somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আজব দেশের গজব আইন

১৬ ই জুলাই, ২০১৪ রাত ১১:১৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

এক আজব দেশের কথা বলছি, যেই দেশে
->আপনি যদি মদ খেয়ে মাতাল হয়ে কারো বাড়িতে প্রবেশ করে (trespass) কাউকে বিরক্ত বা উত্যক্ত করেন, তাহলেপেনালকোডের ৫১০ ধারা অনুযায়ী আপনার শাস্তি হবে সর্বোচ্চ ২৪ ঘন্টার জেল বা ১০ টাকা জরিমানা বা উভয় দন্ড (বিজ্ঞ আদালতের মতানুসারে সর্বনিম্ন শাস্তি আরো কম হতেই পারে)।
কিন্তু আপনি যদি অনলাইনে এমন কিছু প্রকাশ করেন, যা ‘মিথ্যা ও অশ্লীল বা সংশ্লিষ্ট অবস্থা বিবেচনায় [এমনকি প্রাপ্তবয়ষ্ক] কেহ পড়িলে, দেখিলে বা শুনিলে নীতিভ্রষ্ট বা অসৎ হইতে উদ্বুদ্ধ হইতে পারেন’, তাহলে সংশোধিত আইসিটি আইন অনুসারে আপনার শাস্তি হবে সর্বোনিম্ন ৭ বছর থেকে সর্বোচ্চ ১৪ বছরের জেল এবং অনধিক এক কোটি টাকা জরিমানা!

->আপনি যদি কোন দাঙ্গা বা রায়টে যোগ দিয়ে সরাসরি কোন সহিংসতায় অংশগ্রহণ করেন, তাহলে আমাদের পেনালকোডের ১৪৭ ধারা অনুসারে আপনার সর্বোচ্চ শাস্তি হবে ২ বছরের জেল।
এই দাঙ্গায় আপনি যদি এমন কোন মরণাস্ত্র নিয়ে বের হন যা দ্বারা কাউকে হত্যা করা সম্ভব, তাহলে পেনালকোডের ১৪৮ ধারা অনুসারে আপনার সর্বোচ্চ শাস্তি হবে ৩ বছরের জেল (সর্বনিম্ন শাস্তি বিজ্ঞ আদালত নির্ধারণ করবেন)।
কিন্তু আপনি যদি ‘ওয়েব সাইটে বা অন্য কোন ইলেক্ট্রনিক বিন্যাসে’ এমন কিছু প্রকাশ করেন যা থেকে আইন শৃঙ্খলার অবনতি ঘটার ‘সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়’, তাহলে আইসিটি আইন অনুসারে আপনার শাস্তি হবে সর্বোনিম্ন ৭ বছর থেকে সর্বোচ্চ ১৪ বছরের জেল এবং অনধিক এক কোটি টাকা জরিমানা!

->আপনি যদি কোন ভাবে কাউকে চিঠি লিখে বা ফোন করে বা সরাসরি হত্যা করার বা ব্যপক ক্ষতিসাধন করার হুমকী প্রদান করেন, তাহলে পেনালকোডের ৫০৬ ধারা অনুসারে তার শাস্তি সর্বোচ্চ ২ বছর, আর যদি এই হুমকী বেনামে করে থাকেন, তাহলেপেনালকোডের ৫০৭ ধারা অনুসারে শাস্তি সর্বোচ্চ আরো ২ বছর। কিন্তু আপনার অনলাইন কোন লেখাকে কেউ যদি ‘উস্কানী’ হিসেবে নিয়ে থাকে, তাহলে আইসিটি আইন অনুসারে আপনার শাস্তি হবে সর্বোনিম্ন ৭ বছর থেকে সর্বোচ্চ ১৪ বছরের জেল!

->অথবা, আপনি যদি মুদ্রিত কোন মাধ্যমে কিছু প্রকাশ করে বা অন্য যে কোন উপায়ে কারো মানহানি করেন বা কুৎসা রটনা, তাহলেপেনালকোডের ৫০০ ধারা অনুসারে আপনার সর্বোচ্চ শাস্তি হবে ২ বছরের জেল (এবং সর্বনিম্ন শাস্তি বিজ্ঞ আদালত নির্ধারণ করবেন)।
কিন্তু অনলাইনে আপনার কোন লেখায় কেউ যদি প্রমাণ করে যে তার মানহানি ঘটেছে, তাহলে সংশোধিত আইসিটি আইন অনুসারে আপনার শাস্তি হবে সর্বোনিম্ন ৭ বছর থেকে সর্বোচ্চ ১৪ বছরের জেল এবং অনধিক এক কোটি টাকা জরিমানা!
শুধু তাই নয়, সর্বোনিম্ন শাস্তি নির্ধারণে বিজ্ঞ আদালতের ক্ষমতা সীমিতও করা হয়েছে। এছাড়া, গ্রেফতারের অনুমতি ও জামিন দেয়ার ক্ষমতা রহিত করে আদালতের ক্ষমতা ব্যাপক ভাবে খর্ব করা হয়েছে বলে প্রতীয়মান হতে পারে।
সে আজব দেশ হচ্ছে মদীনা-সনদ অনুযায়ী চলা গনপ্রজাতন্ত্রী ডিজিটাল বাংলাদেশ।

আমাদের একটা আঞ্চলিক প্রবাদ আছে- ‘হাগল বেটির লাজ নাই দেখল বেটির লাজ’
অর্থাৎ যে খোলা জায়গায় পায়খানা করে তার লজ্জা করে না কিন্তু যে এহেম কান্ডটি দেখেছে লজ্জা তার।

তেমনি
বাংলাদেশে মাতাল হয়ে অন্যের সম্পত্তিতে অনুপ্রবেশ করে কাউকে উত্যাক্ত করা কিংবা অন্যকোন ভাবে কারো মানহানি করা কিংবা মরণাস্ত্র হাতে সহিংস দাঙ্গায় যোগ দেয়ার অপরাধের চেয়ে এখন অনলাইনে লেখালেখি করা বহুগুন বেশি শাস্তিযোগ্য অপরাধে পরিণত হতে যাচ্ছে। শুধু তাই নয়, অনলাইনে লেখালেখি সংক্রান্ত অভিযোগসমূহকে ‘আমলযোগ্য’ ও ‘অ-জামিনযোগ্য’ করায় এ অপরাধে কাউকে গ্রেফতারের জন্য আদালতের কোন ওয়ারেন্টের প্রয়োজন হবেনা, নিরাপরাধ প্রমাণিত হওয়ার আগ পর্যন্ত কোন জামিনও মিলবে না, এবং লেখালেখি সংক্রান্ত অভিযোগ যত ক্ষুদ্রই হোক, প্রমাণিত হলে এর সর্বোনিম্ন শাস্তি হবে ৭ বছরের জেল এবং অনধিক এক কোটি টাকা জরিমানা!
আপনি যদি ওয়েব সাইটে বা অন্য কোন ইলেক্ট্রনিক বিন্যাসে’, অর্থাৎ ব্লগ, ফেসবুক বা ইউটিউবে কখোনও কিছু প্রকাশ বা সম্প্রচার করে থাকেন, তাহলে আপনিও পড়তে পারেন এই ডিজিটাল ‘একুশে আইনের’ ফাঁদে।
২০০৬ সনের অক্টোবরে তৎকালীন বিএনপি সরকার মেয়াদের শেষপ্রান্তে এসে ‘তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন ২০০৬’ নামে একটি আইন করেছিল, যার হাস্যকর ৫৭ ধারাটি নিয়ে আগেও লেখা হয়েছে। বর্তমান বহুদলীয় আওয়ামী লীগ সরকার তার বিগত মেয়াদের ঠিক শেষ প্রান্তে এসে সেই হাস্যকর ধারাটিকেই সংশোধনের নামে আরো ভয়াবহ করে ফেললো।

এটা ঠিক যে ব্লগ, ফেসবুক বা অনলাইনপত্রিকার নামে যা কিছু একটা ছাপিয়ে কাউকে হেনস্তা করা বা দেশে অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টি করা যাদের উদ্দেশ্য, তাদের প্রতিরোধ করার জন্য আইনি কাঠামো সংশোধন, তথ্যপ্রযুক্তির উপর প্রশিক্ষণ ও অবকাঠামোগত সামর্থ্যবৃদ্ধির প্রয়োজন অবশ্যই আছে। কিন্তু ‘তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন ২০০৬’ –এর ৫৭ ধারায় যে ভাবে অপরাধের ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে, তা এই অপরাধ দমনে ভুমিকা রাখবে না। উপরন্তু এই ধারায় আনীত অভিযোগকে সংশোধন করে একে আমলযোগ্য, অ-জামিনযোগ্য, এবং শাস্তির সর্বোনিম্ন সীমা ৭ বছর করে সাধারণের মধ্যে অনলাইনে মতপ্রকাশের বিষয়ে একটি গণভীতি সৃষ্টির চেষ্টা করা হয়েছে বলে মনে হচ্ছে।

চলুন চোখ বুলিয়ে নিই আইসিটি আইন ২০০৬-এর ৫৭ (১) ধারায় কী বলা আছে তাতে—
কোন ব্যক্তি যদি ইচ্ছাকৃতভাবে ওয়েব সাইটে বা অন্য কোন ইলেক্ট্রনিক বিন্যাসে এমন কিছু প্রকাশ বা সম্প্রচার করেন, যাহা মিথ্যা ও অশ্লীল বা সংশ্লিষ্ট অবস্থা বিবেচনায় কেহ পড়িলে, দেখিলে বা শুনিলে নীতিভ্রষ্ট বা অসৎ হইতে উদ্বুদ্ধ হইতে পারেন অথবা যাহার দ্বারা মানহানি ঘটে, আইন শৃঙ্খলার অবনতি ঘটে বা ঘটার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়, রাষ্ট্র ও ব্যক্তির ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয় বা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করে বা করিতে পারে বা এ ধরনের তথ্যাদির মাধ্যমে কোন ব্যক্তি বা সংগঠনের বিরুদ্ধে উস্কানী প্রদান করা হয়, তাহা ইহলে তাহার এই কার্য হইবে একটি অপরাধ৷


এবার আসুন আইনটির সমস্যাগুলো একটু দেখে নিই—
অপরাধের সংজ্ঞা: কী লিখবো, কী লিখবো না?
বাংলাদেশের পেনাল কোডে অপরাধের সংজ্ঞা এমনভাবে দেয়া হয় যেন অপরাধ করার আগেই একজন মানুষ বুঝতে পারে কী কী করলে তা অপরাধ বলে গন্য করা হবে। উদাহরন স্বরূপ পেনাল কোডের ১৭৭ ধারার কথা বলা যেতে পারে, যেখানে ইচ্ছেকৃত ভাবে ভুল তথ্য দেয়া বলতে ঠিক কী বোঝানো হয়েছে, তা স্পষ্ট করে শুধু বলাই হয়নি, দুইটি উদাহরন দিয়ে তার স্বরুপও ব্যাখ্যা করা হয়েছে।
কিন্তু আইসিটি আইনের ৫৭ (১) অনুচ্ছেদে অপরাধের যে ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে তা একেবারেই স্পষ্ট নয় এবং অভিযুক্ত হবার পূর্ব পর্যন্ত কোন লেখকের পক্ষেই বোঝা সম্ভব নয় যে কী লিখলে তা অপরাধ বলে গণ্য হতে পারে।
আমরা জানি যে, বক্তব্য নির্ভর করে শ্রোতার ওপর, বক্তার ওপর নয়।
ঠিক তেমনি, লেখার মান যাচাইকারী হচ্ছেন পাঠক, লেখক লেখার মান যাচাইকারী নন।
লেখাটি ভাল না খারাপ সেটি পাঠক-ই নির্ধারণ করেন অতএব এ আইননুযায়ী লেখক কিভাবে বুঝবেন তার লেখাটি কি প্রভাব ফেলতে পারে?

এখানে বয়স নির্বিশেষে এমনকি প্রাপ্তবয়ষ্ক কোন উদো’র ‘নীতিভ্রষ্ট বা অসৎ হইতে উদ্বুদ্ধ’ হওয়ার দায়ও তথ্য প্রকাশকারী বুদো’র উপরে চাপানো হয়েছে। এ যেন উদোর পিন্ডি বুদোর ঘাড়ে! অথচ কী ধরনের তথ্য প্রকাশ কাউকে ‘নীতিভ্রষ্ট বা অসৎ হইতে উদ্বুদ্ধ’ করতে পারে, তা উল্লেখ করে দেয়া হয়নি।
একই ভাবে কোন ধরণের মন্তব্যকে ‘কোন ব্যক্তি বা সংগঠনের বিরুদ্ধে উস্কানী প্রদান’ বলে চিহ্নিত করা হবে, তারও কোন সীমারেখা টানা নেই।
আদৌ কারো ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লাগলো কিনা, অথবা কারো ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করার আদৌ কোন উদ্দেশ্য লেখকের ছিল কিনা, তাও যাচাই করার সুযোগ রাখা হয়নি। ‘ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করে বা করিতে পারে’ শুধু এমন অভিযোগেই শাস্তি প্রদানের সুযোগ রাখা হয়েছে।

অর্থাৎ, অনলাইনে কোন লেখা বা মন্তব্যের মাধ্যমে কাউকে উস্কানী দেয়া বা কারো অনুভূতিতে আঘাত করা যদি আপনার উদ্দেশ্য নাও হয়ে থাকে, এবং কারো অনুভূতি যদি আঘাতপ্রাপ্ত নাও হয়ে থাকে, তথাপি পুলিশ যদি মনে করে যে আপনার অনলাইন মন্তব্য কারো ‘ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করিতে পারে’, সেক্ষেত্রেও আপনাকে ওয়ারেন্ট ছাড়াই গ্রেফতার করে অ-জামিনযোগ্যভাবে আটক করে রাখা সম্ভব।
অথচ কথিত অপরাধকর্মের পেছনে অভিযুক্তের আসল উদ্দেশ্য বিচার করা একটি স্বত:সিদ্ধ আইনি চর্চা।
উদাহরন স্বরূপ— যদি প্রমাণিত হয় যে ‘মুরগী ওয়ালা’ কোন একটি লেখা সৎ উদ্দেশ্য নিয়ে লেখার পর ‘কসাই কালা’ তার পত্রিকায় এটিকে ভিন্নভাবে উপস্থাপন করে জনরোষ সৃষ্টির চেষ্টা করেছে, তাহলে উদ্দেশ্য বিচারে এখানে ‘মুরগী ওয়ালা’ কে নির্দোষ ও ‘কসাই কালা’ কে দোষী সাব্যস্ত করার প্রচলন রয়েছে। কিন্তু আইসিটি আইনের ৫৭ ধারায় পুরো দায় ‘মুরগী ওয়ালা’ এর উপর চাপানো হয়েছে।

শুধু তাই নয়, অবস্থা দৃষ্টিতে মনে হচ্ছে, আইন প্রয়োগকারী কর্তৃপক্ষ বিভিন্ন অনলাইন অপরাধ দমনে নিজেদের ব্যার্থতা ঢাকতে গণভীতি সৃষ্টির মাধ্যমে সমস্ত অনলাইন মতপ্রকাশের উপরই এক ধরনের স্বনিয়ন্ত্রন আরোপের চেষ্টা করছেন।
অপরাধের অস্পষ্ট সংজ্ঞায়নের কারণে সাধারণ মানুষ হয়তো মতপ্রকাশে নিরুৎসাহিত হবে, কিন্তু আইপি লুকিয়ে বেনামে মতপ্রকাশ উৎসাহিত হবে, এবং অনলাইন অপরাধ বৃদ্ধি পাবে ছাড়া কমবে না।

সাধারণত: কোন ব্যক্তির অপরাধ প্রমাণ হবার আগ পর্যন্ত তাকে নির্দোষ বিবেচনা করার রীতি আছে এবং কাউকে অপরাধী প্রমাণের দায় সাধারণত: অভিযোগকারীর উপরেই বর্তায়। কিন্তু এক্ষেত্রে কোনো ব্যক্তির নামে যে কোন মিথ্যে তথ্য প্রকাশ করে তাকে হয়রানি করা সম্ভব। কিন্তু অস্পষ্টভাবে সংজ্ঞায়িত ধারাগুলো আমলযোগ্য ও অজামিনযোগ্য করে দেওয়ায়, একজন ব্যক্তি দোষী সাব্যস্ত না হওয়া পর্যন্ত তাকে কার্যত: ‘দোষী’ হিসেবেই আটক থাকতে হবে। তথ্যপ্রকাশের কথিত অপরাধকে বিচারের আগেই অজামিনযোগ্য করে না দিয়ে তা বিজ্ঞ আদালতের সন্তুষ্টির ওপর ছেড়ে দেওয়া উচিত ছিল।

আমরা জানি যে, কাউকে গ্রেফতারের জন্য পুলিশকে সাধারনত: আদালতের কাছে অনুমতি নিতে হয়। কিন্তু খুন, খুনের প্রচেষ্টা, ধর্ষণ বা ধর্ষণ প্রচেষ্টার মতন গর্হিত অপরাধকে ‘আমলযোগ্য’ বিবেচনায় আদালতের অনুমতি ছাড়াই পুলিশ সন্দেহভাজন কাউকে গ্রেফতার ও তদন্ত করতে পারে। আইসিটি আইনে অনলাইনে মতপ্রকাশকে ‘আমলযোগ্য’ করা হয়েছে। ফলে একজন পুলিশ কর্মকর্তা নিছক সন্দেহের বশবর্তী হয়ে বা ইচ্ছাকৃতভাবে অনলাইনে মতপ্রকাশের কারণে যে কাউকে ওয়ারেন্ট ছাড়াই গ্রেফতার করে এবং নির্দোষ প্রমাণের আগ পর্যন্ত জামিনবিহীনভাবে আটক রেখে কার্যত: একাধারে ‘জাজ, জুরি ও এক্সিকিউশনারের’ ভূমিকা পালন করতে পারেন। এখানে কোন কবিতা, গল্প বা প্রবন্ধের অর্থ বিচার করে তা 'আমলযোগ্য' অপরাধ কিনা, তার এখতিয়ারও বিজ্ঞ আদালতের বদলে পুলিশের হাতে দেয়া হয়েছে।

ইলেক্ট্রনিক বিন্যাসে তথ্য প্রকাশের কারনে কারো কতটুকু মানহানি ঘটলো, বা আইন শৃঙ্খলার কতটুকু অবনতি ঘটার সম্ভাবনা সৃষ্টি হলো, তার মাত্রা পরিমাপের সুযোগ বিজ্ঞ আদালতকে না দিয়ে, এই আইনের ন্যূনতম সাজা সাত(৭) বৎসর রাখা হয়েছে। এক্ষেত্রে অতিস্বল্প মাত্রার অপরাধে কেউ দোষী হলে তাকে কমপক্ষে সাত বৎসর জেলে থাকতে হবে, যা লঘু পাপে প্রচন্ড রকমের গুরুদন্ডের সামিল।

তথ্য অধিকার আইন ২০০৯ বাক-স্বাধীনতাকে নাগরিকগণের অন্যতম মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দেয় এবং জনগণের তথ্য অধিকারকে সরকারী ও বেসরকারী সংস্থার স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা বৃদ্ধি ও দুর্নীতি হ্রাসের জন্য অপরিহার্য হিসেবে চিহ্নিত করে স্ব:প্রণোদিত তথ্যপ্রকাশ (proactive disclosure)-কে উৎসাহিত করে। কিন্তু তথ্য প্রযুক্তি আইনে তথ্য প্রকাশ সংক্রান্ত অপরাধের অস্পষ্ট সংজ্ঞায়ন, অভিযোগের জামিন অযোগ্যতা ও সর্বনিম্ন শাস্তির অস্বাভাবিক মাত্রা তথ্য অধিকারের মূল চেতনার পরিপন্থী, যা স্ব:প্রণোদিত তথ্যপ্রকাশকে নিরূৎসাহিত করবে এবং মতপ্রকাশে ভীতির সৃষ্টি হবে যা বাকস্বাধীনতা, উন্নয়ন ও গনতন্ত্রকে ব্যহত করবে। এটি একই সাথে বাংলাদেশের সংবিধান, তথ্য প্রযুক্তি নীতিমালা ও সরকারের ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ রুপকল্পের মূল চেতনার পরিপন্থী।

আইনটি প্রণয়ন ও সংশোধনে দেশের যে দুইটি বড় রাজনৈতিক দলই যুক্ত ছিল, তাদের সংগঠন ও ক্ষমতায়নে তারুণ্যের প্রতিবাদের অবদান অপরিসীম। স্বৈরশাসন থেকে অনির্বাচিত সরকারের শাসনামল—সব সময়ই তরুণ সমাজ তাদের প্রতিবাদের ভাষা অব্যাহত রেখেছে, বর্তমানে যার অন্যতম মাধ্যম হলো অনলাইনের প্রকাশনা। বিভিন্ন প্রভাবশালী গোষ্ঠীর একচ্ছত্র আধিপত্যথেকে জনমতপ্রকাশের মাধ্যমকে মুক্ত করার ক্ষেত্রেও ব্লগ বা অন্যান্য বিকল্প অনলাইন মাধ্যম অগ্রণী ভূমিকা রেখেছে। কিন্তু অন্যান্য নিবর্তনমূলক আইনের মতন এই আইনটিও আগামীতে রাজনৈতিক হয়রানির খড়গ হিসেবে নির্ভিক তরুণদের অ-জামিনযোগ্য ভাবে বন্দী রাখার উপায় হিসেবে ব্যবহৃত হবে বলে আমরা আশংকা করছি।

যেখানে সংখ্যাগরিষ্টতার কারণে আইন পাশে সরকারের কোন সমস্যা হয় না, সেখানে এমন একটি জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সংসদে আলোচনার মাধ্যমে আইনটির সংশোধন হবে, এমনটিই ছিল আমাদের প্রত্যাশা। কিন্তু অধিবেশন শুরুর মাত্র তিন সপ্তাহ আগে সংসদের পরিবর্তে অধ্যাদেশ জারির মাধ্যমে আইন সংশোধন হলো। কারণ হিসেবে ২০ শে আগস্ট ২০১৩ জারিকৃত এই অধ্যাদেশে বলা হয়েছে—
“যেহেতু সংসদ অধিবেশনে নাই এবং রাষ্ট্রপতির নিকট ইহা সন্তোষজনকভাবে প্রতীয়মান হইয়াছে যে, আশু ব্যবস্থা গ্রহনের জন্য প্রয়োজনীয় পরিস্থিতি বিদ্যমান রহিয়াছে”
কিন্তু, পত্রিকার খবর অনুযায়ী, এই অধ্যাদেশ জারীর দুই দিন আগেই, অর্থাৎ ২০১৩ সালের ১৮ই আগস্টেই রাষ্ট্রপতি সংসদের ১৯তম অধিবেশনের আহ্বান করেছেন। যেহেতু মাত্র তিন সপ্তাহ পরেই সংসদ অধিবেশন ছিল, তাহলে ঠিক কী জরুরী প্রয়োজনে তড়িঘড়ি করে অধ্যাদেশের মাধ্যমে আইনটি সংশোধন করা হলো তা বোধগম্য নয়।

আর, অনলাইনে মতামত দেয়ার বিরুদ্ধে গুরুদন্ড প্রস্তাব করে যে আইন, সেই আইন সম্পর্কেই অনলাইনে মতামত দেয়াটা কি ফাঁদে পা দেয়ার মতন হয়ে যাবে না? মতামত দেয়ার কারণে যদি আবার ৭ বছরের জেল দিয়ে দেয়?
তাছাড়া এই আইনের অপপ্রয়োগের ফলে সবচে' বেশী ক্ষতি হবে অনলাইনের জঙ্গিবাদ বিরোধী লেখকদের!! কারণ, কিছু লিখতে গেলেই হাঁটুতে বুদ্ধি রাখা ছাগুরা 'অনুভূতি' টেনে এনে অভিযোগ করবে আর ওই সব প্রগতিশীল লেখনীর খবরদারি করবে গাড়ল পুলিশ প্রশাসন!!

ব্লগ ও ব্লগারদের গলা চেপে ধরে রাস্ট্র ও জনগণের কল্যানের নামে নুনচুনআমেরকষ মেশানো একটা কিছু পাশ করিয়ে আপনারা বিজ্ঞ আইন প্রণেতা ভাবতেই পারেন নিজেকে। অনেক আর্থ্রোপডাই উড়ে কিন্তু তারা অ্যাভিস নয়। অ্যাভিস হতে হলে সেই গোত্রের হতে হয়। রাস্ট্র ও রাস্ট্রের নাগরিকদের বিরুদ্ধে অবস্থান করে যারা ক্ষতি সাধন করে যাচ্ছে তাদের ইয়েটাও না করতে পেরে নিরীহ ব্লগারদের চৌদ্দ বছরের জন্য চৌদ্দ শিকের ভেতরে পুরে রাখার ব্যবস্থা করতে যারা আইণ প্রণয়ন করে তাদেরকে ষাষ্টাঙ্গে স্যালুট!

মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সোল এজেন্ট আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকা অবস্থাতেই এই আইনের অপপ্রয়োগ হচ্ছে আর ক্ষমতার হাতবদল হলে কী হবে চিন্তা করলেই শিউরে উঠি।
সবচেয়ে আশ্চর্য্যের ব্যাপার, আইন দেইখা পুরাই বেকুব বইনা গেছি!!!! কি কমু বুঝতাছি না!! ৫৭ ধারায় যেসব অপরাধ দমনের কথা বলা হয়েছে, তা আরো সুস্পষ্ট করে পেনালকোডে এমনিতেই আছে। যেটা দরকার তা হলো আইনপ্রয়োগকারীদের প্রশিক্ষণ। এটা নাই বলেই তারা অপরাধীকে ধরতে না পেরে গণভীতি সৃষ্টির চেষ্টা করে। আর এতই যদি সমস্যা তাহলে এতো মুচড়া-মুচড়ি না কইরা সোসাল নেটওয়ার্কিং ব্লগ, ফেসবুক, ইউ টিউব, নেট, মোবাইল সব বন্ধ কইরা দিয়া আদিম যুগে ফিরা গেলেই হয়।
অথচ্ দেখুন যে কাজটা বিএনপি জামাত সরকার আসলে করতো, সেটা আগেই করে দিল আওয়ামী লীগ। যাতে বন্ধুরা ক্ষমতায় এসেই খপাখপ ধরপাক্রামি শুরু করতে পারে। আইনটা আগামী বিএনপি সরকারের জন্য বর্তমান সরকারের এক বিশেষ উপহার। আগামীতে বিএনপি জামাত যদি ক্ষমতায় আসে তাহলে মাসখানেকের মধ্যে এই আইনের বলে ব্লগ-ফেসবুকে যারা যুদ্ধাপরাধীর বিচার নিয়ে যারা গলা শুকিয়ে ফেলেছে, মুক্তিযুদ্ধের পতাকাকে সর্বোচ্চ স্থানে রাখার জন্য হাতের আঙুলের গিট ব্যথা করে ফেলেছে, তাদের সবাইকে সাফা করে ফেলতে পারবে।
শুধু তাই না, ব্লগ, ফেসবুক, ইউটিউব, মায় তাবত ইন্টারনেটই নিষিদ্ধ হয়ে যেতে পারে। কারণ সবগুলোর মধ্যে অনুভুতিকে কাতকুতু দেবার ক্ষমতা আছে। কার মনে কোন কারণে ব্যথা লাগে তা তো বলা যায় না। ব্যথা লাগলেই পুলিশ কেস, সাত বছরের জেল।

তাহলে ঘটনা কি দাড়াল? সরকারী, বিরোধী, আমলা তথা সকল সুবিধাভোগীর চক্ষুশূল যে এখন ব্লগার আর অনলাইন একটিভিষ্ট, তা কিন্তু স্পষ্ট।
কি ভাবছেন? ধর্ম নিয়ে ফেসবুকে লোকজনের সাথে তর্কে গেলে ও গ্রেফতার হওয়ার সুযোগ থাকছে ! আরেএএএ যেখানে লোকজন ফেসবুকে "লাইক" দিয়ে আর কমেন্ট করেই অভিযুক্ত হচ্ছে--- তর্ক তো প্রশ্নাতীত!
এক কাজ করা যেতে পারে মতামত এখন টাইপরাইটার দিয়ে লিখে হ্যন্ডবিল আকারে বিলি করতে পারেন নাকি কচুপাতার উপ্রে আলকাতরা আর বাঁশের কলম দিয়া হাতে লেইখা পাব্লিশ করতে পারলে পুরাই নিরাপদ!! নাকি প্রস্তরযুগে ফিরে যাবেন ?

আবার ধরুন আপনি যদি লিখেন: সকালে ঘুম থেকে উঠে আলুভর্তা দিয়ে ভাত খেলাম, ইয়ামি...
তাতেও সাবধান-- আলুভর্তাকে ইয়ামি বলায় আবার (১ম)আলুওয়ালাদের অনুভূতিতে না আঘাত লাগে !

এসব দেখে মনে হয় হুমায়ুন আজাদ সম্ভবতঃ জ্যোতিষবিদ্যা জানতেন
আমি জানি সব কিছু নষ্টদের অধিকারে যাবে।
নষ্টদের দানবমুঠোতে ধরা পড়বে মানবিক
সব সংঘ-পরিষদ; চলে যাবে, অত্যন্ত উল্লাসে
চ‘লে যাবে এই সমাজ-সভ্যতা-সমস্ত দলিল-
নষ্টদের অধিকারে ধুয়েমুছে, যে-রকম রাষ্ট্র
আর রাষ্ট্রযন্ত্র দিকে দিকে চলে গেছে নষ্টদের
অধিকারে।

আসুন আমরা সবাই অনলাইনে এসে ধর্মীয় স্টাইলে প্রার্থনা করি।
অহন থেইক্যা ভাসানী স্টাইল ধরন লাগবো, যা কওনের ব্যাক মোনাজাতে কওন লাগব।
আম্লীগ সরকার বাহাদুরের সবাইরে ধর্মানুরাগী বানানির লাইগ্যা ধইন্যবাদ।
হে রাব্বুল আলামিন, যারা এই আইসিটি আইন বানাইছে তাগোর উপ্রে তুমি লানত বর্ষন কর, তাগোরে তুমি হাবিয়াহ দোযখে নিক্ষেপ কর, আর দুনিয়া থেইক্যা তুমি এই আইসিটি আইন উঠাইয়া নিয়া যাও।
আমিন!

তথ্য সহায়তা : সাঈদ ভাই
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমাদের কার কি করা উচিৎ আর কি করা উচিৎ না সেটাই আমারা জানি না।

লিখেছেন সেলিনা জাহান প্রিয়া, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১:২৮




আমাদের কার কি করা উচিৎ আর কি করা উচিৎ না সেটাই আমারা জানি না। আমাদের দেশে মানুষ জন্ম নেয়ার সাথেই একটি গাছ লাগানো উচিৎ । আর... ...বাকিটুকু পড়ুন

মানবতার কাজে বিশ্বাসে বড় ধাক্কা মিল্টন সমাদ্দার

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ২:১৭


মানুষ মানুষের জন্যে, যুগে যুগে মানুষ মাজুর হয়েছে, মানুষই পাশে দাঁড়িয়েছে। অনেকে কাজের ব্যস্ততায় এবং নিজের সময়ের সীমাবদ্ধতায় মানুষের পাশে দাঁড়াতে পারে না। তখন তারা সাহায্যের হাত বাড়ান আর্থিক ভাবে।... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিসিএস দিতে না পেরে রাস্তায় গড়াগড়ি যুবকের

লিখেছেন নাহল তরকারি, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৫৫

আমাদের দেশে সরকারি চাকরি কে বেশ সম্মান দেওয়া হয়। আমি যদি কোটি টাকার মালিক হলেও সুন্দরী মেয়ের বাপ আমাকে জামাই হিসেবে মেনে নিবে না। কিন্তু সেই বাপ আবার ২০... ...বাকিটুকু পড়ুন

ডাক্তার ডেথঃ হ্যারল্ড শিপম্যান

লিখেছেন অপু তানভীর, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:০৪



উপরওয়ালার পরে আমরা আমাদের জীবনের ডাক্তারদের উপর ভরশা করি । যারা অবিশ্বাসী তারা তো এক নম্বরেই ডাক্তারের ভরশা করে । এটা ছাড়া অবশ্য আমাদের আর কোন উপায়ই থাকে না... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমার ইতং বিতং কিচ্ছার একটা দিন!!!

লিখেছেন ভুয়া মফিজ, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৩:০৩



এলার্ম এর যন্ত্রণায় প্রতিদিন সকালে ঘুম ভাঙ্গে আমার। পুরাপুরি সজাগ হওয়ার আগেই আমার প্রথম কাজ হয় মোবাইলের এলার্ম বন্ধ করা, আর স্ক্রীণে এক ঝলক ব্লগের চেহারা দেখা। পরে কিছু মনে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×