পাঁচ বছরের চিকিৎসা বিজ্ঞানের কোর্সে তৃতীয় বর্ষের ছাত্র হওয়ার পড় থেকেই প্রত্যেক ছাত্রেরই সর্বক্ষণের সঙ্গী হয়ে ওঠে একটি যন্ত্র, ‘স্টেথোস্কোপে’। ব্যাপারটা এভাবেও বলা যায়, হাতে স্টেথোস্কোপ আছে এমন কাউকে দেখেলই সবাই বুঝে ফেলে, ছেলে বা মেয়েটি ডাক্তার কিংবা হবু ডাক্তার। ব্যাপারটা হয়তো সবাই লক্ষ্য করেছেন, ‘একজন ডাক্তার রুগী দেখছে’ বোঝানোর জন্য সবচেয়ে সহজ যে ছবি ব্যবহার করা হয় তা হচ্ছে, ‘স্টেথোস্কোপ দিয়ে রুগী দেখছে একজন চিকিৎসক’ এর ছবি। একসময় যন্ত্রটি হয়ে ওঠে চিকিৎসকের পরিচয়। ‘স্টেথোস্কোপ সঙ্গে আছে, তাঁর মানে ইনি একজন চিকিৎসক’ কিংবা ‘একজন চিকিৎসক, মানে এর কাছে অবশ্যই একটি স্টেথোস্কোপ আছে’।
প্রত্যেক চিকিৎসকের জন্য অপরিহার্য এই যন্ত্রটি আবিস্কারের একটি বেশ মজার গল্প আছে। ১৮১৬ সালের সেপ্টেম্বর মাসের কথা। ৩৫ বছর বয়সী ফরাসী চিকিৎসক রুনা লেনাক এক শীতের সকালে বাড়ীর পেছনের রাস্তা দিয়ে হেঁটে আসছেন। দেখলেন দুইজন ছেলে মজার একটা খেলা খেলছে। একটা কাঠের টুকরোর একদিকে একজন কান দিয়েছে আর অপর জন অন্য দিকে একটা পিন দিয়ে স্ক্র্যাচ করে তাঁকে সংকেত পাঠাচ্ছে। ব্যাপারটা যে একটা যুগান্তকারী আবিস্কারে কাজে দিবে তা তখন হয়তো তিনি ভাবেন নি।
সে বছরের ই শেষের দিকের কথা। তাঁকে দেখাতে আজকে একজন রুগীনি আসবেন। এই মুহূর্তে তাঁর কিছু সাধারণ সমস্যা হচ্ছে। তবে তাঁর হার্ট এর সমস্যা আছে। রুগিনিকে পরীক্ষা করতে তাঁকে যা করতে হবে তা হচ্ছে রুগিনির বুকে মাথা রেখে হার্টের শব্দ শুনতে হবে। কাজটা করতে তিনি ইতস্ততঃ করছেন। কম বয়সী একজন মহিলা হওয়ায় তাঁর অস্বস্তিও যেমন লাগছিল আবার রুগিনি স্থুলাকায় হওয়ায় কিছুটা সন্দেহে আছেন খুব ভালো শোনা যাবে কি না। এমন সময় তাঁর মনে পড়ল বাড়ীর পেছনের রাস্তায় দেখা দুই ছেলের খেলার কথা।
তিনি একটা কাগজ গোল করে অনেকটা চোঙ্গা র মত বানালেন। এরপর তিনি সেটা মহিলার বুকে রেখে হার্টের আওয়াজ শোনার চেষ্টা করলেন। ‘দারুণ স্পষ্ট’ আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। অবাক হয়ে তিনি লক্ষ্য করলেন, বুকে কান রেখে হার্ট বিটের যে আওয়াজ তিনি শুনতেন এই আওয়াজ তাঁর চেয়ে অনেক বেশী স্পষ্ট। তিনি বুঝতে পারলেন এই পদ্ধতি ব্যবহার করলে শুধু হার্টের শব্দ না, বুকের যে কোন শব্দই অনেক স্পষ্ট করে শোনা যাবে।
পরবর্তী তিন বছর তিনি ব্যয় করলেন এই খোঁজে। কি উপাদান ব্যবহার করলে শব্দ আরও সুন্দর, আরও স্পষ্ট শোনা যায়। তাঁর ডিজাইনকে নিখুত করতে অসংখ্য উপাদান ব্যবহার করলেন। অবশেষে কাঠের তৈরি ২৫ সেন্টিমিটার লম্বা আর ৩.৫ সেন্টিমিটার ব্যাসের নলকে তিনি নিখুত আর সঠিক বলে সিদ্ধান্ত নিলেন। বলা যায়, এই যন্ত্রটিই ছিল প্রথম ‘স্টেথোস্কোপ’।
উনিশ শতকের শেষ ভাগের আগে পর্যন্ত এই কাঠের স্টেথোস্কোপই ছিল চিকিৎসকদের অত্যাবশ্যকীয় যন্ত্র। এই যন্ত্র ব্যবহার করে বিভিন্ন রোগের অনেক শব্দ সম্পর্কে তিনি বর্ণনা দিয়ে যান। রাবারের টিউব, দুই নল এমন সব আবিস্কারের সঙ্গে সঙ্গে স্টেথোস্কোপ এর আরও উন্নতি আসে।
স্টেথোস্কোপকে তিনি আরও একটি কারণে স্মরনীয় করে যান। ১৮২৬ সালের কথা। তাঁর শরীর দিন দিন খারাপ হচ্ছে। দুর্বলতা, শরীর ভেঙ্গে পড়া এসব লক্ষণ দেখে অনেকেই বলছে তাঁর ‘টিউবারকুলসিস’ (সে সময়ে একে ‘ক্ষয় রোগ’ বা ‘কনযাম্পশান’ বলা হত) হয়েছে। তিনি মেনে নিতে রাজী ছিলেন না। মে মাস নাগাদ কাশি আর শ্বাসকষ্ট এতোটাই বাড়ল যে তিনি বাধ্য হলেন প্যারিস ছেড়ে যেতে।
জীবনের শেষ সময় এসে গেছে। বুঝতে পেরে একদিন তিনি ভ্রাতুষ্পুত্র মেরিডাক কে বললেন, আমার ফুসফুসের আওয়াজ শুনো আর বর্ণনা দাও। যে আওয়াজের বর্ণনা তিনি দিলেন, চিকিৎসক হিসেবে সেই আওয়াজ তিনি অনেক শুনেছেন। এই বর্ণনা তিনি নিজেই একসময় লিখেছিলেন। নিয়তির পরিহাসে আজ সেই আওয়াজই তাঁকে সেই কঠিন সত্যটি জানিয়ে দিল, তাঁর ‘টিউবারকুলসিস’ হয়েছে। যে আওয়াজ শোনার যন্ত্র তিনি আবিস্কার করেছেন, যে আওয়াজের বর্ণনা ও তাঁর আবিস্কার, আজ তাঁর সেই আবিস্কারই তাঁকে জানিয়ে দিল তিনি অচিরেই মারা যাচ্ছেন। অবশেষে দিনটি এলো। তাঁর বয়স তখন মাত্র ৪৫। দিনটি ছিল ১৮২৬ এর ১৩ ই আগস্ট।
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই জুলাই, ২০১৩ বিকাল ৪:৫৯