যে কয়েকজন শিল্পীর শিল্পকর্মকে একান্তই বাংলাদেশের বলে দাবি করা যায় তার মধ্যে এস.এম. সুলতানের নাম সবার প্রথম দিকে আসে।একান্তই বাংলাদেশের জল-হাওয়াতেই সুলতানের শিল্পকর্মের পরিপুষ্টি।এস.এম. সুলতানের জীবন অনেকটা মিথের মতো। এই মহান শিল্পীর জীবনের অনেক কিছুই এই আধুনিক, শহুরে জীবনে বেড়ে উঠা মানুষজন জানে না।
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এর ' কাব্য পড়ে যেমন ভাবো কবি তেমন নয় গো' পঙক্তিকে এস. এম. সুলতান এর শিল্প ও শিল্পী-জীবনের একাত্নতা মিথ্যা প্রতিপন্ন করেছে।সুলতানের ক্ষেত্রে বিষয় এবং বিষয়ী, এ দুইয়ের কোনো ফারাক নেই।সুলতান অনেকটা স্বেচ্ছা নির্বাসন নিয়েছিল। তিনি ভাংগা, পুরোনো,জরা-জীর্ণ বাড়িতে বিড়াল, মুরগি,সাপ,বেজী ইত্যাদির পশু পাখির সাথে বসবাস করতেন। আর্থিক মোহ তাঁকে কখনোই ছুঁতে পারেনি। তাঁর আঁকা ছবি যেমনটা উচ্চবিত্ত পরিবারের দেয়ালের শোভা বাড়িয়েছে,তেমনি গ্রামের খেটে খাওয়া কৃষকের ঘরের বেড়া হিসেবে অন্তঃপুরের দৈন্যতাকে ঢেকে দিয়েছে। এখানেই সুলতানের চিত্রশিল্পের সার্বজনীনতা।
১৯২৩ সালের ১০ আগস্ট নড়াইলের চিত্রানদী ঘেষা মাছিমদিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন শেখ মোহাম্মদ সুলতান। রাজমিস্ত্রি পিতা মেছার মিঞা তাঁর নাম দেন লাল মিঞা। তবে এস. এম. সুলতান নামটি দিয়েছিলেন তখনকার বিখ্যাত চিত্রকলা সমালোচক ও বুদ্ধিজীবী শাহেদ সোহরাওয়ার্দী। এই লাল মিঞাই এক সময়ে সুলতান হয়ে উপমহাদেশের শ্রেষ্ঠ চিত্রশিল্পী হিসেবে নন্দনকলায় বিজেতা হিসেবে স্থান করে নিয়েছিলেন।সুলতান ভিক্টোরিয়া এমবেংকমেনক এ অনুষ্ঠিত বিশিষ্ট সমকালীন শিল্পীদের যৌথ প্রদর্শনীতে অংশ নেন।তিনিই এশিয়ার একমাত্র শিল্পী যার শিল্পকর্ম পাবলো পিকাসো, সালভেদর ডালি, ব্রাক ও পল ক্লি প্রমুখ এর মতো খ্যাতিমান শিল্পীদের ছবির সাথে প্রদর্শনীতে একসাথে স্থান পায়।
সুলতানের আপাত সরল চিত্রকলার বর্ণনাধর্মী চরিত্র মিথের উপাদানে সমৃদ্ধ হয়ে এক ধরণের এপিক-ব্যঞ্জনা সৃষ্টি করে।এই এপিক-ব্যঞ্জনা সম্ভব হয়েছে কৃষিপ্রধান বাঙালি জাতিগোষ্ঠীর নৃ-তাত্তিক বিমূর্তায়ন সৃষ্টির মধ্য দিয়ে।সুলতানের ছবির কৃষক কোন সাধারণ কৃষক নয়; প্রায় উলঙ্গ কৃষকের গ্রন্থিল পেশি তাদের দেহমনের দৃঢ়তাকেই বিধৃত করে। সুলতানের নারীর অবয়বগুলো অপলব ও সুকঠিন; বাঙালি নারী বলতেই যে কোমলতা ও রোগাটে ভাব তার সম্পূর্ণ বিপরীত ছবি এঁকে দেখিয়েছেন সুলতান। তাঁর ছবির নারী ও পুরুষ উভয়ই বিশালদেহী,স্বাস্থ্যবান, সবল ও গ্রন্থিল পেশিবহুল। মায়াবী তুলির স্পর্শে সুলতান তাঁর আখ্যানমূলক ফিগারেটিভ চিত্রকে মার্গীয় মাত্রা দান করেছেন। তাঁর পেইন্টিং এর আর একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হলো তাঁর পেইন্টিংগুলো ফিগারেটিভ। যেখানে পিকাসো ফিগারেটিভ থেকে নন-ফিগারেটিভ ফর্মে স্থানান্তরিত হয়েছিল ,সেখানে সুলতান নন-ফিগারেটিভ থেকে ফিগারেটিভ ফর্মে স্থানান্তরিত হয়েছিল।আর এখানেই সুলতান অনন্য। তিনি মনে প্রাণে বিশ্বাস করতেন এবং মানতেন যে শিল্প যদি সহজ,সরল ও বোধগম্য না হয়,তবে শিল্প শুধুমাত্র মুষ্টিমেয় লোকের বিনোদনের খোরাক হয়ে থাকবে। তাঁর ছবিগুলো তাই অত্যন্ত সরল আর যেকোন শ্রেণীর নিকট তা বোধগম্য।গ্রামের কোন রান্নাঘরে মাছ কাঁটার দৃশ্য কিংবা আংগিনায় নিত্যনৈমিত্তিক কাজকর্মের দৃশ্য তাঁর ছবিকে জনসাধারণের জীবন-সূতিকাগার এর আসন দিয়েছে। তাঁর ছবির বলদ বা গরুকে দেখে কৃষক অনায়াসে বলে দিতে পারবে গরুটি বা বলদটি তার অথবা কোন লাউয়ের মাঁচা দেখে গৃহস্থ অসংকোচে বলে দিতে পারবে এ তারই লাউয়ের মাঁচা। তাঁর শিল্পের ফর্ম আধুনিক নয় কিন্তু বিষয়বস্তু আধুনিক।আজীবন তিনি এক ইউটোপিয়ার সন্ধ্যানে ব্যাপৃত ছিলেন।
সুলতান ছিলেন চিরকুমার। তবে সুলতানের জীবনেও প্রেম এসেছিল এবং শেষ জীবনে এসেও সে তাঁর প্রেমিকাকে দেখার জন্য ব্যাকুল হয়ে গিয়েছিলেন। তাঁর প্রেমিকার নাম ছিল অরোরা। অরোরা ছিলেন সুলতানের গুরুপিতা রংগলাল দাশের বড় মেয়ে।সুলতানের আঁকা ছবি মূর্ত হয়ে উঠতো অরোরা হাতের সেলাইয়ের অপূর্ব কারুকার্যে।অরারার অন্যত্র বিয়ে হয়ে যাওয়া সুলতানের জীবনের টার্নিং পয়েন্ট ছিলো। তাঁর সময় কিছুতেই কাটতো না। আর এই শূণ্যতা থেকেই সুলতানের কলকাতার আর্ট কলেজে পড়ার বাসনা জাগে। যদিও সে মাত্র তিন বছর পর আর্ট কলেজ ছেড়ে দিয়েছিলেন। সুলতানের তেমন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা না থাকলেও সুলতান যে কোন প্রতিষ্ঠানের চেয়ে কম নয় তা বললে ভুল হবে না।
চিত্রকলায় অবদানের জন্য সুলতান দেশ-বিদেশের অনেক পুরস্কার এ ভূষিত হয়েছেন। ১৯৮২ সালে কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাঁকে এশিয়ার ব্যক্তিত্ব হিসেবে ঘোষণা করে।এছাড়াও তিনি একুশে পদক (১৯৮২), চারুশিল্পী সংসদ সম্মান (১৯৮৫) ও বাংলাদেশ সরকারের সর্বোচ্চ সম্মান স্বাধীনতা দিবস পুরস্কারসহ (১৯৯৪) আরো অসংখ্য পুরস্কার লাভ করেছেন।
হত্যাযজ্ঞ, চরদখল এবং প্রথম বৃক্ষরোপণ সুলতানের বিখ্যাত শিল্পকর্ম।
১৯৯৪ সালের ১০ অক্টোবর যশোরে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে এ মহান শিল্পী মৃত্যুবরণ করেন।
শিল্পী এস.এম. সুলতান তাঁর অবিনশ্বর শিল্পকর্মের জন্য আজীবন বেঁচে থাকবেন আমাদের স্মৃতির মণিকোঠায়। তাঁর ব্যক্তি স্বাধীনতাবোধ অনেক মানুষের জন্যই অনুকরণীয়।
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই আগস্ট, ২০১৬ ভোর ৪:৩৫