চাদরে সকালের এই পৃথিবী বন্দী। হয়ত আজ সারাদিনটাই এমন কুয়াশাচ্ছন্ন থাকবে কিংবা দুপুর যখন পশ্চিমে গা হেলিয়ে পড়বে তখন খানিকটা রোদ ফুটবে।

ঘরে এসে বাসেদ কালো রঙের শালটা গায়ে জড়িয়ে নেয়। তারপর মুঠোবন্দী হাত চাদরের ভেতরে পাঠিয়ে দিয়ে বেরিয়ে পড়ে। উদ্দেশ্য চায়ের দোকান। এতক্ষণে নিশ্চয়ই জহির আর রাসেলও চলে এসেছে। ওরা বাসেদের চা-বন্ধু। চা খেতে খেতেই একদিন ওদের আলাপ-পরিচয় হয়। দেশের ছেলেরা সেদিন ক্রিকেট খেলছিল টেলিভিশনে।

-- হা হা দ্যাখছেন, তামিম হালায় কী মাইরডা দিল এই ওভারে ! – জহির পাশে বসে থাকা ছেলেটার দিকে তাকায় হাসিমুখে।
রাসেল হাসিমুখ সম্মতি জানিয়ে বলে, আবার জিগায়, আমগো জিত আইজক্যা কেউ ঠেকাইতে পারব না।

ধীরে ধীরে কাঁপের শরীরে ঠোঁট ছুঁইয়ে উত্তাপ বোঝার চেষ্টা করে বাসেদ। সহ্যসীমা পার হবে না নিশ্চিত হয়ে এক চুমুক খায়। তারপর, পাশে-বসা দুজনের মতই হা করে টিভি স্ক্রিনের দিকে তাকায়। ওর খুব ইচ্ছে হয় আলোচনায় যোগ দিতে। দেশ ভালো খেলতে শুরু করলে সবাই ক্রিকেটানুরাগী হয় বলেই বাসেদ আলোচনায় ঝাঁপ দেয়,

– তয় যা-ই কন, দেইখ্যা শুইন্যা না খ্যাললে জিতার পারুম না। আমগো উইকেট পড়বার লাগলে তো আর থামারই চায় না।

জহির আর রাসেল ওর দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়ে। সমস্ত সময়টায় আরো কথা বিনিময় হয়। একসময় উত্তেজনা, আশংকা আর প্রত্যাশার ঘাত প্রতিঘাতে জর্জরিত হয়ে দেশের ছেলেরা জিতে যায়। আনন্দে ওরা তিনজনও লাফিয়ে ওঠে। কোলাকুলি করে। আর তারপর চা দোকান থেকে একটা স্টিলের প্লেট নিয়ে, তাতে লাঠির বাড়ি দিয়ে মিছিল গোছায়। নিখাঁদ এই উল্লাসে ছেলে-বুড়োরাও যোগ দেয়। দেখে মনে হয়, সবাই যেন আনন্দের এমনই কোনো উপলক্ষ্যের জন্যে অপেক্ষায় ছিল বহুদিন।

পরদিন সকালে আবার চা-দোকানে দেখা হয়ে গেলে ওরা তিনজন আবিষ্কার করে – ওদের মধ্যে সখ্য হয়ে গেছে।




দোকানে পৌঁছুতেই বাসেদ পায়ের উপর পা তুলে আয়েশ করে বসে। চারপাশটায় একবার চোখ বুলায়। তারপর বলে, বাশার ভাই, লেবু মাইরা এক কাপ চা লন চটজলদি।
বাশার ভাই গরম পানি দিয়ে কাপগুলো ধুয়ে নেন। তারপর কাঁপের ভেতর দু’চামচ চিনি ফেলে দেন। বাসেদ তাকিয়ে থাকে। তখন কেটলির পানি ছাঁকনির ভেতরকার চা-পাতা ভিজিয়ে দিয়ে লিকার হয়ে কাপে পড়ে। রঙিন এই খেলা দেখে মুগ্ধ হয় বাসেদ। চায়ের কাপে লেবুর রস ফেলতেই রঙ বদলে যায়। বদলে যায় স্বাদ। বাসেদ চায়ে ঠোঁট ভেজায়। বলে, পাত্তি লেবুর সোয়াদই আলাদা, আহ।

আজ রাসেল কিংবা জহির কেউই আসেনি। হয়ত খানিকক্ষণ পরে আসবে কিংবা আসবে না। বাসেদের চা শেষ হয়ে আসে।
-- আইজ আমগো রাসেল-জহির কেউরে যে দ্যাকতাছি না ?
-- হ, অহনতরি আইয়ে নাই। মনে কয়, আইয়া পড়ব।
বাসেদ চারপাশটা আরেকবার দেখে নিয়ে বলে, থাউক, আইযক্যা আর বমু না। যাইগা। আইলে কইয়েন আমি আইছেলাম।

শিমুল তুলোর মত কুয়াশা কেটে বাসেদ এগোতে থাকে। হাত দুটো চাদরের ভেতরে ঢুকিয়ে শান্ত ভঙ্গিতে চারপাশটাতে চোখ বোলায় এবং একসময় একজন পাখিওয়ালাকে দেখে থামে। লোকটা ফেরি করে পাখি বিক্রি করছে। খুব সুন্দর টকটকে লাল-ঠোঁট পাখি। বাসেদ লোকটার কাছে এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করে, আপনের পক্ষীর নাম কী? পাখিওয়ালা পা থেকে মাথা পর্যন্ত তাকিয়ে বাসেদকে একবার মেপে নেয়। বলে, পাখি তো আমার না। আল্লার পাখি। আমি ধইরা ধইরা বেচি। বাসেদ ভুল শুধরে বলে, আপনের আল্লার পাখির নামডাই কন?

-- এই পাখির নাম হীরামন।

নামটা খুব ভালো লাগে বাসেদের। দরে পোষালে নেবে এমন একটা ভাব নিয়ে জিজ্ঞেস করে, আলা কন, আপনের আল্লার পাখি শব্দ করব তো? ডাকব তো? না ডাকলে হুদাকামে নিয়া লাভ কী?
পাখিওয়ালা যেন এই প্রশ্নের জন্যেই অপেক্ষা করছিল। বলল, এই পাখি ডাকব, কথা কইব। আর একজোড় নিলে ডিম পাড়ব, বাচ্চা ফুটব। দামেও সস্তা। নিবেন নাকি ভাইজান?
-- ডিম দিয়া কি করমু। আইচ্ছা কন, হীরামন কী খায়?
-- যা খাওয়াইবেন তাই খাইব। ফল-ফলাদি, ধান-গম, মরিচ, ফুলের রেণু সব।
-- আইচ্ছা, আলা কন দাম কত?
পাখিওয়ালা ময়লা দাঁতের পাটি বের করে হাসে। বলে, একদম পানির দামে বেচতাছি ভাইজান, ৩০০ ট্যাকা কইরা।
দাম শুনে বাসেদ পকেটে হাত চালিয়ে টাকা স্পর্শ করে। কপালে ভাঁজ ফেলে বলে, অত ট্যাকা তো নাইক্যা।
পাখিওয়ালার স্বর কিছুটা নিস্প্রভ হয়ে আসে।
-- ভাইজান কত দিবেন, শুনি।
-- দুইশো ট্যাকা।

পাখিওয়ালা কিছু একটা ভাবল। তারপর বিড়বিড় করে হিসেব নিকেশ করতে করতে বলল, না ভাইজান, এই দামে পোষাইব না। আর পঞ্চাশখান ট্যাকা বাড়াইয়া দেন। হীরামন খুউব ভালা পাখি।
-- থাকলে তো দিমু। আপনের না পোষাইলে থাউকগা।
-- আইচ্ছা নেন, আপনেরে দিয়া আইজক্যা বউনি করি।

বাসেদ পছন্দসই একটা হীরামন বেছে নিল। সবুজ দেহের জমিন, লাল ঠোঁট আর গলায় কালো রিঙ। একটা ছোট খাঁচায় হীরমানকে পুরে বাসেদ ওর কামরামুখি পা বাঁড়ায়।




দুপুর নাগাদ হীরামনের খবর জহির আর রাসেলের কানে পৌঁছায়। ওরা হাজির হয় কিছু কাঁচামরিচ সঙ্গে করে। বাসেদ, তোমার পাখির লাইগ্যা আনলাম, দ্যাহোতো খায় কিনা। বাসেদ দেয়ালে খাঁচাসমেত পাখিটার দিকে তাকায়। খাঁচার শিকের ভেতর দিয়ে একটা কাঁচামরিচ এগিয়ে দিয়ে বলে, হীরামন আলা খাও, খাও।

হীরামন লোহার শিকে শক্ত করে পা আঁটকে রেখে দুইবার ডানা ঝাপটায়। বাসেদ খুশিতে জহিরের দিকে তাকায়, যেন হীরামন ওর কথা বুঝতে পেরেছে। রাসেল আরো একটা কাঁচামরিচ খাঁচার শিক গলিয়ে দেয়। হীরামন খপ করে টেনে নেয়। জহির, রাসেল আর বাসেদের মুখে হাসির ফোয়ারা ছোটে।

শীতের রাত নির্জনতা আনে, নিঃসঙ্গতা আনে। বাসেদের একলা থাকার কষ্ট বাড়ে। ও মুখোমুখি দেয়ালে খাঁচার পাখিটার দিকে তাকায়। তাকিয়েই থাকে। মনে মনে ভাবে – আল্লার পাখি কী তাজ্জব জিনিস। আমগো চাইয়া রঙিন দেহা যায়। একসময় বাসেদ ওটাকে খাঁচা থেকে বের করে হাতের ওপর রাখে। হীরামন উড়ে না গিয়ে বাসেদের হাতে বসে থাকে। বাসেদ ওর পিঠে হাত বুলিয়ে দেয়। তারপর হীরামনকে বিছানায় রেখে – হীরামনের দিকে মুখ করে শুয়ে পড়ে। পাখিটা যেন একদিনেই পোষ মেনে গেছে এমনি শান্ত হয়ে বসে থাকে। অবাক চোখে বাসেদ শুধু ভাবে, আল্লার পাখি সত্যই কী তাজ্জব জিনিস ...!

পাখির চোখে তাকাতে তাকাতে একসময় ওর চোখের পাতা ভারী হতে থাকে। চোখের সামনে দৃশ্যপট দ্রুত বদলাতে শুরু করে। বিচিত্র সব ঘটনার ঘনঘটা যেন শ্রাবণের বৃষ্টির মত নামতে থাকে ঝরঝরিয়ে। ঘরময় পাখির ডাকাডাকি টের পায় বাসেদ। তবু চোখ ঘুরিয়ে সত্য যাচাইয়ের শক্তি থাকে না ওর। ও হীরামনের চোখের গভীরে এক অন্য জগতে চলে যায়।

বাসেদ বিশালাকার একটা গাছের একদম মগডালে বসে আছে। বটপাতার মত পাতাময় এ গাছের নাম সে জানে না। ছোট ছোট শাখা-প্রশাখার ফাঁকে লাল-বাদামী অসংখ্য ফল ধরে আছে। থোকা থোকা। ফলের গায়ে পাখির ঝাঁক, মৌমাছির উড়াউড়ি। চারপাশে যতদূর দৃষ্টি যায় - সবুজে সবুজ। লোকালয়ের কোনো চিহ্ন নেই। দূরে একদল বানর এ গাছ থেকে সে গাছে লাফিয়ে পড়ছে, ঝুপঝাঁপ শব্দ করে। পাখির কিচিরমিচির আওয়াজে সমস্ত জায়গায় একটা তরঙ্গ বয়ে যাচ্ছে। বাসেদ দেখল, পাশের গাছটা থেকে দুটো কাঠবিড়ালি যেন তীরবেগে নিচে নেমে গেল কেবলই। আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখল; আকাশ নীল। বরফের চাঁইয়ের মত টুকরো টুকরো মেঘ ভেসে যাচ্ছে। আর তারই ভেতর দিয়ে সূর্যের সোনা-রঙ ঝরে পড়ছে বনবীথিকায়। হঠাৎ দমকা হাওয়ায় বাসেদ ডালসমেত কেঁপে উঠল। সাবধানে খানিক নিচে নেমে এসে একটা শক্ত ডালে পা রেখে ডাকল, হীরামন, হীরামন...

হীরামন উড়তে উড়তে ওর কাঁধে এসে বসল। তারপর - জানে না কেন - পাখি সাথে নিয়ে উঁচু সেই গাছের ডাল থেকে বাসেদ লাফিয়ে পড়ল।




ঘুম ভাঙতেই – বেঁচে আছি – এই ভেবে বাসেদের মন আনন্দে ভরপুর। তাকিয়ে দেখল, ওর হীরামন দেয়ালে ঝোলানো খাঁচার উপরে বসে। বাসেদ পাখিটার কাছে গিয়ে ডাকল, হীরামন, ও হীরামন, মরিচ খাইবা। পাখিটা দু’বার ডানা ঝাপটে একটা তীক্ষ্ণ শব্দ করল। বাসেদ পাখিটাকে হাতের ওপর বসিয়ে মরিচ খাওয়াতে খাওয়াতে ভাবল, পাখিও পোষ মানে অথচ মানুষ?

রাস্তায় নামতেই জহিরের সাথে দেখা হল বাসেদের। তোমার হীরামনের লাইগ্যা দুইডা দানা আনলাম। জহির একটা শস্যদানার প্যাকেট এগিয়ে ধরল। বাসেদ হাসিমুখে হাত বাড়িয়ে নিল। আজ খুব একটা কুয়াশা নেই। সূর্যের লালিমা কুয়াশা ঝেটিয়ে বিদায় করেছে আগেই। জেগে উঠছে চারপাশ। মানুষের হাক-ডাক। রিকশার টুং-টাং। দোকানের কপাট খোলার ধাতব শব্দ। সবকিছু মিলে মিশে আজকের সকালটা জীবন্ত। ওরা দুজন জীবন্ত শহরের প্রাণবায়ু শুষে নিয়ে এগোচ্ছে। জহির মাথার মাফলারটা খুলে গলায় ফেলে রাখল। বাসেদ জহিরের দিকে তাকায়,

-- হইছে কি , আইজক্যা তো হীরামনরে লইয়া খোয়াব দ্যাখলাম।
-- হাঁচা নি , কী দ্যাখলা?
-- দ্যাখলাম হীরামনরে লইয়া বনেত গেছি। ইয়া লম্বা এক গাছের আগাত।
-- হেরপর ?
-- হেরপর, হীরামনের লগে একলগে ফাল দিছি গাছের থন।
-- হা হা হেব্বি খোয়াব দ্যাখছো তো ! তা ফাল দিবার গেছ ক্যা?
-- খোয়াবের মইদ্ধে উড়বার মনে চাইল।
-- কি যে কও বাসেদ, মাইনষে কি আর উড়বার পারে ! মাডি মাইনষেরে ছাড়ে না ।
-- তা হাঁচাই কইছো। রাসেল কোনে, হেরে যে দ্যাকতাছি না?

ওরা কথা বলতে বলতে এগোয়। ওদের কথা রাসেল থেকে রইসুল, নওশাদ আর হালিম হয়ে কারখানা, মেশিন আর লোহা-লক্করে যেয়ে থামে। খুচরো আলাপের ফাঁকে বাসেদের ডান পায়ের বুড়ো আঙুলটা টাটায়। দুদিন আগে কাজের সময় মোটরের ব্লেডে আঙুলের অনেকটা পড়ে গেছে।

-- পাও কি সারছে , আইজ কামে যাইবা নি?
-- লও যাই, বইয়া থাকলে কী প্যাট চলবো !
-- তুমি তাইলে আওগাইতে থাহো, আমি আইয়া তোমারে ধরতাছি।

বাসেদ ধীর পায়ে হাঁটতে থাকে। ও জানে জহির এখন ফাতেমাদের বাড়ির পেছনের জানালায় পাখি হয়ে ডাকবে। ফাতেমার সাড়া মিললে, ওরা দুজন উড়তে উড়তে নিরাপদ একটা ডালে মিনিট পাঁচেক আশা-আকাঙ্ক্ষার বুলি কপচাবে। হয়ত জহির বলবে, আইছে শীতেই তোমারে আমগোর ঘরে তুলুম, ফাতেমা। জবাবে ফাতেমা ভেঙচি কেটে কৃত্রিম অভিমান দেখাবে, যেন এ কথায় ওর আস্থা নেই। তারপর ওরা সবার অলক্ষ্যে ডানা ঝাপটাবে; কিচিরমিচির শব্দ তুলে পরস্পরকে ঠোঁকরাবে।

বাসেদ হঠাৎ জনবিষণ্ণ হয়ে পড়ে। বিচ্ছিন্নতাবোধ ওকে তাড়িয়ে ফেরে। বাসেদ বোঝে না যে, বিচ্ছিন্নতাবোধ মধ্যবিত্তের একান্ত অজুহাত। ওর মতো বিত্তহীনের এতে আক্রান্ত হবার কোনো দায় নেই।




হীরামন দোরবন্ধ ঘরের মধ্যে একবার চক্রাকারে ঘুরে এসে বাসেদের কাঁধে বসে। তীক্ষ্ণ স্বরে ডাকে। ঘাড়ে মাথা ঘষে। বাসেদ বিড়বিড় করে বলে, হীরামন, ও হীরামন, লও বনেত যাই। হীরামন ডানা ঝাঁপটায়। বাসেদের মাথার চারপাশে ক্ষুদ্র বৃত্তাকার পথে পাঁক খায়। তারপর ওর মাথায় বসে তীক্ষ্ণ স্বরে ডেকে ওঠে। বাসেদ হাসে । ও ভুলে যায় ওর ঘা-হয়ে-যাওয়া পায়ের কথা। নড়ে বসতেই পায়ের ঘা টনটন করে ওঠে। বাসেদ ভাবে হীরামনের মত একজোড়া ডানা থাকলে বেশ হয়।

ও হীরামনকে বালিশের পাশে বসিয়ে দেয়। পা-টাকে সাবধানে একপাশে ফেলে রেখে আস্তে আস্তে বালিশে মাথা রাখে। তারপর পাখিটার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বলে, হীরামন, কথা কইতা না ! লও বনেত যাই। পাখিটার চোখে কোনো ভাবান্তর নেই। সে অপলক চেয়ে থাকে বাসেদের চোখে। বাসেদ ভুলে যায় ওর নষ্ট-হতে-বসা পায়ের কথা। চোখভর্তি নেশা নামে ওর। ও দ্রুতবেগে পড়তে থাকে নিচে।

মাটি স্পর্শ করার আগেই বাসেদ বাতাসে ভেসে ওঠে। ডানা ঝাপটায়। সাঁই সাঁই বাতাস কেটে উপরে ওঠে। মেঘ ছুঁয়ে ওদের খুব আনন্দ হয়। ডানা প্রসারিত করে ছোঁ-মারা ভঙ্গিতে নামতে নামতে একটা অনুচ্চ গাছের একথোকা কচি ফলের উপর বসে। ফল ছিঁড়ে ছিঁড়ে খায়। বনের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তের কোনো থই পাওয়া যায় না। পাখির ডাকাডাকি। বড় বড় গাছের বাহারি পাতা। ঝিরঝিরে বাতাস। আর তারই মধ্যে হীরামন আর বাসেদ। হীরামন একটা রসালো ফল ঠোঁটে ধরে বাসেদের দিকে এগিয়ে দেয়। বাসেদ তা ঠোঁটে পুরে দিয়ে হীরামনের কাঁধে ওর ঠোঁট ঘষে। অমৃতরসে ওরা তৃপ্তিতে ডেকে ওঠে। বনময় সে ডাকের প্রতিধ্বনি ছোটাছুটি করতে করতে মিলিয়ে যায় দূরে।




দরজায় ঠক ঠক শব্দ হয়। সদ্য ঘুম ভাঙা চোখে প্রায় হামাগুড়ি দিতে দিতে দরজায় কাছে পৌঁছায় বাসেদ। হীরামন ওর কাঁধের উপরে বসে। দরজা খুলতেই হুড়মুড় করে কিছু রোদ ঢুকে পড়ে ঘরের ভেতর। সেই সাথে রাসেল আর জহিরের উদ্বিগ্ন কণ্ঠ কানে আসে, তোমার শইলডা এখন কেমুন লাগে বাসেদ। ওষুধপাতি খাইতাছো তো? জহির কলার ছড়া আর আঙুরের প্যাকেটটা বিছানার একপাশে রেখে বাসেদের কাঁধে চাপ দেয়। চিন্তা কইরো না এত, ভালা হইয়া যাইবা।

বাসেদের চোখ দেখে বোঝা যায় না - ও ভালো হতে চায় কিনা। রাসেল বলে, বাসেদ ! তোমারে মিয়া সামনের শুককুরবার ভালা ডাকতরের ধারে লমু, নো চিন্তা। ওষুধপাতি খাইলেই তামাম ব্যাদনা ঠিক। জহির ওর হাতে কিছু টাকা দেয়। বলে, পয়সাডি রাখো বাসেদ। আপদে বিপদে লাগব।

বাসেদ হাত বাড়িয়ে টাকা ক’টা নেয়। ওদের দিকে কৃতজ্ঞতার হাসি দিতে চেষ্টা করে। কিন্তু ওর সমস্ত জানটা একটা ঘা-ওয়ালা পায়ের মধ্যে সেঁধিয়ে ওকে একদম বিমর্ষ করে তোলে। ও হাসতে পারে না ঠিকমত। ওরা একবার হীরামনের দিকে তাকায়। এই অল্প ক’দিনে হীরামনের শ্রী বৃদ্ধিতে ওদের চোখ ভরে ওঠে। জহির পাখিটার সামনে শস্যদানা তুলে ধরে। হীরামন সেদিকে ভ্রূক্ষেপ না করেই বাসেদের কাঁধে বসে ডানা ঝাঁপটায়। জহির বলে, হীরামন তো দ্যাখতাছি তোমার বহুত ন্যাওটা হইছে। বাসেদ এ কথায় মুচকি হাসে।




শুক্রবার আসার আগেই বাসেদের পায়ের ব্যথা মাত্রা ছাড়ায়। ঘরের হাওয়া ওর কাছে অসহ্য ঠেকে। পায়ের ঘা-হয়ে-যাওয়া মাংসের দিকে তাকিয়ে বাসেদ শিউরে ওঠে। হীরামনকে কাঁধে নিয়ে পা টানতে টানতে ও ঘরের বাইরে আসে। হীরামনও যেন বাসেদের ব্যথায় কুঁই কুঁই করে ওঠে। পাখিটার দিকে মুখ ফিরিয়ে বাসেদ ঠোঁট ছড়ায়। বলে, হীরামন, ও হীরামন, লও বনেত যাই।

অসহ্য ব্যথায় বাসেদের চোখে অন্ধকার গাঢ় হয়ে উঠলে, ও নিজেকে আর ধরে রাখতে পারে না। ধপ করে করিডোরের মেঝেতে পড়ে যায়।

বাসেদের সংবাদ পেয়ে জহির আর রাসেল হাসপাতালে আসে। ওদেরকে দেখে খাটের স্ট্যান্ডে বসে থাকা হীরামন শব্দ করে ডেকে ওঠে। ওরা পাখিটার দিকে তাকিয়ে কৃতজ্ঞতায় মাথা নাড়ে। বাসেদের মাথার কাছে বসে জহির ওর হাত ধরে । সব ঠিক হইয়া যাইব মিয়া – এমন একটা কিছু উচ্চারণ করতে গিয়ে ওর চোখ যায় বাসেদের ডান পায়ের দিকে। হাঁটুর নিচ থেকে ও আর কিছু ঠাওর করতে পারে না। জহির থমকে যায়। পচে যাওয়ার পরিণতির কথা কে না জানে ! ওরা বাসেদের চোখের জল মুছে দেয়। বলে, আমরা আছি কিল্ল্যাইগা, চিন্তা কইরো না।

বাসেদ মেসে ফিরে ক্র্যাচে ভর দিয়ে ধীরে ধীরে হাঁটার চেষ্টা করে। সারাদিন হীরামনের সাথে বিড়বিড় করে। কাঁদে। হাসে। আর ভাবে, একজোড়া ডানা থাকলে বেশ হয়। হীরামন সবসময় ওর কাঁধে; যেন ও কোনো পাখি নয়, বাসেদেরই অবিচ্ছেদ্দ্য কোনো অংশ। বাসেদ ভাবে, হীরামনও বুঝি তার মত একলা। না হলে উড়ে যায় না কেন?




ক্র্যাচে ভর দিয়ে সিঁড়ি ভাঙতে ভাঙতে বাসেদ আর হীরামন একসময় বহুতলের চূড়া স্পর্শ করে। রেলিঙয়ের একদম ধার ঘেঁষে ওরা দাঁড়ায়। বিকেলের নরম রোদ মুখে পরশ বুলায়। ঝিরঝিরে বাতাস চুলগুলোতে বিলি কেটে হাসতে হাসতে বেরিয়ে যায়। আকাশের দিকে তাকিয়ে বুক ভরে দম নেয় বাসেদ। খোলা আকাশ ওর কাছে বিরাট এক পৃথিবী মনে হয়। সূর্যের রঙ সোনা হয়ে ঝরে ঝরে পড়ে। বাসেদ সেই সোনারঙ আলোতেই চিরকাল ভেসে যেতে চায়।

বাসেদ বুক ভরে শ্বাস নেয়। শরীরটাকে হালকা করে বাতাসে খেলিয়ে দেয়। ক্র্যাচ দুটি ফেলে দিয়ে এক পায়ে দাঁড়িয়ে পড়ে। ওর চোখের সামনে অন্তহীন সবুজের সমাহার ঢেউ খেলে যায়। ও একবার হীরামনের দিকে তাকায়। তারপর কাঁধ থেকে হাতে নামিয়ে নিয়ে বলে, হীরামন, ও হীরামন, কথা কইতা না, লও অহনি বনেত যাই। হীরামন সম্মতি জানিয়ে গাঢ় স্বরে ডেকে ওঠে।


টলটলে নীল জলের ওপর দিয়ে বাসেদ আর হীরামন উড়তে থাকে। জলের আরশিতে বাসেদ নিজেকে দেখতে পায়। ভেতরের পাখিটাকে দেখে ও মুগ্ধ হয়। ডানা ঝাপটে একটা ঘূর্ণি দিয়ে তীক্ষ্ণ স্বরে হেসে ওঠে। তারপর ওরা উড়তে উড়তে – সমস্ত জলময়তা পেছনে ফেলে – একটা উঁচু গাছের ডালে যেয়ে বসে।

খোলা আকাশের তলে বুনো হাওয়ায় দুলতে দুলতে ওরা দেখে - সামনে অথৈ জলরাশি মুহুর্মুহু শব্দ করে আছড়ে পড়ছে বেলাভূমিতে।



----------









ছবি - Click This Link
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই জুলাই, ২০২০ সন্ধ্যা ৭:১৪
৪৬টি মন্তব্য ৪৭টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

কুড়ি শব্দের গল্প

লিখেছেন করুণাধারা, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:১৭



জলে ভাসা পদ্ম আমি
কোরা বাংলায় ঘোষণা দিলাম, "বিদায় সামু" !
কিন্তু সামু সিগারেটের নেশার মতো, ছাড়া যায় না! আমি কি সত্যি যাবো? নো... নেভার!

সানমুন
চিলেকোঠার জানালায় পূর্ণিমার চাঁদ। ঘুমন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

ধর্ম ও বিজ্ঞান

লিখেছেন এমএলজি, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৪:২৪

করোনার (COVID) শুরুর দিকে আমি দেশবাসীর কাছে উদাত্ত আহবান জানিয়ে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম, যা শেয়ার হয়েছিল প্রায় ৩ হাজারবার। জীবন বাঁচাতে মরিয়া পাঠকবৃন্দ আশা করেছিলেন এ পোস্ট শেয়ারে কেউ একজন... ...বাকিটুকু পড়ুন

তালগোল

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৩৫


তু‌মি যাও চ‌লে
আ‌মি যাই গ‌লে
চ‌লে যায় ঋতু, শীত গ্রীষ্ম বর্ষা
রাত ফু‌রা‌লেই দি‌নের আ‌লোয় ফর্সা
ঘু‌রেঘু‌রে ফি‌রে‌তো আ‌সে, আ‌সে‌তো ফি‌রে
তু‌মি চ‌লে যাও, তু‌মি চ‌লে যাও, আমা‌কে ঘি‌রে
জড়ায়ে মোহ বাতা‌সে ম‌দির ঘ্রাণ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

মা

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৩


মায়াবী রাতের চাঁদনী আলো
কিছুই যে আর লাগে না ভালো,
হারিয়ে গেছে মনের আলো
আধার ঘেরা এই মনটা কালো,
মা যেদিন তুই চলে গেলি , আমায় রেখে ওই অন্য পারে।

অন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

কপি করা পোস্ট নিজের নামে চালিয়েও অস্বীকার করলো ব্লগার গেছে দাদা।

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:১৮



একটা পোস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ আগে থেকেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। পোস্টটিতে মদ্য পান নিয়ে কবি মির্জা গালিব, কবি আল্লামা ইকবাল, কবি আহমদ ফারাজ, কবি ওয়াসি এবং কবি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×