কীটনাশক খেয়ে আত্মহত্যার প্রবণতা যে এত বেশী তা ইন্টার্ন করার আগ পর্যন্ত জানতামনা । এই কীটনাশক খুব ভয়াবহ বিষ বলা যায়, তীব্র শারীরিক যন্ত্রণা দিবে আপনাকে । হসপিটালে সঠিক চিকিৎসার পরও কিছু দিন বা মাস পরে মারা যাওয়ার আশংকা থেকে যায় । এ বিষ পানে তাই গড়ে প্রতি ৮ বা ১০ জনে একজন মারা যান । আমাদের দেশে মারা যাবার এই হার বেশী হবার একটা তিক্ত কারন আজ আপনাদের সাথে শেয়ার করছি । পোস্টটি একটু বড় হলেও পড়ার অনুরোধ থাকলো ।
.
কিটনাশক খাওয়া রোগীর চিকিৎসা যত দ্রুত শুরু করা যায় বেঁচে যাবার সম্ভাবনাও ততই বাড়ে । গ্রামে একজন কীটনাশক খেয়ে সদর হসপিটালে আসতে আসতেই ঘন্টা পেরিয়ে যায় । নিয়ম হলো সর্বোচ্চ চার ঘন্টার ভিতরে আসলে স্টোমাক ওয়াশ দেয়া যাবে । কিন্তু বিষ খাওয়া রোগীর চিকিৎসা অনেকেই এড়িয়ে যেতে চান, তার উপর স্টোমাক ওয়াশ দিতে দিতে রোগী মারা গেলে নিজেরই মাইর খাবার ভয় থেকে অনেক ডাক্তার ঝুঁকি নিতে চাননা । তাই তিনি নিজেকে নিরাপদ রাখতে বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই রেফার করেন বিভাগীয় হাসপাতালে । পথের মধ্যে রোগীর অবস্থা যতই খারাপ হোক কোনো প্রাইভেট ক্লিনিক পুলিশ কেস হওয়ায় বিষ খাওয়া রোগী ভর্তি নেয়না। মানে যত সময়ই লাগুক আপনাকে বিভাগীয় হাসপাতালেই আসতে হবে ।
যাহোক, এই বিষের চিকিৎসায় একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হচ্ছে এট্রপিন নামের একটি কমদামি নিরীহ ইনজেকশন কিছু সময় পর পর শিরায় দিতে হয় এবং চোখের মণির চলাচল ও হৃৎপিণ্ডের গতি পরিমাপ করতে হয় । প্রতি পাঁচ মিনিট পর পর একটা করে ইনজেকশন, তারপর প্রতি দশ মিনিট পর পর, তারপরে আধা ঘন্টা পর পর, তারপর এক ঘন্টা পর পর শরীরে যথেষ্ট পরিমানে এট্রপিন না যাওয়া পর্যন্ত দিতেই থাকতে হবে । সব মিলিয়ে আশি নব্বই টি ইনজেকশন দিতে হয় বেশীরভাগ সময় ।
আবারও মনে করিয়ে দেই, এই বিষে ১০% - ১৫% রোগী মারা যান। একবার ভেবে দেখুন, যে রোগীকে এক রাতে ৮০ – ৯০ টি ইনজেকশন দেয়া হয় এবং তিনি যদি দুর্ভাগ্য ক্রমে মারা যান তাহলে তিনি কোনও একটি ইনজেকশন দেবার পরেই মারা যাবেন । হয়ত শেষ এট্রপিনটিও তাঁকে বাচাতে পারবে না। তখনই হয়ত এরকম একটি শিরোনামের সৃষ্টি হবে - “চিকিৎসক ইনজেকশন টি দেয়ার কিছুক্ষণ পরে রোগী মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন”। অথবা ভেবে দেখুন যে রোগী টি হাসপাতালেই আসলো দেরী করে এবং হয়ত প্রথম এট্রপিন ইনজেকশন টি দেবার পরেই রোগী টির মৃত্যু হলো এবং এই মৃত্যুটির সংবাদ শিরোনামের সাথে সেই শেষ দেয়া ইনজেকশন টি যুক্ত হয়ে গেলো । তখন ঐ নিরীহ ডাক্তারের অবস্থা কি হবে ?
আবার এট্রপিন দেয়ার পরে রোগীর যেসব পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ধীরে ধীরে শুরু হয় যেমন অস্থিরতা, পাগলামী করা এসবের দায়ও নিতে হয় ঐ নিরীহ ডাক্তারকেই । সব কিছুর শেষেও, কদিন পরে ফুসফুসের সংক্রমণ হয়েও এই বিষ পান করা লোকটি মারা যেতে পারেন, তার দায়ও বা কে নিবে ? কারন কেউ মারা গেলে আমরা ভুলে যাই উপরে আল্লাহ নামে একজন আছেন, নিয়তি বলতে কিছু আছে, মানুষ অবশ্যই মরনশীল...
.
এত বিস্তারিত লেখার মূল কারন, এত শত অনিশ্চয়তার জন্য অধিকাংশ ডাক্তারই কেন গ্রামের সরকারী ক্লিনিকে বা উপজেলা কিংবা জেলা হসপিটালে এই রোগীর চিকিৎসা না করে বিভাগীয় হাসপাতালে রেফার করেন । পর্যাপ্ত চিকিৎসা দেবার পরও যখন রোগী মারা যাবে তখন সাংবাদিক লিখবেন, “চিকিতসক ইঞ্জেকশনটি দেয়ার কিছুক্ষণ পরে রোগী মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন”, অতঃপর সন্দেহাতীত ভাবে সাধারন পাঠকেরা খবরটি পড়ে যেসকল প্রতিক্রিয়া দিবেন :
- রোগীটি খুব সিরিয়াস ছিলো কিন্তু ডাক্তার রা খুব আন্তরিক ছিলেন না, তাই যথাযথ চিকিতসা না পেয়ে রোগীটি মারা গেলেন ।
- ডাক্তার একটি ভুল ঔষধ দিয়েছেন, যে কারনে ঔষধের প্রতিক্রিয়ায় রোগী টি মারা গেছেন।
- ডাক্তার এই ইনজেকশন টি যদি না দিতেন তাহলে রোগীটি হয়ত মারা যেত না ।
- ডাক্তার এই ইনজেকশন টির স্থানে যদি অন্য একটি সঠিক ইনজেকশন দিতেন, তাহলে হয়ত রোগীটি মারা যেত না, হয়ত বা আরও কিছু দিন বেঁচে থাকতো ।
- এই ডাক্তার এর স্থানে যদি অন্য ভালো ডাক্তার হতো তাহলে রোগীটি বেঁচে থাকতো ।
- প্রায় সকল ডাক্তার ই একই রকম, এই রকমের নিষ্ঠুর ।
.
একই কথা প্রযোজ্য শ্বাসকস্টের রোগীদের জরুরী ভিত্তিতে কটসন, ল্যাসিক্স ইনজেকশন দেয়া, শকের রোগীদের নর-এড্রেনালিন দেয়া, খিঁচুনির রোগীদের সেডিল ইনজেকশন দেয়া.....
যাহোক, ডাক্তার এর সিদ্ধান্তের ভুল, চিকিতসা প্রদানের ভুল, ঔষধ প্রয়োগের ভুল এমন কি রোগটির ডায়াগনোসিসও ভুল হতে পারে এবং রোগী মারা যেতে পারে। এটা দুর্ভাগ্যজনক বাস্তবতা । এই বাস্তবতা নিয়েই সারাবিশ্বে মেডিক্যাল সায়েন্স কাজ করে যাচ্ছে,জীবন বাঁচাতে ঝুঁকি নিচ্ছে। কিন্তু আমাদের দেশে এই বাস্তবতার রিয়েকশন এতটাই তিক্ত যে অনেকেই তাই এখন ঝুঁকি নিতে চাচ্ছেনা । আর ঝুঁকি না নেয়ার প্রবণতার ভুক্তভোগী হচ্ছে একেবারে সাধারন কিছু রোগী ।
এই নির্মম বাস্তবতার জন্যে আসলে দায়ী কারা ?
উত্তরের স্বপক্ষে গত বছরের ইত্তেফাকের একটি শিরোনাম বলছি : "রোগীর শরীরে উপর্যুপরি ৮০ ইনজেকশন, পরে মৃত্যু" ।
বিভিন্ন সময়ে হওয়া আরো কিছু পত্রিকার শিরোনাম দিলাম :
ইনজেকশন দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে শ্বাসকষ্টের রোগীর মৃত্যু ।(যুগান্তর)
ইনজেকশন দেওয়ার পর রোগীর মৃত্যুতে ডাক্তার গ্রেপ্তার । (বিডিনিউজ)
বরিশালে ইনজেকশন দেয়ার পরই রোগীর মৃত্যু, স্বজনদের মারধর।। (মানবকন্ঠ)