somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

কথাচ্ছলে মহাভারত - ৬৪

০৮ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৪ সকাল ১১:৪৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
পান্ডবগনের একচক্রা নগরে বাস:


একচক্রা নগরে ব্রাহ্মণের গৃহে মাকে নিয়ে পান্ডবরা অজ্ঞাতবাসে রইলেন। নগরে সারাদিন ভিক্ষে করে রাতে ঘরে আনতেন। কুন্তী তাই রান্না করে অর্ধেক ভীমকে খেতে দিয়ে বাকি পাঁচজনে ভাগ করে খেতেন। যদিও তাতেও ভীমের তৃপ্তি হত না। এভাবে বহু কষ্টে তারা সেখানে বাস করতে লাগলেন।

একদিন ভীম ঘরে রয়ে গেলেন, বাকি চারভাই ভিক্ষা করতে বেরলেন। হঠাৎ ব্রাহ্মণের গৃহে বিকট শব্দ হল ও ব্রাহ্মণ-বাহ্মণী বিলাপ করতে লাগল।
কুন্তীদেবী তাদের কষ্ট সহ্য করতে না পেরে ভীমকে ডাকলেন। বললেন - এতদিন এই গরিব ব্রাহ্মণের আশ্রয়ে গোপনে বাস করছি। আজ এনার ঘোর বিপদ, অবশ্যই একে রক্ষা করতে হবে। উপকারী জনের যে সাহায্য না করে তার সংসারে অপযশ হয়, পরলোকেও পাপ হয়।

ভীম বলেন – মা! ব্রাহ্মণকে জিজ্ঞেস কর কি তার কষ্ট, সাধ্য অনুসারে তাকে রক্ষা করব।

ভীমের আশ্বাস পেয়ে কুন্তী ব্যগ্র ভাবে ব্রাহ্মণের কাছে ছুটে গেলেন।
তিনি গিয়ে দেখেন বিলাপ করে ব্রাহ্মণ ব্রাহ্মণীকে বলছে- এই জন্যই তোমায় আগেই বলেছিলাম যে দেশে রাক্ষসের উপদ্রপ সেখানে বাস করে কাজ নেই। পিতামাতার স্নেহে সে কথা তুমি শুনলে না। এখন উচিত শিক্ষা পাও! কি করব ভেবে পাচ্ছি না। কোন বুদ্ধি বার করে এর প্রতীকার কর। তুমি আমার গৃহিনী ও ধর্মপত্নী। তুমিই আমায় সব সুখ ও শান্তি দিয়েছ। তোমার ধর্ম জ্ঞানে আমার বিশ্বাস আছে। আমার বালক পুত্রের জননী তুমি, তোমাকে ছেড়া সে বাঁচবে না। তোমাকে হারালে আমি দুঃখের অরণ্যে নিজেকে হারাব। নিজেকে বাঁচিয়ে তোমাকে যদি রাক্ষসের হাতে দিই তবে সংসারে আমার অপযশ হবে। অপূর্ব সুন্দরী কন্যাকে রাক্ষসের হাতে দিলে কুযশ কাহিনী রটবে। কন্যার জন্ম হলে পিতা আশা করে তাকে সুপাত্রে দান করে স্বর্গ বাস করবে। সেই কন্যাকে রাক্ষসের হাতে দিলে নিজেকে আমি ক্ষমা করতে পারব না। আমি নিজেই রাক্ষসের কাছে চললাম।
এত বলে ব্রাহ্মণ কাঁদতে কাঁদতে চললেন।



ব্রাহ্মণী তার পথ আগলে বলেন – তোমরা সুখে বাস কর, আমি রাক্ষসের কাছে যাব। তুমি গেলে পুর পরিবার না খেতে পেয়ে মরব। আমি সহমৃতা হব। পুত্রকন্যা না খেতে পেয়ে মরবে। আমি বাঁচলেও আমি কি ভাবে তাদের পালন করব। তোমাকে ছাড়া আমরা তিনজনেই অনাথ হব। অনাথের বহু কষ্ট। দরিদ্র দেখে অকুলীনজন কন্যাকে চাইবে। পুত্র ভিক্ষারী হবে কিছুদিনেই। কুলধর্ম বেদের বিমুখ হবে। দুর্বল অনাথ দেখে বলবান কামুক দুর্মুখ লোক আমাকে কামনা করবে। তোমাকে ছাড়া আমাদের পদে পদে বহু বিপদ হবে। সে জন্যেই তোমাকে যেতে বারণ করছি। অনেক স্নেহে ভালবাসায় এ সংসার তুমি গড়ে তুলেছ। পুত্রকন্যাও তোমার মত সুন্দর হয়েছে। কন্যাকে সুপাত্রে দান করো। পুত্রকে পড়িও। তুমিও আবার বিবাহ করো। আমি গেলেও আবার তোমার সংসার হবে। কিন্তু তোমাকে ছাড়া পুর পরিবার নষ্ট হবে। নারীর পরম ধর্ম স্বামীর সেবা করা, বিপদে নিজেকে দান করে স্বামীকে রক্ষা করা, তাতেই সে ইহলোকে যশ পায়, স্বর্গে অক্ষয় হয়। তপ, জপ, যজ্ঞ, ব্রত, নানা প্রকার দানের সমান ফল স্বামীর সেবায় লাভ করা যায়। শাস্ত্রে ও সকল ধর্মে একথাই বলা আছে। তাই রাক্ষসের কাছে আমিই যাব।

স্ত্রীর কথা শুনে তাকে জড়িয়ে ব্রাহ্মণ চিৎকার করে কাঁদতে লাগল। ব্রাহ্মণীও কাঁদতে লাগল। মা-বাবার অবস্থা দেখে পুত্র-কন্যাও কাঁদতে শুরু করল।

কন্যা বলে- মা কেঁদো না, তুমি রাক্ষসের কাছে গেলে মা হারা বালকের মৃত্যু হবে, পিন্ডদানের কেউ থাকবে না, কুল বিনষ্ট হবে, তাই মার যাওয়া হবে না। কন্যার জন্ম হলে তাকে ত্যাগ করতেই হবে। বিধির সৃজন কেউ খন্ডন করতে পারবে না। পিতা তুমি আমায় অন্য কাউকেতো দান করতেই, এখন রাক্ষসের হাতেই আমায় দান কর। তোমরা রক্ষা পাবে। আমার মত আরো কন্যা তোমাদের হবে। তাই আমাকেই ত্যাগ কর। পরে আমার পুত্রও আমাকে হয়ত তাড়াবে। এখন আমিই নিশ্চিন্তে যাই।
কন্যার কথা শুনে ব্রাহ্মণ-ব্রাহ্মণী আরো কাঁদতে লাগলো।


এত কথা শুনে ছোট্ট ছেলেটি সবার মুখে হাত দিয়ে কাঁদতে বারণ করল। এক হাতে একটি তৃণ নিয়ে শিশুটি বলে উঠল – তোমরা কেউ রাক্ষসকে ভয় পেও না। এই তৃণ দিয়ে তাকে আমি মারব। তোমরা আমায় রাক্ষস কোথায় দেখিয়ে দাও।

বালকের কথা শুনে তিনজনে কান্না ভুলে হাসতে লাগল।
তাদের হাসতে দেখে কুন্তীদেবী এগিয়ে এসে সকাতরে বলেন – কি কারণে তোমরা কাঁদছো? কি ভাবে আমি তা মোচন করতে পারি বল।



ব্রাহ্মণ বলে – মানুষের সাধ্য নেই এ দুঃখ মোচন করার। এই নগরে দুরন্ত বক রাক্ষস বাস করে। সেই এ রাজ্যের প্রভূ, ঈশ্বর। যক্ষ-রক্ষ-ভূত-প্রেত সকলে তাকে ভয় পায়। তার শক্তির কাছে সবাই হেরে গেছে। সে ঠিক করেছে নগরে যত মানুষ আছে একজন করে প্রতিদিন পায়েস-পিঠে-অন্ন রান্না করে রথে ভর্তি করে তার সামনে আনবে সঙ্গে দুটি মহিষও দিতে হবে। সকলকেই সে ভক্ষণ করবে। আজ আমার দায়িত্ব তার কাছে যাওয়ার, যে যেতে অস্বীকার করবে তাকে তার পরিবারের সবার সঙ্গে মেরে খাবে। আজ আমি কাকে পাঠাব। আমার স্ত্রী-পরিবারসহ চারজন। কাকে বলি দেব ভেবে পাচ্ছি না। মানুষ কিনে যে তার কাছে পাঠাব সে সম্পদও আমার নেই। পরিবারের কাউকেই ছারতে মনও চায় না। ঠিক করেছি সবাই মিলেই তার কাছে যাব। যা কপালে আছে দেখা যাবে।

তার কথা শুনে কুন্তী বলেন – ভয় পেও না। তোমাদের কাউকেই যেতে হবে না। আমার পাঁচপুত্র আছে, তোমার জন্য আমি একটি পুত্রকে দান করব।

ব্রাহ্মণ বলেন – অদ্ভূত কথা বললেন, দেবী! আপনারা আমার অতিথি। নিজের স্বার্থে অতিথিদের প্রাণ নেব! এমন পাপ কর্ম করতে পারব না। প্রাণ দিয়ে অতিথিকে রক্ষা করতে হয়। ব্রাহ্মণ হত্যা করে কুলের কলঙ্ক হতে চাই না।
কুন্তী বলেন – আমিও এসব কথা জানি।
ব্রাহ্মণ বলে- আমায় আর ও কথা বলবেন না।
কুন্তী বলেন- শুনুন ব্রাহ্মণ আমার পুত্ররা মহা বলধর। তাদের রাক্ষস বধ করতে পারবে না। তারা বিদ্যান, বুদ্ধিমান। তারাই কৌশলে রাক্ষস বধ করবে।


কুন্তীর কথায় ব্রাহ্মণ অবাক হল এবং আশার আলো দেখল। কুন্তী ব্রাহ্মণকে নিয়ে ভীমের কাছে এলেন। ভীম সব শুনে যেতে রাজি হলেন। ব্রাহ্মণ আনন্দ মনে ঘরে ফিরল।
......................................
উৎসর্গ: সকল ব্লগার বন্ধুকে
......................................
আগের পর্ব:

কথাচ্ছলে মহাভারত - ৬৩
Click This Link
১১টি মন্তব্য ১১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমার প্রফেশনাল জীবনের ত্যাক্ত কথন :(

লিখেছেন সোহানী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সকাল ৯:৫৪



আমার প্রফেশনাল জীবন বরাবরেই ভয়াবহ চ্যালেন্জর ছিল। প্রায় প্রতিটা চাকরীতে আমি রীতিমত যুদ্ধ করে গেছি। আমার সেই প্রফেশনাল জীবন নিয়ে বেশ কিছু লিখাও লিখেছিলাম। অনেকদিন পর আবারো এমন কিছু নিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমি হাসান মাহবুবের তাতিন নই।

লিখেছেন ৎৎৎঘূৎৎ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



ছোটবেলা পদার্থবিজ্ঞান বইয়ের ভেতরে করে রাত জেগে তিন গোয়েন্দা পড়তাম। মামনি ভাবতেন ছেলেটা আড়াইটা পর্যন্ত পড়ছে ইদানীং। এতো দিনে পড়ায় মনযোগ এসেছে তাহলে। যেদিন আমি তার থেকে টাকা নিয়ে একটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সাংঘাতিক উস্কানি মুলক আচরন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৪



কি সাঙ্ঘাতিক উস্কানিমুলক আচরন আমাদের রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর । নাহ আমি তার এই আচরনে ক্ষুব্ধ । ...বাকিটুকু পড়ুন

একটি ছবি ব্লগ ও ছবির মতো সুন্দর চট্টগ্রাম।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৮:৩৮


এটি উন্নত বিশ্বের কোন দেশ বা কোন বিদেশী মেয়ের ছবি নয় - ছবিতে চট্টগ্রামের কাপ্তাই সংলগ্ন রাঙামাটির পাহাড়ি প্রকৃতির একটি ছবি।

ব্লগার চাঁদগাজী আমাকে মাঝে মাঝে বলেন চট্টগ্রাম ও... ...বাকিটুকু পড়ুন

×