somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

সত্যজিৎ রায় : প্রিয় পাঁচটি চলচ্চিত্র

১০ ই নভেম্বর, ২০১৯ রাত ১২:১২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
গত সপ্তাহে সত্যজিৎ রায়ের বেশ কয়েকটি সিনেমা দেখা হলো। এগুলো হলো আগন্তুক, কাপুরুষ, মহানগর, অরণ্যের দিনরাত্রি, ও শাখা-প্রশাখা।



সত্যজিৎ রায় আমার প্রিয় ফিল্মমেকার। শুধু ফিল্মমেকার বা চলচ্চিত্র নির্মাতা বললে অবশ্য তার অনন্যসাধারণ প্রতিভা সম্পর্কে সঠিক ধারণা পাওয়া যাবে না। তিনি একাধারে চলচ্চিত্র নির্মাতা, চিত্রনাট্যকার, শিল্প নির্দেশক, সঙ্গীত পরিচালক এবং লেখক। বলে রাখা ভালো সত্যজিৎ রায় মোট ৩৭টি পূর্ণদৈর্ঘ্য কাহিনীচিত্র, প্রামাণ্যচিত্র ও স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন। তার নির্মিত প্রথম চলচ্চিত্র পথের পাঁচালী (১৯৫৫) ১১টি আন্তর্জাতিক পুরস্কার লাভ করে, এর মধ্যে অন্যতম ১৯৫৬ কান চলচ্চিত্র উৎসবে পাওয়া “শ্রেষ্ঠ মানব দলিল” (Best Human Documentary) পুরস্কার। পথের পাঁচালী, অপরাজিত (১৯৫৬) ও অপুর সংসার (১৯৫৯) – এই তিনটি একত্রে অপু ত্রয়ী নামে পরিচিত, এবং এই চলচ্চিত্র-ত্রয়ী সত্যজিতের জীবনের শ্রেষ্ঠ কর্ম হিসেবে বহুল স্বীকৃত।

২০০৪ সালে, বিবিসির সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি তালিকায় সত্যজিৎ ১৩তম স্থান লাভ করেছিলেন। যাহোক, এই অসম্ভব প্রতিভাবান মানুষটির বানানো কয়েকটি চলচ্চিত্রের সাথে পরিচিত হওয়া যাক। এ পাঁচটি চলচ্চিত্রের সবকটিই আমার ভীষণ প্রিয়।


চলচ্চিত্র: আগন্তক



কলকাতায় বসবাসরত সুধীন্দ্র বোসের স্ত্রী অনিলা একদিন সকালে হুট করে একটা অদ্ভুত চিঠি পান। চিঠিটা লিখেছেন তার ছোট মামা মনমোহন মিত্র যিনি ৩৫ বছর আগে নিরুদ্দেশ হয়ে যান। তখন অনিলার বয়স মাত্র দুই বছর, সুতরাং তখনকার কোনো স্মৃতিই তার আর মনে নেই। তাই হঠাৎ এই ভবঘুরে মামার ফিরে আসা কিংবা উড়ে এসে জুড়ে বসা তাদের সংসারে একটা দোলাচল তৈরি করে। তিনি আসলেই অনিলার আপন মামা কিনা এবং কেন তিনি এত বছর পর রক্তের দাবী নিয়ে ফিরে আসছেন – এটা নিয়ে অনিলার স্বামী সুধীন্দ্র বোসের মনে তৈরি হয় সন্দেহ। চলে মনমোহন মিত্র আসল না নকল মামা তা পরীক্ষার নানা আয়োজন। এভাবেই ধীরে ধীরে এগিয়ে যায় সিনেমাটি।

কেন দেখবো?

সিনেমাটি আমাদেরকে সভ্যতা সম্পর্কে একটা মৌলিক প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়। প্রকৃতির সাথে মানুষের কিংবা মানুষের সাথে মানুষের সম্পর্ক এবং এর খুঁটিনাটি বিষয়গুলো বলিষ্ঠভাবে উপস্থাপিত হয়েছে সিনেমাটিতে।


চলচ্চিত্র: কাপুরুষ



‘কাপুরুষ’ একটি ব্যর্থ প্রেমের গল্প। কিন্তু গল্পটি যেহেতু বলছেন সত্যজিৎ রায় তাই অনিবার্যভাবেই এখানে আছে মনস্তাত্ত্বিক দ্বিধা-দ্বন্দ্ব, প্রত্যাশা-অপ্রাপ্তির চোরাগলি।

অমিতাভ রায় নামে একজন চিত্রনাট্যকার সিনেমার জন্য গল্পের খোঁজে বের হয়েছেন। পথে তার গাড়ি নষ্ট হয়ে যায় এবং ঘটনাক্রমে এক চা-বাগানের ম্যানেজার বিমল গুপ্তের বাড়িতে তিনি আতিথ্য গ্রহণ করেন। বিমল গুপ্ত তার স্ত্রীর সাথে অমিতাভ রায়ের পরিচয় করিয়ে দিতে গেলে অমিতাভ রায় আশ্চর্য হয়ে লক্ষ্য করে যে এ মেয়েটিই তার প্রাক্তণ প্রেমিকা করুণা।

এ মুভিতে বিমল গুপ্ত একটা দারুণ ব্যতিক্রমী চরিত্র। কিছু কিছু জায়গায় তার ইনসাইটফুল কথাবার্তা শুনে অনাবিল মুগ্ধতা জাগে মনে।


কেন দেখবো?

কেন চা-বাগানের একজন মার্জিত ও রুচিশীল ম্যানেজারকে বিয়ে করেও করুণাকে প্রতি রাতে স্লিপিং পিল খেতে হয়? কেন বিমল গুপ্ত সকালে নাস্তা খেতে খেতে অমিতাভকে বললেন – বিবেক যদি থাকে, ইউ ড্রাউন ইট ইন এলকোহল, হা হা হা হা হা’। কেন বললেন এ কথা? – এসব ভেতরকার খবরাখবর জানতে হলে সিনেমাটা না দেখে উপায় কি!


চলচ্চিত্র: মহানগর



মহানগর চলচ্চিত্রটি নরেন্দ্রনাথ মিত্রের একটি ছোটগল্প অবলম্বনে রচিত, যেখানে আরতি মজুমদার নামের একজন নারী রক্ষণশীল সমাজের গণ্ডি থেকে বেরিয়ে এসে সেলসপারসনের চাকরি বেছে নেয়। একসময় তার স্বামীর চাকরি চলে গেলে সে হয়ে ওঠে পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। কিন্তু নারীর উপার্জনে সংসার চালানো তো পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় একটা ব্যতিক্রমী ঘটনা। এ ঘটনাকে আরতির স্বামী কিংবা ওর শ্বশুর কিভাবে দ্যাখে? তাদের মনের ভেতর কী ঘটে যায়? কেন তাদের সংসারে তৈরি হয় একটা কষ্টকর মনস্তাত্ত্বিক জটিলতা? এর শেষ কোথায়?

কেন দেখবো?

আরতির চরিত্রটি কোমল ও কঠোরে মেশানো, যে সমাজের প্রচলিত নিয়মের বাইরে পা বাড়িয়ে নতুন পরিবর্তনকে স্বাগত জানিয়েছে। আবার নীতি-আদর্শের প্রয়োজনে ভবিষ্যৎ সাফল্যকে পায়ে ঠেলতেও সে দ্বিধা করে না। আরতি সত্যজিৎ রায়ের সৃষ্টি একটি অনন্য নারী চরিত্র।

চলচ্চিত্র: অরণ্যের দিনরাত্রি



অরণ্যের দিনরাত্রি সিনেমাটি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের উপন্যাস অবলম্বনে তৈরি। চার বন্ধু অসীম, সঞ্জয়, হরি এবং শেখর, ছুটিতে পালামৌ এর কাছাকাছি একটি জায়গাতে বেড়াতে যায়। সেখানে বিনা অনুমতিতে চৌকিদারকে বকশিশ দিয়ে একটা বাংলোতে ওঠে। এ জায়গাতেই একসময় ওদের পরিচয় হবে অপর্ণা ও তার বিধবা বৌদির সাথে, যারা কলকাতা থেকে এখানে ক’মাসের জন্য বেড়াতে আসে প্রতিবছর।

তারপর নানা টুকরো টুকরো ঘটনার ঘনঘটা শেষে একসময় একটা মেলায় অসীম তার মনের কথা খুলে বলে অপর্ণাকে। অপর্ণাও অসীমকে নিরাশ করে না। অন্যদিকে বৌদির সাথে সঞ্জয়ের একটা অমিমাংসিত সম্পর্ক তৈরি হয়। আবার হরি আকৃষ্ট হয় আদিবাসী এক মেয়ের প্রতি। শেখর চরিত্রে রবি ঘোষের দুরন্ত অভিনয় সিনেমাটিকে একটি অনন্য মাত্রা দিয়েছে।

কেন দেখবো?

নাগরিক জীবন থেকে ছুটি নিয়ে চার বন্ধুর অরণ্য-অভিযানের এক অনবদ্য কাহিনী, যার পরতে পরতে উঠে এসেছে প্রেম, বিরহ, সামাজিক জটিলতা, হিংসা, লোভ, নাগরিক জীবনের প্রতি জমে থাকা ঘৃণা। সত্যজিৎ রায় প্রতিটি চরিত্রকে স্বতন্ত্রভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন রূপালি পর্দায়।

চলচ্চিত্র: শাখা-প্রশাখা



১৯৯০ সালে মুক্তি পাওয়া এই ছবিতে সত্যজিৎ রায় আধুনিক সমাজের প্রতিটি স্তরে দূর্নীতির স্বরুপ ফুটিয়ে তুলেছেন। সিনেমাটিতে আনন্দ মজুমদার একজন সৎ ও প্রভাবশালী ব্যক্তি। তাকে সকলে সমানভাবে শ্রদ্ধা করে, কারণ তার জীবনে অসততার কোনো নজির নেই। আনন্দ মজুমদারের ধারণা তার চারটি ছেলে তার আদর্শ পেয়েছে। কিন্তু তার এই ধারণা কি সত্য? এ যুগে সততার সিঁড়িতে ভর দিয়ে কতটুকু ওপরে ওঠা সম্ভব?

কেন দেখবো?

ক্ষমতা আর সম্পদের পেছনের গল্পটা উঠে এসেছে এই ছবিতে। সত্যিই কি যারা সততা আঁকড়ে ধরে, তারা রসাতলে তলিয়ে যায়?


সত্যজিৎ রায়ের প্রত্যেকটি সিনেমা অনবদ্য। ভাবনার খোরাক যোগায়, দেখা জিনিসকেই নতুনভাবে নতুন আঙ্গিকে দেখতে শেখায়। আশাকরি এই পাঁচটি চলচ্চিত্র যে কোনো মননশীল দর্শকের ভালো লাগবে।

সত্যজিৎ রায় : প্রিয় পাঁচটি চলচ্চিত্র



সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই নভেম্বর, ২০১৯ রাত ১২:১৮
১৬টি মন্তব্য ১৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

খুলনায় বসবাসরত কোন ব্লগার আছেন?

লিখেছেন ইফতেখার ভূইয়া, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৪:৩২

খুলনা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় তথা কুয়েট-এ অধ্যয়নরত কিংবা ঐ এলাকায় বসবাসরত কোন ব্লগার কি সামুতে আছেন? একটি দরিদ্র পরিবারকে সহযোগীতার জন্য মূলত কিছু তথ্য প্রয়োজন।

পরিবারটির কর্তা ব্যক্তি পেশায় একজন ভ্যান চালক... ...বাকিটুকু পড়ুন

একমাত্র আল্লাহর ইবাদত হবে আল্লাহ, রাসূল (সা.) ও আমিরের ইতায়াতে ওলামা তরিকায়

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৬:১০



সূরাঃ ১ ফাতিহা, ৪ নং আয়াতের অনুবাদ-
৪। আমরা আপনার ইবাদত করি এবং আপনার কাছে সাহায্য চাই।

সূরাঃ ৪ নিসার ৫৯ নং আয়াতের অনুবাদ-
৫৯। হে মুমিনগণ! যদি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। মুক্তিযোদ্ধা

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:২১



মুক্তিযুদ্ধের সঠিক তালিকা প্রণয়ন ও ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা প্রসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেছেন, ‘দেশের প্রতিটি উপজেলা পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধা যাচাই বাছাই কমিটি রয়েছে। তারা স্থানীয়ভাবে যাচাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতীয় রাজাকাররা বাংলাদেশর উৎসব গুলোকে সনাতানাইজেশনের চেষ্টা করছে কেন?

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:৪৯



সম্প্রতি প্রতিবছর ঈদ, ১লা বৈশাখ, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, শহীদ দিবস এলে জঙ্গি রাজাকাররা হাউকাউ করে কেন? শিরোনামে মোহাম্মদ গোফরানের একটি লেখা চোখে পড়েছে, যে পোস্টে তিনি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইরান-ইজরায়েল দ্বৈরথঃ পানি কতোদূর গড়াবে??

লিখেছেন ভুয়া মফিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:২৬



সারা বিশ্বের খবরাখবর যারা রাখে, তাদের সবাই মোটামুটি জানে যে গত পহেলা এপ্রিল ইজরায়েল ইরানকে ''এপ্রিল ফুল'' দিবসের উপহার দেয়ার নিমিত্তে সিরিয়ায় অবস্থিত ইরানের কনস্যুলেট ভবনে বিমান হামলা চালায়।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×