somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

নিজেকে চিন, সত্যকে জান

১৭ ই নভেম্বর, ২০২১ দুপুর ২:৪৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

পারিবারিক ভাবে হওয়া মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ, খৃষ্টান, নাস্তিকতা ইত্যাদির গ্রহণযোগ্যতা নেই, মূল্য নেই। পৈতৃক ভাবে পাওয়া ধর্মবিশ্বাস বা মতবাদের যে দাবি- তার যৌক্তিকতা ও মূল্যায়ন হয় না, কারন ইহা অন্ধ বিশ্বাস। আর অন্ধ বিশ্বাস হচ্ছে মিথ্যা। সত্য-মিথ্যা বুঝার বিবেক বোধ রয়েছে। “সত্য”-কে সত্যের প্ল্যাটফর্মে বিচার করতে হয়; নয়ত রিপুর অনুসারী হয়ে আত্মপ্রতারণার সহিত উদ্দেশ্যহীন জীবন অতিবাহিত ও বিচরণ করার মাধ্যমে মানুষ আর ইতর প্রানীর মধ্যে পার্থক্য থাকে না। বিশ্বাস বা মতবাদে অনু পরিমান সন্দেহ থাকিলে ইবাদতে পবিত্রতা, নিষ্টা এবং আদর্শ গঠিত হয় না। আর সত্যকে অর্জন করতে চাইলে সর্বপ্রথম নিজের সত্তা “আমি”-কে চিনতে হয়, জানতে হয়। আত্মনিয়োগের মাধ্যমে বিবেক দিয়ে বুঝতে হয়, “আমি” এই মহাবিশ্বের সবচেয়ে মূল্যবান সৃষ্টি এবং সকল সৃষ্টির সর্বোত্তম ও উৎকৃষ্ট।


PART-A
=======
ভূমিকাঃ


মানব শিশু অতিশয় দুর্বল। প্রবৃত্তিহীন এক অবুঝতার সৌন্দর্য নিয়ে দুনিয়ায় আগমন ঘটে আর সাথে নিয়ে আসে কান্নার ভাষা যার সাহায্যে জানান দেয় নিজের ক্ষুধা ও প্রয়োজনকে। ভূমিষ্টের সাথে উম্মেষ ঘটে অনুভূতির আর অল্প সময়ের পর তা থেকে জন্ম নেয় “আকর্ষণ”। এই আকর্ষণ মস্তিষ্কের মাধ্যমে পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের দ্বারা নিজ “কর্ম”-কে নিয়ন্ত্রণ করা শেখা শুরু করে। বেড়ে উঠে কৌতূহলের সহিত জিজ্ঞাসু মনে, পরিবার ও চারপাশের সহায়তায়। কিন্তু ইহা লক্ষিত অধিকাংশ পরিবার নিজেদের বিশ্বাস, মতবাদ, নির্ধারিত জ্ঞান ও ধর্মীয় চিন্তা চেতনার দ্বারা তার জিজ্ঞাসু মন, চিন্তার জগতকে বাঁধাগ্রস্ত করে দেয়। শিশুর সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়াকে শুরুতেই কুসংস্কারের শৃঙ্খলে শৃঙ্খলিত করে ফেলা হয়। মুসলিম পরিবারে জন্ম নেয়া পারিবারিক সূত্রে যেমন নিজেকে মুসলিম দাবী করে, তেমনি হিন্দু, বৌদ্ধ, খৃস্টান, নাস্তিকতা ইত্যাদি। সাধারণত মানুষ পৈতৃক ধর্মীয় বিশ্বাসকে আঁকড়ে ধরতে পছন্দ করে, এর কারন মানব শিশু অনুকরণ প্রিয়। আর মানুষের অভ্যন্তরীণ রিপুগুলো খুব আরাম প্রিয়। এই আরামের খাতিরে বিবেক, স্বাধীন আলোচনা ও গবেষণা অসত্যের পুঞ্জীকৃত আবর্জনা রাশির নিম্ন হতে সত্যের উদ্ধার সাধন করিবার জন্য, পরিশ্রম স্বীকার করিতে চায় না। অন্তরের গভীরে সযত্নে লালিত বিশ্বাসকে সত্য হিসেবে আঁকড়ে ধরে এবং সেই আঁকড়ে ধরা অনুভূতির ভিতর সন্দেহ প্রবেশ করাতে চায় না। ইহা মানবীয় দুর্বলতার সর্বাপেক্ষা মারাত্মক একটি দিক। আবার স্রোতের এই অনুকূলের বিপরীতে অনেকে কুসংস্কারের শৃঙ্খল ভেঙ্গে নিজেকে নিয়ে ভাবতে শুরু করে। পরিণত চিন্তার সহায়তায় যখন অনুসন্ধিৎসু মনের জাগ্রতি ঘটে, তখন সে আবিষ্কার করে এই মহাবিশ্বের মহা-বিস্ময় সে নিজেই। “আমি” এই মহাবিশ্বের এক মহা-বিস্ময় ও রহস্যময়। উপলব্ধি করে “আমি বেঁচে আছে”- এর চেয়ে আশ্চর্য ও রহস্য এই মহাবিশ্বে আর কিছু হতে পারে না। আমার কাছে আমি গুপ্ত আবার প্রকাশ্য। “আমি”-কে যখনই বুঝতে ও জানতে আত্মনিয়োগ করা হয়, জটিলতার পর্দা ততই মজবুত হয়ে চিন্তাশক্তি ও অনুভূতিকে আচ্ছাদিত করে। এই জ্ঞান অর্জন করার পন্থা কি? কোথা থেকে শুরু এবং কিভাবে শুরু? আমি কে? আমি কেন? আমি কিসের তৈরি? আমি কিভাবে তৈরি? শুক্রাণু এবং ডিম্বাণুর মিশ্রণই কি আমি? রাসায়নিক বিক্রিয়াই কি আমি? প্রকৃতি কি আমি-কে তৈরি করেছে নাকি আমি নিজেই নিজেকে সৃজন করেছে? কেন ক্ষুধা অনুভব করে? কেন কাম উত্তেজনায় উত্তেজিত হয়? কেন উত্তেজিত হয়ে ঝগড়া, খুনখারাবিতে জড়ায়? কেন কামনার নেশায় মোহগ্রস্ত? কেন জীবনের এত বিড়ম্বনা যা থেকে বাঁচার জন্য রিপুর গোলাম হয়ে খেয়ালখুশির ভিতর বিরাজমান? জীবনের উদ্দেশ্য কি? আর সবচেয়ে গুরুত্ব “আমি”-র অস্তিত্ব কিভাবে টিকে আছে এবং নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে- উত্তরগুলোর জানার উপায় কি?

জ্ঞান ও বিশ্বাসঃ

জ্ঞান অর্জন আর জ্ঞান ধার বৃহত্তর পার্থক্য। মানব জাতির স্বভাব জনিত অভ্যাস জ্ঞান ধার করা। ধার করা জ্ঞান দুই রকম। বিশ্বাস ও অবিশ্বাস। বাস্তবতার জটিলতা ও বিড়ম্বনা থেকে নিজকে মুক্ত রাখতে প্রায় সকলেই “বিশ্বাস”-কে গ্রহণ করে। স্কুল ও চারপাশ থেকে ধার করা জ্ঞানের সহিত বিশ্বাসের ভিত্তিকে মজবুত করে। প্রকৃতিতে রয়েছে ইন্দ্রিয় লব্ধ জ্ঞান ও অনুসন্ধানী জ্ঞান। ইন্দ্রিয় ও অনুসন্ধানী ছাড়াও আরেকটি জ্ঞান হচ্ছে ভাষা জ্ঞান। ভৌত বা বিজ্ঞানের জ্ঞান ধার করা গেলেও, অভৌত জ্ঞান বা অন্তরের জ্ঞান ধার করা যায় না, একে অনুশীলনের মাধ্যমে অর্জন করতে হয়। পরবর্তীতে অন্তর সম্পর্কে জানব। আর এই “অনুশীলনের মাধ্যমে অর্জন”- দুনিয়ার সকলের সত্তাগত আবশ্যিক। এই দায়িত্ব এড়িয়ে যাওয়া মানে নিজ সত্তা ও বিবেকের সহিত শঠতা যা আত্মপ্রতারণা। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় আত্মপ্রতারণা মানুষ দিয়েই দুনিয়া পূর্ণ। অন্তরের জ্ঞানকে অর্জন করার পরিবর্তে বিশ্বাসের সহিত গ্রহণ করলে অন্তরে জমা হয় উৎকৃষ্টের সাথে নিকৃষ্টের মিশ্রণ যুক্ত আস্থা ও নিশ্চয়তার প্রতিশ্রুতি আর সাথে উপস্থিত হয় সন্দেহ ও হাঙ্গামা। আবেগ ও অজ্ঞতার দরুন পক্ষপাতিত্ব ও বাড়াবাড়ির ক্ষীপ্রতা নিজেকে আচ্ছাদিত করে ফেলে। ফলে বিশ্বাসের মতবাদটি পরিণত হয় “অন্ধবিশ্বাস”-এ। আর অন্ধবিশ্বাস “পথভ্রষ্টতা” ও “উগ্রতা” তৈরীর বীজ। পথভ্রষ্টতা ও উগ্রতা, কামনাকে জাগ্রত করে ধর্মান্ধতা, সন্ত্রাসী কর্ম, হত্যা, দাঙ্গাহাঙ্গামায় লিপ্ত হতে অনুপ্রাণিত করে।

সকল ধর্মের অন্ধ বিশ্বাসীরা নিজেদের মহাপুরুষ, গুরুদের চরিত্রের মহিমা, জীবন ব্রত ও সাধনার আলোচনার মাধ্যমে বাড়াবাড়িতে লিপ্ত। কতকগুলি আজগুবি, অনৈতিহাসিক কেচ্ছা কাহিনী, অলৌকিক কেরামতি ইত্যাদি প্রচার করে মহাপুরুষদের “সৃষ্টিকর্তা”-র সমপর্যায়ে বা তারও ঊর্ধ্বে না বসিয়ে ক্ষান্ত হোন না। ফলে মহাপুরুষদের কেচ্ছা-কাহিনী, কুসংস্কার “শাস্ত্র” হয়ে দাড়ায়। ধর্মের এই বিষ মিডিয়ার কল্যাণে দ্রুত প্রসারমান। বর্তমান ধর্মীয় বিশ্বাসীরা এতটাই অন্ধ যে, ধর্ম সম্পর্কে “সত্য” উপস্থাপন করলে, রুক্ষতার সহিত জবাব দেয় “হাজার বছর ধরে ঋষি, গুরু, পণ্ডিত, আলেম, দরবেশ বাবারা যে দীক্ষা দিয়েছেন, তাহাই সত্য এবং সঠিক”। দাবীর আরও অংশ “ঈশ্বর মানুষের বেশ ধরে দুনিয়ায় আগমন করেছেন কিংবা বাপ-দাদারা যে ধর্মে ছিলেন তাহাই সঠিক”- যা জ্ঞানান্ধ ও অসুস্থ চিন্তা এবং বিকৃত রুচীবোধের পরিচয়। এই সকল ভক্ত বা অনুসারীদের বুঝানো যায় না এবং তাদের অবস্থান থেকে নাড়ানো যায় না। ইহাই হচ্ছে জ্ঞান ও বিবেকের চরম শোচনীয় অধঃপতন। “আমি সঠিক আর তুমি ভুল”- ইহা একটি বিষবৃক্ষ যা প্রত্যেক ধর্মে, ধর্মীয় গোত্রে, জাতিতে, ব্যক্তিতে অত্যন্ত শক্তিশালী আসন গাড়িয়া আছে এবং “ইসলাম”-এর অনুসারীদের ভিতর দলাদলির প্রধান কারন চিহ্নিত। মাথার ভিতর শুধু ঘুরে উনি ভুল, সে ভুল, এ ভুল, ঐ ভুল…… অন্যের ভুল ধরার মাধ্যমে মাথা পূর্ণ থাকলে, নিজের ভুল চিহ্নিত করে সংশোধন এবং সচেতন হওয়া যায় না। আর অন্য মানুষদের দোষ ধরার জন্য চিন্তার জগত ব্যস্ত থাকলে, নিজ বুদ্ধি কাজ করে না। এ ধরণের উগ্রতা ও হিংসার ক্ষেত্রে সকলের মধ্যে ইসলামের অনুসারীরা এগিয়ে। বস্তুতঃ ইসলামের অনুসারীরা ইসলামের প্রকৃত শিক্ষা থেকে অনেক দূরে। আর ইসলাম ব্যতীত অন্যান্য ধর্মে বিশ্বাসের ভিত্তি ও আকিদাগত বিভ্রান্তি এতটাই প্রকট ও বিশাল যে, বিবেকবান মাত্রই এর গুপ্ত কৌশল, ছল ও মিথ্যা চিহ্নিত করতে সক্ষম। সকল অন্ধ বিশ্বাসীরা নিজ নিজ মতবাদ নিয়া উল্লসিত এবং কেহ তার সাথে একাত্মা না হলে জ্বালাও, পোড়াও, হত্যা, দাঙ্গাহাঙ্গামায় লিপ্ত হতে কুণ্ঠিত হয় না বরং মহানন্দে ও উদ্যমের সহিত ধর্মীয় উন্মাদনায় নিজেদের বিলীন করে আর আত্মতৃপ্তির সহিত মনে করে, কতই-না পবিত্র কাজ সে করছে! সভ্য দুনিয়ার শান্তিময়তার জন্য উগ্রতা বন্ধ হওয়া জরুরী।

প্রজ্ঞা ও বিবেকঃ

জ্ঞান হচ্ছে কোন বিষয় বা বস্তু সম্পর্কে সম্যক ধারণা করার মত বোধশক্তি কিংবা অভিজ্ঞতাই হচ্ছে জ্ঞান। আর প্রজ্ঞা হচ্ছে জ্ঞানকে হৃদয়াঙ্গম করে কর্মের মাধ্যমে বাস্তবে প্রয়োগ করার শক্তি। অন্যভাবে প্রজ্ঞা হচ্ছে উৎকৃষ্ট জ্ঞান যা অন্তরে কর্ষিত ও চর্চিত হয়েছে এবং বাস্তবতায় কর্ম দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, যার দ্বারা কল্যাণ সাধিত হয়েছে। পুঁথিগত বিদ্যা প্রজ্ঞা নয় আর প্রজ্ঞার সাথে অন্তরের সম্পর্ক গভীর। জ্ঞানী চোর, বাটপাররাও হতে পারে কিন্তু প্রজ্ঞাবান ব্যক্তি কর্মে উত্তম, চিন্তায় সৎ। আরেক শ্রেণী ক্ষমতাধর উত্তম ও সততার ভান করে প্রজ্ঞার পরিচয়ে রাজনীতি ও ক্ষমতা ব্যবহার করে শান্তিকামী ও মীমাংসাকারী বলে দুনিয়ায় নিজেদের জাহির করে। এরা কুটিল অন্তরধারী ধুরন্ধর এবং জগতের সবচেয়ে বিপদজনক। প্রজ্ঞার মর্যাদার স্তর রয়েছে। উত্তম প্রজ্ঞার একটি হচ্ছে স্থান ও সময়ের সাপেক্ষে অন্যের অন্তরের অনুভূতি ও অবস্থান বুঝতে পারার ক্ষমতা। সত্যকে হৃদয়াঙ্গম এবং অন্ধবিশ্বাসের শৃঙ্খল থেকে নিজেকে মুক্ত করতে চাইলে প্রজ্ঞার বিকল্প নেই। “অন্তদৃষ্টি” প্রজ্ঞার হাতিয়ার। বর্তমান জমানার মানুষজন অন্তদৃষ্টিকে মূল্যহীন ও জীবনের বিড়ম্বনা মনে করে এবং আবর্জনা মনে করে ছুড়ে ফেলে। ইহা নির্বোধদের কর্ম। অন্তদৃষ্টি ব্যতীত দাম্পত্য জীবন, পারিবারিক জীবন হয় অস্থির এবং সম্পর্ক হয় ভঙ্গুর, ঝগড়া সর্বদা লেগেই থাকে, রাগ সংবরণ হয় কঠিন। কমবেশী সকলকে প্রজ্ঞার অধিকারী হতে হয় নয়ত মানুষ আর ইতর জীবদের মধ্যে পার্থক্য থাকে না। নিজ সত্তাকে নিজে অপমানিত করা।

জীবন সুশৃঙ্খল ও শান্তিময় করে পরিচালিত করার জন্য সঠিক জ্ঞান ও ভুল জ্ঞান পার্থক্য করতে পারা এবং জ্ঞানের রাজ্যে সঠিকটি প্রবেশ করতে দেওয়া আর ভুলটিকে প্রতিরোধ করার পুরো প্রক্রিয়াকে কার্যকরী রাখার জন্য এক “প্রহরী” জন্মগত ভাবে মানব জাতির প্রত্যেকের ভিতরে স্থাপিত করে দেয়া হয়েছে। সেই প্রহরী হচ্ছে “বিবেক”। মহাবিশ্বের এক মহা মূল্যবান এই “বিবেক”। শুধু যুক্তি দিয়ে যারা জীবন, বাস্তবতা ও চার পাশের জগতকে বিচার করার প্রয়াস চালায় তাদের যেমন বিবেকের অভাব আছে তেমনি অন্ধভাবে ধর্মকে যারা আঁকড়ে ধরে আছে, তারাও একই। মিডিয়ায় ও বাস্তব জীবনে প্রত্যেকে নিজ নিজ মতবাদকে সঠিক হিসেবে জাহির করতে, বিশেষ করে উঠতি বয়সের ছেলেমেয়েরা কথাবার্তার আন্দোলন ও বাচালতার মাধ্যমে ঘায়েল ও পরাস্ত করার মাধ্যমে হাঙ্গামায় লিপ্ত। আর ইসলামের অনুসারীদের অনেকে শুধু বিবেক বা কমন সেন্সই নয়, সাথে নিজেদের মগজও হারিয়ে ফেলেছে। সুস্থ চিন্তা করা ও বুঝার প্রসেস তা তাদের মগজ থেকে উধাও। মোহাম্মদ(সা)-র শিক্ষা কী এবং দুনিয়ার উদ্দেশ্যে কী রেখে গেছেন?- তা তাদের জ্ঞানে নাই। ইসলামিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা, জিহাদের নামে কতল ও যুদ্ধ, নিজের মতের সাথে অমিল হলে মুসলিম-অমুসলিমদের দুনিয়া থেকে বিদায় কর ইত্যাদি জঘন্য উচ্ছৃঙ্খলতার নমুনা। জিহাদ ও ধর্মীয় মতবাদের জ্ঞান কোথা থেকে কে দিচ্ছে, কী উদ্দেশ্যে দিচ্ছে, এই সম্পর্কে কোরআন কী বলছে?- এই সব জানা বা বুঝার প্রয়োজন বোধ করে না। যেখানে মগজ নেই সেখানে বোধ কী করে আসে?

সবলরা দূর্বলদের অন্যায়ভাবে নির্যাতন করবে, বল প্রয়োগে সম্পদ ছিনিয়ে নিবে, নিজেদের চিত্ত বিনোদন ও সেবার জন্য দাসদাসী বানাবে, উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য মানব জীবনকে নিজেদের আনন্দের শিকারে পরিণত করবে, রিপুর তাড়নায় নোংরা আচরণ করবে, সাম্রাজ্য বাড়ানোর নেশায় লক্ষ-কোটি জীবনের প্রান নাশের কারন হবে এবং তার চেয়ে বেশি পরিমান ভুগান্তিতে ডুবাবে, অগণিত সম্পদ ধ্বংস করবে, লুট করবে, ইতিহাস ও ভৌগোলিক সীমানার বিভাজন, মহাসাগর পরিমান অন্তর জ্বালা ও অন্তর শিহরিত লীলার খেলা করবে আর এমনি-এমনি পার পেয়ে যাবে, “বিবেক” তা বলে না। এর বিচার-নিষ্পত্তির আবশ্যিকতা, বিবেক বা কমন সেন্স এড়িয়ে যেতে পারে না। রাজতন্ত্র, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্রের নামে মানব ইতিহাসের সকল শাসক ও শাসক বর্গের কামনা, রিপুর অনুসরণ এবং স্বভাব ও চরিত্র একই। যারা শাসক ও শোষিতদের এক করে, তাদের বিবেকের সাথে চেতনা, বুদ্ধি, অনুভূতি সবকিছুই অকর্মন্য। বিবেককে রিপুর দ্বারা ইচ্ছা করে বা জিদ ধরে কারারুদ্ধ করে রাখলে সেখান থেকে বের হওয়ার বিকল্প পথ থাকে না।

একটি চোখের জটিলতা বোয়িং থেকেও জটিল। এ রকম একটি ডিজাইন ও গঠনের জটিলতা প্রকৃতি এমনি-এমনি নিজ থেকে নিখুঁততার সহিত বানিয়ে ফেলবে, তা “বিবেকের”-র জাল ভেদ করে না। দুনিয়ার সকল প্রানীদের চক্ষুর গঠন, জটিলতা ও বৈচিত্রতার গণনা অসাধ্য। আর ব্রেইনসহ সকল অঙ্গপ্রতঙ্গের অগণিত ত্রুটিমুক্ত, নিখুঁত কার্যাদীর সমন্বয়ে তৈরি “শরীর” নামক এক বিশাল জটিল ও কঠিন সিস্টেম এবং সময়ের সাথে সকল অঙ্গপ্রত্যঙ্গের বৃদ্ধির গোল্ডেন রেশিও উপেক্ষা করে এপেন্ডিক্স বা পুরুষের বুকের স্তনের অপ্রয়োজনীয়তার দোহাই দিয়ে স্রষ্টাবিহীন প্রকৃতি বা ন্যাচারাল সিলেকশানকে আঁকড়ে ধরাকে শুধু “কমন সেন্স”-র অভাব বলা যায় না, সাথে রয়েছে পক্ষপাতিত্ব ও আত্মপ্রতারণা। মানব জাতির বিবর্তনের পূর্বপুরুষের যে দাবী এবং মতবাদ, তার ভিতরের ফাঁক ও অসামঞ্জস্যতা কতটা প্রকট তা সুস্থ চিন্তাধারীরা জানেন। এক অদৃশ্য সর্বশক্তিমান নির্দেশ ব্যতীত সবকিছুই অসম্ভব। একটি কোষের গঠন দুনিয়ার অন্যতম এক জটিল ফ্যাক্টরী। DNA, RNA, প্রোটিন অনু, অ্যমিনো এসিড, জন্ম দেওয়ার সিস্টেম ইত্যাদির মত জটিলতা সৃষ্টিকর্তার হুকুম ছাড়া ডিজাইন এবং উদ্দেশ্যহীন ভাবে তৈরি হয়ে যাবে, বিবেক বা কমন সেন্স তা বলে না। ২০২০-এর হিসাব অনুযায়ী প্রকৃতিতে ৫০০-এর বেশী অ্যমিনো এসিড থেকে আপনা থেকে প্রয়োজনীয় ২২-টি অ্যমিনো এসিডগুলো বাচাই হয়ে প্রোটিন তৈরি, যা দুনিয়ার অন্যতম বড় যাদুবিদ্যা। “দেহ”-র ফাংশান ও কার্যকারীতার লক্ষ্য করলে স্পষ্ট হয়, ইহা মহাবিশ্বের এক মহা কারুশিল্প। যৌনান্দের সহিত অন্তরে প্যারামিটার গুলোর পূর্ণতা না হলে বংশবৃদ্ধি বা প্রানী জগতের অস্তিত্ব থাকত না। যৌনান্দের স্থাপনের কারনের ব্যাখ্যা মানবজাতির ক্ষমতার বাহিরে। আর “প্রান”?- তা অনেক গভীরের বিষয়। মানব সভ্যতা “প্রান”-র নাগাল পাওয়ার ক্ষমতা রাখে না। প্রান এই মহাবিশ্বের কোন বস্তু বা পদার্থ নয় যে অণুবীক্ষণ যন্ত্রের নীচে রেখে সংজ্ঞায়িত বা সীমানা নির্ধারণ করবে। আর প্রান-কে জানার জন্য “প্রান”-র ডাইমেশনে যাওয়ার রাস্তা বা সিস্টেম মানব জাতি কখনও অর্জন করার সামর্থ্য হবে না। কেন সামর্থ্য হবে না- তা একটু পর জানব। অবশ্যই এই মহাবিশ্ব সহ সব কিছুর সীমাবদ্ধতা রয়েছে এবং এই সীমাবদ্ধতার গন্ডি অনু পরিমান বাড়ার ক্ষমতা কারোর নেই। একটি দেহ তৈরির পূর্ণ নির্দেশনা, শৃঙ্খলা, নিখুঁততা, যথাযথ পদ্ধতিতে DNA যে ইনফো ও কার্যকারিতা বহন করে, তাকে প্রকৃতির দোহাই দেয়া অজ্ঞতা ও মূর্খামোর প্রকাশ। “সৃষ্টিকর্তাকে কোন ভাবেই স্বীকার করা যাবে না”- এই জিদ ধরে নিজের অবস্থানকে আঁকড়ে ধরে থাকলে, সেখানে নীরবতা-ই বিদ্বানদের সজ্জ্বা।


PART-B
=========
“আমি” সম্পর্কে অজ্ঞানতা ও উদাসীনতাঃ
“নিজ সত্তা সম্পর্কে অজ্ঞানতার যন্ত্রণা” মানব জাতির বিবেককে স্পর্শ করে না, অন্তরে অনুভব করে না। “কেন করে না”- এই প্রশ্ন জগতের এক বিস্ময়। এই বিস্ময়ের হেতু খুজলে পাওয়া যায় একটি একটি বড় কারন, আর তা হলো “মায়া”। দুনিয়ার প্রতি মায়া। কেহ নিজের “আমি”-কে জানতে চায় না, নিজেকে চিনতে ও বুঝতে আত্মনিয়োগে আগ্রহী হয় না। সকলেই “আমার”-কে কেন্দ্র করে জীবন ধারণ, কর্ম সম্পাদন, চিন্তা, ব্যস্ততা কিন্তু নিজের সত্তা “আমি” থেকে দূরে। আমি-র রহস্য ভেদ করতে খুব কষ্টসাধ্য আবার নিজেকে জানার আত্মনিয়োগে অর্থ-সম্পদ, বিলাসিতা বা দুনিয়ার কোন সুবিধা নগদে অর্জিত হয় না, যা পাওয়ার নেশায় মানব জাতি মৃত্যু অবধি ডুবে থাকে। অট্রেলিকাগুলো মাটির নীচে যেমন শক্ত পিলারের পায়েলিং-র উপর দাঁড়িয়ে থাকে, মানব জাতি কামনার পিলারের কারনে দুনিয়ার দিকে অন্তরকে দাঁড় করিয়ে রাখে। সেই অন্তরের পিলার ভেঙ্গে পবিত্র হওয়া সহজ নয়। রিপুর গোলাম হয়ে থাকার কারনে পবিত্র হওয়ার ইচ্ছাশক্তিকে নিজেই বিলুপ্ত করে দেয়।

“আমি” সত্তা নিজের দর্পণে দেখা সম্ভব হলে, সকলেই ভয়ে সাহস হারিয়ে নিজের সত্তা থেকে পলায়ন করত। কারন, মানুষজন নিজের “আমি”-কে দেখার জন্য নিজেকে কখনও প্রস্তুত করেনি, চিন্তা করেনি। প্রত্যেকে নিজে ও চারপাশের মানুষদের দেখে তুলনা করে স্বস্তি পায়। যেমনঃ কারোর চারটি হাত থাকলে, সে কর্মে আরো দক্ষ এবং জীবন ধারণের জন্য অনেক বেশী সুবিধা পেত কিন্তু দেখতে বেখাপ্পা লাগবে বিধায় চার হাতের অধিকারী হতে চাইবে না। কিন্তু যদি দুনিয়ার সকলের চারটি হাত হলে তখন সানন্দে গ্রহণ করবে। অন্তরের প্যারামিটারের মাধ্যেম ইন্দ্রিয়গুলোকে কাজে লাগিয়ে নিজেকে দুনিয়ামুখী করে রেখেছে কিন্তু ধ্যানের মাধ্যমে এই দুনিয়ামুখী থেকে সরে গিয়ে ইন্দ্রিয়গুলোর উর্ধ্বে উঠে নিজেকে খুঁজে পেতে উৎসাহী হয় না।

স্বভাব/চরিত্র তৈরি হয় “আরামের পাত্র” থেকে। পরে জানব আরামের পাত্র সম্পর্কে। দুনিয়ার মানুষজন এই আরামের পাত্রের দাস। বিবেক, অন্তর, বুদ্ধি সবকিছুই বিকিয়ে বসে এই আরামের পাত্রের কাছে এবং ইহাকে কেন্দ্র করে দুনিয়ার জীবন ধারণ করছে। আরামের পাত্র বিশাল এক গর্ত এবং এর ভিতরে ঢুকলে আর কেহ বের হতে চায় না এবং অধিকাংশরাই পারে না।

“আমি কেমন আছি”- ইহা কেমন করে অন্যকে জিজ্ঞেস করে জানা যাবে? ইহা কি হাস্যস্পদ নয়? নিজের সাথে নিজের আহম্মকি নয় কি? আমি নিজেই “আমি” সম্পর্কে কিছু জানি না। চেষ্টা করা হয়েছে কি কখনও নিজের সম্পর্কে জানতে? নিজের চিন্তাশক্তি তো রয়েছে। নিজের সত্তার প্রশ্ন নিয়ে নিজ বিবেকের সামনে কতবার মুকাবিলা করা হয়েছে? নিজের সাথে নিজে চুরি করলে, পলায়নপর হলে, কিভাবে জানা হবে নিজের “আমি”-কে?

একাগ্রতা ও নীরবতা জরুরী নিজের রহস্য উন্মোচিত এবং নিজেকে জানার উদ্দেশ্যে। রাতের গভীরে শব্দহীন, আলোহীন, মশা-মাছি বিহীন জায়গা নির্বাচন করে চোখ বন্ধ করে সহজ ভাবে বসে নিজের সত্তাকে নিয়ে চিন্তা করা হোক। শরীরের কোথায় “আমি”-র অস্তিত্ব? কোথা থেকে “আমি”-র কর্ম নিয়ন্ত্রিত হয়? ভালবাসা, ক্ষুধা, যৌনতা, রাগ, হিংসা, লোভ, দয়া, ধৈর্য ইত্যাদি কেমন করে “আমি”-কে নিয়ন্ত্রিত করে আবার “আমি” কিভাবে এগুলোকে নিয়ন্ত্রিত করে? আর গুণগুলোর উর্ধ্বে উঠে কিভাবে নিজ সত্তা বা পরম সত্তার সহিত মিলিত হয়? আত্মনিয়োগ করার পরেও যখন কিছুই জানা যায় না তখন অজ্ঞানতার যন্ত্রনা নিজের বিবেককে চেপে ধরে। এই যন্ত্রনা “আমি”-কে জানার রাস্তা তৈরি করে। বুঝতে সক্ষম হয়, জ্ঞানের রাজ্যে নিজ জ্ঞান এতই নগণ্য যে এর অস্তিত্বই নেই। নিজের আত্মশুদ্ধি হয় অহংকারের পতন ও বিনয়ের মাধ্যমে।

আধ্যাত্মিকতাঃ
জটিল বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হচ্ছে যা কারোর সহজে বোধগম্য হবে না। এই বিষয়ে কারো পূর্ব জ্ঞান না থাকলে আধ্যাত্মিকতা সম্পর্কে কিছু বুঝা যায় না। দুনিয়ার সকল ধর্ম, দর্শন, ঋষি, পণ্ডিত, সন্ন্যাস, পীর, আলেম… আধ্যাত্মিকতার স্তরে বৈশিষ্ট্য সমুহ নিয়ে বলেনি, আলোচনা করেনি। উপরের ডাইমেনশন অর্থাৎ “আমি”-র ডাইমেনশনে যাওয়ার দরজা হলো “আধ্যাত্মিকতা”। নীচের ডাইমেনশনের ভাষা, অনুভূতি দিয়ে উপরের ডাইমেনশনকে বর্ণনা বা প্রকাশ করা দূর্বোধ্য এবং বুঝানো কঠিন। এই বিষয়টি কেহ বুঝতে সক্ষম হবে না জেনেও আলোচনা করছি যেন কিছুটা পরিচিতি লাভ করে।

আধ্যাত্মিকতা দুই স্তরের। পরম এবং প্রকৃত। পরম আধ্যাত্মিকতা স্তর হচ্ছে সর্বোচ্চ এবং এই স্তরে পৌঁছাতে পারা আধ্যত্মিকতার সেরা সাফল্য। “আমি” বা “পরম আমি”-র সাক্ষাৎ এখানে। জীবনের সকল রহস্যের কৌতুহলের অবসান এখানে, জ্ঞান পিপাসুদের শেষ সীমানা। এরপর আর কোন সীমানা নাই। পরম আধ্যাত্মিক স্তরে প্রত্যেকে প্রত্যেকের নিজের “আমি”-র সহিত সাক্ষাৎ হয় সরাসরি(শুনতে অদ্ভুত লাগে)। আর এই সাক্ষাত হওয়ার মাধ্যমে যখন কেহ সুপ্রিম জ্ঞান অর্জন করে তখন তাঁর জীবনে অসন্তুষ্টি আর থাকে না। আবার এই সুপ্রিম জ্ঞান অর্জন করে পথভ্রষ্টও হয় অধিক হারে। কারন, সত্য ও সুপ্রিম জ্ঞান এক নয়। আবদ্ধ পাখিদের যেমন মুক্ত আকাশে ছেড়ে দেয়া হলে স্বাধীন ভাবে উড়া শুরু করে তেমনি পরম আধ্যাত্মিক স্তরে বিচরণকারীগণ এই স্তরে পরমানন্দের সহিত স্বাধীনতা পেয়ে উড়তে শুরু করে আর পথভ্রষ্টও হয় ব্যপক হারে।

পথভ্রষ্ট হয় দুটি বড় কারনে। এক. নিজের “আমি”-কে দেখা ও অনুধাবন করার পর সুপ্রিম জ্ঞান অর্জন করে আশপাশের সাধারণ মানুষজন থেকে উপরে উঠে গিয়ে নিজেকে ফেরেশতা বা এরকম কিছু একটা ভাবতে শুরু করে অর্থাৎ তাঁর জ্ঞান অন্য সকল মানুষদের থেকে অতি উচ্চ সুতরাং সে যা মনে করে বা মতবাদ প্রকাশ করবে তাই শুদ্ধ- এই বোধ চেপে ধরে। দুই. প্রকৃত আধ্যাত্মিকতার সংস্পর্শে না আসা। সংসার বিরাগী বা সংসার ধর্ম ছেড়ে বাস্তবতা থেকে বিচ্ছিন্ন হলে, প্রকৃত আধ্যাত্মিকতার জ্ঞানের দরজা সর্বদা বন্ধ থাকে।

প্রকৃত আধ্যাত্মিকতা হচ্ছে তিনটির সমষ্টি। মস্তিষ্ক ও তার প্যারামিটার, অন্তর ও তার প্যারামিটার এবং মন। মানবজাতির সকল কর্ম ও চিন্তা নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে অন্তর ও অন্তরের প্যারামিটার থেকে। অন্তর ও অন্তরের প্যারামিটারগুলোর সাথে এই টাইম ও স্পেস ডাইমেনশনের সাথে সম্পর্ক নেই কিন্তু “দেহ” নামক শরীরের ভিতর আবদ্ধ থেকে “আমি”-কে এই দুনিয়ায় পরিচালিত করছে। “দুনিয়ার আমি” বা “জী-সত্তা” এবং “পরম আমি” বা “পরমাত্মা” এক ডাইমেনশন; “অন্তর ও অন্তরের প্যারামিটার” ও “মন” ভিন্ন আরেক ডাইমেনশন; মস্তিষ্ক হলো “টাইম ও স্পেস”-র ভিন্ন আরেক ডাইমেনশন। এই তিনটি ভিন্ন ডাইমেনশনের জংশন হচ্ছে “দেহ” বা “শরীর”। কাজ ও চিন্তা করার জন্য মস্তিষ্ক কিভাবে অন্তর ও তার প্যারামিটার থেকে নির্দেশ গ্রহণ করে এবং চোখ, নাক, কান, জিহবা, হাত, পা সহ সকল অঙ্গাদি কিভাবে নিয়ন্ত্রিত হয় মস্তিষ্ক থেকে, এই দুই পরিচালিত হওয়ার প্রসেসটা বুঝা ও অনুধাবন করাটাই হলো “প্রকৃত আধ্যাত্মিকতা”। একজন দুনিয়ার ভিতর থেকে দুনিয়ার দায়িত্ব সম্পাদনার সহিত অন্তরের প্যারামিটারগুলোর দ্বারা সেই সম্পাদানগুলো কিভাবে প্রভাবিত হয়, সেই অন্তরের অদৃশ্য জগতকে চিন্তা ও বিবেকের আয়নায় দেখতে পায়। ইহা প্রজ্ঞার উঁচু একটি স্তর।

“সত্য”-কে বুঝতে, জানতে, চিনতে চাইলে পরম ও প্রকৃত আধ্যাত্মিকতা সম্পূর্ণরূপে উপলদ্ধির পর সংসার ধর্মের ভিতরে অবস্থান করে অনুশীলনের মাধ্যমে “চারিত্রিক বিশুদ্ধতা”-কে নিজ স্বভাব ও চরিত্রে প্রতিষ্ঠিত করা। ইহাই ধর্মের সত্যতা। ইহা ছাড়া সত্যকে চিহ্নিত ও নিরূপণ করার আর কোন পদ্ধতি দুনিয়ায় নেই। পরম আধ্যাত্মিকতা সংঘটিত হয় ঘুম ও জাগ্রত এই দুই-র মধ্যবর্তী সময়ে আর প্রকৃত আধ্যাত্মিকতা সংঘটিত হয় বাস্তবতার ভিতর সম্পূর্ণ জাগ্রত অবস্থায়।

পরম আধ্যাত্মিকতাঃ
“পরম আধ্যাত্মিকতার স্তরে পরম সত্তাকে যখন কেহ অবলোকন করে, তখন আশ্চর্য হয়ে নিজেই নিজের “আমি”-কে দেখে এবং দেখতে থাকে। “আমি”-কে বুঝে এবং বুঝার চেষ্টা করে সাথে পরম শান্তি অনুভব করে। আর যখন কোন শ্রোতাকে এই অনুভূতির অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে, শ্রোতা অবাক হয়ে শুনে কিন্তু কিছুই বুঝিতে পারে না”।

ঘুম এবং জাগ্রত এই দু'এর মধ্যবর্তী অবস্থানটি হলো “পরম আধ্যাত্মিকতা”। অর্থাৎ এই স্তরে একজন ঘুমেও থাকে না আবার জাগ্রতও থাকে না। প্রত্যেকে নিদ্রা যায় এবং নিদ্রা থেকে জাগ্রত হয়। নিদ্রা ও জাগ্রত এই দুইয়ের আসা-যাওয়ার সময় দুনিয়ার সকলেই পরম আধ্যাত্মিক স্তর অতিক্রম করে। অল্প সংখ্যক কঠোর সাধকগণ নিজ সাধনায় এই স্তরে নিজেদের ধরে রাখতে সক্ষম হয়। এ সাধনায় কারো তিন মাস লাগে, কারো দশ বছর লাগে আবার কেহ সারাজীবনেও সাধনা করে এই স্তরে পৌঁছাতে পারে না। আবার নগণ্য সংখ্যক বিনা সাধনায় আকস্মিকভাবে এই স্তরে পৌঁছে যায়। যারা আকস্মিকভাবে এই স্তরে পৌঁছে যায় তারা অবর্ণনীয় এক অনুভূতি অনুভব করে এবং বিভ্রান্তিতে পরে থাকে জীবনের পরবর্তী সময়টুকু।

দুনিয়ার সকলে প্রত্যেহ নিদ্রা যাওয়া ও জাগ্রত হওয়ার পথে পরম আধ্যাত্মিক স্তর অতিক্রম করে কিন্তু কেহ পারে না এই স্তরে নিজেকে ধরে রাখতে। কারন ইহা অত্যন্ত কঠিন। কতটা কঠিন? একটি মসৃণ ইস্পাতের টেবিলকে তৈল দ্বারা লেপন করে পিচ্ছিলক করার পর, পা ভাজ করে উপরে বসলে নিজ শরীর স্থিরতায় রাখা কঠিন। পিচ্ছিলতার দরুন শরীর নড়তে থাকবে। যদি তৈলময় টেবিলটিকে ১৫ ডিগ্রী নীচের দিকে এক পার্শ্ব হেলানো হয়, তাহলে? কারো পক্ষে স্থির হয়ে বসা সম্ভব নয়, পিচ্ছিলতার দরুন টেবিল থেকে পরে যাবে। আর যদি ৪৫ ডিগ্রী নীচের দিকে এক পার্শ্ব হেলানো হয়, দুনিয়ার সকলের বুঝে আসবে, এই এঙ্গেলে কারো পক্ষে তৈলময় টেবিলে বসে থাকা সম্ভব না আর ইহাই পরম আধ্যাত্মিকতার স্তর। এ রকম পিচ্ছিলক টেবিলে ৪৫ ডিগ্রী এঙ্গেলে বসে কৌশল রপ্ত করে যে নিজেকে ধরে রাখতে সক্ষম, সে-ই পরম আধ্যাত্মিকতার স্তরে বিচরণ করার ক্ষমতা অর্জণ করে। টেবিলের উদাহারণের মাধ্যমে বুঝাতে পারি, ০ ডিগ্রীতে জাগ্রত, ৯০ ডিগ্রীতে ঘুমন্ত আর ৪৫ ডিগ্রীতে থাকা মানে পরম আধ্যাত্মিক স্তরে। কামনা, দুশ্চিন্তা, যৌনতার খায়েশের চিন্তা, রাগ-বিদ্বেষ-হিংসার বশবর্তী হয়ে কুচিন্তা, জীবনের সাফল্যের চিন্তা, জনমানবের উদ্দেশ্যে কল্যাণের চিন্তা, জ্ঞান ও গবেষণার চিন্তা ইত্যাদি ১ ডিগ্রীর ভিতরে বিরাজমান এবং এই ১ ডিগ্রী জগতের ভিতরে মানব জাতির সকল সুচিন্তা ও কুচিন্তার বিচরণ। ১ ডিগ্রী থেকে উপরে বিচরণ করতে চাইলে দরকার হয় আত্মনিয়োগের সাথে ধ্যান। আর ধ্যানের সর্বশেষ সীমানা ৪৫ ডিগ্রী পর্যন্ত। ডিগ্রীর উদাহারণের মাধ্যমে বিষয়টি সহজ করা। সংসার ত্যাগী, ভিক্ষু, সন্ন্যাস, ঋষি, সূফী আত্মনিয়োগকারীদের মাঝে অল্প সংখ্যাক যারা বিশুদ্ধতার চেষ্টা করে, তাদের সর্বশেষ লক্ষ্য এই আধ্যাত্মিক স্তরে পৌঁছা এবং জীবনের আসল উদ্দেশ্য বলে স্থির করে আর উচ্চ পর্যায়ের পথভ্রষ্টতা এখানেই।

কেহ মিশরে গিয়ে পিরামিড দেখে থাকলে এবং এর বর্ণনা দিতে বললে, সে পিরামিডের আকার, আকৃতি, রঙ, চারপাশের পরিবেশ সহ সকল বৈশিষ্ট্য বলে দিতে পারবে। তেমনি কেহ পরম আধ্যাত্মিক স্তরে বিচরণ করে থাকলে তার বিবরণসহ বৈশিষ্ট্য বলে দিতে পারবে। বৃহত্তর ভারতবর্ষের ঋষি, গুরু, পীর, বাবা ও সাধকগণ এই সব গোপন রাখেন এবং ফালতু আজগুবি, অনৈতিক উপকথার সাথে জিন, ভুতের গল্প-গুজব তৈরি করে সাধারণ মানুষদের বিভ্রান্ত করেছে এবং করছে। আর গোপন রাখার একটা বড় কারন, এরা নিজেরাও পরম আধ্যাত্মিকতা সম্পর্কে জ্ঞান রাখে না।

পরম আধ্যাত্মিকতা স্তরের কিছু বৈশিষ্ট্যঃ
ক) পরম আধ্যাত্মিক স্তরে পৌঁছা মাত্রই দুইটা “আমি” একে অপরের সম্মুখীন হয় এবং বিস্মিত হয়ে নিজে নিজের “আমি”-কে দেখতে থাকে (দেহের দুই চক্ষু ব্যতীত আরেকটি চক্ষু রয়েছে যাকে বলে আধ্যাত্মিক চক্ষু বা থার্ড আই, যার অবস্থান মাঝ কপাল বরাবর বা দুই চক্ষুর মাঝে উপরে। এই চোখের উপস্থিতি শুধু আধ্যাত্মিক স্তরে)। এই দুই “আমি”-র, একটি হচ্ছে “বর্তমান আমি বা দুনিয়ার আমি”, অপরটি “পরম আমি বা পরম সত্তা বা পরমাত্মা”। দুনিয়ার “আমি”-কে বলা হয় “জী-সত্তা” বা “জীবাত্মা”। “পরম আমি বা পরম সত্তা” থেকে একটা নুরের শক্তি যা জী-সত্তা নামে জ্ঞাত তা মস্তিষ্কে অবস্থান এবং পরিচালিত করে যার কারনে এই দুনিয়ায় “আমি” জীবিত। মস্তিষ্কের সকল কার্যকারিতা অস্তিত্ব নির্ভর করে জী-সত্তার উপর। বুঝার উদ্দেশ্যে, মস্তিষ্ক হচ্ছে বৈদ্যুতিক বাতি আর জী-সত্তা হচ্ছে বিদ্যুৎ। আর “পরম আমি” সম্পর্কে কিছুই জানা যায় না বা জানার উপায় নাই। “পরম আমি”-র সামনে “বর্তমান আমি(জী-সত্তা)” যখন মুখোমুখি হয় তখন “দুনিয়ার আমি বা জী-সত্তা” বুঝতে সক্ষম হয় নিজ সত্তা যা মস্তিষ্কে বিরাজ করছে তা “পরম আমি”-র একটি কপি। জাগ্রত অবস্থায় দুনিয়ায় অবস্থানরত “আমি”-কে কেহ বুঝেতে পারে না, কারন উপরের ডাইমেনশনের কোন কিছুকে দুনিয়া(টাইম ও স্পেস) থেকে বুঝা সম্ভব নয়। “আমি”-র একটি অংশ জী-সত্তাকে বুঝতে যে চিন্তা ও অনুভূতির দরকার তা মানব জাতিকে দেওয়া হয়নি আর তার উপর শক্তিশালী পর্দা অন্তর ও তার প্যারামিটার দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়েছে।

একটি উদাহরণ আনা যায় উপরের কথাগুলোর বুঝার সুবিধার্থে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে একজন নিজের “আমি”-কে দেখে। তখন দুইটা “আমি” তৈরি হয় একটা আসল আমি আয়নার বাহিরে, অপরটি আসলটির কপি আয়নার ভিতরে। আয়নার ভিতরে তৈরি হওয়া কপি “আমি” বুঝেতে পারে না সে নকল, সে একটি প্রতিবিম্ব ছাড়া কিছু না। বাহিরের “আমি” যা করে, আয়নায় তৈরি হওয়া কপি “আমি” তাই করে। কিন্তু পরম আধ্যাত্মিক স্তরে যখন দুই “আমি” সামনাসামনি আসে তখন “দুনিয়ার আমি” বা “জী-সত্তা” বা “জীবাত্মা” বা “মস্তিষ্ক” বুঝে ফেলে সে নিজেই নকল এবং সে ঐ আসল “পরম আমি” বা “পরমাত্মার”-র একটি কপি। অর্থাৎ “দুনিয়ার আমি”-র পুরো অস্তিত্ব বা উৎস হচ্ছে “পরম আমি”। কিন্তু জাগ্রত অবস্থায় জী-সত্তা যে কপি বা নকল অর্থাৎ নিজের অস্তিত্বকে অনুধাবন করার বুঝ থাকে না।

খ) “আমি” দেহ নামক পোশাকের ভিতর বিদ্যমান তার অনুভূতি আধ্যাত্মিক স্তরে থাকে না। অর্থাৎ "আমি" শরীর থেকে পৃথক হয়ে যায়। এই হাত-পা-মাথার শরীরের অস্তিত্ব বা অনুভূতি আধ্যাত্মিক স্তরে নেই।

গ) দুনিয়াতে সবকিছু “আমার” কিন্তু “আমি” নাই আর আধ্যাত্মিক স্তরে সবকিছুই “আমি” এবং “আমার” বলে কিছু নেই। ইহা ভাল করে বুঝে লও।

ঘ) পরম আধ্যাত্মিক স্তরের সহিত টাইম ও স্পেস ডাইমেনশনের কোন সম্পর্ক নেই। এই স্তরে যে কেহ নিজেকে আবিষ্কার করবে মহাবিশ্বের বাহিরে এক ভিন্ন ডাইমেনশনে।

ঙ) টাইম ও স্পেস ডাইমেনশনের এই মহাবিশ্ব আধ্যাত্মিক জগতের ভিতরের অতি ক্ষুদ্র একটি অংশ মাত্র। মহাবিশ্বের অবস্থান ধর্মের অধীনে কিন্তু ধর্ম মহাবিশ্বের অধীনে নয়। ধর্মের সহিত বিজ্ঞানের তুলনা করা যায় না এবং উচিত না।

চ) পরম সত্তা বা পরম আমি-র আকার ও রঙ নেই।

ছ) মানব জাতির ডাইমেনশন থেকে জীন জাতি ও ফেরেশতাদের ডাইমেনশন ভিন্ন। বাস্তবে এদের কখনও দেখা যায় না, এদের অস্তিত্ব প্রমাণ করা যায় না। আধ্যাত্মিক স্তরে জীন, ফেরেশতা, মানবদের মত পৃথক জাতি তৈরি করা সহজ আর এদের মত অগণিত ডাইমেনশন তৈরি করে আলাদা আলাদা জাতি তৈরি দেওয়া সম্ভব দুই “আমি”-র মাঝখানে। একমাত্র অদৃশ্য মহান শক্তিই ইহা করতে পারেন। তাঁর দ্বারা সবই সম্ভব তিনি যেমনটি চান।

জ) পরম আধ্যাত্মিক স্তরে “পরম শান্তি” আমি-র সাথে এমন ভাবে বিরাজ করে যে কাউকে সারা বিশ্বের সমস্ত সম্পদ, প্রখর যৌন শক্তির সহিত দুনিয়ার সকল সুন্দরীদের বৈধ করে, দুনিয়ার রাজত্ব, প্রচুর সন্তানের পিতা করে দেওয়া হয় তবুও সে কিছুই গ্রহণ করবে না; “পরম সত্তা”-র সান্নিধ্যে থাকতে পছন্দ করবে। দুনিয়ার সব কিছু দেওয়ার পরেও, দুনিয়ায় জীবনে ফিরে আসতে চাইবে না, এর কারন “পরম শান্তি”। যারা পূর্ব জ্ঞান ছাড়া আকস্মিক ভাবে আধ্যাত্মিক স্তরে উপস্থিত হয় তারা সারাজীবন এক অলীক স্বপ্নে বিভোর থাকে, এদের অনেকে উন্মাদও হয়ে যায় শুধুমাত্র এই “পরম শান্তি”-র অনুভূতির কারনে।

ঝ) পরম অধ্যাত্মিক স্তরে "মন"-র যেমন অস্তিত্ব থাকে না, তেমনি দয়া, মায়া, ভালবাসা, রাগ, লোভ, কাম ইত্যাদি অন্তরের প্যারামিটার গুলো সক্রিয় থাকে না, অনেকটাই নিস্তেজ। প্যারামিটার গুলো অনুপস্থিতি বা নিস্তেজ থাকে বলেই আধ্যাত্মিক স্তরে "পরম শান্তি" অনুভূত হয়। পরম শান্তি অনুভূত হওয়ার একটি কারন, প্রথমত দেহের ওজন থেকে বিচ্ছিন্ন তারপর অন্তরের প্যারামিটারের ওজন থেকে বিচ্ছিন্ন। সেখানে শুধু “আমি”।

ঞ) পরম আধ্যাত্মিক স্তর থেকে দুনিয়ায় ফিরে এলে একজন নিজেকে আবিষ্কার করে এক ভিন্ন রকম। ইহা স্বপ্ন বা অলীক কল্পনা নয়। জাগ্রত অবস্থায় দিনের বেলায় সূর্য বা মেঘমুক্ত আকাশে পূর্ণিমার রাতে চাঁদ দেখলে যে অনুভূতি হয় তার চেয়েও প্রখর বোধ থাকে আধ্যাত্মিক স্তরে। কারো সঙ্গে এই অভিজ্ঞতা শেয়ার করা যায় না কারন শ্রোতাগন বুঝতে অক্ষম। আধ্যাত্মিক জগতে বিচরণকারী নিশ্চিত রূপে জানে তার অভিজ্ঞতা প্রকাশ করলে চারপাশের সকলে তাকে "মস্তিষ্ক বিকৃতি" বা “পাগল” বলা শুরু করবে।

আরো কিছু বৈশিষ্ট্য সংযোজন করা যায় কিন্তু কঠিনত্বের দিকে আর আগ্রসর না হই। আর পরম আধ্যাত্মিকতা, পরমাত্মা, জী-সত্তার রহস্য সাধারণ মানুষজন পক্ষে বুঝা সাধ্যাতীত। আধ্যাত্মিকতার জটিল আলোচনার দিকে ধাবিত না হই আর ইহা গোপন থাকাই শ্রেয়। আর “পরম আমি”-কে যারা খোদা, ইশ্বর, ভগবান, নবী মোহাম্মাদ, জিসাস, ইব্রাহীম, মুসি, কৃষ্ণ বা কোন ব্যক্তি বিশেষ ইত্যাদির দাবী করে, তারা মিথ্যা বিভ্রান্তিতে লিপ্ত এবং এদের অধিকাংশই বিপথগামী ও মিথ্যুক। যারা নিজ সাধনায় পরম আধ্যাত্মিক স্তরে বিচরণ করেছেন, তাদের উচিত নীরবতা অবলম্বন করা। গুরু-শিষ্যের সম্পর্ক একটি উন্মাদনা এবং বর্তমানে ইহা একটি জনপ্রিয় ব্যবসা। গুরুরা তাদের অনুসারীদের পরম আধ্যাত্মিকতার রাস্তা দেখান এবং পরিচালিত করেন ভুল পথে যার কারনে বিভ্রান্তির সৃষ্টি। যে সম্পর্কে স্বচ্ছ জ্ঞান নেই, তার সাথে নিজের মনগড়া মতবাদ মিশিয়ে জনসাধারণদের বিভ্রান্তির দিকে ঠেলে ধর্মীয় উন্মাদনায় প্রবেশ এবং বিপথগামী করা উচিত নহে।

“আমি” শুধু মহাবিস্ময়-ই নয়, ইহা পবিত্রতা ও সৌন্দর্যতার সর্বোচ্চতা। এই সৌন্দর্যতার স্বাদ যারা আস্বাদন করতে সামর্থ্য হয়েছে তারা দুনিয়ার সকল প্রকারের মোহ ও আসক্তি থেকে নিজেদের মুক্ত করার ক্ষমতা অর্জন করতে পেরেছে। বৈদিক অনুসারী, ঋষি, সন্ন্যাসী ও বৌদ্ধ অনুসারীদের সীমানা এই সৌন্দর্য পর্যন্ত আর খোদাপ্রেমী মুমিনদের যাত্রা এই সৌন্দর্য থেকে শুরু।

প্রকৃত আধ্যাত্মিকতাঃ

প্রকৃত আধ্যাত্মিকতা মস্তিষ্ক ও মস্তিষ্কের প্যারামিটার, অন্তর ও অন্তরের প্যারামিটার এবং মনের সত্তাগত অবস্থান ও সমষ্টিগত কাজের ধারাবাহিকতা। মানবজাতির সকল কর্ম ও চিন্তার কারনের উৎস অন্তরের প্যারামিটার। প্যারামিটারগুলো প্রতিক্রিয়া ঘটায় অন্তরে এবং অন্তর মনের মাধ্যমে মস্তিষ্কে প্রেরণ করে জীবন নির্বাহের জন্য সম্পাদান ও নিষ্পত্তির উদ্দেশ্যে।

অন্তরঃ

পরম আধ্যাত্মিক স্তরে সাধনার বলে গমন করা যায় এবং এর কিছু বৈশিষ্ট্য প্রকাশ করা যায় কিন্তু প্রকৃত আধ্যাত্মিক স্তর সম্পর্কে মন্তব্য করা যায় না। অন্তরের অনুধাবন বা বৈশিষ্ট্য প্রকাশ করার কোন মাধ্যম দুনিয়াতে নেই। অন্তর এমনই দূর্বোধ্য যে, দুনিয়ার কোন মনিষী “অন্তর” সম্পর্কে মন্তব্য করার সাহস করেননি। ধৈর্য; শুধুমাত্র ধৈর্য অন্তরের ভিতরে প্রবেশ করে অন্তরের রূপের বৈচিত্র ও বৈচিত্রের স্বাদ আস্বাদন করতে পারে। অন্তরের অন্যান্য প্যারামিটারদের ধৈর্যের মত প্রভাব ও ক্ষমতা দেওয়া হয়নি।

পরম সত্তা, “বর্তমান(দুনিয়া) আমি”-র উৎস। পরম আধ্যাত্মিকতার স্তরে পরম সত্তার অতি ক্ষুদ্র ভগ্নাংশ দেখা গেলেও এর রহস্য এবং উৎস জানা কারো পক্ষে সম্ভব নয়। পরম সত্তা থেকে নির্গত একটি নূরের শক্তি, "জী-সত্তা” নামে জ্ঞাত যা আমাদের মস্তিষ্কে অবস্থান করে মস্তিষ্ককে পরিচালিত করে আর এই জী-সত্তাই হচ্ছে “আমি” বা “দুনিয়ার আমি”। মস্তিষ্ককে “আমি” বা মস্তিষ্কের ক্রিয়াকলাপকে “আমি” মনে করাটা সম্পূর্ণ ভুল আর এই ভুলটি দুনিয়ার প্রায় সকল মানুষ করে থাকে। “মস্তিষ্ক” হচ্ছে আমার কিন্তু আমি নই। মস্তিষ্কের সকল রাসায়নিক ক্রিয়াকলাপ করায় জী-সত্তা এবং অন্তর। আবার এই জী–সত্তা একাকী নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে পারে না, কার্য পরিচালনার জন্য ভিত্তির প্রয়োজন হয়; আর সেই ভিত্তি হলো “অন্তর”। অন্তরের উপর দাঁড়িয়ে জী–সত্তা মস্তিষ্ককে ব্যবহার করে তার আপন কার্য পরিচালনা করে। দেখছি, কথা বলছি, কাজ করছি, চিন্তা করছি, জৈবিক প্রয়োজন মিটাচ্ছি ইত্যাদি সবকিছু করছি অন্তরের নির্দেশে মস্তিষ্কের (জী-সত্তা)-র দ্বারা। অন্তরই ইহ–জীবনের আধার। অন্তরকে ধরা বা বুঝার উপায় নেই। কারন, শ্বাসপ্রশ্বাসের সাথে হৃদপিণ্ডের সংকোচন-প্রসারণের মাধ্যমে অন্তরকে আড়াল করে ফেলা হয়েছে। জী-সত্তা(মস্তিষ্ক), অন্তর থেকে সমস্ত কাজের নির্দেশ গ্রহণ করে আবার অন্তরকেও নিয়ন্ত্রণ করে জী-সত্তা(মস্তিষ্ক)। ঘুমের সময়ে জী-সত্তা বিন্যস্ত হয় আরো জটিল ভাবে। জী-সত্তা(মস্তিষ্ক) যখন অন্তরের সংস্রব ছাড়ে তখন ঘুমের স্তরে আবার অন্তরের সংস্রবে আসা মাত্রই জাগ্রত অর্থাৎ দুনিয়ার জীবনের ফিরে আসে। জী-সত্তা(মস্তিষ্ক), অন্তরের সংস্রবে আসা-যাওয়ার যাকে যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করে, তা হচ্ছে “মন”। জী–সত্তা(মস্তিষ্ক)-র অন্যতম শক্তিশালী গুণ হলো বুদ্ধি আর অন্য গুণগুলো হলো চিন্তা, খেয়াল, কল্পনা, স্মৃতি এবং ধ্যান। সততা, লজ্জ্বাশীলতা, মানবিকতা, খেয়াল, জগতের সত্যমিথ্যা, ভালমন্দ, কল্যাণ-অকল্যাণ সবকিছুর সমন্বয়ে তৈরি হয় “বিবেক”। গুণ একাকী বিরাজ করতে পারে না, গুণ থাকে গুণাধারে। ভালবাসা, দয়া, মায়া, ক্রোধ, লোভ, কাম, ঘৃণা, অহংকার, হিংসা ইত্যাদি গুণ বা প্যারামিটারগুলো থাকে গুণাধারে, আর সেই গুণাধার হলো অন্তর। “বিবেক” জী-সত্তা(মস্তিষ্ক) ও অন্তরের প্যারামিটারের সমন্বয়ে তৈরি মানব জাতির এক সর্বোৎকৃষ্ট ফসল এবং মহাবিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ আর এই বিবেকের জন্যই মানব জাতি সৃষ্টির সেরা। এই মহাবিশ্ব ডায়মন্ড দিয়ে মুড়িয়ে দিলেও “বিবেক”-র মূল্যের সমতুল্য হবে না।

ধৈর্যশীল বা বেপরোয়া? ইতিহাসে সুখ্যাত বা কুখ্যাত? নাস্তিক বা আস্তিক? শিক্ষিত কিংবা মুর্খ? প্রজ্ঞাবান অথবা নির্বোধ? দয়াবান বা যুদ্ধাবাজ? হিংসুক-লোভী বা মানব কল্যাণে আত্মদানকারী… মানব জাতির সকল কর্ম, চিন্তা, ব্যক্তিত্ব, মনমানসিকতা পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত হয় “অন্তর” থেকে অন্তরের প্যারামিটারের মাধ্যমে। মানবজাতির প্রত্যেকের কর্ম অন্তরের গণ্ডির ভিতর আবদ্ধ এবং অনু পরিমান অতিক্রম করার ক্ষমতা কারোর নেই।

অন্তরের ভিতর প্রবেশ করে অন্তরের প্যারামিটারগুলোর মাধ্যমে নিজ কর্ম ও চিন্তা সংঘটিত হওয়ার কারন যখন দেখা ও পর্যবেক্ষণ করা শুরু করে এবং একই প্রক্রিয়ায় চারপাশের মানুষদের অন্তর অনুধাবন করে তাদের কর্ম-চিন্তার উৎস এবং উৎসের কারন পর্যবেক্ষণ করে তখন দুনিয়া ও দুনিয়া সৃষ্টির রহস্য ও সত্য উন্মোচিত হওয়া শুরু হয়। আর এই ক্ষমতা অর্জনই প্রকৃত দার্শনিক(Philosopher), আলেম, পীরদের প্রধান গুণ এবং আসল প্রজ্ঞাবান ও বিচক্ষণতার পরিচয়। নিজ অন্তরের ভিতর প্রবেশ করতে সামর্থ্য হওয়া একটি বড় সাফল্য আর এই প্রবেশ করার মাধ্যমেই প্রকাশ হয়, কে প্রকৃত আধ্যাত্মিক স্তরে বিচরণ করার ক্ষমতা রাখে, কে নিজের “আমি”-কে জানার ও চিনার যোগ্যতা অর্জন করার সামর্থ্য রাখে।

মনঃ

“মন” হচ্ছে একটি টানেল যার এক প্রান্তে জী-সত্তা(মস্তিস্ক) এবং অন্য প্রান্তে অন্তর। অন্তরের প্যারামিটারগুলো মনের এই টানেলের ভিতর প্রবাহিত হয়ে জী-সত্তা(মস্তিষ্ক)-কে চালিত করে কর্ম, চিন্তা নিয়ন্ত্রণ করে, ইহা “অবচেতন মন” আবার জী-সত্তা(মস্তিষ্ক) তার প্যারামিটার টানেলে প্রবাহিত অন্তরের প্যারামিটারদের লাগাম টেনে ধরে কর্ম ও চিন্তার জগত নিয়ন্ত্রণ করে আর তা হচ্ছে “চেতন মন”। “অবচেতন মন” স্বভাব তৈরীর আরামের পাত্রের সহিত সরাসরি সম্পর্কিত। চেতন মনের উৎস বিবেক, বুদ্ধি, খেয়াল, ধ্যান, স্মৃতি আর অবচেতন মনের উৎস অন্তরের আরামের পাত্র। চেতন ও অবচেতনের দুই পক্ষের হাঙ্গামা ও যুদ্ধ চলতে থাকে জন্ম থেকে মৃত্যু অবধি আর এই প্রক্রিয়া “স্বভাব” তৈরিতে মুখ্য ভূমিকা রাখে। সুন্দরীদের প্রতি দৃষ্টি নিক্ষেপের আকর্ষণের তীর বয়স্কদের চেয়ে যুবকরা অত্যন্ত ক্ষিপ্র ও তেজী। কেহ কাম প্যারামিটার জাগ্রত করে আকর্ষনীয় রমনীকে চিন্তাশক্তির মাধ্যমে অন্তরেকে আরামের পাত্রে ডুবিয়ে রেখে যৌনতার খায়েশের মজার ভিতরে মজে থাকে আবার কেহ মস্তিষ্কের প্যারামিটার “বিবেক” দিয়ে কাম প্যারামিটারকে নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে বা নিস্তেজ করে আরামের পাত্র থেকে নিজেকে সরিয়ে অন্তরকে পবিত্র রাখে। আর এই সরিয়ে রাখার যে শক্তি প্রয়োগ করা হয়, সেই শক্তিকে ইসলামের ভাষায় বলে “জিহাদ”। রুচীবোধ যারটা যেমন এবং জীবনের এরকম অগণিত ঘটনার দ্বারা সকলেই নিজে নিজের স্বভাব তৈরি করছে। আরামের পাত্র, মস্তিষ্ককে গোলাম বানিয়ে কর্ম ও চিন্তার মাধ্যমে খেয়ালখুশির জগতে বিচরণ করার প্রক্রিয়াটি ইসলামের দৃষ্টিতে “নফস” হিসেবে চিহ্নিত। মৃত্যু অবধি অগণিত ঘটনাগুলোর উপরে বর্নিত একটি উপমা মাত্র।

ঘুমের সময় জী-সত্তা, অন্তর, মনের প্রয়াণ ঘটে কিন্তু এদের প্রভা(ছায়া) দেহের ভিতর থেকে যায় আর মনের এই অবস্থাকে বলে “অচেতন মন”। প্রভা(ছায়া) যখন বিদায় নেয় তখন “মৃত্যু” হয়।

স্বভাব বা চরিত্র গঠনঃ

স্বভাব বা চরিত্র বুঝতে গেলে অন্তরের প্যারামিটারগুলোর ওজন বুঝতে হবে। তাজমহলের ওজন আর পিতার কোলে পুত্রের লাশের ওজন, এই দুই ওজন দুই ভিন্ন জগতের। শিশুকে একটা খেলনা দিলে আনন্দের যে প্রশান্তিময় হাঁসি তার চেহারায় ফুটে উঠে, একজন প্রাপ্ত বয়স্ককে দুনিয়ার সকল অর্থ-সম্পদ ও ক্ষমতা দান করলেও শিশুর মত আনন্দের হাঁসি তার চেহারায় আসবে না কারন অন্তরের প্যারামিটারগুলোর ওজনের দ্বারা বাধাপ্রাপ্ত। বিদ্বেষের ওজন রাগের ওজনের চেয়ে বেশি। স্বাভাবিক লোভের ওজনের চেয়ে অনেক বেশী ওজন সেই লোভের যাতে মিশ্রিত থাকে অর্থের আধিক্য, কামনা ও ক্ষমতা। একই রকম হিংসার ক্ষেত্রে। আর দানব ওজনের হয়ে সবচেয়ে বেশী ব্যপকতা নিয়ে বিরাজ করে “অহংকার”। উল্লেখিত প্যারামিটারগুলোর ওজন এবং দয়া, ভালবাসা, ত্যাগ, লজ্জাশীলতা ইত্যাদি অর্থাৎ পজিটিভ প্যারামিটারগুলোর ওজন একই অন্তরে অবস্থান নিলেও পর্দা দ্বারা পৃথক।

জন্মের সময় শিশুর অন্তর থাকে চারাগাছ। জন্মের পর “অন্তর” নামক চারা গাছটি সকল প্রবৃত্তির প্যারামিটারগুলোকে ডালপালা বানিয়ে বেড়ে উঠে। ছেলেমেয়েরা বয়ঃসন্ধিতে অন্তরের প্যারামিটারগুলো পরিপূর্ণতা লাভ পায়। জন্ম থেকে বয়ঃসন্ধি পর্যন্ত স্বভাব গঠনের ভিত্তি তৈরি আর অধিক সংখ্যক সন্তানদের সঠিকতা ও বিপথগামীতা নির্ভর করে “বয়ঃসন্ধির সময়”। কে কিভাবে প্যারামিটার ব্যবহার করছে তার উপর। “কৌতুহল” এবং “আকর্ষন” এই দুই প্যারামিটার কিভাবে শিশুরা খেলার ছলে ব্যবহার করে বড় হয়, তা লক্ষ্য রাখা জরুরী কারন ইহাতে আরামের পাত্রের মাধ্যমে স্বভাব তৈরিতে বড় ভূমিকা রাখে। অন্তর অত্যন্ত শক্তিশালী, মজবুত এবং বেপরোয়া। সে তার আপন গতিতে চলতে পছন্দ করে আর তার কাজই হলো মজা লাগানো এবং আরামে থাকা। স্থান-কাল-পাত্র ভেদে প্যারামিটারগুলোর ওজন, বিবেক, বুদ্ধি ইত্যাদির দ্বারা অন্তর তার নিজ আরামের ও আয়েশের জন্য নিজের ভিতরেই বাসস্থানের জন্য “পাত্র” তৈরি করে। জন্ম থেকে কর্ম রেকর্ড হতে থাকে এবং এই পাত্রে জমা হতে থাকে। পাত্রে এই জমা হওয়া রেকর্ড বা নথি পরবর্তীতে “অবচেতন মন”-র দ্বারা কর্মের উপর প্রভাব বিস্তার করা শুরু করে। এই পাত্র হচ্ছে “আরামের পাত্র”। আসক্তির মাধ্যমে এই আরামের পাত্রে সকলেই মজে থাকে এবং এই অন্তরের আরামের পাত্র থেকে বের হতে চায় না এবং অধিকাংশ পারে না। মোবাইলে আসক্তি, মাদকে আসক্তি, যৌনতার আসক্তি ইত্যাদির বিভিন্ন আসক্তি এবং খেয়ালখুশীর কারনে অন্তর তার নিজের ভিতর তৈরি এই আরামের পাত্র থেকে বের হতে পারে না। এই আরামের পাত্র একটি ব্ল্যাকহোলের অভিকর্ষ বলের ন্যায়। সময়ের সাথে এই পাত্র থেকেই প্রত্যেকের কর্মকে নিয়ন্ত্রণ শুরু হয় আর এই পাত্রই হচ্ছে “স্বভাব বা চরিত্র”। দুনিয়ার কারো স্বভাব বা চরিত্র অপরজনের সাথে মিলে না, কারন সকলের পাত্র ভিন্ন। দুনিয়ার প্রত্যেক পুরুষ এবং মহিলা তাদের নিজ নিজ জীবনসঙ্গী/সঙ্গিনীর পাত্র সবচেয়ে বেশি চিনে, জানে এবং পরিচিত। এই জন্য একজন পুরুষের স্বভাবের পক্ষে ও বিপক্ষে সকলের সনদের চেয়েও শক্তিশালী স্ত্রীর সনদ।

জন্ম থেকে অন্তরের বাসস্থান আরামের পাত্র থেকে স্বভাব তৈরি শুরু হওয়ার পর থেকে বয়ঃসন্ধির পরবর্তী সময়ে “আরামের পাত্র” কঠিন থেকে কঠিনতর পরিপক্ষ হতে থাকে। “আরামের পাত্র” আবেগ-বিবেক, ভাল-মন্দ, সত্য-মিথ্যা পরোয়া করে না, সে আরামেই থাকবে আর ইহাই তার দৃঢ় সংকল্প। মস্তিষ্ককে সর্বদা গোলাম বানিয়ে আরামের পাত্র নিজেকে অত্যন্ত শক্তিশালী, ধারালো করে এবং অন্তরের বিস্তীর্ণ জায়গা জুড়ে নিবাস গড়ে তুলে যা নিয়ন্ত্রণ করা যে কারো পক্ষে সাধ্যাতীত। “আমি” সত্তা নিজেই এক আশ্চর্যময় আর এই “আমি”-র ভিতরে অন্তর, অন্তরের প্যারামিটার, অন্তরে আরামের পাত্র আরো আশ্চর্যময়।

স্বভাব অন্তরে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেলে, তার পরিবর্তন অতীব কষ্টসাধ্য। সরলভাবে বলা হলে, স্বভাব পরিবর্তন করার সামর্থ্য রাখেন ধৈর্যশীল ও বিনয়ী অন্তরধারীগণ। আবার কেহ পরিস্থিতির শিকার হয়ে জিদ ধরে স্বভাব পরিবর্তন করে। আর সাধারণদের মাঝে স্বভাব পরিবর্তনের সম্ভাবনা যারা পরিবর্তিত হতে আকুলতা অনুভব করে। অবজ্ঞা, অবহেলা কিংবা আচরণের ব্যক্তিত্ব বা অর্থকষ্ট অন্তরে আত্মগ্লানি তৈরি হলে পরিবর্তনের আকুলতা অনুভূত হয় এবং স্বভাব পরিবর্তনে সামর্থ্য হয়। যার যেমন রুচিশীলতা। ‘ধূমপান’ রক্তের সাথে মিশে অন্তরে অস্থিরতার কম্পন সাময়িক কমিয়ে দিতে সক্ষম হলেও, বিপদ বা বাস্তবতার জটিলতা এড়ানো যায় না, সমাধানও হয় না। দুশ্চিন্তার বিষ অন্তরকে আঁকড়ে ধরলে, সেই অস্থিরতা থেকে বাঁচার জন্য ধূমপান একটা বিকল্প সমাধান হিসেবে গ্রহণ করে আবার কেহ চিৎকার, হাতের কাছের জিনিষ ভাঙ্গাভাঙ্গি বা বদমেজাজী হয়ে আত্মপ্রকাশ করার মাধ্যমে অধৈর্য হয়ে উঠে। ধূমপান, দেহের ক্ষতিকর প্রভাব হিসাব-নিকাশ বিবেকের সামনে রেখে চিন্তায় মশগুল হলে, বিবেক ধূমপানের অনিষ্টকে চিহ্নিত ও নিশ্চিত করলে, ধূমপান ত্যাগ করার দৃঢ়তা শক্তিশালী হয়ে উঠে। দৃঢ়তা, ধূমপানের প্রভুশক্তির প্রভাব বিস্তার করতে বাঁধা সৃষ্টি করে। ধূমপান ত্যাগ করা সহজ হয়। জীবনের সকল প্রকার আসক্তি, বদগুণ, কুস্বভাব বিলুপ্ত করার পদ্ধতি হলো, চিন্তাশক্তির ভিতর সানন্দে নিবিষ্ট হয়ে নিজ বিবেকের সহিত নিষ্পত্তি করার উদ্দেশ্যে আত্মনিয়োগের সহিত নিজের বোঝাপড়া করা।


PART-C
=======
উত্তম চরিত্র বা সিরাতা’ল মুসতাকি’মঃ

অন্তর জ্বালা; চুল্লির ভিতর আগুন যেভাবে জ্বলতে থাকে, অন্তরও সর্বদা জ্বলতে থাকে যখন সদ গুণগুলো আচরণ ও কর্মে প্রকাশ হয়। সেই জ্বালাময়ী আগুনকে নিজ স্বভাবের ধৈর্য ও বিনয়ের দ্বারা প্রতিহত করাই হচ্ছে “উত্তম চরিত্র”। এর সাথে যোগ হবে জগতের ভাল-মন্দ, কল্যাণ-অকল্যাণ, সত্য-মিথ্যা চিহ্নিত করার সুস্থ বিবেকবোধ। আর সুস্থ বিবেকবোধের জন্য নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করা জরুরী আর নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে চাইলে অন্তরকে স্থিরতায় এবং মনের টানেলে প্রবাহিত প্যারামিটারদের দমন করা লাগে। চেতন মন বিবেক ও বুদ্ধির দ্বারা বিক্ষিপ্ত হয় শৃঙ্খলার সহিত এবং নিয়ন্ত্রিত হয় সরল ভাবে আর অবচেতন মন লাগামহীন বিক্ষিপ্ত হয়ে খেয়ালখুশির জগতে উড়তে থাকে এবং একে নিয়ন্ত্রণে আনা কঠিন। সময়ের ব্যবধানে অবচেতন মন কখনও পাগলা ঘোড়া বা বন্য কুকুর যাদের স্থিরতা নেই; আবার কখনও গোখরা যা সর্বদা দংশন করতে থাকে। “আমি” নিয়ন্ত্রিত হবে চেতন মন থেকে কিন্তু যদি অবচেতন মন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়, তবে গণ্ডগোল শুরু হবে।

অল্প সংখ্যক প্যারামিটারের সংক্ষিপ্ত আলোকপাতঃ
সত্যবাদিতাঃ
“সত্যবাদিতা” মানব চরিত্রের গুণাবলীর উচ্ছ্বসনে অধিষ্ঠিত। কোন ঘটনা বা বিষয় বা কোন কিছুর বর্ণনা সঠিক ভাবে প্রকাশ করা হয় তবে তাকে সত্য বলে বিবেচিত আর এই প্রকাশ করাটাই হচ্ছে সত্যবাদিতা। “সত্যবাদী” হতে হলে অন্তরে, চিন্তা-চেতনায়, কর্মে ও কথায় সমভাবে সত্যতা অবলম্বন করতে হয়। “সর্বদা সত্য কথা বলা” একজন মানবকে পুরো জাতির মধ্যে মহৎ ও সম্মানী করে তুলে। একজন সত্যবাদী “অনন্য সাধারণ” হিসেবে দেশ ও জাতির কাছে স্বীকৃত। একজনের বিশ্বস্ততা, নির্ভরশীলতা ও গ্রহণযোগ্যতা তৈরি হয় “সত্যবাদিতা” থেকে। কেহ “সত্যবাদিতা” অনুশীলনের দ্বারা নিজ স্বভাব ও চরিত্র প্রতিষ্ঠিত করলে, অনুধাবন করতে সামর্থ্য হয় শতভাগ চারিত্রিক বিশুদ্ধতার সহিত সত্য কথা বললে জীবন নির্বাহের স্বাদ কেমন হয়। নিশ্চয়ই এই জ্ঞান অর্জণ সকল জ্ঞানের মাঝে অতি উচ্চ মর্যাদা সম্পন্ন ও পবিত্র। “অনুশীলন ছাড়া এই জ্ঞান অর্জন করার আর কোন পথ খোলা নেই”। একজন সত্যবাদী অপর সত্যবাদীর কথা ও কর্মকে হৃদয়ঙ্গমের মাধ্যমে বিচার করার যোগ্যতা অর্জনে সামর্থ্য হয়। “একজন সত্যবাদীর পক্ষে মিথ্যে বলা সবচেয়ে কঠিন”- এই বুঝটুকু বুঝা খুবই গুরুত্ব। উত্তম চরিত্রবান বা সিরাতা’ল মুসতাকি’-মের অধিকারীকে সর্বপ্রথম এই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হয়।

সত্যবাদিতার একটি বড় বৈশিষ্ট্য “অঙ্গিকার”। কেহ একজন চারিত্রিক বিশুদ্ধতায় ভাল বা মন্দ বুঝার সহজ একটি পন্থা হলো অঙ্গীকার। অঙ্গীকার রক্ষায় কতটুকু দায়িত্ববান? আমানত রক্ষায় কতটুকু যত্নশীল? কথা ও অর্থ লেনদেনে কতটুকু আন্তরিক এবং সত্যবাদী? অঙ্গীকার রক্ষার দ্বারা একজনের ভিতরের কঠিনত্ব, স্বভাব ও আচরণ সহজেই অনুধাবন করা যায়। ‘শূন্য’-র সাথে ‘এক’ বা বিলিয়ন সংখ্যক ‘এক’ গুণ করলে ফলাফল ‘শূন্য’-ই হয়। একজন রাসুল সারাজীবনে জেনে-শুনে-বুঝে একটি মিথ্যা বা অঙ্গীকার ভঙ্গ করলে ফলাফল “শূন্য” অর্থাৎ গ্রহনযোগ্যতা থাকে না, সত্যবাদী বলে বিবেচিত হয় না। দেশপ্রধান, ধর্মের প্রবর্তক, নেতৃত্বদানকারী লোকদের অঙ্গীকার খুব গুরুত্ব। তাদের অঙ্গীকার একটি ভঙ্গ হলে সবকিছুই মিথ্যা হয়ে যায়। প্রবর্তক বা দেশ প্রধান বা ক্ষমতাধরদের অঙ্গীকার ভঙ্গের দরুন মিথ্যুক ও প্রতারকে পরিণত হয়। অসৎ বা নীতিহীন লোক কখনই সত্যবাদী হতে পারে না, অঙ্গীকার রক্ষা করতে পারে না আর চারিত্রিক বিশুদ্ধতা তো নয়ই। সে সকলকে নিজের মত ভাবে।

ধৈর্যঃ
দুনিয়ার সর্বশ্রেষ্ঠ ও সবচেয়ে বড় শিক্ষক। এই শিক্ষক জ্ঞান অর্জন করতে শেখায়। পুরো দুনিয়ার বাস্তবতার চিত্র অংকিত আকারে অন্তরে ও মস্তিষ্কে স্থাপন করে জ্ঞানের সমুদ্রের দ্বার খোলে দেয়। শুধুমাত্র এই শিক্ষকেরই ক্ষমতা, চিন্তা ও বিবেকের সামনে “আমি” সত্তা-কে শরীর থেকে পৃথক ও উন্মোচন করে। দুনিয়ার সকল লাইব্রেরীর বই-এর সম্মলিত জ্ঞান, ধৈর্যের জ্ঞানের সমতুল্য নয়। ধৈর্য, দৃশ্যের বাস্তবতার ভিতর থেকে অদৃশ্য বাস্তবতাকে তুলে আনে এবং প্রতিষ্ঠা করে “প্রজ্ঞা”-কে। বাস্তবতার অদৃশ্য আগুন অন্তর-কে জ্বালিয়ে বিরামহীন দহন করতে থাকে আর সেই দহনের ভিতর অন্তরকে নীরবতা ও বিনয়ের সহিত ধরে রাখার ক্ষমতাই হচ্ছে “ধৈর্য” আর নিজ ভিতরে ও বাহিরের বাস্তবতাকে অনুধাবন এবং বিচার করার ক্ষমতা হচ্ছে “জ্ঞান”। “উত্তেজনার সহিত অস্থিরতা” ধৈর্য ও জ্ঞান দুটিকেই বিধ্বস্ত করে। পরিস্থিতি ও সময়ের ব্যবধানে বিপদ, সংকট, দুরবস্থা ইত্যাদি হতে তৈরি অদৃশ্য আগুন অন্তরে আঘাত করে, কখনও ঘূর্ণিঝড়ের ন্যায়, কখনও বন্দুকের গুলির ন্যায়, কখনও বিস্ফোরণের আকারে, কখনও বিরামহীন সমুদ্রের ঢেউ-এর মত। অন্তরে “ধৈর্য” প্রতিষ্ঠা করার অপরিহার্য আরও দুটি প্যারামিটার হলো “দৃঢ়তা” এবং “সাহস”। আর দৃঢ়তা এবং সাহসকে মজবুত করে জী-সত্তার প্যারামিটার “খেয়াল”।

“অভাব” ধৈর্যের ন্যায় প্রকৃতির আরেক বড় শিক্ষক। অভাবের চরমতা থেকে সৃষ্ট “অসহায়ত্ব”। জীবনের মৌলিক প্রয়োজন টুকুর অভাবের তীব্রতা দেখা দিলে অসহায়ত্ব কখনও বেড়ি হয়ে অন্তরকে চেপে ধরে আবার কখনও-বা সুপার হারিকেনের ধ্বংসের বিষ হয়ে অন্তরে বইতে থাকে। অধৈর্য ও অসাবধানতা এই বিষকে সময়ের ব্যবধানে আত্মহননের পথকে সহজের দিকে ঠেলে দেয়। চরম অসহায়ত্বের সহিত ধৈর্যের সমন্বয়ে যে জ্ঞান অর্জিত হয় তা দুনিয়ার সকল পুস্তক ও মানব জাতি মিলে দিতে অক্ষম। দুনিয়া ও দুনিয়ার মানুষদের স্বভাব, আচরণ ভাল করে চিনিয়ে দেয়। এই শিক্ষকদ্বয়ের ছাত্র ছিলেন দুনিয়ার সকল নবী-রাসুলগন এবং বাধ্যতামূলক ছাত্র হতে হয় একজন উত্তম চরিত্র বা সিরাতা’ল মুসতাকি-ম অধিকারীকে যা ”সত্য”-র দ্বার উন্মোচিত করে।

কৃতজ্ঞতা আর ধৈর্য হলো মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। একটি ছাড়া অপরটির পূর্ণতা হয় না। দুনিয়ার মানুষদের কোন কিছুতেই সন্তুষ্টি নেই। অভিযোগের পাহাড়; জীবন সম্পর্কে অভিযোগের শেষ নেই। বাস্তবতার কঠিনতা, জটিলতা অন্তরে বিরামহীন বিদ্ধ হতে থাকলে, অন্তরে জ্বালাময় শুরু হয় আর সেই জ্বালাময়ী থেকে বাঁচার জন্য হাপিত্যেশ করতেই থাকে। “ধৈর্য” ছাড়া আর কোন উপায় নেই- তাদের তা বুঝে নেই। ধৈর্য ধারণ করার শিক্ষা জানা নেই। ওয়ার্মহোল মহাবিশ্বের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তের সংযোগ ঘটায় যার ব্যবধান পাঁচ/সাত বিলিয়ন আলোকবর্ষ কিংবা এক মহাবিশ্ব থেকে অন্য মহাবিশ্বের স্থানান্তরিত করে (ওয়ার্মহোল একটি প্রস্তাবনা, প্রমাণিত নয়)। ওয়ার্মহোলের প্রান্তের শেষ আছে কিন্তু মানুষের চাহিদার শেষ নেই। নিজের যা আছে তাতে সন্তুষ্ট নয়, কৃতজ্ঞ নয়। কৃতজ্ঞতা বোধ ও সন্তুষ্টি ধৈর্যকে প্রতিষ্ঠা করে। জন্ম থেকে সন্তানকে কৃতজ্ঞতাবোধ ও দায়িত্ববোধ না শিখানো মা-বাবার বড় ভুলগুলোর একটি। মনুষত্ববোধ কারোর ভিতর আছে কিনা তা বুঝা ও বিচার করার একটি উপায় কৃতজ্ঞতা বোধ।

লজ্জাশীলতাঃ
লজ্জাশীলতা উত্তম চরিত্র বা সিরাতা’ল মুস্তাকি’ম-র অর্ধেক এবং ইহা ব্যতীত মানবীয় গুণাবলী অসম্পূর্ণ। ব্যক্তিত্বকে সংজ্ঞায়িত ও প্রতিষ্ঠা করে লজ্জাশীলতা। লজ্জাশীলতা যত বেশী, বিবেকবোধ তত তীক্ষ্ম আর বিবেকবোধের তীক্ষ্ণতার অনুপাতে ব্যক্তিত্ব বৃহত্তর হয়। কথা, আঁচরণ, মন-মানসিকতা কার কেমন তা নিশ্চিত এবং সাথে রুচিশীলতার পরিচয় তুলে ধরে। সরলতার সহিত লজ্জাশীলতার সম্পর্ক অতি গভীর ও মজবুত। হিংসা, বিদ্বেষ, অহংকার, উচ্ছৃঙ্খলতার দরুন লজ্জার দরজা বন্ধ থাকে। বেহায়াপনা বা নির্লজ্জ আচরণ দুনিয়াব্যাপী মানবজাতিকে গ্রাস করছে এবং এই নির্লজ্জতার বিষের মাধ্যমে মানবজাতির অধঃপতন বেড়েই চলছে। খেয়ালখুশীর কারনে আধুনিক জেনারেশন বেহায়াপনার বীভৎসতার জ্ঞান, তাদের অনুভূতি থেকে অনেকটাই হারিয়ে যাচ্ছে। “অবৈধ যৌনতা” এখন স্বীকৃত এবং স্বাভাবিক, ভবিষ্যতে সমকামীর ন্যায় শিশুকামীও বৈধ হবে। বেহায়াপনার দরুন তাদের কর্মগুলো বৈধতার ট্যাগ লাগিয়ে আধুনিক সভ্যতার দাবীদার করা হবে। দুনিয়াব্যাপী দাম্পত্য জীবন উচ্ছৃঙ্খল ও অধিক সংখ্যক বিচ্ছেদের বড় কারন “নির্লজ্জতা”।

বাস্তব জীবনের সকলের মধ্যে স্ত্রীর সাথে উত্তম আচরণ, চরিত্রের সর্বোত্তমতার প্রকাশ। যে নিজ স্ত্রীর কাছে উত্তম, সে দুনিয়ার সকলের মধ্যে উত্তম আর লজ্জাশীলতা ব্যতীত ইহা অর্জিত হয় না এবং অর্জিত হওয়ার আর কোন মাধ্যম নেই। অন্তরে লজ্জাশীলতার পরিপূর্নতার মাধ্যমে একজন মহামানব হয়ে মর্যাদায় ফেরেশতাদের উর্ধ্বে আরোহণ করে তেমনি এই গুণটির অনুপস্থিতিতে ইতর প্রাণী থেকেও নিকৃষ্ট হয়।

হিংসাঃ
প্রত্যেক সৃষ্ট জীবের যৌবনের চেতনা থাকে প্রাণবন্ত, উদ্যমতা, ক্ষীপ্রতা, শক্তিসামর্থের সংমিশ্রণ। মন্দ প্যারামিটারগুলোর মধ্যে হিংসাকে তুলনা করা হয়, সৃষ্ট জীবের যৌবনের চেতনার সাথে। হিংসা সকল বদ প্যারামিটার গুলোর মধ্যে সবচেয়ে বিপদজনক হওয়ার কারন, ইহা নিজে এক অগ্নিকুণ্ড আবার অন্য বদ প্যারামিটারদের জাগ্রত ও বলবৎ রাখার জ্বালানী হিসাবে কাজ করে। হিংসুক অন্তরধারী সংকীর্ণ পরিচয়ের ভিতর নিজেরাই নিজেদের আটকিয়ে রাখে। চিন্তা, কর্ম, আচরণসহ জীবন ব্যবস্থার সবকিছুকে হিংসার দাস বানিয়ে ফেলে। পুরো জীবন ব্যবস্থাটাই হয়ে উঠে একটা অস্থির ও উচ্ছৃঙ্খল। হিংসার দরুণ নিজেরা নিজেদের ভালবাসতে জানে না আর নিজেদের ভালবাসতে না জানলে অন্যকে কিভাবে? নরকের অগ্নির ভিতরে নিজেরা থাকে আর আশপাশের মানুষদেরও নরক বানিয়ে রাখে। অন্যকে ঠকিয়ে, বিপদে ফেলে, কষ্টের ভিতর নিমজ্জিত রেখে আত্মতৃপ্তি পায় আর আত্মতৃপ্তিকে “শান্তি” মনে করে এর ভিতর ডুবে থাকার চেষ্টায় ব্যাপৃত। দুশ্চিন্তা, হৃদরোগের সাথে জীবনীশক্তি নষ্ট করে। দুশ্চিন্তা বা উদ্বেগ নিদ্রাহীনতা, পাচক রস, স্নায়ুতন্ত্র সহ শরীরের অঙ্গাদি, ম্যাকানিজম নষ্ট করে ফেলে। জীবনের আয়ু দ্রুত ক্ষয় হয়।

হিংসা এমন একটি ঝোঁক বা প্রবণতা যা কারোর ক্ষতি করার অনুভূতি জাগায়। কোন কিছু পাওয়ার সুপ্ত বাসনাকে জাগ্রত করে। জন্মগত ভাবে অন্তরে হিংসা প্যারামিটারটি সক্রিয়। হিংসা, অন্তরের একটি জটিল আবেগময় প্যারামিটার। শিশুদের সহজাত প্রবৃত্তি যে কোন কিছু নিজের করে পাওয়ার ইচ্ছা। বাবা যদি কখনও মা-কে জড়িয়ে ধরে শিশু সন্তান এসে বাবার কাছ থেকে মা-কে ছাড়িয়ে নেয় এবং মা-কে নিজে আগলিয়ে রাখার সাথে অন্য কারোর সাথে ভাগ দিতে চায় না। শিশুরা ছোটবেলা থেকে সব নিজেদের মত আগলে রাখে। ছোটবেলার হিংসা প্যারামিটার বিপদজনক নয় কিন্তু সময়ের ব্যবধানে বিপদজনক করা হয়। অন্যের সাথে সাফল্যের তুলনা, তিরস্কার, ভালবাসার ভাইবোনদের সাথে প্রতিদ্বন্দীতা, জীবনের লক্ষ্য স্থির করে দেওয়া, সমাজ ও সংস্কৃতির বৈষম্য, ধর্মীয় প্রভেদ যা হিংসার ভিত্তি পিতামাতারাই সন্তানদের বিপথগামী করে ছোট বেলা থেকেই। সময়ের ব্যবধানে আরো দুটি অনুভূতি হিংসুক হওয়ার প্রেরণা জোগায়। দরিদ্রতা এবং নিজের প্রতি আত্মবিশ্বাস না থাকা।

লোভ-লালসা ও কামনার সাথে হিংস্রতার মিশ্রণে অন্তরে তৈরী হয় “কুটিলতা”। গীবত ও অপবাদে জিহবা সর্বদা ব্যাকুল। কুটিল অন্তর-ধারী নিজের ব্যক্তিজীবন অধঃপতনের সাথে পারিবারিক জীবন, সামাজিক জীবন, রাষ্ট্রীয় জীবন সর্বনাশের কারন হয়। নিজেদের স্বার্থে এমন হীন কাজ নেই যা তারা করে না। অন্যের ক্ষতির করার উদ্দেশ্যে সর্বদা কুচিন্তার চক্রের ভিতর মশগুল আর ইহাই উপমার তুলনা “আগুনে কাঠ পুড়ে কয়লা হওয়া”। অর্থ ও ক্ষমতার অধিকারী হলে অন্যের ক্ষতি ও প্রতিশোধ নেয়ার কৌশল নিয়ে গবেষনা ভিতর নিমজ্জিত থাকে। ঘুম, অন্যান্য কর্ম সব বাদ দিয়ে অন্যের ক্ষতি করার চিন্তায় বিভোর। হিংসার এই আগুণ অন্তর পুড়ানোর সাথে অন্যান্য সদ্গুণগুলো জ্বলে বিলোপ হয়। স্বার্থ রক্ষার সময় নিজেদের চোখ-মুখ উল্টিয়ে অসহায়ত্বের ছাপ প্রকাশ করে। স্বার্থের প্রয়োজনে সামনে চাটুকারী করে আর বিবেকবোধের সাথে নিজের মগজটাও অন্যের পায়ের তলায় রাখতে লজ্জিত হয় না। জানান দেয়, সাহায্য না পেলে মৃত্যুর ন্যয় বিপদ অনিবার্য। অথচ বিপদ কেটে গেলে আর উপকারের কথা মনে রাখে না আর মনে রাখলেও স্বীকার করে না। কৃতজ্ঞতা, নৈতিকতা, মানবিকতা হিংসুকদের অন্তরে তৈরি হয় না। এদের লজ্জা নেই, সন্তুষ্টি-ও নেই। হিংসুক ও স্বার্থপর মানুষগুলো সফলতা অর্জন করলেও সুখী কখনই হতে পারে না। হিংসুক ও বেঈমানরা কাঁদে, অনুতপ্ত হয় না। এদের অন্তর হয় পাথরের ন্যায় শক্ত ও কঠিন।

ঝগড়া করে শত্রু বানানোর দরকার নেই। চারপাশে হিংসুক ও অকৃতজ্ঞদের সংখ্যা এত বেশি যে, যাদের উপকার করা হয়েছে, তারাই এক সময় শত্রুতে পরিণত হবে। এদের অনেকে আবার কৃতঘ্নও বটে। হিংসুকরা ঝগড়াটে স্বভাবের। ঝগড়াটে স্বভাবের ছেলে বা মেয়ে সুখের দিন হোক কিংবা দুঃখের কখনই কাউকে কাছে পায় না। নিজের জীবন নিজেই বরবাদ করে।

অহংকারঃ
এই প্যারামিটার হচ্ছে অনুঘটক। এর প্রধান কাজ, অন্যান্য বদ প্যারামিটারগুলোর আকৃতি ও আয়তনকে ছোট থেকে বড় এবং সময় ও সুযোগে দানব বানানো। অর্থ ও ক্ষমতার অধিকারী হলে এই অনুঘটক আরও শক্তিশালী হয়ে উঠে। অর্থ ও ক্ষমতার সাথে কামনা ও হিংসার আধিক্যের পরিধির বিস্তারের অনুপাতে অহংকার বৃহত্তর হতে থাকে। মোমবাতিকে দানব সূর্যে পরিণত করাই অহংকারের কাজ। ‘হিংসা’, ‘কামনা’, ‘লোভ’, ‘বিদ্বেষ’, ‘প্রতিশোধ পরায়নতা’ ইত্যাদি প্যারামিটারদের বৃহত্তর করার মাধ্যমে কর্ম ও চিন্তাকে আচ্ছাদিত রাখে। অহংকারীদের অবজ্ঞা ও অবহেলা যার শিকার পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র। নিজেকে সকলের চেয়ে শ্রেষ্ঠ এবং নিজ চিন্তা-চেতনা ও মতবাদকে জগতের উৎকৃষ্ট মনে করে। সে মনে করে তার থেকে সকলের জ্ঞানের নেয়ার প্রয়োজন, তার উপদেশ গ্রহণ করা উচিত। কোথাও বাছবিচার নেই, বস্তাপচা উপদেশ ও বানী সবজায়গায় এবং সর্বদা তার চোয়ালে বিদ্যমান। এই ধরণের বিকারগ্রস্থদের স্ত্রী ও সন্তানরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ। চেহারায় ভদ্রতার ভান করলেও, প্রকৃতপক্ষে পিশাচ প্রকৃতির। সে মনে করে জগতের সকল দুঃখ-কষ্ট শুধু তারই, চারপাশের মানুষদের কোন অনুভূতি নেই এবং দুনিয়াকে তার সেবার জন্য তৈরি করা হয়েছে। “তোষামোদি”-কে সম্মান মনে করে এবং এর জন্য লালায়িত থাকে। ব্যক্তি ও জাতির মধ্যে তোষামোদি বিরাজ করলে, সেখানে নৈতিকতার শুধু পতন। নিজের সমালোচনা বা ভুল শ্রবণে ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটায় আবার অন্যের সমালোচনায় ব্যস্ত। নীজের ভুল দেখতে পায় না আবার অন্যের ভাল গুণ চোখে দেখে না। হিংসুক ও অহংকারীরা লজ্জ্বাহীন, বিকৃত রুচী ও মানসিক বিকারগ্রস্ত। তাদের হাতে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা বা বিশেষ গুরুত্ব পদের দায়িত্ব দেওয়া হলে জাতি ও বিশাল জনগোষ্ঠীর শুধু দুর্ভোগ আর দূর্নীতি। অহংকারীরা লোভী প্রকৃতির। অর্থ ও সম্পদ গণনা করে এবং তা বাড়ানোর চিন্তায় মশগুল থাকে। স্বভাবে অতিব কৃপণ ও ঈর্ষাপরায়ন প্রকৃতির এবং নিজ জীবনের কোন কিছুতেই সন্তুষ্টি থাকে না।

অহংকার প্যারামিটার নিজেই একটি কারাগার। অহংকার প্যারামিটার সক্রিয় হলে দয়া, মায়া, ভালবাসা, ক্ষমা, মহত্ব, ধৈর্য, লজ্জাশীলতা ইত্যাদি অন্তরে প্রবেশ করতে পারে না। অহংকারের কারাগারে নিজের অন্তরকে নিজেই আবদ্ধ করে ফেলে। “লোক দেখানো” কর্ম ও সকলের কাছ থেকে চাটুকারিতা পাওয়ার জন্য লালায়িত। যার কারনে অহংকারকারীরা জন্ম থেকে মানসিক বিকারগ্রস্থ। জ্ঞানী লোকদের কানটা বড় হয় আর জিভটা ছোট হয় আর অহংকারীদের তার উল্টো।

“বিনয়” ও “অহংকার” একটি অপরটির শক্ত প্রতিপক্ষ।

লোভঃ
কাক একটি রুটি পাওয়ার পরেও আরেকটির জন্য ব্যকুল। যে রুটিটি তার আছে, সেটির একটি অংশ খেয়েও শেষ করার ক্ষমতা রাখে না কিন্তু রুটিটি গাছের ডালে বা নারিকেল গাছের আগায় রেখে আরেকটি নেওয়ার চেষ্টা। শকুন খাবার খাওয়ার সময় হুশ থাকে না, কতটুকু খাবার গ্রহণ করছে। সে খেয়েই চলে তারপর খাওয়া শেষ হলে আর উড়তে পারে না। উড়ে গিয়ে কোন গাছের ডালে বিশ্রাম করবে বা আশ্রয় নিবে সেই শক্তিটুকুও থাকে না মাত্রাতিরিক্ত খাবারের কারনে। মোরগ সর্বদা পাশের বাড়ির মুরগীর প্রতি আকর্ষিত হয়। নিজের ঘরে তিনটি মুরগী থাকার পরেও পাশের বাড়ির অন্য মুরগীদের সাথে যৌণতায় লিপ্ত হতে আকৃষ্ট হয় আর ইহাই মোরগের স্বভাব। মানবজাতি লোভের কারনে নিজেদের বিবেক-বুদ্ধি হারিয়ে অবস্থা হয় কাক, মোরগ, শকুনের চেয়েও ভয়াবহ। “কামনা” দানব হয়ে নিজ সত্তাকে গ্রাস করা শুরু করে। নিজের ঘরে বউ থাকার পরেও পরের বউ বা মেয়েদের প্রতি অভিলাষ ও যৌন লোভী হবেই। আবার অনেকে বিকৃত যৌনাচারে লিপ্ত। শুয়োর নিজের সাথীর সাথে যৌন কর্ম করে অন্য পুরুষ শুয়োরদের ডেকে আনে যৌনতায় লিপ্ত হওয়ার জন্য। দুনিয়ার কিছু মানুষদের যৌন কর্ম শুয়োরের চেয়ে জঘন্য। পবিত্র অন্তরধারী পুরুষ ব্যতীত দুনিয়ার বেশীরভাগ পুরুষেরা মেয়েদের প্রতি কুদৃষ্টি নিক্ষেপ করে। এই কুদৃষ্টির তীর এক বিষময় যা সমাজের ব্যবস্থাকে অসুস্থ করে দেয়। অর্থ ও ক্ষমতার অধিকারী হলে পরের বউ বা মেয়েকে শুধু ভোগ করবে তা নয় বরং নিজেদের যৌনতার বিনোদনের জন্য হেরেমের সংখ্যা বাড়ানোর সাথে থাকে মাদক। মিথ্যা, চুরি, দুর্নীতি, সুদ, জুয়া, মাদকের ব্যবসা, ঠকানো, দখল, লুট, চাঁদাবাজি, রাষ্ট্র ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে, দেশ বা জাতি বা সমাজ সেবক হয়ে “সেবা”-কে ঢালস্বরূপ ব্যবহার করে, যে যেভাবে পারে অর্থ উপার্জনের লোভের ভিতর নিমজ্জিত। পৃথিবী পরিমান স্বর্ণ দিলে সে আরেকটা স্বর্ণময় পৃথিবী কামনা করবে। তারপর আরেকটা, এভাবে চলতে থাকে যার শেষ নেই।

চিন্তার জগতে এই চিন্তা নেই যে, জীবনের আর কতটুকু সময় জীবিত আছে? জীবনের বাকি সময় কতটুকু খেয়ে শেষ করার ক্ষমতা রাখে? রিপুর তাড়নায় মৃত্যুর কথা লোভীদের স্মরণে থাকে না। অন্যের সাথে নিজের তুলনায় আচ্ছাদিত। অহংকারের কারনে আত্মতৃপ্তির এক নেশার দিগন্ত। অর্থের বড়াই, আভিজাত্যের গর্ব, ক্ষমতার দম্ভ- এই প্রতিযোগীতায় জিততেই হবে। নিজের অর্থ-সম্পদ অন্যের চেয়ে ঢের- এই স্মরণের মাধ্যমে আত্মতৃপ্তির জগতে বিচরণ। অমুসলিমদের চেয়ে মুসলিম নামধারীদের এই আসক্তি ও প্রদর্শন বেশী। ক্ষমতার লোভ, অন্য সকল লোভের চেয়ে বৃহত্তর ও ব্যপক যা মানব প্রজন্মের সকল ইতিহাসের নথীতে বিদ্যমান।

আসক্তি এক ভয়ানক। কৃষ্ণগহ্বরের অভিকর্ষ বলের ন্যায় শক্তিশালী। লোভের সাথে আসক্তির সংমিশ্রণ যখন ঘটে তখন “মৃত্যু” চিন্তাশক্তি থেকে উধাও। মৃত্যু বরণ করতে হবে, ইহা আর কখনই স্মরণে থাকে না। চিন্তার জগত থেকে “নাই” হয়ে যায় মৃত্যু। বেপরোয়া অস্থির জীবন। হিংস্র সমাজ আরো ভয়ানক হিংস্রে পরিণত হচ্ছে। সবাই তো সাধু হিসেবে নিজে নিজের সনদ দেয় কিন্তু কতজন সৎ?

খেয়ালখুশীঃ
অন্তর ও দেহ দুটি দুই জগতের বাসিন্দা। মাতৃগর্ভে অন্তরকে দেহের ভিতর মজবুত ভাবে স্থাপন করে যুক্ত করা হয়। অন্তর সর্বদা দেহ নামক ভারী একটি পোশাক বহন করে চলে মৃত্যু অবধি। এই ভার অত্যন্ত কষ্টকর এবং জীবন ধারণে অন্তরায় সৃষ্টি করে। ২০ বছর অবধি অন্তরকে শরীরের ভারের কষ্ট এবং বোঝা বুঝতে দেওয়া হয় না। বয়ঃসন্ধিতে প্যারামিটারের পরিপূর্ণতা আর শরীরের হাড়, মাংসের বৃদ্ধি সেই বুঝার অনুভুতিকে ব্যাঘাত সৃষ্টি করে। বয়স ৩৫-র পর দেহের বোঝার চাপ আস্তে আস্তে তৈরি হতে থাকে। ৪০-এর পর হাড়ের ক্ষয়, মাংসের দূর্বলতা দেহের ভার ও কষ্ট জানান দেয় এবং অন্তরকে চেপে ধরে। বার্ধক্য ও শারীরিক অসুস্থতার বোঝা থেকে অন্তর মুক্ত হতে নীরবে হাপিত্যেশ চলতে থাকে।

পানির নীচে থাকলে শ্বাস যতক্ষন থাকে ততক্ষন স্বাভাবিক, শ্বাসের নির্ধারিত সময় শেষ হলে পানি থেকে উপরে উঠতে বেপরোয়া হয়। দেহের ওজনের বিড়ম্বনার সাথে বাস্তবতার হাঙ্গামা থেকে মুক্ত হতে শ্বাসের নির্ধারিত সময় শেষ হওয়ার ন্যায় অন্তর নিজের অবস্থান “আরামের পাত্র”-এ ধরে রাখতে দৃঢ়তা অবলম্বন করে। ফলে নিজের ইচ্ছামত কর্ম এবং চিন্তার ভিতর ঢুকে আরামের পাত্রের ভিতর মজে থাকে আর এই প্রসেসটাই হচ্ছে “খেয়ালখুশী”। যে বিষয়টি যেমন গুরুত্ব ও প্রাধান্য দেওয়া উচিত সে মোতাবেক মূল্যায়ন না করাই খামখেয়ালী(Whimsical)। আর অন্তরকে আরামের পাত্রের ভিতর না ডুবিয়ে, অস্থির না হয়ে, জ্বালাময়ীতার পাত্রে ধারণ করার নাম “ধৈর্য”। জ্ঞান ও প্রজ্ঞার সোপানসমূহ এখান থেকে খুলে। ইহা ধৈর্য ধারণ করার একটি প্রক্রিয়া।

নিউট্রন স্টার অধিক ঘনত্ব এবং অতীব ওজন। চরম দরিদ্রতার কষাঘাত নিউট্রন স্টারের ন্যায় ওজন হয়ে অন্তরকে চেপে ধরে। চরম অভাবের ভিতর সন্তানের ক্ষুধার জ্বালার অনুভূতি পিতার অন্তরে নিউট্রন স্টারের চেয়েও আরো অধিক ওজন অনুভূত হয়। এই অত্যাধিক ওজন ও চাপ নিউরনের চিন্তাশক্তির ডিজঅর্ডার তৈরির সাথে বড় রকমের শারীরিক ও মানসিক অসুস্থতা, অনৈতিক কর্মে লিপ্ত হতে বাধ্য করে। অন্তরের এই ওজন চেপে ধরার কঠিনত্বের পার্থক্য নির্ধারিত হয় ব্যক্তি বিশেষের ব্যক্তিত্বকে কেন্দ্র করে। যার লজ্জাশীলতা যত বেশি তাঁর ব্যক্তিত্বের পরিধি তত বড় এবং মহৎ। ব্যক্তিত্ব সম্পন্নগণ(প্রকৃত মুমিন) এই স্তরে ধৈর্যের যে পরিচয় দেন তা দুনিয়ার সকল সাধারণ মানুষদের পক্ষে বুঝা ও অনুভব করা সাধ্যাতীত। মানব জাতি স্বভাব জনিত “খেয়ালখুশী”-কে আঁকড়ে ধরে। মোবাইল, মিডিয়া, জিহবা, চোখ ইত্যাদি খেয়ালখুশীর উপাদান।

বিষাদঃ
“ইচ্ছাশক্তি” সাফল্যের মূল চাবি। ইচ্ছাশক্তিকে সম্পূর্ণ রূপে তেজ শূন্য করে বিষাদ। বিষাদ, কর্ম করার আগ্রহ ও গুরুত্বকে নষ্ট করে ফেলে। প্রত্যেকের বয়ঃসন্ধিতে এই প্যারামিটারের উৎপত্তি এবং বয়ে চলে মৃত্যু পর্যন্ত। বয়ঃসন্ধিতে লোভ, অহংকার, যৌনতা, হিংসা, রাগ, বিদ্বেষ, পছন্দ-অপছন্দ, চাওয়া-পাওয়ার প্রাধান্যতা ইত্যাদি প্যারামিটার পরিপূর্ণতা ও শক্তিশালী হওয়ার পাশাপাশি অত্যধিক ওজন, এই “বিষাদ” তৈরির কারন। বাস্তবতার তিক্ততা এবং নির্দয় ও উচ্ছৃঙ্খল সমাজ ব্যবস্থা এই প্যারামিটারকে ধারালো করে। পরিবারের আপন মানুষজনদের সাথে দূরত্ব ও অবহেলা এবং জীবনের মৌলিক প্রয়োজনটুকু মিটাতে ব্যর্থ তখন এই প্যারামিটার অন্তরকে শক্ত ও কঠোর করে ফেলে এবং জীবন ধ্বংসের কারন হয়। পিতামাতার উচ্ছৃঙ্খলতা ও তাদের কঠিন ও উত্তপ্ত বাক্য বিনিময়, কর্কশ আচরণ, হাতাহাতি ইত্যাদি শৈশবেই শিশুদের মনোবিকাশের স্বাভাবিকতা নষ্ট হয় আবার বয়ঃসন্ধিতে অসৎ সঙ্গদোষ জীবনের মোড় ঘুড়িয়ে বিষাদের দিকে ধাবিত করে। যাকে নিয়ন্ত্রণ করা যায় না বা নিয়ন্ত্রণ করার উপায় নেই, সেখানে জোর করে নিয়ন্ত্রণ করতে গেলে গণ্ডগোল সৃষ্টি হবে যা বেশীর ভাগ পিতামাতা সন্তানদের সহিত এই আচরণটি করেন। পিতামাতারা যেহেতু সন্তানদের জন্য অর্থ, কষ্ট ত্যাগ করে সেহেতু সন্তানরা তাদের ইচ্ছামত পরিচালিত হবে- এই মনোভাব প্রায় সকলেই পোষণ করে। ইহা অত্যন্ত ভয়ানক এক আচরণ এবং এই আচরণে সন্তানের অন্তরে বিদ্বেষ তৈরি হয় আর এই বিদ্বেষ থেকে বিষাদ তৈরি হয় দ্রুত। সন্তানদের শিক্ষা দেওয়ার সময় নিয়ন্ত্রণের পরিবর্তে ভালমন্দ চিন্তার জগতে এনে আগ্রহ প্যারামিটার সৃষ্টি করে দেওয়া জরুরী যা বেশীরভাগ পিতামাতা ব্যর্থ। বয়োবৃদ্ধির সাথে শারীরিক দুর্বলতাও বিষাদের মাত্রা বাড়িয়ে তুলে। আর বিষাদ থেকে বাঁচতে খেয়ালখুশি কর্ম ও খেয়ালখুশি চিন্তার দ্বারা অন্তরের আরামের পাত্রে আবদ্ধ থাকে। বয়ঃসন্ধি থেকে বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকর্ষণ, যৌনতার আসক্তি থেকে কামনার সহিত “খায়েশ”-কে চিন্তার জগতে বেধে ফেলে যা আরেক দিগন্তের দিকে মোহ তৈরি করে। বিষাদের জালে আটকিয়ে গেলে জীবনের বাস্তবতার স্বাদ এতটাই তিক্ত ও বিষময় হয়ে উঠে, যা থেকে বাঁচার জন্য জুয়া-মাদক-বহুগামিতার দিকে ঝুঁকতে শুরু করে এবং স্থান-কাল-পাত্র ভেদে আত্মহননের দিকে ঠেলে দেয়। দুনিয়াতে নির্দিষ্ট কিছু জায়গায় মানুষ গমন করে প্রকৃতি উপভোগ করতে আবার একই জায়গায় কেহ যায় আত্মহননের উদ্দেশ্যে। সৃষ্টিকর্তার অস্বীকারকারীরা এই প্যারামিটারের শিকার হোন অধিক পরিমাণ যারা চরম হতাশার ভিতর ডুবে থাকে। হতাশা হিংস্রতাকে শক্তিশালী ও মজবুত করে। এদের অনেকে পুঁথিগত বিদ্যা বা ব্যবসার জোরে সাফল্য অর্জন করে অন্তরকে কঠিনতার চরমতার সীমানায় আরোহণ করায়। নিজের স্মৃতিশক্তি, মেধা দিয়ে জীবনের যে অর্থ-সম্পদ, আভিজাত্য, বিলাসিতা অর্জন করে, তা নিজের পরিশ্রম, যোগ্যতা ও কর্মের ফল হিসেবে দাবী করে এবং নিজ দাবীতে অটল থাকে। এ হচ্ছে অন্তরের সীলগালা এবং বহুল সীলাগালার একটি নমুনা মাত্র। নিজেদের কর্ম নিজেদের কাছে সুশোভিত। ধৈর্যশীলতার দাবী করে সাফল্যকে জনসম্মুখে জাহির করার যে চেষ্টা তারা করে, তা প্রকৃতপক্ষে ধৈর্য নয়, ইহা অন্তরের কঠিনত্বের একটি রূপ। এই শ্রেণীর মানুষদের ব্যক্তি ও পারিবারিক জীবন সব কিছুই উচ্ছৃঙ্খল এবং অস্থির। তাদের সন্তানরাও বিপথগামী। মানুষ কখনই নিজেকে পাল্টাতে পারে না, যতক্ষন না নিজের বিবেক ও বুদ্ধি দুই জাগ্রত হয়। অর্থকে যারা জীবনের সবচেয়ে বড় প্রাধান্য দেয়, তারা বিষাদ ও হিংসা থেকে মুক্ত হতে পারে না। পারিবারিক শিষ্টাচার ও উত্তম রুচিশীলতা ব্যতীত বিষাদ থেকে নিস্তার পাওয়া যায় না।

বিদ্বেষঃ

রাগ, বিরক্তি এইগুলো হচ্ছে বিষ এবং বিষের ঘোড়া। এই বিষের ঘোড়া সর্বদা অন্তরের ভিতর দাবড়িয়ে বেড়াচ্ছে এবং উত্তেজিত করে অশান্তির আগুনের ভিতর ডুবিয়ে রাখছে। মানুষ সেই বিষ খাচ্ছে আর আশা করছে অন্য কেউ মরুক এবং ধরাশায়ী হোক। ইহা সম্পূর্ণ ভুল চিন্তা। অন্তরের রোগ আরও বাড়িয়ে তুলছে আর নিজেই নিজেকে বিনাশ করছে। মানুষ দূর্বল জায়গায় আঘাত পেলে অস্থির হয়ে উঠে, রাগ অন্তরের উপর প্রভাব বিস্তার করে আর সাথে বিবেক, বুদ্ধি হারিয়ে বসে। এই অবস্থায় রাগের কারনে জিভ ও অন্তর কম্পিত হতে থাকে প্রতিপক্ষকে জবাব দেওয়ার, আঘাত বা কথার মাধ্যমে ঘায়েল করার। এই জগত সংসারকে স্বাভাবিকতার সহিত গ্রহণ না করলে এই বিষ থেকে নিস্তার নেই। নিশ্চয়ই সংসারে ধৈর্য ধারণ অত্যন্ত সাহস ও দৃঢ়তার কাজ। ইসলামের পরিভাষায় এই সাহস ও দৃঢ়তা হচ্ছে “জিহাদ”(জিহাদের স্তর রয়েছে) আর শান্তিপ্রিয় মানুষ ব্যতীত অন্য কারো পক্ষে জিহাদে উত্তীর্ণ সম্ভব না। তাকওয়া ও প্রকৃত বিনয় অন্তরধারীরা ব্যতীত দুনিয়ার প্রায় সকল মানুষজনেরা “বিরক্তি” নামক বিষের ঘোড়ার কাছে পরাভূত। রাগ, লোভ, হিংসা, অহংকার, ভয়, দয়া, ভালবাসা ইত্যাদি সকল প্যারামিটার অন্তরে কম্পনের সৃষ্টি করে এবং এই কম্পনের দ্বারা প্রত্যেকের কর্ম আচ্ছাদিত হয়। জিহবার যেমন স্বাদের ভিন্নতা রয়েছে তেমনি কম্পনের দ্বারা সৃষ্ট অন্তরের স্বাদের ভিন্নতা। রাগের কম্পন সবচেয়ে ক্ষিপ্র, তেজি কিন্তু স্থায়িত্ব কম। চিন্তার জগতে রাগের স্থায়িত্ব লম্বা হলে টেনে আনে বিদ্বেষকে এবং বিদ্বেষ টেনে আনে প্রতিশোধ পরায়ণতাকে। কামনা ও হিংসার সাথে বিদ্বেষের সংমিশ্রণে “প্রতিশোধ পরায়ণতা” কত ভয়ংকর হয়ে উঠে তা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নাৎসি বাহিনীর প্রধান এবং অতীতের রাজ্য বিজেতার স্বভাব ও চরিত্র থেকে স্পষ্ট। নিজের কামনা পূর্নতা না হওয়া পর্যন্ত মানুষদের অন্তর কামনা, বিদ্বেষের কম্পনে সর্বদা অস্থিরতার আন্দোলনে দুলতে থাকে এবং নিজের ভিতরে এই অস্থিরতার আন্দোলন নিবৃত-র জন্য অন্যদের ধ্বংস করতে দ্বিধান্বিত হয় না। রাগী মানুষ জীবনে কখনও সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারে না, অস্থিরতার ভিতর বিরাজমান। অস্থির অন্তরধারী কখনও সাফল্য লাভ করে না।

সন্দেহ ও কৌতূহলঃ
“বুদ্ধি” জী-সত্তার প্যারামিটার, অন্তরের নয়। বুদ্ধি অত্যন্ত ধারালো এক ছোরা। একে নিয়ন্ত্রণ না করা গেলে নিজেকেই শেষ করে দেয়। অন্তরের প্যারামিটার “কৌতূহল” বুদ্ধিকে ক্ষিপ্র ও মজবুত করে। বর্তমান ট্যাকনোলজির উন্নতির শিখরে মানব সভ্যতা পৌছার কারন কৌতূহলের সাথে বুদ্ধির সমন্বয়। তেমনি জগত সংসারের বিষময়তার কারনও ঐ একই সমন্বয়। কৌতূহলের ভাল-মন্দ দু’ই আছে। যে যার ইচ্ছামত কৌতূহলের ইতিবাচক ও নেতিবাচক জীবনে প্রয়োগ করে চলছে। আর নেতিবাচক কৌতূহলের সহিত কামনা ও বুদ্ধির সমন্বয়কারীরা “ধুরন্ধর” হিসেবে পরিচিত। গণতন্ত্রের নামে ধুরন্ধর শাসকরা দুনিয়া ও দুনিয়ার মানুষজনদের সাথে মিথ্যা, শোষণ, নিপীড়ন, প্রতারণার মাধ্যমে প্রভুত্ব মজার সহিত খেলা করছে এবং জ্ঞানপাপীরা একই। কৌতূহল “ইচ্ছাশক্তি”-কে শক্তিশালী করে। সাফল্যকে পেতে চাইলে কৌতূহলের সহিত বুদ্ধির সমন্বয়ে “আগ্রহ”-কে জাগ্রত করাতে হয়।

ইউরোপের বেশির ভাগ দেশ এবং অন্য মহাদেশের কিছু সভ্য দেশ ব্যতীত দুনিয়ার বেশিরভাগ মানুষ সঠিক “কৌতূহল”-র ব্যবহার জানে না। কৌতূহল কোথায় দমন করতে হয়, কোথায় ব্যবহার করতে হয়, কোন বিষয়ে কতটুকু কৌতূহল প্রয়োগ করতে হয়- ইহার জ্ঞান নাই। একটা জাতি কেমন, রুচীবোধ কেমন তা ঐ জাতির কৌতূহল পর্যবেক্ষন করলেই বুঝা যায়। আইনের শাসন ও শাসক শ্রেণী রিপুর অনুসারী হলে ঐখানে কিছু আশা করা যায় না। একই ঘটনা সন্তানের ক্ষেত্রে, পিতামাতার সুস্থতার উপর নির্ভরশীল।

“সন্দেহ” সর্বদা মিথ্যাকে আঁকড়ে ধরে। সন্দেহযুক্ত অন্তর-ধারীদের জীবন হয় চরম অস্থির প্রকৃতির, কৃপণ স্বভাব এবং অসুস্থ চিন্তার ভিতর বিরাজমান। সর্বদা এক অস্থিরতা অন্তরকে জ্বালাময়ী করে রাখে। জীবনের কোন কিছুতে ভরসা ও সন্তুষ্টি নেই। সন্দেহপ্রবন মানুষ মানসিক ভারসাম্যহীন বিধায় এদের ব্যক্তি জীবন, দাম্পত্য জীবন, ধর্মীয় জীবন চরম গোলযোগপূর্ণ। সন্দেহপ্রবন ও লোভীরা একই শ্রেনীর।

দয়া ও ভালবাসাঃ

এই জগত সংসার টিকে আছে এই দুই প্যারামিটারের কল্যাণে। সন্তানের প্রতি মা-বাবার ত্যাগের হিসেব পরিমাপ হয় না, কারন সন্তান জন্মানোর সাথে “ভালবাসা” প্যারামিটারটি মজবুত ভাবে অন্তরে গেঁথে যায়। দুনিয়ার সকল মা-বাবা নিজ অন্তরের চক্ষু দিয়ে ভূমিষ্ট সন্তানের ভিতরের সত্তাকে দেখে এবং অনুভব করে। ভূমিষ্ট সন্তানের একটা হাঁসি মা-বাবার প্রাণকে এমনই আনন্দে আন্দোলিত করে যা তাদের কাছে জগতের চেয়েও মূল্যবান। সন্তানের উঠা, বসা, হাটা, কথা বলার মাধ্যমে নিজ রুহ থেকে সৃষ্ট অপর একটি রুহকে অনুভব করে আর এই অনুভূতি এতটাই তীক্ষ্ম, মজবুত ও বৃহত্তর যে- DNA, RNA, প্রোটিন, অ্যামাইনো এসিড, বিবর্তন এমনকি রক্ত, মাংস, হাড় ইত্যাদি কোন কিছুই স্মরণ থাকে না। বিরাজ করে শুধু অনুভূতির ডাইমেনশনে। দুনিয়ার সকল মানুষের অন্তর থেকে দয়া বা ভালবাসা যে কোন একটি প্যারামিটার মুছে ফেলা সম্ভব হত, কিছুক্ষণের মধ্যে মানব জাতি নিজেরা নিজেদের সাথে দুনিয়া ধ্বংস করে দিত। মানবিকতা ও নৈতিকতা তৈরির ভিত্তি এই দুই প্যারামিটার। নিশ্চয়ই “পরোপকার” অতি উচ্চ মর্যাদাশীল আর দয়া ব্যতীত ইহা সম্ভব নয়। অন্যের দুঃখ-কষ্টের অনুভূতি নিজ অন্তরে আন্দোলিত হওয়ার মাধ্যমে এই জগত সংসারের স্থিতিশীলতা বিদ্যমান।

আবেগ ও বিবেকঃ

রেলগাড়ি চলে লোহার দুটি পাতের উপর আর তা হলো রেললাইন। রেললাইনের লোহার পাত দুটি সমান দুরত্বে না থাকলে বা একটি আরেকটির সাথে মিশে গেলে নিশ্চিতই রেলগাড়ি দূর্ঘটনায় পতিত হবে। তেমনি বিবেক ও আবেগ একত্রিত হয়ে গেলে কিংবা শুধু আবেগ দিয়ে কর্ম নিয়ন্ত্রিত হলে জীবনে দূর্ঘটনা ঘটতে থাকবে এবং এই চলতে থাকা বয়ে চলবে মৃত্যু পর্যন্ত। বাস্তবতাকে মোকাবিলা করতে হয় বিবেক দিয়ে। আবেগের দ্বারা বিচার করলে ভুলের জালে আটকিয়ে গিয়ে সেখানেই আবর্তিত হতে থাকে এবং বের হওয়ার আর পথ থাকে না। জীবনের বড় একটি ঘটনা বয়ঃসন্ধির পর বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকর্ষিত হওয়া। যৌনতা এই আকর্ষনকে দূর্বার করে তুলে। অর্থাৎ প্রত্যেকে সন্তুষ্টি অর্জন এবং আত্মতৃপ্তির সহিত ভাল লাগাকে পেতে চায় অন্যের দ্বারা। আর যৌনতার দূর্বার আকর্ষনকেই যারা শুধু প্রাধান্য দেয়, ইহা অসার রুচীর পরিচায়তা এবং এই প্রসঙ্গ থেকে বিরত হই। মানুষ ভালবেসে এবং আবেগে আকৃষ্ট হয়ে বিয়ে করে। কিন্তু সংসার বা নতুন জীবন শুরু করতে গেলে, আবেগ ও বিবেক আলাদা ভাবে প্রয়োগ করতে হয়। এই দুই খেলোয়াড়কে দুই ভিন্ন পাত্রে রেখে জীবন চালিয়ে নিতে হয় যা দুনিয়ার বেশীর ভাগ ছেলে-মেয়েরা ব্যর্থ হয় এই হিসেব কষতে। ফলে সংসারে চলে উচ্ছৃঙ্খলতা, ঝগড়া, হাতাহাতি, মারামারি এবং সব শেষে তিক্ততার সহিত ছাড়াছাড়ি। আবেগ ও বিবেককে এক করে ফেললে এমনটি হওয়া স্বাভাবিক। যে মানুষটিকে ভালবাসা হয় তাকে নিজ শরীরের অঙ্গ মনে করতে হবে নয়ত দূর্ঘটনা চলতেই থাকবে। ভালবাসার মানুষটিকে যখন নিজ চাওয়া-পাওয়ার সীমানার গণ্ডির ভিতর বেঁধে রাখতে চায় তখন সেই ভালবাসা পরিণত হয় “দাসত্ব”-এ। বল প্রয়োগের মাধ্যমে নিজ প্রয়োজন আদায় করতে চাইলে হাঙ্গামার সহিত দাসত্বের উপস্থিতি। আবেগ ও বিবেককে আলাদা করার জ্ঞান অর্জন না করে নতুন জীবন একসাথে শুরু করা নির্বুদ্ধিতা এবং শুরুতেই গলদ। স্বামীস্ত্রীর “বিরক্তি”, “সত্যবাদিতা” ও “সহনশীলতা”-র মাত্রাকে বিয়ের আগেই ভাল করে জেনে নিতে হয়। এই সম্পর্কে জ্ঞান পূর্ণতা না হলে, সেই দাম্পত্য জীবন টিকে না আর টিকলেও সারাজীবন উচ্ছৃঙ্খলতা, অস্থিরতা, অশান্তি লেগেই থাকে। প্রায় সকলেই এই ভুলটি করে থাকে।

ক্ষেত্র বিশেষে “আবেগ” অন্তরে কখনও ভাল লাগা এবং প্রশান্তির দরজা খোলে ভিতরে প্রবেশ করে আবার কখনও বোমা যার কোন বিচার করার ক্ষমতা নাই এবং যেখানে খুশী সেখানে বিস্ফোরণের মাধ্যমে মহা প্রলয় ঘটিয়ে দেয়। তাই খেয়ালের সহিত বিবেককে আবেগের নিরাপত্তা প্রহরী হিসেবে দণ্ডায়মান করে রাখতে হয়। আবেগ ও বিবেকের অসংখ্য ঘটনার মধ্যে মাত্র একটির ক্ষুদ্র অংশ উপরে উল্লেখ করা হলো। ধর্ম বিষয়ে যখন আবেগ ও বিবেক উত্থাপিত হয়, তখন খুব সচেতন ও সাবধানতা অবলম্বন করতে হয় নয়ত নিজের অজান্তেই নিজেকে ধ্বংসের জগতে প্রবেশ করানো হয়। আবেগ ও বিবেকের সংমিশ্রণ এবং পার্থক্যের জ্ঞান অর্জন প্রত্যেক ধার্মিকের জন্য বাধ্যতামূলক। এক শ্রেনীর ধান্ধাবাজ গুরু, পণ্ডিত, রাজনীতিবিদ, আলেম, পীর আবেগ ও বিবেককে একত্রিত করার মাধ্যমে অন্তর ওয়াশ ও ব্রেইন ওয়াশ করে ধর্মের নামে সন্ত্রাসী কর্মে লিপ্ত করে নিজেদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিল করছে।


পক্ষপাতিত্বঃ

সত্যকে গ্রহণ করার “সাহস” থাকতে হবে। সাহসকে প্রতিষ্ঠিত করতে হলে সৎচিন্তা, সৎকর্ম ও সুস্থ বিবেক থাকা চাই। সকল প্রকার পক্ষপাত থেকে অন্তরের পর্দা সরিয়ে নিজেকে পৃথক রাখতে হবে। নিরপেক্ষতা অর্জন করার মাধ্যমে “বাস্তব সত্য”-কে বিচার করতে চাইলে “চারিত্রিক বিশুদ্ধতা” ছাড়া উপায়ন্তর নেই। নৈতিকতা পক্ষপাতহীন হওয়ার বুনিয়াদ। সত্যতার সঠিক মূল্যায়নে আবেগ ও ভক্তিকে একপাশে রেখে নির্মোহ চিত্তে যথাযথ যাচাই করা লাগে। মানুষের সহজাত বৈশিষ্ট্য হলো, সে তার দুনিয়ার জগত সম্পর্কে যতটুকু যুক্তি, নিজের সৃষ্টিশৈলী গুণ, ক্ষমতার দ্বারা ব্যাখ্যা করে, সেই অনুসারে নিজ অনুভূতির সমন্বয়ে তার বিশ্বাস ও মতবাদ গঠন করে। আবার যে মতবাদ ও বিশ্বাসটা তার মধ্যে গঠিত হলো, সেই নেত্র দিয়ে জগতকে পর্যবেক্ষণ ও জগত সম্পর্কে জানার প্রক্রিয়া প্রভাবাচ্ছন্ন হয়। তার এই বিশ্বাস ও মতবাদের সহিত কামনা, বিদ্বেষ, হিংসার উপস্থিতি যদি থেকে থাকে (তা কম-বেশী যতটুকুই হোক), তবে সত্য হতে যেমন দূরে সরে যায় তেমনি বিচক্ষণতা অর্জনে বাধাপ্রাপ্ত হয়ে প্রজ্ঞার দরজা বন্ধ হয়। নিজের কৌতুহলী মস্তিষ্ক নিরপেক্ষ বিশ্লেষণে ব্যর্থ হয়। “হিংসা”-কে তৈরি ও মজবুত করে পক্ষপাতিত্ব। যারা সৃষ্টিকর্তাকে মানতে যারা চায় না, তারা Homo Habilis-কে মানবজাতির পূর্বপুরুষ মনে করে এবং যথাসাধ্য প্রমানের চেষ্টায় ব্যপৃত আর বিশ্বাসীদের দাবী, Homo Habilis-র পা ছিল ছোট এবং গাছে বাস করত। তারা সোজা হয়ে দাড়াতে পারত না। যার যেমন দৃষ্টিভঙ্গি। মানুষের স্বভাব-এর আরেক বৈশিষ্ট্য, সে নিজে পরাজিত হতে চায় না। অন্যকে হারিয়ে নিজে জিততে চাওয়া এটা সাধারন প্রবৃত্তি। আর পরাজিত হওয়া মাত্রই অন্তর বিদ্রোহ করা শুরু করে। বাস্তব যুক্তির দ্বারা তার বিশ্বাস ও মতবাদ ভুল প্রমাণিত হোক তা সে কখনই চাইবে না। সে তার বিশ্বাস ও মতবাদকে প্রতিষ্ঠিত ও শক্তিশালী করার জন্য সম্ভাব্য সকল প্রকার যুক্তি দাঁড় করাবে এবং যে যুক্তিগুলো তার বিপক্ষে যায় তা অগ্রাহ্য করবে। সময়ের ব্যবধানে নিজেই নিজের যুক্তিগুলোকে ধারালো করে এবং অজান্তেই যুক্তির পরিবর্তে কুযুক্তির উপর ঝুকে পড়ে। “প্রতিপক্ষের জ্ঞান কম বা অপব্যাখ্যা করেছে”- এমন মননের দ্বারা নিজেকে বুঝ দেয়। আত্মপ্রতারণা এভাবেই ব্যক্তির চিন্তা চেতনায় শক্তিশালী আসন গাড়িয়া লয়। বস্তুতঃ সত্যকে সন্ধান করার প্রচেষ্টা এখানেই শেষ। ভিতরের সততা ও নৈতিকতা দুর্বল বা মৃত্যু ঘটে। ফলে “সত্য”-কে গ্রহণ করার সাহস মানুষের অজান্তেই বিলোপ হয় আর সেই খেয়াল সাধারণদের দূরে থাক, পণ্ডিতেরও থাকে না।

সরলতাঃ
দুনিয়ার নাট্য মঞ্চে প্যারামিটারগুলোর সহিত সকল মানুষজন ভিন্ন ভাবে পরিচালিত ও প্রবাহিত। অন্তরের সকল প্যারামিটার গুলোর মধ্যে “সরলতা”-র মূল্য বেশী এবং গুরুত্বও অনেক। “সরলতা” একটি ফুলদানি, যেখানে দয়া, ভালবাসা, ক্ষমা, ধৈর্য, লজ্জাশীলতা, বিনয় ইত্যাদি ফুলগুলো একত্রে অবস্থান করে। চরিত্রবান হতে চাইলে প্রথমে অন্তরকে জটিলতার পাত্র থেকে সরলতার পাত্রে ধারণ করা লাগে এবং এর বিকল্প কোন পদ্ধতি দুনিয়ায় নেই।

পরিবারের উচ্ছৃঙ্খলতা, মাবাবার দাম্পত্য কলহ, ভাইবোনদের তিক্ততা, আত্মীয়-প্রতিবেশীদের হিংস্রতা, স্বার্থপরতা, অফিস বা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে নেই সাধুতা, সততা; নেই আন্তরিকতা… চারপাশে জটিলতা, কুটিলতা, কঠিনতা। সরল মানুষের জীবনে বহু ঘটনা ঘটে যা সম্পূর্ণ নির্দোষ হওয়া সত্ত্বেও সকল দোষ তার দিকে এবং সকলে তার বিপক্ষে অবস্থান নেয়। এই পরিস্থিতে সরল অন্তরধারী হওয়া কিভাবে সম্ভব? “ইচ্ছাশক্তি” ও “ধৈর্য” ব্যতীত এই পরিস্থিতে টিকে থাকা দায়। “প্রেম”; সৃষ্টিকর্তার সহিত সাক্ষাৎ হওয়ার আকাঙ্ক্ষা থেকে তৈরি হয় প্রেম, সেই প্রেম অন্তরকে সরলতার পাত্রে ধরে রাখে, পরেহেজগারী বানায়।

আজকাল সরলতার অন্তর-ধারীদের মন্দ অপবাদে ভূষিত করা হয়। অমুসলিমরা এবং অন্য সকল শ্রেণীর লোকেরা তো বটেই, ইসলামের অনুসারীরাও সরলতার অন্তর-ধারীদের হেয়, তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে। অধিকাংশ ইসলামের অনুসারীরা দুনিয়ার কামনায় একদিকে সরলতাকে ঘৃণা এবং এর থেকে দুরত্ব সৃষ্টি করে আবার অন্য দিকে প্রত্যেক ওয়াক্ত নামাযে প্রতি রাকাতে সিরাতা’ল মুসতাকি’ম চায়। মুসলিমরা নামাযের ভিতর কি উদ্দেশ্যে “সিরাতা’ল মুসতাকি’ম” চায়? ইহা অতীব দুঃখজনক এবং নির্বোধদের চিন্তা ও কর্ম। “সরলতা” উত্তম স্বভাব ও চরিত্রের মাপকাঠি- ইহা বেশীর ভাগ মানুষদের জানা নেই। সরলতা ব্যতীত আত্মজ্ঞানের পূর্ণতা ও সৌন্দর্য লাভ এবং ইবাদতে নিমগ্ন হওয়া যায় না। আধুনিক টেকনোলজির অপব্যবহার এক নির্বোধ বেহায়াপনা জেনারেশনের আভাস দেয় যা “সরলতা” থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন এবং জটিলতার দিকে বিশ্বকে ধাবিত করছে। এই নির্বোধ জেনেরেশন নিজেদের জীবনকে বানাচ্ছে ক্রীড়াকৌতুক আর সাথে বিলুপ্ত করছে নিজেদের “বিবেকবোধ”। রিপু নিজের উপর প্রভুত্ব করলে, সিরাতা’ল মুসতাকি’ম-র মূল্য নেই, হবেও না। বাস্তবতা নিয়ে জটিল চিন্তাভাবনার অনুপাতে দুশ্চিন্তা ধরে বসে আর দুশ্চিন্তা শরীরকে ধ্বংস করে সাথে অন্তরের পবিত্রতা নষ্ট করে। দুনিয়ার মানুষ জানে না, শান্তি কি? অথচ শান্তিকে পাওয়ার জন্য বয়ঃসন্ধি থেকে ছুটে চলছে। আত্মতৃপ্তি, বিলাসিতা-কে শান্তি মনে করে বিভ্রান্ত হচ্ছে। “শান্তি”-র অস্তিত্বটি সরলতার উপর নির্ভরশীল। উত্তম চরিত্র বা “সিরাতা’ল মুসতাকি’ম”-র অধিকারী হতে গেলে “সরলতা”-র বিকল্প নেই।

সরলতার শ্রেনী বিভাগ রয়েছে। সমাজে সাধাসিধে সকলেই সরল নন। বিচক্ষণতা ও সাবধানতার সহিত বহুল সৎ গুণের অন্তর ধারীগণ হচ্ছে প্রকৃত সরল আর হিংসুকরা কখনও সরল হতে পারে না। “হিংসা না করা” সরলতার প্রধান শর্ত। কুটিলতা ও সরলতা একটি আপরটি প্রতিপক্ষ।

পরিশেষঃ

প্রত্যেকের অন্তরে প্যারামিটার কেন এবং কিভাবে স্থাপিত হলো, প্যারামিটার কিভাবে কাজ করে, ইহা নিয়ে চিন্তা করা সকলের সত্তা-গত দায়িত্ব ও কর্তব্য। অন্তরে প্যারামিটারগুলো দুই স্তরে বা সারিতে বিদ্যমান। প্রথম স্তরে ধৈর্য, দয়া, লজ্জাশীলতা, নম্রতা, বিনয়ী, সরলতা, ক্ষমা ইত্যাদি আর দ্বিতীয় স্তরে হিংসা, কামনা, রাগ, বিদ্বেষ, অহংকার, লোভ, সন্দেহ ইত্যাদি। দ্বিতীয় দল খুব সহজেই প্রথম দলকে পরাজিত করে। কারন, দ্বিতীয় দলে “আত্মতৃপ্তি”-কে শক্তিশালী করা হয়েছে। উত্তম চরিত্রের গঠন বা সিরাতা’ল মুস্তাকি-মের অধিকারীরাদের দৃঢ়তার সহিত কঠোর অনুশীলনের ভিতর দিয়ে যেতে হয়। এখানে অলসতা ও অনুশীলনে নমনীয় করার সুযোগ নেই। হাঁসি, কান্না, আনন্দ, বেদনা ইত্যাদি প্যারামিটারগুলোর সৃষ্টি এই দুই দল থেকে। ক্ষুধা, ব্যথা, শারীরিক অসুস্থতা ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ প্যারামিটার অন্তরে বিদ্যমান যেগুলো “আমি” সত্তাকে বাঁচিবার উপায় করা হয়েছে।

প্রত্যেক মুসলিম পাঁচ ওয়াক্ত নামাযে প্রত্যেক রাকাতে দৈনিক কম করে হলেও বত্রিশ বার সৃষ্টিকর্তার কাছে সিরাতা’ল মুস্তাকি-মের আবেদন করে। PART-C তে উত্তম চরিত্র বা সিরাতা’ল মুস্তাকি’ম সম্পর্কে যা বলা হলো, তা একজন “মুসলিম”-র পরিচয় এবং মৌলিক গুণ। আরো স্পষ্ট করে বলা হলে “সিরাতা’ল মুস্তাকী’ম হচ্ছে কোন গুনাহ করার নিয়ত না থাকা”। মুসলিমগন নিজেদের চরিত্র সংশোধন না করে, শুধু নামায-রোজা করে জান্নাতের জন্য লালায়িত থাকলে- তা অজ্ঞতা এবং মূর্খামো ছাড়া আর কিছু নয়। জান্নাত এত সহজ নয়, যা মুসলিমসহ দুনিয়ার সকল মানুষ মনে করে।


PART-D
======
মোহাম্মদ(সা) তাঁর ব্যক্তিত্ব এবং স্ত্রী ও সাথীগণঃ
আচরণ ও কথার ব্যক্তিত্ব তিন স্তরের। ব্যক্তিত্বের প্রথম স্তর সমাজ, দেশ ও জাতির উদ্দেশ্যে। এই স্তরের ব্যক্তিত্ব দুনিয়া ব্যাপী পুরাটাই কৃত্রিমতা। রাজন্যবর্গ, রাজনীতিবিদ ও নেতৃত্বদানকারী এবং দুনিয়ার সকল খ্যাতিমান, বিখ্যাত, প্রসিদ্ধরা, রাষ্ট্রপ্রধান, মন্ত্রী পরিষদ, সচিব ইত্যাদি এই শ্রেনীর। ব্যক্তিত্বের দ্বিতীয় স্তর পরিবার, আত্মীয় ও প্রতিবেশীদের উদ্দেশ্যে। এখানে কৃত্রিমতা কম। দ্বিতীয় স্তরে একজনের স্বভাবের চেহারা অধিকাংশ বুঝা যায় কিন্তু অন্তর ও মস্তিষ্কের গভীরে আড়ালে থাকা সেটা সহজে বুঝা যায় না। ব্যক্তিত্বের তৃতীয় স্তর হচ্ছে নিজ বিবেকের দর্পণ যা আসল এবং প্রকৃত ব্যক্তিত্ব। এখানে শুধু “আমি”। কোন ভনিতা নেই, প্রতারণা নেই, মিথ্যে নেই। আমার সাথে আমি-র মোকাবিলা। কুচিন্তা, সুচিন্তা, গোপন কুকর্ম কিংবা কর্মের উত্তমতা, ভোজন বিলাসিতা, ভোজনের শিষ্টাচার, ঘরে অবসর সময়ে আচরণ ও দেহের অঙ্গভঙ্গি, জিহবার সংযম, কামভাবের অভিব্যক্তি, স্ত্রীর সাথে যৌনতার সময় অভিলাষের ধরণ, যার মাধ্যমে একজন পুরুষের অন্তরের গভীরের ভিতর থেকে ব্যক্তিত্বের শিষ্টাচার, সবই বিবেকের দর্পনে দৃশ্যমান। আর এই বিবেকের দর্পনের ব্যক্তিত্ব শুধু একজন ভাল করে জানে, সে হচ্ছে “স্ত্রী” বা “স্বামী”। একজনের চারিত্রিক সনদের ক্ষেত্রে দুনিয়ার সকলের সম্বলিতর চেয়ে অনেক বেশী গ্রহণযোগ্য ও মূল্যবান স্ত্রী-র সনদ। একজনের ব্যক্তিত্বের ভিতরের সত্যবাদিতা, রুক্ষতা, কর্কশতা, দয়া, ভালবাসা, লোভ, ত্যাগ, চিন্তা-চেতনা, অহংকার, হিংসা, বিনয় ইত্যাদি স্ত্রী ভাল করে জানে এবং চিনে। এই চারিত্রিক বিশুদ্ধতার পরীক্ষা সংসার জগতের ভিতর থেকে উত্তীর্ণ হতে হয়, সংসার বিরাগী হয়ে নয়। তৃতীয় স্তরের ব্যক্তিত্ব পবিত্র হলে প্রথম ও দ্বিতীয় স্তরের ব্যক্তিত্ব আপনাতেই প্রকৃত ও সত্য হয় আর তৃতীয় স্তর সঠিক না হলে প্রথম ও দ্বিতীয় স্তরে প্রতারণার দ্বারা পরিপূর্ণ। ব্যক্তিত্বের প্রথম স্তরে সকলেই সাধু হওয়ার ক্ষমতা রাখে আর তৃতীয় স্তরে অল্প কয়েকজন ব্যতীত দুনিয়ার প্রায় সকলেই সম্পূর্ণরূপে অকৃতকার্য ও নিষ্ফল।

সর্বোত্তম ব্যক্তি সেই, যার আচরণ সুন্দর, আখলাক সুন্দর। কথা বলা, অঙ্গভঙ্গি, কাজকর্ম সুন্দর। আর সর্বোত্তমদের মধ্যে যিনি শিখরে, তিনি হলেন সেই, যিনি নিজ স্ত্রী, পিতামাতা, সন্তানের সহিত উত্তম আচরণ করেন। স্ত্রী ও সন্তানদের কাছ থেকে ভালবাসা ও সন্মানের সর্বোচ্চতা অর্জন করতে পেরেছেন। পরিবারের সকলে সকলের প্রতি বিনয় ও নম্র। নিজ স্ত্রীর কাছে যে পুরুষ চারিত্রিক ভাবে বিশুদ্ধ ও উত্তম সে নিঃসন্দেহে দুনিয়ার মধ্যে উত্তমের উত্তম। নিজ স্ত্রীর কাছে শতভাগ চারিত্রিক বিশুদ্ধতা অর্জিত না হলে সেই পুরুষের ধর্মীয় মর্মবানী, প্রচার, প্রসার কোন কিছুই গ্রহণীয় ও মূল্যায়ন হবে না। আর এই সর্বোত্তমতার পরীক্ষায় নাস্তিক, সন্দেহবাদী, পুরোহিত, সন্ন্যাস, সংসারবিরাগী, পণ্ডিত, পীর, দরবেশ, অধিকাংশ সাধারণ মানুষজন ও আলেমরা ব্যর্থ ও বিফল।

ক) কোন ব্যক্তির স্বভাব বা চরিত্র কেমন তা সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য ও সঠিক সনদ দিতে পারেন স্ত্রী ও গৃহকর্মী; তারপর পরিচিত, প্রতিবেশী, আত্মীয়স্বজন ইত্যাদি। মোহাম্মদ(সা)-কে সর্বপ্রথম রাসূল হিসেবে মেনে নিয়ে মুসলিম হোন তাঁর স্ত্রী খাদিজা(রা)। তারপর পরিচিত সকলে যারা সর্বদা তাঁর সাথে ছিলেন। “রাসূল” এটা এমন একটি পদবী যেখানে কারো চরিত্রে অণু পরিমাণ সন্দেহ থাকলে দাবীদারকে কেহ গ্রহণ করবেন না, হোক সে স্ত্রী, সন্তান, পিতামাতা, বন্ধু বা যে কেহ। মোহাম্মদ(সা)-র স্ত্রী যদি সর্বপ্রথম মোহাম্মদকে “রাসুল” হিসেবে স্বীকৃতি না দিয়ে মুসলিম না হতেন তবে তিনি বিশ্বে রাসুল হিসেবে কারো কাছে গ্রহণযোগ্য হতেন না।

খ) মক্কা বিজয়ের পর আরব ভূখণ্ডের সকলে স্বেচ্ছায় দলে দলে ইসলাম গ্রহণ শুরু করে। আরবের যারা ছিলেন মোহাম্মদ(সা)-র ঘোর বিরুধী, হিংস্রতার চরমতা প্রকাশ করেছিল, মোহাম্মদ(সা) ও তাঁর অনুসারীদের চিরতরে খতম করে দেওয়ার দৃঢ় প্রতিজ্ঞ ছিল তারা সকলেই ইসলাম গ্রহণ করল। তারা নিজেদের নির্বুদ্ধিতা ও পক্ষপাতিত্বের ভুল অর্থাৎ অন্তরের পর্দা দূরীভূত করতে সক্ষম হলো। আরবের এই বিশাল সংখ্যক জনগোষ্ঠীর কারো অন্তরে মোহাম্মদ(সা)-র চরিত্র ও স্বভাব সম্পর্কে অণু পরিমাণ সন্দেহ ছিল না। সকলেই তাঁকে “সত্যবাদী” ও “পবিত্র অন্তরধারী” হিসেবে চিনে এবং জানে। সকলের মধ্যে কারো অন্তরে অণু পরিমাণ সন্দেহ থাকলে অবশ্যই তাঁকে রাসুল হিসেবে মেনে নিয়ে “ইসলাম” গ্রহণ করত না।

গ) একজন রাসূলকে চরিত্রের সকল শাঁখায় বিশুদ্ধতার মানদণ্ডে কষ্টিপাথরে পরীক্ষা দিয়ে উত্তীর্ণ হতে হয়। হাজার লক্ষ অনুসারী সর্বদা তাঁর সাথে উঠবস করত। সারা জীবনে যদি তাঁর চরিত্রে একটা মিথ্যা বা ছলনা বা প্রতারণা বা অঙ্গীকার ভঙ্গের ঘটনা ঘটত তবে সর্বদা ঘিরে থাকা অনুসারীরা তাঁকে ধরে ফেলত এবং কেহ রাসূল হিসেবে মেনে নিত না। উনি ছিলেন সত্যের সাধক, সত্য প্রতিষ্ঠিত করতেই দুনিয়ায় তাঁর আগমন। দুনিয়ার কোন ধর্ম প্রচারক এমন সূক্ষ্মভাবে পরীক্ষার সম্মুখীন হোন নাই। এমন একটি মানুষ নিজেকে “আল্লাহ্‌র রাসূল এবং এই কোরআন আল্লাহ্ নাজিল করছেন” দাবী করে মিথ্যা বলবেন? - এর সত্যতা যাচাই করার জন্য তুমি নিজেই যথেষ্ট এবং কারো কাছে জিজ্ঞেসা করার প্রয়োজন নেই।

কারোর স্বভাব, চরিত্রে কুৎসিত রূপ মিথ্যা, লোভ, হিংসা, প্রতারণা দেখে ফেললে বা প্রকাশ হলে তাকে আর সন্মান ও ভালবাসা যায় না- এর চেয়ে বড় সত্য আর কি। আর যিনি রাসুল তার স্বভাব, চরিত্রে কুৎসিত অনু পরিমান প্রকাশ পেলে তাকে কখনই “রাসুল”-র স্বীকৃতি দেওয়া যায় না; কেহ “রাসুল” হিসেবে মেনে নিবে না।

ধৈর্যঃ

দুনিয়ার সকলে “আরামের পাত্র”-র দাস। যে এই দাস থেকে নিজেকে মুক্ত করতে পেরেছে, সে-ই সফলকাম। মানুষজন জন্ম থেকে অন্তরকে আরামের ভিতর রাখতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে, আরামের ভিতর আবদ্ধ থাকার উদ্দেশ্যে নেশার সহিত মোহিত। আকর্ষণ, কৌতূহল, খেলার ছলে জীবনের প্রাথমিক অংশটুকু অতিবাহিত হয়। বয়ঃসন্ধিতে সকল প্যারামিটার পরিপূর্ণতার সহিত স্বরূপে বিকাশ ঘটে। আম গাছ সারাবছর সোজা হয়ে থাকে কিন্তু যখন মৌসুমে আম ধরে তখন ভারে নুইয়ে পড়ে। বয়ঃসন্ধির পর প্যারামিটারগুলোর পরিপূর্ণতার কারনে ভারে অন্তর তার নিজ স্বরূপ বিঘ্নিত এবং নুইয়ে পড়ে বা সংকুচিত হয়। এই সংকোচন অন্তরে জালাময়ীতার তিক্ততা সৃষ্টি করে। এই তিক্ততা হলো “বিষাদ”। এই বিষাদের উপর অন্তর দাঁড়িয়ে থাকতে চায় না। ছোট বেলা থেকে পারিবারিক শিষ্টাচারের শিক্ষা ব্যতিত এই বিষাদকে মোকাবিলা করা যায় না। যে সকল পরিবার উচ্ছৃঙ্খল বিশেষকরে পিতামাতার আচরণ উগ্র, সেসকল পরিবারের সন্তানরা এই বিষাদকে মোকাবিলা করার রাস্তা জানে না। ফলে নিজ অন্তরের বিষাদের আগুনের ভিতর পারিবারিক, সমাজ, রাষ্ট্রের উচ্ছৃঙ্খলতার আগুন যোগ হয়ে অঙ্গার করে। অন্তরের এই অঙ্গার থেকে বাঁচার জন্য রাস্তা খোঁজে কিন্তু সঠিক রাস্তা জানা না থাকায় নিজ রিপুর গোলাম হয়ে যা ইচ্ছা তাই করে। সন্তানেরা পিতামাতার উপদেশকে গ্রহণ করে না, গ্রহণ করে মাতাপিতার আচরণকে, পিতামাতা একে অপরের সাথে কিভাবে কথা বলে সেই কথার ধরণের উপর নির্ভর করে সন্তানরা শিষ্টাচার সম্পন্ন হবে কিনা এবং সন্তানদের বিচারবোধ, স্বভাব-চরিত্র কেমন হবে। লজ্জাশীলতা চরিত্রগঠনের খুবই গুরুত্ব ও মূল্যবান। বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকর্ষন হওয়ার প্যারামিটার এমনিতেই ধারালো আর অন্তরের অঙ্গার থেকে বাঁচার জন্য আরো ধারালো হয়ে উঠে। জীবন সুস্থ ও সুন্দরভাবে পরিচালিত করার ভালমন্দ বুঝার যে জ্ঞান সেটা বুঝার আগেই জীবনের সবকিছু হারিয়ে বসে। অন্তরের বিষাদ থেকে বাঁচার জন্য সবচেয়ে ভয়াবহ হচ্ছে “খেয়ালখুশী”। ইন্টারনেট, মিডিয়া, ডিসকো, স্মার্টফোন, খোশগল্প, কোকেন, এলকোহল জাতীয় নেশাদ্রব্যের ভিতর ডুবে থাকা। অন্তরের খেয়ালখুশীর জগত বৃহত্তর ও ব্যাপক। কলমের কালির দ্বারা খেয়ালখুশী জগতের সীমানা প্রকাশ করা যায় না। অন্তরের ডাইমেনশন ও কলমের ডাইমেনশন ভিন্ন।

অন্তরের আরামের পাত্র ব্যতীত আরো অনেক পাত্র রয়েছে; লোভের পাত্র, বিদ্বেষের পাত্র। বিদ্বেষের পাত্র আরো ভয়ানক। খুন, প্রতিশোধ, অন্যের ক্ষতি করার জন্য সর্বদা মশগুলে থাকা। অন্যকে ধ্বংস করে নিজের জিদ ও হিংসার আত্মতৃপ্তিতে কিভাবে বিভোর হবে সেই পেরেশানীর ভিতর নিমজ্জিত। অতীতের সুসম্পর্কের মানুষগুলো যখন বৈরীতে পরিণত হয়, তখন তাকে কিভাবে কি করলে বা কথার দ্বারা কাবু করলে নিজের ফায়দা হত সেই চিন্তায় মশগুল আর এভাবেই নিজের ভিতর হিংস্রতাকে আরো ধারালো ও মজবুত করে। হিংসার পাত্র একটি জলন্ত কারখানা। এই কারখানা নিজে জ্বলে এবং নিজেই নিজের পাত্রকে বৃহত্তর ও তীক্ষ্ণধার করার সাথে ক্রোধ, লোভ, অহংকারের জগতও বৃহত্তর করা শুরু করে। এরা সমাজে সুশীল হিসেবে নিজেকে জাহির করলেও প্রকৃতপক্ষে এরা মানসিক বিকারগ্রস্থ। আর এদের একটা সংখ্যা দেশ ও জাতি পরিচালিত করছে বিশেষ করে যারা উন্নয়নশীল দেশ গণতন্ত্রের নামে পরিচিত। অর্থ ও ক্ষমতার অধিকারী হলে এই শ্রেনীর মানুষ উচ্ছৃঙ্খলতার দানব থেকে মহাদানব হয়ে উঠে।

ধৈর্য ও ধৈর্যের পাত্রঃ- অন্তর জ্বালা; চারিপাশে অসুস্থ মানুষদের কথা, আচরণ, কর্মের দ্বারা অন্তর আগুনে বিরামহীন জ্বলে। চারিদিক থেকে হিংস্র আক্রমণ। এই জ্বালার ভিতর থাকা অবস্থাতে অন্তরে অনুভূত হয় কখনও বিষময় আগুনের ঘূর্ণিঝড়, কখনও মরিচ বোম, কখনও বন্দুকের গুলি, কখনও ঠাসন, কখনও সোপারনোভা বিস্ফোরণের রূপ নেয়। স্বামীর লাম্পট্য, লুচ্চামি, কর্কশতা ও পিশাচী স্বভাব স্ত্রীকে আত্মহননের দিকে ঠেলে দেয়। ইহা হচ্ছে বিষময়ের “বিষ”। অন্তরে এই বিষ তৈরি হলে বা বিষের সংস্পর্শে আসলে, “অস্থিরতা”-র আরেক বিষ তৈরি হয় যা অন্তরের ভিতর আগুনের আলোড়নে আন্দোলিত হওয়ার তীব্রতা আরও বাড়িয়ে দেয়। অন্তরের ভিতর অস্থিরতার বিষের আগুনের এই আলোড়নের আস্বাদনের সৃষ্টির শুরু হলে, এই আলোড়নের জ্বালাময়ীতার দরজা বন্ধ করে অন্তরকে কোমলতার পাত্রে ধারণ করার যে শক্তি বা বল ভিতর থেকে প্রয়োগ করে নিজের সাথে নিজে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়, তা-ই হচ্ছে “ধৈর্য”। আর এই যুদ্ধে দুনিয়ার বেশীরভাগ মানুষজন পরাজিত। আলোড়নের সময় অন্তর বিষের লেলিহান আগুনে জ্বলতে থাকবে কিন্তু চেহারা, শরীর, আচরণ, কথায় থাকবে কোমলতা ও বিনয়। নিজের দুঃখ-কষ্ট কখনই প্রকাশ নয়, হা-পিত্যেশ নয়, আফসোস নয়, অভিযোগ নয়, ভাগ্যকে দোষারূপ নয়, প্রতিশোধ নয়, কটু বাক্য প্রয়োগ নয়, অন্যকে তিরস্কার করে নয়, জিনিসপত্র ভাঙ্গাভাঙ্গি নয়। নীরবতার সহিত অন্তরের বিষের বিরুদ্ধে যুদ্ধের মোকাবিলা। এই বিষ দুনিয়ার বেশীর ভাগ মানুষের নিজ কর্ম থেকে সৃষ্ট আর কিছু আছে প্রকৃতি ও ভাগ্য। এই যুদ্ধে জয়ীরা হলেন বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী ও সাহসী। সংসারে ও চারপাশে যে সকল কারনে বিষের সৃষ্টি তার কারন বুঝতে পারা জ্ঞানীদের পরিচয়। এই আবিষ্কারের মাধ্যমে নিজেকে প্রস্তুতি ও যুদ্ধ মোকাবিলা করার দৃঢ়তা গ্রহণ করতে হয়। এই যুদ্ধে যারা বারংবার শুধু পরাজিত হয়, চেষ্টা করেও সাফল্য না পায়, তারা এই যুদ্ধ মোকাবিলা করার পূর্বে “ক্ষুধা”-র কষ্টকে নিয়ন্ত্রণ করলে সহজতর হয়। শান্তিপ্রিয় মানুষজন ধৈর্যের অনুশীলনের মাধ্যমে ধৈর্যের পাত্র তৈরি করে এবং অন্তরকে সেই পাত্রে ধরে রাখে। একবার ধৈর্যের পাত্র তৈরি হয়ে গেলে তারপর যুদ্ধ মোকাবিলা করতে সহজ হয়। আবার অনেকে পরিস্থিতির শিকার হয়ে, সময়ের প্রয়োজনে অন্তর জ্বালা আস্বাদন করে কিন্তু ইহা ধৈর্য নয়। কারন, এই জ্বালা আস্বাদনের সাথে থাকে জিদ, কামনা বা কোন লক্ষ্য হাসিলের উদ্দেশ্যে। ধৈর্যের পাত্রে অন্তর যেমন তিক্ততার স্বাদ গ্রহণ করে, তেমনি রয়েছে এর মিষ্টতা। মিষ্টতার কারণেই ধৈর্যধারণকারীরা সেরা সাফল্যে সাফল্যিত হোন। এই মিষ্টতার স্বাদ খুব কম মানুষই গ্রহণ করার সুযোগ পায়। দুনিয়ার সকল জ্ঞানের মধ্যে কমবেশী ভেজাল আছে কিন্তু ধৈর্যের দ্বারা অর্জিত জ্ঞান শতভাগ খাঁটি ও ভেজালমুক্ত।

সমাজের ভেজাল ও হিংসুকরা যাদের পরিবর্তন হওয়ার কোন আশঙ্কা নেই তাদের থেকে দূরে থাকা উত্তম। চারিত্রিক বিশুদ্ধতা নিজ স্বভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে চাইলে ধৈর্যের নৌকায় সরোয়ার হতে হয়। শক্ত হাতলে ধরে দৃঢ়তা অবলম্বন করতে হয়। মূর্খরা অর্থের অধিকারী হলে সর্বক্ষেত্রে, সর্ব কাজে, সর্ব জায়গায় নিজেদের যোগ্য মনে করে। মূর্খদের নিকট হতে ও তাহাদের বৃথা উক্তি হতে দূরে থাকা জ্ঞানীদের কর্ম ও বিদ্যানদের স্বজ্জা। যখন কোন মূর্খ মন্দ বলে ধৈর্যের সহিত ধীর মনোবলের সহিত তার ব্যাপারে নীরবতা অবলম্বন করা, কারন তার অবজ্ঞা ও কটুক্তির যেটুকু বাকী রয়েছে তা বৃহত্তর ও ব্যপক।

শান্তিঃ

দুনিয়ার সকল প্রতিভার মাঝে সর্বশ্রেষ্ঠ প্রতিভা হচ্ছে নিজের শান্তি নিজে বের করা। দুনিয়ার মানুষজন মৃত্যু অবধি “শান্তি”-কে পাওয়ার নেশায় ছুটে চলে। চাকরী করছে, ব্যবসা করছে, বিয়ে করছে, স্ত্রী-সন্তান বানাচ্ছে, অর্থ-সম্পদ গড়ছে, রিপুর অনুসারী হয়ে কামনাকে বাস্তবায়িত করছে, বিত্তের পাহাড় বানাতে মনোনিবেশ করছে, অট্রেলিকা তৈরি করছে… কিন্তু তারপরেও শান্তি নাই। পেরেশানী ও উদ্বিগ্ন। চাই, আরো চাই… আরো চাই…। অঢেল অর্থ, যশ-প্রতিপত্তি, বিলাসিতা, সন্তান-সন্ততি তারপরও ব্যস্ততার শেষ নেই, দুশ্চিন্তায় ঘুম নেই। মাদক, এলকোহল, যৌণতা, ক্লাব, ডিসকো, বিনোদন… না, কিছুতেই শান্তি নেই। সন্তান আছে কিন্তু তাদের সাথে যোগাযোগ নেই, অর্থ-ক্ষমতা-প্রতিপত্তি সবই আছে কিন্তু তারপরেও কিছুই নাই। এক “মহাশূন্যতা” অন্তরকে চেপে ধরে আছে। নিঃসঙ্গতা এক ভয়ানক কষ্ট যার ভিতর নিমজ্জিত। অত্যাধিক পেরেশানীতে, একাকীত্বে থাকা অনেকেই আত্মহননের চিন্তা করে এবং করেও বসে। দরিদ্র দেশগুলো থেকে উন্নত দেশগুলোতে এই প্রবণতা আধিক্য। যদি জিজ্ঞেসিত হয়, “শান্তি কি”? তবে তারা নিশ্চুপ এবং অপারগতা প্রকাশ করে শান্তিকে সংজ্ঞায়িত করতে। আবার কম জানা বা অভাবীরা ক্ষমতা, বিলাসিতা, অধিক অর্থ-সম্পদ, সুন্দরী রমনী, পুত্র সন্তান ইত্যাদিকে শান্তি দাবী করে। এদের বুঝানো কঠিন যে এইগুলো শান্তি নয়। আত্মতৃপ্তি ও শান্তি ১৮০ ডিগ্রী পার্থক্য, এই বুঝটুকু খুব কম মানুষের। নিজের বিদ্যা, বুদ্ধি, জ্ঞান, অর্থ-বিত্ত, সামাজিক স্ট্যাটাস, বিলাসিতার জীবন অন্যদের দেখিয়ে, অন্যদের সাথে নিজের তুলনা করে আত্মতৃপ্তির জগতে বিচরণ আর মানুষের কাছে প্রমান করার চেষ্টায় ব্যাপৃত কতই না সুখে-শান্তিতে আছে আর ইহা যে মানসিক বিকারতা- সে বুঝ নেই। নিজেরা নিজেদের রিপুর দ্বারা শান্তির দরজা সবলে বন্ধ করে রেখেছে। দুনিয়ার বেশির ভাগ মানুষদের সুস্থ জীবন ধারণ করার সিস্টেম জানা নেই।

“শান্তি” সম্পূর্ণ অন্তরের ভিতরের সহিত সম্পর্কিত। যাদের অন্তরে শান্তিতে নাই তারা “লোক দেখানো”-তে মজায় মেতে থাকে। সম্মুখে কথা বলা বা সমীহ করার সময় অন্তরে ভালবাসা বিদ্যমান থাকলে সেটা সন্মান আর ভালবাসা না থাকলে সেটা তোষামোদ এবং “উদ্দেশ্য” হাসিলের উদ্দেশ্যে সমীহ করে যা চারপাশে লক্ষিত। মানুষদের মাঝে কেহ হিংসার ভিতর থেকে পৈশাচিক আনন্দে মেতে উঠে, নিজের চাওয়া-পাওয়ার কাছে জগত অতীব তুচ্ছ, মানবতা যেখানে মূমুর্ষ, পরিবার যেখানে অবহেলিত। অন্যের ক্ষতি করার মাধ্যমে, অন্যকে হেয় করে, দাবিয়ে রেখে নিজেকে বড় মনে করা এবং আত্মগরিমার ভিতর মজে থাকার মধ্যে শান্তির অস্তিত্ব নাই। “চাই... আরো চাই... আরো চাই...” এই চাওয়ার আগুণ অন্তরে প্রবেশ করলে শান্তির দরজা ঐ অন্তরের জন্য চিরতরে বন্ধ। একই রকম হিংসুক, অহংকারী, লোভীদের অন্তরধারীদের।

বিবেক তৈরি হয় অন্তর ও জি-সত্তার প্যারামিটারের কম্বিনেশনে আর বিবেকের কার্যকারিতা ধারালো ও বলিষ্ঠ হয় অন্যের আচরণ পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে। অন্যের কাজকর্ম ও কথার ধরণ দিয়ে নিজেকে সংযত করা। বিজ্ঞতা, অর্থের বড়াই, বিলাসিতার ভাব নেয়ার সাথে ভোগ করলেই হবে না, হতে হবে জাকজমকপূর্ণ ও প্রদর্শনযোগ্য। এই ভাব ও ভোগ যারা দেখায় তা স্বাভাবিকভাবে অন্যের ভাল লাগার কথা না। যখন নিজের জীবনে বড় সাফল্য আসে তখন “বিবেক” বোধ প্রয়োগ করে উচ্ছাস প্রকাশ করা থেকে নিজেকে বিরত রাখে। নিজের কৃতিত্ব ও মোহড়া নেওয়াটা অবিবেচক এবং অসংবেদনশীল মনে করে। বিবেকের কারনে নিজেকে সংযত রাখে। প্রতিদ্বন্দ্বীদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়, নিজে বিনয়ী হয়। “বিবেক” তীক্ষ্ণ করার ইহা একটি প্রসেস।

শান্তি তিন স্তরের। পরম শান্তি, প্রকৃত শান্তি, দুনিয়াবী শান্তি। যে যেই স্তরে নিজের “আমি”-কে মেলে ধরে সে সেই স্তরের শান্তি অন্তরে অনুভব করে। অন্তরের ডাইমেনশন ও মহাবিশ্বের ডাইমেনশন ভিন্ন ও আলাদা কিন্তু দেহ এবং দেহের মাধ্যমে ক্ষুধা, জৈবিক চাহিদা, মায়া, চিন্তা ইত্যাদির মাধ্যমে অন্তরকে মহাবিশ্বের পদার্থের সহিত সংযুক্ত করা হয়েছে। জীবন সংগ্রামের ভিতর অন্তরকে আবদ্ধ করে “আমি”-কে দুনিয়ার ভিতরে নিয়োজিত করা হয়েছে। এটা মহা পরাক্রমশালী সর্বজ্ঞের ব্যবস্থাপনা। অখিল স্রষ্টার কারিশমার ক্ষমতাকে খুব কম মানুষই অনুধাবন করে।

পরম শান্তি অনুভূত হয় পরম আত্মার সান্নিধ্যে। আধ্যাত্মিক স্তরে পরম আমি-র উপস্থিতিতে পরম শান্তি অন্তরকে আচ্ছাদিত করে। এই শান্তি এমন এক অনুভূতি যেখান থেকে কেহ দুনিয়ার জীবনে ফিরে আসতে চাইবে না; এমনকি মহাবিশ্ব পরিমান ক্ষমতা, স্বর্ণ, প্রখর যৌনশক্তির সহিত সুন্দরী রমণীদের দেওয়া হলেও কেহ এইগুলো চাইবে না, সে পরমাত্মার সহিত পরম শান্তির সহিত থাকতে চাইবে। দুনিয়ার সকল মানুষ একই সাথে পরম আধ্যাত্মিকতার উদ্দেশ্যে ধ্যানে মগ্ন হলে খুব অল্প সংখ্যকই পাওয়া যাবে, যারা পরম আত্মার সান্নিধ্যে গিয়ে পরম শান্তিকে অনুভব করতে সামর্থ্য হবে। পরম শান্তির উপরেও আছে “পরম পরম…… শান্তি”। তবে সেখানে দুনিয়ার কেহ পৌঁছানোর ক্ষমতা রাখে না। আধ্যাত্মিকতার সমাপ্তি পরমাত্মা পর্যন্ত। যারা পরমাত্মার স্তরে পৌছাতে পারে তাদের কেহ বুঝতে পারে পরম শান্তির উপরেও আরো উপরের স্তর রয়েছে আর সেই স্তর মৃত্যুর পর্দার দিয়ে ঢাকা। পরমাত্মার স্তরে “আমি” ও “সত্য”-র রহস্যের দ্বার খুলে।

প্রকৃত শান্তি অনুভূত হয় জাগ্রত অবস্থায় নিজের “আমি”-র সত্তার সান্নিধ্যে। “আমি” এই মহাবিশ্বের সবচেয়ে সুন্দর ও শান্তিময়। অন্তরের প্যারামিটারগুলো বাধাগ্রস্থ করে এই সুন্দর ও শান্তিকে অনুভব করতে। অন্তরের বদ প্যারামিটারগুলো সম্পূর্ণরূপে নিস্তেজ না হলে এই সান্নিধ্যে যাওয়া যায় না। জীবন সংগ্রামের ভিতর থেকে এই স্তরে নিজেকে নিয়ে যেতে হয়।

মারিয়ানা ট্রেঞ্চ সমুদ্রের গভীরতম স্থান। ১১.০৩৩ কিমি গভীর এবং চির অন্ধকার। ফ্ল্যাট ফিশ, আই ফিশ, ড্রাগন ফিশ, ডাম্বো অক্টোপাসদের বসবাস ঐ অঞ্ছলে। এই মারিয়ানা ট্রেঞ্চে বসবাসরত প্রানীরা জানে না এগার কিমি উপরে পানির সারফেইসের উপর দীপ্যমান এক সূর্য রয়েছে। মানব জাতির সকলেই দুনিয়ার পৃষ্ঠে অবস্থান করলেও অর্থ, ভোগ, হিংসার কারনে সকলেই মারিয়ানা ট্রেঞ্চের ন্যায় চির অন্ধকারে নিমজ্জিত। অন্তর চির অন্ধকারের ভিতর থাকার সবচেয়ে বড় কারন হচ্ছে “কামনা” এবং “মায়া”। লোভ, হিংসা, কামনা, অহং ইত্যাদি প্যারামিটারগুলো সম্পূর্ণ নিস্তেজ না করলে অন্তর “আমি”-র স্তরে পৌছে প্রকৃত শান্তির সান্নিধ্যে আসতে পারে না। আর এই প্যারামিটারগুলোর ওজন অত্যাধিক। অন্তর সম্পূর্নরূপে ওজনমুক্ত ও পবিত্র না হলে আমি-র সান্নিধ্যে আসতে বাধাগ্রস্থ হয় ও প্রকৃত শান্তির দরজা বন্ধ থাকে। যার লোভ, হিংসা, কামনার পরিধি ও জগত যত বড় তার অন্তর তত বেশী অন্ধকারে নিমজ্জিত। জীবন নির্বাহ করতে হবে প্রয়োজনের উপর ভিত্তি করে কিন্তু কামনা, হিংসা, লোভের বশবর্তী হওয়ার মানে হলো নিজের শান্তি নিজেই ধ্বংস করা।

দুনিয়াবী শান্তি অন্তরের ভাল প্যারামিটার মাধ্যমে প্রকাশিত এবং সৎকর্ম, উৎকৃষ্ট কথা ও উত্তম চিন্তার সহিত সম্পর্কিত। “সৎ উপার্জন” ও “সৎ জীবনযাপন” অন্তরে প্রশান্তি সৃষ্টি করে। সন্তান মাবাবার অনুগত হলে ইহা এক প্রশান্তি। সন্তান আচরণ ও কথার মাধ্যমে বিবেকসম্পন্ন শিষ্টাচার প্রকাশ করার সাথে প্রতিবেশী, আত্মীয় সকলের কাছে গ্রহনযোগ্যতা তৈরি করলে- ইহা মাবাবার শান্তি। স্বামী-স্ত্রী “তাকওয়া”-র ভিতর অবস্থান করলে সেই স্বামী-স্ত্রী দুজনের শান্তি। অন্যের কষ্টকে হৃদয়াঙ্গম করার মাধ্যমে ক্ষুধার্তকে খাবার দিয়ে ক্ষুধা নিবারণ করা হলো শান্তি। অসহায় পরিবারকে দান করার মাধ্যমে রিজিকের ভরণপোষণের স্থায়ীভাবে ব্যবস্থা করে দেওয়া হলো শান্তি। আর সেই দান গোপন ভাবে করা আরো উত্তম। নিজ আচরণ ও পরোপকারের মাধ্যমে মানুষের ভালবাসা অর্জন হলো শান্তি। মোক্ষম সময় ও সুযোগ থাকা সত্ত্বেও প্রতিশোধ না নিয়ে ক্ষমা করে দেওয়া হলো শান্তি। স্ত্রীর নম্রতা ও বিনয় স্বামীর জন্য শান্তি, স্বামীর নম্রতা ও বিনয় স্ত্রীর জন্য শান্তি।

সরলতা ব্যতীত শান্তি আসে না আর কঠোর অন্তরধারীদের অন্তরে শান্তি প্রবেশ করে না। তেমনি ভোগ-বিলাসী লোকদের অন্তরে শান্তি প্রবেশ করে না। শান্তিপ্রিয় মানুষজনের বৈশিষ্ট্য হলো, ক্রোধের সময় ক্ষমা করে আর চরম দরিদ্র ও কষ্টের সময় কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে।

সমতাঃ

সকলের অধিকার ও সুযোগ নিশ্চিত করার সিস্টেম হলো “সমতা”। সমতার আরেক অর্থ সুষম বণ্টন। সমতার এই কথাগুলো দুনিয়া কেন্দ্রিক হলেও, জন্মগত ভাবে দুনিয়ার কেহ সমতার সহিত জন্মায় না। “জন্মগত সমতা” সৃষ্টিকর্তার পূর্ব নির্ধারিত। দুনিয়াতে প্রত্যেকের আগমনের কারন পিতামাতা হলেও ইহা সৃষ্টিকর্তার পূর্ব ফয়সালা। হাজার বছর আগে বা পরে, স্ক্যান্ডিনেভিয়ায় বা আফ্রিকায়, পুরুষ বা মহিলা, লম্বা বা খাট; সাদা চামড়ার বা কালো, জন্মান্ধ বা খোঁড়া, বিলাসিতা বা দরিদ্রতায়… অর্থাৎ দুনিয়ার আগমনের বিষয়ে কারো কোন অভিযোগ বা দোষারোপ করার সুযোগ নেই। যাকে যেই অবস্থান দেওয়া হয়েছে তাকে সেই অবস্থান থেকে জীবন সংগ্রাম ও কর্তব্য পালন করে লড়তে হবে। কেহ নিজের অবস্থানকে দোষারূপ করলে, সে সংসারের আবর্জনা(হাঙ্গামা, বিড়ম্বনা) থেকে নিজেকে মুক্ত রাখতে ক্ষমতাপ্রাপ্ত হয় না। আর কেহ সংসারের অবর্জনা থেকে ইচ্ছা বা অনিচ্ছায় নিজ-কে দূরে রাখে, তার চিন্তা ও কর্ম অসম্পূর্ণ আর এই অসম্পূর্ণতার জন্য অশান্তি, অস্থিরতা সর্বদা লেগেই থাকে।

দুনিয়ার জীবনে সমতার প্রয়োগ করা যেমন জটিল, তেমন কঠিন। যারা সমতার অনুশীলন ও দায়িত্বে নিয়োজিত তারা জানে এই জটিলতা ও কঠিনত্বের স্বাদ। বিচক্ষণ ও প্রজ্ঞার অধিকারীদের এই সমতার দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে নাকাল হতে হয়। সকলকে সন্তুষ্টিতে রাখা অতিশয় কঠিন এবং মানব ইতিহাসে প্রায় সকল শাসক ও রাষ্ট্রপ্রধান সম্পূর্ণরূপে অকৃতকার্য। সম বণ্টন ও অধিকার থেকে বঞ্চিত হলে তৈরি হয় ক্ষোভ এবং তা থেকে বিদ্রোহ; অতঃপর বিভাজন যার শিকার হয় পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র। উচ্ছৃঙ্খলতা, হিংসা-প্রতিহিংসা, প্রতিশোধ পরায়নতা এবং সবশেষে যুদ্ধ যার পরিণতিতে ভোগান্তি, নির্যাতন, অমানুষিক পরিশ্রম, হত্যা, গণগত্যা, গুম, সম্পদ ধ্বংস… যা দুনিয়া বিনাশের আরেক দিগন্ত। পরিবারের কর্তা যখন সুষম বন্টনে কম-বেশী করেন, শুরু হয় উচ্ছৃঙ্খলতা ও উন্মাদনা এবং পারিবারিক বন্ধনের ভঙ্গুরতা সাথে ঝগড়া, ছলনা, বঞ্চনা। সমাজপতি এবং রাষ্ট্রপ্রধানদের এই ভুল হয় আরো বৃহত্তর এবং ভুলের ফলাফলও ভয়ানক।

একজন স্বামী তার নিজ স্ত্রীর প্রতি দায়িত্ব ও আচরণের দ্বারা সুন্দর চরিত্র ও স্বভাব প্রকাশ করে। স্ত্রীর প্রতি ভালবাসা ও কর্তব্যের উদ্যমশীলতা যা শান্তিপ্রিয়তা ও নম্র অন্তরের পরিচয়। যখন একজনের পরিবর্তে দুই স্ত্রী হয় তখন “সমতা”-র এক অগ্নি পরীক্ষার সম্মুখীন হতে হয়। স্বামীর প্রতি একজনের ভালবাসা, যত্ন, দৃষ্টিভঙ্গি অন্তরে অনুভূতির তারতাম্য ঘটায়। এই তারতম্যের কারনে আবেগের ভালবাসা একজন স্ত্রীর প্রতি কমবেশী হলে সেখানে কিছুই করার থাকে না। কিন্তু সমতার ক্ষেত্রে দুই জনকে সমভাবে বিচার করতে হয়। বাসস্থান, পোশাক, অর্থ, খাবার, যৌনতা, সামাজিকতা, শারীরিক ও মানসিক দায়িত্ব ইত্যাদির সবকিছু সমবন্টন যা অত্যন্ত কঠিন। অন্তরের আকর্ষন, দুইজনের মধ্যে একজনের প্রতি দূর্বল করে দেয়, হোক তা যৌনতায় বা অন্য কিছুতে আর ইহাই বাস্তবতা। এই বাস্তবতার পর্দা ভেঙ্গে “সমতা”-কে প্রতিষ্ঠিত করবে, এত শক্তির অধিকারী হয়ে উত্তীর্ণ হওয়া শুধুমাত্র মহাপুরুষগণ ব্যতীত আর কারো পক্ষে সহজ নয়। বিবেকের পরিবর্তে আবেগ দিয়ে সমতাকে বিচার করলে সেখানে ভয়াবহতা ও ধ্বংস। পবিত্র কোরআনে চার বিবাহের অনুমোদন দিলেও এক বিয়েতেই সন্তুষ্ট থাকতে বলেছে, কারন কোরআন বলিষ্টভাবে বলে দিয়েছে, “সমতা” রক্ষা অতিব কঠিন। একাধিক বিবাহের মাধ্যমে জেনেশুনে আগুন ভক্ষণ করতে বারণ করা হয়েছে। স্বামী এবং স্ত্রীর একে অপরের প্রতি দায়িত্ব ও কর্তব্য অতিব সূক্ষ্ম হিসাব। কোরআনে আরো বলা হয়েছে, এই সূক্ষ্ম হিসাবের শাস্তি অবধারিত এবং ভয়াবহ। এখন বারটি স্ত্রী বিবেচিত হলে, “সমতা”-র কঠিনত্বের কঠিনতা কেমন তা অনুধাবন করা প্রজ্ঞার পরিচয় এবং দুনিয়ার অল্প সংখ্যক সুস্থ ও পবিত্র অন্তরধারী হৃদয়াঙ্গম করতে সক্ষম।

বার বিবির সমতা রক্ষার সহিত নাগরিক অধিকারের সমতা, ধর্ম প্রতিষ্ঠা, ধর্মের বানী প্রচার ও বিশ্লেষণ, জীবনের ধারণের প্রতি মুহূর্তের আদর্শ, বিশাল জনগোষ্ঠীর চরিত্র সংশোধন, রাষ্ট্র পরিচালনা, সেনা পরিচালনা, সমাজ পরিচালনা, একজন স্বামী, আদর্শ প্রতিবেশী, আত্মীয়তার বন্ধন, ভাতৃত্ব বন্ধন, শিষ্টাচার, প্রজ্ঞার শিক্ষা ইত্যাদির হক্ব ও সমতা প্রতিষ্ঠা করার স্কেলে মোহাম্মদ(সা) ব্যতীত দুনিয়ার আর কোন মানবের পক্ষে উত্তীর্ণ হওয়া সম্ভব নয় এবং অতীতে আর কারো পক্ষে সম্ভব হয়নি। সম্ভব কি? অন্তরের প্রশান্তির দরজা খোলে এই বিষয়টি নিয়ে চিন্তা করা হোক। নিজের বিবেক থেকে পালায়ন করার ক্ষমতা কারোর নেই।

মোহাম্মদ(সা) ইতিহাসে সর্বশ্রেষ্ঠ এমনি-এমনি হয়ে যাননি। তিনি তার নিজ কর্মের মাধ্যমে “সর্বশ্রেষ্ঠত্ব” অর্জন করেছেন।

দূরদর্শিতা ও দায়িত্ববোধঃ

“ইচ্ছাশক্তি”-র দ্বারা নিজেকে বদলানো গেলেও, অন্যকে পারা যায় না। নিজ “স্বভাব” পরিবর্তন অত্যন্ত কঠিন। সেই কঠিনকে নমনীয় করা যায় ইচ্ছাশক্তির দ্বারা। ইচ্ছাশক্তিকে জাগ্রত করার প্রসেস জানা না থাকলে, কোন কিছুর গুরুত্ব বুঝা কষ্টদায়ক। জীবনের প্রতিটা ঘটনা অন্তরে প্রতিক্রিয়া তৈরি করে। অন্যদের তুলনায় আপন মানুষগুলোর দেওয়া কষ্টগুলো অন্তরে আঘাত তৈরি করে অধিক আর সেই আঘাত শিক্ষা বা অভিজ্ঞতা তৈরি করে। এই অভিজ্ঞতা ইচ্ছাশক্তিকে জাগ্রত করে যা নিজেকে পরিবর্তন করতে ব্যাকুলতা অনুভব করে।

অন্যের স্বভাব পরিবর্তন করে ভিতর থেকে বদলিয়ে দিয়ে আচরণে সদ গুণ গুলো প্রতিষ্ঠিত করার যে কোয়ালিটি নিজের প্রয়োজন, তা হলো “দূরদর্শিতার সহিত দায়িত্ববোধ”। যিনি এই দূরদর্শিতার সহিত দায়িত্ববোধের দায়িত্ব নিবেন তাকে হতে হবে চারিত্রিক বিশুদ্ধতার প্রমানসহ সর্বোচ্চতা। সত্যবাদিতার উপদেশ যিনি দিবেন, আগে তাকে প্রমানসহ সত্যবাদী হতে হবে। কারোর জীবনে অনিচ্ছাকৃতভাবে অল্প পরিমান ভুল হয়ে গেলে সেটা গণনায় আসবে না তবে ইচ্ছাকৃতভাবে ভুল এবং চরিত্রে খুঁত থাকলে তার পক্ষে অন্যের চরিত্র সংশোধন করার দায়িত্ব সম্ভব না। প্রজ্ঞা ও ইচ্ছাশক্তির সহিত ধৈর্যের সর্বোচ্চ সীমানায় আরোহণ না করলে দূরদর্শিতা সহিত দায়িত্ববোধ সম্ভব নয়। মহাপূরুষদের মহৎ একটি গুণ, এই দূরদর্শিতার সহিত দায়িত্ববোধ। “আমার কি উপকার হবে? আমি কি পাব?”- এই জাতীয় চিন্তা মহামানবদের চিন্তায় আসে না, সাথে নিজেকে বিলীন করার সর্বশেষ সীমানায় নিয়ে যাওয়া। সংসার-ধর্ম পালন করার সাথে দূরদর্শিতা আর জগত সংসার ছেড়ে বনে-জঙ্গলে বা উপাসনালয়ে থেকে দূরদর্শিতা এক নয়, কখনও এক হতে পারে না। এক গ্লাস পানির সাথে মহাসমুদ্রের পানির পরিমান তুলনা করা যায় না এবং উচিত নয়।

অনিচ্ছায় দায়িত্বকে গ্রহণ করলে দূরদর্শিতা সম্ভব নয়। দায়িত্ব গ্রহণ করা মানে জেনেশুনে অন্তরকে আগুনের লেলিহান শিখার সাথে সর্বদা বেঁধে রেখে মোকাবিলা করা। দায়িত্ব যত নিখুঁত ও গুরুত্বের সহিত সম্পাদন করা হবে, সে অনুযায়ী দূরদর্শিতার মর্যাদা ও সৌন্দর্যের ব্যপকতা বৃদ্ধি পায়। সাধারণ মানুষ আর মহাপুরুষদের দায়িত্ব বোধের জ্ঞান ও এর কার্যকারিতা এবং দূরদর্শিতার সুন্দরতা ভিন্ন স্তরের। রাষ্ট্র পরিচালনার দূরদর্শিতার পরিধি, পরিবারের দূরদর্শিতা থেকে বৃহত্তর; তেমনি দুনিয়া ব্যপী মানুষ(যেখানে বেশীর ভাগ নির্বোধ ও মূর্খ)-দের স্বভাব ভিতর থেকে বদলিয়ে দেওয়ার সাথে ধর্ম প্রচারের দূরদর্শিতা, রাষ্ট্র পরিচালনার দূরদর্শিতার পরিধির চেয়ে বৃহত্তর, ব্যাপক ও গভীর।

এই দুনিয়ার কেহ দায়িত্ব নেওয়ার সহিত অন্তরে আগুন ভক্ষণ করাতে চায় না এবং দায়িত্ব থেকে অনেকটা ইচ্ছাকৃত দূরত্ব সৃষ্টি করে নিরাপদে থাকতে চায়। জীবনের তাগিদে নিজ ও নিজের পরিবারের রিজিকের উসিলায় বাধ্য হয়ে অনিচ্ছাকৃত দায়িত্ব গ্রহণ করে এবং বাস্তবতার তিক্ততার বিষের ভিতর ডুবে থাকে। দুনিয়ার মানুষজন আত্মকেন্দ্রিক এবং প্রত্যেকে নিজ নিজ দুনিয়া নিয়ে দুশ্চিন্তার ভিতর এমনি নিমজ্জিত যে, সন্তানেরা নিজ পিতামাতার দায়িত্বটুকু নিতে অনিচ্ছুক। নিজ স্ত্রী বা স্বামীকে উত্তম চরিত্র প্রতিষ্ঠিত করে দিতে চাইলে দূরদর্শিতার পরিচয়, বলিষ্ঠ নৈতিকতা এবং এর কঠিনত্বের স্বাদ কেমন, তা অনুশীলন যারা করে তারা জানে। “সত্য” অনুশীলনের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত। কারো কামনা, মতবাদের সাথে “সত্য”-র কোন সম্পর্ক নেই।

নিশ্চয়ই মানবজাতি এই জগত সংসারের “দুশ্চিন্তা”-র চাদরের ভিতর নিমজ্জিত আর সর্বদা ত্রাহি ত্রাহি করছে এই উন্মাদনা থেকে পরিত্রাণের জন্য। সমুদ্রের ঢেউ যেমন বিরামহীন, তেমনি দুশ্চিন্তার ঢেউ অন্তরে বিরামহীন বিষময় চাপ দিচ্ছে। জগত সংসার মানেই দায়িত্বের সমষ্টি। আর দায়িত্ব ও দুশ্চিন্তা একে অপরের মিশ্রণ। দুশ্চিন্তার খুরধার, জীবন ধারণের প্রক্রিয়াকেই নষ্ট করে ফেলে। দুশ্চিন্তাকে নিয়ন্ত্রণ না করা গেলে, এর বিষক্রিয়া আত্মহননের দিকে ঠেলে দেয়।

কথা, আচরণ, সংসারের কর্ম, মেহমানদারী, শুচিতা, পোশাকের পবিত্রতা, দেহের পবিত্রতা, স্ত্রীদের প্রতি দায়িত্ব ও কর্তব্য, আত্মীয়দের ও পরিবারের হক, নিজের হক, অনুসারীদের প্রতি দায়িত্ব, ধর্মের প্রচার, ইবাদত, হারাম-হালাল নির্ধারণ, সত্য-মিথ্যা এবং ভাল-মন্দ চিহ্নিত ও জানার সুস্থ বিবেকবোধ, শিষ্টাচারের শিক্ষা, পরিবার-সমাজ-রাস্ট্রের প্রতি দায়িত্ব ইত্যাদির উত্তমতা অর্থাৎ জীবন ধারণের সকল কর্ম যথাযথ ও নিখুঁত সম্পাদানের দৃষ্টান্ত বিশ্ববাসীর জন্য রেখে গেছেন। অনুসারীদের ভিতর থেকে বদলিয়ে দিয়ে স্বভাব ও চরিত্রকে উত্তমতায় প্রতিষ্ঠিত করে নিজের দূরদর্শিতা ও দায়িত্ববোধের নজির রেখে গেছেন।

বিশ্ববাসীর জন্য আদর্শ রেখে যাওয়ার উদ্দেশ্যে ধর্ম ও বাস্তবতার জ্ঞানের দুই বিশাল মহাসমুদ্র পরিমান যা অনুশীলনের মাধ্যমে দুনিয়ায় প্রতিষ্ঠিত করা- সহজ ব্যাপার নয়। চিন্তা করলে এর কঠিনত্ব অনুধাবন করা যায়। অপরিমান কথা, কর্ম ও জ্ঞানের অসঙ্গতি না থাকার সহিত যথাযথ সংমিশ্রণ, মানব জাতির কল্যাণ ও মুক্তিতে দূরদর্শিতা, বিচক্ষণ ও প্রজ্ঞার সর্বোচ্চতা দীপ্যমান।

বিনয়ঃ

“বিনয়” আচরণের ব্যক্তিত্বকে মাধুর্যতার সহিত মহিমাম্বিত করে। কোমলতার এক মিষ্টতার মিষ্টি ঘ্রাণে চেহারায় অদৃশ্য মৌমাছিদের নর্তন দিপ্তমান যার দেখা মেলে অন্তরের নয়নে। দুনিয়ার মানুষজন বিনয়ীদের সাক্ষাতে আকর্ষন ও আগ্রহ বোধ করে। সকলের কাছে ভালবাসা ও সন্মানবোধের সহিত গ্রহণযোগ্যতা তৈরি হয় আচরণের মিষ্টতার কারনে। বিনয় হচ্ছে ধৈর্য ও লজ্জাশীলতার সর্বোচ্চতা এবং শিষ্টাচারের উত্তমতা। বিনয়ের উৎকৃষ্টতা ও প্রাবল্যের অনুপাতে ব্যক্তিত্বের মহত্ব উচ্চাসীনে এবং মর্যাদায় সর্বশ্রেষ্ঠ মনিষীদের কাতারে অধিষ্ঠিত। বাস্তবতার অদৃশ্য জ্বালাময়ীতায় অন্তরে বিষাদের মাত্রা বেড়ে যাওয়ার সহিত জটিলতা, কুটিলতা, কঠোরতার তিক্ততা অন্তরে অঝোর বৃষ্টির মত বিদ্ধ হতে থাকলে, অন্তরের গরল(বিষ/বিষের ঘা) জেগে উঠে এবং অন্তরকে দংশন করা শুরু করে। এই গরল থেকে রেহাই পাওয়ার উদ্দেশ্যে মানুষজন খেয়ালখুশি কর্ম ও খেয়ালখুশি চিন্তার জগতে ডুবে থাকে আবার কখনও ভিন্ন পন্থায় নিজেকে ব্যস্ত রেখে অন্তরকে আরামের পাত্রে ধারণ করার চেষ্টায় ব্যাপৃত থাকে। রিপুর তাড়নায় অন্তরকে এই স্তরে প্রবেশ না করিয়ে ধৈর্যের মাধ্যমে স্থির ও প্রশান্তির পাত্রে অন্তরকে ধরে রাখার নাম “বিনয়”। বিনয়কে স্বভাবে ধরে রাখতে চাইলে চেতন মন সর্বদা সজাগ রাখতে হয়ে। বিনয় ও নম্রতা সমার্থক হলেও এদের পার্থক্য রয়েছে। বিনয় দুই রকমের। সাধারণ বিনয় ও প্রকৃত বিনয়।

প্রকৃত বিনয় অন্তরে ধারণ করতে গেলে নিজের সাথে বোঝাপড়া করে নিতে হয়, কেন বিনয়ী হব? বিনয় প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে নিজের কি উপকার হবে? কি সুফল? সকলেই বিনয়ী হওয়ার উপদেশ দেয় কিন্তু কেহ বলে দেয় না, বিনয় কি এবং অর্জন করার পথ কি? জিজ্ঞেসিত হলে, চর্বিত চর্বণ “অন্যের চেয়ে নিজেকে ছোট মনে করা” এবং ইহা বলে এড়িয়ে যাওয়া। অন্যের চেয়ে নিজেকে ছোট করার প্রসেস কি- জবাব নেই। “বিনয়” চাইলেই কি অন্তরে প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব?

প্রকৃত বিনয় অন্তরের গভীরতার ভিতর থেকে অনুশীলনের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয় আর এর জন্য দরকার প্রজ্ঞা। প্রজ্ঞা ও সৎ আয় ব্যতীত বিনয়ী হওয়া যায় না। আর সৃষ্টিকর্তার ভয় অর্থাৎ নিজ জীবনের সকল কর্মের জবাবদিহিতার ভয় অন্তরে তৈরি না হলে প্রকৃত বিনয় প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। সাধারণ বিনয় বা নম্রতার ভান করা গেলেও, প্রকৃত বিনয়ে কৃত্রিমতা নেই এবং করার সুযোগ নেই। উন্নয়নশীল দেশের দেশসেবক, সমাজ সেবকগণ… তারা সাধারণ বা প্রকৃত বিনয়ীর কোনটাই নয় কিন্তু বিনয়ের ভান করে এবং ভান করার মাধ্যমে নির্বাচনের উদ্দেশ্যে ছলের আশ্রয় নেয়। অসাধু এবং রিপুর অনুসারীদের পক্ষে “প্রকৃত বিনয়” বুঝা সাধ্যাতীত। ভিক্ষু, ঋষি, পীর, দরবেশ, আলেম নামধারী এক শ্রেনীর মুসলিম, সংসার ত্যাগীরা, উন্নত চিন্তাধারা ও সাধারণ মনিষীগণ… হলেন সাধারণ বিনয়ী ও নম্র। প্রকৃত বিনয়ী হওয়ার প্রজ্ঞা, অনুশীলন তাদের পক্ষে সহজ নয়। দরিদ্রতা, জুলুম-অবিচার এবং বিশেষ পরিস্থিতিতে সাধারণ বিনয়ী অন্তরধারীগণের যেখানে বিচ্যুত ঘটে সেখানে প্রকৃত বিনয়ী অন্তরধারীগণ দৃঢ়তার কারনে চ্যুতি ঘটে না বা ঘটার সম্ভাবনা থাকে না। কারন তাঁরা জানে, তাঁরা সর্বদা সৃষ্টিকর্তার দৃষ্টির সম্মুখে রয়েছে। আচরণের মধুরিমা পরীক্ষা হবে সংসার ধর্মের বাস্তবতার ভিতর ধৈর্য, সততা, লজ্জাশীলতা, বিনয়ের ভিতর থেকে আর মধুরিমা স্বভাবে প্রতিষ্ঠিত হলে হিংসা, লোভ, লালসা, অহংকার আপনাতেই তেজশূন্য।

প্রকৃত বিনয় অন্তরে প্রতিষ্ঠার বিধান রয়েছে। প্রথমে আসবে দুটি বিষয়; রুচীবোধ এবং বিরক্তি। নিজের রুচীবোধের পরীক্ষা নেওয়া। অন্যের সমালোচনা ও ভুল ধরা যত সহজ তার চেয়ে বেশ কঠিন আত্মসমালোচনা ও নিজের ভুল বিচার করা। নিজের বিবেকের বিচারের কাঠগোঁড়ায় নিজের কর্ম ও চিন্তাদ্বয়কে আসামী হিসেবে দাঁড় করিয়ে দেওয়া। ভাল মানুষ হলে কি উপকার হবে আর মন্দ হলে? আনন্দিত হয় পরোপকারে নাকি অন্যকে ঠকানোর মাধ্যমে? পুলকতা অনুভূত হয় মানবিকতায় নাকি গীবতে, অপবাদে? চিত্তবিনোদন হয় মানুষের কল্যাণের উদ্দেশ্যে আত্মনিবেদনে নাকি অবৈধ যৌনতায়? উদারতায় প্রশান্তি হয় নাকি হিংসা, প্রতিশোধ পরায়ণতায়? জীবন উৎসর্গ করে আত্মতুষ্টি নাকি দেশ-জাতিকে হত্যা/গণহত্যার মাধ্যমে দাসদাসী বানিয়ে? অন্তরের আরামের পাত্র যার যার রুচীবোধ তৈরি করে আর এই তৈরি সূচিত হয় পরিবারিক শিক্ষা, পরিবেশ ও সঙ্গীগণ। সুস্থ ও পবিত্র রুচীবোধের অধিকারী না হলে বিনয় প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। রুচীবোধ বিশুদ্ধ হলে অন্তরে “আগ্রহ” প্যারামিটার শক্তিশালী হয়। আর আগ্রহ “দৃঢ়তা”-কে মজবুত করে। দৃঢ়তার হাতলের দ্বারা আচরণে বিনয়কে ধরে রাখে।

রুচীবোধের সঠিকতার পরে আসে “বিরক্তি”। বিরক্তিকে মোকাবিলা মানে আগ্নেয়গিরি লাভার মহাসমুদ্রে সাঁতরানোর প্রস্তুতি গ্রহণ করা যা অত্যন্ত সাহসের কাজ। সাহসের সর্বোচ্চ স্তর। সাধারণরা দূরে থাক, দুনিয়ার পণ্ডিত, ঋষি, সন্ন্যাসী, ভিক্ষু, আলেম, সকল মানুষজনদের এখানে পরাজয় নিশ্চিত। জীবনের সাফল্যের রহস্যগুলো বিরক্তিকে পরাজিত করার ভিতরে লুক্কায়িত। অন্তরের মন্দ রিপুগুলো একেকটি বিষাক্ত গোখরা। এই রিপুগুলো নিয়ন্ত্রণে না আনলে দংশনের মাধ্যমে ধ্বংস করা শুরু করে। ইচ্ছাশক্তি জাগ্রত হওয়ার পর বিনয় প্রতিষ্ঠার বিধানগুলো সময়ের ব্যবধানে সর্বদা স্মরণে থাকে না। মানুষের স্বভাবজনিত অভ্যাস সহজেই ভুলে যাওয়া। তাই ইচ্ছাশক্তিকে জ্বালানি দিয়ে সর্বদা বলবৎ রাখতে হয়। সেই জ্বালানি হচ্ছে “খেয়াল”। বিরক্তিকে মোকাবিলা করার উদ্দেশ্যে ইচ্ছাশক্তি, সাহস, খেয়াল নিযুক্ত করার পরও দেখা যায় একটা সময় নিশ্চল হয়ে পরে এবং এর কারন খুজলে পাওয়া যায় দুটি মুখ্য বিষয়। একটি অলসতা আর অপরটি নিজের চাওয়া বা পছন্দের বিরুধী ঘটনাগুলো। ভিতরে পিতামাতা, স্ত্রী, সন্তান, ভাইবোন আর বাহিরে আত্মীয়, প্রতিবেশী, বন্ধু, সহকর্মী সকলেই পছন্দ-বিরুধী কাজগুলোর মাধ্যমে অন্তরের বিষাদের মাত্রা বাড়িয়ে দেয় যার ফলে, “বিরক্তি” নামক গোঁয়ার ঘোড়া-কে নিয়ন্ত্রনে আনা যায় না। বাহিরের মানুষদের চেয়ে ভিতরের মানুষদের বিরক্তি মোকাবিলা করতে বার বার হিমশিম খেতে হয়, দৃঢ়তা লোহার চেয়ে শক্তিশালী হলেও প্রায়শই ভেঙ্গে পড়ে। তাই “বিরক্তি” নামক বদমেজাজি ঘোড়াকে পরাস্ত করতে চাইলে নিজের পছন্দ-অপছন্দকে বিসর্জন দিতে হয়। ভাল-মন্দ যা চারপাশে ঘটছে সবকিছু স্বাভাবিক ভাবে গ্রহণ করা। মা-বাবা, অন্য সন্তানদের বঞ্চিত করে পছন্দনীয় সন্তান বা পরিবারের বাহিরের কেহকে সকল সম্পদ দান করে দিতেই পারে আর ইহা মেনে নেওয়া সহজ নয় কিন্তু এতে বিচলিত হওয়া যাবে না বরং তাদের সেবায় আত্মনিয়োগ করা লাগবে। ইহাই বিনয়ীদের কর্তব্য। “এই দুনিয়ায় সবকিছুতে ঠকতে হবে”- দৃঢ়তা তৈরির সময় ইহা খেয়ালের সহিত গ্রহণ করা। মৃত্যু অবধি দেশ, জাতি, সমাজ, পরিবার, আত্মীয়, প্রতিবেশী সর্বস্তরের মানুষদের কাছ থেকে প্রতারিত হতে হবে, তা মানিয়ে নেওয়া। অবুঝ শিশু গুরুত্বপূর্ণ মোবাইলটি পানি ভর্তি বালতির ভিতর রেখে খেলা করতেই পারে, অসতর্ক অবস্থায় শখের ল্যাপটপটি টেবিল থেকে ফেলে দিতে পারে, তাই নিজের জীবনের প্রয়োজনটুকুর ব্যাপারে সাবধানতা অবলম্বন করা।

চারিদিকে বৃথা জালাময়ী উক্তি। এর উপমা হলো রক্তাক্ত ক্ষত শরীরে জ্বালাময়ী মরিচের প্রলেপের অনুভুতের চেয়েও ঢেড় বিষাক্ত মূর্খ ও নির্বোধদের অসার কথাবার্তা ও উক্তি। আর এই প্রস্তুতি ও মোকাবিলার জন্য মানসিক ভাবে দৃঢ়প্রতিজ্ঞার অবলম্বনের জন্য হাটু গেঁড়ে অধিষ্ঠান করা লাগে। স্ত্রী ও সন্তানদের সাথে কোমলতার আচরণ ও নম্র কথা বলা, নিঃসন্দেহে দুনিয়ার সবচেয়ে কঠিন। খেয়াল রাখতে হবে, নিজেই নিজের শিক্ষক। নিজের বিনয় নিজেকেই প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। নিজ পছন্দ-অপছন্দগুলো তেজশুন্য করতে চাইলে, নিজের প্রয়োজন কাউকে না বলা, না জানানো। জীবন সম্পর্কে কোন অভিযোগ নেই। “মিষ্টভাষী” হওয়া স্ত্রী, ভাই-বোন, সন্তান, পিতামাতা, প্রতিবেশী, সহকর্মী, আত্মীয়সহ সকলের কাছে। কেহ অনুশীলনের মাধ্যমে বিনয়ী হতে চাইলে মিষ্টভাষী থেকে শুরু করা লাগে। আর মিষ্টভাষী হতে চাইলে জীবনের সবকিছুতে “তাড়াহুড়া” ত্যাগ করে ধীরস্থির হওয়া লাগে। সঠিক কথা বলা, নম্র চলাফেরা, অনর্থক দেহের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সঞ্চালন না করা, দৃষ্টি সংযত, খাবারে সংযমী, সকলের কল্যাণের চিন্তা। অপ্রয়োজনীয় কথা ও জিহবাকে সবকিছু থেকে নিয়ন্ত্রণ রাখা। ‘জিহবা’ অন্তরের অবস্থান জানান দেয় তাই জিহবাকে খেয়ালের দৃষ্টির সহিত বেঁধে ফেলা। জিহবা-র দ্বারা কথার বিষ হচ্ছে দুনিয়ার সকল বিষের প্রভু। “অন্তর” আগ্নেয়গিরির ভিতর জ্বলতে থাকবে আর চেহারায় থাকবে কোমলতার হাঁসি। সব রকমের বিরক্তিকে পরাজিত করাই হচ্ছে “বিনয়ী”।

“গীবত” তড়িৎ গতিতে অন্তরে আকর্ষন ঘটায় এবং মজা লাগায়। মজার ভিতরে আরেক মজার জগত। আরামের পাত্রের ভিতর গীবতের জগতে প্রবেশ করার পর এর দিগন্তের শেষ কোথায় কারও জানা নাই। গীবতকারীরা বিনয়ী অন্তরধারীদের জন্য আশির্বাদ। সমালোচকরা সমালোচনায় যত লিপ্ত হবে তাদের অন্তর ধৈর্য ও বিনয়ের দরুন তত নরম হবে। সমালোচকরা সঠিক, বেঠিক সকল ভুলগুলো অবগত করে। আপবাদকারীরা গীবতকারীদের চেয়ে আরো বহু ধাপ এগিয়ে। গীবত ও অপবাদকারীরা সমাজের চরিত্রটা উত্তম রূপে জানিয়ে দেয়। আর লাঞ্ছিত… সে এক ভয়ানক আগুন যা মহাবিস্ফোরণের মাধ্যমে অন্তরকে পুড়িয়ে দেয়। চারপাশের নির্বোধদের দ্বারা পরিস্থিতির কারনে লাঞ্ছিত হলে সেই আগুনের জ্বালাময়ীতার তীব্রতা ধৈর্যের সহিত নিজেকে নীরবতার সহিত ধরে রাখা যা অহংকারী, হিংসুক বা সাধারণদের পক্ষে কল্পনা করাও কঠিন। ব্যক্তিত্বের লজ্জ্বাশীলতার পরিধি যত বৃহত্তর, লাঞ্ছনার জ্বালাময়ীতা ততই ভয়ংকর ও ব্যাপক। বিত্তবান অহংকারীরা লাঞ্ছিত হলে প্রতিশোধ নিতে মৃত্যুকেও পরোয়া করে না, প্রতিপক্ষকে ঘায়েল বা দুনিয়া থেকে সরিয়ে দিতে এমন কোন কর্ম নেই যা সম্পাদন করতে পিছপা হয় না। অথচ উচ্ছৃঙ্খল ও নিষ্ঠুর সমাজ ব্যবস্থাকে শুধু ক্ষমা করেই প্রকৃত বিনয়ের অন্তরধারীরা দায়িত্ব শেষ করে না, তাদের উপকারে আত্মনিয়োগ করে, কল্যাণের চেষ্টা করে। সৃষ্টিকর্তার সন্তুষ্টি ব্যতীত এই চেতনা ধারণ ও কর্ম সম্পাদন সম্ভব নয়।

অর্থ, সময়, সহযোগীতা পাওয়ার পরেও আরো পাওয়ার নেশায় যারা ব্যাপৃত, তাদের উপর ধৈর্য ধারণ করা দুরূহ। অকৃতজ্ঞ মানুষ বড়ই বিপদজনক এবং এদের সংখ্যা দিয়ে সমাজ পূর্ণ। উপকার পেয়েও সব ভুলে যায় অথচ কম বা বেশী কষ্ট পেলে তা মৃত্যু অবধি ভুলে না এবং অন্তরে পুষে রাখে। সময় ও সুযোগ পেলে প্রতিশোধ নিতে বিলম্ব করে না। এদের অন্তরে মানবিকতা ও নৈতিকতা কখনই তৈরি হয় না কিন্তু সাধুতার ভান করে। হা-হুতাশ এবং হা-হুতাশের ভিতর নিজেদের প্রশংসা, সুখ্যাতির ভজনে ব্যস্ত আর অন্যের নিন্দায় সর্বদা ব্যাকুল। নিজেদের সম্পদ গণনা করে এবং ইহা বাড়ানোর নেশায় অস্থির। তুলনা করার সহিত আত্মতৃপ্তিতে ডুবে থাকে অন্যের চেয়ে তার অবস্থান অধিক; বিলাসিতার এক হীন প্রতিযোগীতা। আস্ত পৃথিবীটা স্বর্ণ বানিয়ে খাওয়ালেও অকৃতজ্ঞদের পেট, অন্তর কিছুই ভরবে না, এদের কামনা ব্ল্যাকহোলের অভিকর্ষ বলের চেয়েও শক্তিশালী, বৃহত্তর। অকৃতজ্ঞরা মানসিক বিকারগ্রস্থ এবং সভ্যতা, দেশ, সমাজ ও জাতির জন্য ক্ষতিকর।

উপকার পাওয়ার যোগ্য কৃতজ্ঞরা, যারা উপকার স্মরণ রাখে। বিনয়ী অন্তরধারীরা কৃতজ্ঞ, অকৃতজ্ঞ সকলের প্রতি সমান। নিজের সন্তানকে শিষ্টাচারের সহিত সুশিক্ষায় শিক্ষিত করা ও অনুশীলনের মাধ্যমে দীক্ষা দেওয়া বিনয়ের এক বিশাল বড় পরীক্ষা। সন্তানের পিছনে অর্থ ব্যয় করার চেয়ে সন্তানদের সময় দেয়া, অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। সন্তানরা খেলার ছলে অনেক প্রশ্নই করবে, ব্যস্ত বা অবসর সর্ববস্থায়, তাদের মনযোগী হওয়া বিনয়ের লক্ষণ। ইহা স্পষ্টতঃ লক্ষিত, চারপাশের অধিকাংশ মানুষজন বিলাসী জীবনের কামনায় মানসিক ভারসাম্যহীন। আর দেশ ও জাতির সকল ভারসাম্যহীণদের সুশিক্ষায় শিক্ষিত করার দায়িত্ব গ্রহণ এবং অনুশীলনের মাধ্যেম পরিবর্তন- কতটা কঠিন এবং ধৈর্য ও বিনয়ের সর্বোচ্চতায় কোথায় পৌছলে পরে ইহা সম্ভবপর হয়, তা অনুশীলন যারা করে তারা ভাল করে জানে। নোবেল জয়ী বা সংসার ত্যাগী বা বিজ্ঞানীদের এই অনুশীলনের কঠিনত্ব বুঝা সাধ্যের বাহিরে, এমনকি ধারণা করতেও অক্ষম।

“অবহেলা” এক ভয়ংকর ব্যাধি সমাজে, পরিবারে। অকৃতজ্ঞ, অহংকারীরা বিনয়ীদের মূল্যায়ন করে না, বুঝেও না। চারপাশের মূর্খ ও নির্বোধদের কাছ থেকে অবজ্ঞা ও উপহাসের শিকার। পরিবারের সদস্যদের দ্বারাও চলে আক্রমণ। নিজে আয়ের উৎস হলেও পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের কাছ থেকে নিজের পছন্দ-অপছন্দ, চাওয়া-পাওয়া সমীহ না করলে, মূল্যায়িত না হলে, সেই কষ্ট খুবই তীব্রতর। এই তীব্রতর এমনি ভয়ানক, আত্মার সম্পর্কের সম্পর্কগুলো ভেঙ্গে যায়। আত্মার সম্পর্কের মানুষগুলোর কথার তিক্ততা অন্তরে মিসাইলের ন্যায় আঘাত করে। পারিবারিক ভাঙ্গন, হাঙ্গামা, সম্পর্ক ছেদ এমনকি হত্যার ঘটনাও ঘটে। বিনয়ী অন্তরধারীরা এই পরিস্থিতিতে পরিবারের সকল প্রকার অবহেলাকে উপেক্ষা করে এবং ক্ষমা করে। এই মহানুভবতা সৃষ্টিকর্তার সন্তুষ্টি ব্যতীত সম্ভব নয়।

উপরে উল্লেখিত স্তরে ধৈর্যের দরুন প্রজ্ঞার সোপান সমূহ নিজ থেকে খুলে যায় আর এই সোপান সমূহ থেকে যে প্রজ্ঞা আহরিত হয় তা দুনিয়ার সকল লাইব্রেরীর জ্ঞান থেকে উত্তম। স্ত্রী ও সন্তানদের কাছে নিজের সম্মান ও মর্যাদা অর্জনে ব্যর্থ হলে, দুনিয়ার সকল ডিগ্রী, জ্ঞান, ব্যক্তিত্ব, মর্যাদা মূল্যহীন। আর ধৈর্য ও বিনয়ের এই স্তরে ভিক্ষু, ঋষি, সন্ন্যাসী, এক শ্রেনীর পীর ও আলেম দাবীদারদের নিজেদের অস্তিত্ব টিকে থাকার ক্ষীণ সম্ভাবনাও নেই। এই সত্যকে অনুশীলনের মাধ্যমে হৃদয়াঙ্গম না করে অযথা কথায় কথায় আন্দোলন ও বাচলতা করো না। সত্য সকলকে বেষ্টন করে আছে।

ব্যক্তিগত ক্ষোভ ও মতপার্থক্য এক পাশে সরিয়ে রেখে অন্যের পাশে দাঁড়ানো, অন্যের মতামতকে মূল্যায়ণ করা বিনয়ীদের বৈশিষ্ট্য। চরম রাগান্বিত অবস্থায় প্রতিপক্ষকে ক্ষমা করতে পারা উচ্চ বিনয়ীদের বৈশিষ্ট্য। চারিত্রিক বিশুদ্ধতার সবোচ্চতার প্রকাশ।

প্রকৃত বিনয় সম্পর্কে অল্প কিছু বলার প্রয়াস। প্রকৃত ও সাধারণ বিনয়ের চেয়েও আরেকটি উচ্চ স্তরের বিনয় রয়েছে যা হলো “প্রেমের বিনয়”। সৃষ্টিকর্তার সহিত সাক্ষাৎ হওয়ার আকর্ষন ও আকাঙ্খা। প্রেমের বিনয় অন্তরে স্থাপিত হলে, “বিরক্তি”-কে মোকাবিলা করার কোন কষ্ট অন্তরে অনুভূত হয় না। সৃষ্টিকর্তার সহিত প্রেমময় অন্তরধারীদের দুনিয়ার কোন সুখময় ঘটনা আনন্দিত করে না; কোন দুঃখে দুঃখিত করে না। জান্নাত, জাহান্নাম, হুরপরী ইত্যাদি পুরস্কারের পরোয়া করে না। সে তাঁর সৃষ্টিকর্তার সহিত সাক্ষাতের জন্য বিভোর এবং আত্মমগ্ন। “পরমাত্মা” হচ্ছে সৃষ্টিকর্তার আদেশ এবং এই পরমাত্মা থেকে একটি প্রতিফলিত নূরের রশ্নি হচ্ছে “আমি” বা “দুনিয়ার আমি” যার বাসস্থান মস্তিষ্কে যার কারনে মস্তিষ্ক সচল।

মহানুভবতাঃ

“নিজের জন্য যা পছন্দ কর, অপরের জন্য তাই পছন্দ কর”- ইহা মহানুভবতার প্রাথমিক মৌলিক গুণ। এই মৌলিক গুণ হচ্ছে মহানুভবতার দরজা খোলার চাবি। এরপর মহানুভবতার জগত শুরু। সততা, লজ্জ্বাশীলতা, দয়া গুণগুলোর মাধুর্যতা ও মিষ্টঁতা স্বভাবের দর্পনে প্রতিফলিত হলে পরে মহানুভবতার প্রাথমিক মৌলিক গুণ প্রতিষ্ঠিত হয়।

কেউ চাইলেই কি মহানুভব হতে পারে? না, এই নিষ্ঠুর ও স্বার্থপর সমাজে কেহ চাইলেই তা পারে না। পরিবার ও চারপাশের মানুষদের উচ্ছৃঙ্খল আচরণের আগ্নেয়গিরির উত্তপ্ত লাভার বিষ অন্তরে ধরে রাখার সাহস ও ক্ষমতা, কেহ চাইলেই তা পারে না। বৈদিক ঋষি, বৌদ্ধরা এমনি-এমনি সংসার ছেড়ে পলায়ন করেন নি। সন্ন্যাসীরা, ভিক্ষুরা ধৈর্যের জগতে ঢুকার আগেই পালিয়েছে। দুনিয়ার মানুষজন যারা মানবতার কথা বলেন, নিজেদের মহানুভবতার পরিচয় দেওয়ার চেষ্টা করেন তা প্রকৃত নয়। সকলেই যার যার নিজ অবস্থান সুরক্ষিত রেখে তারপর মানবতার গান গায়। অন্তরের বিষকে আলিঙ্গন করে তারপর মহানুভবতার সমুদ্রে নামতে হয়। অবহেলা, অপমান, লাঞ্ছিত হজম করার সাথে নিজের প্রয়োজন ও অধিকার ত্যাগ করার ইচ্ছাশক্তি যা অন্তরে ধারণ করা অত্যন্ত কঠিন। “অপমান” হলো পলিথিনের ন্যায় যা মাটির নীচে চাপা পড়ে ঠিকই কিন্তু পঁচে না। লাঞ্চনা অপমানের চেয়েও বৃহৎ এবং নিকৃষ্ট।

অপরের দুঃখ-কষ্ট নিজ অন্তরে কম্পনের সৃষ্টি আর সেই কম্পন থেকে “মানবিকতা”-র জন্ম। জিদ, হিংসা, লোভ, কামনা, অহংকার অন্তর জটিল ও কঠিন করে ফেলে আর জটিল ও কঠিন অন্তরে কখনও মানবতার কম্পন তৈরি করে না। যে অন্তরে মানবতার কম্পন নাই, সেই অন্তর ও বিবেক দ্বারা জনগনের সেবা বা গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা কিংবা মানবতা ও নৈতিক হওয়ার সম্ভাবনা নাই- ইহা ভাল করে বুঝ। যার পা নেই, সে ম্যারাথন দৌড়ে অংশগ্রহন করার দাবী কিভাবে করে!!!?

যিনি রাসুল তাঁকে স্বভাব ও চরিত্রের মাধুর্য এবং শিষ্টাচারের সর্বোচ্চ শিখরে আরোহণ করতে হয়। দূরদর্শিতার সহিত দায়িত্ববোধকে বাস্তবতায় রূপ দিতে গেলে আগ্নেয়গিরির লাভার বিষ অন্তরে শুধু ধারণ করলেই হয় না, সেই বিষের ভিতর ঝাপ দিয়ে নিজের অস্তিত্বকে বিনয়ের ভিতর ধরে রাখা লাগে। ইহা হচ্ছে “বিলীন”। আত্মনিয়োগের মাধ্যমে নিজেকে বিলীন না করলে সমাজ ও জাতির স্বভাব ও চরিত্রের লাগাম নিয়ন্ত্রণের মাধ্যেমে ভিতর থেকে বদলিয়ে দেওয়া সম্ভব হয় না।

উৎপীড়ন, নিপীড়নের উপর কত সময় ধৈর্য ধরা সম্ভব? নিজ পরিবারের সদস্য, আত্মীয়, প্রতিবেশী, পরিচিতদের কটু কথার উপর কতক্ষণ ধৈর্য ধরার ক্ষমতা রাখা যায়? সেকেণ্ড বা মিনিট বা ঘন্টা? নিজের স্ত্রী বা সন্তানকে নিজের মত পরিচালিত করতে কেমন অনুভূত হয়? অন্যকে বিচার করার আগে নিজেকে বুঝ। যদি তের বছর বিরামহীন উৎপীড়ন, নিপীড়ন চলে; তাহলে? দুনিয়ার কোন মনিষী সাহস করেন, তের বছরের অত্যাচার, নিপীড়নের উপর সহনশীলতার পরীক্ষা দিবে? আছে কেহ এই দুনিয়ায়? একজন? এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার আগে নিজ বিবেক বোধ থেকে পালিও না এবং রিপুর তাড়নায় বাচালতা ও তর্ক করো না। তের বছর শুধু নিজের উপর নয়, পরিবার, অনুসারী ও তাদের পরিবারের উপর জুলুম, নির্যাতন চালিয়েছে। এক দীর্ঘ সময়ের অন্তর জ্বালা ও অন্তর শিহরিত কষ্ট। সেই তের বছরের মধ্যে একটা দীর্ঘ সময় সমাজ থেকে পৃথক করে পাহাড়ে বন্দী করে রাখা হয়েছে। “ক্ষুধা”-র চরমতা এমন এক অনুভূতি যা পুরো জগতকে অন্ধকার করে দেয়। নিজের ক্ষুধার সাথে শিশু বাচ্চাদের ক্ষুধার চিৎকারে আশপাশের মানুষসহ আকাশ বিদীর্ণ হয়েছে। নিজ সন্তানের ক্ষুধার চিৎকারের উপর কতটুকু ধৈর্য ধরার ক্ষমতা রাখা যায়? তের বছর অত্যাচারের পর নিজের জন্মভূমি থেকে বের করে দিয়েছে। যারা বের করে দিয়েছে তারাই তিন তিনবার যুদ্ধ করেছে চিরতরে নিশ্চিহ্ন করে দিবার উদ্দেশ্যে।

সেই সকল বর্বর মানুষদের হাতের মুঠোয় পেয়েও প্রতিশোধ না নিয়ে ক্ষমা করেই শুধু মহানুভবতার পরিচয় দেননি, ভিতর থেকে বদলিয়ে দিয়ে চরিত্রের সৌন্দর্যতা প্রতিষ্ঠিত করে দিতে সামর্থ্য হয়েছেন। মোহাম্মদ(সা) বর্বর ও উচ্ছৃঙ্খল জাতির প্রতি “ক্ষমা”-র যে দৃষ্টান্ত দেখিয়েছেন, তা মানব ইতিহাসে দ্বিতীয়টি নেই। ক্ষমার সেই মহানুভবতার মাধ্যমে যে বিপ্লব ঘটিয়েছেন তার সমকক্ষের নথি ইতিহাসে নেই। “ক্ষমা” একজন মুসলমানের প্রতিশোধের সবচেয়ে বড় হাতিয়ার। উল্লেখিত ক্ষমার মহানুভবতা, মোহাম্মাদ(সা)-র জীবনের অগণিত মহানুভবতার একটি মাত্র।

ক্ষমতাঃ

ক্ষমতার দাপট দেখানোতে এক ধরণের আনন্দ আছে। ক্ষমতার দাপটে আঙ্গুলের ইশারায় দেশ ও জাতি যখন উঠবস করে এবং নিজের স্বেচ্ছাচারিতা প্রতিষ্ঠিত হয়, তখন অন্তরে আত্মতৃপ্তির আনন্দের “আন্দোলন” আন্দোলিত হওয়া শুরু করে। ক্ষমতায় যখন জবাবদিহিতা থাকে না, অফুরন্ত অর্থ ও সম্পদ আয়ের দরজা খুলে অন্তরের আনন্দের বহিঃপ্রকাশের সাথে যোগ হয়, সেই আন্দোলনের ব্যপকতা ও গভীরতা এতটাই প্রকট হয় যে, তখন অন্তরের তৃপ্তির জগতে পরিবর্তনের এক দিগন্ত খুলে দেয় যা নিজেকে আবিষ্কার করে এক অলীক জগতে। একজন রাজা বা ক্ষমতাবান শাসক জানে আরেকজন ক্ষমতাবানের আনন্দের আন্দোলনের অনুভূতি। অন্তরে আনন্দের আন্দোলনের সাথে নিজের শরীর, অন্তর সব কিছু দুলতে থাকে এবং ভোগ-বিলাসিতা জীবনকে অক্টোপাসের মত আঁকড়ে ধরে, শুরু হয় অন্তরে ভাল লাগার এক চরমতার নেশা। এই নেশার যখন চলে তখন দেশ ও জাতির সকল মানুষজন শুধুই তার দাস ও সেবাদানকারী হিসেবে ভাবতে থাকে। সিদ্ধান্তের সহিত দৃঢ়তা অবলম্বন করে এই আনন্দের আন্দোলন নিজ অন্তরে ধরে রাখার এবং প্রয়োজনে পুরো দেশ ও জাতিকে ধ্বংস করতে দ্বিধাম্বিত হয় না। আর এমনই মোহগ্রস্ত থাকে যে “মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হবে”- ইহা নিজ চিন্তার জগত থেকে উধাও। পিতা সন্তানকে, সন্তান পিতাকে, ভাই ভাইকে…… হত্যা করতে কুণ্ঠিত হয় না। “হত্যা”-কেই গ্রহণ করে সকল সমস্যার সমাধান হিসেবে এবং নিজের ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে আর সাথে গ্রহণ করে মিথ্যা, প্রতারণা, ষড়যন্ত্রের সকল প্রকারের কৌশল। শোষণ, নিপীড়ন, অসহায়ত্ব, জীবন ধারণের অসুস্থতার চিত্র ফুটে উঠে সমাজ এবং জাতির চরিত্রে। ১৪০০ বছর আগে আরবের সমাজ পর্যবেক্ষণ করলে লক্ষ্য করা যায় এক অন্ধকার ও মূর্খের যুগ। হত্যা, দাঙ্গা-হাঙ্গামা, যুদ্ধ, ব্যভিচার, শিশু হত্যা, প্রতারণা, দস্যুতা, বিচারহীন সমাজ যা ছিল নিকৃষ্টতর এবং মানব ইতিহাসের এক জঘন্য মানবিকতার অধঃপতন ও অনৈতিক সমাজ চিত্র।

রাসূল(সা) রাষ্ট্রনায়ক হয়েও তাঁর চরিত্রে উপরে উল্লেখিত আনন্দের লেশ মাত্রও ছিল না। নিজের জীবনকে বিলিয়েছেন দূরদর্শিতা ও দায়িত্ববোধের সহিত মানবজাতির চারিত্রিক উন্নয়নের জন্য, মানুষদের ভিতর থেকে শুদ্ধ করে পরিবর্তন করতে। খাদিজা(রা)-কে বিয়ে করে মক্কার ধনীতে পরিণত হোন অথচ শেষ জীবনে তাঁর সহায় সম্বল কিছুই ছিল না। আরব ভূখণ্ডের রাষ্ট্রনায়ক হয়েও দরিদ্রতা তাঁর ঘরের দরজায় সর্বদা দন্ডয়মান ছিল। নিজের সকল অর্থ-সম্পদ বিলিয়ে নিঃস্ব হয়েছেন। সংসারের কাজ নিজেই করতেন, বাসন-পাতিল ধৌত করার মাধ্যমে স্ত্রীকে সাহায্য করতেন, নিজের জুতা নিজেই সিলাই করতেন, অতিথিদের আপ্যায়ন করতেন, আত্মীয় ও প্রতিবেশীদের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখতেন। ক্ষমতার দাপটের বা অহংকারের চিহ্ন তাঁর আচরণে ছিল না, বিলাসিতার চিহ্ন ছিল না। পুরো জীবনটা মানবতার সেবায় কাটিয়েছেন, মানুষের কল্যাণের চিন্তা করছেন। মানুষের স্বভাবগত বৈশিষ্ট্য- নির্বোধ, মিথ্যাবাদী, মূর্খ শ্রেণীর মানুষের সাথে মিশতে বা কথা বলতে চায় না। আর রাসূল(সা) পুরো দুনিয়ার মানব জাতিকে কিয়ামত পর্যন্ত দুনিয়ার সকল মানুষের ভিতর থেকে পরিবর্তন করার দায়িত্ব নিয়েছেন- যা সহজ নয়। যারা কার্যকর করে, তাঁরা জানে ইহার কঠিনত্ব। “দূরদর্শিতা”-র কঠিনটি গ্রহণ না করে বরং সহজ ও সরলটি গ্রহণ করে নিজে নিজের উপর পরীক্ষা করে দেখ তো একজন-কে; স্ত্রী বা স্বামী বা ভাই বা সন্তান বা পিতা বা মাতার উত্তম স্বভাব প্রতিষ্ঠিত করে দিতে। অনুশীলনের মাধ্যমে হৃদয়ঙ্গম কর এর কঠিনত্ব।

মোহাম্মদ(সা) দুনিয়ার সকল মানুষদের দিয়ে গেছেন “সভ্যতার আলো”; শিখিয়েছেন শিষ্টাচার, সমতা, ভাতৃত্ব বন্ধন; দেখিয়েছেন দুনিয়ার জীবনের লক্ষ্য, ক্ষমার মহত্ব; বলে গেছেন মৃত্যুর পর জীবনের কথা যেখানে দণ্ডায়মান হতে হবে সৃষ্টিকর্তার সামনে। যেই পবিত্র সত্তা তোমাকে দিয়েছেন মস্তিষ্ক ও পঞ্চ ইন্দ্রিয় সহ শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ, জীবন দিয়ে বাঁচিয়ে রেখেছেন, দিয়েছেন মন, অন্তর ও অন্তরের প্যারামিটার, সেই পবিত্র সত্তার কাছে জবাবদিহি করতে হবে প্রত্যেককে নিজ কর্ম জীবনের ও নিয়ামত সমূহের।

PART-E
======
ইসলামের আকিদা ও সীমানাঃ
“আল্লাহ্‌-কে বিশ্বাস, ফেরেশতাগণকে বিশ্বাস, আল্লাহ্‌ কর্তৃক সকল আসমানী গ্রন্থের প্রতি বিশ্বাস, আল্লাহ্‌ কর্তৃক সকল নবী রাসূলগণের প্রতি বিশ্বাস, আখিরাত বা পরকালে বিশ্বাস, তকদিরে বিশ্বাস”- এই হচ্ছে মুসলিমদের আকিদা। মোহাম্মদ(সা) আকিদার যে সীমা নির্ধারণ করে গেছেন এর কমবেশি করলে সে নিশ্চিতই বিভ্রান্তির ভিতর রয়েছে, বিপথগামী এবং ফিতনাবাজ।

কলেমা বা শাহাদাত, নামায, রোজা, যাকাত ও হজ্ব- এ পাঁচটি মুসলিমদের অপরিহার্য কর্তব্য বা ফরজ বলে চিহ্নিত। এ গুলো পালনের নির্দেশিত হয়েছে কোরআনে। কলেমা “আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি, আল্লাহ্‌ ছাড়া আর কোন মাবুদ নেই এবং মোহাম্মদ(সা) তাঁর প্রেরিত রাসূল"। আল্লাহ্‌র প্রতি এই অনুগত মুসলিমদের সত্যকে অনুধাবন করতে অনুপ্রাণিত করে এবং মুক্ত করে অপর যে কোন শক্তি বা দেবতার প্রতি বিশ্বাস। ইসলামের স্তম্ভ হিসেবে কালিমার পরেই নামাযের স্থান। প্রতিদিন পাঁচ বার করে নামায আদায় করা ফরজ। এই নামায আদায়ে অন্তরের খারাপ গুণগুলো দূরীভূত হয়। নামাযের উসিলায় মানুষ সুযোগ পায় আল্লাহ্‌র নৈকট্যশীল হওয়ার এবং তাঁর অশেষ দয়া, করুণা ও প্রেম লাভ করতে। রমজানের এক মাস রোজা বা সিয়াম পালন প্রত্যেক মুসলিমদের জন্য নির্ধারিত। সংযম শিক্ষার একটি পদ্ধতি যা হিলম লাভ করতে মুসলিমরা সামর্থ্য হয়। শক্তি-সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও প্রতিশোধ গ্রহণ না করা, যা প্রকাশ করে “সহিষ্ণুতা”। যাকাত ও হজ্ব মুসলিমদের উপর ফরজ আর্থিক সামর্থ্য অনুযায়ী। এই ফরজগুলোর সাথে নিজের আখলাক উন্নত করা প্রত্যেক মুসলিমদের সীমানা। নামায কায়েম, রোজা রাখার পাশাপাশি সত্য কথা বলা, হিংসা না করা, লোভ না করা, চুরি না করা, ধৈর্যশীল হওয়া, লজ্জ্বাশীল হওয়া, দৃষ্টি নত রাখা, আঁচরণের নম্রতা, বিনয়, পিতামাতার খেদমত, পরিবার-আত্মীয়-প্রতিবেশীদের হক্ব আদায়- এই সীমানার বাহিরে গেলে সে বিচ্যুতি ও পথভ্রষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা খুব বেশি। আর এই সীমানার ভিতরে জীবন অতিবাহিত করলে জান্নাতের পিছনে দৌড়াতে হবে না, জান্নাতই তাঁর পিছনে দৌড়াবে। একজন সচেতন মুসলিম কখনও এই সীমার বাহিরে যেতে চাইবে না। আর খুব গুরুত্বের সহিত বুঝা উচিত এই সীমানার ভিতরে জীবন অতিবাহিত এবং বাস্তবতার ভাল-মন্দ বুঝার মৌলিক জ্ঞান আল্লাহ প্রত্যেককে দান করেছন। সকলকে “কমন সেন্স” দিয়েছেন। নিজের বিবেককে রিপু এবং অজ্ঞতার কাছে বিক্রি করে দিলে এর জবাবদিহিতা সৃষ্টিকর্তার নিকট করতে হবে যিনি তা আমনত হিসেবে দিয়েছেন। কেহ দাওয়াতের উদ্দেশ্যে সুন্দরতা ও শান্তির বানী প্রচার করতে চাইলে নিজ অবস্থান স্বচ্ছতার সহিত প্রকাশ করতে হয়, নয়ত অসবধানতার কারনে বিপথগামী হওয়ার সম্ভাবনা।

কোরআন(মুসলিম), বাইবেল(খৃষ্টান), তাওরাত(ইহুদী) সবগুলো আসমানী কিতাব এবং সকলের উপর বিশ্বাস স্থাপন ইসলামের আকিদার অংশ। একটি কিতাব অপরটির পরিচয় বহন করে। কিতাবগুলো মুসি(মুসা(আ)), জিসাস(ঈসা(আ)), মোহাম্মদ(সা)-র উপর এবং আরো আসমানী কিতাব যাঁদের উপর নাজিল হয়েছিল তারা সকলেই রাসুল। তাওরাত(তোরাহ) ও বাইবেল পরবর্তীতে অনুসারীদের দ্বারা পরিবর্তিত হওয়ায় কোরআন নাজিল হয়েছে। কোরআন সর্বশেষ ও চূড়ান্ত আসমানী কিতাব এবং ইহাই এখন অনুসরণীয় দুনিয়া বাসীদের জন্য।

বর্তমান আলেমদের পরিচয়ঃ
আলেমগণ সন্মানিত এবং আল্লাহ্‌ তাদের মর্যাদা উচ্চ করেছেন। কোরআন-হাদিস উত্তম রূপে বুঝার উদ্দেশ্যে আলেমের বিকল্প নেই। আল্লাহ কোরআনের হিকমাহ(প্রজ্ঞা) নবী(সা)-কে শিখিয়েছেন। নবী(সা) সেই হিকমাহ সাহাবী, পরবর্তীতে তাবেঈন, তাবে-তাবেঈণ এবং পরে আলেমদের মধ্যে প্রবাহিত। আলেমগন মুসলিম উম্মাহকে কোরআনের আলোকে পথ দেখান, নবী(সা)-র শিক্ষায় দীক্ষিত করেন। মুসলিম জাতির কর্ণধার আলেম সমাজ। কিন্তু এখন “প্রকৃত আলেম” পাওয়া বড় দুষ্কর। হিংসা-প্রতিহিংসা, আধিপাত্য, অর্থের প্রাধান্য, জ্ঞানের অহংকারের দরুণ প্রকৃত আলেমের সংখ্যা পরিমানে অল্প। আকিদা, মাজহাব, কোরআনের মর্মার্থ, হাদিসের ব্যাখ্যা, ফিকহ, মাসায়েল সবকিছু নিয়ে জ্ঞানের কাঁদা ছুড়াছুড়ির মাধ্যমে বিশ্বের মানুষদের ক্লেশের সাথে নিজেরাও হাসির পাত্র হচ্ছে।

প্রকৃত আলেম কারা? প্রসঙ্গিক প্রশ্ন। আশপাশের জ্ঞানী দশজন মুসলিমদের কাগজ-কলম দিয়ে “আলেম”-র সংজ্ঞা লিখতে বললে, দশজন দশ রকমের সংজ্ঞায় সংজ্ঞায়িত করবে। সাধারণ অর্থে আলেম বলতে বুঝায় যার কোরআন ও হাদিস সম্পর্কে গভীর জ্ঞান রয়েছে, সেই সাথে আল্লাহর ভয়ে সর্বদা ভীত, আচরণে মাধুর্যতা। বৃক্ষ যেমন ফলের ভারে নিচের দিকে ঝুলে থাকে তেমনি জ্ঞানের ভারে আলেমগণ বিনয়ী হয়ে ঝুলে থাকে; ধৈর্যশীলতা ও লজ্জ্বাশীলতার পরিপূর্ণতা। আলেমদের চারটি বৈশিষ্ট্য। এক. তারা কোরআনের কালাম তিলাওয়াত করে মানুষদের শুনায়। দুই. আল্লাহ্‌র কালামের অর্থ, বিধিবিধান, ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করে শিখায়। তিন. হিকমাহ অর্থাৎ সুন্নত পদ্ধতি শিখায়। চার. মুসলিমদের আত্মশুদ্ধি করেন।

অনেক সংখ্যক আলেম ও মুসলিম ইসলামের খেদমতে, মানবতার কল্যাণে আত্মনিবেদন করেছেন, নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছেন। তাদের কর্মফল ও পুরষ্কার আল্লাহ্‌র কাছে। দুনিয়ার অনেক মসজিদের ঈমাম ও আলেমগণ মসজিদ কমিটি কতৃক শাসিত ও শোষিত হচ্ছে। অর্থ কষ্টের ভিতরে থেকে সন্মানের কথা চিন্তা করে নিজের ন্যূনতম ভাবে বেচে আছে। মসজিদে এসি, ঝাড়বাতি, সৌন্দর্যবর্ধকের উদ্দেশ্যে খরচের কমতি নেই বরং বিলাসিতা কিন্তু ঈমাম/খতিবদের বেতনের ক্ষেত্রে পাহাড়সম কৃপণতা। সমাজে অনেক কপট, ভানকারী আলেম ও মুসলিম রয়েছে আবার অনেকে মুসলিম সেজে রাজনৈতিক, সামাজিক, ব্যবসার উদ্দেশ্যে ফায়দা নিচ্ছে। আলোচনায় শুধু সেই সকল ধূর্তদের নিয়ে।

বর্তমান আলেমদের বড় একটি দল নিজেদের চারিত্রিক দলিলের সাথে ভক্তিমাখা পরিচয়ের সহিত নিজেদের জাহির করার চেষ্টায় ব্যপৃত। আর সাধারণেরা তাদের ভুলের উর্ধ্বে মনে করে তাদের পা ছুতে বা হাতে মুসাহাফা করে নিজেকে ধন্য মনে করে। কিন্তু ওনারা সবাই আল্লাহতায়ালার বিচারে উত্তীর্ণ হবেন না আর সেজন্যই সন্মানদাতা হিসেবে, অনুগত-অনুরক্ত হিসেবে আলেমদের ব্যাপারে বড় রকমের সতর্কতা অবলম্বন করা প্রয়োজন যাতে করে হাশর তাদের সাথে না হয় যাঁদের টেনে হিচড়ে আগুনে নিক্ষেপ করা হবে।

আলেমগণের বড় একটি সংখ্যা শাসকগোষ্ঠীর মোসাহেবে ব্যস্ত। মোসাহেবের মনমানসিকতার অধিকারী হলে হিকমাহ কখনই সম্ভব না। “আমর বিন মা’রুফ এবং নাহি আনিল মুনকার” করতে আলেমদের ভূমিকা মৌলিকভাবে প্রত্যাশিত। কিন্তু নিজেদের রিপুর তাড়নায় সততা তো নেই বরং মসজিদ কমিটির রাজনীতির ফাঁদে সানন্দে নিজেদের নৈতিকতা বিক্রি করে। এমন আলেমদের থেকে দূরে থাকাই উত্তম। ঈমাম আবু হানিফা, ঈমাম শাফেঈ, ঈমাম মালেক বিন হাম্বলদের শাসকগোষ্ঠী কখনই নিজেদের দলে ভেড়াতে পারেনি। হত্যা ও জঘন্য ভাবে লাঞ্ছিত করা হয়েছে এই ঈমামদের। আলেমদের আরেক শ্রেনী বিশেষ মাজহাব, ফিকহ অনুসরণ করেন এবং বাকীদের “বাতিল” বলে গণ্য করে আর একে অপরের বিরুদ্ধে অনুসারীদের অন্তর-মগজ বিষিয়ে তুলে। নবী(সা)-র একে অপরের সাথে ভালবাসা, ভাতৃত্ব বন্ধন শিখিয়েছেন আর আলেমরা বিষবাষ্প ছড়াতে ব্যস্ত। নিজেদের মনগড়া তর্ক-বিতর্কে লিপ্ত হয়ে নিজেদের “সহিহ” আকিদার দাবীর ঘোষনা করে। বিদআতের ব্যাপারে শুধু অসতর্কতাই নয়, ইহাকে গুরুত্ব দিয়ে দ্বীনের কেন্দ্রে নিয়ে এসে নতুন আকিদা’র জন্ম দেয়। ওয়াজ মাহফিলে অহংকার ও হিংসার দরুন আলেমদের একদল আরেকদলের উদ্দেশ্যে মন্দ বাক্য, অশালীন ভাষা প্রয়োগে অগ্রগামী। দ্বীনকে নিজেদের বিত্তশালী হওয়ার মাধ্যম বানানো এবং দুনিয়াতে বিলাসিতার জীবন যাপন করে। কবীরা-সগীরার পার্থক্য বিবেচনায় না নিয়ে বরং ছোটখাট বিষয়ে বাড়াবাড়ি করে। “মুসলিম” পরিচয় না দিয়ে নিজে ও অনুসারীদের বিশেষ দল, উপদলে পরিচয় ও চিহ্নিত করে। অহংকার ও উগ্রতার দরুন, আরেক শ্রেনীর আলেম নিজেদেরকে কোরআন ও হাদীসের গুপ্ত জ্ঞান ও একমাত্র সঠিক জ্ঞানের দাবী করে সমাজ ও সাধারণদের বিভ্রান্ত করছে। নিজের মতবাদে আত্মপ্রসাদে বিভোর। তাদের শিক্ষা ব্যবস্থা, চিন্তা-চেতনা পর্যবেক্ষন করলে পরিষ্কার হয়, তারা এক প্রকার বোতলবন্দী এবং আধুনিক সভ্যতার সহিত অসামঞ্জস্য। নিজেদের ঘরাণার শিক্ষকদের কাছ থেকে শেখে, তাদের বই-পুস্তক পড়ে এবং তাদেরই ওয়াজ-বয়ান শুনে এবং অন্য ঘরাণার শিক্ষক ও বই-পুস্তক গবেষণা থেকে অনুসারীদের দূরে সরিয়ে রাখে। ব্যক্তি স্বাধীনতায় ও ধর্ম বিশ্বাসের স্বাধীনতায় বিশ্বাসী নয়। এই জীবন ক্ষনস্থায়ী ও মূল্যহীন এই ধরণের চেতনা ধারণ করে মাদ্রাসা কেন্দ্রিক শিক্ষা ব্যবস্থাকে জ্ঞান-বিজ্ঞান থেকে পিছিয়ে দিচ্ছে। আলেমদের কথা ও কাজের মিল নেই। তাদের বক্তব্য ও ফতোয়ার প্রভাব কি সে সম্পর্কে বিচক্ষণতা কম এবং উদাসীন। বিবেক-বুদ্ধি জাগরণে ও বিকাশে এবং ইসলামভিত্তিক স্বাধীন চিন্তাভাবনার উপর গুরুত্ব আরোপ ও সচেতন না করে, নিজেদের চিন্তা-চেতনার চশমা অনুসারীদের চোখে পড়িয়ে দেয়। নিজেদের মনগড়া মতবাদ, আইনবাদী প্রবণতা ইসলামের নীতি ও মূল্যবোধের উপর অগ্রাধিকার দেয়। নিজেদের বিচারকের আসনে বসিয়ে সহজেই অন্যদের মূল্যায়ন/বিচার করে। কথা বলার সময় চিৎকার, চেঁচামিচি আবার কেহ গানের সুরে ওয়াজ/কথা বলে। মানবতার বন্ধনকে যথাযথ ও পর্যাপ্তভাবে বিবেচনায় নেয় না। নারী আলেমদের তারা ডমিনেট করে এবং তাদের শিক্ষা ব্যবস্থা পুরাটাই পুরুষকেন্দ্রিক অথচ আয়েশা(রা), সালমা(রা) কাছ থেকে পুরুষ সাহাবীরা দীক্ষা নিতেন, দ্বিতীয় খলিফা রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য ফতোয়া জানতে আয়েশা(রা)-র কাছে যেতেন। আলেমরা কথার জগতে বাস করে, সমাজ বান্ধব হয়ে মানুষের সুখ-দুঃখের সাথে সম্পৃক্ত নয়, সামাজিক কল্যাণমুখী তৎপরতার সহিত সম্পৃক্ত হতে খুব একটা দেখা যায় না।

নিশ্চয়ই এই দুনিয়ার মূল্য রয়েছে, পরকালের পাথেয় সংগ্রহ করতে হবে এই দুনিয়া থেকেই। “তাকওয়া” দুনিয়া থেকে বিলুপ্তির দিকে দ্রুততর। ইসলামের অনুসারীরা আজ মূল্যহীন আমল ও ইবাদতে লিপ্ত। এই শ্রেনীর ইসলামের অনুসারীদের চিন্তা চেতনা ও কর্মের পচনের দূর্গন্ধে, বিশ্বে আজ ইসলামকে নিন্দিত হওয়ার সুযোগ করে দিচ্ছে।

বর্তমান পীর ও তাদের অনুসারীরাঃ
দাবীদার পীর, ফকির, সংস্কারকগণ এবং যাদুবিদ্যা ও ভবিষ্যৎ বানীর মোহে বা গণকের কথায় বিভ্রান্তিতে লিপ্ত হওয়ার ব্যপারে সাবধান থাকা উচিত। সুস্থ চিন্তা করা একজন মুসলমানের দায়িত্ব ও কর্তব্য। পীর, ফকির, সংস্কারকগণ আধ্যাত্মিকতার মাধ্যমে বেহেস্ত দান, জান্নাতের টিকিট বিক্রি, সত্যের পথে পরিচালিত, আল্লাহ্‌কে পাওয়ার সহিত দাবী করেন নিজেদের কখনও মাহদী, ঈসা(আ)-র আগমন, কখনও নবী-রাসূল আবার পরম আত্মার সহিত মিলিত ও বিলীন হওয়ার তরীকাসহ এমন অনেক মতবাদ যা চারপাশে লক্ষিত। ইহা সম্পূর্ণ ভুল এবং প্রতারণা। যারা এমনটি করেন তাদের আকিদা ভুল এবং তারা স্পষ্টতই সীমালঙ্গনকারী। আল্লাহ্‌ ব্যতীত কেহ সত্যের পথে পরিচালিত করার ক্ষমতা রাখেন না। তারাই সৃষ্টিকর্তার পক্ষ থেকে সত্যের পথে পরিচালিত যারা নিজেদের শুদ্ধ করতে চায় এবং নিজেকে সৃষ্টিকর্তার কাছে সমার্পন করে।

সাধারণ মুসলিমগণ, বেদান্তবাদীগণ(হিন্দু) ও অন্যান্যরা মনে করে সৃষ্টিকর্তা বা ইশ্বর বা আল্লাহর সহিত সম্পর্ক স্থাপন করতে চাইলে মাধ্যম বা পুরোহিত বা পীর/ওলী/আলেম/গুরু ইত্যাদির প্রয়োজন। “ইয়্যা-কা না’বুদু ওয়া ইয়্যা-কা নাসতাই’-ন” ইহা পীর-ফকির-সংস্কারকদের উপর দেওয়াল তৈরি এবং শির্ক-র সীমা নির্ধারণ করে দিয়েছে। এই আয়াতটি স্পষ্ট করে দেখিয়ে দেয় বান্দার সাথে আল্লাহ্‌র সরাসরি সম্পর্ক এবং মাধ্যম বা পীর, ভগবান, দেব-দেবী, গুরু, আলেম ইত্যাদির অস্তিত্ব নেই। কোরআন ও হাদিসে আধ্যাত্মিকতার প্ল্যাটফর্মে বিচরণ সম্পর্কে স্পষ্ট বক্তব্য নেই। “হে মানুষ তোমাকে তোমার পালনকর্তা পর্যন্ত পৌঁছাতে কষ্ট স্বীকার করতে হবে, অতঃপর তাঁর সাক্ষাৎ ঘটবে(৮৪:৬)”। দুনিয়ার সকল মানুষদের মৃত্যু অবধি কষ্ট করতে হবে, ইহা সৃষ্টিকর্তার ফয়সালা। দুনিয়ার সকল নবী-রাসুলগন, সৎকর্মশীলগণ মৃত্যু অবধি কষ্ট করে গেছেন। “আমি তার গ্রীবাস্থিত ধমনী থেকেও অধিক নিকটবর্তী(৫০:১৬)”- সৃষ্টিকর্তা প্রত্যেকের নিজ সত্তার থেকেও কাছে অবস্থান করছেন আর পীর, ফকির, বাবারা কি করার ক্ষমতা রাখেন? "পরম আত্মাই হলো আল্লাহ্‌ বা সৃষ্টিকর্তা বা ঈশ্বর বা ভগবান"- এইসব কথাবার্তা কোথা থেকে পেল? মাইকে কথা হয় তাই বলে মাইক বক্তা হয়ে যায় না। স্বয়ং মুসা(আ) আল্লাহকে দেখার ইচ্ছা প্রকাশ করলে, আল্লাহ বলেন “তুমি আমাকে কস্মিককালেও দেখতে পাবে না(৭:১৪৩)”। আধ্যাত্মিকতার প্ল্যাটফর্মে যারা বিচরণ করার অভিজ্ঞতা অর্জন করতে সামর্থ্য হয়েছে, তাদের বেশির ভাগই বিপথগামী হয় শয়তানের প্ররোচনায়। যেহেতু আধ্যাত্মিক স্তরে পরম শান্তি অনুভূত হয় তাই বেশির ভাগ বিচরণকারী মিথ্যা বিভ্রান্তিতে লিপ্ত থাকে। পরম আত্মার সম্মুখে কেহ নিজেকে আল্লাহ্‌ বা ঈশ্বর দাবী করে ইত্যাদি যা শতভাগ ভুল। আল্লাহ্‌র সাথে শরীক করা বড় গুনাহ। আর এখানে সে নিজেকেই আল্লাহ্‌ দাবী করছে, আল্লাহ্‌র অংশ বলে শরীক করছে। ইহা স্পষ্টতই শির্ক এবং মূর্তি-পূজারীদের চেয়েও বড় শির্ক। আবারো সকলের উদ্দেশ্যে স্পষ্ট করি, পরমাত্মা হচ্ছে “আমি”। আমি-র রহস্য পরমাত্মা। পরমাত্মা বা নিজের “আমি”-কে যদি সকলেই বুঝতে সামর্থ্য হতো তবে দুনিয়ার কেহ আল্লাহ-কে অস্বীকার করত না। আর ইহাই দুনিয়ার পরীক্ষা। ঋষি, গুরু, সংস্কারক দাবীদার অধিক সংখ্যক পথভ্রষ্টরা, দুনিয়ায় সব সময় বিদ্যমান ছিল, আছে এবং থাকবে। ঈমাম গাজ্জালী ছিলেন সুফিইজমের একজন প্রকৃত উদাহারণ কিন্তু সুফীইজমের নামে এখন অনেকেই পথভ্রষ্ট। কোরআনে বর্ণিত “উসিলা” শব্দটিকে নিজেদের মত ব্যাখ্যা করে আরেক শ্রেণী পীরের ব্যবসার ভিত্তিকে শক্ত করেছে এবং করছে। স্বয়ং নবী(সা) গায়েব জানতেন না (৫:১০৯, ৬:৫০, ৭:১৮৮, ১০:২০, ১১:৩১, ২৭:৬৫, ৪৬:৯) অথচ পীরেরা তাদের নিজেদের কাছে গায়েবের ভাণ্ডার আছে বলে দাবী করে। নবী(সা)কে জোড় করে গায়েবের তকমা লাগিয়ে পীর নামক ভণ্ডরা এবং তরিকত/মারেফত নামধেয় কালো জাদু আয়ত্ব করে গায়েবের গোডাউন নিয়ে ব্যবসা প্রসারণে ব্যাকুল। সাধারণ মানুষরা বিভ্রান্ত ও বিপথগামী হচ্ছে। আধুনিক শিক্ষিতরাও কালো জাদুর ফাঁদে পা দিয়ে পথভ্রষ্ট হচ্ছে। অর্থ ও বিলাসিতার নেশায় নিজ ধর্মকে উপহাস করার সুযোগ করে দিচ্ছে। ধর্ম ব্যবসায়ীরা, পীরেরা তরিকত, মারেফতের নামে ইসলামের আকিদার সহিত জন্মান্তর ও বেদান্তবাদীদের মতবাদ সংমিশ্রণ করে সাধারণদের বিপথগামী করছে। একদল জিলানী বা তাঁর মত মনীষীদের ‘গাউসুল আজম’ উপাধি দিয়ে শির্কে লিপ্ত। আরেক দল অতি ভক্তি এবং নিজেদের মতবাদের আদর্শে মোহাম্মদ(সা)-কে খোদা বানিয়ে আবার কেহ খোদার উপরে স্থান দিয়ে বাড়াবাড়িতে লিপ্ত। এই সকল মানুষ নামক প্রাণীরা গাধা থেকেও নিকৃষ্ট। মোহাম্মদ(সা) শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করেছেন নিজ কর্মের দ্বারা, কোন অলৌকিক কেরামতি দিয়ে নয়। বর্তমান জমানার পীর, দরবেশ, আলেম নামক ভণ্ডরা নিজেদের অসার মতবাদের দরুণ নিজেরা তো গোল্লায় গেছে, সাথে দুনিয়ার সাধারণ মুসলিমদের গোল্লায় নিয়ে গেছে এবং যাচ্ছে। পীরের অনুসারীরা সুস্থ চিন্তা, ভাল-মন্দ বুঝার বিবেকবোধ নষ্ট করে নিজেদের মগজ পীরের পায়ের নীচে সঁপে দেয়- ইহা অতীব দুঃখজনক। “পীরবাদ” ইসলাম বর্জিত ভিন্ন এক দর্শন।

পীর, আলেমদের আরেক গ্রুপ নিজেদের কাছে “গোপন জ্ঞান” আছে বলে দাবী করে। পরমাত্মা সহ কোরআনের অনেক বানীর মর্মার্থ গোপনভাবে তাদের কাছে পৌঁছেছে পীর বা গুরুদের মারফত। এরা ভণ্ডামোর চরম সীমানায়। নবী(সা)-র কাছে জীব্রাঈল মারফত যা পৌছানো হয়েছে তা সবই সাহাবীদের কাছে ব্যক্ত করেছেন। “কোন কিছু গোপন করা নবীর কাজ নয়(৩:১৬১)”। “হে রাসুল! তোমার রবের পক্ষ থেকে তোমার প্রতি যা অবতীর্ণ করা হয়েছে তা সকলের নিকট পৌঁছে দাও। আর যদি তা সঠিকভাবে পৌঁছে না দাও তাহলে রিসালাতের দায়িত্বকেই পালন করলে না(৫:৬৭)”। কোরআনের অনুসারী হয়ে কোরআন বিরুধীতায় লিপ্ত। দুনিয়ার কামনায় এরা মনগড়া কথাবার্তা বলে।

পীর, গুরু, বাবারা জাদুবিদ্যা বা এই জাতীয় মন্ত্র ও কথা বলে মৃত্যুর সময়কাল নির্ণয় করে ভক্তদের উদ্ভুদ্ধ করে। “অমল পুরান”-র চতুর্থ স্কন্ধে উল্লেখিত পৃথু মহারাজ কিভাবে মহাসমাধি হয়েছিলেন তার বর্ণনা করে মৃত্যুর সময় পরমাত্মার সহিত লীন হওয়ার তরিকার গোপন জ্ঞান আছে বলে- এই জাতীয় কথা প্রচলন খুব। বৌদ্ধ ভিক্ষুরাও গোপন জ্ঞানের মাধ্যমে ভবিষ্যৎ জানার দাবী করে। পৃথু মহারাজকে যজ্ঞ করতে আবির্ভূত হয় স্বয়ং বিষ্ণু। বিষ্ণুর সাথে যজ্ঞে যোগ দেয় ব্রহ্মা ও শিব। এখান থেকে অনুপ্রানীত হয়ে সূরা আহযাবের ৫৬ নাম্বার আয়াতকে তারা তাদের মত বয়ান করেন। “নিশ্চয় আল্লাহ নবীর প্রশংসা করেন এবং তাঁর ফেরেশতাগণ নবীর জন্য দোআ করে। হে মুমিনগণ, তোমরাও নবীর উপর দুরূদ পাঠ কর এবং তাঁকে যথাযথভাবে সালাম জানাও”। তারা এই আয়াতের সাথে পৃথু মহারাজের কেচ্ছা মিলিয়ে কৃষ্ণ, নবী(সা)কে “এক” করে সৃষ্টিকর্তাকে বাদ দিয়ে তাদেরকেই সৃষ্টিকর্তা বানিয়ে নতুন বিশ্বাস ও আকিদার জন্ম দিয়ে সকল বয়স তো বটেই, স্কুল-কলেজ পড়ুয়া ছাত্রদের ব্রেইন ওয়াশ করে পথভ্রষ্ট ও জঙ্গী হতে উদ্ভুদ্ধ করে। শুধু নক্সবন্দিয়ার ভিতরেই দলাদলির সংখ্যা অনেক যাদের বিশ্বাস ও আকিদা এক দল থেকে অন্য দল সম্পূর্ণ পৃথক। এ রকম অগণিত দৃষ্টান্ত বিদ্যমান চারিদিকে।

এক পীর অন্য পীরের সাথে মতের পার্থক্য হলে, এক আলেম আরেক আলেমের চিন্তার তফাৎ হলেই তাদের অনুসারীরা একে অপরকে আক্রমণ, দাঙ্গা-হাঙ্গমা, হত্যা করতে মহা উদ্যমের সহিত চড়াও হয়। মত, চিন্তার পার্থক্য হলে অপরকে কিভাবে সন্মান করতে হয় তা আলেম, পীরদের এবং তাদের অনুসারীদের শিক্ষা নাই। এরা বুঝাতে চায়, দুনিয়াতে একমাত্র তারাই সঠিক এবং বাকী সকলেই বিপথগামী। আরও বুঝাতে চায়, তাদের সঠিকতার সনদ ফেরেশতার মাধ্যমে গোপনে বা স্বপ্নে দলনেতা প্রাপ্ত হয়েছে কিংবা কোরআন ব্যাখ্যা এটা তাই আমরাই সঠিক। এই শ্রেনীর মানুষজন সম্পূর্ণরুপে ব্রেইন ওয়াশড এবং খুব বিপদজনক।

নামায শিক্ষার জন্য, কোরআন-হাদিস বুঝার জন্য ও মর্মার্থ উদ্ধার করার জন্য আলেম বা শিক্ষকের কাছে যেতে সমস্যা নেই। আর বিবেকের দ্বারা অন্তরের খারাপ প্যারামিটারকে পরাভূত করে স্বভাব বা চরিত্রে যিনি স্থাপন করার পথ দেখিয়ে দিতে পারেন উনি জগতের প্রকৃত শিক্ষক বা অন্তরের চিকিৎসক। তবে যিনি পথ দেখায়, তিনি অর্থের বিনিময় করে না এবং নিজের চারিত্রিক বিশুদ্ধতা সমাজে প্রমানিত ও প্রতিষ্ঠিত। নেককার মানুষদের সংস্পর্শে যাওয়া সাহাবী, তাবেঈন, তাবে-তাবেঈনদের থেকে হয়ে আসছে। ইহা একটি উত্তম কাজ নিজের স্বভাব সুন্দরতার জন্য। আর নেককার মানুষ একজন নয় বরং অনেক নেককার মানুষদের সংস্পর্শে যেতেন। নিজের “বিবেক” ও “ধৈর্য” জগতের সবচেয়ে বড় শিক্ষক ও অন্তরের চিকিৎসক। নিজ সত্তার শিক্ষকের কাছে শিক্ষা গ্রহণ করাই উত্তম। মহান সৃষ্টিকর্তা প্রত্যেকের ভিতরেই এই “শিক্ষক” দিয়ে পাঠিয়েছেন। যারা আল্লাহ্‌র রাস্তায় সাধনা করেন আল্লাহ তাদেরকে সঠিক পথে পরিচালিত করেন(২৯:৬৯)।

হাদিসের গ্রহণযোগ্যতাঃ
হাদিসগ্রন্থগুলো বা বুখারীকে কোরআনের ন্যায় শতভাগ বিশুদ্ধ মনে করা- একটি অন্ধ বিশ্বাস। বিবেক বোধ অপরিপক্ষ, জ্ঞান ও চিন্তার জগতের সংকীর্ণতা। অন্তরের অনুভূতির দুর্বলতা। নিজেদের দাবীর ব্যপারে জ্ঞান নেই- কি বলছে? কি দাবী করছে?

সুন্নী মতালম্বীদের প্রসিদ্ধ(সিহা সিত্তা) হাদিসগ্রন্থ ৬টি আর প্রাথমিক হাদিস গ্রন্থের সংখ্যা ৩৬টি। শিয়া মতালম্বীদের প্রসিদ্ধ হাদিস গ্রন্থ ৪টি আর প্রাথমিক হাদিস গ্রন্থের সংখ্যা ১২টি। এছাড়া এই দুই মতালম্বীদের মাধ্যমিক শ্রেনীর হাদিস গ্রন্থ রয়েছে যা প্রাথমিক হাদিস গ্রন্থগুলো থেকে সংগ্রহ করা। দুনিয়াব্যাপী মুসলিম জাহানের যে হাদিস গ্রন্থ সবচেয়ে বেশি সমাদৃত ও অনুসরণীয় তা “সহীহ বুখারী”।

ঈমাম বুখারীর অরিজিনাল বুখারী গ্রন্থ যা নিজের হাতে লিখেছেন তা দুনিয়ায় অবশিষ্ট নেই। ঈমাম বুখারীর ছাত্র হাজারের অধিক। বুখারী যা বলতেন তারা তা লিখে নিতেন। এদের মধ্যে পাঁচ জন ছাত্র ছিলেন প্রসিদ্ধ। আল ফিরাব্রী, ইব্রাহীম বিন মাকাল, হাম্মাদ বিন শাকির, আবু তালহা বিন মনসুর, হুসেইন বিন ইসমাইল। ফিরাব্রী, বুখারীর সকল ছাত্রদের মধ্যে সবচেয়ে সমাদৃত ও গ্রহণযোগ্য হওয়ার কারন, তিনি বুখারীর পাঠদানের সবচেয়ে কাছে ও বেশি সময় অতিবাহিত করেছিলেন। এই পাঁচজন ছাত্রের লিখিত হাদিস গ্রন্থগুলোও দুনিয়ায় অবশিষ্ট নেই। ফিরাব্রীর ছাত্র খুশায়মানী যার গ্রন্থ দুনিয়ায় বিদ্যমান। ফিরাব্রীর ছাত্রের সংখ্যা অধিক। প্রত্যেকে ফিরাব্রী কাছ থেকে শুনে লিখে নিতেন। ফলশ্রুতিতে ছাত্রদের লিখিত কপি একজনের সাথে অন্যজনের ছিল তফাৎ। খুশায়মানী, ইউনানীসহ আরো বেশ কিছু শিষ্য ঈমাম বুখারীর ছাত্রদের কাছ থেকে শুনা লিখিত গ্রন্থ থেকে ৫০০ বছর পর আসকালানী “ফাতহুল বারী” গ্রন্থ প্রকাশ করেন যা মুসলিম আলেমদের কাছে সর্বাধিক গ্রহণীয়। ফাতহুল বারী মূলত বুখারীর হাদিসের বিস্তারিত বর্ণনা ও বিশ্লেষণ। আর এই “ফাতহুল বারী” গ্রন্থ থেকেই বর্তমান দুনিয়ায় বুখারীর নামে “সহীহ বুখারী”-র প্রচার ও প্রসার। খুশায়মানীর পাণ্ডুলিপি থেকে বুখারী গ্রন্থ দাবী করা হলেও বর্তমান দুনিয়াব্যাপী যে বুখারী নবী(সা) মারা যাবার আটশ/নয়শ বছর পর ফাতহুল বারী থেকে সংগৃহীত।

আব্বাসীয় ও উমাইয়াদের উচ্ছৃঙ্খলতার সহিত ক্ষমতার শাসন ও তাদের অনুকূলে জনগনের সমর্থন পেতে কিছু হাদিস বানানো হয়েছে যা পরবর্তীতে সিহা সিত্তাহ সহ সকল হাদিস গ্রন্থে প্রবেশ করেছে। নিজেদের পক্ষে প্রসিদ্ধ ঈমামদের অনুকূলে পেতে অনেক ঈমামদের শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন, লাঞ্ছিত এমনকি হত্যাও করা হয়েছে, সাহাবী-তাবেঈনদের পাইকরী ভাবে হত্যা করা হয়েছে। উমাইয়া বংশের একমাত্র ঈমানদার খলিফা উমর বিন আব্দুল আজিজ ৯০ হিজরীতে হাদিস লিখার গুরুত্ব অনুধাবন করেন এবং হাদিস লিখার আদেশ করেন। ২৫০/৩০০ বছর পরে সংগ্রহ করা হাদিসগুলো শতভাগ বিশুদ্ধ হবে না, তা বিবেকবান মাত্রই স্বীকার করবেন। আবার পরবর্তীতে হাদিস রচয়িতাদের মূল দলিল বা নথি বিদ্যমান না থাকায় বাস্তবতা বিবর্জিত, বানোয়াট অনেক হাদিস ঢুকে গেছে যা যাচাই-বাচাই করা এক দুরূহ। মঙ্গোল বাহিনী কতৃক বাগদাদ ও অন্যান্য লাইব্রেরীগুলো ধ্বংস ছিল এক বিরাট ক্ষতির কারন। সবচেয়ে প্রসিদ্ধ ও গ্রহণযোগ্য হাদিস গ্রন্থ বুখারীর অবস্থা এই! আর বাদ বাকীদের কি অবস্থা!

বুখারী যে হাদিসটি সঠিক বলেছেন, মুসলিম সেই হাদিস ভুল বলেছেন। বুখারী ও মুসলিম একে অপরের বহু হাদিস গ্রহণ করেননি। বুখারীর শিক্ষক ঈমাম যুহলীর সহিত বুখারীর মতবিরোধ ছিল। তাদের এই মনোভাব পরবর্তী মুসলিম জাতির জন্য সহজ ছিল না। বুখারী ৬ লক্ষ হাদিস থেকে ৭২৭৫(মতান্তরে ৭৩৯৭)টি হাদিস সঠিক বলে রায় দিলেন এবং বাকী সকল হাদিস ভুল বলে ফেলে দিলেন। তাঁর ফেলে দেওয়া হাদিসে সঠিক ছিল না কিংবা ৭২৭৫টি হাদিসে ভুল নেই, এই মানদণ্ড নির্ধারণ কঠিন। রাসুল(সা)-র কবরের পাশে প্রতিটি হাদিসের জন্য দুই রাকাত নফল নামায আদায় করে “সঠিক” মনে করে লিপিবদ্ধ করলে তা সঠিক হয়ে যায় না। ৬ লক্ষ হাদিস সংগ্রহ করে কুফা, বশরা, মদীনা, মক্কা, দামেস্ক… ইত্যাদি বহু জায়গা ভ্রমণ করে ৭২৭৫টি সঠিক বলে সঙ্কলন করা কত সময়ের প্রয়োজন? কঠিন হিসেব। বুখারীতে কোরআন বিরুদ্ধ, বাস্তবতা বিবর্জিত, স্ববিরুধী বহু হাদিস ঢুকে গেছে। হাদিসের আলোচনা থেকে বিরত হই কারন হাদিস সংগ্রহের আরো ভেজাল রয়েছে এবং কম জানা মুসলিমরা বিভ্রান্ত হবেন।

আল্লাহ কোরআনে গুরুত্ব যখন কিছু বলেন তখন কসম করে বলেন। কিন্তু “বিবেক”-র গুরুত্ব বুঝাতে সাত বার কসম করেছেন(সূরা শামস)। “বিবেক” মহাবিশ্বের এক মহামূল্যবান। ভালমন্দ বুঝার সকলকে বিবেকবোধ দেওয়া হয়েছে। সবার বিবেকবোধ সমান নয়। যাদের জ্ঞান কম, তাদের উচিত জ্ঞানের জন্য আত্মনিয়োগ করা কিংবা সৎ প্রজ্ঞাবানদের কাছ থেকে জ্ঞান নেওয়া। হাদিস ছাড়া কোরআন বুঝা, কোরআনের মর্মার্থ করা, ইসলামের জ্ঞান আহরন সহজে সম্ভব না। তাই হাদিস গ্রহণ করার পূর্বে বিবেক প্রয়োগ করা জরুরী হাদিসটি কি সত্যই নবী(সা) বলেছেন নাকি পরবর্তীদের দ্বারা রচিত? কোরআন বিরুদ্ধ, বাস্তবতা বিবর্জিত, স্খলনতা ইত্যাদি পরীক্ষা করা উচিত হাদিস গ্রহণ করার পূর্বে। কিছু সংখ্যক হাদিস ভুল হওয়া অস্বাভাবিক নয়।

আল্লাহ্‌র কাছে সম্পূর্ণরুপে আত্মসমর্পণ ছাড়া মুসলিম জাতির মুক্তি নেই। চারিত্রিক বিশুদ্ধতার অনুশীলনের সহিত ইবাদত বন্দেগীর পাশাপাশি জীবনের সর্ববস্থায় আল্লাহ্‌র উপর তাউয়াক্কুল ছাড়া একজন মুসলিমের জন্য আর কোন পথ খোলা নেই।

“সুন্নাহ” ব্যতীত মুসলিম হওয়া যায় নাঃ

ঈমান ছাড়া ইসলাম এবং ইসলাম ছাড়া ঈমান গ্রহণযোগ্য নয় অর্থাৎ আমল ছাড়া ঈমানের মূল্য থাকে না। আর একজন মুসলিমের আমল হচ্ছে “সুন্নাহ”।

সাহাবীগণ হলেন কিয়ামত পর্যন্ত মুসলিম উন্মার আদর্শ ও অনুসরনীয়। উনারা সরাসরি নবী(সা)-র কাছে থেকে শিক্ষা নিয়েছেন। তারা নবী(সা)-কে দেখেছেন, শুনেছেন, অনুকরণ করেছেন। ইবাদত, আচরণ, বিবিদের প্রতি সমতা ও অধিকার প্রতিষ্ঠা, সাংসারিক কাজকর্ম, সামাজিকতা, নৈতিকতা, চারিত্রিক বিশুদ্ধতা ইত্যাদি সাহাবীরা সরাসরি প্রত্যক্ষ ও অনুশীলনের মাধ্যমে নিজেদের চরিত্রে ও স্বভাবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। তাদের চিন্তা ও কর্ম ছিল দুনিয়ার সকল সময়ের সকল মুসলিমদের মধ্যে সর্বোৎত্তম।

সাহাবীগনের পরে উৎকৃষ্ট ছিলেন তাবেঈন ও তাবে-তাবেঈনগণ। এই সাহাবী, তাবেঈন, তাবে-তাবেঈন সকলের মধ্যে কোরআন মুখস্ত ছিল বিশ ভাগ(আনুমানিক)। তাদের বাকী আশি ভাগ পুরুষ ও মহিলাদের কোরআন মুখস্ত ছিল না এবং তাদের কাছে লিখিত কোরআন বা হাদিস ছিল না। কিন্তু তারা তাদের ঈমান ও আমলের কারনে জান্নাতের উচ্চাসনে অধিষ্ঠিত এবং তারাই প্রকৃত মুসলিম। সাহাবী, তাবেঈন, তাবে-তাবেঈনগণ বিশ্বের সকল মুসলিমদের মধ্যে কর্মে শ্রেষ্ঠ ও অনুকরনীয়। তাদের কাছে ছিল নবী(সা)-র দেখানো ও শিখানো “সুন্নাহ”। যাদের কোরআন মুখস্ত ছিল না, তারা হাফেজ সাহাবী, তাবেঈন, তাবে-তাবেঈনদের কাছ থেকে শুনতেন। আর সুন্নাহ-ই ছিল তাদের ইসলাম ধর্ম ও জীবন ধারণ। কিন্তু পরবর্তী ও বর্তমান মুসলিমরা সুন্নাহ গুরুত্ব কমিয়ে দিয়েছে। বিশুদ্ধ আলেম ও সিহা সিত্তায় বিদ্যমান সুন্নাহর বিস্তারিত।

অনুসারীদের মধ্যে একদল আত্মঘাতী সংঘর্ষ লক্ষিত সুন্নাহ মানা ও না মানার ব্যপারে। নিজেরা নিজেদের পক্ষে কোরআন, সুন্নাহ ও হাদিসের বক্তব্য তুলে ধরে এক দল আরেক দলকে ধরাশায়ী এবং সঠিকতা প্রমান করতে তিক্ততার এক বিবাদে ব্যাপৃত। আহলে কোরআন যারা সুন্নাহ ও হাদিস অস্বীকারকারী সূরা আলে ইমরানের ১০৩-র প্রসঙ্গ টেনে এনে বলে, দেখ আল্লাহ এই আয়াতে শুধু রজ্জু(কোরআন)-কে ধরে রাখার ব্যপারে বলেছেন, হাদিসের কথা বলা হয়নি। নিজেদের দাবীর পক্ষ বলে, কোরআনে বলা আছে কোরআন সহজ ভাষায় লিখা হয়েছে বুঝার জন্য, সুতরাং কোরআন বুঝতে কোন শিক্ষক, আলেম বা হাদিসের প্রয়োজন নেই(৫৪:১৭, ৫৪:২২, ৫৪:৩২, ৫৪:৪০ এবং এরপর বড় আক্রমন ৬:১২৬)। আরো বলে, বিদায় হজ্জের ভাষনে সিহা সিত্তা(বুখারী, মুসলিম, দাউদ, তিরমিজি, নাসাঈ, ইবনে মাজাহ) উল্লেখ আছে “তোমাদের মাঝে একটি জিনিস রেখে যাচ্ছি তা ধরে রাখলে পথভ্রষ্ট হবে না আর তা হলো কোরআন (দক্ষিন এশিয়ার মোল্লা শ্রেণী বিশেষ করে তবলীগ জামাত সিহা সিত্তা বাদ দিয়ে ঈমাম মালিকের রেফারেন্স দিয়ে বলে, বিদায় হজের ভাষনে নবী(সা) দুটি জিনিষের কথা বলেছেন কোরআন ও হাদিস; মালিক সঠিক হলে সিহা সিত্তা মিথ্যা হয়)। তাদের আরো দাবী সাহাবী, তাবেঈন কেহ হাদিস লিখে রেখে যান নাই। মুসলিম শরীফের হাদিস, নবী(সা) বলেন তোমরা আমার মুখ নিঃসৃত বানী(হাদিস) লিখে রেখ না।

“কোরআন অনলি”-রা মুসলিমদের মাঝে ফিতনা তৈরিতে লিপ্ত। নিজেরা পথভ্রষ্ট সাথে অন্যদের বিপথগামী করতে জান-মাল নিয়ে মিডিয়ার মাধ্যমে মাঠে নেমেছে। এই দল ইসলাম বিদ্বেষীদের চেয়ে বিপদজনক। ঈমানের পরেই নামাযের স্থান আর তারা কোরআনের অর্থ করে কেহ দুই বা তিন ওয়াক্ত নামায আদায় করে এবং দুই রাকাত(৪:১০২ আয়াতের দোহাই দিয়ে) করে নামায আদায় করে। পাঁচ ওয়াক্ত নামায ও নবী(সা)-র দেখানো নামাযের পদ্ধতিকে তারা সরাসরি অমান্য করে। মুসলিমদের নামায থেকে দূরে সরিয়ে দিতে পারলে তাদের বড় একটি লক্ষ্য অর্জিত হয়। তারা “সালাত”-র অর্থ করে কোরআন তিলাওয়াত ও জিকির। আরো গুরুতর হচ্ছে এরা কালিমাকে অস্বীকার করে। “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ” এতটুকুই এরপরে “মোহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ” বলে না। তাদের দাবীর অংশ কোরানের মোহাম্মাদ আর মোহাম্মদ বিন আব্দুল্লাহ এক নয় অর্থাৎ ভিন্ন ব্যক্তি। অর্থের বিনিময়ে তারা মুসলিমদের ভিতর কেওয়াস, ফিতনা-ফাসাদ সৃষ্টি করছে কিনা- তা ভেবে দেখার যথেষ্ট অবকাশ রয়েছে।

হাদিস অস্বীকারকারী কোরআন অনলিরা নবী(সা)-র দীক্ষা বাদ দিয়ে নিজেদের মনগড়া কোরআন ব্যাখ্যা করে। সকল হাদিস গ্রন্থ তো বটেই, বুখারীকে শতভাগ মিথ্যুক অপবাদ দিয়ে গোষ্ঠী উদ্ধারে ব্যস্ত। কোরআন অনলিরা উচ্ছৃঙ্খল এবং হাদিস ও সুন্নাহ অনুসারীদের খুঁত ধরতে সর্বদা ব্যাকুল। এদের উদ্দেশ্যই খুঁত ধরার মাধ্যমে ফাসাদ সৃষ্টি করা। কোরআনের আয়াত কোট করে বলে বেড়ায় “দেখ, এই আয়াতে কি বলা হয়েছে?” কিন্তু আয়াতটি কখন, কি উদ্দেশ্যে, কি ঘটনার আড়ালে নাজিল হয়েছে সে সম্পর্কে উদাসীন। নিজেরা নিজেদের মতবাদ নিয়ে উল্লসিত, তাতে সমস্যা নেই কিন্তু নামায নিয়ে তারা যে মনগড়া মতবাদ সৃষ্টি করছে তা ইসলামের ভিতর আরেক বড় ফিতনা।

নবী(সা)-র সময়ে এবং উনার ইন্তেকালের ২৫০/৩০০ বছর পর্যন্ত হাদিসের কপি ছিল না। নবী(সা) মারা যাবার সময় কোরআনের লিখিত একটি কপি ছিল এবং পরে উসমান(রা) আটটি কপি করে আট জায়গায় স্থানান্তর করেন। অসাধু ধূর্তবাজরা কোরআন বিকৃত হয়েছে, এই বলে আস্ফালন। তাদের জ্ঞানে নেই যে, হাজার হাজার সাহাবী কোরআন মুখস্ত করে রেখেছে ইসলামের শুরু থেকে এবং কিয়ামত পর্যন্ত মুখস্তকারীর সংখ্যা কোটি কোটি যা দুনিয়ার অন্য কোন ধর্মীয় কিতাবের ক্ষেত্রে এমন পবিত্রতা, মূখস্ত, সংরক্ষণের গুরুত্ব পরিলক্ষিত হয়নি। হাজার হাজার বছর ধরে কোটি কোটি হাফেজদের কোরআন মুখস্তে একটা অক্ষর কমবেশী বা ব্যতিক্রম নেই। রমজান মাসে কোরআন খতম অর্থাৎ কোরআনের প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত তিলাওয়াতের মাধ্যমে তারাবীর নামায আদায় ইসলামের প্রথম থেকে হয়ে আসছে। ধূর্তবাজরা এতটাই জঘন্য যে স্বয়ং আলী(রা)-র বরাত দিয়ে বলে, উনি বর্তমান কোরআনকে সঠিক বলেন নি। দুঃখজনক হলো, এই দাবী অমুসলিমরা করে না, করে মুসলিমদের ভিতর থেকে পথভ্রষ্ট এক দল। আলীর সামনে কোরআন বিকৃত হবে আর আলী জীবিত থাকবেন- এই অনুভূতির জ্ঞান তাদের নেই। মুখ ও জিহবা আছে, হিংসা-বিদ্বেষ-পক্ষপাতিত্বের মনোভাবী হয়ে যা খুশি তাই বলে বেড়ায়। এদের এক শ্রেণী পীরপূজারী আধা হিন্দু আধা শিয়া এবং কিছু শিষ্য এতটাই জঘন্য যে, নিজেদের স্ত্রীকে গুরু/পীরের সহিত যৌনান্দ ভোগ করার জন্য এক বিছানায় শায়িত করে দেয়।

কোরআনে সুন্নাহর গুরুত্ব বলা আছে। সুন্নাহ মানার ব্যাপারে কোরআনে নির্দেশিত। হাদিস ও সুন্নাহর পার্থক্য রয়েছে। সব হাদিস সুন্নাহ নয় কিন্তু সব সুন্নাহ হাদিস। নবী(সা) যা কিছু বলেছেন, যা কিছু করেছেন এবং যা কিছু বলার বা করার অনুমতি দিয়েছেন অথবা সমর্থন জানিয়েছেন তাকে হাদিস বলে। আর সুন্নাহ হলো যা আমলের মাধ্যমে করা হয়। সুন্নাহ হলো সঠিক আর হাদিস খাঁটি বা সঠিক-বেঠিকের মিশ্রণ বা ভুলও হতে পারে।

বলুন, “তোমরা যদি আল্লাহকে ভালবাস তবে আমাকে অনুসরণ কর, আল্লাহ তোমাদেরকে ভালবাসবেন এবং তোমাদের অপরাধ ক্ষমা করবেন। আল্লাহ্‌ অত্যান্ত ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু” (৩:৩১)।। বলুন, “তোমরা আল্লাহ্ ও রাসূলের আনুগত্য কর। তারপর যদি তারা মুখ ফিরিয়ে নেয় তবে নিশ্চয় আল্লাহ কাফেরদেরকে পছন্দ করেন না” (৩:৩২)।। “হে মুমিনগণ, তোমরা আনুগত্য কর আল্লাহর ও আনুগত্য কর রাসূলের এবং তোমাদের মধ্য থেকে কর্তৃত্বের অধিকারীদের। অতঃপর কোন বিষয়ে যদি তোমরা মতবিরোধ কর তাহলে তা আল্লাহ ও রাসূলের দিকে প্রত্যার্পণ কর, যদি তোমরা আল্লাহ ও আখেরাতে ঈমান এনে থাক। এ পন্থাই উত্তম এবং পরিনামে প্রকৃষ্টতর(৪:৫৯)।। আপনার রবের শপথ তারা মুমিন হবে না যতক্ষন পর্যন্ত তারা নিজেদের বিবাদ-বিসম্বাদের বিচার ভার আপনার উপর অর্পণ না করে; অতঃপর আপনার মীমাংসা সম্পর্কে তাদের মনে কোন দ্বিধা না থাকে এবং সর্বান্তকরণে তা মেনে নেয়(৪:৬৫)।। “অবশ্যই তোমাদের জন্য রাসূলুল্লাহর মধ্যে রয়েছে উত্তম আদর্শ তাদের জন্য যারা আল্লাহ ও পরকাল প্রত্যাশা করে এবং আল্লাহকে অধিক স্মরণ করে” (৩৩:২১)।। “নিশ্চয়ই তুমি মহান চরিত্রের উচ্চমার্গে উন্নীত” (৬৮:৪)।। “রাসূল তোমাদের যা দেয় তা গ্রহণ কর, আর যা থেকে সে তোমাদের নিষেধ করে তা থেকে বিরত হও এবং আল্লাহকেই ভয় কর, নিশ্চয় আল্লাহ শাস্তি প্রদানে কঠোর” (৫৯:৭)।। কোরআনের অন্ততঃ ৩০ জায়গায় রাসুলকে মানার ব্যাপারে বলা আছে। রাসুলকে মানলে আল্লাহ্‌কে মানা হবে।

গুরুত্ব আলোচনাঃ ওহী দুই রকম। ওহী মাতলু এবং ওহী গায়রে মাতলু। কোরআন হলো মাতলু যার ভাষা শৈলী, কাঠামো ইত্যাদি আল্লাহ নাজিল করেছেন, তিলাওয়াত করা হয় এবং লিখে রাখার নির্দেশ দিয়েছেন। আর আল্লাহ্‌র কিছু দেখানো নির্দেশ(গায়রে মাতলু) যা তিলাওয়াত করা হয় না। গায়রে মাতলু নবী(সা) অনুশীলনের মাধ্যমে শিখিয়েছেন। “ ثُمَّ إِنَّ عَلَيْنَا بَيَانَهُ “ অতঃপর তা (ওহীয়ে খফী বা প্রচ্ছন্ন ওহীর মাধ্যমে) বিশদ ভাবে ব্যাখ্যা করা আমারই দায়িত্ব (৭৫:১৯)”। ওহী গায়রে মাতলু আল্লাহ নবী(সা)-কে শিক্ষা দিয়েছেন কিভাবে অনুশীলন করে অনুসারীদের শিক্ষা দিয়েছিলেন, ইহা “সুন্নাহ”। নামায কিভাবে আদায় হবে তা কোরআনে নেই কিন্তু অনুশীলনের মাধ্যমে জীব্রাঈল(আ) নবী(সা)-কে শিখিয়েছেন এবং পরবর্তীতে নবী(সা) থেকে অনুসারীগন নামায আদায়ের পদ্ধতি শিখেছেন। ইসলামের রীতি, ইবাদতের পদ্ধতি, নামায, জাকাত, ওমরা, হজ্ব, জীবন পদ্ধতি, চলাফেরা, হারাম-হালাল, ভালমন্দ, শিষ্টাচার, আদব, বিয়ে, সামাজিকতা, সকল ধর্মের অনুগামীদের সহাবস্থান, সবকিছু অনুশীলনের মাধ্যমে শিখিয়েছেন অনুসারীদের। নবী(সা)-র পূর্বে সকল নবীরাসূলগনের উপর নামায, রোজা, যাকাত ইত্যাদি ফরজ ছিল। ধর্মীয় এই বিধানগুলো প্রথম মানব আদম(আঃ) থেকে পালিত হয়ে আসছে। সকল নবীরাসুলগণদের আল্লাহ শিক্ষা দিয়েছেন যেন অনুসারীদের আমল করার পদ্ধতি শিখিয়ে দিতে পারেন।

হাদিসের ভিতর কিছু সংখ্যক কোরআন বিরুদ্ধ, বাস্তবতা বিবর্জিত, স্ববিরোধী রয়েছে যেগুলোর প্রবেশ হয়েছে রাজনীতির কারনে, তা বর্জন করা উচিত। বুখারীর বেশ কিছু হাদিস ভুল আর যেখানে বুখারী ভুল সেখানে অন্যান্য হাদিসগ্রন্থে ভুল থাকা স্বাভাবিক। জঈফ বা দূর্বল হাদিস গ্রন্থগুলো থেকে মুছে ফেলা উচিত। কিন্তু কিছু সংখ্যক ভুল হাদিসের জন্য সকল হাদিসগ্রন্থগুলোকে ভুল বলে গ্রহণযোগ্যতা বাতিল করা মূর্খামো ছাড়া আর কিছু নয়। যারা হাদিসগ্রন্থগুলো পরবর্তীতে সংরক্ষণ করেছেন তাদেরও চারিত্রিক বিশুদ্ধতার পরীক্ষা করা হয়েছে। যারা সকল হাদিসগ্রন্থ বাদ দেওয়ার পক্ষে, তাদের অনুভূতির সহিত বিচক্ষণতার অভাব, চিন্তার অপরিপক্ষতা এবং উদ্দেশ্য প্রনোদিত হয়ে কাজটি করে।

জ্ঞান-বিজ্ঞানের গবেষণা, মানব কল্যাণের প্রযুক্তি, অর্থনীতি, গণিত, মেডিকেল, ইঞ্জিনিয়ারিং ইত্যাদি বিষয়াদি কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষা দিচ্ছে এবং বুঝানোর জন্য শিক্ষক নিয়োজিত। নিজে নিজে বুঝতে সকলেই অক্ষম। নবী(সা) হলেন কোরআনের শিক্ষক। উনি কোরআনের ব্যাখ্যা যেভাবে বুঝিয়েছেন, সেভাবে বুঝতে হবে। নীজে কোরআন বুঝতে গেলে বা নবী(সা)-কে বাদ দিয়ে গুরু, পণ্ডিত, হুজুর, পীরদের অনুসরণ করলে পথভ্রষ্টতা শতভাগ নিশ্চিত।

“সিরাতা’ল মস্তাকী’ম” জান্নাতে যাওয়ার একমাত্র রাস্তা। নবী(সা)-র সুন্নাহ ব্যতীত সিরাতা’ল মুস্তাকী’ম জানা ও পাওয়ার আর কোন পন্থা দুনিয়ায় নেই। সুন্নাহ, নবী(সা)-কে “রাসুল” হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। সুন্নাহ ব্যতীত নিজেকে মুসলিম দাবী করা যায় না।

কোরআনে নামাযঃ
“আর দিনের দুই প্রান্তেই নামায ঠিক রাখবে এবং রাতের প্রান্থভাগে”(১১:১১৪)। দিনের দুই প্রান্থের সহিত রাতের প্রান্থের কথা বলা আছে। দিনের অপর প্রান্থ ও রাতের প্রান্থভাগ মিলে কতটুকু সময় তা কোরআনে উল্লেখ আছে অন্য আয়াতে। “সূর্য ঢলে পড়ার সময় থেকে রাত্রির অন্ধকার পর্যন্ত নামায কায়েম করুন”(১৭:৭৮)। সূর্য ঢলে পড়ার অর্থ দুপুরের পর থেকে রাত ঘন বা অন্ধকার (পশ্চিম আকাশের লালিমা পুরোপুরি মুছে যাওয়া পর্যন্ত) হওয়া পর্যন্ত; অর্থাৎ যোহর থকে ঈশা পর্যন্ত।

যোহর থেকে ঈশা পর্যন্ত ক্রমাগত নামায আদায় করা সম্ভব না। শারীরিক ধকল, লম্বা সময় ধরে নামাযে মনোনিবেশ ও একগ্রতা কারোর পক্ষে সহজ নয়। পরিবারের জীবিকা এবং সূর্য ঢলে যাওয়ার পর থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত জীবনের প্রয়োজনীয়তার গুরুত্ব খুব। কৃষিকাজ, গবাদিপশু, ব্যবসা, চাকুরী, রাতের প্রস্তুতি সবকিছুতেই সঙ্কট দেখা দেয়। ইবাদতে মশগুল হলে জীবনের প্রয়োজনীয়তা বাধাগ্রস্থ হয় আর প্রয়োজনীয়তার দিকে গুরুত্ব দিলে ইবাদতে ব্যাঘাত ঘটে। তাই জানতে হবে নবী(সা) সূর্য ঢলে পড়ার পর থেকে রাত্রি অন্ধকার পর্যন্ত বাস্তবে কিভাবে এই সময়টুকু ব্যবহার করেছেন অর্থাৎ নবী(সা)-র সুন্নাহ কি ছিল। এই সময়টুকুতে যোহর, আসর, মাগরীব, ঈশা চার বারে চার ওয়াক্ত নামায আদায় করেছেন। চার ওয়াক্ত নামাযের মধ্যে বড় সময়ের ফাঁক রয়েছে যেন জীবন ও পরিবারের প্রয়োজনগুলো সম্পন্ন করা যায়। কোরআনের বেশ কিছু আয়াতে দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত নামাযের উল্লেখ আছে (৩০:১৭, ৩০:১৮, ২০:১৩০, ২৪:৫৮, ২:২৩৮)। নামাযের আগে ও পরে যে সুন্নত নামাযগুলো রয়েছে তা ঐচ্ছিক। সুন্নত নামায আদায় করলে কল্যাণ আছে আর না আদায় করলে গুনাহ নাই।

শিয়া মতালম্বী ও অন্য কিছু দল সূর্য ঢলে পড়ার পর থেকে রাত্রি অন্ধকার হওয়া পর্যন্তকে বুঝে দুই ওয়াক্ত আসর ও মাগরীব, কেহ এক ওয়াক্ত আবার সূফীইজম ও অতি ভক্তিমূলক কিছু পীরের দল নামাযই আদায় করে না। কোরআন অনলিদের মত এদের দাবী নামায হচ্ছে জিকির ও কোরআন পাঠ। সূফীইজমের নামে পীরের অনুসারীরা বলে “শারীরিক রুকু, সেজদা সাধারণদের জন্য”। ইহা সম্পূর্ণ ভুল একটি মতবাদ। সূফীইজম নিষেধ নয় কিন্তু সুন্নাহ ঠিক রেখে সূফীইজম। সম্পূর্ণ জীবন পদ্ধতি সুন্নাহ সহিত সম্পর্ক না থাকলে, তার সূফীইজম নাই; এরা ভণ্ড এবং মিথ্যুক। তারা তাদের ভাবের মাধ্যমে অন্যদের বুঝাতে চায়, তারা মানুষরূপী ফেরেশতা। আসলে এইগুলো মানুষরূপী শয়তান এবং এই শয়তানগুলোকে ভাল করে চিনতে রাখা দরকার, কারন এরাই ফিতনা তৈরি করে। সমাজে এদের অনেকে পীর, দরবেশরূপে বিরাজময়ান। কোরআনের সাথে এদের কোন সম্পর্ক নেই আর যে আয়াতগুলো নিজেদের মতবাদের পক্ষে কাজ করে যেগুলো মুখে আওরায়। অনেকে আবার যোহর ও আসর একসাথে এবং মাগরীব ও ঈশা একসাথে আদায় করে। ইহা সঠিক নয়। হজ্বের মৌসুমে আরাফাতের ময়দানে যোহর ও আসর একসাথে এবং মুজদালিফায় মাগরীব ও ঈশা একসাথে আদায় করার নিয়ম। এটা শুধু হাজীদের জন্য হজের সময় একদিনের জন্য। এই নিয়ম জীবনের অন্য সময়ে প্রয়োগ করার অনুমোদন নেই। নবী(সা) যেভাবে শিখিয়েছেন, দেখিয়েছেন শুধুমাত্র সেই পদ্ধতি অনুসরণ করা লাগবে এর বেশি বা কম নয়। নবী(সা)-র সুন্নাহ ব্যতীত নিজেকে “মুসলিম” দাবী করার কোন উপায় নেই। নবী(সা) মক্কা-মদীনায় ওয়াক্তসহ নামাযের নিয়মকানুন, পদ্ধতি প্রতিষ্ঠা করে গেছেন। এই নামাযের ওয়াক্ত ও নিয়ম কিয়ামত পর্যন্ত বলবৎ থাকবে। কেহ যদি পণ্ডিতি করে নিজের জ্ঞান দিয়ে বুঝে এবং বুঝার চেষ্টা করে পথভ্রষ্ট হয় কিংবা অমুক বাবা বা পণ্ডিত বা হুজুর যা বলেছে তাই সঠিক মনে করে পালন করা শুরু করে আর এতে করে নিজের বিবেকবোধকে নিজেই তালাবদ্ধ করে রাখে, সেখানে কিছু করার থাকে না।

বর্তমান অধিকাংশ মুসলিমগনঃ
শিয়া, সুন্নী সহ দুনিয়াতে যত প্রকার দলাদলি তার মূল কারন রাজনীতি। ক্ষমতা ও রাজনীতির কারনে মুসলিমদের মাঝে মতানৈক্য আর তা থেকে বিভক্তি। কোরানের ব্যাখ্যা নিজেদের মধ্যে বিভিন্ন ভাবে প্রয়োগ করার দাবী করলেও ভিতরে রাজনীতির কারনে ইসলামের শুরুতেই খারেজী, মুতাজিলা তারপর বহু দলের সৃষ্টি। নবী(সা)-র শেখানো ও দেখানো দ্বীনের দীক্ষা, ভাতৃত্ব বন্ধন, শিষ্টাচার, ধৈর্য, বিনয় থেকে দূরে সরে গিয়ে পরবর্তী ক্ষমতাধর কতক দিশাহারা অনুসারী এবং শাসকদের হাত ধরে কিছু সংখ্যক পথভ্রষ্ট আলেম মতবাদ প্রতিষ্ঠিত করে সাধারণ মুসলিমদের বিপথগামী করার মাধ্যমে দলাদলির সৃষ্টি। অপব্যাখ্যা, বানোয়াট হাদিস, নিজেদের মতবাদ ঢুকিয়ে অতিরঞ্জিত করে ধর্মের মূল বিষয় থেকে সরিয়ে সাধারণদের সহজেই পথভ্রষ্ট করেছে এবং করছে। সাধারণ মুসলিমদের আবেগকে উজ্জীবিত করে বিবেককে সরিয়ে নিজেদের উদ্দেশ্য হাসিল করছে। আর সাধারণরা যারা সংখ্যায় অধিক নিজেদের বিচার বোধকে বিক্রি করে পক্ষপাতিত্বের চেয়ারে শক্তভাবে আসন গেঁড়ে বসে নিজেরাই নিজেদের পথভ্রষ্ট করছে। এই সকল নির্বোধদের বুঝানো যায় না। বর্তমান দুনিয়ার মুসলিম জাতির একটা অংশ তারই উদাহারণ।

সুদ, অবৈধ যৌনতা, অশ্লীল সংগীত ইত্যাদি হারামকে হালাল করার জন্য এক শ্রেনীর মডারেট মুসলিম নামধারী উঠেপড়ে লেগেছে। অনেকাংশে সফলও হচ্ছে। দূর্বল ও সহিহ হাদিসের মনগড়া ব্যাখ্যার সাথে নিজেদের মতামত(ফতোয়া) মাধুরী মিশিয়ে উপস্থাপন করে ইসলামের অনুসারীদের মধ্যে বিপথগামী করার উদ্দেশ্যে নিয়োজিত রেখেছে। মদ্য পান ও জুয়া হালাল করার চেষ্টা চলছে। খৃস্ট অনুসারীদের যে ফাঁদে মদ, জুয়া হালাল করা হয়েছে, সেই ফাঁদ মুসলিমদের জন্য চেষ্টায় ব্যপৃত। আর বর্তমান দুনিয়ায় ইসলামের অনুসারীরা ঈমানের দূর্বলতার দরুন, ইসলামে ফাঁক-ফোকর এবং হারামকে বৈধ করার রাস্তা খোঁজে। আর মুসলিমদের মনগড়া ব্যাখ্যার সহিত নিজেদের চাওয়া-পাওয়া মিলে গেলে, গ্রহণ করার মাধ্যমে ঝাপিয়ে পড়তে দেরি করে না। কোরআন কি বলে বা নবী(সা)-র নির্দেশ কি- তা দেখার প্রয়োজন বোধ করে না। পক্ষপাতিত্ব ও প্রবৃত্তি পূজার সহিত “অন্ধ” এবং পাপের সমুদ্রে ডুবে আছে।

ইসলামের অনুসারীদের অনেকে “সুদ”-কে এখন হারাম মনে করে না। তাদের এক অংশের দাবী ব্যাংকের সাথে সুদের যে লেনদেন করা হচ্ছে তাতে কাউকে জুলুম করা হচ্ছে না। কাউকে জুলুম না করলে সুদ হালাল। কোরআন বাদ দিয়ে নিজেদের মনগড়া ফতোয়া নিজেদের জীবনে প্রয়োগ করছে। সুদের টাকা দিয়েই হজ্জ্ব, ওমরা, দান খয়রাত, সামাজিক মর্যাদা, যাকাত, মসজিদ-মাদ্রাসা নির্মান, ইসলামের খেদমত ইত্যাদি। নিজ ও নিজ পরিবারের বিলাসিতা, নিরাপত্তা নিশ্চিত করে ধর্মকে বানিয়েছে ঐচ্ছিক। আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্ন করার সাথে বিলাসিতা ও হিংসার প্রতিযোগীতায় মোহাচ্ছন্ন আর সাথে আছে অর্থের বড়াই। আধুনিকতার ছোয়ায় বিলাসিতার সহিত সামাজিক স্ট্যাটাস নির্ধারিত এবং এই স্ট্যাটাস ধরে রাখতে মরিয়া প্রয়োজনে ধর্মকে বিসর্জন দিতেও দেরী নয়। অথচ ৪৭:১২ বলছে, বিলাসিতা ও ভোজনবিলাসীদের জন্য জান্নাত হারাম। দুনিয়ার জীবন নিয়ে চরম দুশ্চিন্তার ভিতর আর ঘরে অদৃশ্য আগুনের অশান্তি সর্বদা বিরাজমান। আচরণে অধিক কর্কশতা, দাম্ভিকতা, জোড়ালো স্বর ও কতৃত্বকে ফুটিয়ে তুলা উচ্চ শ্রেনীর সামাজিক স্ট্যাটাস বলে চেতনায় ধারণ করে। ভুল ধরিয়ে দিলে সেটা হয় গর্হিত কাজ। “দম” নাকের অগ্রভাগে এমনকি হাসপাতালের বিছানায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগের আগেও চলে আত্মতৃপ্তির সহিত সম্পদের গণনা ও হিসেব। তাদের আফসোস চলতে থাকে কেন জীবদ্দশায় ঐ সম্পদটি ক্রয় বা ব্যবসাটি করল না তাহলে আরো অর্থ বিত্তের মালিক হতে পারত। ইসলামের অনুসারীদের মাঝে এই ধরণের মানসিক বিকারতার সংখ্যা অধিক। মোহাম্মদ(সা)-র শিক্ষা, আদর্শ, সুন্নত তরীকা উধাও আর এ কারনেই দেখা যায় ঘরে ঘরে অশান্তির আগুন।

কষ্ট করে অর্থ, পুঁথিগত বিদ্যা অর্জন করলে তা অন্যদের দেখানো একটি মানসিক প্রবৃত্তি। মানুষের সকল কাজ বা অকাজের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে প্রতিপত্তি অর্জন ও স্বীকৃতি আদায়। সম্পদ অর্জন ও উচ্চ আয়ের উদ্দেশ্য হচ্ছে ভোগ করা। শুধু ভোগ করলেই হবে না, এ ভোগ হতে হবে প্রদর্শনযোগ্য ও সুস্পষ্ট। লোকেরা যাতে প্রশংসা করে ভাসাতে পারে। অর্থ-সম্পদ গণনা ও নিজ জেনেরেশনের জন্য অঢেল অর্থসম্পদ রেখে যাওয়া এবং ইহা মনে করার মাধ্যমে এক বিশাল তৃপ্তির সাগরে ডুব। মানুষ অন্যদের সুখ বা সফলতার সাথে বেশি কানেক্ট করতে পারে, অন্যদের দু:খ-কষ্টের সাথে সংযুক্ত হতে পারে না। মানুষরা ইহা জানে বিধায় দু:খ কিংবা না পাওয়া চাপা দিয়ে রাখে। অন্যদিকে অর্থ সম্পদ অর্জন এগুলো বড়াই করে প্রদর্শন করে।

নিজ অন্তরে শান্তি বিরাজ না করলে অর্থ, সম্পদ, বিদ্যা দিয়ে অন্যকে দেখিয়ে, তুলনা করে আত্মতৃপ্তির ভিতর ডুবে থাকে। অমুসলিমদের চেয়ে মুসলিমদের এই প্রবণতা বেশি। “রিয়া” অহংকারের একটা বড় শাখা। অর্থের অহংকারে, সহসা অঢেল টাকার মালিক হলে নিজেকে আর মানুষ ভাবতে চায় না। অহংকারের দরুন মানব জাতি থেকে উপরের স্তরের কিছু একটা ভাবতে শুরু করে আরো মনে করে আশপাশের মানুষজন দাসদাসী। আচরণ ও কথার ধরণ এমনই। অবজ্ঞা ও খামখেয়ালী এদের স্বভাব। ঈমান, সম্মান, জান্নাতের টিকিট সব কিছু অর্থের বিনিময়ে কেনা হয়ে গেছে- এমনি ভাব। অর্থের অহংকারে এই শ্রেণী মোনাফেক এবং সম্পূর্ন মানসিক বিকারগ্রস্থ- সেই বুঝ নেই। “তাকওয়া” কি- তা জ্ঞানে নেই আর অন্তরে থাকার চিন্তা করার প্রয়োজন বোধ করে না। এই সকল মানসিক ভারসাম্যহীন মুসলিম নামের মানুষগুলো সমাজ ও সভ্যতার জন্য উদ্বেগজনক।

ইসলামের অনুসারীদের মধ্যে অধিক সংখ্যক নামাযের ভিতর কি বলছে, কি উদ্দেশ্যে বলছে, কার উদ্দেশ্যে বলছে- তা জানা নেই এবং জানার প্রয়োজনও বোধ করে না। নামায, রোজা যা আদায় করছে- তা যথাযথ ভাবে হচ্ছে কিনা সেদিকে ভ্রূক্ষেপও নাই। নামায মানে আল্লাহ্‌র সাথে সরাসরি কথা বলা। বিনয়ের সর্বোচ্চতার সহিত আল্লাহ্‌র সামনে দাঁড়াতে হয়। সূরা ফাতিহার সাত আয়াত সাত বারে বিনয়ের সহিত অন্তর লাগিয়ে পাঠ করতে হয়। জামাত, কিছু জায়গার রমজানের তারাবী, একাকী নামায এক/দুই দমে সূরা ফাতিহা পাঠ করে আদায় করা হয়- তা নামায তো নয়ই বরং আল্লাহ্‌র সাথে বিয়াদবী। দুনিয়ার ঈমামগণদের একটা সংখ্যা পাঁচ ওয়াক্ত নামাযের সূরা ফাতিহা পাঠ তা সহিহ মোতাবেক হয় না। দ্রুততার সহিত পাঠ করা হয়। যে নামাযে বিনয় নেই, খেয়াল নেই- সেটা নামায নয়। মুসলিমদের মাঝে বড় একটি সংখ্যা হজ্ব/ওমরা আদায় করে এই উদ্দেশ্যে যে, অতীতের সব গুনাহ মাফ হয়ে যাবে। সারাজীবন পাপে নিমজ্জিত থেকে শেষ বয়েসে হজ্ব করে পবিত্র হয়ে পাপমুক্ত হয়ে যাবে- এমন ধারনা পোষণ করে রাখে। আর এজন্যই মুসলিমদের বিরাট একটা সংখ্যা সারা জীবন গুনাহ করে বৃদ্ধ বয়সে হজ্ব করতে আসে। ইহা শতভাগ ভুল এবং ভুল চিন্তা ও কর্ম। আল্লাহ ক্ষমা করেন তাদের, যারা ভুলক্রমে পাপ করে। তারা সর্বদা তওবা করে, এস্তেগফারের মাধ্যমে নিজেদের পবিত্র রাখেন। হাজার বার ওমরা/হজ্ব আদায় করা হলেও কোন ফায়দা নাই যদি রাসুল(সা)-কে উপলদ্ধির পরেও যৌবন বয়সে যারা পাপে নিমজ্জিত এবং নিজেদের বিবেকবোধ থেকে পালিয়ে পাপে লিপ্ত ছিল। শেষ বয়সে তওবা তাদের জন্য যারা সারাজীবন সত্যকে উপলদ্ধি করতে পারেনি কিংবা যারা অন্য ধর্ম থেকে এসে ঈমান এনে মুসলিম হয়েছে। তওবার বড় শর্ত অনুশোচনা। ইহা নিজের বিবেকবোধ ও অন্তর থেকে তৈরি হয়। আর লজ্জ্বাশীলতা ব্যতীত অনুশোচনা বা বিবেকের দংশন তৈরি হয় না। কতজন মুসলিম নিজের পাপের জন্য বিবেকের দংশনের আগুনে পুড়ার অনুভব করেন? শেষ বয়সে হজ্ব করে জান্নাতের আশা যারা করে, সেই আশা অর্থহীন। তারা ৩:১৪২ আয়াত অনুধাবন করেনি, কোরআন বুঝে পড়েনি ভিতরে কি বলা হয়েছে।

সরল অন্তরধারী না হয়ে ইবাদত যা করা হয়, সেই ইবাদত কবুল হওয়ার বিষয়ে প্রশ্নবিদ্ধ। নামায কবুল হওয়ার শর্ত বিনয় এবং নামাযের খেয়াল অর্থাৎ বুঝে নামায আদায় করা বা যত্নবান (২৩:২, ২৩:৭)। সরল অন্তরধারী না হলে বিনয় ও যত্নবান কোনটাই সম্ভব না। কিন্তু অধিকাংশ মুসলিমদের এই বুঝ আত্মস্থ করতে চায় না। কোরআন পড়া বাদ দিয়ে মোল্লা ও ভণ্ডদের কথা শুনে এবং আমল করে। সরল অন্তরধারী না হলে ১৩:২৮ আয়াত বুঝা কঠিন তা যত বড় আলেমেই হোক বা পণ্ডিত আর অনুধাবন সে তো আরও পরের বিষয়।

সরলতাকে অন্তরে ধারণ না করলে মুসলিম ঐক্য, ভাতৃত্ব বন্ধন সম্ভব নয়। অন্যের মতবাদ ও বিশ্বাসকে সম্মান করতে চাইলে সরলতার বিকল্প নাই। নিজেদের মধ্যে মতানৈক্য হলে কোরআন ও সুন্নাহর দিকে ফিরে যেতে হবে। তাতে সমাধান না হলে, সৃষ্টিকর্তার কাছে নির্ভশীলতা এবং তর্কে না জড়ানো। তর্ক করা শয়তানের কাজ এবং নিজের ব্যক্তিত্ব কলঙ্কিত করা। রফয়ে ইয়াদাইন, জুড়ে আমিন, হাত বুকের উপর নাকি নাভির উপর এই সকল মুস্তাহাব নিয়ে মুসলিমদের মাঝে বাড়াবাড়ি যারা করে তা সংকীর্ণতার পরিচয়। এই মাজহাব ঐ মাজহাবকে বা আহলে হাদিসকে আক্রমন আবার বিপরীত মুখী আক্রমন। নিজেদের আমল ও ঈমান নিয়ে ব্যস্ত না হয়ে সীমা লঙ্গনে ব্যস্ত। ঈমাম মাহদী বা দাজ্জাল আবির্ভাব বা আলী যার উপাধি মওলা, অমুক বাবা, তমুক পণ্ডিত… ফিতনা এখন মুসলিম জাতির ভিতর প্রকট। ঈদে মিলাদুন্নবী ইসলামের ভিতর আরেক বড় ফিতনা। ১২ই রবিউল আউয়াল নবী(সা)-র ইন্তেকাল ইহাতে সকলেই একমত। কিন্তু ১২ই রবিউল আউয়াল নবী(সা)-র জন্মদিন সেই ব্যাপারে কেহ একমত নয়। আলেমগণ বিভিন্ন তারিখে নবী(সা)-র জন্ম তারিখের কথা বলে থাকেন। ১২ই রবিউল আউয়াল নবী(সা) মৃত্যুর এই দিনটিতে খুব কষ্ট পেয়েছেন আর মুসলিমরা এই দিনে আনন্দ উৎসবে মেতে আছে। যে খোলা চোখে ঘুমায় তাকে জাগানো যায় না। যারা বাড়াবাড়িতে লিপ্ত তাদের অন্তরে “তাকওয়া” কখনই আসবে না। নবী(সা)-র জন্মদিন নিয়ে কেন বাড়াবাড়ি? সাহাবী, তাবেঈন, তাবে-তাবেঈনরা ঈদে মিলাদুন্নবী পালন করেন নি। নবী(সা) মারা যাবার পাঁচশত বছর পর ঈদে মিলাদুন্নবীর আবিষ্কার। মাজারের ব্যবসায়ীদের কাছে মিলাদুন্নবী একটি রমরমা ব্যবসা। নবী(সা)-কে যদি মোহাব্বতের সহিত সন্মান করা হয় তবে তাঁর সুন্নত, তাঁর জীবন ধারণের কর্ম পদ্ধতি নিজের চরিত্র ও জীবনে ধারণ করলেই হয় কিন্তু তা না করে ফিতনা তৈরিতে উদ্যমী। ঈদে মিলাদুন্নবীর সাথে আকীদার কোন সম্পর্ক নেই।

ঈদ-উল-আযহা বা কোরবানীর শর্তটি হচ্ছে “তাকওয়া”। “আল্লাহ কোরবানীর রক্ত, মাংস কবুল করেন না, কবুল করেন মনের তাকওয়া(২২:৩৭)”। তাকওয়া কি?- মুসলিমদের জ্ঞানে ইহা নেই। আলেম যারা অর্থের বিনিময়ে জ্ঞান বিতরণ করে তারা এই তাকওয়া সাধারণ মানুষদের বুঝাতে অক্ষম, কারন এরা নিজেরাও জানে না। দুনিয়ার অন্যতম বড় একটি শিক্ষা কোরবানী। ইব্রাহীম(আ) তাঁর জীবনের সবচেয়ে প্রিয় বস্তু নিজ পুত্রকে কোরবানী করেন আর এই উদ্দেশ্যে সন্তান কেন পিতার আদেশ বাস্তবায়িত করার জন্য নিজের জান উৎসর্গ করেন? এই “কেন”-র উত্তর জানলে কোরবানীর মর্ম বুঝা যাবে। ইব্রাহীম(আ) এমন কি শিষ্টাচার, আদব, ধৈর্য, লজ্জাশীলতা, সম্মানবোধ, মমত্ববোধ ইত্যাদি এবং হিংসা, বিদ্বেষ, অহংকার, লোভ থেকে নিজেকে নিভৃত হওয়ার শিক্ষা ইসমাঈল(আ)-কে শিখালেন যা পুত্র, পিতার প্রতি নিজের প্রান উৎসর্গ করতে কোন দ্বিধা করেন নি। ইহা বুঝাই কোরবানীর মর্ম ও শিক্ষা। “ভালবাসা” ও “স্নেহ”-এর মাধ্যমে কিভাবে সন্তানকে পরাজিত করতে হয়- এই দীক্ষা অত্যন্ত সাহস ও ধৈর্যের পরীক্ষা। ইহাই পিতার চরম সফলতা। বর্তমান জমানায় এই মহামূল্যবান দীক্ষা নাই বললেই চলে। এই জ্ঞান আলেম বা ইসলামিক পণ্ডিতগণ দীক্ষা দিতে অপারগ। বর্তমান জমানার মুসলিম পিতারা সন্তানকে স্বপ্নের মাধ্যমে কোরাবানীর কথা বললে সন্তানরা কি রিপ্লাই করবে? রিপ্লাই কি হবে- তা সহজেই অনুমেয়। ভয়ংকর কিছু ঘটবে তাতে সন্দেহ নেই। কোরবানীটা অনেক জাতির ভিতর সামাজিক স্ট্যাটাস। মানুষ দেখানো কোরবানী। সারা বছর নামাযের খবর নাই, রোজার খবর নাই, কোরবানীর সময় সবচেয়ে বড় জন্তুটি কিনা চাই। ঘুষ, সুদ, অবৈধ টাকায় কোরবানী। এদের কর্ম অসৎ ও মন্দ- তা তারা ভাল করে জানে এবং জেনেও করছে। সমাজে অনেক পবিত্র অন্তরধারী মুসলিম রয়েছেন কিন্তু তাদের সংখ্যা অল্প।

তবলীগ জামাতের উসিলায় অন্তরে নম্রতা প্রতিষ্ঠার সহিত সুন্নতের অনুশীলন হয়, যা মুসলিমদের আঁচরণ তৈরির জন্য খুব প্রয়োজন। তিন চিল্লাহর সাথে সম্পৃক্ত হলে উগ্রতা ও উচ্ছৃঙ্খলতার দরজাগুলো অনেকটা বন্ধ হয়। সুন্দরতার প্রকাশ। তাবলীগের ভাল দিক যেমন আছে তেমনি আছে কিছু মন্দ। এই অনুসারীগণ জ্ঞান ধার করে। অন্ধ ভাবে ইসলাম অনুসরণ করে, ব্লাইন্ড বিলিভার। কোরআন-হাদিস বাদ দিয়ে ফাজায়েলে আমল ও ফাজায়েলে সাদাকাত পড়তে উৎসাহিত করে। আর বিভিন্ন বুজূর্গীদের বানোয়াট অলৌকিক কেরামতির কেচ্ছা-কাহিনী যা তাদের মুখে মুখে- শুনতে লজ্জাজনক ও আপত্তিকর। বানোয়াট কেচ্ছা-কাহিনী, আজগুবি গল্পের মাধ্যমে ইসলামকে মুসলিম, অমুসলিমদের কাছে হেয় করা হচ্ছে। নবী(সা) গায়েব জানতেন না, সাহাবীদের অলৌকিক কেরামতি নেই অথচ কোথাকার অদৃশ্য, কাল্পনিক বুজূর্গীদের জীবনে আলৌকিক কেরামতির ঘটনা দিয়ে ভরপুর আর এই সব মিথ্যা-উদ্ভট কাহিনী তবলীগ জামাতের অধিকাংশ মুসল্লিদের মুখে মুখে। তবলীগের বুজুর্গীদের বানোয়াট গল্প বৈদিক ধর্মের উপনিষদ, পুরাণে বিদ্যমান। সনাতন দর্শনের পুরাণগুলো মিথ্যা অলৌকিক কেরামতি গল্পের এক বিশাল ভাণ্ডার। পুরাণ অধ্যায়ন করলে সুস্থ বিবেক কখনই গ্রহণ করবে না। ইসলাম গায়েব বা অলৌকিক কেরামতি দিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়নি। ইসলামে প্রতিষ্ঠিত হইছে অন্তরজ্বালা, অন্তর নিংড়ানো, অন্তর শিহরিত কষ্টের মাধ্যমে। আর দাওয়াতের কাজ করতে হলে নিজেকে বিলীন করতে হয়। নবী(সা) তায়েফে যেভাবে লাঞ্ছিত ও শারীরিকভাবে নির্যাতিত হয়েছেন সেই অনুভূতি অন্তরে স্থাপন করা লাগবে এবং স্থাপন করার পদ্ধতি জানা লাগবে, নিজেকে প্রস্তুতি করা লাগবে।

“উগ্রতা” এক ভয়ানক বিষবৃক্ষ। ইহা শুধু ব্যক্তি জীবনকেই প্রভাবিত করে না, সমাজ জীবন, রাষ্ট্রীয় জীবন এমনকি দুনিয়াকেই ধ্বংস করে দেয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে একজনের উগ্রতা ও কামনার কাছে পুরো দুনিয়া ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে গিয়েছিল। ইতিহাসে উগ্রতার উদাহরণ অগণিত। মতানৈক্য এবং নিজের মত প্রতিষ্ঠা করার উদ্দেশ্যে ইসলামের ভিতর উগ্রতা ভয়ানক ভাবে শিকড় গেঁড়ে আছে। ইসলামে খারেজীদের দ্বারা উগ্রতার সূত্রপাত হলেও বর্তমান দুনিয়ায় উগ্রতা মুসলিমদের মাঝে চরমে রূপ নিয়েছে। নিজেদের মত করে কোরআন বুঝে এবং জিহাদের ভুল ব্যাখ্যা করে। মিথ্যা বুঝিয়ে আর আবেগ দিয়ে মুসলিমদের মাথা এমন ভাবে ধোলাই করা হয়েছে যে বিশেষ করে মুসলিম ইয়ং জেনেরেশন বস্তুনিষ্ট চিন্তা ও কোরআন-হাদীসের তাহকীক করতে ব্যর্থ। নিজেদের আমল এবং আত্মশুদ্ধির দিকে নজর না দিয়ে অন্যের ভুল ও সংশোধনে আত্মনিয়োগ করে নিজেদের মতাদর্শ প্রতিষ্ঠা করতে জিহাদের নামে এবং মোহাম্মদ(সা) ও তার অনুসারীরা অমুসলিমদের সাথে যুদ্ধ করেছেন তাই তারাও এই তরিকার অনুসারী- এমনটি দাবী করে অবৈধ হত্যা, দাঙ্গাহাঙ্গামায় লিপ্ত আর এভাবেই “উগ্রতা” এদের ভিতর আসন গাড়িয়া লয়। অন্তর ও আচরণে সৌন্দর্য না হলে জ্ঞানার্জন বৃথা এবং ঈমানের সৌন্দর্য পূর্ণরূপে বিলুপ্ত। আর অতীব গুরুতর হচ্ছে রাষ্ট্র প্রধানের নির্দেশ ব্যতীত জিহাদ(যুদ্ধ) করার অনুমোদন ইসলামে নেই এবং এই অনুমোদন শুধু ডিফেন্সিভ যুদ্ধের উদ্দেশ্যে। অন্ধ বিশ্বাস এবং অন্ধ গোঁড়ামি থেকে নাস্তিকতা অনেক ভাল।

শারিয়া আইন এক ভয়ানক। একেক ঈমাম একেক ভাবে মাসলা-মাসায়েল, ফতোয়া প্রকাশ করেছেন। প্রত্যেক ঈমামদের অনুসারীদের চাওয়া, শুধু তাদের ঈমামের আইন বলবৎ থাকুক। যারফলে ঈমাম অনুসারীদের নিজেদের ভিতর কোন্দল, দাঙ্গা-হাঙ্গামা, হত্যা লেগেই থাকত। অন্যের মতামতের প্রতি সন্মানবোধ পরবর্তী মুসলিম অনুসারীদের ভিতর খুব কম লক্ষিত। ভিন্ন মত হওয়ার কারনে ঈমাম শাফেঈ-কে হত্যা করে ঈমাম মালিকের অনুসারীরা। সিহা-সিত্তার ঈমাম নাসাঈকে পিটিয়ে মেরে ফেলে মুয়াবিয়া ও উমাইয়াদের স্বীকৃতি না দেওয়ার কারনে। উমাইয়া রাজা মনসুর নিজের পক্ষে আনতে পারেনি বিধায় ঈমাম আবু হানিফাকে বিষ প্রয়োগে হত্যা করে। ঈমাম বুখারীকে শেষ বয়সে নির্বাসনে যেতে হয়েছে। এমন ঘটনার সংখ্যা বহু। মুসলিম উন্মার ঐক্যের বিনাশ নবী(সা) মারা যাবার পর থেকে দৃষ্ট। বিভিন্ন ঈমামদের ফিকহ ও কিতাবগ্রন্থগুলোতে পরবর্তীতে তাদের অনুসারীরা সংযোজন-বিয়োজন করেছে। গম, যব, মধু, বার্লি, ভুট্টা থেকে তৈরী মদ হালাল এবং এই মদ খেয়ে মাতাল হলেও শাস্তি দেওয়া যাবে না (হানাফি শারিয়া কেতাব “হেদায়া”, ৪র্থ খন্ড) যা সরাসরি কোরআনের আয়াতকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করে। কোন নারিকে অপবাদ দিলে তার পক্ষে চার জন প্রত্যক্ষ সাক্ষীর প্রয়োজন অথচ সেই অপবাদের কোরআনের আইনকে ধর্ষিত মহিলার ক্ষেত্রে প্রয়োগ করেছে যা ধর্ষিত মহিলার পক্ষে প্রমান করা অসম্ভব। দুনিয়ার অনেক জায়গায় ধর্ষিতা মহিলারা বিচার পাচ্ছ না। কোরআন ও অন্য ঈমামদের ফতুয়া অনুসারে, রাগের মাথায় তালাক একবার বলা হোক বা বেশি বলুক তা “এক তালাক” হিসেবে গণ্য তারপর নির্দেষ্ট সময়(ইদ্দত) পর দ্বিতীয় তালাক। এই নির্দিষ্ট সময়ে নিজেদের মধ্যে ভুল ভাঙ্গার সুযোগ দেয়া হয়েছে যেন তারা আবার সুন্দর জীবনযাপন করতে পারে এবং তাদের ফিরে আসার পথে বাঁধা না দেওয়ার কথা বলা আছে। কিন্তু হানাফি মাজহাবে তিন তালাক রাগের মাথায় হোক বা ঠান্ডা মাথায় বলা বা উচ্চারণ করা হলে, বিবি তালাক হয়ে যাবে। কোন স্বামীস্ত্রীর যদি মিল কোন ভাবেই না হয় তখন অভিবাবকের মাধ্যেমে সালিশ হবে, তারপরেও মীমাংসা না হলে তখন একসাথে তিন তালাক বললে তিন তালাক সম্পূর্ণ হয়ে যাবে। একসাথে তিন তালাক বললে তিন তালাক হবে নাকি তিন তালাক বললে এক তালাক হবে- সেটা পরিস্থিতির উপর নির্ভর করে। ঈমামদের ভেজাল ফতোয়ার সংখ্যা অনেক। দুনিয়ার দুই-তৃতীয়াংশ মুসলিম হানাফি মাজহাবের অনুসারী। হানাফির কিতাবে আছে, মদ হালাল তাই কোরআন-হাদিস দেখার প্রয়োজন নেই। হানাফির ফতোয়াই কোরআন-হাদিস। দুনিয়ার মুসলিমরা অ্যালকোহল পান ফতোয়া খুজতেছে এবং পেয়েও গেছে। শারিয়া আইনের সংস্কার না হলে মুসলিম উম্মাহকে অনেকাংশে ধ্বংস করবে। বিবেকবোধ জাগ্রত রাখা জরুরী যেমন হাদিসের ক্ষেত্রে একই রকম ঈমামদের ফতোয়ার ক্ষেত্রে।

মুসলিমদের মাঝে এমন অনেক রয়েছে যারা নামায, রোজা আদায় করে আবার চুরি, লোভ, মিথ্যা, অকৃতজ্ঞতা অন্তরে ধারণ করে, সেইসাথে নিজেদের সাধুতার সনদ নিজেরাই গলায় ঝুলিয়ে রাখে। তাদের চারিত্রিক সমস্যাগুলো আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিলে তাতে তারা কঠোরতা অবলম্বন করে। শারীরিক ও মানসিক ঘায়েল করতে মনোনিবেশ করে। পরকালের ভয় বিন্দুমাত্র নেই। এরা মুসলিম নামধারী এবং সমাজের জন্য বিপদজনক।

আধুনিক মুসলিমদের পক্ষপাতিত্ব অন্তরে শক্তভাবে গেঁড়ে আছে। মিথ্যা বলতে বা সত্যকে দেখেও না দেখার ভান করে। অথচ তারা নামাজি, হাজী। নিজ, পরিবার, রাজনীতির পক্ষপাতিত্ব ও স্বার্থের কারনে সত্যকে প্রকাশ করে না, নিজেদের অন্তরের মোনাফিকী প্রকাশ করে চুপ থাকার মাধ্যমে ও মিথ্যার দ্বারা।

গুরুত্ব বিষয়: অধিক সংখ্যক মুসলিম জাহান্নামে যাবে মূলতঃ তিনটি কারনে। প্রথমতঃ হিংসা, দ্বিতীয়তঃ হিংসা, তৃতীয়তঃ হিংসা।

“ইহ-দিনাস সিরাতা’ল মুসতাকি’-ম” জান্নাতে যাওয়ার একমাত্র রাস্তা যাহাতে সাহাবীগণ, তাবেঈনগণ, তাবে-তাবেঈনগণ, ওলীগন, সৎকর্মশীল মুসলিম-গন ছিলেন এবং আছেন। মোহাম্মদ(সা)-র জীবনটাই সিরাতা’ল মুসতাকি’ম। মোহাম্মদ(সা)-র চরিত্র ও কর্ম অর্থাৎ সুন্নত তরীকা হলো সিরাতা’ল মুসতাকি’ম। এই সম্পর্কে কিছুটা আলোকপাত করা হয়েছে।

সাহাবীগণ ইবাদতের পাশাপাশি পরিবারের রিজিকের জন্য ব্যবসা করতেন, ফসলের মাঠে কাজ করতেন তারপরেও তারা জান্নাতের সর্বোচ্চ আসনে অধিষ্ঠিত হয়েছেন আর বর্তমান মুসলিমরা রাতদিন ইবাদতে লিপ্ত হওয়ার পরেও আমলনামা ডান হাতে পাবে কিনা- নিশ্চয়তা নেই। এর কারন? সাহাবী ও বর্তমান মুসলিমদের মধ্যে পার্থক্য শুধু একটি, আর তা হলো “উত্তম আখলাক”।

সূরা তওবা ও ইহার ৫ ও ২৯ নম্বর আয়াতের ব্যাখ্যাঃ
৯:২৯=>

“যাদেরকে কিতাব প্রদান করা হয়েছে তাদের মধ্যে যারা আল্লাহতে ঈমান আনে না এবং শেষ দিনেও নয় এবং আল্লাহ ও তার রাসূল যা হারাম করেছেন তা হারাম গণ্য করে না, আর সত্য দ্বীন অনুসরণ করে না; তাদের সাথে যুদ্ধ কর, যে পর্যন্ত না তারা নত হয়ে নিজ হাতে জিযইয়া দেয়”।

কোরআনের বহু আয়াত প্রসঙ্গ ছাড়া কোট করে ইসলাম বিদ্বেষীরা ইসলামকে আক্রমণ এবং আক্রমণাত্মক আয়াতগুলো তুলে ধরে ইসলামকে ত্রাস বা নিষ্ঠুর ধর্ম হিসেবে উপস্থাপন করার চেষ্টা। কোরানের আক্রমনাত্মক আয়াতগুলোর মধ্যে এই সূরার ৯:৫, ৯:৯, ৯:১১, ৯:১২, ৯:১৩, ৯:১৪, ৯:২৯, ৯:৭৩, ৯:১২৩ বিচ্ছিন্নভাবে উদাহারণ হিসেবে বেশি টেনে আনে। আবার এই উদাহারণগুলোর মধ্যে ৯:৫ ও ৯:২৯ আয়াতটি বেশি চিহ্নিত করে। তারা এই আয়াত সম্পর্কে বলতে চায়, হয় ইসলাম ধর্ম গ্রহণ কর নয়ত জিযইয়া কর দাও নয়ত যুদ্ধ কর। তাদের আরো দাবী, এই আয়াতের কারনে দুনিয়াব্যপী মুসলিমরা যুদ্ধ করার লাইসেন্স পেয়ে গেছে; তাই ইসলাম একটি বর্বর ধর্ম। অমুসলিমদের ন্যায় মুসলিমরাও এই আয়াতের বিস্তারিত সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা নেই।

সূরা তওবা নাজিল হয়েছিল মক্কা বিজয়ের পর। এই সূরাটি মক্কা বিজয়ের পর মদীনা রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি বুঝার জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। আলোচনায় যাওয়ার আগে, মক্কা বিজয় বা হুদায়বিয়া সন্ধি থাকার পরেও কেন আবু সুফিয়ান আত্মসমর্পণ করলেন সে প্রসঙ্গে স্পষ্ট ধারণা থাকতে হবে।

অনেকেই মনে করেন, মক্কা বিজয়ের মাধ্যমেই মুহাম্মদ (সঃ)-এর চূড়ান্ত বিজয় প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়। তার বিরুদ্ধে সকল পক্ষের শত্রুদের অবসান ঘটে। কিন্তু বাস্তবে এই সময়টিতেই তিনি কঠিনতম শত্রুতার মুখোমুখি হন। যে পরিস্থিতি আমরা আধূনিক যুগেও বহু রাষ্ট্রের ক্ষেত্রেই দেখতে পাই। বিপ্লবের পর প্রতিবিপ্লবের কঠিন চ্যালেঞ্জ! এই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করা অত্যন্ত কঠিন। এমনকি আমরা সম্প্রতিক সময়ে(২০০০ সালের পর) আফগানিস্তান, ইরাক, লিবিয়ায় দেখছি- যুদ্ধে একটি পক্ষকে পরাজিত করে ক্ষমতার অধিষ্ঠিতরা কি কঠিন চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করছে।

রক্তপাতহীন মক্কা বিজয়ের পর সেখানকার শক্তিশালী একটি পক্ষের কাছে মূহাম্মদ(সঃ) আরো বড় শত্রু হিসাবে আবির্ভূত হন। সেই সাথে পাশ্ববর্তী অঞ্চলের প্রধানদের নিজ নিজ অবস্থান টিকিয়ে রাখার জন্য নবী(সা) বড় চ্যালেঞ্জ। এই প্রেক্ষিতে হুনাইনের যুদ্ধ সংগঠিত হয়। এই যুদ্ধে মদিনা সামান্য ব্যবধানে বিজয়ী হলেও শত্রুদের তৎপরতা থেমে যায়নি।

ভিন্নমতের মত বা বিশ্বাসের ভিন্নতার কারনে যেমন শত্রু জন্মাতে পারে তেমনি একই মতের বা বিশ্বাসের মধ্য থেকেও কারো জন্য চরম শত্রুতা বা চরম বিপদ আবির্ভূত হতে পারে। ঠিক এই ’দুই শত্রু’- মুশরিক কাফের, কিতাবী কাফের এবং ’মুমিনদের’ মধ্যেই একটি বড় অংশের মুনাফিকী- মক্কা বিজয় নস্যাৎ করতে সম্মিলিতভাবে নানামুখী কি ভয়াবহ ষড়যন্ত্র- সে সম্পর্কে এই সূরায় বর্ণনা করা হচ্ছে। এই ষড়যন্ত্রের মোকাবেলায় তওবা সূরার প্রতিটি আয়াতে আয়াতে রাসুল (সঃ) কে প্রকৃত পরিস্থিতি অবহিতকরণ এবং এই পরিস্থিতিতে মুমিনদের কৌশল ও করণীয় সম্পর্কে উপদেশ দেওয়া হয়েছে।

বিশ্বাসীদের একটি অংশ মোহাম্মদ(সা)-কে হত্যার ষড়যন্ত্র করে যা জানা যায় ৯:১০৭ আয়াতে। পরবর্তী আয়াত ৯:১০৮, ৯:১০৯, ৯:১১০ আরো বিস্তারিত জানা যায়। অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি এতোই সংকটাপন্ন ছিল, বলা যায় প্রতিবিপ্লবের বিষয়টি আমলে না নেওয়া হলে মক্কা বিজয়ের পর অঙ্কুরেই ইসলামের বিনাশ আবশ্যম্ভী ছিল যা ৯:৩৯ আয়াতে সতর্ক করা হয়েছে। আর নবী(সা) ও প্রকৃত মুমিনদের জন্য সর্বপ্রকার উপদেশ শেষে এই সূরার সর্বশেষ আয়াতটি নাজিল হয়। “অতঃপর উহারা যদি মুখ ফিরাইয়া নেয়, তবে তুমি বলিও ‘আমার জন্য আল্লাহ্‌ই যথেষ্ট, তিনি ব্যতীত কোন ইলাহ নাই। আমি তাহারই উপর নির্ভর করি(৯:১২৯)”।

আধুনিক যুগের যুদ্ধের ময়দানে একজন সেনাপতি অবশ্যই এই সূরা পাঠে পরিস্থিতির গুরুত্ব ও তাৎপর্য সহজেই উপলদ্ধি করবেন এবং প্রদত্ত উপদেশসমূহ এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ ঘটিয়ে একটি নতুন রাষ্ট্র বা আদর্শ সুসংহতকরণে কতটুকু বাস্তবসম্যত, নিয়ন্ত্রণ, ন্যায়ভিত্তিক, মানবতাবাদী এবং যুদ্ধ কৌশল হিসেবে কার্যকরী সে তাৎপর্য নিশ্চই আমাদের মতো সাধারণ পাঠক থেকে আরো বহুগুণে গভীরভাবে উপলদ্ধি করতে পারবেন।

এই সূরার রুকু ১ থেকে রুকু ৩ পর্যন্ত মদিনা রাষ্ট্রের অধীনে এবং মদিনার সাথে চুক্তিবদ্ধ মুশরিক; রুকু ৪ ও রুকু ৫ কিতাবী; রুকু ৬ থেকে রুকু ১১ ও রুকু ১৩-তে মুনাফিক, রুকু ১২ বেদুঈন বা মরুবাসীদের সম্পর্কে বলা হয়েছে। এই চারটি পক্ষ মদিনা রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ স্টেকহোল্ডারও। এই সূরার বিভিন্ন আয়াতের মাধ্যমে এই চার পক্ষ সম্পর্কে নবী(সা)-কে বিস্তারিত তথ্য প্রদান, তাদের বিরুদ্ধে করণীয়, করণীয় নয় এবং সামরিক কৌশল সম্পর্কে অবহিতকরণ ও উপদেশ দেওয়া হয়েছে। উপদেশে খুবই খুঁটিনাটি বিষয়সহ বিস্তারিত- সবই নবী(সা)-র অবস্থা সুসংহতকরণ বা বিজয় ধরে রাখার জন্য যা যা করণীয় সবই বলা হয়েছে।

মূলতঃ মক্কা বিজয়ের পর বৃহত্তর মদিনা রাষ্ট্রের বৃহৎভাগে বিভক্ত এই চারটি গুরুত্বপূর্ণ স্টেকহোল্ডারদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা বিস্তারিত কঠোর ভাষায় বলা হয়েছে মুনাফিকদের সম্পর্কে। নবী(সা)-এর নিজ বলয়ের নিজ বিশ্বাসের অন্তর্ভুক্ত বলে দাবীদার অথচ এরাই তাঁর প্রধান শত্রু। এই সূরায় মদিনা রাষ্ট্রের কাফির, কিতাবী, মুনাফিক এবং মুমিন- সবার প্রতি সর্বরকম উপদেশ দেওয়ার পর সর্বশেষ আয়াত(৯:১২৯) নবী(সা) প্রতি বলা হয়।

জিযইয়াকরের মাধ্যমে মুসলিম রাষ্ট্রে বসবাসরত অমুসলিমরা অল্প পরিমান অর্থ প্রদান করে অভ্যন্তরীণ ও বাহিরের আক্রমণ থেকে নিজেদের জানমাল, পরিবারের নিরাপত্তা নিশ্চিত। জিযইয়ার শর্তে মক্কা ও চারপাশের এলাকা বাহিরের শত্রুদের দ্বারা আক্রমনিত হলে অমুসলিমদের যুদ্ধ করতে হবে না- যা অমুসলিমদের জন্য বিরাট সুবিধা। ইসলামের সীমানার ভিতর অমুসলিমদের জন্য এর চেয়ে সুবিধা আর কি-ই বা হতে পারে? তখনকার সময়ে নরওয়ে, নিউজিল্যান্ডের ন্যায় সুসংহত, নিরাপত্তার রাষ্ট্র ব্যবস্থা ছিল না কিন্তু জিযইয়া করের মাধ্যমে ঐসময়ের অমুসলিমগণ বর্তমান এই দেশগুলোর চেয়েও আরো বেশি নিরাপত্তা পেয়েছিল। মুসলিমদের জন্য যাকাত ফরজ। জিযইয়া ও সাদাকা তুলনা করলে- এখানে যে অবিচার হয়নি সে সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারি। মুসলিমদের প্রতি সাদাকা দিতে বার বার তাগিদ দেওয়া হয়েছে। তাগিদের কারন পাওয়া যায় ৯:৬০ আয়াতে। ‘আল্লাহ্‌র পথে’, ‘যুদ্ধে’ এই কারনগুলো পাওয়া যায়। স্বভাবতই ৯:৭৫, ৯:৭৯-৮১, ৯:৮৮, ৯:১০২-১০৪, ৯:১২১ সাদাকা অর্থাৎ যুদ্ধের খরচ বাবদ দান করতে বলা হয়েছে। যুদ্ধে অর্থ সঙ্কট কত তীব্র ছিল, তাও দেখতে পাই ৯:৯২ আয়াতে। যে সকল মুসলিম নামধারী মোনাফেকরা সম্পদ দান করতে চাইছিল না তাদের সম্পর্কে বলা হয়েছে ৯:৫৩, ৯:৫৪, ৯:৭৩ আয়াতে।

মুসলিম রাষ্ট্রের সীমানা কতটুকু?- এই প্রশ্নে বর্তমান ইসলামিক স্কলারগণের দুই রকম অর্থাৎ দুটি শহরের নাম পাওয়া যায়।

৬:৯২ ও ৪২:৭ আয়াতদ্বয়ে উল্লেখিত মাদার অফ সিটিস ও তার চারপাশের সীমানা হচ্ছে ইসলামের সীমানা। মক্কাকে মাদার অফ সিটিস হিসেবে ধরলে দুই রকম উত্তর মিলে। একটি শুধু আরব ভূখন্ড আরেকটি আরব মূল ভূখণ্ড ও তার প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলো মিশর, ইরাক ও ইরান। আর ব্যাবিলনকে মাদার অফ সিটিস ধরলে মরক্কো(সাহারার উত্তরাঞ্চল) থেকে আফগানিস্থান(হিমালয়ের পাদদেশ) পর্যন্ত ইসলামী রাষ্ট্রের সীমানা। “মক্কা”-কেই মাদার অফ সিটিস হিসেবে স্কলারগণ, তফসিরকারক, অনুবাদকারকদের অভিমত। আবার দেখা যায়, আলী(রা)-কে ইসলামের কেন্দ্র মদীনা থেকে সরিয়ে কুফা(ব্যবিলন থেকে ৪০কিমি দূরে)-তে নিয়ে যাওয়া ব্যাবিলনকে নির্দেশ করে। অনেক স্ক্লার বলে থাকেন, উট যে অঞ্চলে যাতায়াত করে সেটাই ইসলামের সীমানা অর্থাৎ ব্যাবিলন। মক্কা বা ব্যাবিলন ও তার নির্ধারিত সীমানা ইসলামের অধীনে আসার পর কিয়ামত পর্যন্ত মুসলিমদের আক্রমণাত্মক যুদ্ধ বন্ধ হয়ে গেছে। অর্থাৎ নবী(সা) মারা যাবার ৫০/৬০ বছরের মধ্যে অফেন্সিভ যুদ্ধ স্থায়ীভাবে বন্ধ হয়েছে, কারন কোরআনে নির্ধারিত সীমানা এই সময়ের মধ্যে ইসলামের আয়ত্তে চলে আসে। এই নির্ধারিত সীমানার বাহিরে মুসলিমদের পক্ষে থেকে আক্রমণ করা ইসলামে চিরতরে নিষিদ্ধ। নির্ধারিত সীমানার বাহিরের কোন রাষ্ট্র বা জাতি স্বেচ্ছায় ইসলামের আয়ত্তে আসলে সেটা ইসলাম অনুমোদন দেয়। তুর্কি, বসনিয়া, মালওয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, বাংলাদেশ, নাইজার, চাদ, সেনেগাল, ব্রুনেই, কাজাখাস্থান ইত্যাদি দেশগুলো ইসলামের সীমানার মধ্যে নয় কিন্তু স্বেচ্ছায় ইসলামের ভিতর আসলে তা অনুমদিত। ইসলামের সীমানার বাহিরে ইসলামের প্রচার ও প্রসারের পন্থা হলো শুধুমাত্র নবী(সা)-র শিক্ষা ও আখলাক। দুনিয়ার সকল মুসলিম ইসলামের প্রকৃত আখলাক স্বভাব ও চরিত্রে ধারণ করেলে দুনিয়ার সকল মানুষ ইসলামের সৌন্দর্যে ‘মুসলিম’ হয়ে যেত। নবী(সা) মারা যাবার ৫০/৬০ বছর পর মরক্কো বিজয়ের পর স্পেন আক্রমণ ছিল কোরআন বিরুদ্ধ। তারা ছিল ঈসা(আ)-র অনুসারী। মুসলিমরা সবসময় শুধু আত্মরক্ষামূলক যুদ্ধ করতে পারবে যদি আক্রমনের শিকার হয়। কোরআন অনুসারে ডিফেন্সিভ যুদ্ধ ছাড়া ইসলামে সব ধরণের যুদ্ধ নিষিদ্ধ। পেটে বোমা বেঁধে বা আত্মঘাতি আক্রমণ করে শহর, অট্রেলিকা ধ্বংসের মাধ্যমে নিরীহ মানুষ হত্যা কিংবা ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার নামে মুসলিম-অমুসলিমদের মাঝে মারামারি, কাটাকাটি ইত্যাদি ইসলামে নিষেধ। ইসলাম সমার্থন করে শত্রুর সাথে সরাসরি যুদ্ধ কিন্তু সেটা আত্মরক্ষার জন্য, আক্রমনের জন্য নয়। দুনিয়ার সম্পদ ধ্বংস ও নিরীহ মানুষ হত্যা নহে। এই দুনিয়া মুমিনদের জন্য কষ্টের জায়গা, পরীক্ষার ক্ষেত্র। প্রিয়জনদের বিয়োজন, নিজের চাওয়া-পাওয়া কোরবানী করা(১০৮:২)। প্রতিশোধ নেওয়ার চেয়ে ক্ষমা করা উত্তম, ইহা নবী(সা)-র শিক্ষা।

৯:৫==>

“অতঃপর নিষিদ্ধ মাস অতিবাহিত হলে অংশীবাদীদের যেখানে পাবে হত্যা করবে, তাদের বন্দী করবে, অবরোধ করবে এবং প্রত্যেক ঘাঁটিতে তাদের জন্য ওঁত পেতে থাকবে, কিন্তু তারা যদি অনুতাপ বা তাওবা করে, যথাযথ নামায পড়ে, যাকাত দেয়, তবে তাদের পথ ছেড়ে দেবে। নিশ্চয়ই আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।”

আয়াতটি মক্কা নগরীতে বসবাসরত মুশরিকদের উদ্দেশ্যে বলা হয়েছে। মক্কা বিজয়ের পর মদিনা রাষ্ট্র তৈরি হওয়া এবং বেঈমান, দ্বিমুখিদের থেকে রাষ্ট্র স্থিতিশীল করার উদ্দেশ্যে শুধুমাত্র ঐ সময়ের জন্য আয়াতটি নাজিল হয়। চুক্তি ভঙ্গকারী ও চুক্তির প্রতি অনুগতদের পার্থক্য তুলে ধরে বলা হয়েছে যারা চুক্তি ভঙ্গ করেছে, গোপনে মুসলিমদের বিরুদ্ধে কাজ করেছে। নিষিদ্ধ মাস অর্থাৎ চার মাস অতিক্রান্ত হলে পরে মক্কায় এদের বসবাস করার সুযোগ নেই। নিষিদ্ধ চার মাস পরে মুশরিকরা মক্কায় বসবাস করলে তাদের জানমালের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা থাকবে না। মক্কায় তের বছর মুসলিমদের নির্যাতন করা হয়েছে তারপর মুসলিমরা মদীনায় হিজরত করলে সেখানেও তিনবার যুদ্ধ করেছে মুসলিমদের নিশ্চিহ্ন করার উদ্দেশ্যে। মক্কা বিজয়ের সময় তাদের সাধারণ ক্ষমা ঘোষনা করা হয়েছে তারপরেও তারা মুসলিম বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত।

নিষিদ্ধ চার মাস পর তাদের বন্দী ও অবরোধ করার নির্দেশ। যদি তারা প্রতিরোধ করে বা সংঘর্ষে লিপ্ত হয় তবে তাদের হত্যা করা বৈধ। মক্কার মুশরিকদের জন্য দুটি পথ খোলা আছে। এক. মক্কা ছেড়ে চলে যাবে, দুই. মূর্তিপূজা ছেড়ে দিয়ে ঈমান এনে মুসলিম হবে। দেবদেবীদের প্রতি অর্থ-সম্পদ দান না করে গরীব মানুষদের যাকাত দিবে।

ইসলামী সীমানার ভিতর মুসলিম, অমুসলিম সকলের বসবাস সমান হলেও অমুসলিমদের বেশি সুবিধা দেওয়া হয়েছে। তাদের পক্ষ থেকে যুদ্ধ নাই যদি বাহিরের শত্রুদের দ্বারা আক্রমনের শিকার হয়। আর এখানে মক্কা নগরীতে মুশরিকদের বার বার সুযোগ সুবিধা দেওয়ার পরেও চুক্তি ভঙ্গ ও গোপন ষড়যন্ত্রের জন্য মক্কা নগরীতে বসবাস নিষিদ্ধ হয়।

“আর মুশরিক বা অংশীবাদীদের মধ্যে কেউ তোমার কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করলে তুমি তাকে আশ্রয় দেবে যাতে সে আল্লাহর বাণী শুনতে পায়। অতঃপর তাকে নিরাপদ স্থানে পৌঁছে দেবে। কারন তারা অজ্ঞ লোক”(৯:৬)। পূর্বের আয়াতের মুশরিকদের সাথে কঠোর আচরণের নির্দেশ দেওয়া হলেও প্রতিশোধের জন্য বা জিঘাংসা চারিতার্থ করার উদ্দেশ্যে ইসলামে যুদ্ধ বা জিহাদের নির্দেশ দেওয়া দেয়নি। “আর মসজিদুল হারামের কাছে তোমরা তাদের সাথে যুদ্ধ করবে না যে পর্যন্ত না তারা সেখানে তোমাদের সাথে যুদ্ধ করে” (২:১৯১)। ইসলামে যুদ্ধ বা জিহাদের নির্দেশ দিয়েছে সামাজিক কুসংস্কার ও অন্যায়-অবিচার দূর করার উদ্দেশ্যে। তাই, শত্রু পক্ষের কেহ যদি আশ্রয় চায় বা তোমাদের কথা শুনার জন্য আগ্রহ ব্যক্ত করে তবে তাঁকে আশ্রয় দিবে এবং নিরাপদ স্থানে পৌঁছে দিবে। মুশরিকরা আল্লাহ্র কিতাব অনুধাবন করলে কিংবা সাহাবীগণের আখলাক পর্যবেক্ষন করলে ইসলামে সত্যতা সম্পর্কে জানতে পারবে। শত্রু পক্ষের কেহ এসে মুসলিম শিবিরে এসে বক্তব্য শুনার আগ্রহ প্রকাশ করতে পারে এবং ইসলাম গ্রহন করুক বা না করুক সে আবার নিজের শিবিরে চলে যেতে পারে কোন ভয়-ভীতি ছাড়াই। এই আয়াতে ইসলামের উদারতা ও মহানুভবতা ফুটে উঠে।

নোটঃ ৯:৫, ৯:২৯ আয়াতের ন্যায় বেশ কিছু আয়াত কোরআনে রয়েছে যা আক্রমণাত্মক প্রকাশ পায়। কি প্রসঙ্গে, কি ঘটনাক্রমে আয়াতগুলো নাজিল হয়েছে তা না জেনে যারা ইসলামকে ধরাশায়ী করা যায় সে চেষ্টায় ব্যপৃত তাদের উচিত ভিতরের ঘটনা না জেনে অহেতুক ঘৃণা, বিদ্বেষ অন্তরে পুষিয়ে না রাখা। এতে নিজেরই ক্ষতি এবং নিজের শান্তি-ই পুরোপুরি বিঘ্নিত। সত্যের উন্মোচনের পথ নিজেই নষ্ট করা।

বুখারী-মুসলিমের বিখ্যাত হাদিস ভুলঃ
মিরাজের ঘটনাটি বুখারী ও মুসলিমের বিখ্যাত একটি হাদিস। দুনিয়ার সকল মুসলিমরা হাদিসটি বিশ্বাস করে কিন্তু হাদিসটি কোরআন বিরুদ্ধ এবং বাস্তবতা বিরুধী।

পঞ্চম আসমানে নবী(সা)-র সাথে মুসা(আ)-র সাথে কথা হয়। মুসা(আ), নবী(সা)-কে জিজ্ঞেস করেন কি নিয়ে এসেছেন? নবী(সা) বলেন ৫০ ওয়াক্ত নামায। মুসা(আ) বলেন, উনি মানবজাতির চরিত্র ভাল করে জানেন। ৫০ ওয়াক্ত নামায উম্মতরা আদায় করতে পারবে না। আপনি কমিয়ে নিয়ে আসুন। নয় বার গিয়ে আল্লাহর কাছে থেকে কমিয়ে ৫ ওয়াক্ত নামায নিয়ে আসেন। মুসা(আ) আবার বলেন যাওয়ার জন্য। নবী(সা) বলেন উনার লজ্জা করে। দশম বারে নবী(সা) বলেন “আমার শরম করে”।

১। (A) তোমাদের দিন-কে করেছি উপার্জনের জন্য, রাতকে করেছি নিদ্রার জন্য, ক্লান্তি দূর করার জন্য। রাতকে করেছি বিশ্রামের জন্য (ফুরকানঃ আয়াত ৪৭)।

আল্লাহ বলেন, “আল্লাহ কারো সাধ্যাতীত ভার অর্পণ করেন না (নাবাঃ৯ + বাকারাহঃ২৮৬)”।

হাদিস অনুসারে আল্লাহ ৫০ ওয়াক্ত নামাযের আদেশ করেন কিন্তু ইহা সরাসরি কোরআন বিরুধী (২৫:৪৭ + ৭৮:৯ + ২:২৮৬)। প্রতি ঘন্টায় ২ ওয়াক্তেরও বেশি নামায আদায় করতে হবে। ঘুম, বিশ্রাম, খাওয়া, আয়-রোজগার, গোছল, বাথরুম, পরিবার, সামাজিকতা…… কোন কিছুই সম্ভব না। ফজর, যোহর, আসর, মাগরীব, ঈশা নামাযের উল্লেখ আছে কোরআনে। আয়াত অনুসারে ৩০:১৭, ৩০:১৮, ৩০:১৮, ৩০:১৭, ২০:১৩০। এই আয়াতগুলো ছাড়াও আরো অনেক আয়াত রয়েছে যেখানে পাঁচ ওয়াক্ত নামাযের কথা বলা আছে। তাই কোরআনের এই আয়াতগুলোর অনুসারে এই হাদিসের অংশ টিকে না।

(B) আল্লাহ্ ৫০ ওয়াক্ত সালাত ফরয করলে এই আয়াতগুলো অস্বীকার করা হয়ঃ-
১৮:২৬=> আল্লাহ্ তাঁর সিদ্ধান্তে কাউকে শরীক করেন না (কিন্তু মুসা(আ) নিজের ডিসিশনের মাধ্যমে শরীক করছেন)।
৩৩:৩৮=> আল্লাহর আদেশ সুনির্ধারিত ও অবশ্যম্ভাবী (এখানে আল্লাহ্‌র আদেশ সুনির্ধারিত নির্দেশ করে না)।
৩৫:৪৩=> তুমি আল্লাহর বিধানে কোন পরিবর্তন পাবে না এবং আল্লাহর বিধানে কোন ব্যতিক্রমও পাবে না (মুসা(আ) নিজের ডিসিশনের মাধ্যমে পরিবর্তন করছেন)।
৫০:২৯ এবং ১০:৬৪ আমার কথার রদবদল হয় না এবং আমি বান্দাদের প্রতি যুলুমকারীও নই (আল্লাহ্‌র কথা রদবদল হচ্ছে এবং করাচ্ছে মুসা(আ)।
২৮:৭৩=> তিনি তাঁর অনুগ্রহে তোমাদের জন্য রাত ও দিন তৈরী করেছেন যেন তোমরা তাতে (রাত্রিকালে) বিশ্রাম নিতে পার ও (দিনের বেলায়) তার অনুগ্রহ (জীবিকা) সন্ধান করতে পার এবং যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর।

২। নবী(সা) দশমবারে বলেছেন “আমার শরম করে”। দুনিয়ার সবচেয়ে বড় লজ্জাশীল ব্যক্তি বলতেছেন দশমবারে যে, আমার লজ্জ্বা করে। নবী(সা)-র ব্যক্তিত্ব কি এমন? এত পচন মার্কা ব্যক্তিত্ব কি একজন রাসুলের হতে পারে? তাও আবার নবী(সা)-র মত রাসুল!!! যার শরম নাই, তার ঈমান নাই, সে মুসলিম না। নবী(সা) নবম/দশম দূরে থাক, দ্বিতীয়বার গেলে উনি রাসুল থেকে খারিজ হয়ে যান।

৩। হাদিস থেকে স্পষ্ট মুসা(আ) তিনি আল্লাহ এবং রাসুল(সা)-র চেয়েও অনেক বড় জ্ঞানী। উম্মতেরা ৫০ ওয়াক্ত নামায আদায় করতে পারবে না- এটা আল্লাহ বুঝেন নি, নবী(সা) বুঝেন নি আর বুঝে ফেলছেন মুসা(আ)!!!

৪। “আপনি আবার যান এবং কমিয়ে নিয়ে আসুন”। নয় বার পাঠানো হইছে। বেকুব মার্কা গেইম খেলা। মুসা(আ) এবং নবী(সা) এই যাওয়া-আসার বেকুব মার্কা গেইম খেলতেছে আর সারা দুনিয়ার মানুষ সহ, সকল পূর্ববর্তী রাসুল, ফেরেশতারা বেকুব মার্কা গেইম খেলার তামাশা দেখতেছে। এই বেকুব মার্কা গেইম খেলা দুইজনের ব্যক্তিত্ব যে প্রশ্নবিদ্ধ তা এই দুই বিখ্যাত নবী বুঝতে পারতেছেন না। তাই নয় কি? এই বার বার যাওয়া-আসার সময় ষষ্ঠ ও সপ্তম আসমানে থাকা নবীগন কি মনে করবেন নবী(সা) সম্পর্কে?

৫। মুসা(আ) কি সাহস রাখেন আল্লাহ এবং নবী(সা)-রে নিজে নিয়ন্ত্রন করার? মুসা(আ)-র কেমন ব্যক্তিত্ব যে তিনি আরেক রাসুলকে জিজ্ঞেস করবেন “কি নিয়ে এসেছেন”? উনারা কি বাল্যবন্ধু?

৬। বার বার পাঠানোতে আরো পরিষ্কার হয়, পঞ্চম আসমান থেকে মুসা(আ)-র তাঁর শ্বশুর শুয়েব(আ)-র কাছ থেকে দুনিয়া থেকে স্পেশাল যান নিয়ে এসেছিলেন। তাঁর যানে করেই নবী(সা) পঞ্চম আসমান থেকে বার বার আল্লাহর কাছে গমন করেছেন।

৭। হাদিসটি নির্দেশ করে নবী(সা) দৃঢ়তা নেই। নামায-রোজা কমানোর জন্য যেভাবে বারবার আসা-যাওয়া করেছেন তা স্পষ্ট যে, তার দৃঢ়তা নেই‌। আর যার দৃঢ়তা নেই সে কখনো রিসালাতের দায়িত্ব পালন করতে পারে না। রিসালাতের দায়িত্ব তাদেরকেই দেওয়া হয় যাদের অন্তরের দৃঢ়তা লোহার চেয়েও শক্ত। ইহা শতভাগ সঠিক।

৮। নবী(সা)-কে বলা হয় নবীদের নবী। তাহলে অন্য নবী কিভাবে তাঁকে নির্বোধের মত শিক্ষা দেয়?

কারন আরো যোগ করা যায়। সঠিকতা বুঝতে একটি উপমাই যথেষ্ট। আল্লাহর মর্যাদা, নবী(সা) এবং মুসা(আ)-র ব্যক্তিত্বকে জঘন্য মানের নীচু করা হয়েছে- এই হাদিসের পরবর্তী অংশ দ্বারা। মিরাজের হাদিস সঠিক কিন্তু্ হাদিসের পরের অংশটুকু পঞ্চম আসমানে মুসা(আ)-র সাথে নবী(সা)-র কথাকোপথন একটি বানোয়াট কেচ্ছা কাহিনী।

“কমন সেন্স” একটি মহামূল্যবান নিয়ামত আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে। কোরআনে আল্লাহ এই কমন সেন্স নিয়ামতের গুরুত্ব বুঝাতে সাত বার কসম করেছেন। মুসলিমদের মাঝে বড় একটা সংখ্যা “কমন সেন্স” গুরুত্ব বুঝে না।

গুরুত্ব আলোচনাঃ একজন মুসলিম হিসেবে ঈমানের একটি শর্ত হচ্ছে নিজের জীবনের চেয়েও বেশি নবী(সা)-কে ভালবাসা। বেশিরভাগ মুসলিম তা মানে ও পালন করে। নবী(সা) সকল নবীদের চেয়েও সর্বশ্রেষ্ঠ কিনা, এই ব্যপারে কোরআনে পরিষ্কার বলা নেই। আল্লাহ ইব্রাহীম(আ)-কে বলেন, "তোমাকে মানব জাতির নেতা বানাব(২:১২৪)”। কিছু ইসলামিক চিন্তাবিদরা ২:১২৪ আয়াত সম্পর্কে বলেন, দশ বিষয় পরীক্ষায় ইব্রাহীম(আ) এক বিষয়ে নবী(সা)-র চেয়ে মার্ক বেশি পেয়েছেন। বাকী বিষয়গুলোতে নবী(সা) বেশি পেয়েছেন। আল্লাহ কোন নবীকে কিয়ামতের ময়দানে সবচেয়ে সন্মানিত করবেন, তা আল্লাহ ভাল জানেন।

হাদিসটির পঞ্চম আসমানের কথাপোকথন অংশটুকু বানিয়েছে ইহুদিরা। মুয়াবিয়া ও উমাইয়াদের নানীবাড়ি ছিল খৃস্টান, ইহুদী। ইহুদী পাদ্রীগণ মুয়াবিয়া ও উমাইয়াদের মজলিসে উঠাবসা ছিল সবচেয়ে বেশি। কৌশলে হাদিসগ্রন্থে ঢুকিয়েছে। মুসা(আ)-র একজন ওস্তাদ আছে, উনি হলেন খিজির(আ)। তাই মোহাম্মদ(সা)-র ওস্তাদ মুসা(আ)-কে বানিয়েছেন যেন মুসলমানরা ইহুদীদের অধীনে থাকে। খিজির(আ) ইহুদী জাতির গলার কাটা হয়ে আছে। খিজিরের জন্য মুসা(আ)-কে ইহুদীরা “সর্বশ্রেষ্ঠ নবী”-র সনদ দিতে পারছে না। নিজেদের আধিপাত্য বজায় রাখতে তারা কৌশলে এই কাজ করিয়েছে। ইহুদী-খৃষ্টানরা এমন আরো বহু হাদিস বানিয়েছে উমাইয়া ও আব্বাসীয় শাসনামলে।

গুরুত্ব বিষয়: বুখারী-মুসলিমের বিখ্যাত উপরে ভুল হাদিসটি তুলে ধরা হলো নিজেদের সাবধানতার জন্য যেন হাদিসগ্রন্থের সকল হাদিস অন্ধভাবে বিশ্বাস বা ইসলামিক বক্তারা যা বলে তা সঠিক কিনা, যাচাই-বাচাই করে গ্রহণ করা হয়। বুখারী, মুসলিমের বিখ্যাত বেশ কিছু হাদিস ভুল অথচ মুসলিমরা তা বিশ্বাস করে। এই কুসংস্কার থেকে বেরিয়ে আস তে হবে। কোরআন বিরুদ্ধ ও বাস্তবতা বিরুধী হাদিসগুলো মুছে দেওয়া দুনিয়ার ইসলামিক স্কলারদের উচিত ইসলামের কল্যাণের জন্য আত্মনিয়োগ করা।


PART-F
======
খ্রিস্টধর্ম, ইহুদী ধর্ম এবং জবুর গ্রন্থঃ
ঈসা(আ) বা জিসাসের তিরোধানের পর খ্রিস্ট ধর্মের প্রকৃত রূপরেখা ও শিক্ষা বিলুপ্ত হয়। আজ বর্তমানে যে খ্রিস্ট ধর্ম দুনিয়ায় বিরাজমান তা ঈসা(আ) বা জিসাসের নয়; ইহা পলের প্রচারিত দীক্ষা। ঈসা(আ)-র ভাষা ছিল হিব্রু-এরামাইক কিন্তু আজ দুনিয়ায় যে বাইবেল বিদ্যমান তা গ্রীক ভাষায় এবং গ্রীক ভাষার ইঞ্জিল থেকে সকল ভাষায় অনুবাদ করা। ঈসা(আ)-র তিরোধানের পর প্রথম ২০০ বছরের মধ্যে বর্তমান দুনিয়ায় প্রচারিত লিখিত(৪টি) বাইবেল ছিল না। পরবর্তীতে গ্রীক খ্রিস্ট পাদ্রীগণ ২০০ বছর পরে ২৭টি লিখিত গ্রন্থ থেকে ৪-টিকে বাছাই করা হয় বাইবেল রূপে। মথি, লূক, মার্ক, যোহন(ইউহোন্না) চারটি বাইবেল। হিব্রু-এরামাইক ভাষার অরিজিনাল বাইবেল দুনিয়ায় অবশিষ্ট নেই এবং পলের অনুসারীরা ঈসা(আ)-র তিরোধানের ১০০ বছরের মধ্যেই বিলুপ্ত করে দেয় অর্থাৎ ঈসা(আ) বা জিসাসের তিরোধানের ১০০ বছরের মধ্যে আসল ও প্রকৃত খ্রিস্ট ধর্ম দুনিয়া থেকে মুছে যায়। বর্তমান চারটি গসপোলের একটির সাথে অন্যটির পার্থক্য লক্ষিত। আবার একই ঘটনা গসপোলগুলোতে ভিন্ন ভিন্ন ভাবে বর্ণিত হয়েছে।

“শৌল” ছিলেন ঈসা(আ) ও তাঁর অনুসারীদের ঘোর শত্রু। ঈসা(আ)-র প্রচারিত ধর্ম প্রসারের ব্যঘাত সৃষ্টি করেন সে ও তার বাহিনী। তারপর দৈব ও প্রাকৃতিক ঘটনার পর নিজেকে সংশোধন এবং ঈসা(আ)-র শিষ্য হিসেবে নিজেকে ঘোষনা করেন। তাঁর নাম “শৌল” থেকে “পৌল” হয় এবং পরবর্তীতে “পল” হিসেবে দুনিয়ায় পরিচিত হোন। বার্বারোসার মাধ্যমে ঈসা(আ)-র রেখে যাওয়া ১২ জন শিষ্য(ঈসা(আ)-র ১২জন সাহাবী)-র কাছে নিজের দৈবক্রমে পাওয়া শিষ্যত্ব প্রকাশ করলে, তাদের কেহ পলকে শিষ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেননি। পল ঈসা(আ)-র প্রচারিত বানী মূল ভুখন্ড প্যালেস্টাইন ও সিরিয়ায় প্রচার করতে পারেন নি কিন্তু গ্রীক ও রোমানদের মধ্যে বিস্তার ঘটান। পলের মতবাদ খৃস্টানদের প্রচণ্ড প্রতিরোধের মুখে পড়ে। আত্মরক্ষার জন্য তিনি অতি ভক্তির আশ্রয় গ্রহণ করে। এতকাল সকলেই জানত যে বিশ্বাস ও শরীয়ত পালনের মাধ্যমেই মানুষ নাজাত পায়। এখন তিনি বলছেন শরীয়ত পালন মুক্তির পথে প্রতিবন্ধক। এটি প্রমানের জন্য তিনি বললেনঃ জিসাস তো আর সাধারণ কোনো নবী নন যে তাঁকে হত্যা করাতে শুধু হত্যাকারীদের পাপ হয়েছে। বরং তিনি ইশ্বর; তিনি ক্রুশে মরে সকলের পাপ মোচন করেছেন। কাজেই শরীয়ত পালনের আর প্রয়োজন নেই। তিনি প্রচার করতে থাকেন “যীশু নিজের আত্মা ত্যাগ করে আমাদেরকে পাপ হতে মুক্ত করেছে”। শরীয়ত আছে বলেই পাপ এবং পাপ হচ্ছে বলেই অনন্ত নরকবাস। যীশুতে বিশ্বাস করলে আর শরীয়ত থাকে না; আর শরীয়ত না থাকলে তো কোনো কিছুই আর পাপ বলে গণ্য হবে না। মদ, সুদ, অবৈধ যৌণতাসহ সকল প্রকার পাপ থেকে খ্রিস্ট অনুসারীরা মুক্ত। ফাদারগণ দুনিয়ার জীবনের সকল পাপ হতে অনুসারীদের মুক্ত করার উদ্দেশ্যে এর সাথে আরো যোগ করেন নিজের অর্থ-সম্পদ চার্চ ও তাদের কাছে দান করার।

পল খ্রিস্ট ধর্মকে একেশ্বরবাদী থেকে ত্রিত্ববাদে(Trinity) নিয়ে খ্রিস্ট অনুসারীদের “শির্ক”-এ লিপ্ত করান। পিতা ইশ্বর, পুত্র ইশ্বর এবং পবিত্র আত্মা ইশ্বর। তিনজন ভিন্ন ভিন্ন ব্যক্তি ইশ্বর। আবার অন্য বিবরণে দেহের ভিতর রক্ত, মাংস, হাড় যেমন তেমনি পিতা, পুত্র, পবিত্র আত্মা এক। পলের দীক্ষা ছিল, শরীয়ত মানতে হবে না এবং জীবন ধারণে স্বাধীনতা দেয়া আছে, যে যা খুশি অনুসরণ ও কর্ম করতে পারে, শুধু যীশুকে ইশ্বরের পুত্র হিসেবে বিশ্বাস ও মানতে হবে। যদি না মানে তাহলে সে কাফের এবং তাকে পুড়িয়ে মারার বিধানও আছে। অথচ খৃস্টান পাদ্রীগণ স্বীকার করেন এবং বাইবেল(মথি, মার্ক, লূক, যোহান)-এর কোথাও ত্রিত্ববাদে বিশ্বাসের কথা উল্লেখ নেই। বৈদিক ধর্মের আকিদা “ইশ্বর মানুষের বেশে দুনিয়ায় আগমন করেছেন” তেমনি উন্মাদনা ও মিথ্যাচার যা বর্তমান খ্রিস্ট ধর্মে লক্ষিত যা পল ও তাঁর অনুসারীদের দ্বারা বিকৃত করা হয়েছে।

ত্রিত্ববাদে বিশ্বাস করে না এমন খ্রিস্ট ধর্মের অনুসারী পাওয়া কঠিন। পল পাকাপোক্তভাবে শির্কের মতবাদ প্রতিষ্ঠা করতে সামর্থ্য হয়েছেন এবং ঈসা(আ)-র সকল অনুসারীদের শির্কে লিপ্ত করে দিতে সফলও হয়েছেন।

ইহুদীদের তৌরাত গ্রন্থ পয়দায়েশ, হিজরত, লেবীয়, শুমারী, দ্বিতীয় বিবরণ এই পাঁচটির সম্বলিত। প্রথম গ্রন্থ পয়দায়েশে বিবৃত হয়েছে সৃষ্টি সম্পর্কে। পুরুষ, স্ত্রীলোক, বিয়ে, ব্যবসা, ইবাদত, গান-বাজনা, শহর, চাষাবাদ বিভিন্ন ভাষা, জাতি দেশ ইত্যাদি। দ্বিতীয় গ্রন্থ হিজরতে ইউসুফ(আ)-এর ইন্তেকালের পর থেকে বনি-ইসরাইলেদের ইতিহাস। মুসা(আ)-কে মহান উদ্ধারকর্তা ও শরীয়তদাতা হিসেবে দেখানো হয়েছে। তৃতীয় গ্রন্থ লেবীয়র মূল বিষয় পাক-পবিত্রতা। পোশাক, কোরবানী ও ইবাদতের হুকুম। চতুর্থ গ্রন্থ শুমারীর মূল বিষয় ইবাদত ও রুহানীর উন্নতি ও অবনতি। বনি-ইসরাইলদের ৩৮ বছর মরুভূমিতে ঘুরে বেড়ানোর কাহিনী। শেষ গ্রন্থ দ্বিতীয় বিবরণে মুসা(আ) মৃত্যুর পূর্বে তিনটি বক্তৃতা দিয়েছিলেন তা বিবৃত হয়েছে।

ইহুদীগণ মুসলিমদের ন্যায় শরীয়া পালন বাধ্যতামূলক এবং আকিদার অংশ। ইহুদীদের তৌরাত(তোরাহ) মূল আকিদা ও শরীয়ত পরিবর্তিত হয়ে বিকৃত হলে যীশু বলেন “ইস্রায়েল-কূলের হারানো মেষ ছাড়া আর কাহারও নিকটে আমি প্রেরিত হই নাই”। ক্যাথলিকদের বাইবেলের মোট পুস্তক সংখ্যা ৭৩টি। প্রোটেস্ট্যান্ট ৭টি পুস্তককে জাল বলে রহিত করেন। ফলে প্রোটেস্ট্যান্টদের মোট পুস্তক সংখ্যা ৬৬টি। ক্রিসমাস বা যীশুর জন্মোৎসব একটি বানোয়াট এবং এর কোন ভিত্তি নেই।

বর্তমান জবুর গ্রন্থ আসমানী কিতাব নয়; এটি প্রাচীন রূহানী গজল বই। জবুর মূলত কাওয়ালী বা কবিতা। মোট ১৫০টি কাওয়ালী বা প্রার্থনা রয়েছে জবুর গ্রন্থে। কাওয়ালী বা প্রার্থনাগুলো নথীতে অন্তর্ভূক্ত হয় খ্রীস্টপূর্ব ১০০০ থেকে ৭০০ এর মধ্যে। ১৫০টির সবগুলো দাউদ(আ)-র নয়। ৭৩টি কাওয়ালী বা প্রার্থনা ছিল দাউদ(আ)-র। বাকী ৪৯টি কার?- তাদের নাম জানা যায়নি। এছাড়া আসফ(আ) ১২টি, কারুনের ছেলেরা ১০টি, বাদশাহ সোলায়মান(আ) ২টি, হযরত মুসা(আ) ১টি, হযরত এতন ১ টি, হযরত হেমন ১টি এবং হযরত উযায়ের(আ) ১টি।

কোরআন ব্যতীত দুনিয়ার সকল ধর্ম গ্রন্থ বিকৃত হয়েছে এবং কোরআনই একমাত্র বিশুদ্ধ ও সঠিক ধর্ম গ্রন্থ হিসেবে দুনিয়াতে প্রতিষ্ঠিত এবং টিকে আছে। কোরআন ইহুদী ও খ্রিস্ট ধর্মের স্বীকৃতি দিয়ে এদের অস্তিত্ব দুনিয়ায় টিকিয়ে রেখেছে। পলের শির্কী মতবাদ ও দীক্ষা খ্রিস্ট ধর্ম থেকে মুছে দেওয়া অতীব জরুরী। নিঃসন্দেহে এই মতবাদ ও দীক্ষা খ্রিস্ট ধর্মের অনুসারীদের জন্য অতীব অকল্যাণকর।

বৈদিক(হিন্দু) দর্শন, বৌদ্ধ দর্শন ও অন্য সকল প্রবর্তকগণের সত্যতাঃ
কালের ব্যবধানে বহু মনিষী নিজেদের দর্শন এবং দাবীকৃত ধর্মীয় মর্মবানীর মাধ্যমে ধর্মকে মানব জাতির উদ্দেশ্যে কেহ রেখে গেছেন আবার কেহ প্রতিষ্ঠিত করে গেছেন। একেশ্বরবাদ, বহুশ্বরবাদ, নিরীশ্বরবাদ ইত্যাদি মতবাদ যার কিছু সংখ্যক বিরাজমান আর অধিকাংশই বিলুপ্ত। সকলেই নিজ নিজ ধর্ম ও দর্শনকে সত্য, মহাসত্য বলে দাবী করছে এবং এর পক্ষে সাধ্যমত যুক্তি দাঁড় করিয়ে নিজেদের মতবাদকে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টায় ব্যাপৃত রয়েছে। বর্তমান পৃথিবী একটি গ্লোবাল ভিলেজ। অতীতে অঞ্চল ও জাতিগত ভাবে ধর্মীয় মতবাদের সীমাবদ্ধতা থাকলেও এখন গ্লোবাল ভিলিজের নিমিত্তে সব এক। এক বা বহু বা নিরীশ্বরবাদ মতবাদের সমাধান দুনিয়ার সভ্যতা ও কল্যাণের উদ্দেশ্যে আবিশ্যিক হয়ে দাঁড়িয়েছে। সত্যকে উন্মোচন করা অপরিহার্য। সকল মতবাদ সঠিক হতে পারে না। একজন সঠিক। সেই একজন কে?

কোন বিষয়ে জ্ঞান অন্বেষণ একজন পরিপক্ব ছাত্র হতে হলে প্রথমেই সামাজিক সাংস্কৃতিক প্রভাবকে এড়িয়ে গিয়ে, বিশ্বাসকে এক পাশে রেখে জ্ঞান অনুসন্ধানের পথে হাটতে হবে। সত্যতার সঠিক মূল্যায়নে আবেগ ও ভক্তিকে একপাশে রেখে নির্মোহ চিত্তে বিষয়টি যাচাই করার পদ্ধতি জানতে হবে। একইভাবে ধর্মীয় বিষয়ে কোন বিশেষ ব্যক্তির ব্যাখ্যা এবং তার ব্যক্তিত্বকে শ্রদ্ধা করতে গিয়ে তাঁকে ভুলের উর্ধ্বে মনে করা ধর্মান্ধতার পরিচয়।

কোন ধর্মের সত্যতাকে উপলব্ধি করিতে হলে সেই ধর্মের প্রবর্তক(ধর্মের প্রধান প্রচারক)-কে ভালভাবে চিনে ও বুঝে নিতে হয়। ধর্মীয় প্ল্যাটফর্মে প্রবর্তককে জানা, চিনা, বুঝা এবং সত্য, পবিত্র ও সঠিক হিসেবে গ্রহণযোগ্যতা হওয়ার একমাত্র পন্থা হলো পরম ও প্রকৃত আধ্যাত্মিকতার সুপ্রিম জ্ঞান অর্জনের সহিত সংসার ধর্মের ভিতর থেকে অনুশীলনের মাধ্যমে স্বভাব ও চরিত্রে শতভাগ “চারিত্রিক বিশুদ্ধতা” প্রতিষ্ঠা করা। মর্মবানী যা প্রচার করা হয় তা অনুশীলনের মাধ্যমে দুনিয়ার মানুষদের জন্য দৃষ্টান্ত তৈরি করা যার আদর্শের উপর ভিত্তি করে ও দেখানো পথে জান, মাল, সময় দেওয়ার সহিত ইবাদতে মশগুল, সারাজীবন অন্তরে আঁকড়ে ধরা হবে, অন্তরে লালন করা হবে, সেই তাঁকে ভাল করে সত্যের সহিত পরীক্ষা না করে, যাচাই-বাচাই না করে গ্রহণ করা বা পারিবারিকভাবে পেয়ে যাওয়া- তা সুস্থতা ও গ্রহনযোগ্য নয় এবং নির্বোধদের কর্ম।

চারিত্রিক বিশুদ্ধতা ব্যতীত দ্বিতীয় কোন পন্থা দুনিয়ায় নেই; দ্বিতীয় আর কোন স্কেল বা পরিমাপ করার সিস্টেম দুনিয়ায় নেই, প্রবর্তকের সত্যতাকে হৃদয়াঙ্গম করার। আর চারিত্রিক বিশুদ্ধতার নিরূপণ করতে চাইলে প্রবর্তকের সারাজীবনের কর্মের রেকর্ড আবশ্যিক। দুনিয়ার মানুষজন জন্ম থেকে মৃত্যু অবধি কর্ম করে। সকল কর্ম নিয়ন্ত্রিত হয় অন্তরের প্যারামিটার থেকে। কে কিভাবে প্যারামিটার চালিত করে কর্ম সম্পাদন করে তা জানা ও বুঝা জরুরী। ভাল-মন্দ বোঝার জ্ঞান সকলের রয়েছে। একজন সারাজীবন শতভাগ সত্য কথার মাধ্যমে জীবন অতিবাহিত করলে এর স্বাদ অন্তরে কেমন অনুভূত হয় তা যারা সর্বদা সত্যের সহিত কথা বলে ও কর্ম করে, তারা জানে। চারিত্রিক বিশুদ্ধতার প্রতিষ্ঠা মানে কোন গুনাহ বা পাপ কাজ চিন্তায় না থাকা; চরিত্র ও স্বভাবকে পবিত্রতার স্তরে ধারণ করা। যে সকল মহাপুরুষ ধর্মীয় মতবাদ দুনিয়ায় রেখে গেছেন এবং প্রতিষ্ঠিত করে গেছেন তাঁদের চারিত্রিক বিশুদ্ধতা অর্জন করতে হয় সর্বোচ্চ পর্যায়ে। কষ্টিপাথরে চারিত্রিক বিশুদ্ধতা পরীক্ষা দ্বারা উৎকর্ষ করার পর মহাপুরুষগণ গ্রহণযোগ্যতা পেয়ে থাকেন। আমরা সেই সকল মনিষীদের চারত্রিক বিশুদ্ধতা পর্যবেক্ষন করে সফলতা নির্নয় করব।

যে ধর্মের প্রবর্তক নাই বা প্রবর্তকের কর্ম জীবনের স্বভাব ও চরিত্র উত্তমরূপে জানা যায় না, সেই ধর্ম অংকুরেই বিলুপ্ত। বৈদিক ধর্মের কোন প্রবর্তককে জানার উপায় নেই, কারন প্রবর্তকগণের কর্মের প্রমান নেই। প্রবর্তকগণের পরিচয়ই বা কি, তারও ঐতিহাসিক সঠিকতা নেই। বৈদিক ধর্ম অনুসন্ধান করলে পাওয়া যায়, পরমাত্মার সংমিশ্রনে নৈতিক উপদেশ বানীর গ্রন্থ। গৌতম(সিদ্ধার্থ)-র সারাজীবনের কর্মের রেকর্ড নেই। ঊনত্রিশ বছর বয়সে গৃহ ত্যাগ করেন। চারিত্রিক বিশুদ্ধতার দোষগুণ, ভালমন্দের পরমান যথার্থ্য বিচার হয় সংসার ও বাস্তবতার ভিতর থেকে। মাপকাঠি হবে বাস্তবতা ও কর্মের মাধ্যমে কে কত উত্তম? বাস্তবতা ও সংসার ত্যাগ করে উপসনালয় বা গুহায় বা গাছের নীচে ধ্যান করলে চারিত্রিক বিশুদ্ধতার পরীক্ষা হয় না এবং শুরুতেই গ্রহণযোগ্যতা হারায়। ধৈর্যের চরমতা, লজ্জাশীলতা, ক্ষমার মহানুভবতা, লোভ-হিংসাকে অন্তর থেকে নিশ্চিহ্ন করা, সত্যবাদিতা, বিনয়, কথার মাধুর্যতা ইত্যাদি অনুশীলনের মাধ্যমে সংসার পালনের ভিতর থেকে নিজের চারিত্রিক বিশুদ্ধতার প্রমান দেওয়া আবশ্যিক। বৈদিক ও বৌদ্ধ দর্শনের প্রবর্তকগণ সন্ন্যাস জীবন ধারণের মাধ্যমে চারিত্রিক বিশুদ্ধতার জগত থেকে দূরে সরে গেছেন এবং সকলের গ্রহণযোগ্যতার সত্যতার সমাপ্তি এখানেই। তথাপি আলোচনা এগিয়ে নিব যেন বৈদিক দর্শন, গৌতম ও অন্য প্রবর্তক যাদের ধর্ম ও দর্শনের কাণ্ডারি দাবী করা হয়, তাদের সম্পর্কে জানা আরো প্রসারিত এবং সাধারণ মানুষের জ্ঞান ও সত্যের জগত উপলদ্ধি এবং উন্মোচিত হয়।

গৌতম ইশ্বরহীন অর্থাৎ নিরীশ্বরবাদকে গ্রহণ করেছেন। নিজ সত্তাকে নিজেই অস্বীকার করেছেন। “আত্মা” বলে কিছুকে স্বীকার করেননি অর্থাৎ নৈরাত্মবাদে বিশ্বাসী ছিলেন। অন্য বিবরণে, নামস্কন্ধ(বেদনা, সংজ্ঞা, সংস্কার, বিজ্ঞান) ও রূপস্কন্ধের সমন্বয়কে “আত্মা” বলে স্বীকার করার কারন অবৌদ্ধদের বুঝানোর উদ্দেশ্যে। নিজেদের কাছে আত্মা ছিল গুরুত্বহীন। এই মতবাদ পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায়, তারা গোলাপ ফুলের গন্ধ নিয়ে কথা বলছেন, আলোচনা করছেন অথচ গোলাপ ফুল নেই, বাতাসও নেই। গোলাপ ফুল এবং বাতাস না থাকলে গোলাপ ফুলের গন্ধের অস্তিত্ব কি করে আসে? আত্মা না থাকিলে চেতন, তৃষ্ণা, দুঃখ, সুখ, বিদ্বেষ, অহং, চিন্তা, ধ্যান কিভাবে অস্তিত্বে আসে? আত্মা সম্পর্কে গৌতমের চিন্তাধারা ছিল অসম্পূর্ণ এবং ধারাবাহিকতায় বিচ্ছেদ। বৌদ্ধ পণ্ডিতগণের সাথে কোন বিষয়ে আলোচনায় লিপ্ত হলে, “আমি” ও “আমার” শব্দ দুটি ব্যবহার করে অথচ এই শব্দদ্বয়ের অস্তিত্বই তারা স্বীকার করে না। জিজ্ঞেসিত হলে চিত্ত ও মন বলে মৌন থাকেন। চিত্ত ও মন কি?- এই বিষয়ে ভিক্ষুগন জবাব দেন না বা জবাব দিতে আগ্রহী হোন না।

জন্মটাই যদি শুধু দুঃখ হত তবে শিশুরা শৈশবেই মারা যেত। আকর্ষন ও উদ্দ্যমতার সহিত শিশুরা আনন্দের সহিত বেড়ে উঠে। শিশুদের এই আনন্দের সহিত বেড়ে উঠা- বিলাসিতা কিংবা দরিদ্রতার প্রভাব কোন প্রতিক্রিয়া করে না। শিশুদের অবুঝতার কার্য্যাদি এবং স্বভাবসুলভ আচরণ নিশ্চয়ই দুনিয়ার অন্যতম সৌন্দর্যমন্ডিত। গৌতম চারপাশে বহু সত্যের প্রতি দৃষ্টি না দিয়ে শুধু জগতের দুঃখকে একমাত্র বড় সত্য বলে চিহ্নিত করেছেন। জগতের অন্য কিছুকে দুঃখের মত গুরুত্ব দেননি আর সেই দুঃখ মতবাদের সাথে রেখে গেছেন চার প্রকারের আর্যসত্য। আর্যসত্যের প্রথমেই দুঃখ। জন্ম দুঃখ সহ আট প্রকারের দুঃখ রয়েছে প্রথম আর্য সত্যে। চারপাশে অগণিত দুঃখের কারন কিন্তু তিনি গ্রহণ করেছেন আট প্রকার। চারিত্রিক বিশুদ্ধতার সহিত সংসার ধর্ম পালন করলে অগণিত দুঃখ আপনাতেই জ্ঞানের জগতে উপনীত হত। দ্বিতীয় প্রকার আর্যসত্য দুঃখের কারন, যাকে বলে তৃষ্ণা। তৃতীয় আর্যসত্য দুঃখ নিবৃত্তি আর চতুর্থ আর্যসত্য দুঃখ নিবৃত্তির উপায় যাতে রয়েছে অষ্টাঙ্গিক মার্গ (সম্যক দৃষ্টি, সম্যক সংকল্প, সম্যক বাক্য, সম্যক কর্ম, সম্যক জীবিকা, সম্যক প্রচেষ্টা, সম্যক স্মৃতি, সম্যক সমাধি)। এই অষ্টাঙ্গিক মার্গ তিন ভাগে বিভক্ত; শীল (বাক্য, কর্ম, জীবিকা), সমাধি (প্রেচেষ্টা, স্মৃতি, সমাধি) এবং প্রজ্ঞা (দৃষ্টি, সংকল্প)। আর ভিক্ষুদের জন্য রেখে গেছেন দশ শীল থেকে ২২৭ শীলের মর্মবানী। তৃষ্ণা থেকে নিজেকে নিবারণ বা মুক্তি করাই হচ্ছে নির্বাণ লাভ।

গৌতম বলেছে মানুষ জন্মান্তরের চক্রে আবদ্ধ এবং চক্র থেকে মুক্তি না হওয়ার কারন অবিদ্যা বা অজ্ঞানতা অর্থাৎ প্রজ্ঞার অভাব। ধর্মের উপদেশ বানী হওয়া উচিত সরল যা সাধারণ মানুষদের বুঝতে ও পালন করতে সহজ হয় কিন্তু গৌতম অত্যন্ত কঠিন করে প্রকাশ করেছেন যা বুঝতে অসুবিধা, পালন করতে কঠিনতর। তাঁর এই অষ্টাঙ্গিক মার্গ পালন করতে চাইলে লোকালয় ছেড়ে বন-জঙ্গলে বা গুহায় থাকতে হবে যেখানে জনমানবহীন। একজন ভিক্ষু কিভাবে জীবিকা নির্বাহ করবে? বৌদ্ধ পণ্ডিতদের মতে, মাধুকরি বা আশপাশ মানুষদের দানের মাধ্যমে (গৌতমও জীবিকা সম্পর্কে এমনটাই বলেছেন)। মনুষত্যবোধ, সততা, মানবিকতা, নৈতিকতার ভিত্তি হচ্ছে “লজ্জাশীলতা”। একজন ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষ লজ্জাশীলতার দরুণ কারো কাছে প্রয়োজন কিছু চাইতে পারে না। কারো দানের উপর যদি জীবন নির্বাহ করতে হয় তাহলে তাঁর চরিত্র ও স্বভাব প্রথমেই প্রশ্নবিদ্ধ। যার লজ্জা নাই সে বিবেক সম্পন্ন মানুষ নয়। অন্যের দানের উপর ভিক্ষুগণ জীবন নির্বাহের সিস্টেম অনুসরণ করলে ইহা স্পষ্ট, দুনিয়ার মানুষজন কখনও নির্বান লাভ করে মুক্তি পাবে না। নিজের ক্ষুধা নিবারণের জন্য অন্যকে বিরক্ত করা! অন্যের দয়ার উপর নির্ভর করা!- যা নির্বানের শুরুতেই গলদ। অনুসারীদের অনেকে বলে থাকেন “ভিক্ষা করা লজ্জা নয়, বিয়ে করা লজ্জা”। যার যেমন বিচার বোধ ও রুচিশীলতা। গৌতম বিশ্ব সৃষ্টির আদি, মানুষ সৃষ্টির কারন ইত্যাদি সম্পর্কে অনেকটা মৌন থেকেছেন এবং এড়িয়ে গেছেন।

কনফুসিয়াসের জন্ম চীনের লু প্রদেশে খৃষ্টপূর্ব ৫৫১। কনফুসিয়াস(খৃষ্টপূর্ব ৫৫১-৪৭৯)-এর আসল নাম খুন চিউ। শৈশব দারিদ্রতার ভিতরে অতিবাহিত ফলে কাজ করতে হয়েছে পশু খামারে, মেষ পালক হিসেবে, শহরের উদ্যানগুলোর রক্ষণাবেক্ষণ ও দেখাশোনা করে আবার কখনও কেরানিগিরি, গ্রন্থগারে চাকরি করে। পাশাপাশি অব্যাহত রেখেছেন অধ্যয়ণ, জ্ঞান সাধনা ও ছাত্র পড়ানোর কাজ। ক্রমশ তার পান্ডিত্যে মুগ্ধ হয়ে প্রদেশের শাসক তাকে হিসেবরক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেন তারপর নিজ যোগ্যবলে পরবর্তীতে আইনরক্ষকের দায়িত্ব পালন সহ বিভিন্ন উচ্চ পদে অধিষ্ঠিত হোন।

কনফুসিয়াস বিশ্বাস করতেন, সমাজে স্থায়ী সুখশান্তি ও শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য আইনের শাসন যথেষ্ট না বরং একইসাথে প্রয়োজন মানুষের চেতনা ও নৈতিক চরিত্রের উন্নতি। তাই তিনি স্বয়ং আইন প্রশাসন কর্মকর্তাদের মাঝে নীতিবোধ জাগাতে বিভিন্ন উপদেশ দিতেন। এর সুফল হিসেবে অল্প সময়ে রাজ্যে অপরাধ প্রবণতা ব্যাপকভাবে কমে যায়। আইনরক্ষকের পদে তাঁর গভীর দক্ষতার স্বীকৃতি হিসেবে অবশেষে তিনি প্রাপ্ত হন লু প্রদেশের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বভার।

কনফুসিয়াসের বিশ্বাস ছিল শিক্ষার মূল ভিত্তি হচ্ছে নীতিজ্ঞান। পরিণত বয়সে তিনি রাজ্য থেকে রাজ্যান্তরে ঘুরে ঘুরে সুনীতি, সৌজন্য ও সুশাসনপ্রণালী শিক্ষা দিতে থাকেন। তাঁর দর্শনের প্রধান উপজীব্য ছিল নীতিবাদ। কনফুসিয়াসের ধ্যানধারণা সম্পর্কে জানা যায় মূলত তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর শিষ্যদের দ্বারা সংকলিত লুন-ইউ মাধ্যমে। কনফুসিয়াস “সাধু” হিসেবে স্বীকৃত হলেও কনফুসিয়াদের জীবন বৃত্তান্তের কর্ম ও পারিবারিক জীবন সম্পর্কে পূর্ণঙ্গ জানা যায় না। তবে কনফুসিয়াসের চিন্তায় ঊর্ধ্বলোকের কতৃত্ব বা “তিয়ান”-র প্রতি গভীর শ্রদ্ধাবোধ ছিল। এই নিরাকার ঊর্ধ্বলোক একাধারে সমস্ত জীবনের উৎস এবং পথ নির্দেশক শক্তি যা একইসাথে সঠিক ও বেঠিকের বিচারক।

গুরু নানক দেব নির্গুণ ও একেশ্বরবাদী চলন করেন। তাঁর শিষ্যরা “শিখ” বা “সিখ” নামে পরিচিত। নানক জাতিভেদ প্রথার বিরুধী ছিলেন। সকলেই এক সাথে আহার করতেন আর এইজন্যই দুনিয়ার বড় লঙ্গরখানা দেখতে পাওয়া যায় অমৃতসরে। নানক নিজ দুই পুত্রকে পরবর্তী গুরুর দায়িত্ব না দিয়ে অঙ্গদকে মনোনীত করেন। গুরু অঙ্গদ শিখদের প্রথম ধর্মগ্রন্থ “গুরুবানী” প্রকাশ করেন। গুরু অঙ্গদের শিষ্য অমর দাস, তাঁর শিষ্য তাঁরই জামাতা রাম দাস এবং রাম দাসের শিষ্য তার ছোট ছেলে অর্জুনের উপর গুরুর দায়িত্ব ন্যস্ত করেন। রাম দাস থেকে পরিবার প্রথার শুরু। প্রধান প্রবর্তক গুরু নানকের উপদেশ, পরবর্তী গুরুদের উপদেশ এবং অর্জুন তার নিজের উপদেশ সংযোজন করে শিখদের প্রধান ধর্মগ্রন্থ “গ্রন্থ সাহিব” প্রকাশ করেন ১৬০৪ খৃষ্টাব্দে যার শ্লোক সংখ্যা ৫৮৯৪ টি। আর গুরু অর্জুন থেকে শিখদের ভিতর ও বাহির উচ্ছৃঙ্খলতার আভাস লক্ষ্য করা যায় এবং এর বড় একটি কারন মোঘলদের সাথে সংঘর্ষ। গুরু নানক সাধারণদের উদ্দেশ্যে জীবন যাপনের জন্য ৫টি ভাল গুণ প্রদান করেন; সৎ, সন্তোষ, দয়া, নম্রতা, পেয়ার বা প্রেম এবং ৫টি খারাপ গুণ কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ ও অহংকার থেকে দূরে থাকতে বলে।

জৈন ধর্মের প্রবর্তক ঋষাভদেব যিনি বৈদিক ধর্মে স্বীকৃত। ঋগবেদ, বিষ্ণু পুরান ও ভগবাদ পুরানে গুরু ঋষাভদেবের নাম পাওয়া যায়। জৈন ধর্মে ২৪ জন তীর্থঙ্কর। ২৩ নম্বর তীর্থঙ্কর পার্শনাথ এবং তিনি চতুর্থী মর্মবানী প্রকাশ করেন। অহিংসা, সত্য, চুরি না করা, কোন জিনিষের প্রতি অধিকার রাখা যাবে না। শেষ তীর্থঙ্কর মহাবীর যিনি গৌতম বুদ্ধের সমসাময়িক। মহাবীর পার্শনাথের চতুর্থীর সহিত আরো একটি যোগ করে পঞ্চ মহাব্রত রেখে যান আর পঞ্ছমটি হলো ব্রহ্মচারিয়া অর্থাৎ পবিত্রতা, কোন কামনা-বাসনা না থাকা। বৌদ্ধ অনুসারীগণ হীনযান ও মহাযান দুই দলে বিভক্ত। পরবর্তীরা মতভেদের ভিন্নতার কারনে হীনযানরা গৌতমের মূল আদর্শ ধরে রাখলেও মহাজানরা গৌতমের মূল শিক্ষা থেকে দূরে সরে আসে। জৈনরাও শ্বেতাম্বর ও দিগম্বর দুই ভাগে বিভক্ত। শ্বেতাম্বরগন সাদা পোশাক পরিধান করে আর দিগম্বররা নগ্ন থাকে। তাদের ভিতরেও রয়েছে আরো শ্রেনীবিভাগ। মহাবীর বেদ ও বেদের রীতিকে অস্বীকার করেছেন, গৌতমের মত সৃষ্টিকর্তায় অবিশ্বাসী ছিলেন কিন্তু আত্মায় বিশ্বাস করতেন। মহাবীর “জন্মান্তর” মতবাদ গ্রহণ করেছেন। কর্মের দ্বারা জন্মান্তর নিয়ন্ত্রিত- এই মতবাদ লালন করতেন।

ঐ সময়কালে ভারত বর্ষে ৬৩টি ধর্ম বা দর্শনীয় মতবাদের আবির্ভাব হয়। এগুলোর মধ্যে বৈদান্তবাদী, বৌদ্ধ, জৈন ও অজীবিকা ছিল প্রধান। মহাবীর ত্রিশ বছর বয়সে সন্ন্যাস জীবন ধারণ করেন। মহাবীরের সাথী মাক্কালি গোসালা হলেন অজীবিকা দর্শনের প্রবর্তক। শুরুর দিকে মহাবীর ও গোসালা একসাথে সন্ন্যাস জীবন শুরু করলেও পরে তাদের মধ্যে মতভেদ হলে পৃথক হয়ে যান। অজীবিকা দর্শন বিলুপ্ত হয়ে গেলেও তাদের প্রচারিত উপদেশবানী আজও কিছু টিকে আছে। যেমনঃ ব্রাহ্মণের ছেলে হলেই ব্রাহ্মণ হওয়া যাবে না। ব্রাহ্মণ সেই, যার ভিতর ব্রহ্ম জ্ঞান রয়েছে। বর্তমানে বৈদিক অনুসারীদের মাঝে বৈষ্ণবরা ব্রাহ্মণদের প্রত্যাখ্যান করে অজীবিকাদের এই উপদেশ মেনে চলার প্রবনতা লক্ষিত। ঋষাভদেব, গৌতম, মহাবীর, নানক, গোসালা সকলেই নীজেদের দর্শন প্রচার করে গেছেন। এদের অনেকে সন্ন্যাস জীবন ধারণ করলেও বাকিদের ব্যাক্তিগত, পারিবারিক ও কর্মজীবন জানা যায় না, জানার উপায় নেই, কর্মের রেকর্ড বা নথী নেই। দর্শন আর ধর্মের “সত্যতা” এক নয়। ধর্মের প্ল্যাটফর্মে এদের কেহ “সত্য” হিসেবে প্রতিষ্ঠিত নন।

ধর্মীয় প্রচারকগণ শুধু স্বর্গীয় বানী উপদেশই দেন না, সেই স্বর্গীয় বানী অনুশীলনের মাধ্যমে মানব জাতির কাছে দৃষ্টান্ত রেখে যান। গৌতম সংসার ধর্ম পালনের সহিত অষ্টাঙ্গিম মার্গের অনুশীলন এবং নির্বান লাভের উপায় মানব জাতির কাছে কর্মের মাধ্যমে দৃষ্টান্ত রেখে গেলে অষ্টাঙ্গিক মার্গ বা নির্বান লাভের তিক্ততা বুঝতে সক্ষম হতেন এবং সাথে জনগনের সমস্যা ও পালনের জটিলতা বুঝতে পারতেন। একই সাথে মহাবীর নিজের বানীর তিক্ততা বুঝতে সক্ষম হতেন যদি অনুশীলন করতেন। জনমানবহীন উপাসনালয়ে বসে অষ্টাঙ্গিক মার্গ বা পঞ্চ মহাব্রত মর্মবানীর কি মূল্য? এই উপদেশবানী জনগনের কি উপকারে আসে? উপদেশ বানী অনুশীলনের মাধ্যমে বাস্তবতায় প্রয়োগ করে দৃষ্টান্ত না তৈরি করা হয়, অনুসারীদের কর্মের মাধ্যমে শিখিয়ে না দেওয়া হয়, তবে তা প্রতারণা; অনেক বড় ধূর্ততা। এই সকল প্রতারক, ধূর্তরা আবার নিজেদের দাবী করে, তারা জগত সংসার ত্যাগ করে সকল প্রকার ইন্দ্রীয় থেকে মুক্ত হয়ে সত্যের সহিত সুপ্রিম জ্ঞানের অধিকারী হয়েছে। পাগলামী ও মিথ্যাচারের সীমা থাকা উচিত।

হরপ্পা সভ্যতার সময় ভারতবর্ষ ছিল আধিভৌতিক এবং আধ্যাত্মিক উভয় দিকে অত্যন্ত উন্নতমানের একটি সভ্যতা। ৩৫০০ থেকে ৩৮০০ বছর পূর্বে মধ্য এশিয়ায় বসবাসরত এক জাতি যারা ছিল আর্য, ভারতবর্ষের আদিবাসীদের আক্রমণ করে হরপ্পা সভ্যতাকে বিনাশ করে আর্য সভ্যতার পত্তন শুরু করে। আর্যরা চার ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়, যার এক ভাগ ভারতে আগমন করে। পরবর্তীকালে আর্য সভ্যতাই একমাত্র ও আদি সভ্যতা রূপে পরিগণিত হয়েছে। আর্যদের ধর্ম বিষয়ে পূর্ণাঙ্গ বৈদিক সাহিত্য পাওয়া গেলেও প্রাকৃতিক শক্তির উপর দেবত্ব আরোপ করেছে। এখানে পুরোহিতরা হচ্ছে সর্বেসর্বা কারন তারা দেবতা ও মানুষের মধ্যে মধ্যস্থের কাজ করেন। কিন্তু হরপ্পা সভ্যতায় ঋষিরা ছিলেন প্রধান ব্যক্তিত্ব। হরপ্পা সভ্যতায় ধ্যান চর্চার কথাই প্রাধান্য ছিল কিন্তু আর্য সভ্যতায় যাগ-যজ্ঞের প্রাধান্য এবং যাগ-যজ্ঞের মাধ্যমে দেবতাদের তুষ্ট করাই লক্ষ্য হয়ে ছিল। হরপ্পা সভ্যতায় বৈদিক ধর্মের উপাসনা ছিল বিমূর্ত কিন্তু আর্য সভ্যতায় মূর্তি পূজা শুরু হয়। হরপ্পা সভ্যতায় লক্ষ্য ছিল “মোক্ষলাভ” আর আর্য সভ্যতার লক্ষ্য হইল “আনুগত্য”-র মাধ্যমে স্বর্গ লাভ। আর্য সভ্যতার আরো গুরুত্বপূর্ন দুটি বিষয় হলঃ (১)জাতিভেদ প্রথা- কর্ম অনুসারে চতুর্বর্ণের সৃষ্টি (২) বেদ সাহিত্যের অপৌরুষেয়ত্ব।

আর্যদের ভারতে আসার পূর্বে বৈদিক সাহিত্য ছিল সরল। যাযাবর পশুচারণজীবী আর্যরা বিভিন্ন প্রাকৃতিক শক্তি ও তাদের অতীত কিংবদন্তি নায়কদের দেবতা হিসেবে উপাসনা করত। উপাসনা অর্থাৎ অগ্নিকুণ্ডে দেবতাদের উদ্দেশ্যে পশুবলির মাংস, খাদ্য, পানীয় নিবেদেন করে তাদের স্তব-স্তুতি করে নিজেদের প্রার্থনা, চাহিদা, দাবী-দাওয়া নিবেদন করত। কৃষিজমি এবং বৃহত্তর অঞ্চল ও জনপদের ভৌগলিক সীমা রক্ষার্থে শাসকের প্রয়োজন হলো। শাসক চাইল, নিজের শাসনক্ষমতা বংশানুক্রমিক করে তুলতে। স্বাভাবিকভাবে অন্যরা তা মেনে নেয়নি। তাই রাজার সহায়ক হলেন পুরোহিতশ্রেনী। সাধারণদের বলা হলো বা বুঝানো হলো, এক শ্রেনীর মানুষ বংশানুক্রমিক শাসন করতে দৈব আদিষ্ট- তারা ক্ষত্রিয় বা রাজন্য। শাসকরাও পুরোহিতদের পৃষ্টপোশকতা দিলেন। পুরোহিত পদও হয়ে উঠল বংশানুক্রমিক। তারা সমাজকে ব্রাহ্মন, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র এই চারভাগে ভাগ করল। ধর্ম ও রীতিনীতি চলে গেল ব্রাহ্মণদের হাতে। তারা যাগযজ্ঞের নিয়মকানুন অত্যন্ত জটিল ও কঠিন করে তৈরি করল। অনার্য(দ্রাবিড়)দের কিছু পুরোহিতরাও ব্রাহ্মণ রূপে স্বীকৃতি পেল। এই ধর্মের নিয়মকানুন বিশেষজ্ঞ ছাড়া কেহ পালন করতে পারত না। তাই ব্রাহ্মণদের আধিপাত্য বজায় থাকল। এজন্যই ইহাকে ব্রাহ্মণ্য ধর্মও বলে। ক্ষত্রিয় ও বৈশ্যরা তাদের দাক্ষিণ্য দিয়ে যজ্ঞ করাত। ব্রাহ্মণ ছাড়া প্রায় সকলেই এই ধর্ম থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিলেন। আর এই মোক্ষম সুযোগটি গ্রহণ করে পরবর্তীতে বৌদ্ধ সম্প্রদায়, জৈন ধর্ম সহ অন্য ধর্মের অনুসারীরা যাদের আক্রমনে বৈদিক ধর্ম লুপ্ত হওয়ার আশংকা হয়েছিল।

পরবর্তীতে এই আর্যরা দ্রাবিড়দের সাথে মিশে একাকার হয়। হরপ্পা সভ্যতা- দ্রাবিড় সভ্যতা ও সিন্ধু সভ্যতা নামেও পরিচিত। আর্যরা যখন ভারতে আগমন করে তখন পূরুষের সংখ্যা ছিল অধিক। ভারতীয় আদি মেয়েদের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে ভারতে চিরস্থায়ী ভাবে থেকে গেলেও, নিজেদের আধিপাত্য অক্ষুন্ন রাখে। নিজেদের ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয় এবং নিজেদের সেবার জন্য প্রাচীন ভারতীয়দের শূদ্র ও বৈশ্য শ্রেনীতে ভাগ করে। সামরিক বিদ্যা ও শারীরিক কাঠামোতে আর্যরা ছিল এগিয়ে যার ফলে ভারতের উপর আধিপাত্য করতে সহজতর হয়েছিল।

আবেগ ও দূর্বলতাকে পুজি করে সাধারণ মানুষদের নিয়ন্ত্রণ ও ঘায়েল করার অভিজ্ঞতায় গুরু ও পুরুহিতরা ছিল দক্ষ। কারোর বীরত্বকে পুঁজি করে আজগুবি কেচ্ছা-কাহিনীর সহিত আলৌকিক কেরামতির সংমিশ্রণে “শাস্ত্র” বানিয়ে জনগণকে ধোকা দেওয়ায় ব্রাহ্মণ্যবাদীরা ছিল পারদর্শী। জগত সংসার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে, বাস্তবতার আগুনের উত্তাপ আস্বাদন না করে, শামুকের খোলসের ভিতর নিরাপদ থেকে পণ্ডিতি জ্ঞান জাহির করার সহিত ধর্ম পালন ও প্রচার কোনটাই হয় না। দুনিয়ার প্রায় সকলের সম্পূর্ণ জীবনের কর্ম ও চিন্তা-চেতনা নিরানব্বই ভাগের বেশি সময় পরিচালিত হয় “অবচেতন মন” দ্বারা। আর এই সুযোগে অবচেতন মনের দুর্বলতাকে কেন্দ্র করে গুরু এবং পণ্ডিতদের ভাষার খেল, বচন ভঙ্গি, উপস্থিত উদ্দৃতি ও বুদ্ধিমত্তার সহিত স্বার্থরক্ষার কৌশল যা কৃত্রিম মাধুর্য্য তৈরি করে আর সেই মাধুর্যের ফাঁদে পা দিয়ে সাধারণ মানুষজন মিথ্যাকে সত্য বলে গ্রহণ করে। আর সাধারণেরা, গুরু ও পুরুহিতদের মধুর কথাবার্তার সহিত নিজেদের চাওয়া-পাওয়া মিলে গেলে আর তা বুঝে হোক বা না-বুঝে, জীবনের পরিপূর্ণতার জন্য যথেষ্ট বলে মনে করতে থাকে এবং সাথে নিজেদের অন্ধবিশ্বাসের ভিত্তিকে মজবুত করে। বর্তমান সচেতন ও শিক্ষিত মনিষীরাও এই বিভ্রান্তির ভিতর হাঁটছে। দুনিয়ার সকলেই যদি আধ্যাত্মিক প্ল্যাটফর্মে বিচরণ করার সাথে উত্তম চরিত্রের অনুশীলনে সক্ষম হত, তবে সকল সন্ন্যাসী, ঋষি, সংসার বিরাগী, পীর-দরবেশ, পণ্ডিত, ইশ্বর বেশে মানুষদের কথা ও কর্মের অসামঞ্জস্যতার সাথে ধর্মীয় উপদেশ বানী, শ্লোক ও কিতাবের মুখোশ আপনাতেই উন্মোচিত হয়ে যেত।

“পরম ইশ্বরের জ্ঞান প্রকৃতি থেকে প্রাচীন ঋষিগণ ধ্যানের মাধ্যমে আবিষ্কার করেছেন যা বেদ গ্রন্থ” বা “বেদ সাহিত্যের অপৌরুষেয়ত্ব”- ইহা প্রতারণামূলক কথা এবং সত্যের সহিত এই দাবীর সম্পর্ক নাই। যে সকল মনিষী ও ঋষিগণের দাবী করেন প্রকৃতি থেকে ঈশ্বরের জ্ঞান আবিস্কারের, তাদের চারিত্রিক বিশুদ্ধতার দলিল নাই এবং কে, কারা, কখন আবিষ্কার করেছেন তারও নিদর্শন বা নথি নাই। বৈদিক অনুসারীদের অনেকের দাবী ঋগবেদ অগ্নিঋষি, যজুর্বেদ বায়ুঋষি, সামবেদ আদিত্যঋষি এবং অথর্ববেদ অঙ্গিরাঋষি ধ্যানের মাধ্যমে ইশ্বরের বানী হিসেবে দুনিয়ার মানুষজনদের জন্য রেখে গেছেন। এই সকল ঋষিদের পরিচয় ও কর্মের রেকর্ড বা নথি নাই আর দাবীগুলো বাস্তবতা বিবর্জিত। বেদ দিয়েই বেদের সঠিকতা প্রমানের চেষ্টা অগ্রহণযোগ্য এবং অসার। শতভাগ সত্যের উপস্থিতি না হলে, অন্তরে তৈরি হয় “সন্দেহ”। কারো অন্তরে অনু পরিমান সন্দেহ থাকিলে ভক্তি ও ইবাদতে “নিষ্ঠা” আসে না আর “সত্য”-র বিলুপ্তি শুরুতেই। আর নিষ্ঠার অনুপস্থিতিতে ধর্মান্ধতা ও মিথ্যা আসন গাড়িয়া লয়। ধ্যানের মাধ্যমে আত্মনিয়োগকারীগন যে কেহ বেদ ও গীতার শ্লোক সদৃশ তৈরি করার ক্ষমতা রাখে আর সাধারণরা এর ভিতরে বিভ্রান্তিতে নিমজ্জিত ও বিপথগামী। হরপ্পা বা আর্য সভ্যতায় জালালুদ্দিন রুমি বা ঈমাম গাজ্জালীদের মত মনিষী উপস্থিত থাকিলে তাদের রচনা করা গ্রন্থাদিও বৈদিক ধর্মের শাস্ত্র হিসেবে পরিগণিত হত এবং উচ্চ মর্যাদা পেত।

২০২০ সালে ভারতের দিল্লীতে যত সংখ্যক মানুষের বসবাস ছিল, বৌদ্ধের সময় সমপরিমান বা তার চেয়েও কম অধিবাসী ছিল পুরো ভারতবর্ষ জুড়ে। আর্য সভ্যতার শুরুর সময় ভারতবর্ষের জনসংখ্যা গৌতমের সময়ের চেয়ে আরো কম এবং হরপ্পা সভ্যতায় আর্য সভ্যতার তুলনায় আরো কম। প্রকৃতিতে “জন্মমৃত্যুর খেলা” ঐ সময়কালে সকল সন্ন্যাসীগণ ছিল গোলকধাঁধায়। কর্মের মাধ্যমে জন্মান্তর মতবাদ কিংবা আত্মাকে মুক্ত করা নিজের ইচ্ছাধীন- এই সকল মতবাদের যৌক্তিকতার ভিত্তি নেই, সবই মনগড়া কথা। গৌতমের দাবী পূর্বে ৫৪৭ বার দুনিয়াতে নিজের জন্ম হয়েছে। গৌতম নিজে আত্মায় বিশ্বাসী নয় অথচ দিয়ে গেছে নির্বান লাভ ও জন্মান্তরের মতবাদ! ইহা স্ববিরুধী মতবাদ। জন্মান্তর মতবাদ যদি সঠিক ধরেও নিই তবে আত্মা না থাকিলে কার জন্মান্তর হয়? বৌদ্ধ অনুসারীরা মনে করেন শুক্রানু, ডিম্বানুর সাথে গন্ধব্বো জন্মান্তর নিয়ন্ত্রণ করে আর বৈদিক পণ্ডিতগণের দাবী উদান বায়ুর মাধ্যমে জন্মান্তর নিয়ন্ত্রিত হয় এবং তারা আরো আগ্রবর্তী। মৃত্যুর পরের ঘটনা, জন্মান্তরের মাঝের সময় ও ঘটনাগুলো বর্ণনা করে সন্ন্যাসীরা- যা সম্পূর্ণ অসার।

পুরোহিতরা নিজেদের আবিস্কৃত বানোয়াট দেবদেবীদের কেচ্ছাকাহিনীর মাধ্যমে সমাজে একচ্ছত্র গায়ের জোরে আধিপাত্য বিস্তার করলে, বৌদ্ধরা আক্রমন করে বৈদিক ধর্মের ভিত নাড়িয়ে দেয়। পুরোহিতগন নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমানের পথকে আঘাত করেন বৌদ্ধ সম্প্রদায়। সেই আঘাতকে আরো শক্তিশালী করে জৈন ধর্ম ও অজীবিক শ্রেণী। জাতিগত প্রথা ও অন্যান্য কারনে হরপ্পা সভ্যতার বৈদিক ধর্মের মূল আকিদা থেকে সরে আসার দরুন বৌদ্ধের অনুসারীরা এই সুযোগটি গ্রহণ করে বা গ্রহণ করতে বাধ্য হয়। বৌদ্ধদের আকিদা হরপ্পা সভ্যতার বৈদিক ধর্মের সাথে অনেকটা সাদৃশ্য বজায় ছিল। বৌদ্ধ, জৈন ও অজীবিক শ্রেনীর আক্রমনে পুরোহিতরা কোণঠাসা হয়ে পরে। চার/পাঁচটি ধর্ম বা মতবাদ নিজেদের আধিপত্য ধরে রাখতে বেপরোয়া হয়ে উঠে এবং এক হীন প্রতিযোগীতায় লিপ্ত হয়। বৈদিক ধর্মের অনুসারীগণ সেই হীন প্রতিযোগীতার ভিতর থেকে আধিপাত্য বজায় রাখতে “রামায়ণ” ও “মহাভারত” ব্রাহ্মণদের দ্বারা পরিমার্জিত হয়ে দুই মহাকাব্য গ্রন্থ প্রকাশ করে। এই দুই মহাকাব্যে যে বীররস সৃষ্টি করা হয় তাতেও নিজেদের প্রাধান্য না পাওয়ায় রাজন্যবর্গদের সহায়তা নেন। এই প্রতিযোগীতায় প্রথমে নিষ্প্রভ হয় অজীবিক শ্রেণী। দ্বিতীয় আঘাত আনে জৈন অনুসারীদের উপর। এর দুই/তিন শত বছর পর বৈদিক ধর্ম পুনঃ সুসংহত হওয়ার পর তৃতীয় আঘাত আনে বৌদ্ধ অনুসারীদের উপর। অজীবিক শ্রেণী অনেকটা বিলীন আর জৈন অনুসারীগণ ভারতের পূর্বে সমুদ্র উপকূলে আজও অল্প পরিমান বিদ্যমান। খ্রিস্টপূর্ব প্রথম শতকে এবং সপ্তম শতাব্দীতে বৌদ্ধ নিধন হয় ব্যাপক হারে। পাইকারীভাবে বৌদ্ধদের হত্যা করা হয়। বাকী বৌদ্ধরা উত্তরে ও পূর্বে মাইগ্রেট করে এবং পাহাড়ে আশ্রয় নিয়ে নিজেদের রক্ষা করে। গৌতমের জন্ম ভারতে হলেও ভারত আজ অনেকটা বৌদ্ধ শূন্য।

সৃষ্টিকর্তা সে তাঁর আপন গুণে গুণান্বিত। কেহ সৃষ্টিকর্তার গুণ এবং গুণের কারনে ক্ষমতাকে চিন্তা করে, স্মরণ করে, নিঃসন্দেহে অতিব উত্তম। উত্তমের উত্তম। কিন্তু গুণকে মাত্রায় এনে ব্রহ্মা, বিষ্ণু, শিব ত্রিশক্তি এবং এদের অবতার তৈরি করে পূজা শুরু করে তবে তা হয় উত্তমের বিপরীত। দুনিয়ার নিকৃষ্ট কাজ। সৃষ্টিকর্তাকে বাদ দিয়ে সৃষ্টিকর্তার শক্তি ও ক্ষমতাকে মানবাকৃতির রূপ দিয়ে উপাস্য হিসেবে উপাসনা করা, মানব জাতির এক চরম বিবেকবর্জিত অধমতা। এর চেয়ে নিকৃষ্ট বিশ্বব্রহ্মান্ডের সৃষ্টির আদি থেকে অন্ত পর্যন্ত আর কিছু নেই। সৃষ্টিকর্তা অবতার রূপে মানুষের বেশ ধরে কিংবা ইশ্বরের পুত্র মানুষের বেশে দুনিয়ার আগমন করার দাবীর অর্থ হচ্ছে সৃষ্টিকর্তার সত্তা ও পবিত্রতাকে কলঙ্কিত করা। যে সৃষ্টিকর্তা মহাবিশ্ব ও মহাবিশ্বের বাহিরের সবকিছু সৃষ্টি করেন, তিনি মানব জাতিকে শিক্ষা দেওয়ার উদ্দেশ্যে মানুষের রূপ ধারণ করে পৃথিবীতে আসবেন- ইহা অসুস্থ অন্তরের সাথে অসুস্থ বিবেকের চিন্তা ও কর্মের সমাহার। পৈতৃক ধর্ম খুবই ভয়ানক ও বিপদজনক। এই ভয়ানক ও বিপদজনক জাল থেকে সহজে কেহ বের হয়ে আসতে পারে না। “পৈতৃক ধর্ম সঠিক নয়”- ইহা জেনেও বের হয়ে আসার ক্ষমতা থাকে না কারন নিজেদের “বিবেক বোধ” জন্ম থেকে অন্ধবিশ্বাসের কারাগারে নিজেরাই বেঁধে রাখে। কেহ নিজ স্ত্রী ও কন্যাকে অর্থের জন্য সন্ধ্যায় পতিতালয়ে পাঠিয়ে ভোরবেলায় ফিরে এলে ঐ পুরুষ স্ত্রী-কন্যাকে জড়িয়ে ধরে দাবী করে যে, তারা শান্তিতে আছে, মহা সুখে আছে তবে তার রুচীবোধ, বিবেকবোধ সম্পর্কে বলার কিছু আছে কি? কেহ নিজ স্ত্রীকে যৌনতায় তৃপ্তি ও সন্তান ধারণের জন্য আশপাশের সকল পুরুষদের ডেকে আনে মিলিত হওয়ার জন্য তবে এই লোকের রুচীবোধের পরিচয় কেমন হবে? যে সকল দেবদেবীদের পূজো করা হয় তাদের চরিত্র, রুচী যদি এই বিকৃত লোকের মত হয় কিংবা তার চেয়েও জঘন্য হয় তাহলে যারা পূজো করে, তারা যে মানসিক বিকারগ্রস্থ- তা না বুঝার আর অবশিষ্ট থাকে কি? আর ইহা ধর্ম হিসেবে মানতে বিবেক কিভাবে সম্মতি দেয়?

শিব পুরাণ, ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ, পদ্ম পুরাণ, বিষ্ণু পুরাণ, মার্কণ্ডেয় পুরাণসহ অন্যান্য পুরাণ গ্রন্থাদিতে দেবী দূর্গাকে যেভাবে চিত্রিত করা হয়েছে তা ঐ লোক যে স্ত্রী-কন্যাকে পতিতালয়ে পাঠায় তার চেয়েও বেশী কুরুচীপূর্ণ ও জঘন্য। কুচনিপাড়া পতিতালয়ের যৌনকর্মী ছিল দেবী দূর্গা। ধর্মীয় গ্রন্থগুলো দূর্গাকে যেভাবে পতিতা, কামিনী হিসেবে পেশ করেছে ইহা বৈদিক অনুসারীদের জন্য অতীব লজ্জ্বাকর। ভগবান শিব ও তার অনুসারী মহিষাসুর ঐ পতিতালয়ে দূর্গাকে ভোগ করত। তখন তার নাম ছিল মায়াময়ী। দূর্গার আসল নাম পার্বতী। হিমালয়ের পর্বত তাকে জন্ম দিয়েছে তাই তার নাম পার্বতী। বিভিন্ন গ্রন্থে কখনও ঊমা, কখনও গৌরি, বৈষ্ণবী, শারদা, মহামায়া, যোগমায়া, অম্বিকা, কাত্যায়নী, মহিষাসুরসংহন্ত্রী, চন্ডীকা ইত্যাদি নামে পার্বতীকে অভিহিত করা হয়েছে। “কালী” পার্বতীর আরেক রূপ। একদা ভগবান শিব ঐ পতিতালয় থেকে দূর্গাকে বিয়ে করে কিন্তু স্বর্গে নারায়ণ(বিষ্ণু) ও ব্রহ্মা এই বিয়ের অসম্মতি জানায়। তারপর শিব তাদের সাথে নিস্পত্তি করে এই শর্তে যে ব্রহ্মা ও নারায়ণকে দূর্গাকে ভোগ করতে দিতে হবে। যার ফলে দূর্গার নাম হয় নারায়ণী, ব্রহ্মাময়ী। দূর্গাপুজায় যে অসুরকে দূর্গা বধ করে, সেই অসুরের বিরুদ্ধে ব্রহ্মা, বিষ্ণু, শিবের সম্মলিত বাহিনী ১৭ বার যুদ্ধে পরাজিত হয়। ঋগবেদে দেবরাজ ইন্দ্রকে উদ্দেশ্য করে যুদ্ধ জয়, শারীরিক শক্তির কামনার প্রার্থনামালা। ব্রহ্মা, বিষ্ণু, শিব মিলে অসুরের বিরুদ্ধে পেরে উঠতে না পেরে পার্বতীকে প্রস্তুত করে অসুরকে হত্যা করার জন্য। অসুর মদ পান করতেন না তাই তিনি অসুর আবার তিনি ছিলেন শক্তিশালী। অসুর শুধু একজন মহান রাজাই ছিলেন না, তিনি ছিলেন প্রাচীন ভারতীয় এবং দ্রাবিড় শ্রেনীর অন্তর্ভূক্ত। সে মহিলাদের বিরুদ্ধে কখনই অস্ত্র ধারণ করতেন না, মহিলারা কিছু প্রস্তাব দিলে তা ফিরিয়ে দিতেন না। মহিলাদের সন্মান করতেন। দূর্গা অসুরের দূর্বলতা অবগত ছিল। দূর্গা অসুরকে ১৮ বার বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে প্রত্যাখ্যান হওয়ার পর ১৯তম বারে অসুরকে কৌশলে রাজি করাতে সামর্থ্য হোন। অসুরের নৈতিকতার সুযোগে দূর্গা অসুরকে হত্যা করেন অথচ পূজোতে অসুরকে রাক্ষস বানিয়ে, অপদেবতা উপাধি দিয়ে আর্য ব্রাহ্মণ্যবাদীদের উল্লাসের শেষ নেই। শিব, পার্বতী, মহিষাসুর সকলেই অনার্য। কালীর গলায় যে সকল মানুষের কল্লা দিয়ে মালা বানানো সেই সকল কল্লাওয়ালারা ছিল আর্য। আর্যরা অনার্য মেয়েদের গণ হারে ধর্ষণ করত। কালীর আবির্ভাব সেই সকল ধর্ষকদের শায়েস্তা করতে। অনার্য মেয়েদের ধর্ষণ থেকে রক্ষা করার জন্য কালী আর্যদের হত্যা শুরু করেন। বর্তমানে বৈদিক অনুসারীরা অন্ধভাবে দূর্গাপূজা পালন করে। বৈদিক ধর্মে মহিলাদের যে অবমাননা ও অসন্মান করেছে বাংলার নোবেল বিজয়ী কবি সনাতন গ্রন্থগুলোর কঠোর সমালোচনা করেন। কর্ণাটকের শাসক ছিল হেমন্ত সেন। সেই হেমন্ত সেনের ছেলে বিজয় সেন দূর্গাপূজা উত্তর ভারত ও দুই বাংলায় চালু করে এবং পরবর্তীতে বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পরে। ১৭৬৫ সালে নবকৃষ্ণের হাত ধরে কলিকাতার শোভাবাজার থেকে আধুনিক দূর্গাপূজার জনপ্রিয়তা পায়। শিব দিনের বেলায় বাঘের চামড়া পরিধান করে থাকলেও রাতে নগ্ন থাকতেন আবার কখনও দিনের বেলাতেও। জগতজুড়ে সকল ছেলেমেয়েদের সামনে তার নগ্নতা প্রকাশমান ছিল। তার নগ্নতা, পতিতালয়ে গমন ও সংসারের উদাসীনতার কারনে দূর্গা নিজেকে ও শিবকে অভিশাপ দিতেন এবং দূর্গা নিজ দুঃখ-কষ্টের বিলাপ করতেন। শিবলিঙ্গ ও বিদ্যার দেবী সরস্বতীকে কেন্দ্র করে পুরাণগ্রন্থগুলোর বিবরণগুলো অত্যন্ত আপত্তিকর, বিবেক বর্জিত অসুস্থতা। দেবী সরস্বতীর ঘটনাগুলো দেবী দূর্গার কাহিনীর চেয়েও করুণ ও লজ্জাকর। সুস্থ মানুষের পক্ষে এগুলো বলাও সম্ভব নয় অথচ ধর্মগ্রন্থগুলোতে বর্ণনা রয়েছে। পার্বতী, শিব, কৃষ্ণ, বিষ্ণু, ব্রহ্মা, কালী, দেবরাজ ইন্দ্র, সরস্বতী, লক্ষ্মীসহ বিভিন্ন মুনিঋষিদের অজাচার ও বিকৃত যৌনতার বিবরণগুলো অগনিত এবং এগুলো বিকৃতমনা ও মস্তিষ্কবিকৃত ব্রাহ্মণ্যবাদী ও নীচু শ্রেনীর মুনি-ঋষিদের দ্বারা রচিত- তা স্পষ্ট। আজগুবি নোংরা কেচ্ছাকাহিনীর দ্বারা এই ধর্মের পুরাণ গ্রন্থগুলো পরিপূর্ণ। ভাষাজ্ঞান প্রয়োগ করলে গীতা বিভিন্ন ছন্দ, বিভিন্ন ঋষিদের দ্বারা বিভিন্ন সময়ে রচিত তা স্পষ্ট হয়। ব্রাহ্মণ্য পণ্ডিতরা যেভাবে খুশী সেভাবে গ্রন্থগুলো রচনা করেছে নিজেদের আধিপাত্য বজায় রাখতে। যারা ব্রাহ্মণ্যবাদীদের বিরুদ্ধাচারণ করেছে তাদের সুমূলে ধ্বংস করেছে।

যাচাই-বাচাই না করে কারোর মতবাদ অন্ধভাবে অনুসরণ করার মাধ্যমে নিজের বিবেকবোধ নিজেই বিনষ্ট করলে সেখানে কিছুই করার থাকে না। ভগবান, দেবদেবীদের স্বভাব-চরিত্র যদি এমনই হয় এবং যারা পূজা করে তারা এমন ধর্মান্ধ হলে, “সৃষ্টিকর্তা মানুষরূপে আবির্ভূত হবেন”- এমন ধারনা পোষন ও বিশ্বাস করাই স্বাভাবিক।

আধ্যাত্মিক স্তরে বিচরণকারী অধিকাংশরাই বিভ্রান্ত হয়ে অলীক চিন্তাভাবনা করা শুরু করে। ঐ স্তরে বৈদিক ও বৌদ্ধ সন্ন্যাস/পণ্ডিতগণসহ অন্যান্য মনিষীগণ ব্যাপক হারে ভুল পথে চালিত হোন; নিজে যা মনে করে তা মতবাদের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত করতে আত্মনিয়োগী হয়। পরমাত্মার সম্মুখে পরমানন্দ অনুভূত হয়। পরমানন্দকে প্রকাশ না করা গেলে নিজের ধ্যান ও সাধনা স্বার্থক হয় না। পরমাত্মাকে স্বর্গীয় পরমানন্দ অনুভূতি হয় বিধায় “কৃষ্ণ”-র পোশাক পরিয়ে নিজেদের মতবাদ প্রতিষ্ঠা করে গেছেন। আর সেই মতবাদ শক্তশালী করেছে গুরু-শিষ্য সম্পর্ক। আর্যদের ব্রহ্মা, বিষ্ণু, বেদ, উপনিষদ ইত্যাদি এবং সাথে দ্রাবিড়দের শিবকে গ্রহণ করে নিজেদের মধ্যে মিল রাখার প্রয়াস। আধ্যাত্মিক স্তরে “পরম শান্তি” অনুভূত হয় বিধায় বিভ্রান্তরা স্ক্রু-ড্রাইভার হাতে পেলে ইহাকে রেলগাড়ির ইঞ্জিন, রকেট আবার কখনও চাঁদ-সূর্য পেয়ে গেছে এমনটি দাবী করতে থাকে, যা সম্পূর্ণ উম্মাদনা আর এই উম্মাদনার কারনে বৈদিক ধর্মে অগণিত মতবাদের সৃষ্টি। পরম আত্মার সহিত সকলেই মিলিত হবে এবং এই উদ্দেশ্যে জন্মান্তরের মাধ্যমে এক দেহ থেকে অন্য দেহে প্রবেশ করে যতক্ষন সন্ন্যাস জীবন ধারণের মাধ্যমে নিজেকে পাপমুক্ত না করতে পেরেছে ততক্ষন মুক্তি নেই। একদিকে ক্ষুধা, কাম সহ সকল প্যারামিটার স্থাপিত আবার অন্যদিকে সন্ন্যাস ধারণের মাধ্যমে নিস্তেজ করার আদেশ যা স্পষ্টতই ব্রহ্মার পরিকল্পনার অসমাঞ্জস্যতা ও চিন্তার অপরিপূর্ণতা। ইহা পুরোহিতদের বানোয়াট গল্প যা পরম ইশ্বর ব্রহ্ম-র নামে সংযোজন করা হয়েছে। এই সকল পণ্ডিতরা চারিত্রিক বিশুদ্ধতার অনুশীলন করলে নিজেদের মতবাদের অসারতা বুঝতে সক্ষম হত। আর বৈদিক দর্শন, বৌদ্ধ অনুসারীদের সাথে অন্য সকল মতবাদের সীমানা এই আধ্যাত্মিকতার স্তরেই সমাপ্তি। বৈদিক বা বেদান্তবাদী দর্শনের সত্যতার কোন ভিত্তি নেই।

দুনিয়ার জীবন একটি পরীক্ষা। অন্তরের ইন্দ্রিয়গুলো ব্যবহার করে কে কিভাবে পরীক্ষা দিচ্ছে তাই দুনিয়ার পরীক্ষা। এই পরীক্ষায় কে সফলকাম আর কে নয়? দুনিয়া ও সংসার ধর্ম ছেড়ে সন্ন্যাস জীবন ধারণের মাধ্যমে পরীক্ষা থেকে পলায়ণ কাপুরুষতা আর সংসারবিরাগী মতবাদ একটি ভ্রান্ত ও বড় ধরণের প্রতারণা।

সৃষ্টিকর্তা, নবী(সা)-কে জগৎ-সংসার ছেড়ে বৈরাগী/সন্ন্যাসী হয়ে ধ্যানে লিপ্ত হতে আদেশ করেননি। নিজের শরীরের হক্ব আছে, পিতামাতার হক্ব আছে, স্ত্রী-সন্তান, ভাই-বোনদের প্রতি দায়িত্ব ও কর্তব্য আছে, প্রতিবেশী ও আত্মীয়তার হক্ব আছে, সমাজ-দেশ-জাতির প্রতি দায়িত্ব ও কর্তব্য আছে। সকল দায়িত্ব, কর্তব্য, হক্ব ত্যাগ করে, নির্লজ্বতার মত অন্যের দানের উপর নির্ভর করে জীবন অতিবাহিত করার মাধ্যমে কাপুরুষ হওয়ার চেয়ে আত্মহত্যার মাধ্যমে নিজেকে শেষ করে দেওয়া ভাল। দায়িত্ব, কর্তব্য, হক্ব পালন করতে চাইলে অর্থের প্রয়োজন। শারীরিক ও মস্তিষ্কের পরিশ্রম ব্যতীত অর্থ অর্জিত হয়না। আর একাগ্রতার সহিত শারীরিক ইবাদতের সাথে জগত সংসার চালিয়ে কিভাবে জীবন নির্বাহ করতে হয় তার নমুনা মানব জাতিকে কর্ম পদ্ধতি দেখিয়ে দেওয়ার আদেশ করেছেন। “রুহ” বা “আমি” সম্পর্কে চিন্তা করতে বা জানতে যে জ্ঞানের প্রয়োজন তা অল্পই মানব জাতিকে দেওয়া হয়েছে- সেই বার্তা নবী(সা)-র মাধ্যমে কোরআনে অবহিত করা হয়েছে এবং এই বিষয়ে চিন্তা করে বাড়াবাড়ি করতে নিষেধ করা হয়েছে। সৃষ্টিকর্তা কাউকে কিছু অদৃশ্যের জগত উন্মোচিত বা পরমাত্মার জগত দেখিয়ে দিলে তা একান্তই ব্যক্তিগত এবং ইহা প্রকাশ করা উচিত নহে আর ইহা প্রকাশ করার বিষয়ও নয় কারন কেহ পরমাত্মা, আধ্যাত্মিকতা বুঝবে না। আইনস্টাইন বা নিউটন টাইপের মনিষীরা পরমাত্মা, আধ্যাত্মিকতা বুঝার ক্ষমতা রাখে না। মানুষ সৃষ্টি এবং দুনিয়াতে আগমণের উদ্দেশ্যের বার্তা দিয়ে নবী(সা)-কে জানিয়েছেন মানব জাতিকে সতর্ক করার জন্য। মানব জাতিকে অন্তরের সাথে প্যারামিটার স্থাপন করে দুনিয়ায় পাঠিয়েছেন, কার কর্ম কেমন এবং কে কর্মে শ্রেষ্ঠ? প্রত্যেকে নিজ কর্ম নিয়ে সৃষ্টিকর্তার সম্মুখে দণ্ডায়মান হবে।

রাস্ট্রের ক্ষমতায় প্রধান থেকেও বিনয়ের চর্চা, ধৈর্যের চরমতা, বাস্তবতার ঘটনাগুলোর সমতা ও সুসম বণ্টন, বিবিদের মধ্যে সমতা(দুনিয়ার সকল পুরুষ অধিক সংখ্যক বিবিদের মধ্যে সমতার দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ), আচরণের মাধুর্যতা, দূরদর্শিতা ও দায়িত্ববোধ, মহানুভবতার ইত্যাদির সহিত রাষ্ট্র পরিচালনা, ধর্ম পরিচালনা ও প্রতিষ্ঠা এবং ধর্মীয় মর্মবানীর ব্যাখ্যা করে বুঝিয়ে দেওয়া, পাঁচ ওয়াক্ত নামায প্রতিষ্ঠা, রাতের শেষ এক-তৃতীয়াংশ সময়ে ইবাদতে মশগুল থাকা, যুদ্ধ পরিচালনা, সমাজ পরিচালনা, ধর্ম প্রচার, পবিত্রতা, জীবন ধারণের সিস্টেম বাথরুম-টয়লেট থেকে ঘুমানো পর্যন্ত উত্তম কর্মের মাধ্যমে দৃষ্টান্ত ইত্যাদির সহিত সবচেয়ে বড় ও কঠিন দায়িত্ব মানুষদের ভিতর থেকে চরিত্র সংশোধন অর্থাৎ মানব জাতির ভিতর থেকে বদলিয়ে দেওয়া অনুশীলনের মাধ্যমে বিশ্ববাসীর সামনে রেখে গেছেন। যা উপদেশ দেন তা আগে নিজে কর্মের মাধ্যমে প্রমান করে গেছেন। এই সকল দায়িত্ব ও কর্ম অন্য ধর্মের প্রবর্তকগণ, বৌদ্ধ পণ্ডিত ও বৈদিক ঋষি ও পুরোহিতদের উপর ন্যস্ত করা হলে, তাদের কি দশা হত- তা বুঝা ও কল্পনার তুলিতে চাক্ষুস দেখতে পাওয়া জ্ঞানী ও প্রজ্ঞাবানদের গুণ ও পরিচয়।

সমালোচনা নয়, সত্যকে স্পষ্ট করাই উদ্দেশ্য। ঋষি, ভগবান, দেব-দেবী, গুরু এবং মানুষ বেশে ইশ্বরদের জীবন ও বানী যদি সত্য হয়, তবে তাদের সম্পূর্ণ জীবনের চারিত্রিক বিশুদ্ধতার গ্রহণযোগ্য প্রমান পেশ করা হোক। চারিত্রিক বিশুদ্ধতা প্রমানিত হলে বৈদিক, জৈন ও গৌতমের মতবাদ ও বিশ্বাস- ইসলামের সকল অনুসারীদের সাথে বিশ্ববাসীরাও সানন্দে গ্রহণ করবে।

বেদ, গীতা, উপনিষদ, পুরাণের ভুল ও বিভ্রান্তিময় মতবাদঃ
সত্যকে স্পষ্ট করার উদ্দেশ্যে বেদ, গীতা, পুরাণ, উপনিষদ কেন সঠিক নয়- তা তুলে ধরা। কারোর অনুভূতিতে আঘাত বা কষ্ট দেওয়া লিখার উদ্দেশ্য নয়। মুষ্টিমেয় অল্প কিছু পুরোহিত ব্রাহ্মণ পণ্ডিত ধর্মের কাণ্ডারি সেজে পরমাত্মার ফাঁদে হাজার বছরের বেশি সময় ধরে কোটি কোটি বৈদিক অনুসারীদের বিভ্রান্তির ভিতরে নিমজ্জিত করে বিপথগামী করেছে এবং করছে। সেই ভুল ও নিষ্ফলগুলো তুলে ধরা এই অধ্যায়ের উদ্দেশ্য যেন যে কেহ সত্যমিথ্যার পার্থক্য এবং হৃদয়াঙ্গমের সহিত বাস্তবতা বুঝতে সক্ষম হয়। গীতার পরমাত্মা বিষয়টিকে স্পষ্ট করব।

ধর্মের নামে বড় প্রতারণাটি হচ্ছে “গোপন জ্ঞান”। সাধনা ও ধ্যান করে সন্ন্যাসী, ঋষি, বাবা, পীরেরা তাদের বচনভঙ্গি, উপস্থিত উদ্দৃতির মাধ্যমে সাধারণদের আকর্ষনের ফাঁদে মিথ্যাকে সত্যের পোশাক পরিয়ে সেই গোপন জ্ঞানের বহু শাখাপ্রশাখা তৈরি করে আরো মহাপ্রতারণার আশ্রয় নিয়েছে। সেই মহাপ্রতারণার সংখ্যা অগনিত। আর সকল গোপন জ্ঞানের মধ্যে আসলটি হলো “পরম আত্মা”। হাজারের অধিক সাধনায় লিপ্ত হলে পরমাত্মার সাক্ষাৎ পাবে এমন একজন পাওয়া দুরূহ। কঠোর আত্মনিয়োগের মাধ্যমে ধ্যানে নিয়োজিত হওয়ার অনুশীলন করলে পরমাত্মার সাক্ষাৎ পাওয়া সম্ভব।

“আধ্যাত্মিকতা”-র স্তরের বৈশিষ্ট্যর ব্যাপারে হাদিস, বেদ, গীতা, বাইবেল, উপনিষদ, পুরাণ, শ্রুতি, স্মৃতি, মনুসংহিতা, ত্রিপিটক ইত্যাদি গ্রন্থগুলো এবং পীর, গুরু, পণ্ডিত, ঋষি, সন্ন্যাসী দুনিয়ার কেহ কিছু বলেনি। আর এই লিখার “আধ্যাত্মিকতা(PART-B)”-র অংশে পরমাত্মা ও তার জগতের বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করা হয়েছে যেন সকলে পরমাত্মার রহস্য বুঝতে পারে। পরমাত্মায় জগতে পরমাত্মা দেখতে কেমন এবং এর সাক্ষাতে কি অনুভূত হয় তা প্রকাশ করা হয়েছে যেন সকলে বুঝতে পারে পরমাত্মা নিয়ে অতীত ও বর্তমান সকল ঋষি, সন্ন্যাস, পীরদের মিথ্যাচার ও বাড়াবাড়ি।

পরমাত্মাকে নিজেদের মতবাদের মাধ্যমে কৃষ্ণ, ব্রহ্ম, ব্রহ্মা, শিব, বিষ্ণু, দূর্গা, গনেশ, রাম যার যার পথের সাথে মিলে তারা তাদের সেই পোশাকের ভিতর ভরে ভগবান/ইশ্বরের মতবাদ তৈরি করে গেছে। এভাবেই পুরোহিত ব্রাহ্মণরা হাজার হাজার বছর ধরে কোটি কোটি অনুসারীদের মিথ্যা দিয়ে বিশ্বাস ও আকিদার জন্ম দিয়ে শির্কের বোতলের ভিতর ঢুকিয়ে প্রতারণা করে আসছে। বৈদিক ধর্ম পুরোটাই ব্রাহ্মণদের হাতে; তারা যা বলবে তাই বিশ্বাস করতে হবে। পরমাত্মার সান্নিধ্যে পরম শান্তি অনুভূত হয় বিধায় ইহাকে সর্বশেষ ও চূড়ান্ত বলে দাবী। পরমাত্মার সহিত মিলিত হওয়াই বৈদিক ধর্মের সর্বশেষ ও চূড়ান্ত লক্ষ্য। গীতা কৃষ্ণের বানী আর কৃষ্ণ স্বয়ং পরম ইশ্বর- যা গীতাতেই লিখা। আর গীতার সত্যতার সনদ দিয়েছে ব্রাহ্মণ পুরোহিতরা। আর এই বিশ্বাসের ফলে গীতা অনুসারীদের কাছে নিজ পিতামাতার চেয়েও বেশি সন্মানজনক ও গুরুত্বপূর্ণ। তাদের এই দাবীর সাথে সত্যের কি সম্পর্ক? এই দাবী কেন সত্য?- এই প্রশ্ন নিজেরা নিজেদের জিজ্ঞেসিত করে না। অন্তরে অন্ধ বিশ্বাসের শিকড় এতই গভীরে প্রবেশ করেছে যে, সত্য উপস্থাপন করলেও বিশ্বাসের নড়চড় হয় না। পৈতৃক ধর্মীয় বিশ্বাস অত্যন্ত ধারালো ও মজবুত। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, অনুসারীরা নিজ ধর্ম সম্পর্কে অধ্যয়ণ করে না, চিন্তা করে না আর অনুসারীদের কেহ-ই নিজ ধর্ম সম্পর্কে “সন্দেহমুক্ত” নয়। এত এত ভগবান, মতবাদ, ধর্মীয় গ্রন্থ, ইশ্বর, দেবদেবী, দুষ্টের বিনাশকারী থাকলে সন্দেহমুক্ত হওয়া যায় না। ইশ্বরকে পলিমারফিজম বোতলের ভিতরে ভরে যত সংখ্যক ইশ্বর, ভগবান বানিয়ে যা খুশী তাই দাবী করছে।

পরমাত্মা পেটের ক্ষুধা নিবারণ করতে পারে না, পারে না জৈবিক চাহিদা মিটাতে, সন্তানকে শিষ্টাচার শিক্ষা দিতে, স্ত্রীর সাথে উত্তম আচরণের ধৈর্য ধারন করাতে, অন্তরের শক্তিশালী বিষময় প্যরামিটার বিরক্তিকে পরাস্ত করতে, রাগকে নিয়ন্ত্রণ করতে, আচরণে মাধুর্যতা তৈরি করাতে…… কিছুই পারে না, কিছুই করার ক্ষমতা নাই। পরমাত্মা সে তার নিজ জগতের ভিতর থাকুক, ইহাকে টেনে এনে মানবজাতিকে বিভ্রান্তির ভিতর প্রবেশ করিয়ে ধর্ম তৈরি করা যায় না এবং উচিতও না। যারা করে এরা মহা-উন্মাদ ছাড়া কিছুই নয়। উন্মাদনার কারন, পরম শান্তি অনুভূতির কারনে স্থির থাকতে চায় না। কেহ পরমাত্মার সাক্ষাৎ পেলে সেটা নিজের ভিতর অটুট থাকুক। নিজের শান্তি, অনুভূতি ঢোল পিটিয়ে অন্যকে জানিয়ে মতবাদ প্রতিষ্ঠা করতে যাওয়াটা, অবশ্যই বিপথগামীতা এবং এই বিপথগামীতা সকলের বুঝা উচিত। পরমাত্মাকে ভিন্ন কাল্পনিক মনিষীর নামে পোশাক পরিয়ে এবং এর কেচ্ছা তৈরি করে বেদ, গীতা, উপনিষদ, পুরাণ সহ সকল বৈদিক পুস্তক ভর্তি করা হয়েছে। সন্ন্যাসী, ঋষি, ব্রাহ্মণগণ কেন বাস্তবতা পরিত্যাগ করে, দুনিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পরমাত্মার গান গেঁয়ে জীবন কাটিয়েছেন এবং ইহাকেই ইহকাল ও পরকালের লক্ষ্য বলে মতবাদ প্রতিষ্ঠা করেছেন, সেই “কেন”-র উত্তর একটু পর জানব।

অন্তর লাগিয়ে শোন এবং বুঝ। পরমাত্মা সৃষ্টিকর্তা নয়, পরম ইশ্বর নয়, খোদা নয়, ব্রহ্ম বা ব্রহ্মা-বিষ্ণু-শিব কেহ নয়, জিসাস নয়, কৃষ্ণ নয়, নবী মোহাম্মদ নয়, ইব্রাহীম বা মুসা নয়। পরমাত্মা হচ্ছে “আমি” যা সৃষ্টিকর্তার আদেশ। পরমাত্মার জগত থেকে আরো উর্ধ্ব রয়েছে যেখানে আছেন স্বয়ং সৃষ্টিকর্তা ও সৃষ্টিকর্তার আরো অগণিত সৃষ্টি। আধ্যাত্মিক জগতের পরমাত্মার সীমানা পর্যন্ত মানব জাতির ধ্যান, চিন্তার চৌহদ্দির সমাপ্তি।

পরমাত্মা হচ্ছে “আমি” যা থেকে জী-সত্তা বা জীবাত্মা তৈরি; যেই জী-সত্তা দুনিয়ার আমি ও আমার জীবন তৈরি ও পরিচালিত করছে অর্থাৎ দুনিয়াতে “আমি”-র বেঁচে থাকার পুরো সিস্টেম। কেহ ধ্যানের মাধ্যমে পরমাত্মার সান্নিধ্যে গেলে, উপরের কথা(আধ্যাত্মিক স্তরের বৈশিষ্ট্য যা PART-B তে উল্লেখিত)-গুলোর সত্যতা দেখতে পাবে।

বেদ সংস্কৃত ভাষায় সংস্কৃত কবিদের প্রার্থনার কবিতামালা। অনেক আর্য পণ্ডিত মিলে বেদ রচনা করেন। ফলে আর্যদের কিংবদন্তি নায়ক-নায়িকারা বেদে দেব-দেবীদের মর্যাদা পায়। ইন্দ্র, অগ্নি, সোম, বরুণ, আদিত্য, ঊষা… এদের উদ্দেশ্যে ধন অর্জন, জীবন সংগ্রামে সাফল্য, যুদ্ধে সাফল্য, আরোগ্য লাভ, ভয়কে জয়, সোমরস পান ইত্যাদি প্রার্থনার কবিতামালা। একদিকে সন্ন্যাস জীবন ধারণ করে দুনিয়ার জীবন থেকে নির্মোহ থাকা অন্যদিকে তাদের ধর্মীয় প্রধানগ্রন্থ ঋগবেদ “কামনা”-র প্রার্থনা দ্বারা পূর্ণ। ব্রাহ্মণদের জন্য এক, ক্ষত্রিয়দের জন্য আরেক, শূদ্র-বৈশ্যদের জন্য আরেক। বেদ সাহিত্য অপৌরুষেত্বের যে দাবী, তা চিন্তার অসুস্থতা ছাড়া আর কিছু নয়। কল্পিত প্রধান দেবতা ইন্দ্রকে উদ্দেশ্য করে প্রার্থনা। পরম ইশ্বর ব্রহ্ম ও শিবের উল্লেখ নেই ঋগবেদে। ইন্দ্রকে প্রতিষ্ঠিত করতে গিয়ে বিষ্ণুর দুই-এক জায়গায় উল্লেখ আছে শুধু ইন্দ্রকে মহৎ করবার উদ্দেশ্যে কিন্তু বিষ্ণূর কোন অবদান বা তাকে উদ্দেশ্য করে প্রার্থনা বা শ্লোক নেই। বিবেকবান মাত্রই বুঝতে সক্ষম বেদের অসারতা। গুরুরা মনের কল্পনায় যা বানিয়েছে তাই শিষ্যের কাছে বেদের বানী দাবী করে রেখে গেছে। একেক গুরু একেক ভাবে বেদে নিজের কল্পিত প্রার্থনা যোগ করেছেন। সত্যের সহিত বেদের প্রার্থনার কবিতামালার কোন সম্পর্ক নেই।

“শিব” ছিল প্রাচীন ভারতীয়দের পরম দেবতা এবং আসল। আর্যরা ভারতে এসে নিজেদের একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করলে প্রাচীন ভারতীয় দ্রাবিড়দের অল্প কিছুকে ব্রাহ্মণ হিসেবে স্বীকৃতি দেয় এবং তাদের শিবকে গ্রহণ করে নিজেদের দেবদেবী, ইশ্বরের সহিত মিল রাখার প্রয়াস। দ্রাবিড়রা সাড়ে তিন হাজার বছর পরেও আজও আর্যদের মেনে নেয়নি। দক্ষিন ভারত ভ্রমণ করলে তা স্পষ্ট হয়ে উঠে। ইশ্বরকে বহু রূপে রূপায়িত করার এক সংমিশ্রণ। যার ফলে, এই ধর্মে একটি বিশৃঙ্খলতা লক্ষিত। বর্তমান অনুসারীরা আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত হওয়ায় উন্নত চিন্তাধারার স্ফুরণ ঘটেছে এবং উপলদ্ধি করতে পারছে এই ধর্মের অসারতা। কেহ ব্রহ্ম সমাজ প্রতিষ্ঠা করে ব্রহ্মের আরাধণা, কেহ ইস্কনের মাধ্যমে কৃষ্ণ, দ্রাবিড় জাতি শিব, বৈষ্ণবরা বিষ্ণুর আরাধনা করছে।

বেদ, উপনিষদ অদৈতবাদ মতবাদের সহিত আত্মজ্ঞানের উপর জোর দিয়েছে। এই সকল পুস্তকের ভাষ্য, আত্মজ্ঞানী হতে চাইলে “ত্যাগ” করার বিকল্প নেই। জীবনের সর্বক্ষেত্রে ত্যাগ করতে হবে। ইহা বড় একটি ভুল। সংসার বিরাগীদের ত্যাগের মূল্যায়ন কিভাবে সম্ভব? ত্যাগের মূল্য বুঝা যায় সংসার ধর্ম পালনের ভিতর থেকে। আর আত্মজ্ঞানী হতে চাইলে সর্বপ্রথম আসে “ধৈর্য”। ধৈর্য ছাড়া কেহ আত্মজ্ঞানী হতে পারে না, প্রজ্ঞাবান সম্ভব না। ধৈর্য সকল জ্ঞান ও সাফল্যের চাবিকাঠি এবং এই মহাবিশ্বের সবচেয়ে বড় শিক্ষক। একমাত্র ধৈর্য অন্তরের ভিতর প্রবেশ এবং অন্তরের স্বাদ অনুভব করার ক্ষমতা রাখে। সংসার ধর্ম ছেড়ে উপাসনালয়ে, গাছের নীচে বসে কেহ ধৈর্য ধারণ করার ক্ষেত্র তৈরি করতে পারে না। ঋষি, সন্ন্যাসীদের এখানেই বড় গলদ আর এখানেই তাদের মতবাদ অসারে পরিণত। আত্মজ্ঞানের জগৎ বিস্তৃত হয় চারিত্রিক বিশুদ্ধতার মাধ্যমে। চারিত্রিক বিশুদ্ধতার অনুশীলন যত দৃঢ় ও মজবুত হবে, আত্মজ্ঞানের ততই ব্যাপ্তি। সংসার ধর্ম ত্যাগ করে ধ্যান করে আত্মজ্ঞানী হতে চাইলে পথভ্রষ্টতা অক্টোপাসের ন্যায় ঝাপটে ধরে। শত শত অনুশীলনের মধ্যে শুধু নিজ বিবির উপর বিরক্ত না হওয়ার অনুশীলন করা হোক এবং সাথে নিজের শক্তিমত্তা পরীক্ষিত হোক আর আত্মজ্ঞানের জগত নিজ বিবেকের সামনে দৃশ্যমান হোক।

প্রধান কিতাব “ঋগবেদ” রচিত দেবতা ইন্দ্রকে কেন্দ্র করে আর অমল পুরাণ ও অন্যান্য পুরাণ গ্রন্থাদি সেই ইন্দ্রকে বানিয়েছে চোর, লোভী, খুনি, ধর্ষক ইত্যাদি মহারাজ, মুনি, ঋষি, গুরুদের সন্তুষ্ট করার উদ্দেশ্যে। বিভিন্ন মুনি, ঋষিদের প্রার্থনা, বর কবুল করে, বিষ্ণু যেভাবে দেবরাজ ইন্দ্রকে শায়েস্থা করেছে তাতে ঋগবেদের প্রাধান্যতা সম্পূর্ণরূপে লুপ্ত হয়। পুরাণ ঋগবেদকে বানিয়েছে হাস্যকর। পুরাণ জুড়ে বিভিন্ন মহারাজ, ঋষি, মুনিদের ঘটনা, যা বাস্তবতা বিবর্জিত কেচ্ছা কাহিনীর সমগ্র। অধুনিক ও ভবিষ্যৎ বৈদিক অনুসারীদের বৈদিক ধর্ম ত্যাগ করে ইশ্বরে অবিশ্বাসী হওয়ার জন্য এই সকল কিতাবই যথেষ্ট।

পরমাত্মার সাধনার ক্ষেত্র নিয়ে গীতা বলে অন্তরের সকল প্যারামিটার(ইন্দ্রিয়)-গুলোর দরজা বন্ধ করে দুই ভ্রূর মাঝখানে নিজের চিন্তাশক্তিকে আবদ্ধ করে ধ্যান করা। নিঃসন্দেহে অত্যন্ত শক্তিশালী তপস্যা। আর উপনিষদ বলে পরামাত্মার স্থান মূলাধারে। প্রান, অপান, ব্যান, সমান ও উদান বায়ুর সাধনা করা লাগে পরমাত্মাকে ধ্যানের সীমানার ভিতর আনতে। যজ্ঞশালা(মানবদেহ)-র ৭২০টি ইট ৩৬০ দিন ও রাত্রি অর্থাৎ সংবৎসর দিবারাত্রি কাঠে কাঠে ঘষে অগ্নি প্রজ্জলিত কিংবা আরো স্পষ্ট করলে অপান বায়ু নিম্নমুখী, সেই অপান বায়ু ও প্রান বায়ুর সংঘর্ষ করে অগ্নি প্রজ্জলিত করে ধ্যান করতে হয় পরমাত্মাকে পাওয়ার জন্য। পরমাত্মা সম্পর্কে গীতা ও উপনিষদের নিজ নিজ বক্তব্য স্ববিরুধী।

“অন্তর”-এর সাথে “দুনিয়ার আমি” বা “জী-সত্তা”-র পরিচয় প্রয়োজন পরমাত্মাকে ধ্যান করতে। অন্তরের পর্দা না সরিয়ে পরমাত্মার ধ্যান করা যায় না এবং হয় না। যাদের অন্তরে হিংসা, অহংকার, লোভ, কামনা ইত্যাদি থাকে তারা সারাজীবন ধ্যান করেও পরমাত্মার সান্নিধ্য পাবে না।

গুরু-শিষ্যের সম্পর্ককে বেশ জোর দেয়া হয়েছে। “গুরুর কাছে দীক্ষা নিবার পূর্বে নিজেকে সম্পূর্ণরূপে বিলিয়ে দেওয়া গুরু-শিষ্যের সিস্টেম। গুরু যা বলবে তা অন্ধ ভাবে মানতে হবে, অনু পরিমান আদেশের নড়চড় করা যাবে না। পরমাত্মাকে পেতে চাইলে ইন্দ্রিয়গুলোর দরজা বন্ধ করে দুই ভ্রূর মাঝে ধ্যানের মাধ্যমে গুরুকে চিন্তা করা। এভাবেই এক সময় পরমাত্মা ধরা দিবে”- গুরুদের ভ্রান্ত এই মতবাদ শিষ্যদের উদ্দেশ্যে প্রাথমিক সবক। বর্তমান বেশির ভাগ গুরুরা নারীলোভী। একেকটা গুরু অসংখ্য নারীদের উপর নিজেদের যৌনতার খায়েশ পূরণ করে।

গীতার কিছু শ্লোক বিশ্লেষনঃ

যদ যদাচরতি শ্রেষ্ঠস্তত্তদেবেতরো জনঃ।
স যৎ প্রমাণং কুরুতে লোকস্তদনুবর্ততে।।
ইস্কনের প্রতিষ্ঠাতা বলেন, “সাধারণ মানুষদের এমনই একজন নেতার প্রয়োজন হয়, যিনি নিজের আচরণের মাধ্যমে তাদের শিক্ষা দিতে পারেন”। শতভাগ সঠিক উক্তি। আচরণের শিক্ষাই একমাত্র প্রকৃত শিক্ষা এবং সঠিকতার মাপকাঠি। যিনি একটি ধর্মের কান্ডারী হয়ে আবির্ভূত হোন, তাঁকে চারিত্রিক বিশুদ্ধতার সর্বশ্রেষ্ঠতার প্রমান দিতে হয়, নয়ত গ্রহণযোগ্যতা নয়। “চারিত্রিক বিশুদ্ধতা” ব্যতীত আর কোন পন্থা নেই নিজের সাধুতা, পবিত্রতা, গ্রহনযোগ্যতা প্রমান দেওয়ার এবং প্রবর্তক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার। সত্যবাদিতা, বিনয়, ধৈর্য, সহনশীলতা, লজ্জাশীলতা, বদান্যতা, বণ্টন, ক্ষমতার মোহ না থাকা, লোভ-কামনা-হিংসার অস্তিত্ব অন্তরে না রেখে নিজেকে বিলীন করার অনুশীলনের মাধ্যমে উত্তীর্ণ হতে হয় শতভাগ। মহাপুরুষের সর্বোচ্চতা স্বভাব ও চরিত্রে ধারণ করতে হয়। বহু পত্নী গ্রহন করলে চরিত্র পরীক্ষার এক জ্বালাময়ীতার ক্ষেত্র তৈরি হয়, যে ক্ষেত্র অতি বৃহত্তর ও ব্যপক। সকল স্ত্রীদের মধ্যে “সমতা”-র পরীক্ষা যেমন কঠিন তেমন জটিল। স্ত্রীরা খুব জানে একান্ত সান্নিধ্যে সময় কাটানোর ক্ষণে পতির স্বভাব কিরূপ থাকে? পতি কিরূপ আচরণ করে? পতি নিজের গোপন ও প্রকাশ্য রিপুগুলো কিরূপে ব্যবহার করে? “চারিত্রিক বিশুদ্ধতা” জীবনের সর্বক্ষেত্রে প্রমান দেয়া লাগে। সেই বিশুদ্ধতার নথি দুনিয়ার সকলের কাছে প্রকাশ করা অত্যাবশ্যক নয়ত তার কথার মূল্যায়ন হবে না।

কৃষ্ণ, অর্জুনের উপর গীতা নাজিল করেন, তাদের উভয়ের কর্মের রেকর্ড দুনিয়ায় নাই। স্বভাব-চরিত্র কেমন ছিল- তা জানার উপায় নেই। আদৌ দুনিয়ায় আগমন করেছিলেন কিনা- তারও প্রমান নেই। বলা হয় ৫২০০ বছর আগে তাদের আগমন, এই দীর্ঘ সময়ে তাদের জীবনের রেকর্ড সম্ভব নয়। যে সব গল্প তাদের সম্পর্কে প্রচলিত, তা বানোয়াট এবং বাস্তবতা বিবর্জিত। চারিত্রিক বিশুদ্ধতার কোন প্রমান তাদের ক্ষেত্রে নেই। গীতার শ্লোক দিয়ে প্রমান? না, পরমাত্মার কেচ্ছা দিয়ে সত্য প্রতিষ্ঠিত হয় না। রুমির “মসনবী” একটি উচ্চাঙ্গের আধ্যাত্মিক গ্রন্থ। গীতার চেয়েও বহু উন্নত আধ্যাত্মিক গ্রন্থ দুনিয়ায় রয়েছে এবং যে কেহ পরমাত্মার সান্নিধ্য পেলে গীতা সদৃশ তৈরি করা কঠিন কিছু নয়। সংস্কৃত ভাষা রপ্ত করলে গীতা তৈরি সহজ। মসনবী, মিনহাজুল আবেদীন, সৌভাগ্যের পরশমনি-১, মুকাশাফাতুল কুলূব ইত্যাদি গ্রন্থগুলো চিন্তার গভীরতার সহিত লিখা হয়ছে। বহু মনিষী ক্ষমতা রাখেন আধ্যাত্মিক গ্রন্থ রচনা করার যারা পরমাত্মার সাক্ষাৎ পেয়েছেন।

যদা যদা হি ধর্মস্য গ্লানির্ভবতি ভারত।
অভ্যুত্থানমধর্মস্য তদাত্মনং সৃজামহাম।।
“হে ভারত! যখনই ধর্মের অধঃপতন হয় এবং অধর্মের অভ্যুত্থান হয়, তখন আমি নিজেকে প্রকাশ করে অবতীর্ণ হই”- বৈদিক বা সনাতন অনুসারীদের ইহা সবচেয়ে জনপ্রিয় উক্তি এবং ভক্তি ও বিশ্বাসের প্রধান কেন্দ্রস্থল। অথচ ইহা ব্রাহ্মণ্যবাদীদের সবচেয়ে বড় ধোঁকাবাজি। উক্তিটি এরকম নয়, উক্তিটির আড়ালে আছে এক অদৃশ্য উক্তি, আর তা হলোঃ যুগে যুগে যখন ব্রাহ্মণদের অধঃপতন শুরু হয় এবং সমাজের উপর নিজেদের প্রাধান্য হারায় তখন ব্রাহ্মণরা আমাকে তৈরি করে। আমি ভগবানরূপে আবির্ভূত হয়ে ব্রাহ্মণদের রক্ষা করি এবং ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্রসহ সকলের বিদ্রোহী মতবাদ বিচূর্ণ করি, সমাজে ব্রাহ্মণদের আধিপাত্য বজায় রাখি এবং সাথে অন্যান্য ধর্মগুলো বিনাশ করি।

গরুড় পুরাণ, মৎস পুরাণ, পদ্ম পুরাণ, মনুসংহিতাসহ অন্যান্য পুরাণগ্রন্থাদিতে শ্রাদ্ধের নামে ব্রাহ্মণদের শূদ্র, বৈশ্যদের উপর একচেটিয়া আধিপত্য এবং নিজেদের দুনিয়া ভক্ষণের বিস্তারিত বর্ণনা এসেছে। জন্ম, জন্ম থেকে মৃত্যু অবধি, মৃত্যুর সময়, মৃত্যুর পর বাৎসরিক অনুষ্ঠানে প্রতিটি ক্ষণে ব্রাহ্মণদের কর্তৃত্ব। পরিবারের কারোর মৃত্যু হলে কঠিন কর্তব্য পালনের ভিতর দিয়ে যেতে হয়। মাবাবা মারা গেলে যে রীতি ব্রাহ্মণরা সাজিয়েছে সকল সময়ের জন্য এই নিয়মগুলো পালন করা কারো পক্ষে সম্ভবপর নয়। ব্রাহ্মণদের দাবী, এই রীতিগুলো পালন না করলে মাবাবার আত্মা এক লক্ষ সাত হাজার কোটি বছর নরকে ঘোরাফেরা করবে। ব্রাহ্মণরা ফর্দ পরিবার বা সন্তানদের ধরিয়ে দেয় যেন লিস্টির সব দান করা হয়, নরক থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য। এই ফর্দের সাথে আছে বাধ্যতামূলক ষোল দান। এই ষোল দানের প্রতি দানে ষাট লক্ষ বছর মাবাবা স্বর্গে থাকবে। এই দান শুধু ব্রাহ্মণদের করতে হবে। যদি দান না করা হয়, তবে বৈতর্ন বা বৈতরনী নদীতে মাবাবার আত্মা শাস্তি পেতে থাকবে। এই বৈতরনী নদী গ্রীক পুরাণে স্টাইক্স নদীর সমতুল্য। ব্রাহ্মণদের পায়ে অর্পন করতে হবে স্বর্ণ, জমি, পশুসহ সকল প্রয়োজনীয় জিনিস যাতে বৈতরনী নদীর শাস্তি থেকে মাবাবা স্বর্গে চলে যেতে পারেন। জমি দান করলে সেই জমির একেকটি ধূলোর জন্য এক লক্ষ বছর স্বর্গ থাকবে। শূদ্র, বৈশ্যরা যাতে দ্বিধাগ্রস্ত না হয় তাই কৃষ্ণ-র মাধ্যমে বলেছে ব্রাহ্মণদের দান করলে নিশ্চিত স্বর্গ লাভ, যদি শূদ্ররা ব্রাহ্মণদের সেবা না করে তবে যমদূত তাদের দমন করে, শূদ্ররা কখনই স্বর্গ লাভ করবে না। পুত্র সন্তান না হলে স্বর্গ লাভ করবে না, কন্যা সন্তান বা নিঃসন্তান বা সংসার বিরাগীরা স্বর্গ লাভ করবে না। পুত্র দুশ্চরিত্র লম্পট হলেও স্বর্গ লাভ করবে। আবার অন্যদিকে গীতা, পুরাণের সাথে উক্ত কথাগুলো সাংঘর্ষিক। গীতা বলে মৃত্যুর সময় কৃষ্ণের নাম নিলে বা কৃষ্ণকে স্মরণ করলে কিংবা গীতা গ্রন্থ মৃত ব্যক্তির বুকে বা পাশে রাখলে স্বর্গ। পুরাণ বলছে, ৮৪ লক্ষ যোনী ভ্রমণের কথা এবং আরো বলছে এক মূহূর্তের লক্ষ ভাগের এক ভাগ সময়ের মধ্যে আত্মা আরেক দেহে স্থানান্তরিত হয়। বেদান্তবাদীদের ধর্মগ্রন্থগুলোতে বৈপরীত্য অগণিত এবং এর শেষ নেই। বৈদিক সকল অনুসারীদের ব্রাহ্মণরা নিজেদের চাওয়া-পাওয়ার কাছে বন্ধী করে রেখেছে খ্রীস্টপূর্ব ১৫০০ থেকে আজ অবধি।

কৃষ্ণ নামে যে রাজার নাম পাওয়া যায় সে ছিল একজন অসুর এবং দ্রাবিড় শ্রেনীর। আর্যরা পশুচারণ ভুমির জন্য ভারতে প্রবেশ করে। ঋগবেদ অনুসারে, অনার্য রাজা কৃষ্ণের সাথে আর্য রাজা ইন্দ্রের যুদ্ধ হয়। সেই যুদ্ধে কৃষ্ণের বাহিনী পরাজিত হলেও কৃষ্ণ এবং অনুসারীরা কখনই বহিরাগত আর্যদের মেনে নেয়নি। কৃষ্ণকে দ্রাবিড় জাতি খুব সমাদর করত, পুজো করত। আর্যরা যুদ্ধের মাধ্যমে পরাস্ত করে আধিপাত্য নিলেও দ্রাবিড়দের মন থেকে কৃষ্ণকে মুছে ফেলতে পারেনি। ফলে আর্যরা কৃষ্ণকে তাদের অনুকূলে আনতে বাধ্য হয়। ছান্দোগ্য উপনিষদের মাধ্যমে সন্ন্যাসী, ব্রাহ্মণরা কৃষ্ণকে তাদের দলে যুক্ত করেন। ঋষি আঙ্গিরাস বা অঙ্গিরসের শিষ্য হিসেবে কৃষ্ণকে উপস্থাপন করে। ব্যাসদেব সে তার কল্পনার মাধুরী মিশিয়ে কৃষ্ণকে চিত্রিত করে। আর্যরা কিছুটা সাফল্যিত হয়, নিজেদের ধর্মীয় সংস্কৃতির ভিতরে অনার্যদের সংস্কৃতির অনেকটা বিলুপ্তি এবং মতামত চাপিয়ে; যদিও পুরোপুরি করে উঠতে পারেনি।

রাম বালীকে হত্যা করে সুগ্রীবের চক্রান্তে। সীতাকে উদ্ধার করার কাজে সুগ্রীব সাহায্য করবে এই বলে। গোপনে জায়গা থেকে রাম তীর নিক্ষেপ করে বালীকে হত্যা করে, বালীর রাজ্য সুগ্রীবকে দান করে, বালীর স্ত্রী তারার আবদার উপেক্ষা করে জোর করে সুগ্রীবের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ করায়। রাম এই কাজের জন্য “কাপুরুষ”-র উপাধি ও কলঙ্ক নিয়ে বয়ে চলছে। বাল্মীকি রামায়ণে বিবেক বর্জিত গল্পের সংখ্যা প্রচুর।

কৃষ্ণ ও বলরাম যাচ্ছে কংসের এক রাজসভায় যোগ দিতে। রাস্তায় কুবজার সঙ্গে দেখা হলো। কুবজা দেখতে সুন্দরী হলেও শরীর ছিল কুঁজো। পিঠে তার অনেক বড় কুঁজ ছিল। কৃষ্ণ তার শরীরে হাত দেওয়া মাত্রই কুঁজ মুছে গেল এবং কুবজা সর্বাঙ্গে ভাল হয়ে গেল। কুবজা ভাল হবার পর কৃষ্ণকে সেবা করার অনুরোধ করেন। কৃষ্ণ কুবজার ঘরে গিয়ে যৌন মিলন করার পর কুবজাকে বলে, “এতদিন আমি যত মেয়ের সাথে সহবাস করেছি, তোমার সাথে মিলন করে যে তৃপ্তি পেয়েছি এমন তৃপ্তি আর কোথাও পাইনি”। আবার গীতায় কৃষ্ণ অর্জুনকে বলছে, “হে অর্জুন! দুনিয়ার কোন কিছুতেই আমি তৃপ্ত হই না”। গ্রন্থগুলোতে পরস্পর স্ববিরুধী। বেদ, গীতা, উপনিষদ, পুরাণ স্ববিরুধীর সংখ্যা অনেক।

ব্রাহ্মণরা নিজেদের ক্ষমতা ও অর্থের আধিপত্য ও কতৃত্ব ধরে রাখতে সব ধরণের ছলের আশ্রয় নেয় আর এই ছলের সংখ্যা অগনিত। হাজার হাজার বছর ধরে তারা প্রতারণা করে আসছে সহজ, সরল মানুষদের সাথে। ব্রাহ্মণরা অল্প সংখ্যক হয়েও নিজেরা নিয়েছিল জ্ঞান আর ওদের দিয়েছিল মন্দির। ব্রাহ্মণরা ছিল শাসক ও শোষক আর শুদ্র, বৈশ্যরা ছিল শাসিত ও শোষিত। জ্ঞান জগতের সঠিকতা, ভালমন্দ উন্মোচিত করে, প্রশ্ন করতে শিখায়, চিন্তার ক্ষেত্র তৈরি করে আর তা ব্রহ্মণরা ভাল করে জানত। তাই ব্রাহ্মণরা শূদ্র, বৈশ্যদের জ্ঞান আহরণ করতে বারণ করেছে। জ্ঞান আহরণ করলে নিজেদের অন্তরে পোষে রাখা অন্যদের ডমিনেট করার চক্রান্ত প্রকাশ পেয়ে যাবে, নিজেদের প্রতারণা উন্মোচিত হবে। তাই তাদের কমন উক্তি ছিল, “জ্ঞান ভগবান ভালবাসে না”। প্রচার করে, “ভক্তি হচ্ছে প্রেম সাম্রাজ্য, ভগবান ভক্তি ভালবাসেন”। ভক্তদের “অন্ধ ভক্তি”-র কারাগারের ভিতর ঢুকিয়ে দিতে পুরোপুরি সামর্থ্য হয়েছিল এবং হচ্ছে। পরমাত্মার কেচ্ছার মাধ্যমে কৃষ্ণের চরিত্রটি তৈরি করেছে সমাজ ও জাতিতে নিজেদের প্রাধান্য ধরে রাখতে। কৃষ্ণকে ব্রাহ্মণরা তৈরি করেছিল দুনিয়া ভোগের সবচেয়ে শক্তিশালী হাতিয়ার হিসেবে।

যো যো যাং যাং তনুং ভক্তঃ শ্রদ্ধয়ার্চিতুমিচ্ছতি।
তস্য তস্যাচলাং শ্রদ্ধাং তামেব বিদধাম্যহম।।
এই শ্লোকে কৃষ্ণ নিজেই নিজেকে পরমাত্মার দাবী করছে। নবী(সা) হেরা গুহায় প্রথম জীব্রাঈল(আ)-র সাথে অল্প সময়ের সাক্ষাত পেয়ে ভয়ে দৌড়ে বাড়ি এসে নিজ বিবি খাদিজা(রা)-কে বলতে লাগলেন “আমাকে আবৃত কর, আমাকে আবৃত কর”। ভয়ে তিনি ছিলেন অস্থির, শ্বাসপ্রশ্বাস ছিল দ্রুত, শরীরে কাঁপুনি। নবী(সা) তখনও জানতেন না, তাঁর কী হয়েছে; জানতেন না, হেরা গুহায় যিনি সাক্ষাৎ করেছে তাঁর পরিচয়-বা কী? তারপর বিবিকে হেরা গুহায় ঘটে যাওয়া সমস্ত ঘটনা খুলে বললেন। বিবি সব শুনার পর, তাঁকে অভয় দিতে লাগলেন। “আপনি ক্ষুধার্তকে খাবার খাওয়ান, অভাবীদের অভাব দূর করেন, পথহারাকে পথ দেখান……” নিশ্চয়ই সৃষ্টিকর্তা আপনার অমঙ্গল কিছু করবেন না বলে সান্ত্বনা দিলেন। খাদিজা(রা) হলেন ইসলামের প্রথম মুসলিম। নবী(সা) কি নিজ বিবি খাদিজা(রা)-কে বলেছেন “আমি আল্লাহ্‌র রাসূল, আমার উপর ঈমান আন?” নাকি বিবি খাদিজা(রা) নিজ থেকে নবী(সা)-র ঈমান এনেছিলেন? হ্যা, বিবি খাদিজা(রা) নিজ থেকে ঈমান এনেছিলেন। তুমি নিজে নিজের উপর পরীক্ষা কর। এমন ঘটনা তুমি তোমার নিজের বিবির সাথে কর এবং দেখ তোমার বিবি তোমার সাথে কি আচরণ করে?

জীব্রাঈল(আ)-র সাথে হেরা গুহায় প্রথম সাক্ষাতের পর দ্বিতীয় সাক্ষাৎ হয় ছয় মাস পর। নবী(সা) এই ছয় মাস অত্যন্ত অস্থির ছিলেন কারন হেরা গুহায় ঘটে যাওয়ার ঘটনার তাৎপর্য বুঝতে পারছিলেন না। জীব্রাঈলের সহিত দ্বিতীয় সাক্ষাতে নবী(সা) বুঝলেন উনার উপর দায়িত্ব এসেছে। তাঁকে দায়িত্ব পালন করতে আদেশ করা হয়েছে। নবী(সা) যে রাসূল তা নবী(সা) নিজে বুঝার আগে বিবি খাদিজা(রা) বুঝেছিলেন। স্ত্রী ব্যতীত দুনিয়ায় আর কেহ নাই কোন পুরুষের চারিত্রিক স্বভাব বেশি জানে। খাদিজা(রা) নবী(সা)-কে সবচেয়ে বেশি জানতেন। আর খাদিজা(রা) নিজে নবী(সা)-কে রাসুল হিসেবে স্বীকৃতি না দিলে দুনিয়ার কেহ তাঁকে রাসুল হিসেবে স্বীকৃতি দিত না। নিজ বিবিই যদি স্বভাব-চরিত্র নিয়ে সন্দেহ করে তাহলে দুনিয়ার কোন মানুষ সন্দেহমুক্ত থাকবে? অল্প কিছু অনুসারী হয়েছিল যারা সত্যতা হৃদয়াঙ্গম করতে পেরেছিল মক্কা জীবনের তের বছরে। অগণিত অন্তরজ্বালা কষ্ট এই অল্প অনুসারীদের ভোগ করতে হয়েছে। তারপর মদীনায় হিজরত করতে বাধ্য হোন। মদীনায় যাওয়ার পর মক্কার লোকেরা তিন বার যুদ্ধ করেছে এই অল্প অনুসারীদের সম্পূর্ণরূপে নিশ্চিহ্ন করে দিতে কিন্তু তা না পেরে পরবর্তীতে সন্ধি করতে বাধ্য হয়। সন্ধি হলেও অন্তরে লালিত রাগ-বিদ্বেষ শেষ হয়ে যায়নি বরং আরো বেড়েছিল।

এই বিদ্বেষ পোষনকারী শত্রুরাই পরে মুসলিম হয়ে জান-মাল-পরিবার কোরবানী করে ইসলামের প্রচার ও প্রসার ঘটিয়েছে দুনিয়াব্যাপী। এদের কারোর অন্তরে নবী(সা)-র চারিত্রিক বিশুদ্ধতার অনু পরিমান সন্দেহ থাকলে, কেহ নিজের ভুল শুধরিয়ে ইসলাম গ্রহণ করতো না। নবী(সা) নিজ জীবন তাদের সম্মুখেই অতিবাহিত করেছে। তারা জানে নবী(সা)-র আখলাক/চরিত্র কেমন ছিল। অনু পরিমান মিথ্যা, ছলনা, হিংসা থাকলে তাঁকে রাসুল হিসেবে মেনে নিত না। সকলের দৃষ্টির সামনে নবী(সা) জীবন অতিবাহিত করেছে।

একই রকম কৃষ্ণের সারা জীবনের কর্মের রেকর্ডের সহিত চারিত্রিক বিশুদ্ধতার অধিকারী না হলে তার গ্রহণযোগ্যতা থাকে না। কৃষ্ণ গীতার ভিতর যতই নিজেকে চরিত্রিক সনদ ও ক্ষমতা নিয়ে দাবী করুক- তার গ্রহনযোগ্যতা নেই। কৃষ্ণ জীবনে একটা মিথ্যা বলেনি, প্রতারণা করেনি, ক্ষমা ও ধৈর্যের সহিত উত্তম বদৈন্যতা, মাধুর্যতার পরিপূর্ণ ছিল- ইহা শতভাগ প্রমান করা আবশ্যিক। কৃষ্ণ নীজেকে কিংবা গীতা যতই কৃষ্ণকে ইশ্বর বা প্রবর্তক রূপে ঘোষনা করুক, কোন ফায়দা নেই। ফলাফল শূন্য। ব্রাহ্মণ পুরোহিত ও পণ্ডিতরা প্রতারণার মাধ্যমে এই শূন্যের ভিতর ধরে রেখেছে বৈদিক অনুসারীদের। কৃষ্ণের কর্মের রেকর্ডের পরিবর্তে দেখা যায় বিভিন্ন অসুরদের বধ করার কাহিনী, বর দেওয়া বা পুরস্কৃত করা, শায়েস্তা করা, অন্যায়ভাবে ভীমের দ্বারা দূর্যোধনকে হত্যা, অশ্বত্থামার মিথ্যার আশ্রয়ে দ্রোণাচার্যকে হত্যা এবং এরকম বিভিন্ন রকমের গল্প, উপদেশ কিতাবগুলোতে রয়েছে যা সত্যের সহিত সম্পূর্ণ সম্পর্কহীন।

উপনিষদে উল্লেখ আছে, ঋষি আঙ্গিরসের উপদেশে কৃষ্ণ নিস্পৃহ হোন। একজন পরম ইশ্বর কেন একজন মনিষীর কথা শুনে নিস্পৃহ হবেন? গীতার ভিতর কৃষ্ণের ভাষ্য, পরমাত্মা রূপে দুনিয়ার সকলের ভিতর সে বিরাজ করে। পরমাত্মার ফাঁদে নিজের উপস্থিতির সনদ নিজেই প্রচার করছে। প্রকৃত হচ্ছে, ইহা কৃষ্ণের প্রচার নয়, কৃষ্ণের নামে ব্রাহ্মণদের প্রচার। ইহাই গোপন জ্ঞানের ফাঁদ এবং মহা-প্রতারণা। ব্রাহ্মণ্যবাদীরা নিজেদের মনগড়া ও খেয়ালখুশী ইচ্ছার মাধুরী মিশিয়ে যা খুশী তা তৈরি করে গেছেন।

কৃষ্ণের আবির্ভাব হরপ্পা সভ্যতার পূর্বে মেহেরগড় সভ্যতার শেষ দিকে অথচ কোন আভাস বা চিহ্ন পর্যন্ত নেই। এপ্লাই কমন সেন্স। রামের আবির্ভাব ৭৪০০ বছর পূর্বে হলে ক্রেতা যুগ ও দাপর যুগের পার্থক্য থাকে না। ভারতবর্ষে লৌহের ব্যবহার কিংবা বিভিন্ন সময়ে ভারতবর্ষের জনসংখ্যার পরিমানের দিকে লক্ষ্য করলে বৈদিক ধর্মের অসরতা ও বানোয়াট “বিবেক”-এর জালে স্পষ্ট হয়। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের সময়(৫১০০ বছর পূর্বে) পুরো ভারতবর্ষের জনসংখ্যা ২৫ লক্ষ বা তার কম-বেশি। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে যে পরিমান পুরুষ নিহত হয় বলে দাবী করা হয়, এত সংখ্যক নারীপুরুষ মিলেও পুরু ভারতবর্ষে ছিল না। মহাভারত ও রামায়নের সংস্কৃতি, পরিচয় তা মেহেরগড় সভ্যতার সহিত পুরোপুরি বেমানান। গীতায় অর্জুনকে কৃষ্ণের উপদেশ বানী। মায়া ত্যাগ করে নৈতিকতার জন্য যুদ্ধ? জীবন নির্বাহ ও বাস্তবতার কোন কিছুই গীতায় নেই। মায়া ত্যাগ করতে চাইলে সংসারী লোকদের আত্মহনন ছাড়া আর কোন পথ খোলা থাকে না। আর বৈদিক ধর্মের প্রধান গ্রন্থ ঋগবেদ ভর্তি মায়া ও কামনার প্রার্থনা। সাধারনরা দূরে থাক, কোন মহাপুরুষের পক্ষেও মায়া ত্যাগ করা সম্ভব না। যা খুশি বলে দিলেই তা ধর্ম হয়ে যায় না। অন্তরের অস্তিত্ব থাকবে, মায়াও থাকবে। মৃত্যু ব্যতীত মায়া থেকে নিস্তার নেই। আর মায়া ত্যাগ করার উদ্দেশ্যে দুনিয়া ছেড়ে গাছের নীচে বা উপসনালয়ে সারাজীবন ধ্যান করার পরিকল্পনা করলে- তবে তা অবশ্যই সুস্থতা নয়। “লজ্জাশীলতা” ব্যক্তিত্বের মাপকাঠি। যার ব্যক্তিত্ব নেই, সে প্রবর্তক বা মহাপুরুষ হয় কি করে? গীতার উপদেশ দাতা ও গ্রহীতা এবং অন্যান্য চরিত্রধারী কারোর অস্তিত্বের প্রমান নেই। বর্তমানে সকলে সভ্যতার সাপেক্ষে ভুল ও শুদ্ধ প্রমানের সহিত জ্ঞান অর্জন করছে, সত্য-মিথ্যা স্পষ্ট হচ্ছে।

আর্য ব্রাহ্মণ পুরুহিতরা গীতা রচনা করে, কৃষ্ণকে পরেমেশ্বর ভগবানের পোশাক পরিয়ে নিজেদের প্রাধান্য ধরে রাখার প্রয়াস। বৌদ্ধ, জৈনদের দর্শনের কাছে নিশ্চিত পরাজয় জেনে সময়ের ব্যবধানে ক্ষত্রিয় রাজাদের সাহায্যে ভারত থেকে বৌদ্ধ, জৈনসহ অন্যান্য সকল অনুসারীদের অস্তিত্ব বিলুপ্ত করে। বর্তমান বৈদিক পণ্ডিতগণ স্রষ্টায় অস্বীকারকারী গৌতমকে বিষ্ণুর একাদশ অবতার হিসেবে স্বীকার করে। অথচ গৌতম গোঁড়া থেকে একজন সংশয়বাদী। সৃষ্টিকর্তায় শুধু অবিশ্বাসী নয় বরং নিজে নিজের সত্তাকেও অস্বীকার করেছে। শিব অনুসারী পণ্ডিতদের দাবী গৌতম, ভগবান শিবের ১১২টি পথের একটি পথ গ্রহণ করে জগত বিখ্যাত হয়েছে।

যঃ সর্বত্রানভিস্নেহস্তত্তৎ প্রাপ্য শুভাশুভম।
নাভিনন্দতি ন দ্বেষ্টি তস্য প্রজ্ঞা প্রতিষ্ঠিতা।।
আত্মৌপম্যেন সর্বত্র সমং পশ্যতি যোহর্জুন।
সুখং বা যদি বা দুঃখং স যোগী পরমো মতঃ।।
সুহৃন্মিত্রার্যুদাসীনমধ্যস্থদ্বেষ্যবন্ধুষু।
সাধুস্বপি চ পাপেষু সমবুদ্ধির্বিশিষ্যতে।।
নিজে অনুশীলনের মাধ্যমে কর্ম করে দৃষ্টান্ত অনুসারীদের না দেখিয়ে দিলে সেই ধর্মের গুরু বা প্রবর্তক প্রতারক হিসেবে স্বীকৃত হয়। গৌতম, রাম, কৃষ্ণের অত্যাবশ্যক দায়িত্ব ছিল বহু পত্নী গ্রহণ করে সংসার ধর্ম পালনের ভিতর থেকে উপরোক্ত উপদেশ(শ্লোক)গুলোর নিজের জীবনে কর্মের মাধ্যমে তা অনুশীলনের করে অনুসারীদের দীক্ষা দেওয়া। গৌতম, রাম, কৃষ্ণের শক্তিমত্তা, ধৈর্য ও চারিত্রিক বিশুদ্ধতা প্রমান হত। প্রমান হত সত্যের। প্রমানের সহিত প্রতিষ্ঠিত হত একজন আদর্শ ও সত্য প্রবর্তক হিসেবে। আরো প্রমান হত, সে যা বলে তা জানে কিনা এবং আমল করে কিনা?

বৈদিক ধর্মের অনুসারীগন নিজ ধর্মকে সনাতন হিসেবে দাবী করেন। সনাতনের প্রধান বৈশিষ্ট্য অসাম্প্রদায়িকতা। ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র নিজেদের ভিতরেই ভগবান কৃষ্ণ সাম্প্রদায়িকতা তৈরি করার সহিত জন্মান্তরবাদ, অবতারবাদ ইত্যাদির বিভ্রান্তিময় পুরো গীতা জুরেই। এই সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে যে-ই কথা বলেছে তাকেই দুনিয়া থেকে বিদায় নিতে হয়েছে। শ্রী চৈতন্য দেবসহ অনেক মনিষীদের হত্যা করা হয়েছে। স্বভাবতই একজন পরম ভগবান যিনি তার নিজ সৃষ্টির প্রতি প্রেমময় সে কখনও সাম্প্রদায়িক হতে পারে না। “কর্মের মাধ্যমে জন্মান্তরবাদ”- এই থিওরী ব্রাহ্মণবাদীরা সহ সকল বৈদিক অনুসারীরাই এক সময় ত্যাগ করতে বাধ্য হবে বিজ্ঞান ও আধুনিক ট্যাকনোলজির কারনে। অতীতে ব্রাহ্মণদের দ্বারা শোষিত বৈষ্ণবরা বর্তমানে সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে ক্ষুধার্ত হায়িনার ন্যায় ফুসে উঠছে।

উপনিষদে বৈশ্য ও শূদ্র জাতিকে চরম অবমাননা করা হয়েছে যা অত্যন্ত আপত্তিকর। গীতার দাবী, কৃষ্ণ প্রথমে গীতা প্রকাশ করেন সূর্যদেবের কাছে, সূর্যদেব মনুকে, মনু ইক্ষাকুকে এইভাবে গুরু-শিষ্য পরম্পরায় চালিত তারপর আবার বিচ্যুতি। পুনরায় অর্জুনের মাধ্যমে আবার চালিত এবং এরপর গুরুদের মাধ্যমে আজ অবধি- এইগুলো মনগড়া দাবী। বৈদিক গ্রন্থগুলোর বিবরণ অন্য রকম পাওয়া যায়।

যুদ্ধ শেষে অর্জুন কৃষ্ণকে উদ্দেশ্য করে বলে, “প্রভু যুদ্ধ ক্ষেত্রে আপনি যে উপদেশ বানী দিয়েছিলেন তা ভুলে গেছি, আমাকে আবার দীক্ষা দিন”। কৃষ্ণ জানায় সে নিজেও ভুলে গেছে। যুদ্ধ ক্ষেত্রে কৃষ্ণ যে ধ্যানে ও অভিব্যক্তিতে ছিল তা এখন নেই অথচ তিনি একজন স্বয়ং পরম ইশ্বর, তিনি ভুলে গেছেন। এই ৭০০ শ্লোকের গীতার বানী কিভাবে নথিভুক্ত হয়? আর যুদ্ধক্ষেত্রে ৭০০ শ্লোকের উপদেশ বানী বলা কখনই সম্ভব নয়। রামায়ণ, মহাভারত, গীতা ব্রাহ্মণদের দ্বারা তৈরি হয়েছে বৌদ্ধ, জৈন, অজীবিকা সহ অন্যান্য অনুসারীদের উপর আধিপত্যের উদ্দেশ্যে তা উপরে স্পষ্ট করে দেখানো হয়েছে।

গুরু কি কারনে সত্য এবং গুরু-শিষ্যের সম্পর্ক কিসের উপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত হয়, সে ব্যাপারে মৌন এবং কিছুই বলা নেই। উপনিষদ বলে, গুরুর চরিত্র পরীক্ষা করে গুরুর দীক্ষা নিতে। কতজন শিষ্য এই পরীক্ষা করেন? চরিত্র পরীক্ষার প্রসেসই-বা কি? গীতার দাবী গীতাকে পরমেশ্বর ভগবানের বানী হিসেবে স্বীকার না করলে, না মানলে সে মূর্খ, জাহেল, ইন্দ্রিয় অনুসারী, জ্ঞানহীণ, ইতর, অশিক্ষিত, পরজন্মে ইতর প্রানী হিসেবে জন্মানো ইত্যাদি। এখানে গীতা শক্তি প্রয়োগ করতেছে অন্ধ বিশ্বাসের। অন্ধভাবে কৃষ্ণকে ও গীতা কৃষ্ণের বানী তা মানতে হবে এমনটাই দাবী। এত এত অসুস্থতার ভিতর অনুসারীরা কিভাবে অনুসরণ করে!

বেদ, গীতা অপৌরুষেত্ব, সারাজীবন পাপ করে মৃত্যুর পূর্বে কৃষ্ণকে স্মরণ করলে মুক্তি লাভ ইত্যাদি অসার যা খ্রীষ্টধর্ম প্রচারক পলের ন্যায়- সত্যের সহিত এই সব দাবীর সম্পর্ক নেই। ছান্দোগ্য উপনিষদে বিশ্ব ও মানব সৃষ্টির বর্ণনার সাথে অন্যান্য সৃষ্টির বিবৃতি এবং সত্য, ক্রেতা, দ্বাপর ও কলি যুগের সময়কাল মানব সভ্যতার সহিত বাস্তবতা বিবর্জিত। প্রানীর গোশত ভক্ষণ বৈদিক(হিন্দু) অনুসারীদের ধর্মীয়ভাবে অনুমোদন থাকলেও বৌদ্ধ ভিক্ষুদের দ্বারা নিরামিষ হওয়ার অনুসরণ করে। বৈদিক(হিন্দু) আধুনিক পণ্ডিতরা ভাল করে উপলদ্ধি করতে পেরেছে বৈদিক(হিন্দু) ধর্মের সংস্কার অত্যাবশ্যক। বহু কারন বাদে শুধু বর্ণ বৈষম্য বৈদিক ধর্মকে দুনিয়া থেকে বিলুপ্ত করে দিচ্ছে কিন্তু পরমেশ্বর ভগবান কৃষ্ণের নামে হাজার হাজার বছর ধরে চালিত শাস্ত্রে এত বেশি ভুল ও অসঙ্গতি যে সংস্কার করতে চাইলেও, সম্ভব নয়।

বেদ, গীতা, মহাভারত, রামায়ণ, উপনিষদ, মনুসংহিতা ইত্যাদি আর্যদের কতৃক পরবর্তীতে ব্রাহ্মণ পুরোহিতদের দ্বারা রচিত। ৩৫০০ বছর পূর্বে এই সকল ধর্মীয় বানীর অস্তিত্ব ভারতে ছিল না। দ্রাবিড়দের শিব মেহেরগড় সভ্যতা থেকে আদি ভারতীয়দের প্রথম থেকে পূজিত হয়ে আসছে। হরপ্পা সভ্যতার সময়কাল খৃষ্টপূর্ব ২৮০০ থেকে খৃষ্টপূর্ব ১৮০০ শতাব্দী পর্যন্ত। হরপ্পা সভ্যতার পূর্বে মেহেরগড় সভ্যতা যার সময় কাল খৃষ্টপূর্ব ৭০০০ থেকে খৃষ্টপূর্ব ২৮০০ শতাব্দী পর্যন্ত। হরপ্পা সভ্যতার ভাষার সংখ্যা ছিল চার বা তারও অধিক। প্রোটো-ড্রাভিডিয়ান ছিল মূল ভাষা আর এই ভাষা থেকে তামিল, তেলেগু, কানারি, মালায়ালাম ইত্যাদির সৃষ্টি। প্রোটো-ড্রাভিডিয়ানের পূর্বে(মেহেরগড়ের সময়) ছিল প্যারা-মুন্ডা ভাষা। এই প্রোটো-ড্রাভিডিয়ান ও প্যারা-মুন্ডার ব্যাপারে ইতিহাসবিদ ও প্রত্নতাত্ত্বিকদের কাছে প্রমাণিত নয়। পাথরে লিখিত কিছু শিলালিপি উদ্ধার করে। আর্যরা ভারতে আসার পূর্বে ভারতবর্ষের সকল বিষয়াদি স্পষ্ট নয়। আর্যরা আসার পূর্বে হরপ্পা সভ্যতার সময় জনবসতি নগরকেন্দ্রিক ছিল তা প্রমাণিত।

ইন্দো-ইরানীয় ভাষাটি আজ থেকে সাড়ে চার হাজার বছর আগে ইন্দো-ইউরোপীয় থেকে আলাদা হয়। ইন্দো-ইরানীয় ভাষাটি তিন ভাগে ভাগ হয় আজ থেকে সাড়ে তিন হাজার বছর আগে। একটি থেকে গেল ইরানে। সেখান থেকেই জেন্দা আবেস্তার ভাষা “আবেস্তান”। একটি শাখা কাশ্মীরে যেটির ভাষা ছিল “দরদীয়”। এই দরদীয় থেকে পরে কাশ্মীরী ভাষার সৃষ্টি। আরেকটি চলে আসে ভারত মূল ভূখন্ডে এবং এই শাখাটির নাম “ইন্দো-আর্য”।

এই ইন্দো-আর্য ভাষার প্রাচীনতম নিদর্শনে প্রচারিত হয় বৈদিক ধর্মের প্রধান গ্রন্থ “ঋগবেদ”। এই ইন্দো-আর্য ভাষা বৈদিক ভাষা নামেও পরিচিত। এর অপর আরেকটি নাম বৈদিক সংস্কৃত। এই বৈদিক সংস্কৃত নামটি ভাষাতত্ত্ব সমর্থিত নয়, কারন সংস্কৃত ভাষাটি বৈদিকের এক বিশেষ ধরণ। ভারতবর্ষ বৃহৎ দেশ। আর্যরা এক জায়গায় থাকল না, লোহা আবিস্কারের পর ভারতবর্ষের বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে পরল। বন-জঙ্গল কেটে নতুন জনবসতি শুরু করে। সময়ের ব্যবধানে আর্য ভাষাকে তিনটি যুগে ভাগ করা হয়। প্রাচীন ভারতীয় আর্য(খৃষ্টপূর্ব ১৫০০ থেকে খৃষ্টপূর্ব ৬০০ শতাব্দী পর্যন্ত), মধ্য ভারতীয় আর্য(খৃষ্টপূর্ব ৬০০ থেকে ৯০০ খৃষ্টাব্দ) এবং নব ভারতীয় আর্য(৯০০ খৃষ্টাব্দ থেকে আজ পর্যন্ত)। মধ্য ভারতীয় আসার পূর্বেই ইন্দো-আর্য ভাষা প্রাচীন ভারতীয় আর্যের সময়কালে দুটি আলাদা দৃষ্টিকোন ও ভাষাদর্শন জন্ম নেয়। একটি সংস্কৃত এবং অপরটি পালি।

ইন্দো-আর্য ভাষায় ঋগবেদ রচিত হলেও পরবর্তীতে প্রকৃতির নিয়মে কালের ব্যবধানে এই ভাষার ভিতর বিকৃত হওয়া শুরু করে। লোকমুখে এই ভাষা বদলে যাচ্ছে, লোকে আর্যকে বলছে অজ্জ, ধর্মকে বলছে ধম্ম। অনেকের কাছে ইহা পছন্দ হলো না। কিছু সংস্কারক ভাবতে থাকলেন কিভাবে এই বিকৃতি রোধ করা যায়। “সংস্কৃত” ভাষার জন্ম এখানে। বিকৃতি রোধ করার উদ্দেশ্যে সংস্কৃত ভাষার নিয়ম যুগের ব্যবধানে যারা লিখলেন, তাদের বলা হয় “বৈয়াকরণ”। এই বৈয়াকরণের লিস্টি বেশ লম্বা। রচয়িতাদের মধ্যে বিখ্যাত ত্রয়ী হলেন খৃষ্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দীর পাণিনি, খৃষ্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দীর কাত্যায়ন এবং খৃষ্টপূর্ব দ্বিতীয় শতকের পতঞ্জলি। আজ থেকে আড়াই হাজার বছর আগে পাণিনি সংস্কৃত ভাষা তৈরির নিপুনতা দেখায়। পাণিনি সংস্কৃত ভাষার যে ব্যাকরণ এবং সূত্র প্রকাশ করে গেছেন, কাত্যায়ন পাণিনির বেশ কিছু সুত্রকে পরিবর্তন করার প্রয়োজন বোধ করেন, কারন ঐ সময় ভাষা প্রবাহ আরো বদলে গিয়েছিল। কাত্যায়ন, পাণিনির যে সূত্রগুলো খন্ডণ ও পরিবর্তন করেন, পতঞ্জলী পাণিনির সূত্র ও ব্যাকরণ পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করেন। পতঞ্জলির ব্যাকরণ শুধু বিশ্লেষনের দিক থেকে বিশিষ্ট নয় বরং সরস ও প্রঞ্জাল হিসেবে জনপ্রিয় ও সমাদৃত হয়েছিল।

“সংস্কৃত” কোন দেশ বা জাতি বা লোকালয়ের ভাষা নয়। বেদের বিকৃতি রোধ করার উদ্দেশ্যে সংস্কৃত ভাষার জন্ম আর পালি ভাষার জন্ম নিজেদের মতবাদকে ভাষার মাধ্যমে প্রকাশ করার উদ্দেশ্যে। বৌদ্ধ দর্শন পালি ভাষায় নিজেদের মতবাদ প্রতিষ্ঠিত করে গেছেন। পালির আলোচনা থেকে বিরত হই।

বৈদিক ধর্ম কোন নির্দিষ্ট প্রবর্তক দ্বারা প্রবর্তিত হয়নি বরং যুগে যুগে বহু মনিষীর চিন্তাধারার সমন্বয়ে ক্রম বিবর্তনের মাধ্যমে বৈদিক(হিন্দু) ধর্মের উৎপত্তি এবং বিকাশ ঘটেছে। ফলে বহু মত ও পথের সমন্বয় ঘটেছে। তাই বৈদিক(হিন্দু) ধর্ম একটি লৌকিক এবং গৌতমের মতবাদের ন্যায় বহু ঋষি ও পণ্ডিতদের সন্মলিত দর্শন।

বৈদিক(হিন্দু) ও বৌদ্ধ অনুসারীদের উদ্দেশ্যেঃ
বর্তমান দুনিয়ায় বিনোদনের অন্ত নেই। ইন্টারনেটের কল্যাণে মিডিয়ার ভিতর প্রবেশ করলে, সময় কিভাবে অতিবাহিত হয় সে খেয়াল থাকে না। ট্যাকনোলজির কল্যাণে মানুষ দুনিয়ার এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ঘুরে বেড়াচ্ছে মজা নেওয়ার উদ্দেশ্যে। একাকীত্ব এক বড় অন্তরজ্বালা। একাকীত্ব থেকে বাঁচতে সব বয়সের তো বটেই, বিশেষকরে উঠতি বয়সের ছেলেমেয়েরা নেশার ন্যায় মেতে থাকে। অন্তরের “আরামের পাত্র”-র ভিতর আবদ্ধ থাকতে সকলেই চায়। যার কারনে, খেয়ালখুশী কর্ম ও চিন্তায় লিপ্ত হতে আগ্রহী হয় এবং সেই অনুপাতে নির্বোধের সংখ্যাও পাল্লা দিয়ে বাড়ছে। দুই/চার/পাঁচ হাজার বছর আগে বিনোদনের অস্তিত্ব ছিল না। বিপরীত লিঙ্গের প্রতি যৌণতার আনন্দ ছাড়া বিনোদনের কিছু ছিল না। বিনোদন কিভাবে সৃষ্টি করতে হয়, তাও জানা ছিল না। যার ফলে কিছু মানুষ ধ্যানের জন্য আত্মনিয়োগ করে অনেকটা পরিস্থিতির কারনে। যারা আত্মনিয়োগ করে তাদের একটা সংখ্যা জন্ম থেকে যৌনশক্তি দুর্বল বা নাই। আবার অনেকে দরিদ্রতার দরুণ বিয়ে বা সংসার চালানো অসামর্থ্য হওয়ায়, গাছের নীচে বা জঙ্গলে ধ্যান করতে আত্মনিয়োগের অনুশীলন শুরু করে। সন্ন্যাস জীবন ঐকালে জীবন ধারণের জন্য নিজেদের অনুকূলে হওয়ায়, “সংসার বিরাগী” সিস্টেমকে শাস্ত্রের ভিতর ঢুকিয়ে পরমাত্মার সাথে মিলিত হওয়ার শর্ত জুড়ে দেয়। পরবর্তীতে পণ্ডিতরা সন্ন্যাস জীবনকে জনপ্রিয় করে তুলে। এদের কেহ পরমাত্মার স্তরে পৌঁছাতে সক্ষম হওয়ায় নিজেদের মতবাদ প্রচার করে গেছে। হাজার বছরের অধিক সময় ধরে অগণিত ঋষি, সন্ন্যাসী নিজেদের মতবাদ রেখে গেছে পরমাত্মাকে ঘিরে। ব্রাহ্মণ সেই মতবাদগুলো একত্রিত করে নিজেদের মতবাদের সাথে সংমিশ্রিত করে ধর্মের নামে নব দর্শন প্রতিষ্ঠা করতে সামর্থ্য হয়েছে। সাধারণ অনুসারীরা তাদের মতবাদকে পরম ইশ্বরের বানী ও সত্য বলে ধরে নিয়েছে। আর সাধারণদের বড় ভুলটা এখানেই। মানুষজন উপলদ্ধির মাধ্যমে বুঝতে শিখে ভালবাসা, ক্রোধ, লোভ, হিংসা, প্রতিশোধ, দয়া, মায়া, ত্যাগ ইত্যাদি প্যারামিটার মাধ্যমে কর্মের ভিতরে থেকে জীবন নির্বাহ করছে। আর এই প্যারামিটারগুলোর প্রমান বিজ্ঞান বা মানবজাতির কাছে নেই বা প্রমান করার পদ্ধতি বা উপায় এই মহাবিশ্বে নেই। আরো বুঝতে শিখে এই প্যারামিটারগুলোর উৎস পরমাত্মা, তাই পরমাত্মাকে অস্বীকার করার উপায় নেই। আর এই অনুভূতিকে আশ্রয় করে ব্রাহ্মণেরা পরমাত্মাকে ঢাল রুপে ব্যবহার করে নিজেদের মতবাদের মাধ্যমে পরমাত্মাকে কৃষ্ণ, ব্রহ্ম, অবতারবাদ, জন্মান্তরবাদ প্রতিষ্ঠা করে অনুসারীদের পরিচালনা এবং নিয়ন্ত্রণ করতে সামর্থ্য হয়েছে।

সকল ধর্মের অনুসারীরা নিজেদের বিশ্বাসের কাছে দূর্বল। নিজেদের ধর্মগ্রন্থে কি লিখা আছে তা অধ্যায়ন করে না। ধর্মগ্রন্থে কি বলা আছে তা জানার আগ্রহ বোধও নেই। পীর, ঋষি, সন্ন্যাস, ব্রাহ্মণ, পণ্ডিত যা বলে, উহাই নিজেদের আকিদা, বিশ্বাসের ভিত্তিকে মজবুত করে বসে আছে, সাথে আছে পৈতৃক অন্ধবিশ্বাসের শিকড়। তারা সঠিক নাকি বেঠিক- তা নির্ণয় করতে যে পরিশ্রমের সহিত বিবেক প্রয়োগ করতে হয়, সেই কষ্ট কেহ করতে চায় না। বৈদিক গ্রন্থসমূহের সংখ্যা অনেক আর এইগুলো অধ্যয়ন করা এবং বুঝা জীবনের একটা বড় সময় অতিবাহিত করা লাগে। জীবনের অর্ধেক ব্যয় হয়ে যায় শুধু ধর্মগ্রন্থগুলো অধ্যয়ণ করতে। মেধার কষ্ট কেহ করতে চায় না ফলে সত্যকে অনুসন্ধান করার যে ধৈর্য তা থেকে সকলেই দূরে। অন্ধবিশ্বাস খুব ভয়ানক। উগ্রতা, বাড়াবাড়ি, নিজের বিশ্বাসের দ্বারা অন্যকে পরিবর্তন করার গোড়ামি থেকে খুনাখুনি মনোভাব অন্তরে অক্টপাসের ন্যায় ঝাপটে ধরে।

ঋষি, সন্ন্যাসদের বৈদিক অনুসারীরা “সাধু” মনে করে এবং তারা পাপমুক্ত এমনটা ধারনা করে থাকে। তারা জগত সংসার থেকে বিচ্ছিন্ন তাই তারা সাধু এবং পাপমুক্ত। সংসারবিরাগী হলেই সাধু ও পাপমুক্ত হবেন এমনটি ভাবার যৌক্তিকতা নেই। সাধুরা নিজেদের মনগড়া যা খুশী দর্শন বা ধর্মের নামে চাপিয়ে দিতে পারে এবং করেছেও যা তাদের কিতাবগুলোতে স্পষ্ট। সত্য-মিথ্যার বিচার তাদের থাকে না। যা ধারণা করেছে, চিন্তা করেছে কৌশলে তাই প্রচার করেছে। সত্যের বলিষ্টতা ঋষি, সন্ন্যাসীদের অন্তরে ছিল না। সত্যের অনুশীলন করে “সত্য” প্রতিষ্ঠার ভিত্তি, সেই ভিত্তিই তাদের নাই। সত্যের সাথে তারা ছিল সম্পর্কহীন। ঋষি, সন্ন্যাসী, পুরোহিত সম্পর্কে পক্ষপাতিত্বের পর্দা সরিয়ে নিজ বিবেক প্রয়োগ করে সত্যমিথ্যা বুঝা সকলের জন্য খুব জরুরী।

একজন সাধারণ উত্তমরূপে বুঝতে পারে অন্তর আগুনে পুড়ে কয়লা হওয়ার ধৈর্যের প্রস্তুতি গ্রহণ না করলে “চারিত্রিক বিশুদ্ধতা” অনুশীলনের মাধ্যমে নিজ স্বভাব ও চরিত্রে প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব না। আর যিনি প্রবর্তক তাঁকে সুপারনোভা, হাইপারনোভা বিস্ফোরণের আগুনের ভিতর অন্তর পুড়ে “চারিত্রিক বিশুদ্ধতা”-র পরীক্ষা দিতে হয়। এই বুঝটুকু যে না বুঝে, সে কখনও ধর্মের সত্যতা হৃদয়াঙ্গম করতে পারে না। এই পরীক্ষায় কোন কোন ভগবান, দেবদেবী, সন্ন্যাস, সংসার বিরাগী, পণ্ডিত উত্তীর্ণ হওয়ার ক্ষমতা রাখে? আছে একজন? ইহা বুঝা দুনিয়ার সকল মানুষের নিজ দায়িত্ব এবং ইহা অন্যের কাছ থেকে ধার করার বিষয় নয়। একজন এসে নিজেকে “কৃষ্ণ” বা “ব্রহ্ম” বা “প্রবর্তক” বা “ইশ্বর” বা “অবতার” ইত্যাদি ঘোষনা করবে আর এমনি মানুষ তা মেনে নিবে- ব্যাপারটা এত সহজ নয়। দাবীকৃত ইশ্বর, দেবদেবী, মুনি, ঋষিদের জীবনের কর্মের রেকর্ড দুনিয়ায় ও দুনিয়ার কোন কিতাবে নেই।

সৃষ্টিকর্তা মানব জাতিকে দেহ নামক পোশাকের ভিতর ভরে সকল ইন্দ্রিয়র মাধ্যমে জীবন নির্বাহ করার জন্য কর্ম করার নির্দেশ দিয়েছেন। কর্মের পাশাপাশি সৃষ্টিকর্তার ইবাদতের উদ্দেশ্যে দুনিয়ায় পাঠিয়েছেন। কর্মে কে উত্তম? সংসার ধর্ম ছেড়ে সন্ন্যাস ধারণ করলে তবে দুনিয়ায় পাঠানোর প্রয়োজন ছিল না। জগত সংসার ছেড়ে সারাজীবন পরমাত্মার ধ্যান কোন সুস্থতা নয়, সমাধান নয়। ভিন্ন ডাইমেনশনের ক্ষুধাহীন, কামহীন, লোভহীন প্রানীদের মত “হরে কৃষ্ণ হরে রাম” জপে পার পাওয়া সহজ ছিল এবং উহাই সঠিক ছিল।

“আর্যরা বহিরাগত নয়”- ইহা বর্তমান অধিকাংশ বৈদিক অনুসারীদের দাবী এবং এই দাবীর সঠিকতা প্রমান করতে মরিয়া। উপনিষদ ও গীতার নতুন সংস্করণের ভুমিকায় “আর্যরা ছিল প্রাচীন ভারতীয়”- তা অনুকূলে সঠিকতা তুলে ধরার জন্য চেষ্টায় ব্যাপৃত। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা পরিশ্রম ও গবেষণা করছে স্বপক্ষে তুলে ধরার এবং যে যার সুবিধামত বক্তব্য পেশ করছে। পক্ষপাতিত্বের নীরব এক প্রতিযোগীতা। শিক্ষিত অনুসারীদের এক অংশ অনুধাবন করতে পেরেছে, আর্যরা বহিরাগত হলে বৈদিক ধর্ম পুরাটাই অসার ও মিথ্যা- তা সকলের কাছে প্রমান হয়ে যায়। রাম, কৃষ্ণ, গীতা, বেদ ব্রাহ্মণদের কল্পিত ও বানোয়াট- তা আপনাতেই স্পষ্ট হয়।

দক্ষিন ও উত্তর ভারতবাসীদের DNA-র পার্থক্য আছে। দ্রাবিড়দের বৈশিষ্ট্য, গঠন, সংস্কৃতি, ধর্ম, বর্ণ সবই আর্যদের থেকে পৃথক। দ্রাবিড়দের জাতিগোষ্ঠীর বিশাল এক অংশ আর্যদের মেনে নেয়নি। “বিবেক” এক মহামূল্যবান এবং ইহা ভালমন্দের পার্থক্য ও সঠিকতা তুলে ধরে। কেহ নিজ বিবেক থেকে পালানোর ক্ষমতা রাখে না।

ব্রাহ্মণ্যবাদীরা নিজেদের আধিপাত্য আর দুনিয়া ভোগ করার উদ্দেশ্যে বেদান্তবাদী বা সনাতন ধর্মগ্রন্থগুলোকে নিজেদের মত করে সাজিয়েছে, বানিয়েছে। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন মুনিঋষি, পুরোহিতদের দ্বারা সাজানোতে হাজার হাজার বৈপরীত্য ও অসামঞ্জস্যতা লক্ষিত। আর তারা যা বলবে তাহাই সঠিক- ইহাই তাদের প্রচারের লক্ষ্য ছিল। যারাই তাদের বিরুদ্ধাচারণ করেছে তাদের হত্যা করেছে। তেমনি একজন শ্রী চৈতন্য প্রভু।

সৃষ্টিকর্তা সে তাঁর আপন গুণে গুণান্বিত। সৃষ্টিকর্তার প্রশংসা, পবিত্রতা, মহত্ত্ব, ক্ষমতা সম্পর্কে মানুষের চিন্তার শেষ সীমানায় গিয়ে অনুধাবন করার পারগতা থেকেও আরো অনেক উর্ধ্বে। “সৃষ্টিকর্তা মানুষের বেশ ধরে দুনিয়ায় এসেছেন”- এমন দাবী সৃষ্টিকর্তার সত্তাকে চরম অপমানের সহিত অবহেলার সহিত উপহাস করা। বিশ্ব সৃষ্টির আদি থেকে অন্ত পর্যন্ত এর চেয়ে নিকৃষ্ট আর কিছু নেই। ভাল-মন্দ বুঝার “বিবেক” সৃষ্টিকর্তা সকল মানুষদের দিয়েছেন। কেহ নিজের বিবেকবোধকে অসুস্থতার কারাগারে আবদ্ধ করে রাখলে, সেখানে কিছুই করার থাকে না।


PART-G
======
নাস্তিকতাঃ
দুনিয়ার কেহ সৃষ্টিকর্তাকে সরাসরি অস্বীকার করার মত সাহস রাখে না। যারা সৃষ্টিকর্তাকে মানতে চায় না, তারা দুই রকম। সন্দেহবাদী এবং ধর্ম(ইসলাম) বিদ্বেষী। নাস্তিক বা আজ্ঞেয়বাদ বলে দুনিয়াতে কেহ নেই, কাউকে খুঁজে পাওয়া যাবে না, আর যদি পাওয়া যায় তবে তারা ভানকারী। সকলের জ্ঞানে রয়েছে “নিজের মৃত্যু নিশ্চিত”; আরো জানে সে নিজের “আমি” সম্পর্কে কিছু জানে না। জীবনের চলার পথে সকলেই মহাশুন্যতা অনুভব করে, নিজ ও পরিবারের বাস্তবতার হিসেব কেহ মিলাতে পারে না। মহাশুন্যতা ও হিসেব “সেই মহান একজন”-র সাক্ষ্য হয়ে প্রত্যেকের বিবেকের ভিতর নাড়া দেয় কিন্তু বিবেকের সেই নাড়া অন্তরে পৌছতে পারে না কারন কঠোরতা আরোপ করে নিজেদের অন্তরের দরজা নিজেরাই বন্ধ করে রেখেছে। জ্ঞানীরা কখনই সৃষ্টিকর্তাকে অস্বীকার করে না তবে প্রবর্তকগণের সত্যতা নিয়ে সন্দিহান। তাদের দাবী ধর্ম মানব রচিত। ধর্মগ্রন্থগুলো পরবর্তীতে সেই ধর্মের অনুসারীদের দ্বারা পরিবর্তিত হওয়ায় দাবীগুলো উত্থাপিত। যে কেহ চিন্তাশীল হতে পারেন কিন্তু প্রজ্ঞাবান হওয়া সহজ নয়। প্রজ্ঞা, বিচক্ষণতার সহিত চারিত্রিক বিশুদ্ধতার অনুশীলনের সাথে সম্পর্কিত। আর প্রজ্ঞাবানের সহিত চারিত্রিক বিশুদ্ধতা প্রতিষ্ঠা না হলে প্রবর্তকগণের সত্যতা জানার উপায় নেই। সন্দেহবাদীরা ভাল করে জানে প্রকৃতি, বাস্তবতা ও ব্যক্তি জীবনের হাঙ্গামা ও বিড়ম্বনার অগণিত ঘটনার সমাধান নেই, উত্তর নেই যেখানে যুক্তি টিকে না, যুক্তি কাজ করে না, যুক্তির দেয়াল ভেঙ্গে পরে। নিজ সত্তা “আমি” পরিচালিত হচ্ছে এক অদৃশ্য শক্তির উৎস থেকে। সন্দেহবাদীরা জ্ঞানী এবং নম্র স্বভাবের, আচরণে রুক্ষতা কম। আর ধর্মবিদ্বেষীরা জিদ ধরে সত্য থেকে দূরে সরে নিজের অবস্থান ধরে রাখে এবং গোঁয়ার।

সন্দেহবাদী ও ধর্মবিদ্বেষীরা চিন্তাশক্তি ও অনুভূতির দ্বারা সৃষ্টিকর্তাকে বুঝতে ও অনুধাবনে ব্যর্থ। এর প্রধান কারন, নিজ সত্তা রহস্য উন্মোচন করতে না পারা। নিজ সত্তা “আমি”-কে না জানা এবং জানতে আগ্রহী না হওয়া। যারা নিজেদের সৃষ্টির ব্যাখ্যার অতীত, তাদের পক্ষে সৃষ্টিকর্তা এবং নিজেকে বুঝা দূর্বোধ্য। “আমি” সমান্তরাল দুটি জগত থেকে একই সাথে পরিচালিত। “দেহ” নামক বাহিরের পোশাকটি টাইম ও স্পেসের সহিত সম্পর্কিত আর ভিতরের সত্তাকে স্বীকার বা গুরুত্ব দিতে চায় না কারন তাদের যুক্তির দেওয়ালের ভিতর অন্তর ও অন্তরের প্যারামিটারের স্থান নেই। অথচ অন্তরের প্যারামিটারের দ্বারা সর্বদা পরিচালিত হয়ে কর্ম ও চিন্তার সহিত জীবন নির্বাহ করছে। আত্মসাধনা ও চারিত্রিক বিশুদ্ধতার অনুশীলন তাদের বুঝশক্তির বাহিরে। মস্তিষ্ক ও তার সাথে রাসায়নিক বিক্রিয়াকে “আমি”-কে আখ্যায়িত করে গোঁজামিল দেওয়ার প্রয়াস। আবার কখনও ভিন্ন মনগড়া মতবাদ।

ইসলাম-বিদ্বেষীদের পর্যালোচনা করলে, এদের অনেকের মত প্রকাশের জন্য বিদ্বেষের জন্য অজ্ঞতা বড় কারন। এরা দেখেছে, কোনো কোনো মুসলিম নির্বিচারে নিরপরাধ মানুষ হত্যা করছে এবং এজন্য তারা ইসলামের পবিত্র গ্রন্থ কোরআনের উদ্ধৃতি পেশ করছে। কাজেই তারা ধারণা করে আছে কোরআন এরূপ শিক্ষা দিয়ে থাকে। ইসলাম বিদ্বেষী অপপ্রচারের জোয়ারের মধ্যে নিরপেক্ষভাবে তথ্য সংগ্রহ বা যাচাই করা অনেকের জন্য খুব কঠিন কর্ম। এদের অনেকেই ইসলামের জিহাদ বিষয়ক কিছু নির্দেশ হয়ত পাঠ করেছে, লোকমুখে কথা শুনেছে, মিডিয়া থেকে জ্ঞান ধার করেছে কিন্তু জিহাদের প্রকৃত অর্থ, শর্ত বা বিধানাবলি জানে না। এরা অধিকাংশ ক্ষেত্রে ইসলাম সম্পর্কে অমুসলিম ধর্ম-প্রচারক বা ধর্মগুরুদের বিভ্রান্তিমূলক, ভুল প্রচারণামূলক বইপুস্তক পাঠ করেছে কিন্তু ইসলামী জ্ঞানের সূত্রগুলি থেকে নিরপেক্ষভাবে তথ্য সংগ্রহ করেনি।

সন্দেহবাদী ও ধর্মবিদ্বেষীরা নিজেদের ইন্টিলিজেন্ট দাবীর সাথে এই গ্রহের একমাত্র জ্ঞানী মনে করে। ইগো এই দাবীকে আরো জোড়ালো করে এবং অন্তরকে কঠোরতার সহিত পর্দা দ্বারা আবৃত করে। কঠিন বাস্তবতা এবং চারপাশের কুসংস্কার, বানোয়াট প্রচলিত ধর্মীয় অস্বাভাবিক উপকথা, গল্প-গুজব তাদের অন্তর কঠিন ও বিদ্বেষী করে তুলে যার কারনে নিজেরাই নিজেদের প্রকৃত জ্ঞান ও সুস্থ চিন্তার মাঝে দেওয়াল তৈরি করে। “সাফল্য” ও “সত্য”-কে অর্থ, ক্ষমতা ও বিলাসিতার দ্বারা পরিমাপ করে। জীবন ব্যবস্থাকে এলগরিদমের ভিতর থেকে পরিচালিত করার মাধ্যমে সঠিকতা মনে করে। আধুনিকতার সহিত ইন্দ্রিয় সন্তুষ্টির সহিত বিলাসিতাই জীবনের আসল উদ্দেশ্য এবং ইহাই জীবনের চূড়ান্ত বলে লক্ষ্য স্থির করে। বিলাসিতার শক্ত অবস্থান তৈরিতে নিজের যে মেধা ও পরিশ্রম বিনিয়োগ করে, “ধর্মের অপ্রয়োজনীয়তা” সেই বিনিয়োগের ভিতর নিজেদের কাছে নিজেরা সুশোভিত হচ্ছে।

সন্দেহবাদী ও ধর্মবিদ্বেষীদের লক্ষ্য করলে দেখা যায় চরম হতাশাগ্রস্ত। “হতাশা” জীবনকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে কিন্তু ভান করে আনন্দ ও সুখী জীবনের। জোর করে কৃত্তিমতার সহিত জীবন ধারণ। হতাশা তাদের হিংস্রতায় রুপান্তরিত করে। এলকোহল এবং নেশা জাতীয় দ্রব্যাদির ভিতরে থাকতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। সন্তান নিজের কিনা, তা ডিএনএ পরীক্ষা করে নিশ্চিত হতে হয়। দাম্পত্য জীবন চরম অশান্তিময়। ডিভোর্স, ঝগড়া, হাতাহাতি, আচরণে রুক্ষতা, চিৎকারের সাথে কথা বলা ইত্যাদি ধর্মবিদ্বেষীদের নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। পারিবারিক উচ্ছৃঙ্খলতার কারনে তাদের সন্তানরাও বিপথগামী। তাদের অন্তর হয় নির্দয় ও কঠোর। দুনিয়াব্যাপী সন্দেহবাদী ও ধর্মবিদ্বেষীরা যে সকল মনিষীদের কাছ থেকে জ্ঞান ধার করে নিজেদের বিশ্বাস ও মতবাদ তৈরি, সেই গুরুদের একটা সংখ্যা “ধর্ষনের আসামী” বা “সমকামী” আর অধিক সংখ্যক পরকীয়ায় লিপ্ত। আবার এই গুরুরা মানবতার গান গেয়ে ধর্মকে হেয় করে। সন্দেহবাদী ও ধর্মবিদ্বেষীদের চরিত্র/স্বভাবের সুস্থতা নেই।

বিশ্ব সৃষ্টির স্রষ্টার ব্যপারে সন্দেহবাদীরা অনেকটা মৌন থাকলেও, ধর্মবিদ্বেষীরা স্বীকার করে না। সৃষ্টির শুরুতে কিছুই ছিল না। “কিছুই না”-র ভিতর “কিছুই না”। তারপর এই “কিছুই না” ভিতর থেকে উদ্দেশ্যহীনভাবে অলৌকিক ভাবে সবকিছু অস্তিত্বে চলে এল এবং নিজ থেকে মহাবিশ্ব, গ্রহ, নক্ষত্র, গ্যালাক্সী তৈরি হয়ে গেল এবং সবশেষে উদ্দেশ্যহীনভাবে আমি-তুমি-সে। সৃষ্টিকর্তা আদম-হাওয়া(এডাম-ইভ)কে সৃষ্টি করেছেন আর তা নিয়ে উপহাসে লিপ্ত অথচ নিজেদের দাবী যে কত বড় উপহাসের পাত্র তা তাদের বুঝে নেই। নাথিং অর্থ যেখানে স্থান, কাল, শক্তি, বস্তু, শৃঙ্খলা কিছুই নেই অথচ “Something created from Nothing”- ইহাতে তারা দৃঢ় বিশ্বাসী। Physical cosmology অনুযায়ী একটি বিন্দু বা সিঙ্গুলারিটি থেকে মহাবিশ্বের সৃষ্টি। সেই বিন্দুটি অসীম শক্তি যা মহাবিস্ফোরিত(বিগ ব্যাং) হয়ে মহাবিশ্বের সৃষ্টি- এই মতবাদ প্রতিষ্ঠিত। কারন, মহাবিস্ফোরণের প্রমান চারিদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। সেই বিন্দু বা সিঙ্গুলারিটি-কে তারা নাথিং বলে দাবী করে। তাদের এই দাবীর মাধ্যমে কাকে বুঝায়? নিজেকে বুঝ দেয় নাকি বিজ্ঞানকে? বিন্দু কেন এবং কিভাবে বিস্ফোরিত হলো তারও কোন কারন নেই। মহাবিস্ফোরণের পূর্বে কি ছিল- জবাব নেই। মহাবিস্ফোরণ থেকে আমি-তুমি-সে উদ্দেশ্যহীনভাবে সৃষ্টিকর্তা ছাড়াই তৈরি হয়ে গেছে। মহাবিশ্বের শৃঙ্খলা ও নিয়ম নীতির উপস্থিতির কারনে সন্দেহবাদীদের আরেক শ্রেণী সৃষ্টিকর্তাকে স্বীকার করতে হবে বিধায় “সিঙ্গুলারিটি বা মহাবিষ্ফোরনের মাধ্যমে মহাবিশ্বের সৃষ্টি”- তা মেনে নেয় না। তাদের দাবী মহাবিশ্ব অনন্তকাল ধরে ছিল, আছে এবং থাকবে অর্থাৎ মহাবিশ্বের শুরু বা শেষ নেই। কিন্তু বিজ্ঞান কখনই স্থির মহাবিশ্ব স্বীকার করে না আর ইহা প্রমানিত মহাবিশ্ব সম্প্রসারিত হচ্ছে এবং এর শুরু ছিল। “প্রকৃতি আপনা থেকে প্রান সৃষ্টি হয়ে গেছে”- ইহা প্রমান করতে তারা যেমন ভীত তেমনি “Nothing”-কে সংজ্ঞায়িত করতেও ভীত। “প্রান কি?”- ইহাই সন্দেহবাদী ও ধর্মবিদ্বেষীরা জানে না, জানার আগ্রহও নেই। জানে না বিধায় মার্ক্সবাদের দ্বান্দিক বস্তুবাদকে সঠিক ও সত্য মতবাদ হিসেবে গ্রহন। উদ্দেশ্যহীন অন্ধ জড় থেকে “চেতনা”-র উদ্ভব আর জড়ই প্রাথমিক ও চিরন্তন। “চেতনা” স্রেফ জড়ের বিবর্তিত রূপ……- এই যুক্তি কেন এবং যুক্তির ভিত্তি কি? পুজিবাদীদের উপর আক্রোশ মিটাতে গিয়ে সেই আক্রোশের চশমা দিয়ে অসংলগ্ন কথা ও মতবাদ তৈরি সুস্থতা প্রকাশ করে না। ধর্মবিদ্বেষীরা সৃষ্টিকর্তাকে মানতে হবে বিধায় নিজ অন্তর কঠোরতা আরোপ করে সেই অসংলগ্ন কথাবার্তা আঁকড়ে ধরে আছে। বারট্রেন্ড রাসেল বস্তুবাদ ও ভাববাদের সমন্বয়ে “নিরপেক্ষ অদৈতবাদ” প্রচার করে গেছেন যা সন্দেহবাদীদের আশ্রয়স্থল। রাসেল অগ্রগামী হয়ে বলেছে, মানুষ মানুষকে কখনও জানার পূর্ণতা অর্জন করতে সামর্থ্য হবে না যতক্ষন ভিনগ্রহের অগন্তুক হয়ে মানুষকে তাদের না-মানুষী বিভিন্ন দৃষ্টিকোন থেকে পর্যবেক্ষন না করেছে। আরাম-আয়েশের বোতলের ভিতর থেকে পণ্ডিতি জ্ঞান জাহির করলে ফলাফল শূন্য। দর্শন ও প্রকৃত আধ্যাত্মিকতার শিক্ষক হচ্ছে “ধৈর্য”। নিজের ভিতরের শিক্ষককে উপেক্ষা করে ভিন গ্রহের অগন্তুকের প্রস্তাবনা, জ্ঞানের বিলাসিতা- নিজের আহম্মকি ছাড়া আর কিছু নয়।

প্রকৃতি নিজ থেকে একটি কোষে প্রোটিন তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা কতটুকু? ১:১০^১৬৪। ১-এর পর ১৬৪টি শূন্য। একটি বালুর কনা ১০^৯৬ গুণ বৃদ্ধি করলে মহাবিশ্বের মোট পদার্থের পরিমান হয়। তাহলে ১:১০^১৬৪? “আমি”-র জটিলতা এখনো শুরু হয়নি। প্রোটিন তৈরির উপাদান অ্যমিনো এসিড প্রকৃতি থেকে আপনা থেকে তৈরি হওয়া সেও এক বিশাল জটিলতা। বিজ্ঞানীরা স্বীকার করেন, প্রকৃতিতে ৫০০ ধরণের অ্যমিনো এসিড থেকে ২০টি(সাম্প্রতিক আপডেট হয়ে আরও ২টি সেলেনোসিস্টাইন ও পাইরোলাইসিন দাবী করা হয়, মোট ২২টি) প্রয়োজনীয় অ্যমিনো এসিড আপনা থেকে আলাদা হয়ে নির্দিষ্ট সিকোয়েন্সে প্রোটিন তৈরির প্রক্রিয়াটি মানব জাতি কোনদিন সমাধানে আসতে পারবে না। জীবদেহে ১১ ধরণের অ্যমিনো এসিড নিজ থেকে তৈরি হয় বাকী ৯ ধরণের অ্যমিনো এসিড বাহির থেকে। বিবেক কি বলে সৃষ্টিকর্তা ব্যতীত প্রকৃতি আপনা থেকে এই জটিলতার প্রোটিন তৈরি হয়ে গেছে? আর প্রকৃতি নিজ থেকে কোষে প্রান তৈরি হওয়ার সম্ভবনা? ১:১০^৩৪০০০০০০০ (৩৪০ মিলিয়ন পাওয়ার)। সকল বৈজ্ঞানিকগণ স্বীকার করেন ১:১০^৭০ পার হলে কোন কিছু ঘটা বা হওয়ার আর সম্ভাবনা থাকে না। ১:১০^৭০ পার হলে সেটা “impossible” হয়ে যায় এবং এই সীমানার বাহিরে কিছু ঘটার “প্রশ্ন” থাকে না বা করা যায় না। তাহলে ১:১০^১৬৪ ও ১:১০^৩৪০০০০০০০ কিভাবে সম্ভব? প্রত্যেকের “দেহ” বা “শরীর” ৩৭.২ ট্রিলিয়ন কোষ দ্বারা গঠিত। কোষ অনবরত নিজের প্রতিলিপি তৈরি করছে এবং টিকে আছে। আমি-র “দেহ” প্রকৃতি আপনা থেকে তৈরিতে সম্ভবনা, দশের উপর পাওয়ার ট্রিলিয়ন নয় বরং ম্যাথমেটিকেলি অসম্ভব। এ তো গেল “আমি”-র পোশাক দেহ সম্পর্কে অল্প কথা আর “আমি”-র হিসেব কিভাবে? এই বিষয়ে কাউকে কিছু জিজ্ঞেস না করে, নিজের বিবেক এপ্লাই করাই বুদ্ধিমানের কাজ। কারন, কেহ জবাব দেওয়ার ক্ষমতা রাখে না। চোখ দুটি বন্ধ করে নিজের বিবেকের আয়নায় নিজের চিন্তাশক্তিকে মোকাবিলা কর। “আমার” সাথে “আমি”-র খেলা হোক এবং এই খেলা চলতে থাকুক। নিজ বিবেক থেকে পালিও না।

একজন বিশ্বাসী বলবে “আমি” হচ্ছে সৃষ্টিকর্তার আদেশ। অ্যমিনো এসিড, প্রোটিন, কোষ, গ্যালাক্সি, গ্রহ, নক্ষত্র, স্ট্রং নিউক্লিয়ার ফোর্স, উইক নিউক্লিয়ার ফোর্স, ম্যাগনেটিক ফিল্ড, অভিকর্ষ বল, রুহ, ভালবাসা, হিংসা, কামনা, লোভ, যৌনতা, ধৈর্য, গাছ, প্রানী, মানুষ, দূর্যোগ, পাহাড়, মাটি, আকাশ, বাতাস, পানি, আলো, অন্ধকার, সময়, মহাবিশ্ব…… সবই সৃষ্টিকর্তার আদেশ। সৃষ্টিকর্তার এক হাতের মুঠোয় মহাবিশ্ব, আরেক হাতের মুঠোয় মৃত্যুর পর বিনয়, সরল, লজ্জ্বাশীল, ধৈর্যশীল বান্দাদের অদৃশ্য জগত। মহাবিশ্বের জগত থেকে ঐ জগতে যাওয়ার রাস্তা “পুলসিরত”। এই দুই জগত ব্যতীত আরো জগত রয়েছে। আর একজন অবিশ্বাসী, সন্দেহবাদী বলবে সবই প্রকৃতি। এমনি-এমনি উদ্দেশ্যহীন ভাবে হয়ে গেছে। ইহাই বিশ্বাসী ও অবিশ্বাসীদের পার্থক্য। মূর্খের সাথে জ্ঞানীর আলোচনা চলে না এবং উচিত না। “Self-Replication” সৃষ্টিকর্তার একটি আদেশ। এই Self-Replication মহাবিশ্বের অন্যতম বড় যাদুবিদ্যা আর এই যাদুবিদ্যা তোমার ও দুনিয়ার সকলের সামনে ঘটে চলছে। এই যাদুবিদ্যার কাছে যুক্তি কিভাবে টিকে? “ন্যাচারাল সিলেকশান” এই যাদুবিদ্যা ঘটায় না এবং ঘটানোর ক্ষমতা নাই।

অবিশ্বাসীরা ভাল করে জানে তাদের দাবী যুক্তিবিরুদ্ধ। যুক্তির সকল দ্বার রুদ্ধ হলে শেষ আক্রমন “সৃষ্টিকর্তাকে কে সৃষ্টি করেছে”? নিজেরাও জানে সৃষ্টিকর্তাকে নিয়ে চিন্তা করার যায় না, সৃষ্টি দিয়ে স্রষ্টাকে জানা যায় না কারন মানব জাতির মস্তিষ্কের চিন্তাশক্তি কখনই সৃষ্টিকর্তাকে নিয়ে চিন্তা করার ক্ষমতা রাখে না। যেই সৃষ্টিকর্তার শুরু নাই, শেষ নাই তার সৃষ্টি নিয়ে কথা বলা বা প্রশ্ন তোলা সম্ভব? সৃষ্টিকর্তা তো পরের বিষয়, নিজের “আমি”-কে জানা ও বুঝার স্তরে চিন্তাশক্তি পৌঁছাতে পারে না। যে নিজের সাথে নিজে তামাশা করে, রিপুর তাড়নায় নিজের জীবনকে বানিয়েছে ক্রীড়া-কৌতুক তার সাথে আলোচনা হয় না। চুপ থাকা ছাড়া আর কোন পথ নেই।

অবিশ্বাসীরা বলেন বস্তুই আসল ও চরম, মন একটি বিভ্রম আর বিশ্বাসীরা বলেন মন-ই আসল ও চরম, বস্তু একটি বিভ্রম। “বিবেক” এই মহাবিশ্বের সবচেয়ে দামি। যার বিচারবোধ যেটাকে সমর্থন করে, সে সেভাবেই পরিচালিত হবে।

সন্দেহবাদী ও ধর্ম-বিদ্বেষীদের উদ্দেশ্যেঃ
একজন মনোরম ও বিলাসী জীবন ত্যাগ করে, বাকী জীবন অন্তর জ্বালা ও অন্তর শিহরিত আগুনের ভিতর অবস্থান করে, মৃত্যুর পর সম্মানিত ও আদর্শ হয়ে দুনিয়ায় বিদ্যমান থাকার জন্য কিংবা মরুভূমির অর্থনৈতিক অবস্থা যেখানকার আবহাওয়া অত্যন্ত কর্কশ আর খেজুর, উট, ছাগল এই সকল নিম্ন মানের জিনিস পাওয়ার আকাঙ্খা কিংবা যৌনতাকে প্রাধান্য দেওয়া বা ক্ষমতা কব্জা করার জন্য নিজেকে “আল্লাহ্‌র রাসূল” দাবী করে তামাশার অভিনয় করবেন(মৃত্যুর পর সম্মান ও আদর্শ যেখানে অনিশ্চিত)- ইহা মন্দ ও নির্বোধদের অসুস্থ চিন্তা ও অসার কথাবার্তা। বিলাসিতা, অর্থ, ক্ষমতা, নয়ন জুড়ানো রমনীসহ অনেক প্রস্তাবনা দেওয়া হয়েছিল ইসলামের প্রসার ও প্রচার বন্ধের জন্য কিন্তু তিনি ঘৃণা ভরে ত্যাগ করেছেন এবং তাঁর কর্তব্যে ছিলেন অটল। নবী(সা) প্রবৃত্তির তাড়নায় কথা বলেন না। নবী(সা)-র চরিত্র নিয়ে কথা বলার পূর্বে নিজে অনুশীলন করে বিবেকবোধ জাগ্রত কর।

নিজেকে “রাসুল” দাবী করে নিজ স্ত্রী, সন্তান, পরিবার, আত্মীয়, প্রতিবেশী, দুনিয়ার সকল মানুষের কাছে প্রকাশ কর এবং দেখ সকলে তোমাকে কিভাবে গ্রহণ করে এবং তোমার সাথে কি আচরণ করে? নবী(সা)-র সকল দায়িত্বগুলো নিজে অনুশীলনের মাধ্যমে পালন করে দেখাও। নিজে নিজের উপর পরীক্ষা কর। “সত্য” তোমাকে বেষ্টন করে আছে। কোথায় পলায়ন কর?

মানুষের জন্ম থেকে মৃত্যু অবধি জীবনের সকল কাজ ও চিন্তা নিয়ন্ত্রন করে অন্তর, মস্তিষ্ক নয়। মস্তিষ্ক অন্তরের দাস আবার অন্তরও মস্তিষ্কের দাস হয় বিবেকের দ্বারা। সেই বিবেকও জাগ্রত হয় অনেকগুলো জ্বালানী থেকে যার একটি লজ্জ্বাশীলতা(অন্তরের প্যারামিটার)। অন্তরের এতই জটিল ও রহস্যময় যে পুরো মহাবিশ্বের রহস্য অন্তরের রহস্যের সমকক্ষ নয়। হাত, পা, চোখ, কান, শরীর সবকিছু যেমন মস্তিষ্ক নিয়ন্ত্রন করে তেমনি মস্তিষ্ককে নিয়ন্ত্রন করে অন্তর বা অন্তরের প্যারামিটার। দুনিয়ার সকল মানুষের মস্তিষ্ক সমান সত্ত্বেও আইনস্টাইন, নিউটন জ্ঞানীদের উঁচু স্তরে। তা কিভাবে? এর কারন “আগ্রহ”। অন্তরের আগ্রহ প্যারামিটার তাদের বিষয়বস্তুর উপর মস্তিষ্ককে বেশি পরিমান ব্যবহার করিয়ে সর্বোচ্চ চিন্তাশীলদের স্তরে নিয়ে গেছে। অন্তর তার প্যারামিটারের মাধ্যমে দুনিয়ায় “আমি”-কে চালিয়ে নিচ্ছে। অন্তর মস্তিষ্কের মাধ্যমে যখন সঠিক কর্ম ও চিন্তায় লিপ্ত না থাকে তখন অন্তরের বিষময় প্যারামিটার “বিষাদ” এসে অন্তরের সহিত সংঘর্ষ শুরু করে। সেই সংঘর্ষের সময় অন্তর স্থিরতার পাত্রে থাকতে চায় না। সেই বিষাদ থেকে বাঁচতে মোবাইল, গেইম, মিডিয়া বা অন্য কর্ম ও চিন্তার সহিত অন্তর-কে খেয়ালখুশী প্যারামিটারের মাধ্যমে অক্টোপাশের মত বেধে ফেলে। “সত্য”-কে জানতে ও চিনতে চাইলে অন্তরের সোপানগুলো খুলে ভিতরে প্রবেশ করতে হয়। এক অদৃশ্য পর্দা অন্তরের সহিত আমিকে ঢেকে ফেলা হয়েছে। সেই পর্দা ভেদ করে ভিতরে প্রবেশ করা লাগে। আমার জীবন ও জীবনের সকল কর্ম নিয়ন্ত্রন হচ্ছে অন্তর থেকে অথচ আমি তা বুঝি না।

দুনিয়ার সৃষ্টিকুল কেন ভুমিকম্প, সুনামি ইত্যাদির মত প্রকৃতিক দূর্যোগে মারা যায়? কেন খরা বা অতি বৃষ্টির জন্য ফল-ফসালাদি নষ্ট? কেন মানব জাতি রোগে-শোকে ভুগে? কেন এত ব্যাথা-বেদনা? কেন এত অর্থ কষ্ট, দরিদ্রতার কষ্ট, এত এত ভুগান্তি?- তোমরা যারা এই সব অভিযোগ তুলে সৃষ্টিকর্তাকে “নাই” বলে উপসংহার টান তবে জেনে রাখ, “দুঃখ কি”- তা এর কিছুই জান না, অনুধাবন করার ক্ষমতা রাখ না। তোমাদের জানার প্রসেসটাই ভুল, কারন নিজের অবস্থান ও শয্যা ঠিক রেখে জগৎ ও মানব জাতির অন্তরের অবস্থাকে বিচার করা যায় না। চারিত্রিক বিশুদ্ধতার অনুশীলন করলে আপনাতেই “দুঃখ”-র জগৎ উন্মোচিত হয়। খুব ভাল করে অনুধাবন করতে পারবে, দুঃখের প্রকৃতি ও এর স্বাদ কেমন? অতএব সত্যকে জানতে হলে, সত্যকে পাইতে হলে সাহসী হওয়া ছাড়া বিকল্প নেই।

সৃষ্টিকর্তা তোমাকে এক অনন্য রূপে, অত্যন্ত নিখুঁত রূপে সৃষ্টি করছেন। “আমি” সত্তা এই টাইম ও স্পেস ডাইমেনশন মহাবিশ্বের বাসিন্দা নয় এবং এই সত্তা সকল যুক্তি ও কারনের ঊর্ধ্বে। জগতের এমন কিছু নেই যার দ্বারা অন্তর সন্তুষ্ট হবে বা হতে পারে। এই সত্তা নিজ আপন জাত নূরের জগতে না যাওয়া পর্যন্ত সন্তুষ্ট হবে না। ভাল এবং মন্দ গুণের সমন্বয়ে গুণাধার অন্তরকে রুহের সহিত দুনিয়ায় পাঠানো হয়েছে পরীক্ষার জন্য। অবশ্যই ইহা রহস্যময় পরীক্ষা কারন, তুমি তোমার নিজের কাছে গুপ্ত ও রহস্যময়। সারাজীবনের কর্ম নিয়ন্ত্রণ করে অন্তর অথচ এই অন্তরকে চিন না, জান না, বুঝ না। চিনা, জানা, বুঝা কোনটাতেই আত্মনিয়োগ কর নাই অথচ আত্মনিয়োগ করেছ ইন্দ্রিয় সুখের পিছনে। মানব প্রজাতির সহিত অন্য প্রানীদের শারীরিক কাঠামো তুলনায় জেনে রাখ, সৃষ্টিকর্তা সর্বোত্তম কৌশলী ও রহস্যময়। প্রকৃতি আপনা থেকে DNA, RNA, অ্যমিনো এসিড, রাইবোজোম, কোষ… এমন জটিল সৃষ্টি ও ডিজাইন করার ক্ষমতা রাখে না। তুমি নিজেকে ইন্টিলিজেন্ট দাবী কর অথচ মহাবিশ্বের জটিল ইন্টিলিজেন্ট ডিজাইনকে প্রকৃতির কাজ বলে চালিয়ে দিতে, তুমি নিজেই নিজের বিবেকের কাছে অপরাধী। “দেহ” আমি সত্তার মহাবিশ্বের সূক্ষ্ম এক পোশাক। হাড়গুলো সেই পোশাকের খুঁটি আর সেই খুঁটিকে ‘আমি’ মনে করলে, তা নিজের সত্তাকে অপমানিত করার সহিত ধোকা দেওয়া। যে পোশাক পরিধান করে আছ, কত নিখুঁত ভাবে এই যন্ত্রের পোশাকটি দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে তোমায় বাঁচিয়ে রাখছে! এই প্রকৃতি পারে না “ক্ষুধা”-কে নিবৃত্ত করতে, পারে না স্ত্রী বা সন্তানকে নিজের মত পরিচালিত করতে তাহলে কিভাবে আরো উচ্চ জটিল সিস্টেম প্রাণ ও দেহকে? ডান চোখের তুলনায় বামটি ছোট বা বড় হলে তাকে তুমি বিয়ে করে সংসার করবে না, তা যতই মানবতাবাদী সাজ না কেন। নিজ পোশাকের বৃদ্ধির গোল্ডেন রেশিও এবং কার্যকারিতার প্রতি লক্ষ্য কর, কিভাবে নিখুততার সহিত সৃষ্টি করা হয়েছে। “Self-renewable” ও “Self-sustainable” বা “Strong Neuclear Force” সিস্টেমটির গঠন ও জটিলতা কিংবা পদার্থ কিভাবে ভরপ্রাপ্ত হয়, এগুলোর জটিলতা ও রহস্য এমনি-এমনি হয়ে গেছে? প্রকৃতির কারন, পদার্থবিদ্যার নিয়ম/নীতি যেখানে একটি কোড তৈরিতে অক্ষম সেখানে প্রানের স্পন্দন DNA-র ভিতর সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা কিভাবে এল যার উপর ভিত্তি করে তৈরি হয় প্রানীর শরীর? সৃষ্টিকর্তার আদেশ না থাকলে, DNA-র ভিতর সুনির্দিষ্ট নির্দেশনার চেয়ে মহাবিশ্বে বড় যাদুবিদ্যা আর কি হতে পারে? তোমার চারপাশে ঘটে চলছে অগনিত যাদুবিদ্যা আর তুমি প্রকৃতির দোয়াই দাও? পুথিগত বিদ্যা “কিভাবে হয়” তার ব্যাখ্যা করে কিন্তু “কেন হয়” সেই জবাব নেই। “কেন” ইহা বিজ্ঞানের সীমানার বাহিরে। উন্মাদ হয়ে অন্তরে অদৃশ্য নৃত্য পরিবেশনের সহিত যৌনতার স্বাদ গ্রহণ কর কিন্তু কিভাবে সেই স্বাদ তোমার ভিতর পরিপূর্ণ হয়? কোথায় পরিপূর্ণ হয়? কিভাবে সেই স্বাদ স্থাপিত হয়েছে? প্রকৃতি আপনা-আপনি করে ফেলে? এ সবই সৃষ্টিকর্তার আদেশ এবং অগণিত সূক্ষ্ম আদেশ মহাবিশ্বে ও তোমার ভিতর ছড়িয়ে রয়েছে। তিনি শূন্য থেকে তোমাকে এবং মহাবিশ্বকে অস্তিত্বে অনয়ন করেছেন। নিজের “আমি”-কে নিয়ে চিন্তা কর। তোমার “বিবেক” সৃষ্টিকর্তার মহত্ব ও প্রশংসা-র উদ্দেশ্যে সিজদার ভিতর বিদ্ধ হবে। সৃষ্টিকর্তা সর্ব বিষয়ের উপর সর্ব শক্তিমান।

সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টির নিদর্শন তোমাকে বেষ্টন করে আছে। চারপাশের যা অবলোকন করছ তা “এমনি-এমনি” তৈরি হয়ে যায় নি। যে পবিত্র সত্তা তোমাকে তৈরি করেছেন, তিনি উদ্দেশ্যহীন করে তোমাকে তৈরি করেন নি আর তোমাকে এমনি-এমনি ছেড়ে দেওয়া হবে না। তোমাকে দেওয়া হয়েছে চিন্তাশক্তি, বিবেক ও বুদ্ধি। তোমাকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে স্বাধীন ইচ্ছাশক্তির ভিতর। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত চলছে কর্ম। আর সেই কর্ম লিপিবদ্ধ হচ্ছে। প্রত্যেকে কি উপার্জন করছে নিজ কর্ম থেকে? শরীর, অন্তর, মন, প্যারামিটার কোন কিছুই তোমার নিজের নয়, সবই সৃষ্টিকর্তার আমানত। সবাইকে সবার আমানত সম্পর্কে জিজ্ঞেসিত করা হবে। ইহাই পরীক্ষা; এই পরীক্ষার জন্যই সৃষ্টিকর্তা মানুষ সৃষ্টি করছেন, কর্মে কে শ্রেষ্ঠ? আল্লাহ্‌ এই জন্যই রাসূল পাঠিয়েছেন সবাইকে এই সতর্ক করার জন্য এবং কোরআনের মাধ্যমে নির্দেশ দিয়েছেন কিভাবে জীবন নির্বাহ করতে হবে। আল্লাহ্-র সাথে শরীক করতে নিষেধ করছেন। অহংকার, খেয়ালখুশি, অজ্ঞতা, আত্মতৃপ্তি, মায়া এবং মায়ার বাঁধনে আবদ্ধ হয়ে নিজের বাপ-দাদা থেকে প্রাপ্ত ধর্ম বা সৃষ্টিকর্তায় অস্বীকার, পক্ষপাতিত্ব ইত্যাদি এবং অন্য যে সকল কারনের কারনে সত্যকে অস্বীকার কর, মোহাম্মদ(সা)-কে রাসূল মেনে নিতে প্রত্যাখ্যান কর, তবে জেনে রাখ যার উপর দাঁড়িয়ে আজ নিজ সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছ, এর কোনটিই তোমার নিজের নয়; ইহা ফাঁদ; মহা ফাঁদ। মৃত্যুর সাথে নিজ সত্তা “আমি” থেকে অন্তর, অন্তর থেকে অন্তরের প্যারামিটার, মন এবং অন্তর ও অন্তরের প্যারামিটার থেকে শরীর তারপর সারাজীবনের কর্ম(আমলনামা) অর্থাৎ সকল পোশাক একটার পর একটা তোমার সম্মুখে তোমাকেই পৃথক করে খোলা হবে। “আমি” এবং জীবনের সকল রহস্য তোমার সামনেই স্পষ্ট করা হবে। এই স্বচ্ছতা বা স্পষ্টতা কেহ দুনিয়ার জীবনে আত্মসাধণা ও চারিত্রিক বিশুদ্ধতার সহিত অর্জন করে সৃষ্টিকর্তার সাহায্যে আবার কেহ নিজ ইন্দ্রিয় সুখের গোলাম হয়ে দূরে সরে থাকে। “সকল নবী-রাসুলগণ ক্ষমতাকে পাওয়ার উদ্দেশ্যে, যৌনতার আকাঙ্ক্ষায়, অর্থের আধিক্য, খ্যাতির জন্য নিজেদের ধর্ম প্রচার করেছেন”- তোমাদের এমন দাবী নবী-রাসুলদের চরিত্রের সহিত মানানসই নয়। তাদের কর্ম জীবন তোমাদের সামনে প্রকাশ্যমান।

উত্তম চরিত্র বা সিরাতা’ল মুস্তাকি’-মের সকল গুণ নিজ স্বভাবে প্রতিষ্ঠিত কর, তারপর মোহাম্মদ(সা)-কে ভুল বলার সাহসী হও। তবেই সারা দুনিয়া তোমার বক্তব্য শুনবে, দেখবে এবং গ্রহণ করবে।


PART-H
======
শেষ কথাঃ
দুনিয়ার গোয়েন্দা সংস্থাগুলো, বিজ্ঞানীগণ, বিজ্ঞ মনিষীগন, চিন্তাশীলরা দায়িত্বে অতিশয় দক্ষ, কর্তব্যে অবিচল এবং যে কোন বিষয়ের জটিল রহস্য উদঘাটন করতে পারদর্শী কিন্তু ধর্মের প্ল্যাটফর্মে সত্যতা যাচায়ে তারা দূর্বল, অসহায় এবং নীরব। এর কারন? কারন, ধর্মের প্ল্যাটফর্মে রহস্য ও সত্যসহ প্রমান উদঘাটন হয় “চারিত্রিক বিশুদ্ধতা”-র দ্বারা। আর এই সত্যতা যাচায়ে দুনিয়ার মানুষজন নিষ্পত্তি ও সত্যকে মোকাবিলা করতে অপারগ। ধৈর্যের চরমতা অর্জন অত্যন্ত সাহসের কাজ আর দুনিয়ার গোয়েন্দা সংস্থাগুলো, বিজ্ঞানী, নোবেল বিজয়ীসহ দুনিয়ার সকল মানুষজন এই সাহসের কাছে হেরে বসে আছে। চারিত্রিক বিশুদ্ধতার অনুশীলন করলে দুনিয়ার সকল নবী-রাসুলগণের সত্যতা অনুধাবনের মাধ্যমে স্পষ্ট হয়।

মোহাম্মদ(সা) তাঁর জীবনে যদি জেনেশুনে একটি মিথ্যা বলেন- তাহলে তিনি আর রাসূল থাকেন না। একটি “মিথ্যা”-ই যথেষ্ট তাঁকে রাসূল থেকে খারিজ এবং ইসলাম ধর্মের সাথে খৃষ্টান, ইহুদী ধর্ম দুনিয়া থেকে বিলুপ্তি হওয়ার। মোহাম্মদ(সা)-র জীবনীতে মিথ্যার অস্তিত্ব আছে বা নেই, তা বুঝার রাস্তা হলো উত্তম চরিত্র বা সিরাতা’ল মুস্তাকি’ম নিজ স্বভাব ও চরিত্রে প্রতিষ্ঠিত করা। প্রানকে যেমন শ্বাসপ্রশ্বাসের সাথে বেঁধে দুনিয়ায় বাঁচিবার উপায় করা হয়েছে তেমনি চারিত্রিক বিশুদ্ধতার সহিত সত্যকে বেঁধে দেওয়া হয়েছে।

মা-বাবা, পরিবার, বিজ্ঞানী, শিক্ষক, গুরু, পীর-দরবেশ, লাইব্রেরী, মিডিয়া, বন্ধু… কেহ “সত্য”-কে অর্জন বা শিখিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে না আর ইহা বিজ্ঞানেরও বিষয় নয়। ধর্ম হচ্ছে আচরণ। নিশ্চয়ই দুনিয়ার সকল মানুষজনদের চিন্তার ক্ষেত্র ও অন্তরের পবিত্রতার সহিত মর্যাদা(ব্যক্তিত্ব)-র স্তর ভিন্ন। মূর্খ ও নির্বোধেরা কখনই প্রজ্ঞাবানদের সমকক্ষ নয় তেমনি সমকক্ষ নয় শান্তিপ্রিয়দের সাথে প্রবৃত্তি পূজারীদের।

মৃত্যুর স্বাদ সকলেই গ্রহণ করিবে এবং খুব অল্প সময়ের ব্যবধানে সত্য-কে চাক্ষুষ দেখিবে যে সত্যকে সন্দেহ করিত। আশ্চর্য রকম বুদ হইয়া দেখিবে নিজের “আমি”-কে ও নিজ জীবনের সকল কর্মগুলোকে। পরিষ্কার হবে সকল নবী-রাসূলগণের উদ্দেশ্য; আরও পরিষ্কার হবে নিজেদের খেয়ালখুশি, ঠাট্টা, তামাশা। কু-প্রবৃত্তির তাড়নায় এবং এর ফাঁদে পা দিয়ে আত্মপ্রতারণা করে নিজের সর্বনাশ ও ধ্বংস করো না। “সত্য” তুমি নিজে যা প্যারামিটারের সহিত তোমার চিন্তা ও কর্মের সাথে মজবুত ভাবে বেঁধে দেওয়া হয়েছে। জেনে রাখ, সৃষ্টিকর্তার পাকড়াও অতীব সূক্ষ্ম, অত্যন্ত কঠিন এবং মজবুত। যার ইচ্ছা সে তার পালনকর্তার কাছে ঠিকানা তৈরি করুক।

নিজ সিদ্ধান্তের দোষে কিংবা পারিবার ও অন্যদের মতাদর্শ গ্রহণ করে বিশ্বাসকে আঁকড়ে ধরার ভুলে মৃত্যুর পর “বিশ্বাস” বা নিজ “সিদ্ধান্ত” মিথ্যা হলে যেন পিতামাতা বা অন্যকে দোষারূপ কিংবা নিজ কর্ম ও চিন্তার জন্য আফসোসের কারন না হয়।

ইহা একই কথা- তোমাকে উপদেশ দেওয়া হোক কিংবা মনে করিয়া রাখ।

****

সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে মে, ২০২৩ বিকাল ৫:৫১
২টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

সৎ মানুষ দেশে নেই,ব্লগে আছে তো?

লিখেছেন শূন্য সারমর্ম, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১:৪৮








আশেপাশে সৎ মানুষ কেমন দেখা যায়? উনারা তো নাকি একা থাকে, সময় সুযোগে সৃষ্টিকর্তা নিজের কাছে তুলে নেয় যা আমাদের ডেফিনিশনে তাড়াতাড়ি চলে যাওয়া বলে। আপনি জীবনে যতগুলো বসন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

গরমান্ত দুপুরের আলাপ

লিখেছেন কালো যাদুকর, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৫৯




মাঝে মাঝে মনে হয় ব্লগে কেন আসি? সোজা উত্তর- আড্ডা দেয়ার জন্য। এই যে ২০/২৫ জন ব্লগারদের নাম দেখা যাচ্ছে, অথচ একজন আরেক জনের সাথে সরাসরি কথা... ...বাকিটুকু পড়ুন

রাজীব নূর কোথায়?

লিখেছেন অধীতি, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৩:২৪

আমি ব্লগে আসার পর প্রথম যাদের মন্তব্য পাই এবং যাদেরকে ব্লগে নিয়মিত দেখি তাদের মধ্যে রাজীব নূর অন্যতম। ব্যস্ততার মধ্যে ব্লগে কম আসা হয় তাই খোঁজ-খবর জানিনা। হঠাৎ দু'একদিন ধরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বৃষ্টির জন্য নামাজ পড়তে চায়।

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৩৮



ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষার্থী গত বুধবার বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে বৃষ্টি নামানোর জন্য ইসতিসকার নামাজ পড়বে তার অনুমতি নিতে গিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এটির অনুমতি দেয়নি, যার জন্য তারা সোশ্যাল... ...বাকিটুকু পড়ুন

=তুমি সুলতান সুলেমান-আমি হুররাম=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:৩৬



©কাজী ফাতেমা ছবি

মন প্রাসাদের রাজা তুমি, রাণী তোমার আমি
সোনার প্রাসাদ নাই বা গড়লে, প্রেমের প্রাসাদ দামী।

হও সুলেমান তুমি আমার , হুররাম আমি হবো
মন হেরেমে সংগোপনে, তুমি আমি রবো।

ছোট্ট প্রাসাদ দেবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×