somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

'৭১ এর বুড়ি : সাধারণ কিছু মানুষের গল্প

০৫ ই নভেম্বর, ২০০৭ রাত ১২:৩৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

একটা গল্প শোনাই। সাধারণ গল্প। ছোট্ট গল্প। বর্ণনার রংচংয়ে হয়তো অসাধারণ হয়ে উঠতে পারত,কিন্তু সাদাকালো সত্যি ঘটনার ছেঁড়া অংশে রংয়ের প্রলেপ দিয়ে সেটাকে আর
কিম্ভুতকিমাকার করে তুলতে চাইনা। গল্প যুদ্ধের,তবে বীরত্ব,নাটকীয়তা,নায়ক-নায়িকা,ক্লাইম্যাক্স আছে কিনা বিচার করতে পারিনি। সময়টা খুব পরিচিত ১৯৭১। মাস,মনে নেই,কারণ কথক দেবাশিষ দা'রও মনে ছিলনা,যিনি আবার শুনেছিলেন কোন এক মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারের কাছে,যে যোদ্ধা এই গল্পের আপাত নায়ক।

স্থানটা ভালুকার কাছাকাছি কোথাও। মুক্তিযোদ্ধাদের ছোট্ট একটা দলের দায়িত্ব সেখানকার একটা ব্রিজ উড়িয়ে দেয়া। কারণ? কারণ পাকবাহিনী বেশ বড়সড় একটা দল আর সাঁজোয়া বহর নিয়ে এগোচ্ছে ব্রিজের ওপারে ক্যাম্প ফেলবে বলে,ওদিকের মুক্তিবাহিনীকে নির্মূল করাই যার উদ্দেশ্য। কাজেই ঠেকাতে হবেই,যেভাবেই হোক।

সবকিছু দেখেশুনে রেকি করে ব্রিজ উড়ানোর পরিকল্পনা করা হয়ে গেল.যে রাতে পাকবাহিনী আসবে,তার বেশ খানিক আগে এসে ব্রিজে ডিনামাইট পাতার কাজ শেষ,ইচ্ছা,পাকবাহিনীর মোটামুটি বেশিরভাগ অংশটা ব্রিজে উঠলে সেটা উড়িয়ে দেয়া হবে,ক্ষয়ক্ষতি যতটা বেশি হয় আরকি। রাত গভীর হচ্ছে,ছেলেরা ওঁতপেতে বসে থেকে মশার কামড়ে বিরক্ত হয়ে যাচ্ছে,মাথামোটাগুলোর দেখা নেই। মোটামুটি অধৈর্য্য হয়ে গেছে যখন সবাই,ভারি গাড়ির শব্দ শোনা গেল,বোঝা গেল,মহাজনরা আসছে। সবাই যার যার জায়গা নিয়ে তৈরি।আস্তে আস্তে পুরো বহরটা দেখা গেল,বেশ বড়,দ্রুত ঠিক করা হয়ে গেল,প্রথম সাঁজোয়া গাড়িটা ব্রিজের মাঝখানটা পার হলেই ব্রিজটা উড়িয়ে দেয়া হবে। কিন্তু প্রথম গাড়িটা যখন ব্রিজের কাছে চলে এসেছে,তখনি লাগলো গোলমাল। হঠাত করেই ক্ষেতের মাঝখান থেকে এক বুড়ি উদয় হল,আর হলো তো হলো,রাস্তা পার হয়ে অন্যদিকে যাবার বদলে সোজা ব্রিজের উপর উঠলো। এইবারে সবার মাথায় হাত। গাড়িগুলিও ব্রিজের খুব কাছে চলে এসেছে,এদিকে,থুড়থুড়ে বুড়ি দেখেই কিনা,পাকবাহিনীও বুড়িকে না থামিয়ে যেতে দিচ্ছে। এদিকে ঐপারে চাপা গলায় তর্ক শুরু হয়ে গেছে,কি করা যায় তা নিয়ে,কারণ বুড়ির যে হাঁটার গতি আর ভাব,তাতে বোঝাই যাচ্ছে বুড়ি ব্রিজ পার হতে হতে পাকবাহিনীও পগাড় পার হয়ে যাবে। কমবয়সী একজন পরামর্শ দিলো যেহেতু এই বহরটাকে থামাতে না পারলে মুক্তিযোদ্ধাদের বড় রকম ঝামেলায় পড়তে হবে,কাজেই বুড়ি থাকলেও কিছু করার নেই,উড়িয়ে দেয়া হোক ব্রিজ। কিন্তু বেঁকে বসলেন কমান্ডার স্বয়ং। না,কিছুতেই না। পাকবাহিনীকে থামানো কর্তব্য,তাই বলে নিরপরাধ এক বুড়ো মানুষকে মেরে ফেলবো? সেটা হবে না। তর্ক আরো ঘোরালো
হয়ে উঠলে কমান্ডার শেষমেষ হুমকি দিলেন,কেউ একাজ করার চেষ্টা করলে তিনি সোজা গুলি করবেন,এরপর যা হয় হোক। বাধ্য হয়ে অন্যরা মেনে নিলো। যাই হোক,দেখা গেল অনুমান ঠিক,বুড়ি ব্রিজ পার হয়েছে,পাকবাহিনীও প্রায় পার হয়ে এসেছে,এখন আর খামোকা ডিনামাইট ফাটিয়ে লাভ নেই। মাথায় হাত দিয়ে বসে ভাবছেন ব্যাপারটা কি হলো,এমন সময় সবাই আবার একটু সজাগ হয়ে উঠলেন,কারণ সেই বুড়ি ব্রিজ পার হয়ে তাদের খুব খুব কাছে চলে এসেছে। হাতে কিছু
একটা আছে,পুঁটলির মত। দেখে মনে হলো কাউকে খুঁজছে। এবার যোদ্ধাদের পালা,ঝটপট বুড়িকে ঘিরে ফেলা হলো। বুড়িকে দেখে অবশ্য মনে হলোনা ভয় পেয়েছে। সোজা জিজ্ঞেস করলো-- "বাবারা তোমরা মুক্তিবাহিনীর পোলা?" কমান্ডারের উত্তর--"ক্যান আপনের কি দরকার?" এবার বুড়ির উত্তর--" কালকে শুনসি এইপারে মুক্তির পোলারা আসে,অনেক কষ্ট কইরা পোলাগুলি যুদ্ধ করে,খাইতে পায়না ঠিকমত। মনে করসি ঘরে যা আসে নিয়া যাই,দিনে তো পারিনা বাবারা,রাইতে কেউ দেখে না,এইজন্য বাইর হইসি খাওয়া নিয়া,এইদিকে কোন জায়গায় কাউরে পাইলে খাওয়াগুলি দিতাম।" কমান্ডার আর যোদ্ধারা এবার নীরব,মুখে ভাষা আসবার কথাও না। একটু আগেই কিনা এই বুড়িকেই তারা ব্রিজসহ উড়িয়ে দিতে চেয়েছিল। বুড়ির ঐ পুঁটলিতে বেশ কিছু খাবারদাবার,না-দেখা না-চেনা কোন মায়ের সন্তানের জন্য,যারা যুদ্ধ করছে তাদের মায়ের জন্য,দেশের জন্য। কোথা থেকে এল এই মমতা? কিসের জন্য পরের সন্তানের জন্য নিজের সন্তানের খাবার নিয়ে অন্ধকার পথে কোন মা ছুটে আসে? কমান্ডার,প্রায় ২০ বছর পরেও,এই প্রশ্নের জবাব দিতে পারেননি। শুধু চোখ মুছে বলেছিলেন,আমরা সবাই,ঐদিন থেকেই জানতাম,যে দেশে এমন মা আছে,ঐ দেশের মানুষকে দুনিয়ার কেউ আটকাতে পারবে না,আজ হোক কাল হোক স্বাধীন আমরা হবই। যুদ্ধে আমরা জিতবই,জিতবই।

[এই সত্যি ঘটনাটা,দেবাশিষ দা'র মুখে শোনা,ময়মনসিংহের এক মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারের কাছে।জানিনা কারো স্মৃতি হিসাবে কোথাও লেখা হয়েছে কিনা। খুব দাগ কেটেছিলো,চোখ মুছেছিলাম সবাই,শ্রোতারা। মনে হলো,সবাইকে একবার শোনাই,নাই বা থাকলো অসাধারণ কোন বীরত্বগাথা,শোনাতে তো সমস্যা নেই।]
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে সেপ্টেম্বর, ২০০৯ বিকাল ৩:৩৬
৪০টি মন্তব্য ২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

সবুজের মাঝে বড় হলেন, বাচ্চার জন্যে সবুজ রাখবেন না?

লিখেছেন অপলক , ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:১৮

যাদের বয়স ৩০এর বেশি, তারা যতনা সবুজ গাছপালা দেখেছে শৈশবে, তার ৫ বছরের কম বয়সী শিশুও ১০% সবুজ দেখেনা। এটা বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থা।



নব্বয়ের দশকে দেশের বনভূমি ছিল ১৬... ...বাকিটুকু পড়ুন

আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে লীগ আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে জামাত

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৪৬


বাংলাদেশে রাজনৈতিক ছদ্মবেশের প্রথম কারিগর জামাত-শিবির। নিরাপত্তার অজুহাতে উনারা এটি করে থাকেন। আইনী কোন বাঁধা নেই এতে,তবে নৈতিক ব্যাপারটা তো অবশ্যই থাকে, রাজনৈতিক সংহিতার কারণেই এটি বেশি হয়ে থাকে। বাংলাদেশে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাঙ্গালির আরব হওয়ার প্রাণান্ত চেষ্টা!

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১০



কিছুদিন আগে এক হুজুরকে বলতে শুনলাম ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে নাকি তারা আমূল বদলে ফেলবেন। প্রধানমন্ত্রী হতে হলে সূরা ফাতেহার তরজমা করতে জানতে হবে,থানার ওসি হতে হলে জানতে হবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

লিখেছেন নতুন নকিব, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৪৩

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

চা বাগানের ছবি কৃতজ্ঞতা: http://www.peakpx.com এর প্রতি।

আমাদের সময় একাডেমিক পড়াশোনার একটা আলাদা বৈশিষ্ট্য ছিল। চয়নিকা বইয়ের গল্পগুলো বেশ আনন্দদায়ক ছিল। যেমন, চাষীর... ...বাকিটুকু পড়ুন

অবিশ্বাসের কি প্রমাণ আছে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩১



এক অবিশ্বাসী বলল, বিশ্বাসের প্রমাণ নাই, বিজ্ঞানের প্রমাণ আছে।কিন্তু অবিশ্বাসের প্রমাণ আছে কি? যদি অবিশ্বাসের প্রমাণ না থাকে তাহলে বিজ্ঞানের প্রমাণ থেকে অবিশ্বাসীর লাভ কি? এক স্যার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×