আপনার কর্ম ব্যস্ত জীবনে চোখের ভূমিকা অপরিসীম। অবস্থানগত কারণেই আমাদের গোলাকার চোখ সর্বদা সুরক্ষিত। বাইরে থেকে যেটুকু দেখা যায় সে টুকুও চোখের পাতা দিয়ে ঢাকা থাকে। এছাড়া আইলেশ ও আইভ্রু চোখকে ধুলোময়লা থেকে রক্ষা করে। চোখের পানি সাধারনত ধুলোবালি ও রোগ জীবানু ধুয়ে চোখকে সুস্থ রাখে।
এরপরও চোখ ভাল রাখার জন্য আমাদের কিচু করণীয় আছে। যেমনঃ
চাই সুষম খাবারঃ
চোখ ও চোখের দৃষ্টি ভাল রাখতে নিয়মিত কার্বোহাইড্রেট, প্রোটিন, চর্বি, খনিজ লবন, পানি ও ভিটামিন জাতীয় খাবার প্রয়োজনীয় পরিমানে গ্রহন করতে হবে।
ভিটামিনের মধ্যে ভিটামিন এ চোখের জন্য সবচেয়ে বশী প্রয়োজন। এছাড়া ভিটামিন ই এবং ভিটামিন সি দৃষ্টিশক্তি ভাল রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। শাকসবজী, ফলমূল, ছোট মলাঢেলা মাছ ইত্যাদি বেশী বেশী খেতে হবে। শিশুদের ৬ মাস বয়স থেকে বুকের দুধের পাশাপাশী শাকসবজী, ফলমূল আল্প অল্প করে খাওয়াতে হবে।
চাই আলোর সঠিক ব্যবহারঃ
দেখার জন্য চোখ যে কোন আলোই কিছুক্ষনের মধ্যেই গ্রহন করে নিতে পারে। কিন্তু চোখ ভাল রাখার জন্য কম আলো বা তীব্র আলোতে লেখাপড়া এবং অন্যান্য কাজ কর্ম করা উচিৎ নয়। দিনের বেলা সূর্যের আলো সরাসরি ব্যবহার করা উচিৎ নয়। রাতে টিউব লাইটের আলো চোখের জন্য আরাম দায়ক। টেবিলল্যাম্পের আলোতে লেখাপড়ার সময় ল্যাম্পটি দেয়ালের দিকে রেখে প্রতিফলিত আলোতে পড়া ভালো। লোডশেডিং এর সময় বা যে সব এলাকায় বিদ্যুত নেই সেখানে যে আলোকম্পমান নয় সে আলো ব্যবহার করা ভালো। ল্যাম্প, মোমবাতী কিংবা হারিকেনের মধ্যে হারিকেনের আলো সবচেয়ে ভালো।
টিভি দেখাঃ
টিভি দেখার সময় টিভির পিছনরে দিকের দেয়ালে একটি টিউব লাইট বা শেড যুক্ত ৪০/৬০ ওয়াটের বাল্ব জ্বালিয়ে টিভি দেখা উচিৎ। সম্পূর্ণ অন্ধকার কক্ষে টিভি দেখা উচিৎ নয়। দিনের বেলা যে দরজা বা জানালার আলো টিভি স্ক্রীনে প্রতিফলিত হয় সে গুলো বন্ধ রাখাই ভাল। সাধারণত ১০ ফিট দূর থেকে টিভি দেখা উচিৎ তবে ৬ ফিটের কম দুরত্ব থেকে টিভি দেখা উচিৎ নয়। বড় চোট বিভিন্ন সাইজের টিভি দেখার ক্ষেত্রে ভিন্ন ভিন্ন দুরত্ব বজায় রাখতে হয়। ঝিরঝির করা, কাঁপাকাঁপা ছবি এবং ভৌতিক ছায়া যুক্ত ছবি না দেখাই ভাল। রঙ্গিন টিভিতে রং (কালার), উজ্জলতা (ব্রাইটনেস) এবং কন্ট্রাস্ট ঠিক রেখে টিভি দেখা উচিৎ। একটানা অনেকক্ষন টিভি দেখা উচিৎ নয়, মাঝে মাঝে দর্শন বিরতি দিয়ে টিভি দেখা চোখের জন্য ভাল।
চোখে প্রসাধনীর ব্যবহারঃ
প্রসাধনী চোখের জন্য ক্ষতিকর। অতিরিক্ত প্রসাধনী চোখে ব্যবহার করলে এলার্জিক কনজাংটিভাইটিস, ব্লেফারাইটিস, স্টাই ইত্যাদি রোগ হওয়ার সম্ভাবনা বেশী থাকে।
মাথায় খুশকী থাকলে সপ্তাহে ২ বার খুশকী নাশক শ্যাম্পু ব্যবহার করে মাথা খুশকী মুক্ত রাখতে হবে। নইলে মাথার খুশকী থেকে চোখ আক্রান্ত হয়ে চোখে ব্লেফারাইটিস দেখা দিতে পারে।
ধুলো ময়লা ও দূষিত পরিবেশঃ
দূষিত পরিবেশ, বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক গ্যাস কিংবা কল - কারখানার পরিবেশ চোখের জন্য ক্ষতিকর। এসব ক্ষেত্রে প্রতিদিন কাজের শেষে চোখ ঠান্ডা ও পরিষ্কার পানি দিয়ে ভালভাবে ধুয়ে নিতে হবে।
ক্ষেতে খামারে কৃষকদের কীটনাশক স্প্রে করার সময় এলার্জিক কনজাংটিভাইটিস বা কেমিকেল কনজাংটিভাইটিস হওয়ার সম্ভাবনা থাকে এসব ক্ষেত্রে সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে।
সূর্যালোকের অতি বেগুনী রশ্মি চোখের শত্রু তাই সূর্যালোক থেকে দূরে থাকা উত্তম । রোদে গেলে সানগ্লাস পড়া উচিৎ যাদের এমনিতেই চশমা পড়তে হয় তাদের ফটোক্রোমেটিক লেন্স ব্যবহার করা আরাম দায়ক হবে। কনজাংটিভাইটিস, কর্নিয়াল আলসার, আইরাইটিস এর রোগীদের জন্য এবং ছানী অপারেশনের পর কালো চশমা ব্যবহার করা জরুরী।
চোখ ভাল রাখতে প্রতি দিন ঘুমাতে যাবার আগে ঠান্ডা ও পরিষ্কার পানি দিয়ে চোখ ভালভাবে ধুয়ে ঘুমানো উত্তম।
বিভিন্ন রোগের সময় চোখের যত্নঃ
বাচ্চাদের হাম, জল বসন্ত, হুপিংকাশি, ডায়রিয়া ইত্যাদি রোগে বিশেষ যত্ন নেয়া আবশ্যক। এই সব রোগের ঠিকমত চিকিৎসা না করালে চোখের ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। অন্যদিকে যক্ষ্মা, কুষ্ঠ, যৌন রোগে (এইডস্, সিফিলিস, গনোরিয়া) চোখের ক্ষতি বা অন্ধ হওয়া বিচিত্র কিছু নয়। তাই যথা সময়ে এসবের চিকিৎসা নেওয়া উচিৎ।
ডায়াবেটিস ও উচ্চরক্তচাপের রোগীদের সঠিক সময়ে চিকিৎসা না নিলে চোখের স্থায়ী ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। দীর্ঘদিন ডায়াবেটিস অনিয়ন্ত্রিত থাকলে চোখে ডায়াবেটিস রেটিনোপেথি হতে পারে। এই সব রোগে নিয়মিত ও সঠিক নিয়ে ডায়াবেটিস বা রক্তচাপ নিয়ন্ত্রন রাখতে পারলে চোখ ভাল রাখা সম্ভব।
গর্ভাবস্থায় পুষ্টিকর খাবার গ্রহন গর্ভজাত শিশুর চোখ ভাল রাখা সম্ভব। এছাড়া গর্ভাবস্থায় সংক্রামক রোগ থাকলে গর্ভজাত শিশুর ক্ষেত্রে এর প্রভাব পড়ে তাই এসময় সংক্রমক রোগ মুক্ত থাকা উচিৎ।
চোখে চশমার ব্যবহারঃ
যাদের চোখে চশমা প্রয়োজন তাদের অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ মতো পাওয়ার পরীক্ষা করে চশমা পড়া উচিৎ।
স্বাভাবিক ভাবেই ৪০ বছরের কাছাকাছি বয়স থেকেই পড়াশুনা করতে ও কাছের জিনিস দেখতে অসুবিধা হয়। এসময়ে দূরের বস্তু ভাল দেখলে কাছে দেখার জন্য চিকিৎসকের পরামর্শ মত বাইফোকাল চশমা গ্রহন করতে হয়। দূরের দৃষ্টি ভাল না থাকলে চিকিৎসকের পরামর্শ মত দূরের ও কাছে দেখার জন্য বাইফোকাল চশমা ব্যবহার করা উচিৎ। অনেকেই এসময় নিজের মন মত রেডিমেট পাওয়ার চশমা ব্যবহার করেন যা চোখের জন্য ক্ষতিকর। চোখে অবশ্যই চক্ষু বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক দ্বারা চোখ পরীক্ষা করে প্রয়োজনীয় চশমা পড়া উচিৎ। আবার অনেকে মনে করেন এসময় চশমা ব্যবহার করলে সারাজীবন চশমা ব্যবহার করতে হবে তাই চশমা ব্যবহার করেননা। আসলে এ সময় চশমা ব্যবহার করলেই চোখ ভাল নতুবা পড়াশুনা বা কাচের জিনিস দেখতে চোখে চাপ পড়ে এই চাপ চোখের ক্ষতি করতে থাকে। চশমা সবসময় পরিষ্কার রাখা উচিৎ। অস্বচ্ছ ও ফাটা লেন্স ব্যবহার করা উচিৎ নয়।
শিশুদের চোখের যত্নঃ
জন্মের সাথে সাথেই খেয়াল করুন শিশুর চোখে কোন সমস্যা আছে কিনা থাকলে দ্রুত চক্ষু বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিন। এসময় চোখ দিয়ে পানি পড়লে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ অনযায়ী চোখের ওষুধের পাশাপাশি চোখের কোঠায় ম্যাসেজ দিতে হয়। শিশুর বয়স ৪/৫ বছর হলেই চোখের দৃষ্টিশক্তি পরীক্ষা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া উচিৎ।
চোখ ভাল রাখুনঃ
চোখ আমাদের অমূল্য সম্পদ। আমাদের জীবনের জন্য চোখের গুরুত্ব তুলনাহীন। তাই চোখের যত্ন নিয়ে চোখ রাখার জন্য সবার সচেষ্ট হওয়া উচিৎ।
ডাঃ মোঃ মিজানুর রহমান