somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

খালিদের ইয়ারমুখ যুদ্ধ - (কিস্তিঃ চার)

২৭ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ রাত ১২:০৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



কিস্তিঃ১
http://www.somewhereinblog.net/blog/delHkhan/30109019

কিস্তিঃ২
http://www.somewhereinblog.net/blog/delHkhan/30109091

কিস্তিঃ৩
http://www.somewhereinblog.net/blog/delHkhan/preview/30110683

মুসলিম আর্মি জাবিয়া পৌছে গুছিয়ে উঠবার আগেই হেরাক্লিয়াস তার বাইজান্টাইন আর্মি গুলোকে দ্রুত এগিয়ে যাবার নির্দেশ দিলেন। ক্যাসারির বাইজান্টাইন গ্যারিসন অবরোধ বাতিল করে দিয়ে ইয়াজিদ জাবিয়ার পথ ধরতেই ক্যাসারি থেকেও বাইজান্টাইন সৈন্যরা পিছু ধাওয়া করতে চেস্টা করল। সামনে দামেস্কের দিক থেকে আর পেছনে ক্যাসারির দিক থেকে একযোগে বাইজান্টাইন আক্রমনের আশঙ্কায় আবু উবায়দা খালিদের আন্ডারে ৪০০০ ঘোড়সওয়ারের মোবাইল গার্ডকে রিয়ার গার্ড হিসেবে রেখে মুসলিম আর্মি নিয়ে জাবয়া রোড ধরে ইয়ারমুখে শিফট করলেন।

খালিদ যথারীতি তার স্বভাবমত জাবিয়া বসে না থেকে বরং দামেস্কের দিকে এগিয়ে গিয়ে বাইজান্টাইন এডভান্সিং কলামের ভ্যানগার্ডকে আক্রমন করে দামেস্ক অবধি ধাওয়া করে ফিরিয়ে নিয়ে গেলেন। এরপর বাইজান্টাইনরা আর মুসলিম আর্মির জাবিয়া রিডেপ্লোয়মেন্টে কোন বাগড়া দেবার চেস্টা করেনি। সমগ্র মুসলিম আর্মি ইয়ারমুখে ক্যাম্প করার পর খালিদও জাবিয়া ছেড়ে ইয়ারমুখে ফিরে গেল।

ইয়ারমুখ যুদ্ধক্ষেত্রটি গোলান মালভূমির দক্ষিন-পূর্বে গ্যালিলি সাগরের পূর্বে আর ইয়ারমুখ নদীর উত্তরে বর্তমান ইসরায়েল, জর্ডান আর সিরিয়া সীমান্তের সংযোগস্থলে অবস্থিত। যুদ্ধক্ষেত্রের পশ্চিম প্রান্ত ওয়াদিউর রাক্বাদ নামের রাভিন বা গিরিখাত দ্বারা সীমাবদ্ধ যা উত্তর থেকে নেমে এসে দক্ষিনে ইয়ারমুখ নদীতে যোগ দিয়েছে। পূর্বে আজরা হিল ট্র্যাক্টস। পূর্বে জাবিয়া রোড আর পশ্চিমে জর্ডান নদীর শাখা ইয়ারমুখ নদী। ইয়ারমুখ প্রান্তরে দুই আর্মির জন্যই পর্যাপ্ত ঘাস আর পানি ছিল।

অবশেষে জেনারেল ভাহান দ্য আর্মেনিয়ান তার বাইজান্টাইন বহুজাতিক বাহিনী নিয়ে ইয়ারমুখ পৌছে দেখলেন খালিদের মুসলিম আর্মি নিয়ে ইতোমধ্যে ইয়ারমুখের প্রান্তরের পুর্ব প্রান্তে ডানে জাবিয়া রোড আর বামে ইয়ারমুখ নদীর মধ্যবর্তী লাভা গঠিত সমতলে ক্যাম্প করে বসে আছে। খ্রীস্টের জন্মের ৪০০ বছর আগে চৈনিক সমর দার্শনিক সানজু বলে গেছিলেন যে যুদ্ধক্ষেত্রে যে আগে পৌছায়, সে এডভান্টেজে থাকে। খালিদও তেমনি তিনটা এডভান্টেজ নিয়েই যুদ্ধ শুরু করলেন।

প্রথমতঃ খালিদের মুসলিম আর্মি পুর্ব প্রান্তে ক্যাম্প করার ফলে ভাহানের বাইজান্টাইন আর্মি মুসলিম ক্যাম্পের বিপরীতে ইয়ারমুখের প্রান্তরের পশ্চিম প্রান্তে ক্যাম্প করতে বাধ্য হল। পজিশনাল এই এডভান্টেজের ফলে সকাল থেকে দুপুরের আগ পর্যন্ত বাইজান্টাইনদের চোখের ওপর সূর্য থাকত; ব্যাপারটা বাইজান্টাইন তীরন্দাজদের জন্য তো বটেই এমনকি পদাতিক সৈন্যদের জন্যও ছিল বেশ অস্বস্তিকর। পক্ষান্তরে সূর্যের বিপরীতে থাকায় সকাল থেকেই মুসলিম সৈন্যরা প্রতিপক্ষকে স্পষ্ট দেখতে পেত।

দ্বিতীয়তঃ ইয়ারমুখ প্রান্তরের সেন্টারে পর্যাপ্ত ফ্রন্টেজ পেতে গিয়ে বাইজান্টাইনরা পশ্চিম প্রান্তে ওয়াদি উর রাক্বাদ নামের এক গভীর গিরিখাদ পেছনে রেখে ক্যাম্প করতে বাধ্য হল। গিরিখাদটি স্থানে স্থানে প্রায় ২০০ মিটারের মত গভীর আর আইনাল ধাকার এলাকার একটা মাত্র ক্রসিং সাইট ছাড়া ইয়ারমুখের প্রান্তর থেকে পিছিয়ে এই গিরিখাতের ওপারে যাবার আর কোন উপায় ছিলনা। ইয়ারমুখ যুদ্ধের ষষ্ঠদিন এই আইনাল ধাকার বেদখল হয়ে যাবার কারনে বাইজান্টাইনরা দূর্ভাগ্যজনক এনিহিলেশনের শিকার হয়েছিল। অবশ্য আগের পাঁচদিনের বাইজান্টাইন নৃশংশতার কারনে খালিদের নির্দেশও ছিল কোন যুদ্ধবন্দী গ্রহনের ঝামেলায় না যাবার।

তৃতীয়তঃ যুদ্ধক্ষেত্রের পূর্ব প্রান্তে ক্যাম্প করায় খলিফা উমর প্রতিদিন সকালের দিকে ছোট ছোট দলে রিইনফোর্সমেন্ট পাঠাতে লাগলেন। ছোট ছোট এই দলগুলো হৈচৈ আর ঢাক ঢোল পিটিয়ে এমনভাবে এসে মুসলিম ক্যাম্পে যোগ দিত যে সকালের সুর্যের কারনে বাইজান্টাইনরা তাদের সঠিক সংখ্যাটা ঠাহর করতে না পেরে ক্রমেই আরো ফ্রাস্ট্রেটেড হতে উঠত।

বিশাল বাইজান্টাইন আর্মি ক্যাম্প করতেই তাদের জেনারেল ডাইরেকশন অব এটাক আর ফ্রন্টেজ স্পষ্ট হয়ে উঠল; খালিদ এর সাথে সামঞ্জস্য রেখে মুসলিম ডেপ্লয়মেন্ট এডজাস্ট করে নিলেন। তখনকার যুদ্ধের নর্ম অনুযায়ী যুদ্ধের চূড়ান্ত দিনক্ষন (ডি ডে) ফাইনাল হবার আগ পর্যন্ত দু পক্ষই মুখোমুখি অবস্থান নিয়ে নিজ নিজ রেকি, প্ল্যানিং, অর্ডারস আর লজিস্টিক বিল্ডাপে মনোযোগ দিল। এরিমধ্যে ভাহানের কাছে হেরাক্লিয়াসের নির্দেশ এল শান্তিপূর্ন উপায়ে এই ঝামেলা মেটানোর সব উপায় এক্সপ্লোর করার আগেই যেন কোন প্রকার হোস্টাইলিটি শুরু না করা হয়।

প্রথমে বাইজান্টাইন জেনারেল গ্রেগরি এল মুসলিম ক্যাম্পে আবু উবায়দার সাথে দেখা করতে। বাইজান্টাইন প্রস্তাব ছিল লেভান্ট ছেড়ে যেন মুসলিমরা আরবে ফিরে যায়, আর কথা দিতে হবে আর কখনো লেভান্ট দখলের চেস্টা করা হবে না। আবু উবায়দা প্রস্তাব ফিরিয়ে দিলে গ্রেগরি ফিরে গেল শুন্য হাতেই।

ইউরোপিয়ান গ্রেগরির চেয়ে প্রাচ্যদেশীয় জাবালাহ বেশি ফলপ্রসু হবেন ভেবে এরপর ভাহান পাঠালেন জাবালাহ কে, কিন্তু ফলাফল একই। অগত্যা মুসলিম আর্মির স্ট্রেন্থ পরীক্ষা করতে জুলাইয়ের গোড়ার দিকে ভাহান ফের জাবালাহ কে পাঠালেন রেকি ইন ফোর্সে। জাবালাহ মুসলিম ফ্রন্টে পৌছাতেই খালিদের মোবাইল গার্ডের তুমুল আক্রমনের মুখে পড়ে ফিরে এলেন। ভাহান বুঝলেন মুসলিম আর্মি সহজেই পিছু হটবে না।
এরপর আরো মাসখানেক দুই পক্ষই যার যার ক্যাম্পে বসে রইল। হেরাক্লিয়াস চেস্টা করে যাচ্ছিল পার্সিয়ান সম্রাট ইয়াজদেগার্ডকে যুদ্ধে রাজী করাতে, আর মুসলিমরা ধীরে ধীরে শক্তিবৃদ্ধি করছিল আরবের বিভিন্ন প্রান্ত হতে যোদ্ধা এনে এনে।

আগস্টের দ্বিতীয় সপ্তাহের শেষ দিকে ভাহান যুদ্ধ শুরু করার ফাইনাল প্রিপারেশন শুরু করলেন। তার আগে শেষ বারের মত তিনি যুদ্ধ এড়িয়ে আলোচনার মাধ্যমে এ সংকট সমাধানের চেষ্টা করতে তিনি মুসলিম শিবিরে আলোচনার প্রস্তাব পাঠালেন। আবু উবায়দা এবার খালিদকে পাঠালেন বাইজান্টাইন ক্যাম্পে আলোচনার জন্য।

আলোচনার শুরুতেই ভাহান বললেন, “জানি মরুভূমির কষ্টসাধ্য জীবন আর ক্ষুধাই তোমাদের নিজ দেশের বাইরে টেনে আনে বারবার। আমরা তোমাদের জনপ্রতি ১০ দিনার করে দিচ্ছি, দেশে ফিরে যাও। আর আগামী বছরও একই পরিমান অর্থ মদিনায় পাঠিয়ে দেবার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি।

ক্ষুব্দ খালিদ ক্রোধ সামলে বললেন, “আসলে রক্তের পিপাসায় আমরা দেশের বাইরে বেরিয়ে আসি, আর শুনেছি রোমান রক্তের চে সুস্বাদু রক্ত আর হয় না। আমি বরং তোমাকে তিনটা অপশান দিচ্ছি, তোমার পছন্দেরটা তুমিই বেছে নাও। হয় ইসলাম ধর্ম গ্রহন করে মুসলমান হয়ে যায়, নয়ত জিজিয়া কর দিয়ে নিজের মত থাক, কিংবা আর সময় নস্ট না করে অস্ত্রধারন কর আর আমাদেরকে যুদ্ধে পরাজিত কর।”

ভাহান শেষ অপশানটা বেছে নিলেন আর পরদিন সকাল থেকেই যুদ্ধ শুরু হবে বলে কথা দিলেন। “তথাস্তু” বলে খালিদ ভাহানের তাবু থেকে বেরিয়ে মুসলিম আর্মির ক্যাম্পের দিকে পা বাড়ালেন।

(ক্রমশ...)
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ রাত ৮:০৩
১২টি মন্তব্য ১১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

কে কাকে বিশ্বাস করবে?

লিখেছেন অনিকেত বৈরাগী তূর্য্য , ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৩৯


করোনার সময় এক লোক ৯৯৯ এ ফোন করে সাহায্য চেয়েছিল। খবরটা স্থানীয় চেয়ারম্যানের কানে গেলে ওনি লোকটাকে ধরে এনে পিটিয়েছিলেন। কারণ, ৯৯৯ এ ফোন দেওয়ায় তার সম্মানহানি হয়েছে।

সমাজে এমন... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিসিএস পরীক্ষার্থীদের পরীক্ষায় বসতে না পারার কষ্টটা সমালোচনার কোন বিষয়বস্তু নয়

লিখেছেন ঢাবিয়ান, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:৩৬

গতকালের একটি ভাইরাল খবর হচ্ছে কয়েক মিনিটের জন্য বিসিএস পরীক্ষা দেয়া হলো না ২০ প্রার্থীর !! অনেক প্রার্থীর কান্নাকাটির ভিডিও ভাইরাল হয়েছে।এ বিষয়ে পিএসসি চেয়ারম্যান এর নিয়ামানুবর্তিতার জ্ঞান বিতরনের... ...বাকিটুকু পড়ুন

বারবাজারে মাটির নিচ থেকে উঠে আসা মসজিদ

লিখেছেন কামরুল ইসলাম মান্না, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:৪০

ঝিনাইদহ জেলার কালীগঞ্জ উপজেলার বারবাজার ইউনিয়নে মাটির নিচ থেকে মসজিদ পাওয়া গেছে। এরকম গল্প অনেকের কাছেই শুনেছিলাম। তারপর মনে হলো একদিন যেয়ে দেখি কি ঘটনা। চলে গেলাম বারবাজার। জানলাম আসল... ...বাকিটুকু পড়ুন

সৎ মানুষ দেশে নেই,ব্লগে আছে তো?

লিখেছেন শূন্য সারমর্ম, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১:৪৮








আশেপাশে সৎ মানুষ কেমন দেখা যায়? উনারা তো নাকি একা থাকে, সময় সুযোগে সৃষ্টিকর্তা নিজের কাছে তুলে নেয় যা আমাদের ডেফিনিশনে তাড়াতাড়ি চলে যাওয়া বলে। আপনি জীবনে যতগুলো বসন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

পরিবর্তন অপরিহার্য গত দেড়যুগের যন্ত্রণা জাতির ঘাড়ে,ব্যবসায়ীরা কোথায় কোথায় অসহায় জানেন কি?

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৩:৫৭


রমজানে বেশিরভাগ ব্যবসায়ীকে বেপরোয়া হতে দেখা যায়। সবাই গালমন্দ ব্যবসায়ীকেই করেন। আপনি জানেন কি তাতে কোন ব্যবসায়ীই আপনার মুখের দিকেও তাকায় না? বরং মনে মনে একটা চরম গালিই দেয়! আপনি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×