'আমি তো এগিয়ে আছি
ভয়, সে তো কবেই গেছে দূরে
আরো দূর নক্ষত্র যাবে
সঙ্গে যাবে কে?'
এভাবে বালকটি তার বুক থেকে কথামালা ঝেড়ে ফেলতে উদ্যোগী হলে 'প্রাণের বিনিময়ে প্রাণ' কর্মটি সম্পাদিত হয়ে গেলো বাংলাদেশে। এক মস্ত বড় দম্ভের ভেতর রাষ্ট্রকর্তৃক দায়িত্বটি বহুদিন ঝুলেছিল। কেউ এগিয়ে আসেনি, ৭৫ পরবর্তী কোনো রাষ্ট্রনায়কই আমলে আনেনি - একটি জাতির জন্মমুখ রক্ষা করতে, জাতির মহানয়কদের ব্যাপারে পক্ষের-বিপক্ষের কেউ উচ্চবাচ্য করেনি কেবল রাজনৈতিক স্বার্থ ছাড়া। বরং এই খুনিদের সহায়তায় রাষ্ট্রচিন্তাকে পিছিয়ে দেয়ার প্রক্রিয়াটি প্রতিদিন বলবান হয়েছে বেশি।
একজন অপরাধীর যখন শাস্তি হয়ে যায়, সেখান থেকে মানুষটিকে আমরা নতুনভাবে দেখার চেষ্টা করবো। অর্থাৎ অপরাধীর জীবনের সবচে মূল্যবান 'প্রাণ'টি আদালতকর্তৃক হরণ করার মাধ্যমে রাষ্ট্র ও বাদীপক্ষ তাকে মুক্তি দিয়েছে। হোক সেটা প্রাণের বিনিময়ে অথবা যাবজ্জীবন-এর মাধ্যমে। সভ্যতার লগ্ন থেকে মানুষকে তার পাপের শাস্তি প্রদান করার পর আর সে ঘৃণীত হতে পারে না। অনেকে এদের মির্জাফরের সঙ্গে মিলিয়ে কথা বলতে সচেষ্ট হয়েছেন। জেনে রাখতে হবে যে মির্জাফরের বিচার আজও হয়নি। তার পাপের সাজা রাষ্ট্র দিতে অক্ষম ছিল বা সে যোগ্যতা রাষ্ট্রের ছিল না। (এখানে বুঝতে হবে আমাদেরই কিছু বিপদগামী সৈনিক-মুক্তিযোদ্ধাকর্তৃক জাতির মহানায়কদের হত্যার কাজটি সংগঠিত হয়েছে, তাদের বিচারের ভার রাষ্ট্র নিয়েছে এবং তাদের মুক্তি দিয়েছে) আমাদের সেই জায়গা থেকে এদের মূল্যায়ন করতে হবে। তাদের কৃতকর্মের আলোচনা হবে, মুল্যায়ন হবে - ইতিহাসের প্রাপ্য জায়গাটিতে তারা স্থান পাবে, তাদের কর্তৃক অন্যায়ের সমালোচনাও হবে। এটাই স্বাভাবিক।
তারা আত্মস্বীকৃত খুনি জেনেও রাষ্ট্র তাদের আত্মপক্ষ সমর্থনের সর্বোচ্চ সুযোগ দিয়েছে। অর্থাৎ এটা থেকেই আমাদের জ্ঞাত থাকতে হবে যে, অপরাধী যত বড় দোষকর্ম করে থাক না কেন তাকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দিতে হবে। কোনোভাবেই ঘৃণার বশবর্তী হয়ে তাকে বঞ্চিত করা যাবে না।
বঙ্গবন্ধুকে স্বপরিবারে হত্যা ও পরে জেলে জাতীয়চারনেতাকে হত্যার মাধ্যমে খুনিরা কী পরিমাণ ঘৃণা নিয়ে গত ৩৪ বছর প্রবল প্রতাপের সাথে পৃথিবীময় চষে বেড়িয়েছে তা আমাদের সকলের জানা। কী ধরণের ঘৃণাপোষলে একজন মানুষ রাসেলের মতো শিশুকে হত্যা করতে পারে, গর্ভবতীকে পিষ্ট করতে পারে তা অনুমান করা স্বাভাবিক মানুষদের পক্ষে সত্যিই কষ্টকর। হত্যা করেই তারা ক্ষান্ত হয়নি, সেই ঘৃণা আমরা প্রতিদিন রাস্তাঘাটে দেখেছি বছরের পর বছর। ১৯৯১ সালে স্বৈরাচার এরশাদের পতের পর যে নির্বাচন হয়েছিল, সে-সময় যারা ঢাকার চিত্র দেখেছেন একবার অনুমান করতে পারবেন সেটা কেমন ছিল। ঢাকার দৈনিকবাংলা মুড়ে আওয়ামী লীগের তোরণের ঠিক উপরে 'ফ্রিডম পার্টি' তোরন বেঁধেছিল। ঠিক শেখ হাসিনার বিশাল পোস্টারের উপর ইলেক্ট্রনিক কোড়াল (ফ্রিডম পার্টির প্রতীক) বেঁধে রাখা হয়েছিল, যা সর্বক্ষণ তার মাথার উপর ঘুরছিল। ফ্রিডম পার্টি কর্তৃক এটি একটি বার্তা ছিল। সে বার্তা হলো সন্ত্রাসের বার্তা। অন্য একটি ঘটনা : রাস্তার টোকাইদের কাছে মাইক ও টেম্প্যু ধরিয়ে দিয়ে তাদের শ্লোগান শিখিয়ে দেয়া হতো - 'এক টেহা সের আডা হাসিনার (....) ফাডা'। অনুচ্চারিত উক্তিটির মাধ্যমে অনুমান করে নিন তাদের নিকৃষ্টতম ভাষাটি কেমন ছিল। এই ছিল তথাকথিত রাজনৈতিক দলের সর্বোচ্চ নিকৃষ্টতম ঘৃণা ও সন্ত্রাসীভাবাপন্ন ভাষা যা গত ৩৪ বছর আমাদের চোখের সামনে প্রবল-দম্ভের সাথে ঘুরে বেড়িয়েছে।
আজ তাদের পতনের পর, এমনকি রাষ্ট্র তাদের সুবিচার দেয়ার পরও আমরা কি তাদের সেই মানসিকতা লালন করবো? তাহলে তাদের ঘৃণার ভাষার সঙ্গে আমাদের পার্থক্য নির্ণয় করবে কীভাবে? পক্ষ-বিপক্ষ উভয় দিক থেকে যদি সমান ঘৃণা ও মানসিকতা পোষন করে থাকি তাহলে জাতি হিসেবে কি আমরা এমনই দৈন্য যে, আমরা কখনই সুস্থতার প্রকাশ দেখাতে পারবো না। শুভবোধ এর শুরু যেখান থেকে সেখানে অশুভ আচরণ কোনোভাবেই কাম্য নয়।
শুরুতে একটি কবিতার চরণ উদ্ধৃত করেছিলাম। হ্যা, আমরা আরো দূর যেতে চাই। আমাদের সামনে পড়ে আছে এখনও পবর্তসম সমস্যা ও জঞ্জাল। সেই নষ্টরাজনীতি ও জঞ্জাল সরাতে হলে অবশ্যই আমাদের আরো সহনশীল হতে হবে।