somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

মেয়েটি- কাফি কামাল (মৌলিক গল্প)- প্রথম অংশ

০৮ ই মে, ২০১৩ রাত ১০:২৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

মেয়েটি
কাফি কামাল
সারাদিন উত্তাপ ছড়িয়ে, আলো বিলিয়ে ক্লান্ত সূর্য হেলে পড়েছে পশ্চিমে। মিইয়ে আসছে রোদের উত্তাপ। পেটে তিনটি রুই-কাতলা নিয়ে কোর্টকাচারী থেকে বেগমবাজারের উদ্দেশ্যে ছুটছে লক্করঝক্কড় প্রিজন ভ্যানটি। চিকন রডের জালি ধরে প্রিজন ভ্যানের ভেতরে দাঁড়িয়ে আছেন তারা। তিনজন বর্ষীয়ান নেতা। আবদুল গাফ্‌ফার খান, নুর হোসেন সিকদার ও সোলাইমান তালুকদার। মাসখানেক আগেও যারা ছিলেন দণ্ডমুণ্ডের কর্তা। বাস করতেন সরকারি বাড়িতে। তাপানুকুল গাড়িতে জাতীয় পতাকা উড়িয়ে পুলিশি পাহারায় ছুটে বেড়াতেন দেশের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত। রাজধানী শহরে তাদের গাড়ি ছুটে যাওয়ার সময় মোড়গুলো বন্ধ করে দিতো পুলিশ। রাস্তার দু’পাশে স্টাচুর মতো দাঁড়িয়ে থাকতে হতো পথচারীদের। মাত্র এক মাসের ব্যবধান। আজ তারা তীরবিদ্ধ, ক্ষতবিক্ষত। পতাকা, এসি দূরে থাক, আজ গাড়িতে বসার টুলটিও নেই। পুলিশ পাহারা আছে বটে তবে তা নির্দেশ দেয়ার জন্য, পালনের জন্য নয়। রাস্তার দু’পাশের উঁকি মারছে কৌতূহলী মানুষ। ছুড়ে দিচ্ছে নানা মন্তব্য। একটু পর যে বাড়িতে নেয়া হবে সেটাও সরকারি। কিন্তু সেখানে চলাফেরা নিয়ন্ত্রিত, ইচ্ছে করলেই বেরোনো যায় না।
খান, সিকদার ও তালুকদার। তিনজনের কেউ নতুন নন। বেগমবাজারে যাতায়াত তাদের পুরনো। বিশেষ করে তালুকদার। এ নিয়ে আটবার। তালুকদার এটাকে চিল্লা বলে। সিকদার কিছুটা বিস্মৃতি প্রকৃতির। তিনি ভেতরবাড়ির স্মৃতি মনে করার চেষ্টা করেন। কিছুটা মনে পড়ে, কিছুটা ঝাপসা হয়ে থাকে। প্রিজন ভ্যানে দাঁড়ানো খান সাহেবের মুখে কুলুপ। দলে তিনি খান সাহেব নামেই পরিচিত। প্রভাবের কারণে সম্মানিতও বটে। তার চেহারায় রাজ্যের বেদনা। অপমানের বিষে তিনি নীল। সিকদারের চোখে আগুনের হল্কা ফুটেছে। মনে হচ্ছে কিছু জিজ্ঞেস করলেই ঘুষি মেরে বসবেন। কিন্তু অনেকটাই সহজ তালুকদার। রাজ্যপাট আর নতুন রাজন্যের প্রতি আক্ষেপ ও রাগ প্রকাশ করছেন স্বগোক্তিতে।
প্রিজন ভ্যানটি গিয়ে দাঁড়ালো বেগমবাজার ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের গেটে। উল্টোপাশের কোনায় অপেক্ষা করছেন সরকারি মেহমানদের আত্মীয়-স্বজনরা। ততক্ষণে খুলে গেছে কারাগারের মূলফটকের স্টিলের গেটটি। হুড়মুড় করে প্রিজন ভ্যানের দরোজায় ভিড় করেছে পোশাকধারী জওয়ানরা। স্টিলের গেটটি পার করে দিয়ে তারা তাদের শেষ কর্তব্যটুকু গুরুত্বের সঙ্গে পালন করবেন। প্রিজন ভ্যান থেকে নামতে নামতে খান সাহেব চারদিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিলেন। পরিচিত কাউকে চোখে পড়ছে না। প্রতিদিন সকালে বাড়ি থেকে বেরোনোর ও রাতে বাড়ি ফেরার সময় বাড়ির আঙ্গিনা ও ড্রয়িং রুমে শত শত মানুষ ভিড় করে। নানা তদবির, হরেকরকম চাহিদা, ভালোবাসার ফুলঝুরি নিয়ে। এখন থেকে অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য নিঃসঙ্গ জীবন শুরু হলো। নতুন বাড়িতেও পরিচিত লোক থাকবে, গল্প-গুজব চলবে কিন্তু ভেতরে ভেতরে তিনি নিঃসঙ্গতায় ডুবে থাকবেন। মনটা তার খুব খারাপ হয়ে গেল।
রুই-কাতলা তিনটি উগলে দিয়েই বেরিয়ে গেল প্রিজন ভ্যানটি। পোশাকী জওয়ানরাও বেরিয়ে গেলেন পেছনে পেছনে। তাদের জায়গা দখলে নিল কারারক্ষীরা। জেল সুপারের কক্ষের সামনে একটি হাতল ভাঙা টুলে বসেছেন তিনজন। খান সাহেব যে কোন পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত করছেন মনকে। তিনি খেয়াল করলেন একজন কারারক্ষী তাকে সালাম দিয়েছে ইশারায়। তার মানে কি জেলখানার মধ্যেও আতঙ্ক! তাই তিনি শব্দ করে উত্তর না দিয়ে খানিকটা মাথা দোলালেন। জেল সুপার বাইরে আছেন। অল্পক্ষণের মধ্যেই তিনি অফিসে ফিরবেন। তিনি ফিরলেই খান সাহেবদের কক্ষ নির্ধারণ হবে। ততক্ষণে নানা খাতাপত্রে অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে তাদের নাম। সহকারী জেল সুপারের বয়স কম। এখনও চল্লিশ পেরোয়নি সম্ভবত। ছেলেটি দেখতে খুবই ভদ্র। আদবের সঙ্গে নানা কাগজপত্রে তাদের সই নিলেন। তালুকদারকে কোর্টে নেয়া হয়েছিল মামলার হাজিরা দিতে। খান সাহেব ও সিকদার গ্রেপ্তার হয়েছেন একদিন আগে-পরে। তাদের কারাগারে পাঠানো হয়েছে দেখে পরিবারের লোকজন ব্যবহারের কিছু কাপড়-চোপড় দিয়ে গেছে কারা কর্তৃপক্ষের কাছে। সহকারী জেল সুপার সেগুলো তাদের হাতে দিলেন।
খান সাহেব টুলে বসে ভাবছেন। দল ক্ষমতা ছেড়ে দেয়ার পর হঠাৎ করেই যেন পাল্টে গেল সবকিছু। রাস্তায় বেরোনো যায় না। কেবল ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ, পুলিশের সঙ্গে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া আর রাজনীতিকদের বাকযুদ্ধ। অনেকদিন ধরেই গুমোট একটি আবহাওয়ায় বিরাজ করছিল দেশের আকাশে। অবশেষে সেটাই ঝড় হয়ে বয়ে এল। দু’দলের চিড় ধরা বিশ্বাসে সেতু হয়ে ক্ষমতার উঁচু চেয়ারগুলোতে বসল কয়েকজন। যারা বছরখানেক আগেও মন্ত্রীদের স্যার ডাকতেন। একটি ভাল পদের জন্য তদবির করতেন। তারাই এখন রাজদণ্ড ঘুরাচ্ছেন। একবছর আগে স্যার বলতেন, এখন বলেন দুর্নীতিবাজ; রুই-কাতলা। সে মওসুমি দণ্ডমুণ্ডের কর্তাদের নির্দেশে বাছবিচারহীনভাবে দেশে বাড়ছে দুর্নীতিবাজের সংখ্যা। তাদেরই নির্দেশে দুইদিন আগে সন্ধ্যার পরপর খান সাহেবকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে রাজধানীর অভিজাত এলাকার প্রসাদোপম বাড়ি থেকে। তখন তিনি সবে হোটেল ব্লু পয়েন্টে বিদেশী কূটনীতিকের সঙ্গে বৈঠক করে ফিরেছেন। খান সাহেব বুঝতে পেরেছিলেন তাকে গ্রেপ্তার করা হতে পারে। কিন্তু যেভাবে গ্রেপ্তার করা হয়েছে তা কল্পনাও করেননি। বিশেষ করে গ্রেপ্তার পরবর্তী দুদিনের কথা তিনি না পারছেন বিশ্বাস করতে, না পারছেন ভুলতে। গ্রেপ্তারের পর চোখে কালোকাপড় বেঁধে নেয়া হয়েছিল বিশেষ কোন জায়গায়। টেবিলের সামনে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছিল দু’ঘণ্টা। তারপর একটি অন্ধকার শূন্যকক্ষে। সেখানে ছিল না ঘুমোনোর কোন ব্যবস্থা। তার ওপর দফায় দফায় জিজ্ঞাসাবাদ। কোনবার টেবিলের সামনে চেয়ার থাকে, কোনবার থাকে না। পাশের কক্ষ থেকে নির্যাতনের শব্দ ভেসে আসে। অন্ধকার কক্ষে বসেছিলেন কিছুক্ষণ। কিন্তু উপোসী শরীরের ক্ষুধা ও ক্লান্তি তাকে ভুলিয়ে দিয়েছিল নিজের অবস্থান। খালি ফ্লোরে শুয়ে পড়েছিলেন তিনি। পরের দিন ও রাত নির্যাতনের মাত্রা ছিল ভিন্নরকম। শেষে আদালতে হাজির করলেও অন্যদের মতো রিমান্ড চাওয়া হয়নি। সম্ভবত চম্পাকলি থেকেই ছুটতে হবে রিমান্ডে। দু’দিনের অপমানজনক নির্যাতনের ঘটনাগুলো মনে করে ছোট হয়ে যাচ্ছিলেন খান সাহেব। বারবার ভাবছেন রাজনীতি কি আর করবেন?
তিনজনের মধ্যে খান সাহেবই বয়োজ্যেষ্ঠ। তিনি অর্ধযুগ আগেই ষাট পেরিয়েছেন। জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হয়েছেন চারবার। দুই মেয়াদে পালন করেছেন পূর্ণমন্ত্রীর দায়িত্ব। এখন হোক না বন্দিদশা। চারদিকে সবাই তো স্যার স্যার সম্বোধনেই কথা বলছে। কোন ধরনের ছেলে মানুষী তার মানায় না। যত কষ্টই হোক মুখ বুজে থাকতে হচ্ছে। সিকদার সাহেবও পূর্ণমন্ত্রী ছিলেন। তার দপ্তরে সুবিধাভোগীদের মৌ মিলত না। তাই তারা তার বিরুদ্ধে নানা কথা ছড়িয়েছেন বছরের পর বছর জুড়ে। দলের প্রতি অসম্ভব রকম নিবেদিত এ লোকটি রাগী প্রকৃতির। খানিকটা একরোখাও। একটু এদিক-ওদিক হলেই রেগে যান। জেল সুপারের কক্ষের সামনে টুলে বসে তিনি বিরক্তি প্রকাশ করছেন থেকে থেকে। সহকারী জেল সুপারকে উদ্দেশ্য করে এরই মধ্যে দু’বার বলেছেন- খাঁচায় তো ভরেছে। এখন একটু দ্রুত ঠিকানা দাও। কোন সেলে যাই। সিকদারের কথা শুনে কষ্ট লুকিয়ে ম্লান হাসলেন তালুকদার। কিছুদিন আগেও তিনি এখানকার বাসিন্দা ছিলেন। তখন এসেছিলেন বিরোধী নেতা হিসেবে রাজপথে নৈরাজ্য সৃষ্টির অভিযোগে। এবার আসতে হলো দুর্নীতির অভিযোগে। খান সাহেব ও সিকদারের বিরুদ্ধে অভিযোগও দুর্নীতির। তাই তিনি খানিকটা শ্লেষ করে বললেন, ভাই মাখন খেলেন আপনারা, দুর্নীতির দড়ি কোমরে পড়লো আমাদেরও। সিকদার রেগে কিছু বলতে যাচ্ছিল, খান সাহেব তার মুখের দিকে তাকিয়ে নিবৃত করলেন। পরিবেশ হাল্কা করতে তালুকদারই বললেন, চলেন ভাই কর্ণফুলীতে। সেখানে অনেকেই আছে। সুখ-দুঃখের আলাপে দিন কাটানো যাবে।
সন্ধ্যার একটু আগে আগে এলেন জেল সুপার। সালাম দিলেন বটে তবে তা শুনতে গালির মতো মনে হলো। অথচ মন্ত্রী থাকা অবস্থায় খান সাহেব যখন পরিদর্শনে এসেছিলেন তখন এ লোকটিই স্যার স্যার বলতে মুখে ফেনা তুলেছিলেন। সেদিন মনে হচ্ছিল, লোকটি পারলে নিজের গায়ের চামড়া খুলে কারাগেটে বিছিয়ে দেয়। সেদিনের কথা মনে করে খান সাহেব নিঃশব্দে হাসলেন। জেল সুপার এসেই খান সাহেব ও সিকদারকে পাঠিয়ে দিলেন চম্পাকলি সেলে। পর্যাপ্ত কক্ষ খালি নেই। আপাতত চম্পাকলির ‘নয় নম্বর’ কুটুরিতে ঠাঁই পেলেন খান সাহেব ও সিকদার দু’জনই। অন্যকক্ষ খালি হলেই তাদের আলাদা কক্ষ মিলবে। তালুকদারকে সম্ভবত কর্ণফুলীতে পাঠানো হবে। কর্ণফুলীই আসলে রুই-কাতলাদের বাসস্থান। সেখানে স্থান সংকুলান না হওয়ায় ছাব্বিশ সেলকে চম্পাকলি নাম দিয়ে রূপান্তর করা হয়েছে ভিআইপি সেলে। চম্পাকলি। হাল আমলের রঙিন নাম। রাজবন্দিদের কাছে এটি সুপরিচিত ‘ছাব্বিশ সেল’ নামে। বহু পুরনো ভবন। ১৫০ বছরের কাছাকাছি বয়স। ভবনের ১৩টি কক্ষে দুইজন করে বন্দি রাখা হতো বলেই রাজবন্দিদের কাছে পরিচিত পেয়েছে ছাব্বিশ সেল হিসেবে। চম্পাকলি ভবনটির অবস্থান ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের দক্ষিণ পশ্চিম কোনে। ভবনের সঙ্গে লাগোয়া কারাগারের উঁচু বহির্প্রাচীর। দক্ষিণমুখী উঁচু ফ্লোরের এ ভবনটি গরমকালে অনেকটাই ঠাণ্ডা থাকে। মাথাগরম রাজনীতিকদের গরমের দিনে মাথা ঠাণ্ডা রাখতেই সম্ভবত কোন এককালে এ ভবনটি তাদের জন্য বেছে নিয়েছিল কারা কর্তৃপক্ষ।
চম্পাকলিতে পা রেখেই খান সাহেবের চোখে পড়ল একটি বড় পরিবর্তন। নামে নয় আকারেও পরিবর্তন ঘটেছে ছাব্বিশ সেলের। ১৩টি কক্ষ এখন ১১-তে এসে ঠেকেছে। কারাগারের পশ্চিমপাশের উর্দু রোডটি প্রশস্ত করার সময় বহিঃকারাপ্রাচীরটি অনেক ভেতরে সরিয়ে আনা হয়েছে। এ সময় চম্পাকলিকে আত্মত্যাগ করতে হয়েছে দুইটি কক্ষ। অন্য একটি ওয়ার্ডের সঙ্গে যোগাযোগের পথটিও। তবুও চম্পাকলি কারাগারে বিশেষ শ্রেণীপ্রাপ্ত বন্দিদের এক ঠিকানা। খান সাহেব আগেরবার এসেছিলেন অর্ধযুগ আগে। হরতালে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে থেকে গ্রেপ্তার করে দুই মাসের ডিটেনশন দেয়া হয়েছিল। সেবার চম্পাকলিতেই কাঠিয়েছিলেন প্রায় পুরো সময়। সরকারে থাকাকালে তিনি কারা কমিটির সদস্য ছিলেন। জনগণের রাস্তা প্রশস্ত করতে গিয়ে চম্পাকলির পরিসর কমছে তা জানতেন। এখন নিচ চোখেই সে পরিবর্তনটা দেখলেন।
নয় নম্বর কক্ষে ঢুকেই সিকদার ছুটলেন বাথরুমের দিকে। একই দল ও রাজনীতি করায় খান সাহেব সিকদারের ব্যক্তিজীবন সম্পর্কে অনেক কিছুই জানেন। রাগের পাশাপাশি তার মধ্যে শুচিবায়ু প্রবল। সবার সঙ্গে তার বসবাস করা কঠিন। বাথরুম থেকে বেরিয়েই কারা কর্তৃপক্ষকে একচোট বকলেন সিকদার। সব শালাই দুর্নীতি করে, নাম হয় রাজনীতিকদের। দেখেন বরাদ্দ কিন্তু কম দেয়া হয়নি, কাজে কত ফাঁকিবাজি করেছে। কিভাবে থাকব এখানে! ব্যারিস্টার কাদেরকে বলতে হবে হাইকোর্ট থেকে একটি চিকিৎসার আদেশ চাইতে। হাসপাতালে চিকিৎসার আদেশ পেলেই রক্ষা। কথাগুলো একনাগাড়ে বলে গেলেন সিকদার। ভিআইপি বন্দি হলেও প্রথমদিন নিজেদের কাজ নিজেদেরই করতে হবে। পরদিন থেকেই সহায়তাকারী কয়েদি মিলবে তাদের। তাই রাগে গো গো করতে করতে কক্ষের একটি চৌকিতে কাপড় বিছিয়ে নিলেন সিকদার।
খান সাহেব তলপেটে চাপ অনুভব করলেন। কোর্টে আনার আগে তিনি বাথরুমে গিয়েছিলেন। মাঝখানে লম্বা সময় পেরিয়ে গেছে। বয়সজনিত কারণে তলপেটের চাপ দীর্ঘক্ষণ ধরে রাখা কঠিন। তবুও ঘটনাপরম্পরায় এতক্ষণ ভুলে ছিলেন তিনি। সিকদার বেরোনোর পর তলপেটের চাপ কমাতে ছুটলেন খান সাহেব। ১০০ ফুট দীর্ঘ ও ৩০ ফিট প্রশস্ত চম্পাকলি ভবনের সামনের দখিনমুখী বারান্দাটির প্রস্ত ১০ ফুট। বাথরুম-টয়লেটসহ প্রতিটি কক্ষের আকার ২০ক্ষ্মক্ম২০ ফুট। কক্ষের এক-তৃতীয়াংশ জুড়ে বাথরুম। খান সাহেব আগেরবার যখন চম্পাকলির বাসিন্দা ছিলেন তখন বাথরুমের দেয়ালগুলো ছিল অনেকটাই নিচু। টয়লেটের কোন দরজা ছিল না। হাল্কা গন্ধে একটি অস্বস্তি লেগেই থাকতো দিনভর। এখন বাথরুমের দেয়াল উঁচু করা হয়েছে খানিকটা। শ্রেণীপ্রাপ্ত বন্দিদের কক্ষগুলো আধুনিক করা হয়েছে। বাথরুমে ঝরনা, বেসিন, গ্লাস এবং পুরনো প্যানের পরিবর্তে কমোড বসেছে। ভিআইপি বন্দিদের প্রত্যেকের জন্য আলাদা কক্ষ বরাদ্দ। ব্যক্তিগত গোপনীয়তা নিয়ে মোটামুটি আরামেই থাকা যাবে। কমোডে বসে খান সাহেব খেয়াল করলেন দরজা-জানালায়ও পরিবর্তনের ছোয়া লেগেছে। চম্পাকলি কক্ষগুলোর দরজা ও উত্তর পাশের জানালায় কাঠের জানালা ও নেট লাগানো হয়েছে। আগে দরজা-জানালাগুলোতে ছিল কেবল লোহার গ্রিল। বৃষ্টির ছাটে ভিজে যেত বিছানা। শীতকালে উত্তরের কনকনে হাওয়ায় হিম বরফের চাংয়ে পরিণত হতো কক্ষগুলো। পুরান ঢাকার মশারা আরামে পান করতো রুই-কাতলাদের রক্ত। এখন তার কিছুটা হলেও রেহাই মিলবে। জেল কোড পরিবর্তনের মাধ্যমে এ পরিবর্তন ঘটেছে খান সাহেবরা ক্ষমতায় থাকাকালে। এই ভেবে চরম দুঃখের দিনেও খানিকটা আত্মতৃপ্তি পেলেন তিনি।
প্রথম রাতে কারাগারের খাবার খেলেন না দু’জনই। পরিবারের দেয়া আপেল-বিস্কুট খেয়েই শুয়ে পড়লেন। অপমান, যন্ত্রণা ও আতঙ্কে গল্প করার মেজাজ হারিয়ে ফেলেছেন। বয়সী শরীর, তাই দুদিনের টানা যন্ত্রণার পর কারাগারে চম্পাকলির কুঠুরিতে গা এলিয়ে দিতেই ঘুম নেমে এলো খান সাহেবের চোখে। সিকদার শুয়ে চোখ বন্ধ রাখার চেষ্টা করছেন কিন্তু ঘুম আসছে না। বারবার এপাশ-ওপাশ করছেন। তার নড়াচড়ায় শব্দ হচ্ছে চৌকিতে। ঘুম ভেঙে যাচ্ছে খান সাহেবের। দু’জনই বর্ষীয়ান, দেশের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। তাই সিকদার সাহেবের কষ্টে লুকিয়ে রাখছেন নিজের কষ্টকে। একটি কাপড় দুই কানের মধ্যে ভালো মতো গুঁজে দিয়ে তিনি ঘুমের রাজ্যে পাড়ি দিলেন।
সকালে ঘুম ভাঙতেই শরীরটা বেশ ফুরফুরে অনুভব করলেন খান সাহেব। মনে হলে বারিধারায় নিজের বাড়িতেই আছেন তিনি। ঘুম ভাঙতেই ডাকলেন সুনয়নাকে। প্রতিদিনের অভ্যাস। পরক্ষণেই মনে পড়লো তিনি তো কারাগারে। পাশ ফিরে দেখলেন সিকদার গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। মনটা খারাপ হয়ে গেল। প্রতিদিন সকালে ঘুম ভাঙতেই সুনয়নাকে ডাক দেন তিনি। বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া একমাত্র মেয়ে। বাবার ডাক শুনেই এককাপ কফি নিয়ে হাজির হয় সুনয়না। মেয়ের হাতে বানানো কফি গলাধকরণ করেই বিছানা ছাড়েন তিনি। বাসায় কাজের লোক থাকলেও মেয়ের হাতেই কফি পানে অভ্যস্ত তিনি। এর পেছনে রয়েছে আরেক গল্প। ছাত্রজীবনে প্রতিটি সকালে মায়ের হাতে গরম একগ্লাস দুধ পান করেই দিন শুরু হতো তার। স্ত্রীর হাতে মাঝে মধ্যে চা-কফি খেয়ে দিন শুরু করেছেন বটে তবে সেটা কালেভদ্রে। দাদির গল্প শুনে সুনয়না ফের প্রৌঢ় বয়সে খান সাহেবকে গরম কফি পান করিয়ে ঘুম ভাঙানোর অভ্যাস রপ্ত করিয়েছেন।
খান সাহেব আড়মোড়া ভেঙে বিছানা ছাড়লেন। চম্পাকলি সেলের ভেতরে দক্ষিণ পাশে দেয়াল ঘেষে একটি বড় রান্নাঘর। কারাভাষায় চৌকা। সেখান থেকে ফ্লাক্সে করে গরম পানি যোগাড় করলেন। গরম পানি নিয়ে নিজেই চা বানালেন। চায়ের মগ হাতে নিয়ে বারান্দায় গিয়ে বসলেন। চা খেয়ে বারান্দায় পায়চারী করলেন কিছুক্ষণ। ততক্ষণে সেখানে জড়ো হয়েছেন আরও কয়েকজন। যারা কিছুদিন আগেও একত্রিত হতেন ক্যাবিনেট কিংবা পার্টি অফিসে। দলে ও সরকারে খান সাহেব ছিলেন বয়োজ্যেষ্ঠদের একজন। তাই চম্পাকলির বেশিরভাগ বাসিন্দাই সালাম দিয়ে তাকে চম্পাকলিতে স্বাগত জানালেন। এরই মধ্যে বরাদ্দকৃত কয়েকটি পত্রিকা এনে দিয়েছে কারারক্ষীরা। রাজনৈতিক নেতাদের ঢালাও গ্রেপ্তার নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া গণমাধ্যমে। কোন পত্রিকায় শিরোনাম হয়েছে গ্রেপ্তারের নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিতে। কোনটিতে আবার নেতাদের গোপনজীবন, ধন-সম্পদের তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে সত্য-মিথ্যার মিশেলে। চম্পাকলিতে সবাই ভিআইপি বন্দি। বেশিরভাগেরই ব্যক্তিগত টেলিভিশন আছে। কেউ কেউ সারাক্ষণই টেলিভিশন নিয়ে পড়ে থাকেন। তবে টেলিভিশনে সংবাদের খণ্ডাংশ দেখা যায়। বিস্তারিত জানতে পত্রিকার বিকল্প নেই। চম্পাকলিতে যারা পুরনো বাসিন্দা ইতিমধ্যে বিবমিষা কাটিয়ে উঠেছেন তারা মেতে উঠলেন সংবাদ বিশ্লেষণে। খান সাহেব বয়সজনিত একটা দূরত্ব রেখেই চম্পাকলির দিন শুরু করেন।
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

লবণ্যময়ী হাসি দিয়ে ভাইরাল হওয়া পিয়া জান্নাতুল কে নিয়ে কিছু কথা

লিখেছেন সম্রাট সাদ্দাম, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ১:৫৪

ব্যারিস্টার সুমনের পেছনে দাঁড়িয়ে কয়েকদিন আগে মুচকি হাসি দিয়ে রাতারাতি ভাইরাল হয়েছিল শোবিজ অঙ্গনে আলোচিত মুখ পিয়া জান্নাতুল। যিনি একাধারে একজন আইনজীবি, অভিনেত্রী, মডেল ও একজন মা।



মুচকি হাসি ভাইরাল... ...বাকিটুকু পড়ুন

মিল্টন সমাদ্দার

লিখেছেন মঞ্জুর চৌধুরী, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ৩:০৬

অবশেষে মিল্টন সমাদ্দারকে গ্রেফতার করেছে ডিবি। এবং প্রেস ব্রিফিংয়ে ডিবি জানিয়েছে সে ছোটবেলা থেকেই বদমাইশ ছিল। নিজের বাপকে পিটিয়েছে, এবং যে ওষুধের দোকানে কাজ করতো, সেখানেই ওষুধ চুরি করে ধরা... ...বাকিটুকু পড়ুন

জীবন চলবেই ... কারো জন্য থেমে থাকবে না

লিখেছেন অপু তানভীর, ০২ রা মে, ২০২৪ সকাল ১০:০৪



নাইমদের বাসার ঠিক সামনেই ছিল দোকানটা । দোকানের মাথার উপরে একটা সাইনবোর্ডে লেখা থাকতও ওয়ান টু নাইন্টি নাইন সপ ! তবে মূলত সেটা ছিল একটা ডিপার্টমেন্টাল স্টোর। প্রায়ই... ...বাকিটুকু পড়ুন

যুক্তরাষ্ট্রে বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিলিস্তিনের পক্ষে বিক্ষোভ ঠেকাতে পুলিশি নির্মমতা

লিখেছেন এমজেডএফ, ০২ রা মে, ২০২৪ দুপুর ১:১১



সমগ্র যুক্তরাষ্ট্র জুড়ে ফিলিস্তিনের পক্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসগুলোতে বিক্ষোভের ঝড় বইছে। যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিলিস্তিনের পক্ষে বিক্ষোভ কর্মসূচী অব্যাহত রয়েছে। একাধিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বিক্ষোভ দমনের প্রচেষ্টা চালালেও তেমন সফল... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছাঁদ কুঠরির কাব্যঃ ০১

লিখেছেন রানার ব্লগ, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ৯:৫৫



নতুন নতুন শহরে এলে মনে হয় প্রতি টি ছেলেরি এক টা প্রেম করতে ইচ্ছে হয় । এর পেছনের কারন যা আমার মনে হয় তা হলো, বাড়িতে মা, বোনের আদরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×