আমরা দেখেছি সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের মিনিয়াপোলিসে পুলিশের হাতে জর্জ ফ্লয়েড নামের একজন কৃষ্ণাঙ্গ ব্যক্তির মৃত্যুর পর সমগ্র বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে বর্ণবাদ বিরোধী আন্দোলন। এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, একটি বাসযোগ্য পৃথিবী গড়ে তুলতে হলে আমাদেরকে বর্ণবাদী মনোভাব পরিহার করতে হবে। বর্ণবাদ পশ্চিমা বিশ্বের একক কোনো সমস্যা নয়, আমরা এই বাংলাদেশের মানুষেরা অনেকেই বর্ণবাদী মনোভাবে আক্রান্ত এবং প্রায়শই আমাদের আচরনে সেটা প্রকাশ করে থাকি। আমাদের মধ্যে এই বর্ণবাদী মনোভাবকে উসকে দেয়ার পেছনে ফেয়ারনেস ক্রিম বা ত্বক ফর্সাকারী পণ্যের একটি বড় ভূমিকা রয়েছে।
ফেয়ারনেস ক্রিমের বিষয়ে আসার আগে চলুন জেনে নেয়া যাক, বর্ণবাদ বলতে আসলে কি বোঝানো হয়। বর্ণবাদের একটি সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞা দেয়া কঠিন। সাধারণত বর্ণবাদ হলো এমন দৃষ্টিভঙ্গি, চর্চা এবং ক্রিয়াকলাপ যেখানে বিশ্বাস করা হয় যে, মানুষ কতগুলো গোষ্ঠীতে বিভক্ত এবং কোনো কোনো গোষ্ঠী অন্য গোষ্ঠীর চেয়ে নির্দিষ্ট কিছু বৈশিষ্ট্যের জন্য উঁচু অথবা নিচু। খুব সংক্ষেপে বর্ণবাদ বলতে বোঝায়, এক জাতি অন্য জাতি অপেক্ষা উৎকৃষ্ট এবং তার উপর কর্তৃত্ব করার অধিকারী - এমন ধারণা বা বিশ্বাস। বর্ণবাদ নানাভাবে প্রকাশিত হতে পারে – কখনো গোত্র দিয়ে, কখনো আঞ্চলিকতা দিয়ে, আবার কখনোবা গায়ের চামড়ার রঙ দিয়ে। তাই শ্বেতাঙ্গ বা সাদা চামড়ার মানুষকে কৃষ্ণাঙ্গ বা কালো চামড়ার মানুষের চেয়ে উৎকৃষ্ট মনে করাটা নিঃসন্দেহে বর্ণবাদী আচরণের বহিঃপ্রকাশ।
আমাদের দেশের মানুষের মধ্যে এই বর্ণবাদী আচরন লক্ষ্য করা যায়। বিশেষত নারীরা তাদের নিজেদের অজান্তেই বর্ণবাদী মনোভাব নিয়ে বেড়ে ওঠেন। কোনো পরিবারে যদি গায়ের রঙ কালো এমন মেয়ে শিশু জন্ম নেয়, তাহলে পরিবারের সদস্যরা তার ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে হতাশ হয়ে পড়েন। গায়ের রঙ কালো মেয়েরা হীনমন্যতায় ভোগে এবং রঙ ফর্সা করার জন্য নানাবিধ প্রসাধনী ব্যবহার করতে থাকে। পুরুষের মধ্যেও বর্ণবাদী আচরণ দেখা যায়। তারা ফর্সা ত্বকের মানদন্ডে সৌন্দর্য বিচার করে থাকে প্রায়শই। বিয়ের ক্ষেত্রে ফর্সা পাত্রীই তাদের পছন্দের শীর্ষে থাকে। সমাজে নারী পুরুষ উভয়েরই ফর্সা ত্বকের প্রতি এমন দুর্বলতা থাকায়, ফর্সা হওয়ার প্রবল প্রচেষ্টা লক্ষ্য করা যায় তাদের মধ্যে। আর এই সুযোগটিকে কাজে লাগিয়ে ফেয়ারনেস ক্রিম বা ত্বক ফর্সাকারী পণ্যের কোম্পানি রমরমা ব্যবসা ফেঁদে বসে। বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে তারা সবসময় আপনার মধ্যে একটি হীনমন্যতাবোধ জাগিয়ে রাখে। আপনাকে মনে করিয়ে দিতে থাকে যে, আপনার ত্বকের স্বাভাবিক যে রঙ, তা যথেষ্ট নয়। আপনাকে বোঝানো হয় যে, শুধুমাত্র ত্বকের রঙ ফর্সা ও উজ্জ্বল করতে পারলেই আপনি আকর্ষনীয় হয়ে উঠবেন এবং জীবনের নানাবিধ সমস্যা থেকে সহজেই মুক্তি পাবেন, উত্তরোত্তর সফলতা অর্জন করবেন। স্পষ্টত বর্ণবাদী মনোভাব উসকে দেয়া এসব বিজ্ঞাপন প্রতিদিন প্রচার করা হয় দেশের প্রায় সবগুলো টিভি চ্যানেল, এফএম রেডিও, এমনকি ফেসবুক ও ইউটিউবে। এতে অভিনয় করেন নামীদামী শিল্পীরা।
ত্বক ফর্সাকারী পণ্যের বিজ্ঞাপন প্রতিনিয়ত দেখতে দেখতে একসময় মানুষের মধ্যে এই বিশ্বাস দৃঢ় হয় যে, ফর্সা ত্বক মানেই সুন্দর এবং ত্বক ফর্সা করতে পারলেই অন্যদের চেয়ে অনেকটা এগিয়ে থাকা যাবে।
ফেয়ারনেস ক্রিমের আড়ালে বর্ণবাদ
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা'র তথ্য অনুযায়ী, সারাবিশ্বেই ফেয়ারনেস ক্রিমের ব্যবহার রয়েছে। তবে এশিয়ার দেশগুলিতে এর ব্যবহার সবথেকে বেশি। চিন, ভারত, বাংলাদেশসহ এশিয়ার দেশগুলির প্রায় পঞ্চাশ শতাংশ মহিলা এই ধরনের ক্রিম ব্যবহার করেন।
আমাদের দেশে ফেয়ারনেস ক্রিমের সবচেয়ে বড় বাজার ইউনিলিভার নামের একটি বহুজাতিক কোম্পানির, যাদের ত্বক ফর্সাকারী ক্রিম ‘ফেয়ার অ্যান্ড লাভলী’ সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয়। ১৯৭৫ সালে বাজারে আসার পরপর দ্রুত ভারতের বাজারে জনপ্রিয়তা পায় এই ক্রিম। এখনও ভারতেই এর সবচেয়ে বড় বাজার রয়েছে, এরপর রয়েছে বাংলাদেশে। আমরা যদি শুধুমাত্র এই একটি পণ্যের বিজ্ঞাপনের দিকে লক্ষ্য করি, তাহলেই বর্ণবাদী মনোভাব উসকে দেয়ার পেছনে এর ভূমিকাটি স্পষ্ট হয়ে উঠবে।
টেলিভিশনে ‘ফেয়ার অ্যান্ড লাভলী’র নানা ধরণের বিজ্ঞাপন প্রচারিত হয়। সব ক’টিতেই দেখা যায়, শ্যামলা বা কালো একটি মেয়ে ‘ফেয়ার অ্যান্ড লাভলী’ মেখে ত্বক ফর্সা ও উজ্জ্বল করার মাধ্যমে জীবনে সফল হয়েছে। ধরা যাক, মেয়েটি চাকরি পাচ্ছে না, ‘ফেয়ার অ্যান্ড লাভলী’ ব্যবহারের পর তার চাকরি হয়ে গেল। বারবার পাত্র দেখতে আসলেও বিয়ে হচ্ছে না, দেখা গেল ‘ফেয়ার অ্যান্ড লাভলী’ ব্যবহারের পর তার দিক থেকে কেউ আর চোখ ফেরাতে পারছে না। অফিসের লুক নিয়ে চিন্তিত, ক্রিমটি ব্যবহারের পর উঠেছে আকর্ষণীয়। এরকম নানা ধরণের বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে আপনার মধ্যে হীনমন্যতা তৈরি করা হচ্ছে এবং তারপর এটাকে পূঁজি করে আপনার কাছেই বিক্রি করা হচ্ছে ফেয়ারনেস ক্রিম।
এছাড়া ক্রিমের ধরনে ও মোড়কেরও রয়েছে ভিন্নতা। কখনো আপনাকে বোঝানো হচ্ছে যে আপনার দরকার মাল্টিভিটামিন, তো এর কিছুদিন পরেই হয়তো বলা হচ্ছে - উজ্জ্বলতা পুরোনো হয়ে গেছে এখন আপনার দরকার এইচডি-গ্লো। এছাড়া আছে এডভান্সড মাল্টিভিটামিন, উইন্টার ফেয়ারনেস, বিবি ক্রিম, লেজার ট্রিটমেন্ট, আয়ুর্বেদিক কেয়ার, আরো কতো কি। পুরুষদের জন্য আছে মেনস ফেয়ার অ্যান্ড লাভলী, মেনস একশান, ইত্যাদি।
এভাবে চটকদার বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে ক্রমাগত আমাদেরকে বলা হচ্ছে যে, আমাদের গায়ের যে স্বাভাবিক রঙ ও উজ্জ্বলতা আছে সেটি যথেষ্ট নয়। বিষয়টি যেন এমন যে, কালো বা শ্যামলা মানুষ সুন্দর হতে পারে না, কালো হলে আপনি কর্মক্ষেত্রে সফল হবেন না, উপযুক্ত সঙ্গীও আপনার জুটবে না আপনার কপালে। তাই ফেয়ারনেস ক্রিম ব্যবহারের মাধ্যমে ত্বক ফর্সা করলেই কেবল আপনি সুন্দর হয়ে উঠবেন এবং অনেক সম্ভাবনার পথও উন্মক্ত হবে।
কেন আপনি ত্বক ফর্সা করতে চান?
ইতিহাস থেকে জানা যায় যে, ভারতীয় উপমহাদেশ মধ্যযুগ থেকেই ছিলো ইউরোপীয়দের বাণিজ্যের একটি অন্যতম কেন্দ্র। ইউরোপের নানা দেশ থেকে ইউরোপীয় স্যাটেলার, পর্তুগিজ, ডাচ, ফ্রেঞ্চ বণিকগণ এ উপমহাদেশে এসে ব্যবসা করেছে, বসতি গড়েছে। এরপর ষোড়শ শতাব্দী থেকে শুরু হয়েছে মুঘল শাসন এবং তারপর ১৯৪৭ সাধে স্বাধীনতা লাভের আগ পর্যন্ত এই উপমহাদেশ শাসিত হয়েছে ইংরেজদের দ্বারা। এইসব শাসকগোষ্ঠীর সকলেই ছিল সাদা চামড়ার অধিকারী। অন্যদিকে এ উপমহাদেশের দেশগুলো গ্রীষ্মপ্রধান হওয়াতে এবং ত্বকে মেলানিনের ঘনত্ব বেশি থাকায়, এখানকার মানুষের ত্বক সাধারণত শ্যামলা বর্ণের। তাই এই উপমহাদেশের মানুষেরা সাদা চামড়ার মানুষদের দ্বারা দীর্ঘদিন শাসিত হয়ে চামড়ার সাদা রঙের সাথে ক্ষমতা, সম্মান, আর প্রতিপত্তিকে একাত্ম করে দেখতে শিখেছে।
এছাড়া ত্বক ফর্সা করার প্রতি আমাদের আকাঙ্ক্ষা বৃদ্ধি হওয়ার আরেকটি কারণ বিনোদন মাধ্যম। বিশেষত টেলিভিশনে বিভিন্ন নাটক, সিনেমা ইত্যাদিতে সবসময় গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র, নায়ক নায়িকাকে ফর্সা হিসেবে দেখানো হয়। এতে করে তাদের অনুকরণ করেও অনেকে নিজেদের ত্বক ফর্সা ও উজ্জ্বল করতে সচেষ্ট হচ্ছেন। এমনিভাবে একটি বদ্ধমূল ধারণা তৈরি হয়েছে যে, আপনি ফর্সা ও উজ্জ্বল ত্বকের অধিকারী হলেই অধিক সুন্দর ও সফল হয়ে উঠবেন।
আপনার করণীয়
প্রথমত, আপনাকে ত্বক ফর্সাকারী পণ্যের রকমারি প্রলোভন থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। একজন শিক্ষিত আধুনিক মানুষ হিসেবে আপনাকে বুঝতে হবে যে, আপনার চামড়ার রঙের উপর আপনার সৌন্দর্য বা সাফল্য নির্ভর করে না। আপনার সৌন্দর্য নির্ভর করে আপনার পরিচ্ছন্নতা, রুচিশীলতা ও মেধার উপর। আর আপনি মেধাবী ও পরিশ্রমী হলে তবেই সফল হবেন। এজন্য আপনাকে কোনো রঙ ফর্সাকারী ক্রিম ব্যবহার করতে হবে না।
অবশ্যই আপনি ত্বকের প্রয়োজনীয় পরিচর্যা করবেন। কিন্তু ফর্সা ত্বক সৌন্দর্যের পরিচায়ক এমন বর্ণবাদী চিন্তা থেকে আপনাকে বেরিয়ে আসতে হবে। কারণ এমন বর্ণবাদী মনোভাব সমাজের মানুষের মধ্যে দূরত্ব তৈরি করে। এতে করে ব্যক্তিগত হতাশা ও হীনমন্যতাবোধে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
তাই পরবর্তীতে ফেয়ারনেস ক্রিম বা ত্বক ফর্সাকারী পণ্য কেনার আগে নিজেকে প্রশ্ন করুন যে, এর মাধ্যমে নিজের অজান্তেই আপনি বর্ণবাদী হয়ে উঠছেন না তো?
* পোস্টে ব্যবহৃত ছবিটি ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে জুন, ২০২০ সন্ধ্যা ৬:৫১