ন্যাড়া বেলতলায় যায় একবার, আর আমি গিয়েছি তিনবার।
প্রথম যখন আলাপ আত্মপ্রকাশ করল তখন টি অ্যান্ড টি ইনকামিং-আউটগোয়িং সুবিধার উত্তেজনায় কক্সবাজার থেকে চট্টগ্রাম চলে গিয়েছিলাম, কিনলাম চৌদ্দহাজার পাঁচশত টাকা (মাত্র) মূল্যের মোটোরোলা সিডিএমএ-হ্যান্ডসেট। নাকে নতুন মোবাইলের গন্ধ শুঁকি। আহ! গন্ধেই বুঝি মোবাইল চেনা যায়। কিন্তু গন্ধ মিলিয়ে না যেতেই দু-তিন মাসের মধ্যে একই মডেলের হ্যান্ডসেটের দাম ধাপে ধাপে বারো হাজারে, নয় হাজারে এবং শেষ পর্যন্ত সাত হাজারে এসে প্রভুদের কাছে অবশিষ্ট সম্ভ্রম প্রার্থনা করে। তখন মনে মনে সান্ত্বনা খুঁজি: এখনকার সেটগুলো মানে ও গন্ধে নিশ্চয়ই আমারটার মতো নয়। কিছুদিন পর আমার মানসম্পন্ন সেটের চার্জার যায় বিগড়ে। সে-সময় চট্টগ্রাম থাকার সুবাদে দৌড়ে গেলাম প্রধান কাস্টমার কেয়ার সেন্টারে। বলল, স্টক শেষ, ঢাকা থেকে না আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। অপেক্ষা করলাম এবং একসময় পেলাম। একদিন মোবাইলটাই নষ্ট হয়ে গেল, হয়তো নস্টালজিক বেচারা উন্নত বিশ্বের খোলামেলা পরিবেশে থেকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিবিরবেষ্টিত রক্ষণশীল পরিবেশে বিদ্রোহী হয়ে আত্মঘাতী হয়েছিল। ওয়ারেন্টি থাকায় নতুন আরেকটা পেলাম। পর্যাপ্ত সিগন্যাল না থাকায় আমাকে রুমের এ মাথা ও মাথা সিগন্যাল খুঁজে কয়েক হাত ওপরে দেয়ালে পেরেক মেরে মোবাইল ঝুলিয়ে রাখতে হত, বেচারা মোবাইল ফোন হয়ে গেল ফিক্সড ফোন। কথা বলতে হত ইয়ারফোন দিয়ে। সেই দুঃখেই হয়তো এবারের বদলি মোবাইলটা ঘুমন্ত আমাকে একা ফেলে এক ভ্রাম্যমাণ ভিক্ষুকের হাত ধরে পালিয়ে গেল। আমি দরজায় ভিক্ষুকের মতো কাউকে দেখেছিলাম, কিন্তু ভিক্ষুকের চেয়ে ঘুম মূল্যবান। আমি হয়তো তখন কোনো ন্যাড়াকে স্বপ্ন দেখছিলাম! ফকিরকে মোবাইল-দানের আগে বিভিন্ন সমস্যায় আমাকে কাস্টমার কেয়ার সেন্টারে যেতে হত। সেখানে বসা ‘জানা’ (ছদ্মনাম) নামের এক সুন্দরীর কারণেই কি আমার সেট বিগড়ে যেত নাকি আমিই চাইতাম সেট বিগড়ে যাক—সেটা এখন ঠিক স্পষ্ট মনে পড়ছে না। তবে ওখানে যেতে আমার কষ্ট হত না। মাঝে মাঝে বন্ধুদেরও নিয়ে যেতাম, কারণ সৌন্দর্য একলা একলা উপভোগ করা যায় না, নিজেকে ছোটলোক ছোটলোক মনে হয়।
পরবর্তীকালে নিজের মস্তিষ্কে রি-ইনস্টল দিয়ে নবাগত ন্যাড়া সেজে মোবাইল কিনতে ফের গেলাম সিটিসেলে। এ-ব্যাপারে ঐ সুন্দরীর কোনো অদৃশ্য অবদান ছিল কিনা তাও এখন আর মনে পড়ে না। এবার কিনলাম এক টাকা কম নয় হাজার টাকা দিয়ে স্যামসাং সেট (এক টাকা ফেরত নিতে কিন্তু ভুল করি নি)। কিনেই ওটাকে পুরানো নোংরা কুৎসিত কভার দিয়ে মুড়ে ফেললাম যাতে ছিনতাইকারী ধরলেও মোবাইলটি নিতে তাদের রুচিতে বাধে। এবারও মোবাইলে সমস্যা। আবার বেড়াতে যাই, যেহেতু চট্টগ্রামে বেড়ানোর জায়গা কম। সুন্দরীর পাশের জনা—নাম-অজানা, দেখতে কেমন ঠিক জানি না, আমার মোবাইল রেখে দেন—ওনাদের ইঞ্জিনিয়ার সাহেবকে দেখাতে হবে। কয়েকদিন পরে সেট আনতে গেলাম। কিন্তু বিজ্ঞ ইঞ্জিনিয়ার সমস্যা সারাতে পারলেন না। উল্টো আমার নতুন কেসিঙের জায়গায় একটা ঘষামাজা কেসিং কীভাবে যেন চলে এল। ভীষণ মন খারাপ হয়ে গেল। সাথেই সাথেই অভিযোগ করলাম। সেবাদাত্রী আমায় বললেন, এটার দায়ভার আমার, কারণ আমি নিশ্চয়ই আগে অন্য কোথাও হ্যান্ডসেট ঠিক করিয়েছি, সেখানেই কেসিং বদলে ফেলেছে। ওনার রোমান্টিক বাণীতে আমি বেরসিকের মতো গরম হচ্ছি। বললাম, ওয়ারেন্টি কার্ড থাকা সত্ত্বেও আমি অন্য কোথাও কেন মোবাইল ঠিক করাব? আর অন্য কোথাও যদি ঠিক করিয়েই থাকি, তাহলে আপনাদের তো প্রথমেই আমার মোবাইল গ্রহণ করার কথা না...। আমাকে ঠান্ডা করতে ভিতরের রুম থেকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা এক আপু চলে আসলেন। ইঞ্জিনিয়ার সাহেবও দৌড়ে চলে আসলেন। বললেন: আপনি এক মিনিট দাঁড়ান, আমি পাঁচ মিনিটের মধ্যে ঠিক করে দিচ্ছি। ব্যাটা কি জোকস্ করছে? এক মিনিট দাঁড়াতে বলে পাঁচ মিনিট? না, আমার নতুন কেসিং পাওয়া যায় নি; স্পিরিট দিয়ে ঘষে ঘষে ওটাকে নতুন বানানোর বৃথা চেষ্টা করেছে কেবল। এর চেয়ে জানা’র কাছে থাকলে মোবাইলটা ভালো হয়ে যেত—এমন একটা বিশ্বাস আমার মধ্যে জন্মেছিল।
ইত্যবসরে মোবাইলে অদ্ভুত বিমার দেখা দেয়। কথা না বললেও মোবাইল থেকে টাকা উড়ে যায়। কই যায় জানি না। জানা’র অফিসের নম্বরে ফোন করি, সুভদ্র কণ্ঠে অভিযোগ জানাই। ওপাশ থেকে সুমিষ্ট জবাব আসে, ফ্যাক্স করে যেন অভিযোগ পাঠাই। জীবনের প্রথম ফ্যাক্স করলাম। কয়েকদিন হয়ে গেলেও টাকাগুলো নীড়ে ফিরে এল না। আবার বেড়াতে যাই। (আসা-যাওয়ার খরচের পরিমাণ গায়েব হওয়ার পরিমাণের চেয়ে কম বা সমান ছিল ভাবলে ভুল হবে।) এবার ভাগ্যটা খারাপ। আমার নম্বর পড়েছে পুরুষ-ডেস্কে। তারে টাকা গায়েব হয়ে যাওয়ার কথা, কোন দিন কত টাকা—সব বললাম। তিনি তখন আমাকে নতুন বাণী শোনালেন। আমি জানি না ভদ্রলোকের ঐশীবাণী পাওয়ার বাতিক আছে কি না। তিনি বললেন: “আপনি হয়তো কথা শেষ করার পর লাইন কাটেন নি। তাই আপনার টাকা কাটা গেছে।” আমারে নগদে ব্যাক্কেল বানানোর পাঁয়তারা। আমি বললাম: ভাই, মোবাইল ব্যবহার করছি ২০০১ সাল থেকে। সিটিসেলের আগে একটেল ব্যবহার করেছি। আর আমি যদি ভুলে লাইন না কাটি, ও-পাশেও কি কাটে নি? ও-পাশেও কি আমার মতো ভুল করেছে? আর একই ভুল কেউ কি কয়েকবার করে? উত্তর দিতে না পেরে ভদ্রলোক আমাকে application করতে বললেন। বললাম: আমি তো ফ্যাক্স করেছি, এই যে দেখেন ফ্যাক্সের প্রমাণ; application কেন করব? তারা আমার পাঠানো কোনো ফ্যাক্স পায় নি। মনে মনে ভাবছিলাম আমি না হয় জীবনে প্রথম ফ্যাক্স করেছি, কিন্তু ফ্যাক্সের দোকানদার তো জীবনের প্রথম করেন নি। কী আর করা, application লিখলাম। জমা দিতে গিয়ে দেখি টেবিলের ওপর application-এর রমরমা ভিড় এবং আমার মতো আরো অনেকের টাকা গায়েব হয়ে গেছে। ও ভাই, এরাও কি কথা বলে লাইন কাটে নি?
মনে পড়ে, নিজের ক্ষোভ মেটাতাম কল্পনায় সিটিসেল অফিস ভাংচুর করে। অনেক পরে আমার মতো কোনো ভুক্তভোগীই হয়তো চট্টগ্রামের সিএ ভবনস্থ একটেল কাস্টমার কেয়ার সেন্টারে ভাংচুর চালিয়েছিল। এরপর কোনো এক বিষাদমুখর দিনে আমার মোবাইলটা খুন হয়। আমি সেই আত্মস্বীকৃত খুনী।
সেই বিবাহিতা-অন্তঃসত্ত্বা সুন্দরীর (নামটা যেন কী?) বিবাহপূর্ব রূপ আমাকে নস্টালজিক করে তুলেছিল কিনা জানি না, তবে ২০০৮ সালে এসে আমি আবার বেলতলায় গেলাম। টিভি বিজ্ঞাপনে ঘোড়া ছেড়ে ভাঁড়সদৃশ রাজপুত্রের দ্রুত গতির ট্রাকে ছুটে যাওয়া আর কোত্থকে চামড়াসাদা এক রাজকন্যার হাজিরা দেখে আমিও কিঞ্চিৎ আশা নিয়ে রিকশায় করে দ্রুত গতির ‘জুম’ কিনে আনলাম। গুগলে সার্চ দিয়ে কোনো রাজকন্যা খুঁজে না পেলেও ২০০৮-এর ৮ম মাসে এক ৮ম আশ্চর্যের ঘটনা ঘটল। এবার গায়েব নয়, রাশি রাশি টাকার আগমন ঘটল—তবে হায়, প্রদেয় বিল হিসেবে! হায় বিল! আমার যাবতীয় পূর্বপুরুষ কখনো এতটা বোবা হয়েছিলেন কিনা জানি না, তবে তাঁরা নিশ্চয় জানতেন তাঁদের এক উত্তরপুরুষ একসময় বোবা হয়ে যাবে এবং পরিণামে লেখক হবে।
পুনশ্চ: টিভিতে বিজ্ঞাপনে একটা ছোট ছেলেকে বলতে শুনি: একটু বড় হলেই কিনব। সিটিসেল কি ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে লেখক বানাতে চায়? সেই ভিক্ষুকের কী অবস্থা? পত্রিকায় বা ইন্টারনেটে কেউ কি তাকে দেখেছেন?