যে বয়সে সবাই 'আমার জীবনের লক্ষ্য' প্রবন্ধে ডাক্তার , ইঞ্জিনিয়ার কিংবা প্লেন ,জাহাজ অথবা রিকশার ড্রাইভার হইতে চাহিতো তখন আমি চেয়েছিলাম অন্য কিছু । গ্রীবার বাম পাশের খাঁজে ভর করা নজরুলের ভুত কলা চিবাইতে চিবাইতে সেদিন আমায় বলিয়াছিল কবি হইতে ।
ক্লাসের কাপ্তান হইয়া যখন ব্ল্যাকবোর্ডের সামনে দাঁড়িয়ে চৌকিদারের দায়িত্ব পালন করিতাম তখন মনে আমার উঁকি দিতো নিযুত কাব্য প্রতিভা ।
"আকাশেতে পাখি
মেলে দুটো আঁখি
দেখিতেছে রাখি
দিয়ে ক্লাস ফাঁকি !"
কিংবা
"শিশির একটা ছ্যারা
ক্যাপ পড়া ন্যাড়া
চোখ গুলা ট্যারা
যেন একটা ভেড়া !"
আগ্নেয়গিরির অগ্নুত্পাতের মত গলগল করে বেরিয়ে আসা আমার কাব্য প্রতিভায় কেউ তখন বিনোদিত , কেউবা ঈর্ষান্বিত , আবার কেউ উদাসিত !
নিজেকে কেমন যেন কবি নজরুলের উত্তরপুরূষ মনে হইতে লাগিলো । দিন যায় , বাড়ে ভাব । সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ে ছন্দের অভাব ।
কিঞ্চিত ক্ষীণকায়(নিন্দুকেরা একটু বাড়িয়ে বলে) দেহে ইয়া লম্বা জুব্বা চাপিয়ে চলাফেরা আরম্ভ করিলাম । পাশ দিয়ে চড়া নরাধমদের ফিসফিসানো অট্টহাসিতে মেজাজ যখন এপোলো-১১ চড়িয়া দুম করে সপ্তমে উঠিতো তখন নিজেকে বুঝ দিতাম ওদের 'গোমুর্খ' বলিয়া । "ব্যাটা , দাঁত কেলায়া কেবল হাসিতেই পারিবে , আমার মতো কবিতা লিখিতে পারিবে ? অন্তঃত আধেকটা , দু এক লাইন ?"
নামের পূর্বপদে কবি উপাধী লাগিয়ে আমি যখন দিগবিদিক জয় করিয়ে বেড়াইতেছি তখনই বাগড়া দিলো পাড়ার কুদ্দুস ভাই । বলিতে থাকিলেন ওগুলো কাব্য নয় , কাব্যের ছোড়দা ছড়া !
কাঁহাতক আমায় বিন্দুমাত্র দমানো গেলোনা । একের পর এক কাব্যের ঝংকারে মাতাইতে থাকিলাম বিদ্যালয়ের কক্ষ থেকে উত্তর পাড়ার মত্সবাজার !
খানিক কাল বাদে সেই ছুঁচো কুদ্দুস নতুন করিয়া প্রচার করিতে লাগিলেন আমি নাকি সুকান্ত দাদা , রবী দাদা আর জীবন দাদার কবিতার হুবহু অনুলিপন করিতেছি । চৌর্যবৃত্তির এহেন অভিযোগের জবাবে কেহ জিজ্ঞেস করিলেই মুখের উপর বলিয়া দিতাম ,"আমি অনুলিপন করিতে যাইবো হে কেন শুনি ! আমার কবিতা যদি কেহ আগেই লিখিয়া ফেলে তবে কি তাহা আমার অপরাধ !"
সকলেই ঘাড় নাড়িয়া বলিতো, "হাঁ হাঁ আলবত্ বলিয়াছ কবি !"
যাহা হউক , কিছুকাল বাদেই আমি কাব্য চর্চায় ইতি টানিবার সিদ্ধান্ত নি । ভাবিয়া দেখিলাম আমার কবিতা যদি অন্যরাই লিখিবে তাহাতে আমার অঙ্গুলি বাঁকিয়ে কলম ধরিবারই বা কি হেতু !
সবশেষে, বিদ্যাপিঠে মুত্রালয়ের দেয়ালে দেয়ালে আমার বিদায় সম্ভাষণ লিখিয়া তাহা জানাইয়াও দিলামঃ
"একদা আসিয়া রবীন্দ্রনাথ , হাঁকিয়া নমস্কার ।
"হে উস্তাদজী ! লাগিতেছেনা ভালো , বিদ্যাশিক্ষা দিব ছাড় !"
বিলি কাটিয়া কৃন্তনে বলি, "ওহে বাছাধন মোর ,
বহিস না তুই বিদ্যার ভার , করিবনা আমি জোর !"
দন্তপাটি কেলিয়ে রবি- "গুরু , এখন তব কি করি ?"
"কাব্য লিখিয়া যা , মিশাইয়া মনের যত মাধুরী !"
সেই রবি হলো কবিগুরু , আজিকে সবার কাছে !
জানেনা হায় ধরণীর লোক , ওঁকে কাব্য কে শিখায়াছে !"
ইহাই ছিলো আমার শেষ কবিতা , আর ইহার মধ্যি দিয়েই অবসান হয় আমার কবি জীবনের ! শুরু হয় মানুষ হবার নিরন্তর চেস্টা !
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা ডিসেম্বর, ২০১৬ দুপুর ১:০৯