somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

কথাচ্ছলে মহাভারত - ৬৩

০১ লা সেপ্টেম্বর, ২০১৪ সকাল ১১:৪৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
হিড়িম্ব–রাক্ষস বধঃ



ভীম ও হিড়ম্বা যখন কথোপকথন করছিলেন হিড়ম্ব তাদের দুর থেকে নিরীক্ষণ করল। হিড়িম্বা ভুবনমোহন রূপে বিদ্যু ঝলকে ভীমের বামদিক আলো করে বসে আলাপ করছে। খোপায় তার ফুলের মালা, গলায় মুক্তা-মানিক-প্রবালের মালা দুলছে। পায়ে নূপুর কঙ্কণ, বসন ভূষণ সজ্জায় যেন স্বর্গের বিদ্যাধরী, যৌবনের মোহে নবীন, কথায় প্রিয় সম্ভাষণ দেখে মনে হয় দম্পতী যুগল যেন কথা কয়।
দেখে হিড়িম্ব ক্রোধে জ্বলতে লাগল। ভগিনীকে ডেকে সে বলে -এই জন্য তোর এত দেরি হচ্ছে! কুলের কলঙ্কিনী তুই, তোর জীবনকে ধিক্কার। হে পাপিনী তুই এক মানুষকে স্বামীরূপে লোভ করছিস! আমার ক্রোধ তুই ভুলে গেলি! আমার আহারে ব্যাঘাত ঘটালি! সেই কারণে আগে তোকে মারব তারপর এদের মেরে আহার করব। এত বলে চোখ লাল করে, দাঁত কড়কড় করতে করতে সে হিড়িম্বাকে মারতে গেল।
ভীম তা দেখে বলে – রাক্ষস তোর লজ্জা করল না, বোনকে অচেনা পুরুষদের স্থানে পাঠালি। তুই পাঠালি তাই সে এলো ও মদনের শরে আক্রান্ত হয়ে আমাকে কামনা করল। আমার সামনে তুই আমার কামপত্নী, নিজের বোনকে যা খুশি বললি, আবার অহঙ্কার করে মারতে আসছিস! এখনি তোকে যমের দ্বারে পাঠাব।
বেশি গর্জন করলে মা-ভাইদের ঘুম ভেঙ্গে যাবে ভেবে ভীম রাক্ষসকে দুরে টেনে নিয়ে গেল।
ভীমের কথা শুনে হিড়িম্ব দুহাত বাড়িয়ে তাকে মারতে এগিয়ে এলো। হেসে কুন্তীপুত্র তাকে একটানে নিজের দিকে টেনে নিলেন। এভাবে রাক্ষস ও ভীমের ভীষণ যুদ্ধ শুরু হল। ভীম এই যুদ্ধে পরম আনন্দ পাচ্ছিলেন। দেখে মনে হল দুটি হাতি পরস্পরকে শুঁড়ে টেনে মাটিতে ফেলছে। দুই মোষ যেন মাথা ঠুকেঠুকে যুদ্ধ করছে। দুই মত্ত সিংহ যেন দাঁত কড়মড় করে ঘনঘন নিশ্বাস সিংহনাদ দিচ্ছে। মেঘেরা যেন আহ্লাদে গর্জন শুরু করেছে। তাদের আস্ফালনে বৃক্ষ ভেঙ্গে পড়তে লাগল। বন্যপ্রাণীরা পালাতে লাগল। সম্পূর্ণ বন তাদের গর্জনে কাঁপতে লাগল।
কুন্তী ও চারভাই শব্দে জেগে উঠলেন। কুন্তী পাশে সুন্দরী চিন্তিতা হিড়িম্বাকে বসে থাকতে দেখে অবাক হলেন। আশ্চর্য হয়ে দ্রুত উঠে বসে তিনি হিড়িম্বাকে জিজ্ঞেস করলেন –কে তুমি অপ্সরা, নাগিনী না বনের দেবী! কোথা থেকে এলে!


হিড়িম্বা কুন্তীকে প্রণাম করে বলে – জাতে আমি রাক্ষসী। এ বনেই আমার বাস। আমার ভাই হিড়িম্ব মহাযোদ্ধা বীর রাক্ষস। আপনাকে ও পাঁচভাইকে ধরে আনার জন্য আমাকে পাঠায়। কিন্তু আপনার পরম সুন্দর পুত্র ভীমকে দেখে আমি তাকে স্বামীরূপে কামনা করি। দেরি দেখে ভাই এখানে চলে আসে এবং আপনার ছেলের সাথে এখন তার যুদ্ধ হচ্ছে।
হিড়িম্বার মুখে সব শুনে চারভাই যুদ্ধস্থানে উপস্থিত হলেন। ভীম-হিড়িম্বের বর্ণনাতিত সাঙ্ঘাতিক যুদ্ধ হতে দেখলেন। তাদের যুগল পর্বতের মত লাগল। দুজনেই ধুলোয় ধূসর। কুয়াসায় যেন পর্বত আচ্ছাদিত। দুজনেই দুজনকে টানছে। তাদের নিশ্বাস ঝড়ে বৃক্ষ উড়ে গেল।
সব দেখে যুধিষ্ঠির চেঁচিয়ে বললেন- ভাই রাক্ষসকে ভয় পেয় না। আমরা ঘুমাচ্ছিলাম তাই তোমাদের ঝগড়ার কথা কিছু জানতে পারিনি। এখনি সব ভাই মিলে রাক্ষসকে মারব।
শুনে দুঃখিত হয়ে ভীম বলেন – কেন আমায় সন্দেহ করছ। এখনি আমি রাক্ষস বিনাশ করব। তোমারা দুরে দাঁড়িয়ে দেখ। বলে হাত বাড়িয়ে হিড়িম্বকে মারতে গেলেন।
অর্জুন বলেন – রাক্ষসের সাথে অনেক যুদ্ধ করলেন, অনেক পরিশ্রম হল, এখন আপনি বিশ্রাম করুন, আমি এই দুষ্ট নিশাচরের বিনাশ করব।


অর্জুনের কথায় ভীম আরো রেগে গেলেন চুল ধরে হিড়িম্বকে মাটিতে আছড়ে ফেললেন। চড়-চাপড়-ঘুষি-পদাঘাত চলতে লাগল। পাখির মত তাকে শেষ করলেন। মাঝখান থেকে দুইখান করলেন। তারপর ভাইদের দেখালেন। পঞ্চভাই পরষ্পরকে আলিঙ্গন করলেন। চারভাই বৃকোদর ভীমের বহু প্রশংসা করতে লাগলেন।
অর্জুন যুধিষ্ঠিরকে ব্যগ্র হয়ে বলেন- ঐ সামনে একটা গ্রাম দেখতে পাচ্ছি এখনি সেখান থেকে কেউ এসে সব দেখে দুর্যোধনকে খবর দেবে, তাই এখানে আমাদের থাকা নিরাপদ নয়, শীঘ্র অন্য স্থানে যাওয়া উচিত। এই সব ভেবে কুন্তী ও পাঁচভাই দ্রুত সেস্থান থেকে গমন করলেন।

হিড়িম্বা কুন্তীর সাথেই যেতে লাগল। হিড়িম্বাকে দেখে ভীম রেগে গেলেন। চেঁচিয়ে বললেন – রাক্ষসরা সহজেই মায়া করতে পারে। মোহিনীরূপ ধরলেও স্বভাব একই থাকে। সময় গেলে এও আমাদের মারবে। ভায়ের প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতে, আমাকে হত্যার উদ্দেশ্যেই সে আমাদের সাথে চলেছে। এক চড়ে তোকেও ভায়ের কাছে পাঠাব।
এই বলে ভীম হিড়িম্বাকে মারতে এল।

যুধিষ্ঠির তাকে বাঁধা দিয়ে বলেন- ভীম ধর্মে বলে স্ত্রীজাতিকে বধ করা অন্যায়। তুমি কেন এমন পাপ কাজ করছ! তোমাকে মহা বলবান হিড়িম্ব মারতে পারল না, এর কি শক্তি যে তোমায় সংহার করবে!
যুধিষ্ঠিরের কথায় ভীম শান্ত হলেন।
হিড়িম্বা কাতর কণ্ঠে কুন্তীকে বলে –কায়মনোবাক্যে আমি সত্য অঙ্গীকার করছি তুমি ছাড়া আমার আর গতি নেই। তোমাকে মিথ্যে বলছি না, তুমিও নারী আমার মনোকষ্ট তুমি বুঝবে। কামবশে অজ্ঞান হয়ে আপন ভাই ও কুল ত্যাগ করে তোমার পুত্রকে ভালবাসলাম। এখন সব হারিয়ে আমি তোমার শরণে এসেছি। শরণাগতের উপর ক্রোধ অনুচিত, আপনি দয়া করে আমার ব্যবস্থা করুন। সব সময় আমি আপনার সেবা করব। সব সঙ্কট থেকে উদ্ধার করব। আপনি ভীমকে আজ্ঞা করুন আমাকে গ্রহণ করার জন্য। না হলে এখনি আপনার সামনে আমি প্রাণত্যাগ করব। কৃতাঞ্জলি করে আমি সবিনয়ে এ অনুরোধ জানাচ্ছি। না হলে অধর্ম অবশ্যই হবে।


হিড়িম্বার এত কথা শুনে দয়াময় যুধিষ্ঠির বলেন – হিড়িম্বা মন থেকে সত্য কথা বলছে। কেউ শরণ চাইলে তাকে রক্ষা করতে হয়। ভাই ভীম তুমি হিড়িম্বাকে নিয়ে সুখে বনের ভিতর বিচরণ কর । পরে আবার আমরা দেখা করব। আমার বাক্য লঙ্ঘন করো না।


ধর্মপুত্রের আজ্ঞা পেয়ে হিড়িম্বা খুশি হল এবং ভীমকে নিয়ে শূণ্যপথে চলে গেল। নানা বনে উপবনে যেখানে খুশি তারা ঘুরে বেড়াতে লাগল মনের আনন্দে। কত নদ-নদী-পাহাড়-পর্বত ঘুরলো, নতুন নতুন সাজে পরস্পরকে আকর্ষণ করে বহুদিন কাটাল। এর কিছু পরেই ঋতুযোগে হিড়িম্বা গর্ভবতী হল। ভয়ঙ্কর মূর্তির এক পুত্র সে জন্ম দিল। জন্মমাত্র পুত্র মহাবীর যুবক হল। তার বিশাল শরীর ঘটের মত মাথা ও খাড়া খাড়া চুল – ভীম তার নাম রাখল ঘটোৎকচ। এই মহা বলবান হিড়িম্বাপুত্রই হবে ইন্দ্রের একাঘ্নী শক্তির আধার। ঘটোৎকচ মায়ের সঙ্গে আলোচনা করে ভীমকে কৃতাজ্ঞলি সহ দন্ডবৎ করে বলেন – আজ্ঞা করুন আমরা নিজেদের স্থানে যাই। যখনই স্মরণ করবেন অবশ্যই উপস্থিত হব।


মাতা ও পুত্র ভীমের আজ্ঞা পেয়ে উত্তরদিকে নিজেদের স্থানে যাত্রা করল। ভীম আবার মা ও ভাইদের সাথে মিলিত হলেন। তারা একস্থান থেকে অন্যস্থানে ঘুরতে লাগলেন। কোন স্থানে এক রাত্রের বেশি অবস্থান করলেন না। পরিধানে গাছের ছাল, মাথায় জটার ভার। কোথাও ব্রাহ্মণ কোথাও তপস্বী রূপে তারা থাকতে লাগলেন। পথে লোক দেখলে বনে লুকিয়ে পরতেন। যেখানে কেউ থাকেনা সেখানেই আশ্রয় নিতেন। ত্রিগর্ত, পাঞ্চাল, মৎস্য ও অনেক দেশে বহু কষ্টে ভ্রমণ করে বেরাতে লাগলেন।

হঠাৎ একদিন ব্যাসদেব পান্ডবদের কাছে এসে উপস্থিত হলেন। তাকে দেখে কুন্তীদেবী এগিয়ে এসে সবার সাথে ব্যাসকে প্রণাম জানালেন। ব্যাসকে দেখে কুন্তী নিজেকে সংবরণ করতে পারলেন না। বহু বিলাপ করতে করতে কাঁদতে লাগলেন।
বেদব্যাস তাকে সান্তনা দিয়ে বললেন - আমাকে কি আর বলবে, সবই আমি জানি। ধৃতরাষ্ট্রের পুত্ররা অধর্ম করল তোমাদের সাথে। তাই আজ তোমাদের বনে বনে ভয়ে দিন কাটাতে হচ্ছে। তারা যা করেছে সব আমার গোচরে এসেছে সে জন্যই তোমাদের দেখতে এলাম। তিনি পুত্রবধূকে মনস্থির করে দুঃখ করতে বারণ করলেন এবং আশির্বাদ করলেন অচিরেই সব দুঃখ দুর হবে।
ব্যাস বলেন – তোমার পুত্রদের গুণ তুমি যান না, আমি সব জানি। ধর্মবলে, বাহুবলে সকলকে জয় করবে, সাগরান্ত ভূমন্ডলের সম্পদ হবে। এখন আমি যা বলছি সাবধানে শোন। বহু দুঃখে অনেক বনে ঘুরলে। এখন কাছেই একচক্রা নামে এক নগর আছে। কিছুদিন সেখানে বিশ্রাম কর। গোপনে ছন্মবেশে ছয়জনে বাস কর সেখানে যতদিন না আমি ফিরে আসি।
এত বলে ব্যাসদেব তাদের নিয়ে একচক্রা নগরে চললেন। সেখানে এক ব্রাহ্মণের গৃহে তাদের থাকার ব্যবস্থা হল। ব্রাহ্মণের ঘরে ছয়জনকে রেখে ব্যাসদেব চলে গেলেন।
......................................
উৎসর্গ: সকল ব্লগার বন্ধুকে
......................................
আগের পর্ব:

কথাচ্ছলে মহাভারত - ৬২
Click This Link
৯টি মন্তব্য ৯টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আপনি কি পথখাবার খান? তাহলে এই লেখাটি আপনার জন্য

লিখেছেন মিশু মিলন, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১০:৩৪

আগে যখন মাঝে মাঝে বিকেল-সন্ধ্যায় বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিতাম, তখন খাবার নিয়ে আমার জন্য ওরা বেশ বিড়ম্বনায় পড়ত। আমি পথখাবার খাই না। ফলে সোরওয়ার্দী উদ্যানে আড্ডা দিতে দিতে ক্ষিধে পেলে... ...বাকিটুকু পড়ুন

কষ্ট থেকে আত্মরক্ষা করতে চাই

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৯



দেহটা মনের সাথে দৌড়ে পারে না
মন উড়ে চলে যায় বহু দূর স্থানে
ক্লান্ত দেহ পড়ে থাকে বিশ্রামে
একরাশ হতাশায় মন দেহে ফিরে।

সময়ের চাকা ঘুরতে থাকে অবিরত
কি অর্জন হলো হিসাব... ...বাকিটুকু পড়ুন

রম্য : মদ্যপান !

লিখেছেন গেছো দাদা, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৫৩

প্রখ্যাত শায়র মীর্জা গালিব একদিন তাঁর বোতল নিয়ে মসজিদে বসে মদ্যপান করছিলেন। বেশ মৌতাতে রয়েছেন তিনি। এদিকে মুসল্লিদের নজরে পড়েছে এই ঘটনা। তখন মুসল্লীরা রে রে করে এসে তাকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

= নিরস জীবনের প্রতিচ্ছবি=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৪১



এখন সময় নেই আর ভালোবাসার
ব্যস্ততার ঘাড়ে পা ঝুলিয়ে নিথর বসেছি,
চাইলেও ফেরত আসা যাবে না এখানে
সময় অল্প, গুছাতে হবে জমে যাওয়া কাজ।

বাতাসে সময় কুঁড়িয়েছি মুঠো ভরে
অবসরের বুকে শুয়ে বসে... ...বাকিটুকু পড়ুন

Instrumentation & Control (INC) সাবজেক্ট বাংলাদেশে নেই

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৫৫




শিক্ষা ব্যবস্থার মান যে বাংলাদেশে এক্কেবারেই খারাপ তা বলার কোনো সুযোগ নেই। সারাদিন শিক্ষার মান নিয়ে চেঁচামেচি করলেও বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরাই বিশ্বের অনেক উন্নত দেশে সার্ভিস দিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×