somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

সুনীল এর দেখা মুক্তিযুদ্ধ

২৯ শে আগস্ট, ২০২০ বিকাল ৩:৪৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

দীর্ঘ ৯-১০ বছর ধরে সুনীল বাবু অসুস্থ।হিক্কা থাকে প্রায় সময়,সাথে কিডনি সমস্যাসহ নানাবিধ শারীরীক সমস্যা।কিছু সময়ের জন্য হিক্কা কমলেও তখন বেশ ক্লান্ত থাকেন।ওষুধপত্র নিজেই ঠিকমত সেবন করতে পারেন, একটু ভালোবোধ করলে কলপাড় পরিস্কার করেন,টুকটাক জিনিসপত্র গুছায়ে রাখেন,ভেজাকাপড় রোদে দেন,নাতির খোঁজ নেন।তাঁর স্ত্রী ফেব্রুয়ারী-২০ থেকে গুরুতর অসুস্থ,যিনি ছিলেন সংসার মগ্ন।একজন বেড়াতে আসবে শুনলে কী খাওয়াবেন,কে বাজার করবে,কোন বেলায় কী রান্না হবে এ চিন্তায় ঘুম হতনা,কাজ আর কাজ ছিলো তার নেশা,বিশ্রাম নিতে বললে বলতেন আমি ঠিক আছি তোরা চিন্তা করিসনা,অসুস্থ হওয়ার আগে বেশ কয়মাস ওষুধেও ঘুম আসতে চাইতোনা-কেন ঘুমের ওষুধ ডাবল ডোজও লুকায়ে খেয়ে ফেলতেন,অসুস্থ হওয়ার পর কয়মাস মানসিক রোগীরমত আচারণ করেছেন,এখন কেমন নির্জিব।তাঁর টুকটাক খোঁজখবরও নেন সুনীল বাবু।ক্লান্তির মধ্যে একটু ভালোবোধ করলে- তিনি মুক্তিযুদ্ধ ও অতীত রোমন্থন করেন।
১৯৬১ সালে বাগেরহাট পিটিআই তে বাছাই পরীক্ষায় ফার্স্ট হয়ে পিটিআই ভর্তি হয়ে ১ বছরের ট্রেনিং এ পাস করেন।১৯৬৩ সালে ইন্দুরকানীর বদরখালী প্রাইমারীতে প্রথম চাকুরী জীবনের শুরু,সেখান থেকে বদলী হয়ে মুক্তিযুদ্ধের কয়েকবছর আগে টোনা ইউনিয়নের পান্থাডুবিতে যোগদান করেন।এর মধ্যেই পূর্ব পাকিস্তানে ঘটে যায় কত আন্দোলন সংগ্রাম।আসে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ডাক।২৫ মার্চ ১৯৭১ দিবাগত রাতে অপারেশন সার্চলাইট শুরু হয়।২৬ মার্চ ১৯৭১ প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা দেন।বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায় পাকিস্তান।ঢাকাসহ সারাদেশে নিরীহ মানুষের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে পাকিস্তনী হানাদার বাহিনী,গুলিকরে মারে জ্ঞানীগুনী সহ সাধারন মানুষকে।


টোনা ইউনিয়নের ওদনকাঠী,নরখালী,লখাকাঠী,মুলগ্রাম,তেজদাসকাঠী ও টোনার একটা অংশের চন্দ বাড়ির অনেক নামী লোকদের স্থানীয় রাজাকারদের সহায়তায় ধরে এনে তেজদাসকাঠী প্রাইমারী স্কুলের সামনের খালপাড়ে গুলি করে মারে হানাদার বাহিনী। ওদনকাঠি-লখাকাঠী-তেজদাসকাঠীর রমনী কবিরাজ,নারায়ন দাস,যোগেশ দাস,গনেশ মন্ডল,..চন্দ বাড়ীর লোকও আছে তার মধ্যে।গুলির শব্দে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে দুই আড়াই বছরের ছেলে নিক্সনকে নিয়ে বাড়ীর পাশের বাগানে লুকায় সুনীল চন্দ্র কুন্ডু এর পরিবার।সেদিন ভাগ্যভালো মিলেটারীদের টোনার পথ কেহ দেখিয়ে দেয়নি দোশররা ,তাহলে অগনিত হিন্দু মারা যেত-কারণ এই এলাকায় হিন্দুদের বসাবস বেশি ।ঐদিন শুধুমাত্র মাথাওয়ালা হিন্দুদের হত্যা করেছে হানাদার বাহিনী।


এর দু-একদিন পরেই বারেক হাওলাদার রাস্তায় বসে থাকা নগেন মাস্টারকে(নগেন কুন্ডু,পাঠশালার শিক্ষক) থাপ্পর দিয়ে হাতঘড়িটা নিয়ে বলে,“ এখনো বসে আছো ওদিকে লুটপাট শুরু হয়েগেছে”।গ্রামের পূর্বদিক থেকে জাগৈড়(হৈহুল্লোর শ্বব্দ) দিতে দিতে লুটতরাজ ও ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দিতে শুরু করে।মানুষজন দৌড়াদৌড়ি শুরু করে।কাসার থালাবাসন,সুটকেস নিয়ে তাঁর বাবা জলপাই ভিটার ডোবার পাশে লুকায় আর পরিবারের অন্যান্যরা ধরের বাড়ির বাগানে পালিয়ে থাকে।তাদের হাইল্লা(হালুডি করত বা বর্গা চাষি) পশ্চিম টোনার এসমাইল খাঁ লুট করে নৌকায় করে নিয়ে যায় তাদের সবকিছু-যা জলপাই বাগানে বসে দেখতে পায় তাঁর বাবা।কতক্ষণ পরে এদিক ওদিক খুঁজতে খুঁজতে তাঁর বাবা সখানাথ কে দেখে ফেলে পশ্চিম টোনার বড়বাড়ির খালেক।গলায় দা ধরে সবকিছু নিয়ে নেয় খালেক।সবকিছু ঠান্ডা হলে বাগান থেকে বেরিয়ে আসে সবাই।গোয়ালের গরু তখনো নেয়নি।সেগুলোকে ইব্রাহীম খাঁকে ডেকে দিয়ে দেয়। পাছের বাড়ির হরিপদ-কালিপদর গোলা থেকে আধামণ চাউল নিয়ে মামাদের কাডাম(মালামাল পরিবহনের) নৌকায় সন্ধ্যায় রওনা হয় অজানা উদ্দ্যেশে।শ্রীরামকাঠী হয়ে হিন্দু অধ্যুষিত এলাকা বানিয়ারী গোবর্ধন প্রাথমিক বিদ্যালয়ে অবস্থান নেয় তাঁরা।ওখানের পার্শ্ববর্তী এলাকার কিছু মুসলিমরা ঐ এলাকায় হামলা চালাতে চেষ্টা করে কিন্তু ওখানকার একচাটিয়া হিন্দুদের বাধায় তা ব্যর্থ হয়।সেখানের মানুষের সহযোগিতায় ওখানেই দু-একদিন কাটিয়ে কোন উপায় না পেয়ে চলে আশে পার্শ্ববর্তী ইউনিয়ন দূর্গাপুরের ভদ্দর মৌলবীর দরজায়,তার বড় ছেলে ক্লাসমেট ছিল এই ভরসায়।সেখানে একটা ছাড়াভিটায় থাকতে বলে তারা।সেখানে খোলা জায়গায় কীকরে থাকবে ?ভিটার উদ্দ্যেশে রওনা হয়।পোড়াভিটায় চলে আসে।বাড়ির সামনের নির্মানাধীন টোনা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে অনেকের মত আশ্রয় নেয়।
সেখানে এসে শোনে পোদ্দার বাড়ির কার্তিককে কেয়াবনের ভিতর থেকে ধরে এনে গুলি করে মেরেছে,কৈবর্তবাড়ির একজনকেও গুলিকরে মেরে ফেলা হয়েছে।বাড়ির অনন্ত,অজিৎ এবং পাড়ার সুরেশ মাস্টার,চিত্ত মাস্টার,সতিন্দির ডাক্তার(গ্রাম্য) আশ্রয় নেয় মতিমেম্বরের ভাই সোবাহানের বাড়িতে।সেখানে সোবাহানের কাছে কলেমা পড়ে তারা মুসলমান হয়ে থাকে। পালের বাড়ির নারায়নের বোনকে হানাদার বাহিনীর দোসর মৌজেআলী ধরে নিয়ে ছয়মাস আটকে নির্যাতন চালায়।কাউখালি বাজার লুটপাটে সহযোগিতাকারী ছিলো মৌজেআলি।মিলিটারিদের না জানিয়ে ডালডার টিন নিয়ে আসলে তাকে পরবর্তিতে তাকে গুলি করে মারে মিলিটারিরা এমন কথা শোনা গেছে।
স্কুলেও এক রাতে লুটপাট করে নিয়ে যায় স্থানীয় কিছু মুসলমানেরা।বঙ্গবন্ধুর ডাকে সব প্রতিষ্ঠানের মত স্কুলও বন্ধ হয়ে যায়।কয়েকদিন বাদে ঘোষণা আসে চাকরীতে যোগদান না করলে চাকরী হারাতে হবে।সুনীল যোগ দেয় তাঁর কর্মস্থলে।স্কুলের আশেপাশের কেউ কেউ চাউল, ডাইল দিয়ে সাহায্য করে।মাহাবুব হাজরার বোনরা দুপুরে এসে ডেকে নিয়ে যেতো-নানা ছুতোয়।দুপুরের খাবার সেখানেই প্রায়ই খাওয়া লাগতো।ফাঁকে একদিন রওনা হয় দিদি বাড়ি,শ্বশুর বাড়ির কে কেমন আছে দেখতে।পায়ে হেঁটে রওনা হয় বিষখালী বাধালের উদ্দ্যেশে।বনগাঁ খেয়া পাড় হয়ে উপরে ওঠার আগেই হাঁক আসে ও মাঝি কয় ক্ষ্যাপ দিলা,এ ক্ষ্যাপে কয়জন হিন্দু আছে ,হাত জাগাতে বলো।সুনীলের বুক কেঁপে ওঠে,এই বুঝি গেছি,দুড়ুদুড়ু বুকে হাত জাগায় সে।হঠাৎ একটা বাস আসার শব্দ হলে সেইলোক দৌড়ে গিয়ে বাসে ওঠে।এ যাত্রা বেঁচে যায়।বিষখালী বাধাল তখন হিন্দু অধ্যুষিত এরিয়া।পায়ে হেঁটে সেখান থেকে ঘুরেফিরে আসেন তিনি।তাঁর দিদি ও শ্বশুর বাড়ির লোকজন তখনও বাড়িতেই আছে।
এসডিপিও ফয়জুর রহমানকে মেরে ফেলে হানাদাররা।অভিযোগ ট্রেজারী লুটে সাহায্য করেছে।তাঁর এক বোনের স্বামী আলি হায়দার খাঁর বৌ।তাঁর সুযোগ্য সন্তান হুমায়ুন আহম্মেদ,ড: মুহম্মদ জাফর ইকবাল,আহসান আহম্মেদ।ওমর ফারুকের নেতৃত্বে পিরোজপুরে ট্রেজারী লুট হয়।তাকে হানাদার বাহিনী হন্যে হয়ে খোঁজে ফজলুল হক আশ্রয় নেয় দুর্গাপুরের ভদ্দর মৌলবীর কাছে। নিরাপদ জায়গায় নিয়ে যাবে বলে ফজলুল হককে নিয়ে ভদ্দর মৌলবী নৌকায় করে নিয়ে মেরে কালিগঙ্গায় ফেলে দেয়।এসব দৃশ্যে সুনীলের মন অস্থির হয়ে উঠে।
এদিকে স্কুলের মুসলিম শিক্ষকদের বেতন দেয় সরকার। কিন্তু হিন্দু বলে তাকে বেতন দেয় না।বাড়ির যাকিছু ছিল লুটে নিয়েছে রাজাকাররা।কী খেয়ে বাঁচবে তাঁরা।যারা মুসলিম হয়েছে তাদের মুসলমানরা খাওয়াদাওয়া দিচ্ছে।ভারতে আশ্রয় শিবির খোলার খবর আসে।স্কুলের আশপাশের কেহ কেহ চাউল ডাল দিয়ে সাহায্য করে তাঁকে।পুব টোনার নিছু মল্লিক(নেছারউদ্দিন) এর বৌ কাঁথা,পাটাপুতা দিয়ে সাহায্য করে।প্রথমবার পোড়া ভিটায় ফিরে আসার পর একদিন রাত্রে সার্টিফিকেট,দলীলের সুটকেসের খোঁজে মতিমেম্বরের দরজায় নক করেন সুনীল।মতিমেম্বরের বড় বৌ কে-রে বলে রামদা নিয়ে বেরিয়ে আসে।ভেবেছিলো কোন দুস্কৃতিকারী।কী হয়েছে মাস্টার তোমার কী হয়েছে প্রশ্নে সুনীল কেঁদে দেয়।কান্নাজড়িত কন্ঠে তিনি বলেন ,“আমাদের সব নিয়েছে নিক আমার সার্টিফিকেট আর আমাদের দলীলপত্রগুলো দিয়ে দিক”।আম্বিয়া ওই সময় উঠানে নেমে ,“তোদের ঝোলা হবে তোদের নির্বংশ হবে বলে চিৎকার দেয়”।পরের দিন সুনীল বাবু কাগজপত্রগুলো আম্বিয়া বেগম(মতি মেম্বরের বৌ) এর চেষ্টায় ফেরৎ পান।
তেজদাসকাঠীর সেজন মাঝির কাছে পরামর্শ নিতে গেলে সে ভারতে যেতে বলে।সেজন মাঝি পাকিস্তানপন্থি লোকছিলো।পিরোজপুরে টোনা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান কাদের হাওলাদারের সাথে দেখা হলে কী করবে পরামর্শ চান।চেয়ারম্যান বুকে জড়িয়ে ধরে বলেন,“মাষ্টার আমিতো তোমাদের জন্য কিছু করতে পারলাম না ,তোমাদের রক্ষা করতে পারলাম না,তোমরা ভারতে চলে যাও”।তিনি বহু বছর টোনা ইউনিয়নে চেয়ারম্যান ছিলেন।মুসলিমলীগের লোক ছিলেন-শান্তি কমিটিতেও ছিলেন কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন কাউকে ক্ষতি করেননি।
বাড়ির কয়েকটা গাছ বিক্রি করে কিছু টাকা হয়। ওদনকাঠীর মাহাবুব হাজরাকে চাউল রাখার বড় দুটি মটকী(মটকা) ও কিছু সুপারীর চারা দিয়ে দেয়।স্বর্নের দুএকটা জিনিস গলায়ে নেয়,কিছু কৌটায় ভরে ছাইয়ের নিচে চাপা দিয়ে রাখে,চেইন ব্লাউজের পেডিকোটের বর্ডারে ঢুকায়ে সেলাই করে নিয়ে আগের পথেই এক ভোর রাত্রে রওনা হয়।চেনা সেই গোবর্ধন স্কুলে এক রাত কাটায়।সেখানের ওয়ালে নাম ঠিকানা লিখে রওনা হয় নয়া গন্তব্যে।পথে সন্ধ্যার আগে নাজিরপুরের কাছে পৌঁছলে উপর থেকে হাঁক আসে নৌকা থামাও নইলে টুকরা টুকরা করে ফেলাবো।সুনীলের মামার কাছে থাকা রামদা খানা ভয়ে নদীতে ছেড়ে দেয়।নৌকা পাড়ে আসে।ঐ ঘাটে কুত নেয়া হত।উপস্থিত লোকেরা নামাজ পড়ে অন্য সহযোগীদের ডেকে এনে টাকা পয়সা যা পেয়েছে তা নিয়ে নেয়। আবার চলে তাদের নৌকা।একসময় পৌছে যায় বর্ডার এলাকায়।মানুষের স্রোত এগিয়ে যাচ্ছে ভারতের দিকে।লোকজনের পায়ের হাঁটায় বর্ষা-কাঁদায় রাস্তাঘাট জমির মতো হয়ে গেছে। ছোটদের ,বৃদ্ধদের ঘারে করে, ঝাঁকায় করে মাথায় নিয়ে,ভারবাঁশে করে মানুষ চলছে নিরাপদ আশ্রয়ে।কোন আসুস্থ বৃদ্ধকে নিতে না পারলে কোন মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে রেখে গেছে পথের পাশে।যারা যাচ্ছে তারা তাকে খাবার দিয়ে যাচ্ছে।
নিক্সনকে ঘারে করে এগিয়ে চলছে তাঁরা।বর্ডারের খাল পাড়াতে বৃদ্ধ মাকে ভেলায় করে পয়সার বিনিময়ে পার করে তাঁরা পৌছায় ভারতে।আশ্রয় নেয় কৃষ্ণ নগরের জেনারেল পোষ্ট অফিসে,তারপর সেখানের আমবাগান শরনার্থী ক্যাম্পে সেখান থেকে আত্মীয়স্বজন পরিচিতজন বেশি থাকায় সেখান থেকে নদীয়া জেলার রানাঘাটের ধুবুলিয়া শরনার্থী ক্যাম্পে।তাঁর ব্লাউজের বর্ডারে লুকিয়ে নেয়া চেইন বিক্রি করে টুকটাক মুদি জিনিসপত্র কিনে ঐ কয়মাস ছোটখাট ব্যবসাও করেছেন ছোট ভাইকে সাথে নিয়ে।নোংরা পরিবেশ ,সল্প আহার,বিভিন্ন রোগ ব্যাধি নিয়ে চলে শরনার্থী ক্যাম্পের ভয়ঙ্কর কয়টা মাস।ডায়রিয়ায় সেখানে বসে মারা যান তাঁর বাবা।শ্রাদ্ধক্রিয়া শেষে জ্ঞাতি আত্মীয় স্বজনদেরও ভোজনও করান।এভাবেই কেটে যায় শোক, কষ্ট,বেদনার দিনগুলি।ঘর বাড়ি হারানোর দিনগুলি।চোখের সামনে ঘটে যাওয়া লুটপাট,অগ্নিকান্ডের দিনগুলি।পরিচিত জনের সেই নির্মম কর্মকান্ডের ঘটনাগুলি।আবার বিপরীত ঘটনাও সে সময় কম ঘটেনি।সেই সাহায্যকারী লোকদের কথাও মনে পরলে চোখ ছলছল করে ওঠে তাঁর।


অনেক জল্পনা কল্পনার পরে ১৬ ডিসেম্বর ঘোষণা আসে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে।মাইকিং শুরু হয় শরনার্থী ক্যাম্পের চারিদিকে।সকলকে বাড়ি ফিরে যাওয়ার ঘোষনা আসে।ট্রেনে বেনাপোল,সেখান থেকে ট্রেনে যশোর,সেখান থেকে ট্রেনে খুলনা,সেখান থেকে স্টিমারে হুলারহাট-সব ভাড়াই ফ্রী ছিলো।
এই পথ পরিক্রমায় ছায়া সঙ্গি ছিলো তাঁর স্ত্রী অনিমা।যুদ্ধকালীন সময়ে প্রতিকুল পরিবেশে সকলকে রান্নাবান্না করে খাওয়ানো ,বাচ্চাকে আগলে রাখা,শ্বশুর শ্বাশুড়ি দেবর কে যতটুকু পারা যায় তার বেশি সহযোগিতার মাধ্যমে আগলে রাখার চেষ্টা ছিলো তার প্রানান্তর চেষ্টা।বাপের বাড়ির দেয়া স্বর্ণের জিনিস বিক্রি করে সংসার চালানো।কত স্মৃতি মনে পরে তাঁর।
স্বর্ণের যে জিনিসগুলো নেয়া যাবেনা তা কৌটায় করে রেখে গেছিলো পিছনের আদারের ছাইয়ের ভিতর।তাঁর কাকার ফ্যামিলি পালানোর এক পর্যায়ে আবার ফিরে আসলে কাকীমা সেই স্বর্ণের কৌটা পেয়ে পরবর্তীতে ফেরৎ দেয়।ঐ সময় একজনের কাছে কিছু জমা রেখে গেলে তা প্রায়ই অস্বীকার করেছে বা কুড়ায়ে পেলেও ফেরৎ দেয়নি।সে ক্ষেত্রে তাঁর কাকীমা সততার এক বিরল দৃষ্টান্ত।শরনার্থীদের নানা রকম সাহায্য সহযোগিতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত মানুষকে বাঁচিয়ে রেখেছে।আবার পথেঘাটে টাউট বাটপারের সংখ্যাও কম ছিলোনা।মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পরে যতদিন বাড়িতে ছিলেন তখন দেখেছেন বিশ্বাস বাড়ি কীভাবে দখল করেছে,রমনী কবিরাজের বাড়ি কীভাবে দখল হয়েছে।
বাড়িতে ফিরে আসার পর চাকুরীতে যোগদানের ঘোষণা এলে চাকুরীতে যোগদান করেন।পোড়ায়ে দেয়া তাঁদের ঘরখানি বেশ ভালো কাঠের ঘর ছিলো।বিভিন্ন সংস্থার দেয়া গোলপাতা টিন দিয়ে বাঁশ খুটির নতুন কুড়ে ঘর বানিয়ে থাকা শুরু করেন তাঁরা।
বিজয় মিছিলের নৌকা ভেঙ্গে ফেললে মৌজেয়ালীকে কাউখালী থেকে ধরে এনে মেরে ফেলে মুক্তিবাহিনী।ইসমাইল খাকে তার অপকর্মের জন্য মেরে ফেলে রক্ষী বাহিনী।এরকম এক রাত্রে রান্নাঘরে খেতে বসলে আ.সোবাহান হাওলাদারকে রক্ষী বাহিনী গুলি করে মেরে ফেলে।হাকেম আলী,তার ভাই আজিজ আলী,হারেম আলী(গনেশ মন্ডলের হত্যাকারী),লখাকাঠীর চৌকিদার দুই ভাই টোনা ইউনিয়নের বড় বড় রাজাকার ছিলো বলে শুনেছেন তিনি। ইসমাইল খা ছিলো বড় মাপের রাজাকার।সে ,দেশের বিজয় হলে নৌকার বিজয় মিছিলের নৌকা পিটায়ে ভাঙ্গে।এরপর একদিন মূলগ্রাম হাটের দিন মুক্তিবাহিনীর লোকজন ধরে নিয়ে যায়।পরবর্তিতে বেপারীবাড়ির বাগানে মাথাবিহীন ও পুরুষাঙ্গবিহীন অবস্থায় পাওয়া যায় তার লাশ।


তেজদাসকাঠীর টুক্কু খা ছিলেন টোনা ইউনিয়নের অন্যতম মুক্তিযোদ্ধা।ডা. আব্দুল হাই ছিলেন পিরোজপুর কাউখালী এলাকার এমপিএ।এনায়েত খা ছিলেন প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য।
তখনকার হানাদার বাহিনীর সহযোগীরা সে সময় দখল করে নিয়েছে হিন্দুদের জায়গাজমি, লুটে নিয়েছে অস্থাবর সম্পদ।তাদের সন্তানেরা এখন সম্পদশালী ,তারাই এখন ক্ষমতায়।তারাই শাসন শোষণ করছে নতুন তকমা লাগিয়ে মুক্তিযুদ্ধের কথা বলে।দীর্ঘনিশ্বাস ছেড়ে আক্ষেপ করে বলেন তিনি।


দেশে মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী ইউনিয়ন কাউন্সিল নির্বাচনে চেয়ারম্যন পদে লড়েন-বাবু অনুকুল চন্দ্র কুন্ডু(অনুকুল বাবু নামে পরিচিত ছিলেন),খলিল হাজরা,রহমান হাওলাদার,ভাইলাল দত্ত(মন্মথ ঘোষের জামাই)।অনুকুল কুন্ডুর পদবি কুন্ডু/দেব নিয়ে একজন রিট করেন।তাতে অনুকুল বাবু ইলেকশন করতে পারবেন কী-না তা নিয়ে ধুম্রজাল তৈরী হয়।নির্বাচনের দুইদিন আগে রায় আসে অনুকুল বাবু নির্বাচন করতে পারবেন।কিন্তু ভাইলাল দত্ত ইলেকশন করায় অনুকুল বাবুর কিছু ভোট তার পক্ষে চলে যায়।অনুকুল বাবু নির্বাচিত হতে পারেননি।রহমান হাওলাদার নির্বাচিত হন।
নতুন করে শুরু হয় রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট।সাধারণ মানুষ ক্ষেত খামারে চাষাবাস শুরু করে।ব্যবসা বানিজ্য শুরু করে।পরিচিত জনদের অপরিচিত কাজকর্ম ভুলে গিয়ে মিলেমিশে নতুন জীবন শুরু করে।অনুকুল বাবুর নেতৃত্বে টোনা কুন্ডুপাড়ায় জুনিয়র হাইস্কুল প্রতিষ্ঠা হয়,সঙ্গে ছিলেন সুনীল চন্দ্র কুন্ডু।স্কুলের প্রধান শিক্ষক খুঁজতে সুনীল বাবু অন্যদের নিয়ে বিভিন্ন অঞ্চলে ঘুরেন।প্রধান শিক্ষক পাওয়া যায়।সুনীল বাবু সেখানে কিছুকাল শিক্ষকতা করেন।টোনা কুন্ডুপাড়ায় সার্বজনীন রাস কীর্তন অনুষ্ঠান শুরু করেন।সেখানে সার্বজনীন দূর্গা পুজা প্রচলন করেন তাঁরা।এভাবে নানা অনুষ্ঠানের মধ্যে বিভিন্ন জাতি,সম্প্রদায় মিলেমিশে কাটিয়ে দিচ্ছেন এ এলাকার মানুষেরা।
[বিদ্রঃব্যবহৃত ছবিগুলো নেট থেকে নেয়া।]


সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে আগস্ট, ২০২২ বিকাল ৩:৫৭
২টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমাদের কার কি করা উচিৎ আর কি করা উচিৎ না সেটাই আমারা জানি না।

লিখেছেন সেলিনা জাহান প্রিয়া, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১:২৮




আমাদের কার কি করা উচিৎ আর কি করা উচিৎ না সেটাই আমারা জানি না। আমাদের দেশে মানুষ জন্ম নেয়ার সাথেই একটি গাছ লাগানো উচিৎ । আর... ...বাকিটুকু পড়ুন

মানবতার কাজে বিশ্বাসে বড় ধাক্কা মিল্টন সমাদ্দার

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ২:১৭


মানুষ মানুষের জন্যে, যুগে যুগে মানুষ মাজুর হয়েছে, মানুষই পাশে দাঁড়িয়েছে। অনেকে কাজের ব্যস্ততায় এবং নিজের সময়ের সীমাবদ্ধতায় মানুষের পাশে দাঁড়াতে পারে না। তখন তারা সাহায্যের হাত বাড়ান আর্থিক ভাবে।... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিসিএস দিতে না পেরে রাস্তায় গড়াগড়ি যুবকের

লিখেছেন নাহল তরকারি, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৫৫

আমাদের দেশে সরকারি চাকরি কে বেশ সম্মান দেওয়া হয়। আমি যদি কোটি টাকার মালিক হলেও সুন্দরী মেয়ের বাপ আমাকে জামাই হিসেবে মেনে নিবে না। কিন্তু সেই বাপ আবার ২০... ...বাকিটুকু পড়ুন

ডাক্তার ডেথঃ হ্যারল্ড শিপম্যান

লিখেছেন অপু তানভীর, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:০৪



উপরওয়ালার পরে আমরা আমাদের জীবনের ডাক্তারদের উপর ভরশা করি । যারা অবিশ্বাসী তারা তো এক নম্বরেই ডাক্তারের ভরশা করে । এটা ছাড়া অবশ্য আমাদের আর কোন উপায়ই থাকে না... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমার ইতং বিতং কিচ্ছার একটা দিন!!!

লিখেছেন ভুয়া মফিজ, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৩:০৩



এলার্ম এর যন্ত্রণায় প্রতিদিন সকালে ঘুম ভাঙ্গে আমার। পুরাপুরি সজাগ হওয়ার আগেই আমার প্রথম কাজ হয় মোবাইলের এলার্ম বন্ধ করা, আর স্ক্রীণে এক ঝলক ব্লগের চেহারা দেখা। পরে কিছু মনে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×