বাংলা ভাষার বাগধারা, প্রবাদ-প্রবচন এর অনেক শব্দই আমরা সবসময় ব্যবহার করি, কিন্তু সেটার উৎপত্তির ইতিহাস জানি না। আমি এই লেখায় চেষ্টা করেছি এই বাংলা শব্দ, প্রবাদ-প্রবচন ও বাগধারার পেছনের গল্প লিখতে। যেহেতু শত শত বছর ধরে মানুষের মুখে মুখে প্রচলিত এই শব্দের উৎপত্তি লিখিতভাবে ছিলো না, তাই উৎপত্তির বিষয়ে একাধিক প্রচলিত কাহিনী রয়েছে।
১) অক্কা পাওয়া - মারা যাওয়া
ফারসি “আকা” শব্দটি বিকৃত হয়ে বাংলায় “অক্কা” হিসেবে এসেছে। “আকা” অর্থ ঈশ্বর বা প্রভু। সুতরাং অক্কা পাওয়া অর্থ প্রভুকে পাওয়া। যেহেতু মৃত্যু হলে আমরা বলি ঈশ্বরের কাছে চলে গেছে বা প্রভুর তাকে নিয়ে গেছে, তাই মারা যাওয়াকে কৌতুকাচ্ছলে বোঝাতে অক্কা পাওয়ার প্রচলন হয়।
২) অকালকুষ্মাণ্ড - অপদার্থ, অকেজো
“অকাল” মানে অসময় আর কুষ্মাণ্ড অর্থ কুমড়ো। অকালকুষ্মাণ্ড অর্থ অসময়ে জন্মানো কুমড়ো।
অসময়ে যে কুমড়া জন্মায় তা কোন কাজে আসে না, স্বাদ নেই তাই খাওয়া যায় না। তাই অকেজো বা অপদার্থ কিছু বোঝানোর জন্য অকালকুষ্মাণ্ড ব্যবহার করা হয়।
৩) অক্ষয়বট - অতিবৃদ্ধ ব্যক্তি
হিন্দু পূরাণ মতে, অক্ষয়বট হচ্ছে একটি বটগাছ, যার মৃত্যু নেই। এজন্য অতিবৃদ্ধ কাউকে বোঝাতে এই শব্দটি ব্যবহৃত হয়।
ঋষি মার্কন্ডেয় দেবতা নারায়ণের কাছে একটি ঐশ্বরিক সৃষ্টির নমুনা দেখতে চাইলে, নারায়ণ কিছু সময়ের জন্য পুরো পৃথিবী বণ্যায় প্লাবিত করে দেন। এই বন্যার মাঝে শুধু অক্ষয় বটকেই পানির উপরে দেখা যায়।
ভারতের এলাহাবাদে (বর্তমান প্রয়াগরাজ) এই অক্ষয়বট গাছ অবস্থিত। এছাড়া বিহারের গয়ায়, বারাণসীতে অক্ষয়বট গাছ রয়েছে। অনেকেই বুদ্ধদেব এর বোধিবৃক্ষকেও অক্ষয়বটের একটি প্রজাতি মনে করে। তিব্বতি বিশ্বাস মতে, বুদ্ধদেব এলাহাবাদের অক্ষয়বটের একটি বীজ কৈলাস পর্বতের পাশে রোপণ করেছিলেন, সেখানেও একটি অক্ষয়বট আছে।
ছবি এলাহাবাদ (বর্তমান প্রয়াগরাজ) এর অক্ষয়বট
কথিত আছে, সম্রাট জাহাঙ্গীর এলাহাবাদের অক্ষয়বট গাছ গোড়া থেকে কেটে ফেলেন এবং গাছের কান্ড উত্তপ্ত গরম লোহার বড় পাত্র দিয়ে সিল করে দেন। কিন্তু এক বছরের ভেতরেই লোহা ভেদ করে অক্ষয়বট নতুন করে শাখা প্রশাখা বিস্তার করে। - সূত্রঃ স্যার যদুনাথ সরকার লিখিত Shivaji and His Times
৪) উজবুক - আহাম্মক, আনাড়ি
মুসলমান শাসকগন যুদ্ধ ও প্রতিরক্ষার প্রয়োজনে উজবেকিস্তান থেকে ভাড়া করে সৈনিক আনত। এই সৈন্যদের কে উজবেক বা উজবক বলা হত। এই উজবেক সৈন্যরা স্বাস্থ্যবান ও প্রচণ্ড শক্তিশালী হলেও উপস্থিত বুদ্ধি কম ছিল। এইজন্য বোকা বা আহাম্মক শব্দের সাথে উজবুক শব্দটা জুড়ে যায়
৫) পড়েছি মোগলের হাতে, খানা খেতে হবে সাথে – বাধ্য হয়ে/ইচ্ছা না থাকা সত্বেও কোন কাজ করা
ভারতবর্ষের বেশিরভাগ মানুষ সাধারনত নিরামিষাভোজী ছিলো। কিন্ত মুঘল শাসকগন মাছ, মাংস ও আমিষ খাবার বেশি পছন্দ করতেন। এবং তারা একা খাবার খেতেন না, সভাসদ ও রাজ-কর্মকর্তাদের সাথে বসিয়ে সবাই একসাথে খেতেন। তাই অনেকে আমিষ পছন্দ না করলেও সম্রাটের হুকুুম মানতে বাধ্য হয়ে খেতে বসতেন।
৬) গড্ডলিকা প্রবাহ - অন্ধ অনুসরণ
গড্ডল শব্দের অর্থ ভেড়া / মেষ। গড্ডল শব্দের স্ত্রীলিঙ্গ হচ্ছে গড্ডলিকা।
একটি ভেড়ার পালের একদম অগ্রগামী ভেড়ীকে 'গড্ডলিকা' বলা হয়। এই গড্ডলিকাকেই বাকি ভেড়া/ভেড়ীগুলো অন্ধভাবে অনুসরণ করে।
৭) 'সাত খুন মাফ' - অত্যধিক প্রশ্রয় / অপরাধ গণ্য না করা
একটি গল্প প্রচলিত আছে, বৃটিশ আমলে রাজস্ব আদায়ের জন্য দেশকে ছোট ছোট অঞ্চলে ভাগ করে জমিদারি প্রথা চালু করা হয়। প্রজাদের কাছ থেকে রাজস্ব আদায়ের জন্য জমিদাররা প্রজাদের উপর শক্তি প্রয়োগ করত এবং অনেক ক্ষেত্রে তা খুন পর্যন্ত গড়াতো। রাজস্ব আদায়ের প্রয়োজনে বৃটিশ শাসকরা জমিদার ও তাদের লাঠিয়ালদের সাতটি পর্যন্ত খুনের অনুমোদন দেয় এবং এজন্য তাদের কোনো বিচারের সম্মুখীন হতে হতো না।
আবার আরেকটি প্রচলিত মত হচ্ছে, নীলকরদের নীলচাষের জন্য অনেক ছাড় দেয়া হতো। বিদ্রোহ দমন ও চাষে বাধ্য করতে খুন-খারাবী হলেও শাস্তি হতো না। সেখান থেকেই সাত খুন মাফ প্রবাদের উৎপত্তি।
৮) আটঘাট বেঁধে লাগা - প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নিয়ে কাজে নামা।
একটি তবলার প্রতিটি ঘুটির উপর চামড়ার যে দুটি ফিতা বা চ্যাপ্টা দড়ি থাকে তার মাঝের অংশকে ঘাট বলা হয়। তবলায় ঘাট আটটি। তবলা বাজানোর পূর্বে গুটির উপর হাতুড়ি ঠুকে ঠুকে ঘাটগুলো যত্নসহকারে খুব গভীরভাবে যাচাইকরে বেঁধে নিতে হয়। নইলে তবলার আওয়াজ শুদ্ধ হয় না।
হাতুুুরি ঠুুকে তবলার ঘাট বেঁঁধে নেয়া হচ্ছে
তবলা বাজানোর আগে তবলা বাদক প্রয়োজনীয় এই কাজটি অবশ্যই সেরে নেন। এর থেকেই কোনো বিশেষ কাজ শুরু করার আগে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি সেরে নেওয়াকে আটঘাট বেঁধে কাজ শুরু করা বলা হয়।
৯) পটল তোলা - মৃত্যু
ফলবান পটলগাছের সবগুলি পটল তুলে নিলে গাছটি মারা যায়।
১০) বিনা যুদ্ধে নাহি দিব সূচ্যগ্র মেদিনী - নিজের কথায়/অধিকারে অনড় থাকার দৃঢ়প্রত্যয়ী
মহাভারতে দূর্যোধন ও শকুনির চালাকিতে কৌরবরা যুধিষ্ঠিরকে পাশা খেলায় হারিয়ে দেয়য়। পাশার বাজিতে যুধিষ্ঠির নিজের রাজ্য, সম্পদ হারায়। এমনকি ভাইদের এবং নিজেকেও বাজিতে রেখে হেরে যায়, এবং কৌরবদের দাস হয়ে যায়। এরপর নিজে(দে)র স্ত্রী দ্রৌপদীকেও বাজিতে রেখে হেরে যায়।
হিন্দুুু দেবতা শ্রীকৃষ্ণ দ্রৌপদীর বস্ত্রহরনের সময় মায়াশক্তির মাধ্যমে সম্মান রক্ষা করেন
দুঃশাসন দাসীতে পরিনত হওয়া দ্রৌপদীকে সবার সামনে বস্ত্রহরন করার চেষ্টা করে এবং দ্রৌপদী দেবতা শ্রীকৃষ্ণকে স্বরন করলে দেবতা শ্রীকৃষ্ণ তার মায়াশক্তিতে দ্রৌপদীর সম্মান রক্ষা করেন।
এটা দেখে ভয়ে ধৃতরাষ্ট্র পান্ডবদের সকল সম্পদ ও রাজ্য ফিরিয়ে দেয়। তবে শর্ত থাকে যে পাণ্ডবদের ১২ বছরের বনবাস ও ১ বছরের অজ্ঞাতবাসে থাকতে হবে এবং এই ১৩ বছরের জন্য পাণ্ডবদের রাজ্যের শাসন কৌরবরা নিজেদের হাতে নিয়ে নেয়।
বনবাসে পাঠানোর সময় পাণ্ডবদের বলা হয় ১৩ বছর পর তারা যখন ফিরে আসবে তখন তাদের রাজ্য ও শাসন অধিকার ফিরিয়ে দেওয়া হবে। কিন্তু ১৩ বছর পর পাণ্ডবরা যখন ফিরে আসে তখন কৌরবরা প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে পাণ্ডবদের রাজ্য ফিরিয়ে দিতে অস্বীকৃতি জানায়। এই পরিস্থিতিতেই কৌরব ও পাণ্ডবদের মধ্যে শুরু হয় কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ।
দেবতা শ্রীকৃষ্ণ রক্তপাত এড়ানোর জন্য শান্তিদূত হিসাবে কৌরব পক্ষের দুর্যোধনের কাছে যান এবং পুরো রাজ্যের বদলে পাঁচ পাণ্ডবের জন্য কেবল পাঁচটি গ্রাম ভিক্ষা চান। কিন্তু দুর্যোধন এ প্রস্তাবে অস্বীকৃতি জানিয়ে বলে, বিনা যুদ্ধে নাহি দিব সূচ্যগ্র মেদিনী, অর্থাৎ একটি সুঁইয়ের অগ্রভাগে যে কণা পরিমাণ ভূমি রাখা যায় তাও পাণ্ডবদের দেওয়া হবে না যতোক্ষণ না তারা সেটা যুদ্ধ জয় করে নিতে পারছে।
১১) অষ্টরম্ভা - কিছুই না, ফাঁকি
অষ্ট অর্থ আট আর রম্ভা অর্থ কলা গাছ/কলা।
সনাতন ধর্মের অষ্টসিদ্ধি যোগদর্শনে আটটি সিদ্ধির কথা বলা আছে ।
যথাঃ ১. অনিমা ২. লঘিমা ৩. গরিমা ৪. প্রাপ্তি ৫. মহিমা ৬. ঈশিতা ৭. বশিতা ও ৮. প্রাকাম
এই আটটি সিদ্ধির রম্ভা বা কলা (ব্যাঙ্গার্থে শূন্য/অনুপস্থিতি) মানে সিদ্ধির ফাঁকি বা “কিছুই না”
১২) বারোভাতারী - যে মহিলার একাধিক পুরুষের সাথে প্রণয় আছে
ভাতার অর্থ যে ভাতের যোগান দেয়। বাংলায় স্বামী বোঝাতে এই শব্দ ব্যবহার হয়।
বারোভাতারী শব্দের অর্থ যার ভাত বারোজন যোগান দেয়, অর্থাৎ বারো জন স্বামী আছে। চরিত্রহীন কিংবা একাধিক প্রণয়ের সম্পর্ক থাকা নারীর ক্ষেত্রে এই বিশেষন ব্যবহৃত হয়।
১৩) পরের ধনে পোদ্দারি - অন্যের সম্পদ নিজের ভোগে ব্যবহার
"পোদ্দার" পদবীটা আদতে একটি পেশা বা পদের নাম। কোষাধ্যক্ষ বা খাজনাদির আদায় ও হিসাব রাখার ভারপ্রাপ্ত কর্মচারীদের পোদ্দার বলা হতো। পোদ্দার পদের কর্মচারী সাধারনত জনগন থেকে খাজনা আদায় করতো। অনেক পোদ্দার আবার খাজনার এই অর্থ সূদে ধার দিতো। অন্যের অর্থে এভাবে নিজের লাভ করাই পোদ্দারি হিসেবে মানুষের মুখে প্রচলিত হয়ে গেছে।
১৪) গদাই লশকরি চাল - আলসেমী, ঢিলেমী
প্রাচীন ভারতীয় অঞ্চলে গদা নামে একটি অস্ত্র ছিলো। যা দেখতে বড় একটি লাঠির মতো লম্বা এবং এর মাথায় বড় গোল বলের মতো। এই গদা যে সৈন্য ব্যবহার করতো, তাকে গদাধর বলা হতো। গদাধর থেকে সংক্ষেপে গদাই শব্দটি এসেছে।
গদাই লশকর - গদাধারী সৈন্য
আর লস্কর/লশকর হচ্ছে সৈনিকের একটি পদবী। সাধারনত ভারী গদা বহন করায় গদাধারী লস্কর যুদ্ধযাত্রায় একটু পিছিয়ে পরতো, ধীর গতির হতো। এই ধীরগতিকেই অন্য সৈনিকেরা গদাই লস্করদের অলস আর ঢিলেমী বলে মজা নিতো।
১৫) নখদর্পণে থাকা - নিখুঁত ও স্পষ্ট জ্ঞান থাকা
নখদর্পণ শব্দটি ভাঙলে পাওয়া যায় নখ ও দর্পণ। নখ তো হাত/পায়ের আঙুলের নখ বোঝাই যাচ্ছে, দর্পণ অর্থ আয়না।
প্রাচীনকালে মুনি-ঋষিগন নিজের বুড়ো আঙুলের নখের দিকে তাকিয়েই ভুত-বর্তমান-ভবিষ্যৎ বলতে পারতেন। এজন্যই বলা হতো, সবকিছু তাদের নখদর্পণে।
সূত্র :
১) প্রবাদের উৎস সন্ধানে- সমর পাল
২)ফাউনটেনপেন - হুমায়ূন আহমেদ
৩) উইকিপিডিয়া
৪) কোরা
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে জুলাই, ২০২১ সন্ধ্যা ৭:৪০