কিছু পরে চারভাই ঘরে ফিরলেন। ভীমকে না দেখতে পেয়ে যুধিষ্ঠির একান্তে ডেকে কুন্তীকে ভীম কোথায় যানতে চাইলেন। সব শুনে যুধিষ্ঠির চিন্তিত হলেন।
কুন্তী বলেন - ব্রাহ্মণকে রক্ষা করতে, এই নগরকে রক্ষা করতেই আমি ভীমকে বক রাক্ষস বধে পাঠালাম।
যুধিষ্ঠির বিরস বদনে বলেন – মা হয়ে তুমি পুত্রকে রাক্ষসের কাছে পাঠালে! আমরা অজ্ঞাতবাসে আছি। ভীম আমাদের মধ্যে বলবান। তার শক্তির সাহায্যে রাজ্য অধিকারের আশা রাখি। কৌরবরা তাকে ভয়ও পায়। তার সাহায্যেই জতুগৃহে আমরা বাঁচলাম। সেই হিড়িম্ববনে আমাদের কাঁধে করে নিয়ে গেল ও হিড়িম্ব বধ করল। সেই বীর পুত্রকেই তুমি রাক্ষস ভোজনে পাঠালে! আমরা আর কি ভাবে বাঁচব। গর্ভধারিণী হয়ে তুমিই এমন কাজ করলে! বলে যুধিষ্ঠির হাহাকার করতে লাগলেন।
কুন্তী বলেন - যুধিষ্ঠির ভেব না। আমিও ভীমের প্রতাপ জানি। তার শরীরে অযুত হস্তীর বল। তাকে কেউ পরাজিত করতে পারবে না। তার জন্মের সময়ই তার পরাক্রম দেখি। প্রসবের পর তাকে তুলতে পারিনি। একটু তুলেই ফেলে দিয়েছিলাম ধুলায়। তার আস্ফালনে পর্বতের শৃঙ্গ চূর্ণ হয়। বারণাবতে দেখলাম স্বচক্ষে সে হাতে করে তোমাদের চারজনকেই সহজে তুলেছিল। আমাদের সবাইকে কাঁধে তুলে হিড়িম্ববনে গেল, হিড়িম্ব বধ করল। তার শক্তিতে আমার বিশ্বাস আছে। সেই এই রাক্ষস বধ করবে। ভীত মানুষদের যিনি ত্রাণ করেন তার সমান পূণ্যবান কেউ নেই। বিশেষ করে ব্রাহ্মণের জন্য প্রাণদান ও জন্মভূমির জন্য যুদ্ধ পৌরুষের প্রতীক। এমন পূণ্যকাজের জন্য তুমি দুঃখ করছ কেন! মায়ের কথা শোন।
মায়ের সকল কথা শুনে দয়ালু যুধিষ্ঠির ধন্য ধন্য করলেন। পরের দুঃখে নিজের পুত্রকে দিয়ে ত্রাণ করায় তিনি মাকে ধন্যবাদ জানালেন। মায়ের পূণ্যেই তারা সকল বিপদ থেকে রক্ষা পাবেন।
তিনি মাকে বলেন - তবে মা ব্রাহ্মণকে বোলো এ সকল কথা যেন অন্য কাউকে না জানায়।
রাত্রে ব্রাহ্মণরূপী ভীম রথে চড়ে বনে গেল বক রাক্ষসের কাছে। ভীম চিৎকার করে বককে ডেকে তারই খাবার খেতে শুরু করল। তার নাম ধরে ডাকায় বক রাক্ষস রেগে থর থর করে কাঁপতে কাঁপতে ক্রোধে সেখানে উপস্থিত হল। তার চলনের ভারে ধরা যেন ভিতরে ঢুকে যেতে থাকল।
ভীমকে তার অন্ন খেতে দেখে রেগে বক দুই চোখ লাল করে চিৎকার করে বলে – হে দুষ্টমতি মনুষ্য! তুই এমন অনীতির কাজ কেন করলি! তোর দোষে সকুটুম্ব ব্রাহ্মণকে আমি আজই ভক্ষণ করব।
এই বলে রাক্ষস রাগে আস্ফালন করতে থাকে। যদিও ভীম রাক্ষসের প্রতি ভ্রুক্ষেপ না করে পিছন ফিরে তার খাদ্য খেতে থাকেন গোগ্রাসে। দেখে ক্রোধে নিশাচর গর্জন করতে করতে দুহাত তুলে ভীমকে ধরতে যায়। সে দুই হাত দিয়ে ভীমের পিঠে আঘাত করতে থাকে। ভীম তাও গ্রাহ্য করেন না। রাক্ষস পিঠে মারতে থাকে ভীমও হেলায় তা সহ্য করে নির্ভয়ে পায়সান্ন খেতে থাকেন। তা দেখে রাক্ষস আরো রেগে বৃক্ষ উপড়ে ভীমকে ছুঁড়ে মারে। তবু ভীম হাসতে হাসতে অন্ন খেতে খেতে বাঁ হাতে বৃক্ষ কেড়ে নেন। পুনরায় রাক্ষস একটি মহাবৃক্ষ উপড়ে গর্জন করে ভীমের উপর ছোঁড়ে।
ভোজন শেষ করে ভীম আচমন সেরে বৃক্ষ উপড়ে যুদ্ধ শুরু করেন। বৃক্ষে বৃক্ষে সাংঘাতিক যুদ্ধ শুরু হয়। এভাবে বনের সব বৃক্ষ নষ্ট হল। এরপর দুজনে দুজনের উপর শিলাবৃষ্টি শুরু করল। দুজনে পরষ্পরকে জড়িয়ে ধরে বাহুযুদ্ধ শুরু করে। পরস্পর পরস্পরের মুন্ড ধরে, বাহুতে বাহু দিয়ে, হাত জড়িয়ে মাটিতে গড়াগড়ি দিয়ে যুদ্ধ করে।
এত যুদ্ধ করে বক রাক্ষস শ্রান্ত হয়ে পরে। কুন্তীপুত্র ভীম সহজেই বক রাক্ষসকে ধরে ফেললেন। বাম হাতে দুই জানু ও ডান হাতে মাথা রাক্ষসের চেপে ধরেন। রাক্ষসের বুকে হাটু দিয়ে ভীমবীর জোরে টান মারলেন। রাক্ষস দু’টুকরো হয়ে ভেঙ্গে পরল। বক রাক্ষস আর্তচিৎকার করে মরল। বক রাক্ষসের যত অনুচর ছিল তারা ভয়ে সে স্থান ত্যাগ করে পালালো। নগরের কাছে ভীম বক রাক্ষসকে ফেলে মা ও ভাইদের কাছে গিয়ে সব জানালেন।
আনন্দিত মা কুন্তী যুধিষ্ঠিরকে ডেকে ভীমকে আলিঙ্গন করে তার প্রশংসা করতে লাগলেন।
পরদিন ভোরে নগরবাসী বক রাক্ষসের পর্বত প্রমাণ দেহ নগর দ্বারপ্রান্তে পরে থাকতে দেখে চমৎকৃত হল। কেউ জিজ্ঞেস করে এমন কাজ কে করল, কেউ বলে যেই করুক সবাই নিষ্কন্টক হলাম। এই পরম দুষ্ট হিংস্র বক রাক্ষস নিজের পাপেই মরেছে। পরে তারা বিচার করে দেখল আগেরদিন বক রাক্ষসকে খাদ্য পাঠানোর দায়িত্ব কার ছিল। সেই বলতে পারবে বক রাক্ষস কি ভাবে মরল। দেখা গেল ব্রাহ্মণের দিন ছিল। সকলে তাকে দ্রুত ডেকে পাঠাল। কি ঘটেছিল সকলে জানতে উদগ্রিব।
ব্রাহ্মণ বলে – আমার ঘরে কাল পাঁচ মহাপুরুষ আসেন। আমাদের শোকার্ত দেখে তাদের মধ্যে একজন মন্ত্রসিদ্ধের দয়া হল। তিনি আমার পরিবর্তে রাক্ষসের কাছে অন্ন নিয়ে গেলেন। তিনিই বক রাক্ষসকে হত্যা করেছেন এবং রাজ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠিত করেছেন।
সব শুনে নগরবাসী খুশি হল। সকলে ব্রাহ্মণকে পূজা করল। আনন্দ মনে ব্রাহ্মণ ঘরে ফিরে এলো। এরপর থেকে পান্ডবদের ব্রাহ্মণ দেবতুল্য সন্মান করতে লাগল।
মহাভারত অমৃতের ধারা, কাশীরাম কহে শুনে ইহলোকের দুঃখ পার হবে সর্ব জনা।
.....................................
উৎসর্গ: সকল ব্লগার বন্ধুকে
......................................
আগের পর্ব:
কথাচ্ছলে মহাভারত - ৬৪
Click This Link
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৪ দুপুর ১:০৬