somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

কলকাতা – দ্য সিটি অফ জয়

২৮ শে আগস্ট, ২০১৮ দুপুর ২:২২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


কলকাতার রাস্তায় ঐতিহ্যবাহী ট্রাম

শালপাতার থালায় খেতে নিশ্চয় আপনার ভালো লাগবে না? নাকি লাগবে? আমার প্রথমটা বেশ অস্বস্তি লাগছিল। পরে অবশ্য শালপাতার থালায় ভাত-তরকারি মেখে খেয়ে ফেললাম দুদ্দাড়। রাস্তায় রাস্তায় হাটলাম; সকাল থেকে সন্ধ্যা। হাঁটলাম আর মানুষ দেখলাম। দেখলাম তাদের জীবনযাপন। গেলাম কিছু দর্শনীয় স্থানে, যেখানে ইতিহাস, ঐতিহ্য মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। পরিচিত গণ্ডীর সীমারেখা অতিক্রম করে এমনি ঘুরে বেড়ানোর মধ্যেই তো আনন্দ। বাঁকে বাঁকে বিস্ময়।

চলুন নেমে পড়ি কলকাতার রাস্তায়। দেখি কি কি অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য। তবে তার আগে কলকাতা পর্যন্ত আসার গল্পটা বলি।

এবারে ঠিক করেছিলাম ঈদুল আযহা’র ছুটিতে ‘সলো ট্রাভেল’-এ বের হব শিলং, মেঘলয়ের পথে পথে। এর আগেও অবশ্য বার তিনেক ইন্ডিয়া ভ্রমণ করেছি – মেঘালয়, মানালি, আর গঙ্গোত্রীতে। প্রতিবারই পরিচিত গ্রুপের সাথে। তাই এবার স্বাদ পাল্টাতে একাকী যাব ঠিক করলাম। কিন্তু খোঁজখবর করতেই জানলাম, ঈদের সময় শিলং এ প্রচণ্ড ভীড় হবে। ভীড়ের ভেতর স্বস্তি পাই না আমি। শেষমেশ প্ল্যান পালটে উড়িষ্যার ভুবনেশ্বর ও পুরীতে যাবার প্ল্যান করি।

এ ট্যুরটাকে একটা এক্সপেরিমেন্ট ট্যুর বলা যেতে পারে। একাকী ঘুরতে কেমন লাগবে সেটার এক্সপেরিমেন্ট। যথারীতি অফিস থেকে ৪ দিনের ছুটি নিয়ে ব্যাগপ্যাক গুছিয়ে ফেললাম। গুগল ঘেটে প্রয়োজনীয় সব তথ্য মগজে এবং মোবাইলে পুরে নিলাম। 'গুগল ট্রিপে' ট্রিপ প্ল্যান করে বেরিয়ে পড়লাম বাসা থেকে। ঠিক ঈদের দিন ২২ আগস্ট ২০১৮, রাতের বাস। দেশ ট্রাভেলস এর হুন্দাই রাত ১১.৩০ মিনিটে ঢাকা ছাড়ল। পরদিন ভোরে প্রায় সাড়ে ৫টার সময় বেনাপোল বর্ডারে পৌছালাম। কিন্তু তাতে কী, মানুষের প্রচণ্ড ভীড়। সবাই ইন্ডিয়া যাচ্ছে। কেউ ঘুরতে, কেউবা ডাক্তার দেখাতে। প্রায় ৪ ঘন্টারও বেশি সময় লেগে গেল শুধুমাত্র বর্ডার পার হতে। এরই মধ্যে বর্ডারে ২৫০ টাকা চলে গেছে সিকিউরিটি চেক এর সময় ড্যামারেজ হিসেবে। বর্ডারে এই এক যন্ত্রণা। টাকা খাওয়ার জন্য সব ‘হা’ করে বসে থাকে। কি বাঙালি, কি ইন্ডিয়ান ! টাকার কাছে কোনো দেশভেদ, জাতিভেদ নেই। বাংলা টাকা সংগে এনেছ, তো টাকা দাও। ডলার এনডোর্স করেছ, তবুও টাকা দাও। ঈদের সময়, তো বকশিস দাও। এন-ও-সি আনতে ভুলে গেছ, তো খেসারত দাও। সব ঠিক আছে, তবুও কিছু দাও। দাও, দাও, দাও। সব ‘হা’ করে আছে, টাকার হা বড় রাক্ষুসে।

যাহোক, তখন বেলা ১১টা, বর্ডার পার হয়ে এপারে হরিদাসপুর এসে আবার গাড়িতে উঠলাম। গন্তব্য কলকাতা, দ্য সিটি অফ জয়। তারপর কলকাতা থেকে রাতের বাসটিকিট কেটে ভুবনেশ্বর। কিন্তু হরিদাসপুর থেকে দেশ ট্রাভেলস এর যে বাসে উঠলাম তাতে না উঠে হেটে গেলেই বোধহয় তাড়াতাড়ি যেতে পারতাম। হরিদাসপুর বর্ডার থেকে কলকাতা মাত্র ৮৪ কিলোমিটার। ড্রাইভারের অসাধারণ নৈপূণ্যে এই ৮৪ কিলো যেতে সময় লাগলো প্রায় ৫ ঘন্টা। মাঝে আবার ২৫ মিনিটের খাদ্য-বিরতি। স্থানীয় হোটেলে মুরগীর মাংস, সবজি, ডাল, ভাজি, আর চাটনি সহযোগে ১৪০ রুপির উপাদেয় খাবার। খেয়ে আবার গাড়িতে বসে ঝিমুতে লাগলাম এবং বিকাল প্রায় সাড়ে ৪ টার সময় এসে নামলাম কলকাতার মারকুইস স্ট্রিটে।

এদিকে সব স্ট্রিটের ছড়াছড়ি – মির্জা গালিব স্ট্রিট, মারকুইস স্ট্রিট, রিপন স্ট্রিট, কিদওয়ায়ি স্ট্রিট, কলিন স্ট্রিট, রাসেল স্ট্রিট, পার্ক স্ট্রিট, উড স্ট্রিট, হরে স্ট্রিট, আরো কত কি। সব মহাত্মারা কলকাতায় এসে একেকটা স্ট্রিট হয়ে বেঁচে আছেন। এখন তাদের উপর দিয়েই সবাই হেঁটে হেঁটে নিজ গন্তব্য খুঁজে নেয়।

আমি মারকুইস স্ট্রিটে নেমে এদিক সেদিক কয়েক চক্কর ঘুরে, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট এবং পার্ক স্ট্রিটের মধ্যে পাঁক খেয়ে অবশেষে রাফি আহমেদ কিদওয়ায়ি স্ট্রিটের একটা হোটেলে এসে পড়লাম। হোটেলের নাম কোয়েস্টার’স প্যারাডাইজ গেস্ট হাউস। একটা সিঙ্গেল নন-এসি রুম ভাড়া নিলাম মাত্র ৭০০ রুপিতে। কেয়ারটেকার সাকিব সাহেব আমাকে রুম দেখিয়ে, বিছানা পালটে দিলেন আর বললেন, দাদা এটা হাজার টাকার রুম। লোকজন নেই বলে তোমাকে কমিয়ে দিলুম। আমি মনে মনে বললাম, আপকা মেহেরবানি। যাহোক, সত্যিকারের প্যারাডাইজ না হলেও রুমটা মন্দ নয়। তাছাড়া রাত কাটিয়ে দেয়ার মত মাথা গোঁজার ঠাই পেলেই আমার হবে। সেদিন আর তেমন কোথাও বের হলাম না। গোসল দিয়ে চিন্তা করলাম ভুবনেশ্বরের একটু খোঁজ-খবর নিই। গুগল করে ওয়েদার ফোরকাস্ট দেখলাম এবং যথারীতি হতাশ হলাম। আগামী পুরো সপ্তাহ জুড়ে বজ্রসহ বৃস্টি হবে। এদিকে আব্বাও বারবার ফোন দিয়ে বলছেন যেন আমি উড়িষ্যার দিকে না যাই, ওদিকে নাকি বন্যা হচ্ছে। ওড়িষ্যার বাস ছাড়ে ধর্মতলা থেকে। গ্রীণলাইনের ভলভো আছে। ভুবনেশ্বর পর্যন্ত ৭০০ আর পুরী পর্যন্ত ভাড়া ৮০০ রুপি করে ভাড়া। শেষ বাস ছাড়ে রাত সাড়ে নয়টায়। বেশ একটা দ্বিধায় পড়ে গেলাম। এতপথ গিয়ে যদি বৃষ্টিতে আঁটকে থাকতে হয় পুরী কিংবা ভুবনেশ্বরে, তাহলে ট্যুরটাই মাটি হয়ে যায়। তাও আবার একা। সঙ্গী কেউ থাকলে না হয় কথাটথা বলে কাটানো যেত। অবশেষে ঠিক করলাম, আগামী তিনদিন কলকাতাতেই থাকবো। যেহেতু এর আগে কলকাতা ঘুরে দেখা হয়নি, তাই এবার কলকাতা ঘোরাটা মন্দ হবে না।

এরই মধ্যে মারকুইস স্ট্রিট থেকে একটা সিম নিয়েছি এয়ারটেল-এর। সিম নিতে দোকানে পাসপোর্ট, ভিসা, ছবি জমা দিতে হয়েছে। সিম নিলাম। দোকানী বলল, রাত সাড়ে ন বাজকে সিম একটিভ হো যায়েগা, ইস নাম্বারমে ডায়াল কারনা, অর জো বোলে ও ইনফরমেশন দেনা। আমি বললাম, তথাস্তু। দোকানী রিচার্জের কথা বললে বললাম ১০০ রুপি রিচার্জ করে দিতে। যথারীতি রাত নটার দিকে দেখলাম সিম নেটওয়ার্ক শো করতেছে। তখন দোকানীর বলা নাম্বারে ডায়াল করে পিন আর বার্থইয়ার দিয়ে সিম একটিভ করলাম। কিন্তু দুঃখের বিষয় সেই ১০০ রুপি রিচার্জ পেলাম না। আমি মোবাইল হাতে নিয়ে গুতাগুতি করলাম। ৩৩ বছর অপেক্ষা করলাম কিন্তু কিছুতেই রিচার্জ এলো না। কেউ কথা রাখে না। বুঝলাম, দোকানদার আমার কথা রাখেননি, তিনি রেখেছেন ভুট্টো সাহেবের কথা।


কলকাতাঃ ১ম দিন


যে যে জায়গাতে গেলাম –

• ডালহৌসি (ফেয়ারলি প্লেস - ইস্টার্ণ রেলওয়ে)
• মিলেনিয়াম পার্ক
• হাওড়া ব্রিজ
• ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল

সকালে ঘুম থেকে ওঠা খুব কষ্টের। বার বার এলার্ম পালটে অবশেষে সাড়ে আটটায় ঘুম থেকে উঠলাম। রেডি হয়ে বের হতে হতে সকাল ৯টা। নাস্তা করলাম মেজবান হোটেলে।একটা তন্দুর রুটি আর একবাটি ডালের বাটির ভেতর তিন টুকরো মাংস। দাম ৯০ রুপি। খাওয়া শেষ করে প্রথমেই ঠিক করলাম ঢাকা ফেরার টিকেটটা আগে কনফার্ম করতে হবে। বাস এবং বর্ডারের ভয়াবহ অভিজ্ঞতার পর, আর ওমুখো হতে ইচ্ছা করলো না। তাই মৈত্রী ট্রেনের টিকিট কাটতে ছুটলাম ডালহৌসি, ফেয়ারলি প্লেস।

ধর্মতলা থেকে হাওড়ার বাসে উঠে বেশ অল্প সময়ের মধ্যেই ফেয়ারলি প্লেস চলে আসলাম। রাস্তায় কোনো জ্যাম নেই। আর সবচেয়ে বড় কথা বাংলাদেশের রাস্তায় যে পরিমাণ উন্নয়ন সারাবছর হয় ওদিকে তেমন উন্নয়নের ছোয়া এখনো লাগে নাই বলে জনগন অল্পসময়ে দ্রুত গন্তব্যে পৌঁছাতে পারে। রাস্তাগুলো অনেক প্রশস্ত। দু’পাশে সবুজ গাছ। সব গাড়ি ট্রাফিক সিগন্যাল স্ট্রিক্টলি ফলো করে। প্রতিযোগিতার প্রবণতা কম। কারণে অকারণে হর্ণ দেয় না। এখানে সব রুটের গাড়ির একেকটা নাম্বার আছে। কত নাম্বার গাড়ি কোন রুটে চলে জানা থাকলে খুব অল্প খরচে সারা কলকাতা চষে ফেলা যায়। যেখানে ট্যাক্সিতে ভাড়া প্রায় ২০০ থেকে ২৫০ রুপি, বাসে সে ভাড়া মাত্র ০৯ কিংবা ০৮ রুপি। ফেয়ারলি প্লেস পৌছুলাম দশটার কিছু আগে। পৌছেই তিন দিন পর মানে ২৭ আগস্টের মৈত্রী ট্রেনের টিকিট কাটার লাইনে দাঁড়িয়ে গেলাম। কাউন্টার দশটায় ওপেন হলে নির্দিষ্ট ফর্ম নিয়ে পাসপোর্ট ও যাত্রা সংক্রান্ত ইনফরমেশন ফিল-আপ করলাম। তারপর সিরিয়াল আসলে এসি-ফার্স্ট-ক্লাসের একটা কেবিন নিলাম ২১২৫ রুপি দিয়ে। ট্রেন ২৭ আগস্ট ২০১৮, সকাল ৭ টা ১০ মিনিটে, কলকাতা রেলস্টেশন থেকে ছাড়বে। দীর্ঘ অপেক্ষার পর টিকেট হাতে পাওয়ার পর মনে হল – পাইলাম, আমি ইহাকে পাইলাম, এবার যেদিকে দু'চোখ যায় চলে যেতে পারব। ঢাকা ফেরা নিয়ে আর টেনশন নেই।

টিকেট কাটা শেষ করে প্রায় ১২ টার দিকে বিবিডি বাগ – এর আশেপাশে হেঁটে বেড়ালাম। দেখলাম কিরণ সংকর রায় রোড কিংবা হরে স্ট্রিট - সব জায়গার ফুটপাথ দখল করে নানান পসরা সাজিয়ে বসেছে মানুষ। কেউ ফল বিক্রি করছে, কেউ দুপুরের খাবার; ভেজ বা নন-ভেজ, কেউ বসেছে ভাজাভুজি নিয়ে, কেউ আবার বিক্রি করছে পানি, ড্রিংক্স, বিড়ি-সিগারেট, কেউবা চা-কফি। ফুটপাত ধরে হাঁটতেই দুপুরের খাবারের জন্য আমন্ত্রণ জানাচ্ছে তারা। ডাকছে - দাদা, দুপুরের খাবার রয়েছে, খেয়ে নিন। আমি এক ফল বিক্রেতার কাছ থেকে জাম্বুরা মাখানো খেলাম। তারপর গুড়ি গুড়ি বৃস্টি মাথায় নিয়ে গেলাম পাশেই হুগলি নদীর ধারে মিলেনিয়াম পার্কে।

ছোট্ট সুন্দর গোছানো পার্ক এটি। একেবারে নদীর গা ঘেঁষে। রেলিং এ দাঁড়িয়ে দুচোখ ভরে দেখা যায় হুগলি রিভার। নদীতে চলছে ছোট ছোট স্টিমার, ফেরী। সামনেই বিশাল স্টিলের কাঠামো নিয়ে সদম্ভে দাঁড়িয়ে আছে বিখ্যাত হাওড়া ব্রিজ। ব্রিজের অপর প্রান্তে হাওড়া রেলস্টেশন। হাওড়া স্টেশনের কথা মনে হতেই বারবার শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এর কথা মনে হয়। তার কতো উপন্যাসে এই হাওড়া স্টেশনের উল্লেখ আছে। মনে হয়, বাতাসে, ধুলো-মাটিতে এখনো সেই সময়ের ছাপ লেগে আছে। হাঁটতে হাঁটতে হাওড়া ব্রিজকে আরো কাছ থেকে দেখি। ১৮৭৪ সালে নির্মিত অদ্ভুত সুন্দর এই জায়ান্ট ব্রিজ মন ভরিয়ে তোলে।

হাওড়া ব্রিজ দেখা শেষ করে বাসে করে ধর্মতলা ব্যাক করলাম। সেখান থেকে হাঁটতে হাঁটতে পার্ক স্ট্রিট হয়ে সোজা ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল। গুগলিং করে জেনে নিই যে, বেলফাস্ট সিটি হলের স্থাপত্যশৈলীর আদলে এটির নির্মান কাজ সম্পন্ন করেন স্যার উইলিয়াম এমারসন সেই ১৯২১ সালে। ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল এর চারপাশে রয়েছে কয়েকটি পন্ড আর নান্দনিক বাগান। ৩০ রুপির টিকিট কেটে ঢুকে পড়লাম মেমোরিয়ালে। চারপাশ ঘুরে প্রধান ভবনে প্রবেশ করলাম। সেখানে একটা যাদুঘর রয়েছে। পুরোনো পেইন্টিংস, সেই আমলের নবাবদের ব্যবহৃত জিনিসপত্র, মসনদ, কামান, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির জাহাজের মডেল, কলকাতার আজকের কলকাতা হয়ে ওঠার বিবর্তনের প্রদর্শনী, আরো কতো কি রয়েছে এখানে। মীর জাফরের ব্যবহৃত তরবারিও শোভা পাচ্ছে এই মেমোরিয়ালে। তরবারি দেখেই মনে পড়ল - বাংলা, বিহার, উড়িষ্যার মহান অধিপতি নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে তিনি কিরকম নাকানি চুবানিই না খাইয়েছিলেন। হাহ! বিশ্বাসঘাতক মীর জাফর ! যাহোক, সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে, ওপর থেকে দেখলে মিউজিয়ামটি আরো সুন্দর দেখায়। বলা বাহুল্য, এটি কলকাতার পর্যটন স্পটগুলোর মধ্যে অন্যতম।


মীর জাফরের ব্যবহৃত তরবারি

মেমোরিয়াল থেকে বেরিয়ে গড়ের মাঠের পাশ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে হঠাত চোখ পড়ল একটা সাদা ঘোড়ার উপর। দেখলাম এখানে ঘোড়াতে চড়ার সুব্যবস্থা আছে। কথায় আছে, ঘোড়ায় চড়িয়া মর্দ হাটিয়া চলিল। সুতরাং আমাকেও চড়িতে হইবে। জিজ্ঞেস করে জানলাম, ছোট পাক ৮০ রুপি আর বড় পাক ১৫০ রুপি। আমি দামদস্তুর করে ৬০ রুপি দিয়ে ছোট পাঁক চড়লাম। ঘোড়ার চড়া খুব মজার। একটা দারুন ছন্দ তৈরি হয় ঘোড়া চলতে শুরু করলে ... টগবগ...টগবগ...টগবগ। সবার উচিত অন্তত একবার হলেও ঘোড়াতে চড়া। তবে আমি পুরোপুরি মজা উপভোগ করার আগেই ছোট পাক শেষ হয়ে গেল। হায় রে, ছোট পাক ! তুমি আসলেই খুব ছোট।

প্রথম দিনের মত বেড়ানো এ পর্যায়েই শেষ হয় আমার। পার্ক স্ট্রিট হয়ে হাঁটতে হাঁটতে হোটেলে ফিরি। অতি অবশ্যই গুগল ম্যাপ না থাকলে পথ হারিয়ে ফেলতাম। যদিও ম্যাপ দেখেও একই চক্করের আশেপাশে অনেকবার ঘুরেছি আমি, ম্যাপ ব্যবহারে অদক্ষ হলে যা হয় আর কি। এখানকার সব রাস্তা কেমন যেন এলোমেলো হয়ে যায় মাথার ভেতরে। কুলকিনারা করতে পারি না। জীবনানন্দের মতই অনেক ঘুরেছি আমি বিম্বিশার অশোকের ধূসর জগতে...


কলকাতাঃ ২য় দিন

যে যে জায়গাতে গেলাম –
• আলিপুর জু-লজিকাল গার্ডেন
• হাওড়া রেলস্টেশন
• শিবপুর বাজার
• হুগলী রিভারব্যাঙ্ক

প্রথমদিনে অনেক তো মানুষ দেখা হলো। তাই ভাবলাম দ্বিতীয় দিনটা চিড়িয়াদের জন্য থাক, নাহলে তাদের উপর অন্যায় করা হবে। আমি আবার কারো উপর অন্যায় করতে পারি না! সুতরাং যে ভাবা, সেই কাজ। চলে গেলাম আলিপুর জু-লজিকাল পার্ক ওরফে আলিপুর চিড়িয়াখানা। বাংলাদেশের চিড়িয়াখানা দেখার দুর্ভাগ্য যাদের হয়েছে তাদের কাছে পৃথিবীর তাবৎ চিড়িয়াখানা ভালো লাগবে – এটা ৮ বছরের গ্যারান্টি দিয়ে বলা যায়। সুতরাং এক কথায় আলিপুর চিড়িয়াখানা সুন্দর, পরিকল্পিত এবং পর্যটকবান্ধব। কিছুদূর পরপর পানি ও ওয়াশরুমের ব্যবস্থা আছে। চারদিকের লনের ঘাস, গাছ সবকিছু সুচারুভাবে ছাঁটা। জন্তুদের খাঁচার কাছে বিদঘুটে গন্ধ নেই। একটু পরপর রোড-সাইনেজ দেয়া আছি। আপনি চাইলেও হারিয়ে যেতে পারবেন না কিংবা একই জায়গায় ঘুরপাক খাবেন না।

সিকিউরিটি খুব ভালো। কো-অপারেটিভ। এছাড়া রাস্তার বাঁকে বাঁকে ছোট ছোট ফুডকোর্ট আছে। কিছু খেয়ে নেয়া যায়। অনেক পশু-পাখি-জীব-জন্তুর মেলা দেখলাম এই আলিপুর জু-লজিকাল পার্কে। আমার যেহেতু পাখিপ্রীতি বেশি, তাই পাখি দেখেছি অনেকটা সময় নিয়ে। বিশেষত আমাজনের রেড-প্যারোট, ব্রাজিলের ম্যাকাও, অস্ট্রেলিয়ার ব্ল্যাক-সোয়ান, নানারকম ও আকারের ফেজ্যান্ট, বিচিত্র সব হাঁসজাতীয় পাখি, আরো কত কি। আলিপুর জু দেখে মনে হলো, আমাদের দেশের জু-কর্তৃপক্ষ একটু সচেতন হলে, আমরা হয়ত এর চেয়েও আরো সুন্দর একটা চিড়িয়াখানা পেতাম।

চিড়িয়াখানার বাইরে এসে গেটের কাছেই রয়েছে নানারকম খাবারের ভ্রাম্যমান দোকান। আমি ভেলপুরি, ঘুগনি, আর ফ্রুট স্যালাদ খেলাম। তারপর দু’পায়ে ভর করে চলে গেলাম হেস্টিংস মোড়। সেখান থেকে বাসে চেপে আসলাম ফোর্ট উইলিয়াম। কিন্তু ফোর্ট উইলিয়ামের গেট থেকেই নিরাশ হয়ে ফিরতে হলো, কারণ এটা রেস্ট্রিক্টেড আর্মি এরিয়া। সাধারণের প্রবেশ নিষেধ। আমি যে অতিসাধারণ, তা তারা বুঝলেনই না। যাহোক, ফোর্ট উইলিয়ামের আশেপাশের রাস্তাগুলোও খুব দর্শনীয়। প্রশস্ত রাস্তার দুপাশে সবুজের সমারোহ। চোখ জুড়িয়ে যায়। সবুজে চোখ জুড়াতে জুড়াতে হেঁটে চলে এলাম ধর্মতলা। এদিকে দুপুর হয়ে গেছে। একটা হোটেলে থামলাম। খুব সম্ভবত মীর্জা গালিব স্ট্রীটে। হোটেলে ঢুকে সবজি আর মুরগীর কারি ওর্ডার দিলাম। বিস্ময়ে লক্ষ্য করলাম, খাবার পরিবেশন করছে শালপাতার তৈরি প্লেটে। শালপাতার বাটিতে গতদিন স্ট্রিটফুড খেয়েছি কিন্তু ঝোলওয়ালা তরকারি দিয়ে ভাত খাবার সৌভাগ্য এই প্রথম। যাহোক দেখলাম, সিস্টেমটা বেশ ভালো। প্লেট ধোয়াধুয়ির ঝামেলা নেই। খাওয়া শেষ, তো পাতার প্লেট ফেলে দিলেই কেল্লা ফতে। খেয়ে দেয়ে একটা ২ ঘন্টার ঘুম দিয়ে নিলাম হোটেলে এসে। তারপর বিকেলে উঠে ভাবলাম, সায়েন্স সিটি যাব। আমার আবার বিজ্ঞান নিয়ে অনেক আগ্রহ কিনা ! তাছাড়া বাংলাদেশ যেহেতু ডিজিটাল হয়ে গেছে, কলকাতা থেকে একটু সায়েন্স না জেনে দেশে গেলে কি হয় !

সন্ধ্যা ৬ টা মতো বাজে। সায়েন্স সিটি যাব বলে ধর্মতলা দাঁড়িয়ে আছি অনেকক্ষণ ধরে। কিন্তু বিধি বাম। সায়েন্স সিটির বাস আর আসে না। আসে শুধু শিয়ালদহ যাবার বাস। মেজাজ খিচড়ে গেল। রাগ করে উল্টোদিকে হাঁটা দিলাম। এসপ্লানেড ম্যানশন এর সামনে থেকে উঠে গেলাম হাওড়া যাবার বাসে। তারপর বাকিটা ইতিহাস। হাওড়া স্টেশনে নামলাম। সাবওয়ে দিয়ে স্টেশনের ভেতরে ঢুকে নানান রঙের, নানান জাতের, ও নানান দেশের মানুষ দেখলাম। সবাই অপেক্ষা করছে ট্রেনের জন্য। কেউ কেউ প্ল্যাটফর্মে শুয়ে আছে চাদর বিছিয়ে। কেউ কানে হেডফোন গুজে বুদ হয়ে বসে আছে মোবাইল নিয়ে। এক বিদেশী যুগলকে দেখলাম পাশাপাশি বসে আছে। দুজনেই মহাব্যস্ত মোবাইল নিয়ে। কেউ কারো দিকে তাকাচ্ছেও না, কথাও বলছে না। মনে হল, তারা যেন পরস্পরকেও ভুলে গেছে। আহা, প্রযুক্তির ছোঁয়া বড় চমৎকার, জয় বাবা ভোলানাথ!

স্টেশন থেকে যখন বেরিয়েছি তখন প্রায় সন্ধ্যা হয় হয়। গোধুলির আলো এসে পড়ছে হুগলী নদীর ঘোলাটে জলে। আমি ফেরীঘাট হয়ে ঘুরে আবার ফুটপাথে উঠে এলাম। তারপর হাঁটা শুরু করলাম শিবপুরের দিকে। হাঁটতে হাঁটতে একটা কালী মন্দির পড়ল পথে। আমি মন্দিরে ঢুকে এক পলক দেবীকে দেখে বসে পড়লাম নদী সংলগ্ন সিড়িতে। তখন সন্ধ্যার অন্ধকার ভেদ করে চাঁদ উঠে গেছে। দেখলাম ছোট দু-তিনটি ছেলেমেয়ে সিঁড়ি ভেঙ্গে নিচে নেমে নদীতে কিছু একটা ভাসিয়ে দিল। আমি দৃশ্যটি মনের মধ্যে বন্দী করে নিলাম। মহোত্তর কোনো শক্তির প্রতি প্রণতি জানানো শিশুদেরকে দেখে আমার মনে হলো এরা ‘চিলড্রেন অফ নেচার’ আর আমরা ‘ক্রেজি পিপল অফ দ্য টুয়েন্টি-ওয়ান্থ সেঞ্চুরি’।

অনেক হাঁটলাম। ঘন্টার পর ঘন্টা। কোথাও বসলাম নদীর পাশের ‘রিভারব্যাংক পার্ক’ এ। দেখলাম আমার মতো হাওয়া খেতে অনেকেই এসেছেন। অনেক যুগল ঘনিষ্ঠ হয়ে বসেছেন একে অপরের সাথে। সলো ট্রাভেলারের কাছে এই দৃশ্য একরকম কাটা ঘা-য়ে নুনের ছিটার মতো। যাহোক, হাঁটতে হাঁটতে শিবপুরের কাছাকাছি চলে এলাম। একটা স্ট্রিট-শপ থেকে পিয়াজু, বেগুনি, আর চপ কিনে খেলাম।

তারপর একটা অটোতে করে খানিকটা ঘুরে, বাসে করে চলে এলাম হোটেলে। শিবপুর থেকে হাওড়া পর্যন্ত ব্যাক আসতে বেশ অনেকক্ষণ জ্যামে বসে থাকতে হয়েছিল। ট্র্যাফিক জ্যামের হাত থেকে বাঙালীর মুক্তি নেই, সুদূর চিন দেশে গেলেও না !


কলকাতাঃ ৩য় দিন

যে যে জায়গাতে গেলাম –
• সায়েন্স সিটি
• বিড়লা প্ল্যানেটোরিয়াম
• কফি হাউস, কলেজ স্ট্রিট

ভেবেছিলাম, সায়েন্স সিটিতে যাব না; আগে যাব কলেজ স্ট্রিট কিংবা রবীন্দ্র সরোবর। কিন্তু কপালের লিখন না যায় খণ্ডন। কলেজ স্ট্রিটের বাসের জন্য দাঁড়িয়ে আছি তো আছিই। বাসের আর দেখা মেলে না। এমন সময় দেখি বাস নাম্বার ৪৬। গতদিন জেনেছি যে ৪৬ নাম্বার বাস সায়েন্স সিটি যায়। তো আর কি, অনস্পটে ডিসিশন পালটে উঠে পড়লাম বাসে। গন্তব্য সায়েন্স সিটি।

প্রায় মিনিট ৩০ বা তারো কম সময়ে পৌছে গেলাম সায়েন্স সিটির গেটে। ভেতরে টিকিট কাউন্টার। দু’রকম টিকিট। পায়ে হেঁটে প্রবেশ ৫০ রুপি। আর দড়িতে ঝুলে প্রবেশ, আইমিন রোপিং এর মাধ্যমে প্রবেশ ৯৮ রুপি। কে জানে ঝোলাঝুলির সুযোগ আবার কবে পাব, তাই ৯৮ রুপি দিয়ে ঝুলে ঝুলে সায়েন্স সিটিতে যাওয়ার টিকিট নিলাম। কাউন্টারের পাশের সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে গেলাম। যেখানে থেকে রোপিং শুরু হবে। অনেকটা কেবল কারের মত। শুধু কারের শেপটা ডিফরেন্ট, এই যা। যাহোক, রোপিং শুরু হলো। উপর থেকে নিচের সায়েন্স সিটির বাগান আর ভবনগুলো দেখতে খুব চমৎকার লাগল। আমার পাশে এক কাপল বসে ছিল। মেয়েটা হঠাত তার ইয়েকে জিজ্ঞেস করলো, ইহাসে পড় যায়েগা তো কেয়া হোগা? মনে হচ্ছিল বলি, লাফ দিয়ে দেখেন কি হয়। মেয়েটার ইয়ে বলল, জিয়াদা কুচ নেহি হোগা। বলে আমার দিকে তাকাল। আমি সাথে সাথে বললাম, কুচ নেহি হোগা, দো চার হাড্ডিয়া টুটেংগে ওর কুচ নেহি হোগা। যদিও এই কাপলের সাথে বসে নিজেকে কাবাব-মে-হাড্ডি মনে হচ্ছিল। কিন্তু কি আর করা। অবশেষে আমরা আরামদায়ক ঝোলাঝুলির মাধ্যমে সায়েন্স সিটিতে প্রবেশ করলাম।

প্রথমে গেলাম সায়েন্স সিটি ডায়নামোশন হলে। এখানে মোশন নিয়ে নানান ধরণের এক্সপেরিমেন্ট শো-কেস করা আছে। শুধু সুইচে চাপ দেবেন আর আনন্দ নিয়ে দেখবেন সায়েন্স কা খেল। এই হলটার গঠনটাও মোশনের মত। ঘুরে ঘুরে নিচে গেছে। খুব চমৎকার জায়গা। নানান এক্সপেরিমেন্ট দেখতে দেখতে মনে হয় শৈশব যেন আবার ফিরে এসেছে দরজায়।

এরপর গেলাম পাশের সায়েন্স এক্সপ্লোরেশান হলে। সেখানে আলাদাভাবে টিকিট কাটা লাগলো ৮০ রুপি দিয়ে – হিউম্যান ইভল্যুশন এর প্যানারোমিক শো এবং ডার্ক রাইড এ চড়ে অতীতে ডায়নাসরের যুগে যাবার জন্য। দুটোই খুব চমৎকার এবং আকর্ষনীয়। খুব উপভোগ করলাম। চারপাশ ঘুরে ফিরে দুপুরের খাবারের জন্য সায়েন্স সিটির ভেতরের একটা কাউন্টারে গেলাম ফুড-কুপন নেবার জন্য। জিজ্ঞেস করলাম ভাত আছে কিনা। বলল, নেই। অগত্যা ১১০ রুপি দিয়ে এগ চাউমিন নিলাম। একজনের জন্য যে পরিমান দিলো তাতে করে মনে হলো আমার বাসার সবাইকে নিয়ে গেলেও এটা খাওয়া শেষ হত না। বহু কষ্টে অর্ধেকের একটু বেশি খেয়ে বাকিটা রেখে উঠে আসলাম।

এবারের গন্তব্য রবীন্দ্র সরোবর। ভাবলাম, লেকের হাওয়া খেতে খেতে কবিগুরুকে স্মরণ করা যাক। কিন্তু তা কি আর হবার আছে ! বাস পেতেই যতো বিপত্তি। কারণ সায়েন্স সিটি থেকে রবীন্দ্র সরোবরের সরাসরি বাস নেই। তাই নিউ টাউনের বাসে উঠে বসলাম। বেশ কিছু সময় পর দেখি বাস পার্ক স্ট্রিটের কাছে বিড়লা প্ল্যানেটোরিয়ামের কাছে চলে এসেছে। হঠাত কি মনে করে আমি বাস থেকে নেমে প্ল্যানেটোরিয়ামের টিকিট কাটতে লাইনে দাঁড়িয়ে গেলাম।

এই হলো অবস্থা !! একা থাকলে মতিগতির ঠিক থাকে না। একদিকে যেতে যেতে আরেক জায়গায় নেমে যাই। যাহোক, বিড়লা প্ল্যানেটোরিয়ামে সৌরজগতের উপর একটা শো হবে নাম ‘কসমিক কলিশনস’। ৮০ রুপি দিয়ে টিকিট নিলাম। শো-টাইম ৩ টা ৩০ মিনিট। যথাসময়ে শো শুরু হলো। স্প্লেন্ডিড শো। অসাধারণ। মনে হচ্ছিল যেন আমি মহাকাশে ভাসতে ভাসতে সব প্রত্যক্ষ করছি। বৃত্তাকার অডিটরিয়ামের উপরিভাগ পুরোটা জুড়ে গ্রহ, নক্ষত্র, আর বিস্ময় পরতে পরতে। অনন্যসাধারণ অনুভূতি। আমি অভিভূত হয়ে দেখলাম ৩০ মিনিটের শো ‘কসমিক কলিশনস’। সেই সাথে এটা ভেবে মন খারাপ হলো যে, মহাবিশ্বের অন্যান্য গ্রহ-নক্ষত্রের তুলনায় আমাদের পৃথিবীটা একটা ক্ষুদ্র ধুলিকণার চাইতেও ক্ষুদ্র, অথচ আমরা পৃথিবীর অধিবাসীরা নিজেদেরকে কতো বড় হাতি-ঘোড়াই না মনে করি ! শব্দে ধরা যাবে না এমন অনুভূতি হলো বিড়লা প্ল্যানেটোরিয়াম তথা তারামন্ডলে।

অসাধারণ এই অভিজ্ঞতা মাথায় নিয়ে ভাবলাম, অনেক হলো - এবার যাই মান্না দে’র বিখ্যাত গান কফি হাউসের সেই ‘কফি হাউস’টা দেখে আসি। যে কথা সেই কাজ। অনেক অপেক্ষার পর কলেজ স্ট্রীটের একটা বাসে করে চলে গেলাম কলেজ স্ট্রিট। তখনো বিকেল। প্রায় সাড়ে পাঁচটা মতো বাজে। আমি কফি হাউজে ঢুকলাম। কেমন একটা নস্টালজিয়ার মতো অনূভুতি হলো। যেখানে কতো সাহিত্যিক, শিল্পী, খ্যাতিমান মানুষেরা পদচিহ্ন রেখে গেছেন, সেখানে আমিও এসেছি। চারপাশে এই এখনকার তরুন-তরুণীদের আড্ডা ছাপিয়ে সেই পুরাতনদের কথা শুনতে পেলাম বাতাসে।

কফি হাউজে এসেছি আর কফি খাব না, তা কি হয়? জানালার পাশের একটা টেবিলে বসে তাই এক কাপ কফি আর একটা এগ-মামলেট অর্ডার করে দিলাম। তেল চপচপে ডিম আর তারপর কফি খেয়ে কফি হাউস থেকে বের হয়ে এলাম। মনে হলো, কফি হাউস সারাদিনই এমন লোকে লোকারণ্য হয়ে থাকে। কোনো টেবিলই খালি থাকে না এক মুহূর্ত। তরুণ-তরুণী, মধ্যবয়সী, নানান বয়সের মানুষ আসছে কফি খেতে, নাস্তা করতে, কিংবা আড্ডা দিতে। এখান থেকে বের হয়ে কলেজ স্ট্রিট ধরে হাঁটলাম। আজ বইয়ের দোকান সব বন্ধ। দু’এক জন বসেছে কিছু বই নিয়ে। আমি সন্ধ্যার আধো আলো-আধারিতে কলেজ স্ট্রিট ধরে হাঁটতে হাঁটতে ফিরছি। কলেজ স্কয়ারে বিদ্যাসাগর উদ্যানের লেকে চাঁদের আলোর খেলা দেখছি। আবার হাঁটছি ফুটপাত ধরে। ফুটপাত থেকে ফুটপাতে। জীবনানন্দ দাশ যেমন করে হাঁটতেন কলকাতার রাস্তায় রাস্তায়।

রাস্তার দু’পাশে ফুটপাত জুড়ে বসেছে জীবনের পসরা। কেউ রাস্তার উপরেই বসে গেছে তরিতরকারি নিয়ে। কেউ ফুটপাতে বসে বানাচ্ছে রুটি, ঘুগনি, সবজি-ভাজি। কেউ আবার গাছের ডাল কেটে দাঁতন বানাচ্ছে বিক্রির জন্য। কেউ গোসল করছে। একজন মধ্যবয়সী মহিলাকে দেখলাম রিকশা ভাড়া ঠিক করছে। একদল আবার ফুটপাতের উপরেই শুরু করে দিয়েছে কেরাম খেলা। আমি একটা মিস্টির দোকান থেকে দুটো রসগোল্লা খেলাম। অপূর্ব স্বাদ।

ওদিকে রাখি উৎসবের ঘটাও চলছে রাস্তায়। একটা ছোট মেয়েকে দেখলাম খাবার নিয়ে বরফের তৈরি একটা প্রতিমা দেখছে মনোযোগ দিয়ে। সামনে মোড়ের বটগাছের নিচে লাইটিং, প্যান্ডেল বসেছে। লাইন ধরে অনেকে খাবার নিচ্ছে প্যান্ডেল থেকে। হাসিমুখে ঘরে ফিরছে। এরই মধ্যে গড়গড় শব্দ করে একটা ট্রাম চলে গেল শ্যামবাজারের দিকে। হাঁটতে হাঁটতে একসময় মাইকে ভেসে এলেন রবীন্দ্রনাথ। বললেন, আকাশ ভরা সূর্য তারা, বিশ্ব ভরা প্রাণ।

আর সাথে সাথেই আনন্দে দুলে উঠলো আমার মন। আমি হাঁটছি ধীরলয়ে, আমার কানে ভেসে আসছেন রবীন্দ্রনাথ। চারিদিকে জীবনের শত আয়োজন দেখে মন অনাবিল প্রশান্তিতে ভরে উঠছে। এইতো জীবন। এইসব মানুষের বেঁচে থাকার নিরন্তর সংগ্রাম নিয়েই তো কলকাতা। ফুটপাত মাড়িয়ে চলতে চলতে আনমনে গেয়ে উঠলাম, আমি তাহারই মাঝখানে ... পেয়েছি ... পেয়েছি মোর স্থান / বিস্ময়ে ...তাই জাগে ... জাগে আমার প্রাণ ... আকাশভরা...



ছবিতে কলকাতা



১। হরিদাসপুর বর্ডার থেকে কলকাতার পথে মধ্যবিরতিতে দুপুরের খাবার। মূল্য ১৪০ রুপি





২। মিলেনিয়াম পার্ক, বিবিডি বাগ। এন্ট্রি ফ্রি।



৩। ইস্টার্ণ রেলওয়ের পাশের ফুটপাতে চলছে স্ট্রিট ভেন্ডরদের জীবন সংগ্রাম






৪। ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালস । এন্ট্রি ফি ৩০ রুপি



৫। আলিপুর জু-লজিকাল গার্ডেন। এন্ট্রি ফি ৩০ রুপি



৬। হাওড়া স্টেশন এবং হুগলি রিভার






৭। সায়েন্স সিটি। এন্ট্রি ফি ৯৮ রুপি।






৮। বিড়লা প্ল্যানেটোরিয়াম। এন্ট্রি ফি ৮০ রুপি (কসমিক কলিশন্স শো)।



৯। কফি হাউস, কলেজ স্ট্রিট, বিদ্যাসাগর উদ্যান।



১০। কলকাতার রাস্তায় রাস্তায়।


সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে আগস্ট, ২০১৮ সন্ধ্যা ৬:২৭
১৭টি মন্তব্য ১৭টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বাংলাদেশ একদিন মাথা উঁচু করে দাঁড়াবেই

লিখেছেন নতুন নকিব, ২১ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১:৫৩

বাংলাদেশ একদিন মাথা উঁচু করে দাঁড়াবেই

ছবি এআই জেনারেটেড।

ভিনদেশী আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে সত্যের বজ্রনিনাদে সোচ্চার হওয়ার কারণেই খুন হতে হয়েছে দেশপ্রেমিক আবরার ফাহাদকে। সেদিন আবরারের রক্তে লাল হয়েছিল বুয়েটের পবিত্র... ...বাকিটুকু পড়ুন

রাজাকারের বিয়াইন

লিখেছেন প্রামানিক, ২১ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ২:০৪


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

রাজাকারের বিয়াইন তিনি
মুক্তিযোদ্ধার সন্তান
ওদের সাথে দুস্তি করায়
যায় না রে সম্মান?

কিন্তু যদি মুক্তিযোদ্ধাও
বিপক্ষতে যায়
রাজাকারের ধুয়া তুলে
আচ্ছা পেটন খায়।

রাজাকাররা বিয়াই হলে
নয়তো তখন দুষি
মেয়ের শ্বশুর হওয়ার ফলে
মুক্তিযোদ্ধাও খুশি।

রচনা কালঃ ১৮-০৪-২০১৪ইং... ...বাকিটুকু পড়ুন

দাসত্বের শিকল ভাঙার স্বপ্ন দেখা এক ক্রান্তদর্শী ধূমকেতু ওসমান হাদী।

লিখেছেন মুঃ গোলাম মোর্শেদ (উজ্জ্বল), ২১ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ২:৪২

বাংলাদেশের স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে দেশে যে ধরণের রাজনৈতিক সংস্কৃতি চালু হয়েছে, তাহলো বিদেশী প্রভুরদের দাসত্ব বরণ করে রাজনৈতিক দলগুলোর রাষ্ট্র ক্ষমতায় গিয়ে দেশের মানুষের উপর প্রভুত্ব করা , আর... ...বাকিটুকু পড়ুন

দিপুকে হত্যা ও পোড়ানো বনাম তৌহিদী জনতা!

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ২১ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৩:০৫


পাইওনিয়ার নিটওয়্যারস বিডি লিমিটেড (Pioneer Knitwears (BD) Ltd.) হলো বাদশা গ্রুপের (Badsha Group) একটি অঙ্গ প্রতিষ্ঠান। বাদশা গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান কর্ণধার হলেন জনাব বাদশা মিয়া, যিনি একইসাথে এই... ...বাকিটুকু পড়ুন

সাজানো ভোটে বিএনপিকে সেনাবাহিনী আর আমলারা ক্ষমতায় আনতেছে। ভোট তো কেবল লোক দেখানো আনুষ্ঠানিকতা মাত্র।

লিখেছেন তানভির জুমার, ২১ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৮:২২



১০০% নিশ্চিত বিএনপি ক্ষমতায় আসছে, এবং আওয়ামী স্টাইলে ক্ষমতা চালাবে। সন্ত্রাসী লীগকে এই বিএনপিই আবার ফিরিয়ে আনবে।সেনাবাহিনী আর আমলাদের সাথে ডিল কমপ্লিট। সহসাই এই দেশে ন্যায়-ইনসাফ ফিরবে না। লুটপাট... ...বাকিটুকু পড়ুন

×