somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পোস্টটি যিনি লিখেছেন

দেবশ্রী চক্রবর্ত্তী
আমি চিত্রাঙ্গদা, আমি রাজেন্দ্রনন্দিনী।নহি দেবী,নহি সামান্যা নারী।পূজা করি মোরে রাখিবেউর্ধ্বেখসে নহি নহি,হেলা করি মোরেরাখিবে পিছেখসে নহি নহি।যদি পার্শ্বে রাখ মোরেসঙ্কটে সম্পদে,সম্মতি দাও যদি কঠিনব্রতেসহায় হতে,পাবে তবে তুমি চিন

উদ্বাস্তু সমস্যা ও রোহিঙ্গাদের নিয়ে কিছু কথা

১৪ ই অক্টোবর, ২০১৫ রাত ৯:২২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

উদ্বাস্তু সমস্যা ও রোহিঙ্গাদের নিয়ে কিছু কথা

দেবশ্রী চক্রবর্ত্তী


সন্ত্রাসের ঘায়ে সর্বহারা বিশ্বের প্রায় এক কোটি দশ লক্ষ মানুষ! ভিটেমাটি ছেড়ে মাথা গোঁজার ঠাঁই খুঁজতে সীমান্তের কাঁটাতারে আটকে পড়েছেন কেউ। কেউ আবার কোনও মতে দু’বেলার খাবার জোগাচ্ছেন উদ্বাস্তু শিবিরে।
অনেকে যাত্রিবোঝাই নৌকোয় সমুদ্রে পাড়ি দিচ্ছেন আস্তানার খোঁজে। বর্তমানে বিশ্ব জুড়ে উদ্বাস্তু সমস্যার এই ভয়াবহ চেহারা সামনে এনেছে রাষ্ট্রপুঞ্জের একটি রিপোর্ট।

শরণার্থী বা উদ্বাস্তু একজন ব্যক্তি যিনি নিজ ভূমি ছেড়ে অথবা আশ্রয়ের সন্ধানে অন্য দেশে অস্থায়ীভাবে অবস্থান করেন। জাতিগত সহিংসতা, ধর্মীয় উগ্রতা, জাতীয়তাবোধ, রাজনৈতিক আদর্শগত কারণে সমাজবদ্ধ জনগোষ্ঠীর নিরাপত্তাহীনতায়
আক্রান্তই এর প্রধান কারণ। যিনি শরণার্থী বা উদ্বাস্তুরূপে স্থানান্তরিত হন, তিনি আশ্রয়প্রার্থী হিসেবে পরিচিত হন।
আশ্রয়প্রার্থী ব্যক্তির স্বপক্ষে তার দাবীগুলোকে রাষ্ট্র কর্তৃক স্বীকৃত হতে হবে।

৩১ ডিসেম্বর, ২০০৫ সাল পর্যন্ত আফগানিস্তান, ইরাক, সিয়েরালিওন, মায়ানমার, সোমালিয়া, দক্ষিণ সুদান এবং ফিলিস্তিন থেকে বিশ্বের প্রধান শরণার্থী উৎসস্থল হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে।আইডিপি অনুযায়ী বিশ্বের সবচেয়ে বেশী শরণার্থী ব্যক্তি
এসেছে দক্ষিণ সুদান থেকে প্রায় ৫ মিলিয়ন। জনসংখ্যা অনুপাতে সবচেয়ে বেশী আইডিপি রয়েছে আজারবাইজানে। সেখানে ২০০৬ সালের তথ্য মোতাবেক প্রায় আট লক্ষ শরণার্থী অন্যত্র আশ্রয় নিয়েছে।

১৯৫১ সালে জাতিসংঘ কর্তৃক শরণার্থীদের মর্যাদা বিষয়ক সম্মেলনে অনুচ্ছেদ ১এ-তে সংক্ষিপ্ত আকারে শরণার্থীর সংজ্ঞা তুলে ধরে। একজন ব্যক্তি যদি গভীরভাবে উপলদ্ধি করেন ও দেখতে পান যে, তিনি জাতিগত সহিংসতা, ধর্মীয় উন্মাদনা, জাতীয়তাবোধ,
রাজনৈতিক আদর্শ, সমাজবদ্ধ জনগোষ্ঠীর সদস্য হওয়ায় ঐ দেশের নাগরিকের অধিকার থেকে দূরে সরানো হচ্ছে, ব্যাপক ভয়-ভীতিকর পরিবেশ বিদ্যমান, রাষ্ট্র কর্তৃক পর্যাপ্ত নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হচ্ছে; তখনই তিনি শরণার্থী হিসেবে বিবেচিত হন। ১৯৬৭ সালের
সম্মেলনের খসড়া দলিলে উদ্বাস্তুর সংজ্ঞাকে বিস্তৃত করা হয়। আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকায় অনুষ্ঠিত আঞ্চলিক সম্মেলনে যুদ্ধ এবং অন্যান্য সহিংসতায় আক্রান্ত ব্যক্তি কর্তৃক নিজ দেশত্যাগ করাকেও অন্তর্ভূক্ত করা হয়।

এ সংজ্ঞায় শরণার্থীকে প্রায়শঃই ভাসমান ব্যক্তিরূপে অন্তর্ভূক্ত করা হয়। সম্মেলনে গৃহীত সংজ্ঞার বাইরে থেকে যদি যুদ্ধের কারণে নির্যাতন-নিপীড়নে আক্রান্ত না হয়েও মাতৃভূমি পরিত্যাগ করেন অথবা, জোরপূর্বক নিজ ভূমি থেকে বিতাড়িত হন - তাহলে তারা শরণার্থী
হিসেবে বিবেচিত হবেন।

সংঘর্ষ এবং রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার প্রেক্ষাপটে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন সময়ে অগণিতসংখ্যক লোক শরণার্থী হয়েছিলেন। যুদ্ধ শেষে একমাত্র ইউরোপেই ৪০ মিলিয়নেরও অধিক লোক শরণার্থী ছিল। ১৯৪৩ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মিত্রশক্তি জাতিসংঘ ত্রাণ ও পুণর্বাসন প্রশাসন (ইউএনআরআরএ) গঠন করে। যার প্রধান কাজ ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অক্ষশক্তির নিয়ন্ত্রণাধীন দেশসহ ইউরোপ ও চীন থেকে আগত শরণার্থীদেরকে সহায়তা করা। তাদের নিয়ন্ত্রণে ও প্রত্যক্ষ সহায়তায় ৭ মিলিয়ন লোক নিজ বাসভূমিতে ফিরে যায়। কিন্তু উদ্বাস্তু এক মিলিয়ন লোক মাতৃভূমিতে ফিরে যেতে অস্বীকৃতি জানায়।

বিশ্বযুদ্ধের শেষ মাসে প্রায় পাঁচ মিলিয়ন জার্মান বেসামরিক নাগরিক পূর্ব প্রুশিয়া, পোমারানিয়া এবং সিলেসিয়া রাজ্য থেকে রেড আর্মির প্রচণ্ড আক্রমণের হাত থেকে রক্ষার লক্ষ্যে ম্যাকলেনবার্গ, ব্রান্ডেনবার্গ এবং স্যাক্সনিতে উদ্বাস্তু হিসেবে আশ্রয় নেয়।

পটসড্যাম সম্মেলনের সিদ্ধান্ত মিত্রশক্তি অনুমোদন না করায় যুগোস্লাভিয়া এবং রোমানিয়ায় অবস্থানরত হাজার হাজার জাতিগত জার্মানদেরকে সোভিয়েত ইউনিয়নে দাস শ্রমের জন্য ফেরত পাঠানো হয়। বিশ্বের ইতিহাসে এটিই ছিল সবচেয়ে বেশী শরণার্থী স্থানান্তর প্রক্রিয়া। ১৫ মিলিয়ন জার্মানদের সবাই এতে অন্তর্ভূক্ত ছিলেন। এছাড়াও, দুই মিলিয়নেরও অধিক জার্মান বিশ্বযুদ্ধকালীন সময়ে বিতাড়িত হয়ে প্রাণ হারান।




পূর্ব ইউরোপ থেকে ব্যাপক সংখ্যায় দলে দলে লোক দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে অন্যত্র চলে যাওয়ার প্রেক্ষাপটে শরণার্থীরূপে বিবেচিত হয়। প্রধানতঃ ইউরোপীয় শরণার্থী হিসেবে ইহুদী এবং স্লাভগণ জোসেফ স্টালিন, নাজি এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রতিক্রিয়ার প্রেক্ষাপটে যুক্তরাষ্ট্রে আশ্রয়গ্রহণকে নিরুৎসাহিত করা হয় ।

আজ আমার আলোচনার বিষয় রোহিঙ্গাদের নিয়ে । গত এক বছর খবরের কাগজ খুললেই আমরা দেখতে পাই এই নাম । আমরা অনেকেই জানি না রোহিঙ্গা কারা । তাই আজ একবার চেষ্টা করব রোহিঙ্গাদের
শিকর সন্ধানের ।


দেড় হাজার বছরের যাযাবর জীবন রোহিঙ্গাদের। আধুনিক বাঙ্গালিদের কাছে মিয়ানমারকে পরিচিত করেন সম্ভবত কথাসাহিত্যিক শরৎচন্দ্র চট্টপ্যাধ্যায়। তার উপন্যাস বাঙালি পাঠকের কাছে পরিচিত করে ইয়াঙ্গুন বা আকিয়াব বন্দরকে- সারি সারি বাঙালি জাহাজ নোঙর করে সেখানে। বোঝা যায়, শিল্পসাহিত্যে আর বাণিজ্যে কতটা সমৃদ্ধ ছিল রেঙ্গুন। উঠে আসে আরাকান রাজসভার কথাও।
এই আরাকান রাজসভায় রচিত হয়েছিল মুসলিম সাহিত্যের অনুপ্রেরনা- কবি আলাওলের পদ্মাবতী কাব্য । আলাওলের সাথে উঠে আসেন কোরোশি মাগন ঠাকুর, দৌলত কাজী, কাজী মরদান এর মত মধ্যযুগে বাংলা সাহিত্যের খ্যাতনাম আরো অনেক নাম। যে রাজসভায় বাংলা সাহিত্য পেয়েছিল মধ্যযুগের কাব্য সতীময়না লোরচন্দ্রানী'র মত কাব্য।
আরাকানকে বারবার উল্লেখিত হয়েছে রোসাং, রোসাঙ্গো দেশ ও রোসাঙ্গো শহর নামে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের তিন বছর পর ১৯৪৮ সালে ব্রিটিশ শাসন থেকে স্বাধীন হয় মিয়ানমার। ব্রিটিশ চলে গেলেও রেখে যায় সাম্প্রদায়িক সংঘাতের বীজ। আরাকান প্রদেশে বৌদ্ধ রাখাইন আর মুসলিম রোহিঙ্গাদের সাম্প্রদায়িক বিভাজন।
স্বাধীনতার পরপরই আরাকানের স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে একটি ব্যর্থ সশস্ত্র বিদ্রোহ করে রোহিঙ্গা মুসলিমরা। এজন্য চরম মূল্য দিতে হয় তাদের। অচ্ছুৎ বলে চাকরিতেও নিয়োগ বন্ধ। চলাচলে আনা হয় নানা বিধিনিষেধ।
১৯৬২ সালে জেনারেল নে-উইন রোহিঙ্গাদের অবৈধ অভিবাসী ঘোষণা করে। ১৯৭৪ সালে জরুরি আইনে রোহিঙ্গাদের জাতীয়তা কেড়ে নেয়া হয়। এর পরের ইতিহাস শুধু না পাওয়ার। শতবছরের বঞ্চনা আর লাঞ্ছনার। নিজ ভূমিতে রোহিঙ্গাদের কাটে পরবাসী জীবন।
বিশ্বের ইতিহাসে রাষ্ট্রহীন জনগোষ্ঠীর তালিকায়ও নাম লিখা হয়ে যায় রোহিঙ্গাদের।
স্বাধীনতার পর থেকেই বারবার সামরিক শাসন, বেড়েছে নির্যাতন নিপীড়ন। পাড়ি দিতে হয়েছে শত সহস্র মাইল। কখনো তারা আশ্রয় নিয়েছে বাংলাদেশে। কারো জায়গা হয়েছে থাইল্যান্ড সীমান্তে। রাখাইন প্রদেশে রোহিঙ্গাদের শেকড় থাকলেও তা অস্বীকার করে মিয়ানমার।

১৯৯১-৯২ সালে আড়াই লক্ষাধিক মুসলিম রোহিঙ্গা শরণার্থী বার্মার (বর্তমান: মায়ানমার) সামরিক জান্তার নির্যাতন-নিপীড়ন থেকে মুক্তি পেতে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। তাদের অনেকেই বিশ বছর যাবৎ বাংলাদেশে অবস্থান করছে। বাংলাদেশ সরকার তাদেরকে দু'টি ভাগে ভাগ করেছে। শরণার্থী ক্যাম্পে অবস্থানকারী স্বীকৃত রোহিঙ্গা এবং বাংলাদেশী সম্প্রদায়ের সাথে মিশে যাওয়া অস্বীকৃত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী রয়েছে। কক্সবাজারের নয়াপাড়া এবং কুতুপালং এলাকার দু'টি ক্যাম্পে ত্রিশ হাজার রোহিঙ্গা বাস করছে।

আরাকান রাজ্য থেকে গত কয়েক মাসে রোহিঙ্গাদের উপর ব্যাপক নির্যাতনের ফলে তাদের বাংলাদেশে অবৈধ অনুপ্রবেশ অব্যাহত রয়েছে। কঠোর নিবন্ধিকরণ আইনে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব, চলাফেরায় বিধিনিষেধ আরোপ, ভূমি বাজেয়াপ্তকরণ, বার্মার বৌদ্ধদের অবস্থানের জন্য জোরপূর্বক উচ্ছেদকরণ, ২০০৬ সালের শেষ পর্যায়ে পশ্চিমাঞ্চলীয় আরাকানের ৯টি মসজিদের আশেপাশে অবকাঠামোগত প্রকল্প গ্রহণ এর জন্য দায়ী বলে ধারনা করা হয়।

রোহিঙ্গা আদিবাসী জনগোষ্ঠী পশ্চিম মায়ানমারের আরাকান রাজ্যের একটি উলেখযোগ্য নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী। এরা ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত। রোহিঙ্গাদের আলাদা ভাষা থাকলেও তা অলিখিত। মায়ানমারের আকিয়াব, রেথেডাং, বুথিডাং মংডু, কিয়ক্টাও, মাম্ব্রা, পাত্তরকিল্লা এলাকায় এদের বাস। বর্তমান ২০১২ সালে, প্রায় ৮,০০,০০০ রোহিঙ্গা মায়ানমারে বসবাস করে। মায়ানমার ছাড়াও ৫ লক্ষের অধিক রোহিঙ্গা বাংলাদেশে এবং প্রায় ৫লাখ সৌদিআরবে বাস করে বলে ধারনা করা হয় যারা বিভিন্ন সময় বার্মা সরকারের নির্যাতনের কারণে দেশ ত্যাগ করতে বাধ্য হয়। জাতিসংঘের তথ্যমতে, রোহিঙ্গারা বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে নির্যাতিত জনগোষ্ঠী

বর্তমান মিয়ানমারের রোহিং (আরাকানের পুরনো নাম) এলাকায় এ জনগোষ্ঠীর বসবাস। ইতিহাস ও ভূগোল বলছে, রাখাইন প্রদেশের উত্তর অংশে বাঙালি, পার্সিয়ান, তুর্কি, মোগল, আরবীয় ও পাঠানরা বঙ্গোপসাগরের উপকূল বরাবর বসতি স্থাপন করেছে। তাদের কথ্য ভাষায় চট্টগ্রামের স্থানীয় উচ্চারণের প্রভাব রয়েছে। উর্দু, হিন্দি, আরবি শব্দও রয়েছে। রাখাইনে দুটি সম্প্রদায়ের বসবাস ‘মগ’ ও ‘রোহিঙ্গা’। মগরা বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী। মগের মুল্লুক কথাটি বাংলাদেশে পরিচিত। দস্যুবৃত্তির কারণেই এমন নাম হয়েছে ‘মগ’দের। এক সময় তাদের দৌরাত্ম্য ঢাকা পর্যন্ত পৌঁছেছিল। মোগলরা তাদের তাড়া করে জঙ্গলে ফেরত পাঠায়।

রোহিঙ্গাদের সম্পর্কে একটি প্রচলিত গল্প রয়েছে এভাবে_ সপ্তম শতাব্দীতে বঙ্গোপসাগরে ডুবে যাওয়া একটি জাহাজ থেকে বেঁচে যাওয়া লোকজন উপকূলে আশ্রয় নিয়ে বলেন, আল্লাহর রহমে বেঁচে গেছি। এই রহম থেকেই এসেছে রোহিঙ্গা।

তবে,ওখানকার রাজসভার বাংলা সাহিত্যের লেখকরা ঐ রাজ্যকে রোসাং বা রোসাঙ্গ রাজ্য হিসাবে উল্লেখ করেছেন।

তবে ইতিহাস এটা জানায় যে, ১৪৩০ থেকে ১৭৮৪ সাল পর্যন্ত ২২ হাজার বর্গমাইল আয়তনের রোহিঙ্গা স্বাধীন রাজ্য ছিল। মিয়ানমারের রাজা বোদাওফায়া এ রাজ্য দখল করার পর বৌদ্ধ আধিপত্য শুরু হয়।

এক সময়ে ব্রিটিশদের দখলে আসে এ ভূখণ্ড। তখন বড় ধরনের ভুল করে তারা এবং এটা ইচ্ছাকৃত কিনা, সে প্রশ্ন জ্বলন্ত। তারা মিয়ানমারের ১৩৯টি জাতিগোষ্ঠীর তালিকা প্রস্তুত করে। কিন্তু তার মধ্যে রোহিঙ্গাদের নাম অন্তর্ভুক্ত ছিল না। এ ধরনের বহু ভূল করে গেছে ব্রিটিশ শাসকরা।

১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি মিয়ানমার স্বাধীনতা অর্জন করে এবং বহুদলীয় গণতন্ত্রের পথে যাত্রা শুরু হয়। সে সময়ে পার্লামেন্টে রোহিঙ্গাদের প্রতিনিধিত্ব ছিল। এ জনগোষ্ঠীর কয়েকজন পদস্থ সরকারি দায়িত্বও পালন করেন। কিন্তু ১৯৬২ সালে জেনারেল নে উইন সামরিক অভ্যুত্থান ঘটিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করলে মিয়ানমারের যাত্রাপথ ভিন্ন খাতে প্রবাহিত হতে শুরু করে। রোহিঙ্গাদের জন্য শুরু হয় দুর্ভোগের নতুন অধ্যায়। সামরিক জান্তা তাদের বিদেশি হিসেবে চিহ্নিত করে। তাদের নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়। ভোটাধিকার কেড়ে নেওয়া হয়। ধর্মীয়ভাবেও অত্যাচার করা হতে থাকে। নামাজ আদায়ে বাধা দেওয়া হয়। হত্যা-ধর্ষণ হয়ে পড়ে নিয়মিত ঘটনা। সম্পত্তি জোর করে কেড়ে নেওয়া হয়। বাধ্যতামূলক শ্রমে নিয়োজিত করা হতে থাকে। তাদের শিক্ষা-স্বাস্থ্যসেবার সুযোগ নেই। বিয়ে করার অনুমতি নেই। সন্তান হলে নিবন্ধন নেই। জাতিগত পরিচয় প্রকাশ করতে দেওয়া হয় না। সংখ্যা যাতে না বাড়ে, সে জন্য আরোপিত হয় একের পর এক বিধিনিষেধ।

মিয়ানমারের মূল ভূখণ্ডের অনেকের কাছেই রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী 'কালা' নামে পরিচিত। বাঙালিদেরও তারা 'কালা' বলে। ভারতীয়দেরও একই পরিচিতি। এ পরিচয়ে প্রকাশ পায় সীমাহীন ঘৃণা ।

মায়ানমারের আরাকান রাজ্যের (রাখাইন) রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর আধুনিক লিখিত ভাষাই হল রোহিঙ্গা ভাষা। এটি ইন্দো-ইউরোপীয়ান ভাষাগোষ্ঠীর অন্তর্গত যার সাথে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষার মিল রয়েছে। রোহিঙ্গা গবেষকগণ আরবি, হানিফি, উর্দু, রোমান এবং বার্মিজ স্ক্রীপ্ট ব্যবহার করে সফলতার সাথে রোহিঙ্গা ভাষা লিখতে সক্ষম হয়েছেন। হানিফি হচ্ছে নতন তৈরি করা স্ক্রীপ্ট যা আরবি এবং তার সাথে চারটি বর্ণ (ল্যাটিন এবং বার্মিজ) সংযোগে সৃষ্ট।

সম্প্রতি একটি ল্যাটিন স্ক্রীপ্টের উদ্ভাবন হয়েছে যা ২৬টি ইংরেজি বর্ণ এবং অতিরিক্ত ২টি ল্যাটিন বর্ণ, Ç (তাড়নজাত R -এর জন্য) এবং Ñ (নাসিকা ধ্বনি-র জন্য) সংযোগে সৃষ্ট। রোহিঙ্গা ধ্বনি সঠিকভাবে বোঝার জন্য ৫টি স্বরধ্বনি (áéíóú) ব্যবহার করা হচ্ছে। এটি আই.এস.ও দ্বারা স্বীকৃত।

অষ্টম শতাব্দীতে আরবদের আগমনের মধ্য দিয়ে আরাকানে মুসলমানদের বসবাস শুরু হয়। আরব বংশোদ্ভূত এই জনগোষ্ঠী মায়্যু সীমান্তবর্তী অঞ্চলের (বাংলাদেশের চট্টগ্রাম বিভাগের নিকট) চেয়ে মধ্য আরাকানের নিকটবর্তী ম্রক-ইউ এবং কাইয়্যুকতাও শহরতলীতেই বসবাস করতে পছন্দ করতো। এই অঞ্চলের বসবাসরত মুসলিম জনপদই পরবর্তীতে রোহিঙ্গা নামে পরিচিতি লাভ করে।

ম্রক-ইউ রাজ্যের সম্রাট নারামেখলার (১৪৩০-১৪৩৪) শাসনকালে বাঙ্গালীদের আরাকানের বসবাসের প্রমাণ পাওয়া যায়। ২৪ বছর বাংলায় নির্বাসিত থাকার পরে সম্রাট বাংলার সুলতানের সামরিক সহায়তায় পুনরায় আরাকানের সিংহাসনে আরোহন করতে সক্ষম হন। যে সব বাঙ্গালী সম্রাটের সাথে এসেছিল তারা আরাকানে বসবাস করতে শুরু করে। সম্রাট নারামেখলা বাংলার সুলতানের দেওয়া কিছু অঞ্চল ও আরাকানের ওপর সার্বভৌমত্ব অর্জন করে। সম্রাট নারামেখলা পরবর্তীতে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন এবং বাংলার প্রতি কৃ্তজ্ঞতা স্বরূপ আরাকানে বাংলার ইসলামী স্বর্ণমূদ্রা চালু করেন। পরবর্তীতে নারামেখলা নতুন মূদ্রা চালু করেন যার একপাশে ছিল বার্মিজ বর্ণ এবং অপরপাশে ছিল ফার্সী বর্ণ। বাংলার প্রতি আরাকানের কৃ্তজ্ঞতা ছিল খুবই অল্প সময়ের জন্য। ১৪৩৩ সালে সুলতান জালালুদ্দিন মুহাম্মদ শাহের মৃত্যু হলে সম্রাট নারামেখলার উত্তরাধিকারীরা ১৪৩৭ সালে রামু এবং ১৪৫৯ সালে চট্টগ্রাম দখল করে নেয়। ১৬৬৬ সাল পর্যন্ত চট্টগ্রাম আরাকানের দখলে ছিল। বাংলার সুলতানদের কাছ থেকে স্বাধীনতা অর্জনের পরেও আরাকানের রাজাগণ মুসলিম রীতিনীতি বজায় রেখে চলে। বৌদ্ধ রাজাগণ নিজেদেরকে বাংলার সুলতানদের সাথে তুলনা করতো এবং মুঘলদের মতোই জীবন যাপন করতো। তারা মুসলিমদেরকেও রাজদরবারের গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ দিত।১৭ শতকের দিকে আরাকানে বাঙ্গালী মুসলিমদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে। তারা আরাকানের বিভিন্ন কর্ম ক্ষেত্রে কাজ করতো। যেহেতু রাজাগণ বৌদ্ধ হওয়ার পরেও বাংলার সুলতানদের রীতিনীতি অনুযায়ীই রাজ্য পরিচালনা করতো, তাই আরাকানের রাজদরবারে বাংলা, ফার্সী এবং আরবি ভাষার হস্তলিপিকরদের মধ্যে অনেকেই ছিল বাঙ্গালী। কামেইন বা কামান নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠী যারা মায়ানমার সরকারের নৃতাত্ত্বিক জাতিসত্ত্বার মর্যাদা পেয়েছে তারা আরাকানের মুসলিম জনগোষ্ঠীরই একটা অংশ ছিল।

১৭৮৫ সালে বার্মিজরা আরাকান দখল করে। এর পরে ১৭৯৯ সালে পঁয়ত্রিশ হাজারেরও বেশি মানুষ বার্মিজদের গ্রেফতার এড়াতে এবং আশ্রয়ের নিমিত্তে আরাকান থেকে নিকটবর্তী চট্টগ্রাম অঞ্চলে চলে আসে।[২০] বার্মার শোসকেরা আরাকানের হাজার হাজার মানুষকে হত্যা করে এবং একটা বড় অংশকে আরাকান থেকে বিতাড়িত করে মধ্য বার্মায় পাঠায়। যখন ব্রিটিশরা আরাকান দখল করে তখন যেন এটি ছিল একটি মৃত্যুপূরী।১৭৯৯ সালে প্রকাশিত "বার্মা সাম্রাজ্য"তে ব্রিটিশ ফ্রাঞ্চিজ বুচানন-হ্যামিল্টন উল্লেখ করেন, "মুহাম্মদ(সঃ) - এর অনুসারীরা", যারা অনেকদিন ধরে আরাকানে বাস করছে, তাদেরকে "রুইঙ্গা" বা "আরাকানের অধিবাসী" বলা হয়।

কৃষিকাজের জন্য আরাকানের কম জন অধ্যুষিত এবং উর্বর উপত্যকায় আশপাশের এলাকা থেকে বাঙ্গালী অধিবাসীদের অভিবাসন করার নীতি গ্রহণ করেছিল ব্রিটিশরা। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলাকে আরাকান পর্যন্ত বিস্তৃত করেছিল। আরাকান ও বাংলার মাঝে কোন আন্তর্জাতিক সীমারেখা ছিল না এবং এক অঞ্চল থেকে আরেক অঞ্চলে যাওয়ার ব্যাপারে কোন বিধি-নিষেধও ছিল না। ১৯ শতকে, হাজার হাজার বাঙ্গালী কাজের সন্ধানে চট্টগ্রাম অঞ্চল থেকে আরাকানে গিয়ে বসতি গড়েছিল। এছাড়াও, হাজার হাজার রাখাইন আরাকান থেকে বাংলায় চলে এসেছিল।

১৮৯১ সালে ব্রিটিশদের করা এক আদমশুমারীতে দেখা যায়, আরাকানে তখন ৫৮,২৫৫ জন মুসলমান ছিল। ১৯১১ সালে এ সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে ১৭৮,৬৪৭ জন হয়।[২৪] অভিবাসনের মূল উদ্দেশ্য ছিল ব্রিটিশ বাংলার সস্তা শ্রম যা আরাকানের ধান ক্ষেতের কাজে লাগত। বাংলার এই অধিবাসীরা (বেশিরভাগই ছিল চট্টগ্রাম অঞ্চলের) মূলত আরাকানের দক্ষিণেই অভিবাসিত হয়েছিল। এটা নিশ্চিত যে, ভারতের এই অভিবাসন প্রক্রিয়া ছিল পুরো অঞ্চল জুড়ে, শুধু আরাকানেই নয়। ঐতিহাসিক থান্ট মিন্ট-ইউ লিখেছেন: "বিংশ শতাব্দীর শুরুতে, বার্মায় আসা ভারতীয়দের সংখ্যা কোনভাবেই আড়াই লক্ষের কম নয়। এই সংখ্যা ১৯২৭ সাল পর্যন্ত বাড়তেই থাকে এবং অভিবাসীদের সংখ্যা হয় ৪৮০,০০০ জন, রেঙ্গুন নিউ ইয়র্ককেও অতিক্রম করে বিশ্বের বড় অভিবাসন বন্দর হিসেবে। মোট অভিবাসীদের সংখ্যা ছিল প্রায় ১.৩ কোটি (১৩ মিলিয়ন)।" তখন বার্মার রেঙ্গুন, আকিয়াব, বেসিন, প্যাথিন এবং মৌমেইনের মত অধিকাংশ বড় শহরগুলোতে ভারতীয় অভিবাসীরা ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ। ব্রিটিশ শাসনে বার্মিজরা অসহায়ত্ব বোধ করত এবং দাঙ্গা-হাঙ্গামার মাধ্যমে তারা অভিবাসীদের উপর প্রভাব খাটানোর চেষ্টা করত।[২৫]

অভিবাসনের ফলে সংঘাত মূলত আরাকানেই ছিল সবচেয়ে প্রকট। ১৯৩৯ সালে, রোহিঙ্গা মুসলিম ও রাখাইন বৌদ্ধদের মধ্যকার দীর্ঘ শত্রুতার অবসানের জন্য ব্রিটিশ প্রশাসন জেমস ইস্টার এবং তিন তুতের দ্বারা একটি বিশেষ অনুসন্ধান কমিশন গঠন করে। কমিশন অনুসন্ধান শেষে সীমান্ত বন্ধ করার সুপারিশ করে, এর মধ্যে শুরু হয় ২য় বিশ্ব যুদ্ধ এবং এর পরে ব্রিটিশরা আরাকান ছেড়ে চলে যায়।

১৯৪২ সালের ২৮শে মার্চ, মায়ানমারের মিনবিয়া এবং ম্রক-ইউ শহরে রাখাইন জাতীয়তাবাদী এবং কারেইনপন্থীরা প্রায় ৫,০০০ মুসলমানকে হত্যা করে। ইতোমধ্যে, রাখাইন রাজ্যের উত্তরাঞ্চলে প্রায় ২০,০০০ মুসলমানকে হত্যা করা হয়। এতে উপ-কমিশনার ইউ য়ু কিয়াও খায়াং-ও নিহত হন যিনি দাঙ্গা নিয়ণ্ত্রনের চেষ্টা করছিলেন।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়, জাপানীরা ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের অধীনস্হ বার্মায় আক্রমণ করে। ব্রিটিশ শক্তি পরাজিত হয়ে ক্ষমতা ছেড়ে চলে যায়। এর ফলে ব্যাপক সংঘর্ষ ছড়িয়ে পরে। এর মধ্যে বৌদ্ধ রাখাইন এবং মুসলিম রোহিঙ্গাদের মধ্যকার সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ছিল উল্লেখযোগ্য। এই সময়ে ব্রিটিশপন্হীদের সাথে বার্মার জাতীয়তাবাদীদেরও সংঘর্ষ হয়। জাপানীদের আক্রমণের সময় উত্তর আরাকানের ব্রিটিশপন্হী অস্ত্রধারী মুসলমানদের দল বাফার জোন সৃষ্টি করে।রোহিঙ্গারা যুদ্ধের সময় মিত্রপক্ষকে সমর্থন করেছিল এবং জাপানী শক্তির বিরোধিতা করেছিল, পর্যবেক্ষণে সাহায্য করেছিল মিত্রশক্তিকে।

জাপানীরা হাজার হাজার রোহিঙ্গাদের নির্যাতন, ধর্ষণ এবং হত্যা করেছিল। এই সময়ে প্রায় ২২,০০০ রোহিঙ্গা সংঘর্ষ এড়াতে সীমান্ত অতিক্রম করে বাংলায় চলে গিয়েছিল।

জাপানী এবং বার্মাদের দ্বারা বারংবার গণহত্যার শিকার হয়ে প্রায় ৪০,০০০ রোহিঙ্গা স্হায়ীভাবে চট্টগ্রামে চলে আসে।

১৯৪৭ সালে রোহিঙ্গারা মুজাহিদ পার্টি গঠন করে যারা জিহাদি আন্দোলন সমর্থন করতো।মুজাহিদ পার্টির লক্ষ্য ছিল আরাকানে একটি স্বাধীন মুসলিম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা। তারা জেনারেল নে উইনের নেতৃত্বে ১৯৬২ সালের সামরিক অভ্যুত্থানের পূর্ব পর্যন্ত অত্যন্ত সক্রিয় ছিল। নে উইন তাদেরকে দমনের জন্য দুই দশকব্যাপী সামরিক অভিযান পরিচালনা করেন। উল্লেখযোগ্য একটি অভিযান ছিল "কিং ড্রাগন অপারেশন" যা ১৯৭৮ সালে পরিচালিত হয়। এর ফলে অনেক মুসলমান প্রতিবেশী বাংলাদেশে পালিয়ে আসে এবং শরনার্থী হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। বাংলাদেশ ছাড়াও উল্লেখযোগ্য সংখ্যার রোহিঙ্গারা পাকিস্তানের করাচীতে চলে যায় (দেখুন পাকিস্তানে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী)। এরপরও, বার্মার মুজাহিদরা আরাকানের দূর্গম এলাকায় এখনও সক্রিয় আছে

প্রায় অর্ধ শতাব্দী ধরে বার্মা শাসন করছে মায়ানমারের সামরিক জান্তা। ক্ষমতা কুক্ষিগত করার জন্য এরা বার্মিজ জাতীয়তাবাদ এবং থেরাভেদা বৌদ্ধ ধর্মীয় মতবাদ ব্যাপকভাবে ব্যবহার করে থাকে। আর এর ফলেই তারা রোহিঙ্গা, চীনা জনগোষ্ঠী যেমন - কোকাং, পানথাইদের(চীনা মুসলিম) মত ক্ষুদ্র জাতিসত্ত্বাকে ব্যপকভাবে নির্যাতন করে থাকে। কিছু নব্য গণতন্ত্রপন্থী নেতা যারা বার্মার প্রধান জনগোষ্ঠী থেকে এসেছেন তারাও রোহিঙ্গাদের বার্মার জনগণ হিসেবে স্বীকার করেন না।
বার্মার সরকার রোহিঙ্গা ও চীনা জনগোষ্ঠীর মত ক্ষুদ্র জাতিসত্ত্বাদের বিরুদ্ধে দাঙ্গার উসকানি দিয়ে থাকে এবং এ কাজ তারা অতি সফলতার সাথেই করে যাচ্ছে।

রাখাইনে ২০১২ সালের দাঙ্গা হচ্ছে মায়ানমারের উত্তরাঞ্চলীয় রাখাইন রাজ্যের রোহিঙ্গা মুসলিম ও বোদ্ধ রাখাইনদের মধ্যে চলমান সংঘর্ষের ঘটনাপ্রবাহ। দাঙ্গা শুরু হয় জাতিগত কোন্দলকে কেন্দ্র করে এবং উভয় পক্ষই এতে জড়িত হয়ে পরে।

রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী মূলত ইসলাম ধর্মের অনুসারী। যেহেতু বার্মা সরকার তাদের পড়াশুনার সুযোগ দেয় না, তাই অনেকেই মোলিক ইসলামী শিক্ষাকেই একমাত্র পড়াশুনার বিষয় হিসেবে গ্রহণ করেছে। অধিকাংশ গ্রামেই মসজিদ এবং মাদ্রাসা (ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান) রয়েছে। ঐতিহ্যগতভাবে, পুরুষরা জামাতে এবং মহিলারা বাড়িতেই প্রার্থণা করে থাকে।

রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে বলা হয় "বিশ্বের সবচেয়ে কম প্রত্যাশিত জনপদ"এবং "বিশ্বের অন্যতম নিগৃহীত সংখ্যালঘু"। ১৯৮২ সালের নাগরিকত্ব আইনের ফলে তারা নাগরিকত্ব থেকে বঞ্চিত হন।তারা সরকারি অনুমতি ছাড়া ভ্রমণ করতে পারে না, জমির মালিক হতে পারে না এবং দুইটির বেশি সন্তান না নেওয়ার অঙ্গীকারনামায় স্বাক্ষর করতে হয়।

অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের অনুসারে, ১৯৭৮ সাল থেকে মায়ানমারের মুসলিম রোহিঙ্গারা মানবাধিকার লংঘনের শিকার হচ্ছে এবং তারা প্রতিবেশী বাংলাদেশে পালিয়ে আসতে বাধ্য হচ্ছে। ফলে:

“ রোহিঙ্গাদের চলাচলের স্বাধীনতা ব্যপকভাবে নিয়ণ্ত্রিত এবং তাদের অধিকাংশের বার্মার নাগরিকত্ব বাতিল করা হয়েছে। তাদের উপর বিভিন্ন রকম অন্যায় ও অবৈধ কর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। তাদের জমি জবর-দখল করা, জোর-পূর্বক উচ্ছেদ করা, ঘর-বাড়ি ধ্বংস করা এবং বিবাহের উপর অর্থনৈতিক অবরোধ চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। যদিও উত্তর রাখাইন রাজ্যে গত দশকে বাধ্যতামূলক শ্রমিকের কাজ করা কমেছে তারপরও রোহিঙ্গাদের রাস্তার কাজে ও সেনা ক্যাম্পে বাধ্যতামূলক শ্রমিকের কাজ করতে হচ্ছে। […]
১৯৭৮ সালে মায়ানমার সেনাবাহিনীর 'নাগামান' ('ড্রাগন রাজা';) অভিযানের ফলে প্রায় দুই লক্ষ (২০০,০০০) রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আসে। সরকারিভাবে এই অভিযান ছিল প্রত্যেক নাগরিকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং যে সব বিদেশী অবৈধভাবে মায়ানমারে বসবাস করছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা। এই সেনা অভিযান সরাসরি বেসামরিক রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে চলছিল এবং ফলে ব্যাপক হত্যা, ধর্ষণ ও মসজিদ ধ্বংসের ঘটনা ঘটে। […]

১৯৯১-৯২ সালে একটি নতুন দাঙ্গায় প্রায় আড়াই লক্ষ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে চলে আসে। তারা জানায় রোহিঙ্গাদের বার্মায় বাধ্যতামূলক শ্রম প্রদান করতে হয়। এছাড়া হত্যা, নির্যাতন ও ধর্ষণের স্বীকার হতে হয়। রোহিঙ্গাদের কোনো প্রকার পারিশ্রমিক ছাড়াই কাজ করতে হত।


২০০৫ সালে, জাতিসংঘ শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশনার রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশ থেকে ফিরিয়ে নেওয়ার উদ্যোগ গ্রহণ করে, কিন্তু রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে বিভিন্ন ধরণের মানবাধিকার লংঘনের অভিযোগে এই উদ্যোগ ভেস্তে যায়।

মিয়ানমারের পশ্চিমা প্রদেশ আরাকান (রাখাইন) আবার জ্বলছে। স্বাধীন আরাকান রাজ্যের পুরোনো রাজধানী ম্রাউক-উ-তে চলছে বৌদ্ধ রাখাইনদের মিছিল। মিছিল চলছে জীপগাড়ি, মোটরসাইকেল, রিক্সা, টুক-টুক কিংবা সাইকেলে চড়ে – কিন্তু সবচেয়ে বেশী লোক চলছে পায়ে হেঁটেই। তাদের সাথে আছে বর্শা, তরবারী, ধামা, বাঁশ, গুলতি, তীর-ধনুক এমনকি ক্ষেত্রবিশেষে পেট্রোল বোমাও। তাদের লক্ষ্য – নিরস্ত্র রোহিঙ্গা মুসলিম জনগোষ্ঠী। ঐ মিছিলেই জনৈক বৌদ্ধ সন্ত্রাসীকে গলা-কাটার মতো ভয়াবহ ইশারা-ইঙ্গিত করতে দেখা যায় (যুক্তরাজ্যের দি ইকনমিস্ট; ৩-রা নভেম্বর, ২০১২)।
দুঃখের বিষয় এই যে ম্রাউক-উ’ই একমাত্র শহর নয় যেখানে রোহিঙ্গা মুসলিমরা পরিকল্পিত গণহত্যার মুখোমুখি। মিয়ানমারের ভেতর থেকে পাওয়া খবর থেকে জানা যাচ্ছে যে স্থানীয় সরকার, কেন্দ্রীয় সরকার, পুলিশ ও নিরাপত্তা রক্ষী বাহিনীর মদদে রাখাইন বৌদ্ধ সন্ত্রাসীরা পরিকল্পিত ভাবে প্রতিটি রোহিঙ্গাকে বার্মা (মিয়ানমার) থেকে বের করে দেয়ার অভিপ্রায়ে গণহত্যার উন্মাদনায় মেতে উঠেছে। এই নির্মূলাভিযান এমনই ভয়াবহ ও নৃশংস যে, পরিকল্পিত হিংস্রতা লুকিয়ে রাখার স্বগত প্রবণতা থাকা বর্মী রাষ্ট্রপতিও শুক্রবার, ২৬-শে অক্টোবর, স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছেন যে ৮টি মসজিদ সহ ২০০০ রোহিঙ্গার ঘরবাড়ি পুড়ে ছাই হয়ে গেছে (সূত্র: বার্মিজ সরকারপন্থী পত্রিকা, the New Light of Myanmar)। এই সপ্তাহে তার মুখপাত্র বিবিসিকে বলেছেন, “রাখাইন প্রদেশে পুরো গ্রাম কিংবা আংশিক নগর পুড়ে ভস্মীভুত হবার মতো ঘটনা ঘটেছে।” বলার অপেক্ষা রাখেনা যে আসল সংখ্যা ও বাস্তবতা আরো অনেক ভয়াবহ।

আশংকা করা হচ্ছে যে অক্টোবরের শেষ সপ্তাহে ৫০০০ রোহিঙ্গার বসতি পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। উপগ্রহ (স্যাটেলাইট) থেকে তোলা ছবিতে সমুদ্র উপকূলবর্তী শহর চিয়াউকফুর (Kyaukphyu) মুসলিম অধ্যুষিত অংশে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞের ছাপ দেখা যায় (১, ২)। এই শহর থেকেই তেল ও গ্যাসের পাইপ-লাইন বার্মা থেকে চীনে যাবার কথা। সাম্প্রতিক এই গণহত্যার আগ্রাসনের সময় মুসলিম অধ্যুষিত গ্রাম ও শহরাংশে তাদের আঁটকে রেখে আগুনের গোলা ছোঁড়া হয়। মৃত্যু আতংকে পালাতে চেষ্টা করা মুসলিমদের উপর রাখাইন বৌদ্ধ সন্ত্রাসী ও সরকারের মধ্যে তাদের পৃষ্ঠপোষকরা চালায় নির্বিচার গুলিবর্ষণ। বর্ণবাদী রাখাইন রাজনীতিবিদ ও ভিক্ষুরা দিনে দিনে সেখানে গড়ে তুলছে বর্ণ ও ধর্মের ঘৃণার পরিবেশ, যাতে নিরস্ত্র রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সব ধরণের সহিংসতাকে অনুমোদন দেয়া যায়। অনেক রোহিঙ্গা তাই প্রাণভয়ে পালাচ্ছে সাগরে কিংবা জঙ্গলে। কিন্তু হায়! সেখানেও রক্ষা নেই। গত সপ্তাহে শতাধিক রোহিঙ্গার সলিল সমাধি হয়েছে বঙ্গোপসাগরে। অনেকে বাধ্য হয়ে পালিয়ে গেছেন বাংলাদেশে। ধরা পড়ে অনেককেই যেতে হচ্ছে সিত্তেওয়ের মানবতের জঘণ্য ক্যাম্পগুলোতে, যেখানে জুন মাস থেকেই আঁটকে আছে আরো অনেক রোহিঙ্গা ভুক্তভোগী। ঐদিকে রাখাইন সন্ত্রাসীরা আবার ডজন ডজন রোহিঙ্গা মেয়েদের তুলে নিয়ে করছে ধর্ষণ – আর সেইসাথে চারিদিকে ছড়িয়ে দিচ্ছে যুদ্ধের বিভীষিকা ।

অহিংস বৌদ্ধ ভিক্ষুদের অহিংসার প্রকাশ। ও.আই.সি'র কোনো রকমের উপস্থিতি ভিক্ষুরা মিয়ানমারে চাননা – এমনকি দূর্যোগপূর্ণ স্থানে তাদের ত্রাণ তৎপরতা চালানোও।
মুসলিমদের ভয়াবহ হত্যার জন্যে একজন বৌদ্ধ সন্ত্রাসীকেও শাস্তি দেয়া হয়নি। থেইন সেইনের সরকার থেকে আমরা কেবল সহিংসতার হোতাদের চিহ্নিত করা ও তাদের বিচারের আওতায় আনার ফাঁকা বুলি শুনেছি। কিন্তু এসব প্রতিজ্ঞা কখনো ন্যায়বিচারে পর্যবসিত হয়না, যেমনটা আমরা দেখেছি ৩-রা জুনে ১০ বর্মী মুসলিমদের বিনা বিচারে মেরে ফেলার ঘটনায়। এই যখন বাস্তবতা – তখন সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা মুসলিমদের জান-মাল রক্ষার কথা না হয় বাদই দিলাম।
বুঝতে কষ্ট হয়না যে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সাথে থেইন সেইনের সরকার ইঁদুর-বিড়াল খেলা খেলছে; একদিকে যেমন উপগ্রহ থেকে তোলা ছবি থেকে অপরাধগুলোকে আর লুকিয়ে রাখা যায়না তখন তারা সবাইকে মিথ্যে প্রতিশ্রুতি দিয়া শান্ত করে – আর অন্যদিকে যখন বহির্শক্তির চাপ কিছুটা কমে আসে, সাথে সাথেই বেড়ে যায় জঘন্য অপরাধগুলোর মাত্রা। তাই ৩-রা জুনে শুরু হওয়া সংঘবদ্ধ হত্যা ও নির্যাতনের ফলে সৃষ্ট এক লক্ষ আভ্যন্তরীন শরণার্থীর সাথে সম্প্রতি ঘটে যাওয়া সন্ত্রাসের ফলে আরো কয়েক অযুত বাস্তুহারা শরণার্থী যোগ দিলে সার্বিক অবস্থার অবনতি ঘটে অনেকখানি। এক সময়ের সমৃদ্ধ মুসলিম জনপদ এখন যেন বোমার আঘাতে ধ্বংস হওয়া অঞ্চল! কোনো রোহিঙ্গাকেই তাদের এলাকাতে ফিরে গিয়ে নিজেদের ঘরবাড়ি পূনর্গঠন করতে দেয়া হয়নি। নাৎসি কন্সেন্ট্রেশন ক্যাম্পের আদলে গড়ে ওঠা ক্যাম্পে তাদের আঁটকে রাখা হয়েছে। ঐ বীভৎস ছাউনিগুলো থেকে বের হয়ে জীবিকা আহরণের চেষ্টা করলে রাখাইন বৌদ্ধ নিরাপত্তা রক্ষীদের হাতে গুলিবিদ্ধ হবার সমূহ ঝুঁকি থাকে। ঐ ক্যাম্পগুলোতে রোহিঙ্গাদের রাখা হয়েছে যাতে তারা ধীরে ধীরে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে।

নিরস্ত্র রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে ভীত-সন্ত্রস্ত রাখা যেন রাখাইনদের জাতীয় চেতনাতে পরিণত হয়েছে। সীমান্তরক্ষীরা (NASAKA) বারংবার স্মরণ করিয়ে দেয় যে আরাকান হচ্ছে রাখাইন রাজ্য – যেখানে রোহিঙ্গা মুসলিমদের কোনো স্থান নেই। রোহিঙ্গাদের বলা হয় তারা যেন আরাকান থেকে চলে যায়, না হলে তাদের মেরে ফেলা হবে। রোহিঙ্গা মুসলিমদের ভীত-সন্ত্রস্ত করে নির্মূল করার তালিকায় একে একে যুক্ত হচ্ছে মুসলিম অধ্যুষিত জনপদগুলো। পাঁচের বেশী লোকের সমাবেশ ঘটানোর উপর নিষেধাজ্ঞা জারী করা ১৪৪ ধারা কেবল রোহিঙ্গাদের উপরই প্রয়োগ করা হয়। নিরাপত্তারক্ষীদের আশীর্বাদ পওয়া রাখাইন সন্ত্রাসীদের হাতে ঘর-বাড়ী, দোকান-পাট, মসজিদ, স্কুল কিংবা গ্রাম লুট হওয়া অগ্নিদগ্ধ হওয়ার হাত থেকে রক্ষা করতেও বাইরে যেতে পারেনা রোহিঙ্গারা।

বেশীরভাগ ক্ষেত্রে সন্ত্রাসী রাখাইনরা সরকারের সহযোগিতা পায়। চিয়াউকফু শহরের ক্ষেত্রে এমনও দেখা গেছে যে, বৌদ্ধ অগ্নি-নির্বাপক দল জলের বদলে আগুনের উপর জ্বালানী ছিটিয়েছে, যাতে ধ্বংসলীলা সম্পূর্ণ হয়! পিট প্যাটিসন নামের একজন স্থানীয় শিক্ষক, যিনি যুক্তরাজ্যের ইন্ডিপেন্ডেন্ট পত্রিকার জন্যেও কাজ করে থাকেন বলেন,
দমকলের বাহিনীর লোকজন আগুনের উপর আদতে ঢেলেছে পেট্রোল – কিন্তু ভান দেখাচ্ছে যেন তারা জল ছিটাচ্ছে! কর্তৃপক্ষ আসলেই একপেশে। আমরা তাদের বিশ্বাস করতে পারিনা।

সপ্তাহান্তে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ কর্তৃক প্রকাশিত উপগ্রহ থেকে তোলা ছবিতে চিয়াউকফু ও পার্শ্ববর্তী উপকূল অঞ্চলের ধ্বংসের চিহ্ন স্পষ্ট। অজস্র ঘরবাড়ি আর অসংখ্য নোঙ্গর করা বজরা আর নৌকার শহর আজ যেন পোড়ো ধ্বংসস্তুপ – যার মধ্যে আছে পুরোপুরি ধ্বংস হওয়া ৮১১টি বাড়ীসহ অন্যান্য স্থাপনা।

রোহিঙ্গাদের বর্তমান অবস্থাকে ঠিকভাবে প্রকাশ করার জন্য গণহত্যা ছাড়া আর কোনো শব্দ আছে বলে মনে হয়না। এক্ষেত্রে গণহত্যা শব্দের ব্যবহারে কারো অবাক হবার কিছু নেই, কেননা মিরিয়াম ওয়েবস্টার অভিধানে গণহত্যাকে এভাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে, “ইচ্ছাপ্রনোদিত ও নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে কোনো নৃ, জাতি কিংবা সাংস্কৃতিক গোষ্ঠীর নির্মূল অভিযান [the deliberate and systematic destruction of a racial, political or cultural group]।" সংশ্লিষ্ট বিষয়ে অভিজ্ঞরা বলছেন, হোক সার্বিক কিংবা আংশিক – নৃ, জাতি, ধর্ম কিংবা রাষ্ট্রিক গোষ্ঠীর নিয়মতান্ত্রিক নির্মূলাভিযান থাকলেই গণহত্যা’র সংজ্ঞা প্রাসঙ্গিকই থাকে। আর যেকোনো সংজ্ঞা অনুসারেই আরাকানের রোহিঙ্গারা নৃ, জাতি ও ধার্মিক আঙ্গিকে সংখ্যাগুরু রাখাইন বৌদ্ধ বর্মীদের চাইতে পুরোপুরি আলাদা।

ড. ড্যানিয়েল জোনাহ গোল্ডহ্যাগেন তার লেখা Worse than War বইতে পাঁচ ধরণের উচ্ছেদ প্রক্রিয়ার কথা বলেছেন, সেগুলো হচ্ছে –পরিবর্তন, নিবর্তন, বিতাড়ন, জন্মনিরোধ ও সর্বাংশে নির্মূল। এখানে পরিবর্তন বলতে বোঝানো হয়েছে, কোনো নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিচিতি-সহ সকল মৌলিক পরিচিতিগুলোকে ধীরে ধীরে পাল্টে দেয়া। আগে আমি যেভাবে বললাম, যদিও আরাকানে রোহিঙ্গাদের ইতিহাস স্মরণাতীত কালেই পৌঁছে – তবুও তাদেরকে বাংলাদেশ থেকে আসা নব্য বসতকারী গোষ্ঠী হিসেবে নতুন মিথ্যে পরিচিতি দেয়া হচ্ছে।


নিবর্তন হচ্ছে সেই পদ্ধতি যার মাধ্যমে ঘৃণিত, অননুমোদিত ও ভয়ঙ্কর মানুষদের নিজেদের কব্জায় রেখে তাদের উপর সহিংস দমননীতি চালানো যাতে সেই ভয়ানক জনগোষ্ঠী আসল কিংবা কল্পিত কোনও রকমের ক্ষতিই আর করতে না পারে। নিবর্তন মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের জীবনের প্রাত্যহিক বৈশিষ্ট্য।
বিতাড়ন কিংবা বিবাসন হচ্ছে তৃতীয় উচ্ছেদের উপায়। বিতাড়নের মাধ্যমে অনাকাঙ্ক্ষিত জনগোষ্ঠীকে হয় দেশের সীমানার বাইরে কিংবা দেশের মধ্যেই এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলে তাড়িয়ে দেয়া হয়। বিতাড়নের আরেকটি উপায় অবশ্য হচ্ছে জনগোষ্ঠীকে স্বদলবলে ক্যাম্পের জীবন বেছে নিতে বাধ্য করা। আর নে উইনের আমল থেকেই মিয়ানমার সরকার এই দোষে দোষী।
উচ্ছেদের চতুর্থ উপায় হচ্ছে জন্ম নিরোধ যা মিয়ানমার সরকার অন্যান্য উপায়গুলোর সাথে ব্যবহার করে। এই পদ্ধতিতে রোহিঙ্গা মেয়েদের বিয়েতে নিষেধাজ্ঞা আরোপ ছাড়াও ব্যবহার করা হয় জোরপূর্বক বন্ধ্যাকরণ, গর্ভপাত ও ধর্ষণ। হালে ঘটা নিবর্তনে মুসলিমদের ঘরবাড়ি, শহর ও লোকালয় আক্রমণের সময় অনেক মেয়েদের অপহরণ করে নিয়ে যাওয়া বলতে গেলে নৈমিত্তিক ঘটনাতে পরিণত হয়েছে।
সর্বাংশে নির্মূল হচ্ছে উচ্ছেদের পঞ্চম উপায় যেখানে নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীকে মেরেই ফেলা হয়। সর্বাংশে নির্মূলের ক্ষেত্রে মাঝে মধ্যে এমন কারণও দেয়া হয় যে উল্লেখ্য গোষ্ঠীর সামান্য উপস্থিতিই যেন অন্যদের জন্য ভয়ানক হুমকির ব্যপার। এই পদ্ধতিতে সাময়িক, খণ্ডকালীন কিংবা সম্ভাব্য সমাধানের বদলে দেয়া হয় “চিরস্থায়ী সমাধান।” বুঝতে কষ্ট হয়না যে সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে কেন রাখাইন ব্যবসায়ীরা রোহিঙ্গাদের মেরে ফেলার জন্যে বিষাক্ত তেল ও খাদ্যাদি বিক্রী করেছে। বর্ণবাদী বৌদ্ধ ভিক্ষু, রাখাইন সন্ত্রাসী, রক্তপিপাসু রাজনীতিবিদ ও সরকারের সাম্প্রতিক কার্যকলাপে এটা পরিষ্কার যে সার্বিক মিয়ানমার সমাজে রোহিঙ্গারা নির্মূলাভিযানের শিকার।

রোহিঙ্গাদের সম্পর্কে একটি প্রচলিত গল্প রয়েছে এভাবে- সপ্তম শতাব্দীতে বঙ্গোপসাগরে ডুবে যাওয়া একটি জাহাজ থেকে বেঁচে যাওয়া লোকজন উপকূলে আশ্রয় নিয়ে বলেন, আল্লাহর রহমে বেঁচে গেছি। এই রহম থেকেই এসেছে রোহিঙ্গা।

তবে, ওখানকার রাজসভার বাংলা সাহিত্যের লেখকরা ঐ রাজ্যকে রোসাং বা রোসাঙ্গ রাজ্য হিসাবে উল্লেখ করেছেন।

ইতিহাস এটা জানায় যে, ১৪৩০ থেকে ১৭৮৪ সাল পর্যন্ত ২২ হাজার বর্গমাইল আয়তনের রোহিঙ্গা স্বাধীন রাজ্য ছিল। মিয়ানমারের রাজা বোদাওফায়া এ রাজ্য দখল করার পর বৌদ্ধ আধিপত্য শুরু হয়।

এক সময়ে ব্রিটিশদের দখলে আসে এ ভূখণ্ড। তারা মিয়ানমারের ১৩৯টি জাতিগোষ্ঠীর তালিকা প্রস্তুত করে। কিন্তু তার মধ্যে রোহিঙ্গাদের নাম অন্তর্ভুক্ত ছিল না।

১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি মিয়ানমার স্বাধীনতা অর্জন করে এবং বহুদলীয় গণতন্ত্রের পথে যাত্রা শুরু হয়। সে সময়ে পার্লামেন্টে রোহিঙ্গাদের প্রতিনিধিত্ব ছিল। এ জনগোষ্ঠীর কয়েকজন পদস্থ সরকারি দায়িত্বও পালন করেন। কিন্তু ১৯৬২ সালে জেনারেল নে উইন সামরিক অভ্যুত্থান ঘটিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করলে মিয়ানমারের যাত্রাপথ ভিন্ন খাতে প্রবাহিত হতে শুরু করে। রোহিঙ্গাদের জন্য শুরু হয় দুর্ভোগের নতুন অধ্যায়। সামরিক জান্তা তাদের বিদেশি হিসেবে চিহ্নিত করে। তাদের নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়। ভোটাধিকার কেড়ে নেওয়া হয়। ধর্মীয়ভাবেও অত্যাচার করা হতে থাকে। নামাজ আদায়ে বাধা দেওয়া হয়। হত্যা-ধর্ষণ হয়ে পড়ে নিয়মিত ঘটনা। সম্পত্তি জোর করে কেড়ে নেওয়া হয়। বাধ্যতামূলক শ্রমে নিয়োজিত করা হতে থাকে। তাদের শিক্ষা-স্বাস্থ্যসেবার সুযোগ নেই। বিয়ে করার অনুমতি নেই। সন্তান হলে নিবন্ধন নেই। জাতিগত পরিচয় প্রকাশ করতে দেওয়া হয় না। সংখ্যা যাতে না বাড়ে, সে জন্য আরোপিত হয় একের পর এক বিধিনিষেধ।

মিয়ানমারের মূল ভূখণ্ডের অনেকের কাছেই রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী ‘কালা’ নামে পরিচিত। বাঙালিদেরও তারা ‘কালা’ বলে। ভারতীয়দেরও একই পরিচিতি। এ পরিচয়ে প্রকাশ পায় সীমাহীন ঘৃণা।

অষ্টম শতাব্দীতে আরবদের আগমনের মধ্য দিয়ে আরাকানে মুসলমানদের বসবাস শুরু হয়। আরব বংশোদ্ভূত এই জনগোষ্ঠী মায়্যু সীমান্তবর্তী অঞ্চলের (বাংলাদেশের চট্টগ্রাম বিভাগের নিকট) চেয়ে মধ্য আরাকানের নিকটবর্তী ম্রক-ইউ এবং কাইয়্যুকতাও শহরতলীতেই বসবাস করতে পছন্দ করতো। এই অঞ্চলের বসবাসরত মুসলিম জনপদই পরবর্তীতে রোহিঙ্গা নামে পরিচিতি লাভ করে।

১৭৮৫ সালে বার্মিজরা আরাকান দখল করে। এর পরে ১৭৯৯ সালে পঁয়ত্রিশ হাজারেরও বেশি মানুষ বার্মিজদের গ্রেফতার এড়াতে এবং আশ্রয়ের নিমিত্তে আরাকান থেকে নিকটবর্তী চট্টগ্রাম অঞ্চলে চলে আসে। বার্মার শোসকেরা আরাকানের হাজার হাজার মানুষকে হত্যা করে এবং একটা বড় অংশকে আরাকান থেকে বিতাড়িত করে মধ্য বার্মায় পাঠায়। যখন ব্রিটিশরা আরাকান দখল করে তখন যেন এটি ছিল একটি মৃত্যুপূরী। ১৭৯৯ সালে প্রকাশিত “বার্মা সাম্রাজ্য”তে ব্রিটিশ ফ্রাঞ্চিজ বুচানন-হ্যামিল্টন উল্লেখ করেন, “মুহাম্মদ(সঃ)-এর অনুসারীরা”, যারা অনেকদিন ধরে আরাকানে বাস করছে, তাদেরকে “রুইঙ্গা” বা “আরাকানের অধিবাসী” বলা হয়।

১৯৪২ সালের ২৮শে মার্চ, মায়ানমারের মিনবিয়া এবং ম্রক-ইউ শহরে রাখাইন জাতীয়তাবাদী এবং কারেইনপন্থীরা প্রায় ৫,০০০ মুসলমানকে হত্যা করে। ইতোমধ্যে, রাখাইন রাজ্যের উত্তরাঞ্চলে প্রায় ২০,০০০ মুসলমানকে হত্যা করা হয়। এতে উপ-কমিশনার ইউ য়ু কিয়াও খায়াং-ও নিহত হন যিনি দাঙ্গা নিয়ণ্ত্রনের চেষ্টা করছিলেন।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়, জাপানীরা ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের অধীনস্থ বার্মায় আক্রমণ করে। ব্রিটিশ শক্তি পরাজিত হয়ে ক্ষমতা ছেড়ে চলে যায়। এর ফলে ব্যাপক সংঘর্ষ ছড়িয়ে পরে। এর মধ্যে বৌদ্ধ রাখাইন এবং মুসলিম রোহিঙ্গাদের মধ্যকার সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ছিল উল্লেখযোগ্য। এই সময়ে ব্রিটিশপন্হীদের সাথে বার্মার জাতীয়তাবাদীদেরও সংঘর্ষ হয়। জাপানীদের আক্রমণের সময় উত্তর আরাকানের ব্রিটিশপন্হী অস্ত্রধারী মুসলমানদের দল বাফার জোন সৃষ্টি করে। রোহিঙ্গারা যুদ্ধের সময় মিত্রপক্ষকে সমর্থন করেছিল এবং জাপানী শক্তির বিরোধিতা করেছিল, পর্যবেক্ষণে সাহায্য করেছিল মিত্রশক্তিকে। জাপানীরা হাজার হাজার রোহিঙ্গাদের নির্যাতন, ধর্ষণ এবং হত্যা করেছিল। এই সময়ে প্রায় ২২,০০০ রোহিঙ্গা সংঘর্ষ এড়াতে সীমান্ত অতিক্রম করে বাংলায় চলে গিয়েছিল। জাপানী এবং বার্মাদের দ্বারা বারংবার গণহত্যার শিকার হয়ে প্রায় ৪০,০০০ রোহিঙ্গা স্থায়ীভাবে চট্টগ্রামে চলে আসে।

১৯৪৭ সালে রোহিঙ্গারা মুজাহিদ পার্টি গঠন করে যারা জিহাদি আন্দোলন সমর্থন করতো। মুজাহিদ পার্টির লক্ষ্য ছিল আরাকানে একটি স্বাধীন মুসলিম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা। তারা জেনারেল নে উইনের নেতৃত্বে ১৯৬২ সালের সামরিক অভ্যুত্থানের পূর্ব পর্যন্ত অত্যন্ত সক্রিয় ছিল। নে উইন তাদেরকে দমনের জন্য দুই দশকব্যাপী সামরিক অভিযান পরিচালনা করেন। উল্লেখযোগ্য একটি অভিযান ছিল “কিং ড্রাগন অপারেশন” যা ১৯৭৮ সালে পরিচালিত হয়। এর ফলে অনেক মুসলমান প্রতিবেশী বাংলাদেশে পালিয়ে আসে এবং শরনার্থী হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। বাংলাদেশ ছাড়াও উল্লেখযোগ্য সংখ্যার রোহিঙ্গারা পাকিস্তানের করাচীতে চলে যায়। এরপরও, বার্মার মুজাহিদরা আরাকানের দূর্গম এলাকায় এখনও সক্রিয় আছে।

প্রায় অর্ধ শতাব্দী ধরে বার্মা শাসন করছে মায়ানমারের সামরিক জান্তা। ক্ষমতা কুক্ষিগত করার জন্য এরা বার্মিজ জাতীয়তাবাদ এবং থেরাভেদা বৌদ্ধ ধর্মীয় মতবাদ ব্যাপকভাবে ব্যবহার করে থাকে। আর এর ফলেই তারা রোহিঙ্গা, চীনা জনগোষ্ঠী যেমন- কোকাং, পানথাইদের(চীনা মুসলিম) মত ক্ষুদ্র জাতিসত্ত্বাকে ব্যপকভাবে নির্যাতন করে থাকে। কিছু নব্য গণতন্ত্রপন্থী নেতা যারা বার্মার প্রধান জনগোষ্ঠী থেকে এসেছেন তারাও রোহিঙ্গাদের বার্মার জনগণ হিসেবে স্বীকার করেন না।

বার্মার সরকার রোহিঙ্গা ও চীনা জনগোষ্ঠীর মত ক্ষুদ্র জাতিসত্ত্বাদের বিরুদ্ধে দাঙ্গার উসকানি দিয়ে থাকে এবং এ কাজ তারা অতি সফলতার সাথেই করে যাচ্ছে।

রাখাইনে ২০১২ সালের দাঙ্গা হচ্ছে মায়ানমারের উত্তরাঞ্চলীয় রাখাইন রাজ্যের রোহিঙ্গা মুসলিম ও বোদ্ধ রাখাইনদের মধ্যে চলমান সংঘর্ষের ঘটনাপ্রবাহ। দাঙ্গা শুরু হয় জাতিগত কোন্দলকে কেন্দ্র করে এবং উভয় পক্ষই এতে জড়িত হয়ে পরে।

অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের অনুসারে, ১৯৭৮ সাল থেকে মায়ানমারের মুসলিম রোহিঙ্গারা মানবাধিকার লংঘনের শিকার হচ্ছে এবং তারা প্রতিবেশী বাংলাদেশে পালিয়ে আসতে বাধ্য হচ্ছে। ফলে: রোহিঙ্গাদের চলাচলের স্বাধীনতা ব্যপকভাবে নিয়ণ্ত্রিত এবং তাদের অধিকাংশের বার্মার নাগরিকত্ব বাতিল করা হয়েছে। তাদের উপর বিভিন্ন রকম অন্যায় ও অবৈধ কর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। তাদের জমি জবর-দখল করা, জোর-পূর্বক উচ্ছেদ করা, ঘর-বাড়ি ধ্বংস করা এবং বিবাহের উপর অর্থনৈতিক অবরোধ চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। যদিও উত্তর রাখাইন রাজ্যে গত দশকে বাধ্যতামূলক শ্রমিকের কাজ করা কমেছে তারপরও রোহিঙ্গাদের রাস্তার কাজে ও সেনা ক্যাম্পে বাধ্যতামূলক শ্রমিকের কাজ করতে হচ্ছে।

১৯৭৮ সালে মায়ানমার সেনাবাহিনীর ‘নাগামান’ (‘ড্রাগন রাজা’) অভিযানের ফলে প্রায় দুই লক্ষ (২০০,০০০) রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আসে। সরকারিভাবে এই অভিযান ছিল প্রত্যেক নাগরিকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং যে সব বিদেশী অবৈধভাবে মায়ানমারে বসবাস করছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা। এই সেনা অভিযান সরাসরি বেসামরিক রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে চলছিল এবং ফলে ব্যাপক হত্যা, ধর্ষণ ও মসজিদ ধ্বংসের ঘটনা ঘটে।

১৯৯১-৯২ সালে একটি নতুন দাঙ্গায় প্রায় আড়াই লক্ষ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে চলে আসে। তারা জানায় রোহিঙ্গাদের বার্মায় বাধ্যতামূলক শ্রম প্রদান করতে হয়। এছাড়া হত্যা, নির্যাতন ও ধর্ষণের স্বীকার হতে হয়। রোহিঙ্গাদের কোনো প্রকার পারিশ্রমিক ছাড়াই কাজ করতে হত।

২০০৫ সালে, জাতিসংঘ শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশনার রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশ থেকে ফিরিয়ে নেওয়ার উদ্যোগ গ্রহণ করে, কিন্তু রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে বিভিন্ন ধরণের মানবাধিকার লংঘনের অভিযোগে এই উদ্যোগ ভেস্তে যায়।

বাংলাদেশে পাঁচ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশকারী অবৈধভাবে বসবাস করছে। মোট চারটি ধাপে তারা বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। প্রথম আসে ১৭৮৪ সালে। বিভিন্ন পর্যায়ে অনুপ্রবেশের ফলে বর্তমানে তাদের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে পাঁচ লাখে। এ সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এটি বৃদ্ধি পাচ্ছে দু’ভাবেই। প্রথমত, অনিয়ন্ত্রিত জন্মহার। দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশী স্বার্থান্বেষী মহলের প্রচেষ্টায় পুশইনের মাধ্যমে প্রবেশ করানোর ফলে। পরবর্তী সময়ে তারা ভোটার তালিকায় স্থান করেও নিয়েছে ও নিচ্ছে। উল্লেখ্য, রিফিউজি রেজিস্টার্ডভুক্তরা ভোটার তালিকায় স্থান না পাওয়ার কারণে স্বার্থান্বেষী মহলের ইঙ্গিতে রোহিঙ্গারা পালিয়ে কক্সবাজারের বিভিন্ন গ্রামে বসবাস করছে। পরে সুযোগ বুঝে ভোটার তালিকায় নাম উঠিয়ে নিচ্ছে।
রোহিঙ্গা শরণার্থীরা শুধু বাংলাদেশের ভোটার হয়েই ক্ষান্ত হচ্ছে না, তারা ভোটার আইডি কার্ড ব্যবহার করে বাংলাদেশী পাসপোর্ট বানিয়ে মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন দেশে পাড়ি জমাচ্ছে। সেসব দেশে গিয়ে তারা বিভিন্ন অপকর্ম করে ধরা পড়ে বাংলাদেশের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে দিচ্ছে। এরই খেসারত দিতে হচ্ছে বাংলাদেশ সরকারকে।
রোহিঙ্গারা এখন রীতিমতো দেশের জন্য ত্রাস হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশেষ করে কক্সবাজার, টেকনাফ, চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামের জনপদে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করছে। জীবন-জীবিকার তাগিদে তারা বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠনের সঙ্গে জড়িয়ে যাচ্ছে। জড়িয়ে যাচ্ছে ডাকাতি, ছিনতাই, জাল টাকা তৈরি, অবৈধ অস্ত্র বহন, বনজ সম্পদ লুটপাট, ইয়াবাসহ নেশা জাতীয় দ্রব্যাদি বিক্রিসহ নানা অপকর্মের সঙ্গে। এছাড়া শরণার্থী ক্যাম্পের কর্তৃত্ব নিয়েও নিজেদের ভেতর সংঘর্ষে লিপ্ত হচ্ছে। এসব যারা করছে তাদের হিম্মতকে বাহাবা দিয়ে আশ্রয় দিচ্ছে স্থানীয় রাজনৈতিক নেতারা। এরই মাধ্যমে নেতারা ওদের পরবর্তী সময় যে কোনো কাজে ব্যবহার করার সুযোগ পাচ্ছে। অন্যদিকে নেতা গোছের রোহিঙ্গারা নিজেদের ক্যাম্পে যেমন প্রভাব খাটাচ্ছে, তেমনি ক্যাম্পের বাইরে এসেও প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করছে। এতসব অপকর্ম করেও তারা পার পেয়ে যাচ্ছে জাতিসংঘের শরণার্থী শিবিরে নাম রেজিস্ট্রি করার বদৌলতে। সে সুবাদে তারা জাতিসংঘের রেশন ভাতাও ভোগ করছে বলে জানা যায়।

বাংলাদেশের মাটিতে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেয়া হয়েছিল সম্পূর্ণ মানবিক কারণে। মিয়ানমারের আরাকান প্রদেশের এই জনগোষ্ঠী যুগের পর যুগ শরণার্থী হিসেবে এদেশে অবস্থান করে, বাংলাদেশী সেজে এখন বাংলাদেশের জন্যই সমস্যা হয়ে উঠেছে। তারা নানা দুষ্কর্মে জড়িয়ে পড়ছে।


জাতিসংঘের বিবেচনায় পৃথিবীর সবচেয়ে নিপীড়িত জনগোষ্ঠীর নাম রোহিঙ্গা। ‘রোহিঙ্গা’ শব্দের অর্থ হলো নৌকার মানুষ, যারা সমুদ্রজলে নৌকা ভাসিয়ে মৎস্য সম্পদ আহরণ করে জীবিকা অর্জন করে।
এই একবিংশ শতাব্দীতে কি পৃথিবীর আর কোথাও এমন কোন জনগোষ্ঠী আছে যারা অসুস্থ হলে হাসপাতালে যেতে পারে না, আর হাসপাতালে গেলেও তাদের চিকিৎসা দেয়া হয় না। শিশুরা স্কুলে যেতে পারে না, তরুণ-তরুণীদের বিয়ে ও সন্তান ধারণে বাধা দেয়া হয়। শত শত বছর ধরে একটি নির্দিষ্ট ভূখন্ডে বসবাস করলেও তাদের নাগরিকত্ব নেই। এত অত্যাচার-নির্যাতন নিপীড়ন সহ্য করেও বর্তমানে প্রায় ৮ লাখ রোহিঙ্গা মিয়ানমারে বসবাস করেছেন। বিভিন্ন সময়ে অত্যাচারের মাত্রা সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে গেলে প্রায় ৫ লাখ রোহিঙ্গা মিয়ানমার থেকে প্রাণভয়ে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। সৌদি আরবে আশ্রয় নিয়েছে প্রায় ৫ লাখ। জাতিসংঘ ও ওআইসি মিয়ানমার সরকারকে এই সা¤প্রদায়িক ও জাতিগত নিপীড়ন বন্ধের আহŸান জানালেও প্রকৃতপক্ষে সরকার তাতে কর্ণপাত করছে না।
বৌদ্ধ ভিক্ষুরা মুসলিমবিদ্বেষী প্রচারণা চালাচ্ছে এবং তাদের নেতৃত্বেই চলছে হত্যাযজ্ঞ, অগ্নিসংযোগ। প্রাণ বাঁচাতে ক্ষুধার্ত রোহিঙ্গা নারী, পুরুষ, শিশু, বৃদ্ধরা ছোট ছোট নৌকায় করে প্রতিবেশী দেশগুলোতে আশ্রয় নেয়ার জন্য আকুতি জানাচ্ছে। কিন্তু প্রতিবেশী দেশগুলোও তাদের গ্রহণ করতে চাচ্ছে না। মিয়ানমার ইতিহাসকে অস্বীকার করে বলছে রোহিঙ্গা মুসলিমরা বাংলাদেশ থেকে আসা অবৈধ অভিবাসী। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় রোহিঙ্গাদের ওপর ভয়াবহ নির্যাতনের পরও বিশ্বের শক্তিধর দেশগুলো কোন কার্যকর পদক্ষেপ নেয়নি। বিশ্ববিবেক এখানে যেন বধির। মিয়ানমারে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হলে সমস্যার সাময়িক সমাধান হতে পারে। তবে আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের অনেকেই মনে করেন, মিয়ানমারের প্রভাবমুক্ত করে রাখাইনকে আবার স্বাধীন আরাকানে পরিণত করতে পারলেই শুধু এই সমস্যার স্থায়ী সমাধান সম্ভব। তা না হলে পৃথিবীর সবচেয়ে নির্যাতিত রোহিঙ্গা মুসলমান জনগোষ্ঠীকে বাঁচানো সম্ভব নয়। জাতিসংঘ, ওআইসি, মুসলিম বিশ্ব ও বিশ্বের সকল মানবাধিকার সংগঠনগুলো রোহিঙ্গাদের জন্য স্বাধীন আরাকান রাষ্ট্রপ্রতিষ্ঠায় সোচ্চার হলে এবং এ ক্ষেত্রে সার্বিক সহযোগিতার হাত প্রসারিত করলেই নির্যাতনের অবসান সম্ভব।

সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই অক্টোবর, ২০১৫ রাত ৯:২২
১০টি মন্তব্য ২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

জীবন চলবেই ... কারো জন্য থেমে থাকবে না

লিখেছেন অপু তানভীর, ০২ রা মে, ২০২৪ সকাল ১০:০৪



নাইমদের বাসার ঠিক সামনেই ছিল দোকানটা । দোকানের মাথার উপরে একটা সাইনবোর্ডে লেখা থাকতও ওয়ান টু নাইন্টি নাইন সপ ! তবে মূলত সেটা ছিল একটা ডিপার্টমেন্টাল স্টোর। প্রায়ই... ...বাকিটুকু পড়ুন

যুক্তরাষ্ট্রে বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিলিস্তিনের পক্ষে বিক্ষোভ ঠেকাতে পুলিশি নির্মমতা

লিখেছেন এমজেডএফ, ০২ রা মে, ২০২৪ দুপুর ১:১১



সমগ্র যুক্তরাষ্ট্র জুড়ে ফিলিস্তিনের পক্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসগুলোতে বিক্ষোভের ঝড় বইছে। যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিলিস্তিনের পক্ষে বিক্ষোভ কর্মসূচী অব্যাহত রয়েছে। একাধিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বিক্ষোভ দমনের প্রচেষ্টা চালালেও তেমন সফল... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছাঁদ কুঠরির কাব্যঃ ০১

লিখেছেন রানার ব্লগ, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ৯:৫৫



নতুন নতুন শহরে এলে মনে হয় প্রতি টি ছেলেরি এক টা প্রেম করতে ইচ্ছে হয় । এর পেছনের কারন যা আমার মনে হয় তা হলো, বাড়িতে মা, বোনের আদরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

হিটস্ট্রোক - লক্ষণ ও তাৎক্ষণিক করণীয়

লিখেছেন ঢাকার লোক, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:০৭

সাধারণত গরমে পরিশ্রম করার ফলে হিটস্ট্রোক হতে পারে। এতে দেহের তাপমাত্রা অতি দ্রুত বেড়ে ১০৪ ডিগ্রী ফারেনহাইট বা তারও বেশি হয়ে যেতে পারে।

হিটস্ট্রোক জরুরি চিকিৎসা প্রয়োজন। চিকিৎসা... ...বাকিটুকু পড়ুন

আল্লাহকে অবিশ্বাস করার সংগত কোন কারণ নাই

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:৪৩



সব কিছু এমনি এমনি হতে পারলে আল্লাহ এমনি এমনি হতে সমস্যা নাই। বীগ ব্যাং এ সব কিছু হতে পারলে আল্লাহও হতে পারেন। সব কিছুর প্রথম ঈশ্বর কণা হতে পারলে আল্লাহও... ...বাকিটুকু পড়ুন

×