“ওস্তাদ, বামে গর্ত, ডানে ৬ নাম্বার। আস্তে যান। ৬ নাম্বার চাপ দিলে আপনে, আমি দুইজনেই গর্তে পড়ুম!” আফসোস! ওস্তাদ আমার কথা শুনতে পায় না। তার বদলে শোনে ইঞ্জিনের ঘড় ঘড় আওয়াজ।
আমাকে আপনারা রোজই দেখেন। আমি সবুজ জামা পড়ি আর আমার ওস্তাদ পরে নীল রঙের শার্ট। চিনতে পারলেন, আমি কে? ঠিক ধরেছেন, আমার নাম সি,এন,জি। আপনারা রাস্তায় দাঁড়িয়ে ডাকেন, “ঐ সি,এন,জি! যাবা?”, তখন খুব দুঃখ পাই, জানেন! আমাকে ডাকেন, আমি জবাবও দেই। কিন্তু আপনারা শুনতে পান না । শুধু আপনারা কেন, জীবন্ত কোনও কিছুই শুনতে পারে না আমাদের কথা। শোনে শুধু আমার জ্ঞাতিভাইরা। সিগন্যালে বসে বসে আমরা একে অন্যের সাথে সুখ-দুঃখের আলাপ করি। আপনারা জানতে পারেন না। অবশ্য সুখ-দুঃখের কথা শুধু সি,এন,জি ভাইদের সাথেই হয়। বাসের পাশে দাঁড়ালে চুপ করে থাকা লাগে। চুপ না থেকে উপায় আছে? কথা বলতে গেলেই ধমক দেয় না! আর প্লাস্টিক মানে প্রাইভেট কারগুলার কথা আর নাই বা বললাম। দেমাগে ওগুলার তো মাটিতে চাকাই পড়ে না! অবশ্য ধমক আমরাও যে মারি না , তা না। রিকশাগুলা দেখলে সেই সুযোগ ছাড়ে কে?
বড়ই আজব লাগে। সি,এন,জি হলাম আমরা আর আপনারা আমাদের ওস্তাদদের ডাকেন ‘সি,এন,জি’ বলে। কেউ বলেন না, “ঐ সি,এন,জিওয়ালা ! যাবা?”
আরেকটা জিনিস বড়ই অপছন্দ। সেইটা অবশ্য আমার ওস্তাদের। আপনারা যেখানেই যেতে চান, আমার ওস্তাদ বেশীরভাগ সময় বলে, “ যামু না!” ক্যান? গেলে কি হয়? কত্ত নতুন নতুন জায়গায় ঘুরতে পারতাম! আমার আবার ঘুরতে খুব ভালো লাগে।
হেডলাইট লাগানোর পর থেকে (আপনারা যাকে ‘ জ্ঞান হওয়ার পর থেকে ’ বলেন আর কি ) এই পর্যন্ত আমি তিনটা ওস্তাদ পেয়েছি। প্রথমজন খুব ভালো মানুষ ছিল। কখনও কোনও প্যাসেঞ্জারকে ‘না’ বলেনি, মিটারে যা ওঠে তার থেকে এক টাকাও বেশি নেয়নি কখনও। ওস্তাদের যখন মেয়ের বিয়ে ঠিক হল, অনেক টাকার দরকার তখন, সেসময়ও বেশি ভাড়া নেয়নি কখনও। দিন হিসাবে মালিককে যত দেওয়া লাগতো, সারাদিন আমাকে চালিয়েও সেটা উঠতো না। এভাবে বকেয়া বাড়তে বাড়তে একদিন মালিক ওস্তাদকে ছাটাই করে দিল। শুনেছি সে দেশে চলে গেছে। জমি বিক্রি করে একটা মুদি দোকান দিয়েছে। ওস্তাদ, আপনি ওখানেই ভালো আছেন। এই শহর আপনার জন্য না।
তারপর পেলাম এক রঙ্গিলা ওস্তাদ। মন তার বড়ই ফুরফুরা। গলায় লাল রঙের একটা রুমাল বাঁধতো। আর রাস্তা দিয়ে যত মেয়ে যেত সবার দিকে একবার করে হলেও তাকাতো। এই ওস্তাদ অবশ্য মিটারের থেকে ২০/৩০ টাকা বেশি নিত। সেও প্যাসেঞ্জারদের কখনও ‘না’ বলতো না। তবে সেটা শুধুমাত্র মেয়ে প্যাসেঞ্জারদের বেলায়। একদিন এক মাস্তান টাইপ ছেলে এসে ওস্তাদকে কুবুদ্ধি দিল, মলম পার্টি। রাতে কোনও টাকা-পয়সাওয়ালা প্যাসেঞ্জার পেলে এরা চোখে মলম লাগিয়ে , সবকিছু কেড়ে নিয়ে নিরিবিলি রাস্তায় ফেলে রেখে যেত। এভাবে চলতে চলতে একদিন এরা ধরা পড়ে যায়। মলম পার্টির লোকগুলোসহ ওস্তাদকে জেলে পাঠিয়ে দেয়।
সবশেষে পেলাম এখনকার ওস্তাদকে । তার কথা আর কি বলবো। পছন্দমত জায়গা না হলে যায় না। দরকার হয় সারাদিন আমারে নিয়ে বসে থাকবে, তবু যাবে না। আর মিটারে যা উঠে ভাড়া চায় তার থেকে ১০০-১৫০ টাকা বেশি। এদের জন্য কত গালি যে শুনতে হয়! অবশ্য প্যাসেঞ্জাররা আমাদের গালি দেয় না, গালি দেয় ওস্তাদকে। কিন্তু তার কিছুটা হলেও তো আমাদের গায়ে এসে লাগে।
এভাবেই চলছে। প্রতিদিন কত কিসিমের যে প্যাসেঞ্জার ওঠে। সবার কথা বলতে গেলে বছর পার হয়ে যাবে।
ঐ তো, আরেকজন আসছে এদিকে। ওস্তাদের জায়গা পছন্দ হলে রওনা দেওয়া লাগবে। অবসর পেলে আপনাদেরকে প্যাসেঞ্জারদের গল্প শোনাবো কোনও একদিন।
আর বড় গাড়ির ওস্তাদেরা, আমাদের উপর একটু মায়া-দয়া করে চলেন। ছোট হলেও আমাদেরও তো জান আছে। যেভাবে তেড়ে আসেন, তাতে জান বের হয়ে যেতে চায়।
গেলাম। সবাই সাবধানে চলেন। আর পথচারী ভাইরা, আপনারা একটু ফুটপাথ, ওভারব্রীজ ব্যবহারে অভ্যস্ত হন।
বিদায়!
ছবিঃ গুগল আংকেল
( লিখতেও আর ভালো লাগে না আজকাল। অনেকদিন পর কিছু একটা লিখতে চেষ্টা করলাম। ব্লগ এবং অন্য সবখানে আবার কবে ফিরবো, জানি না। আদৌ ফিরবো কি না , তাও জানি না। )