somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আগা নষ্টালজিক গোড়া নষ্টালজিক [দুই]

২৯ শে নভেম্বর, ২০১২ সকাল ১০:৫৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
:::মনোপলি:::



ছোটবেলায় আব্বু আমাকে মুখরোচক বা আকর্ষনীয় কিছু কিনে দিত না। হাজারো বায়না করলেও দিত না। তখন অনেক রাগ করতাম। অভিমান করে না খেয়ে থাকতাম, তবুও পাশান হৃদয় গলত না। কিন্তু মাঝে মাঝেই আমাকে এমন কিছু উপহার দিত যা আমার জীবন এ গভীর ভাবে ছাপ ফেলে গেছে। এই এত বছর পরের সেই জিনিস গুলোকে আমি অসম্ভব ভালবাসি, প্রচন্ড রকম মিস করি। তেমনই একটি উপহার ছিল “মনোপলি”।

যথারীতি লুডুর মতই একটা বোর্ড গেম। বিশাল একটা বোর্ড, রঙিন ছক কাটা, কাড়ি কাড়ি টাকা, অনেক অনেক ঘর বাড়ি- লাল আর সবু্‌জ, সাথে বিরাট দুটা ডাইস। দেখেই তো মন ভাল হয়ে গেল। কিন্তু এখন খেলতে তো আর পারি না। খেলতে হলে নিয়ম জানতে হবে, নিয়ত জানতে হলে ইংলিশ জানতে হবে। হলুদ আর লাল রঙের ছোট ছোট কার্ডে নিয়ম লিখা।

‘ইনহেরিট’ এর মত ইংলিশ শব্দ বুঝতে না পারলে যখন জিজ্ঞেস করতাম, আব্বু এটার মানে কি?
আব্বুর সাফ উত্তর, তুই না স্কুলে যাস? আমি লজ্জা পেয়ে চলে যেতাম।
আবার কিছুক্ষন পর এসে জিজ্ঞেস করতাম, আব্বু ‘মর্টগেজ’ অর্থ কি?
তখন আব্বু আদর করে বলত, যা এ টি দেব এর ডিকশনারি টা নিয়া আয়। ডিকশনারী হাতে নিয়ে আমাকে তখন শিখিয়েছিল, কিভাবে ইংলিশ শব্দের অর্থ খুঁজতে হয়। এই সময়ে এসে মনে হয়, তখন তো উনি বলে দিলেই পারত, কিন্তু নিজে নিজে ডিকশনারি ঘেঁটে শব্দার্থ খোঁজার মধ্যে যেই মজা আছে, আমাকে সেটার সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়া টাই তার উদ্দেশ্য ছিল- কি ঘাগু মাল রে বাপ।

ঘুমানোর সময় আব্বু গল্প করত লন্ডন নিয়ে আর আমি তন্ময় হয়ে শুনতাম। এমনভাবে কল্পনা করতাম যেন এই মাত্র আমার সামনে দিয়েই ট্রাফালগার স্কোয়ার থেকে এক ঝাক জালালি কবুতর উড়ে গেল। পলমল, কিংস্টন রেলওয়ে স্টেশন, পিকাডেলি আর মে ফেয়ার নাম গুলা স্বপ্নের মত মনে হত। লিভারপুলে জাহাজ বানানো হয় আর টাইটানিকের গল্প তখনই তো প্রথম শুনেছিলাম। মেট্রো নামের পাতালপুরীর সেই আশ্চর্য জগতের সাথে তখনই পরিচয় হয়েছিল।

একটু বামে ঘেঁষা নিন্দুকেরা বলে মনোপলি হচ্ছে ক্যাপিটালিষ্ট সমাজ এর ব্রেইন ওয়াশ করার প্রথম অস্ত্র। আমিও স্বীকার করি। বুর্জুয়া পৃথিবীতে বেঁচে থাকার কঠিন নিয়ম গুলো আমি এখানেই প্রথম শিখেছি। স্ট্যাটাস টকস... ধনী আর গরীব এর মধ্যে পার্থক্য, টাকার নানা রকম ব্যবহার, দামী জায়গা-কম দামী জায়গা, দামী জায়গার ভাড়া বেশী, কম দামী জায়গার ভাড়া কম, ব্যবসায়ী বুদ্ধি খাটিয়ে ঘড়-বাড়ি বানানো, সিস্টেমে থাকতে হলে তোমাকে ট্যাক্স দিতে হবে, নইলে জেল এ যাও- জেল থেকে বের হতে চাও...?? তাহলে টাকা দাও।

ছোটবেলা থেকেই সিস্টেম এর দাস বানানোর বুর্জুয়া পরিকল্পনা ...।

বুর্জুয়া হোক বা নির্মল বিনোদন, আমার কাছে এর চাইতে প্র্যাক্টিকাল গেম খুব কমই আছে। মনোপলি অনেক কিছু শিখায়, জীবন সম্পর্কে, জীবিকা সম্পর্কে। এর চাইতে মজা করে ভূগোল ছোটদের শিখানোর কোন উপায় আছে বলে আমার মনে হয় না। আজকআলকার ছেলে মেয়েরা মজার এই গেমস টা খেলে বলে তো মনে হয় না। ওদের অবশ্য অনেক অন্তরায় আছে। সারাদিন পড়ালেখার চাপ, বাসায় এসে কম্পিউটার, ফেসবুক, এনএফএস, ফার্স্ট পারশন শুটার, ব্লা ব্লা ব্লা। একা একাই তো তাদের থাকতে হয়। আর মনোপলি তো একা খেলা যায় না। সমাজ এর কাঠামো টাই যেন কেমন হয়ে গেছে। খুবই খারাপ লাগে এসব ভাবলে। একই সাথে নিজেকে খুব ভাগ্যবান মনে হয়। এমন বঞ্চনা আর একাকিত্বের মাঝে আমার শৈশব টা কাটে নি।

ছুটির দিন গুলোতে আমরা সব ভাই বোন মিলে সারাদিন মনোপলি খেলতাম। সকাল থেকে শুরু হত চলত গভীর রাত পর্যন্ত। খাওয়ার জন্য আম্মু আর চাচিদের কত বকা খেয়েছি তখন, কিন্তু কিছুই গায়ে লাগত না। ফুতুর হয়ে গেলে ধার-দেনা, কারো ৪-৫টা হোটেল ওয়ালা জায়গায় গিয়ে পরলে প্রতিবারের মতই “এই শেষবার” মাফ করে দেওয়ার আকুতি-মিনতি, ব্যাংক থেকে টাকা চুরি, চামের উপর সবার চোখ কে ফাঁকি দিয়ে নিজের জায়গায় একটা-দুটা বাসা বসিয়ে দেয়ার শিহরন, চোট্টামি করে ধরা খাওয়ার পর ভাইয়াদের শক্ত হাতের ঠুয়া সবই আজকে মনে পরছে।

সবার সাথে বসে মনোপলি খেলার যেই আনন্দ আর উত্তেজনা সব কিছু ছেড়ে এরপর একদিন হোস্টেলে চলে গেলাম। কিছুদিন পর দেখি বাংলা মনোপলি ও বাজারে এসে গেছে। একটু ক্ষেত টাইপ হলেও মজার ছিল। এক সময় ফিস্ফাস শুনি হোস্টেলে লুকিয়ে লুকিয়ে কারা যেন মনোপলি খেলে। তখন শুধু ভাবতাম, ইশশ হোস্টেলের এমন রেসট্রিকশনের মধ্যে মনোপলি খেলতে ক্তই না মজা হবে। সিনিয়রদের সাথে সুসম্পর্ক থাকায় সেই সুযোগও একদিন জুটে গেল। জীম ভাইদের সেকশনেই তারা মনোপলি খেলে। জীম ভাইদের রুমে উনারা চার জন আর আমি। রাত দুটা পর্যন্ত একদিন খেলেছিলাম। পরে কোন এক অভাগা কান ভাঙানোতে নজরুল স্যার সেটা সীজ করে নিয়ে যায়। তখন থেকেই আসলে মনোপলির সুর কেটে যায়। এরপর ছুটিতে বাসায় আসলেও সবসময় আর খেলা হয়ে উঠত না। তখন তো বাইরের স্বাদ পেয়ে গেছি, ঘরে বসে খেলার মত সময় কই?

বাসায় পরে থাকতে থাকতে মনোপলির বক্স্বের উপর ধুলো জমতে লাগল, ভিতর থেকে ভূতুরে উপায়ে এক এক করে টাকা গায়েব হতে লাগল, সময় এর সাথে সাথে একদিন কিভাবে যেন বক্স টাই গায়েব হয়ে গেল।
২০টি মন্তব্য ১৯টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

কুড়ি শব্দের গল্প

লিখেছেন করুণাধারা, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:১৭



জলে ভাসা পদ্ম আমি
কোরা বাংলায় ঘোষণা দিলাম, "বিদায় সামু" !
কিন্তু সামু সিগারেটের নেশার মতো, ছাড়া যায় না! আমি কি সত্যি যাবো? নো... নেভার!

সানমুন
চিলেকোঠার জানালায় পূর্ণিমার চাঁদ। ঘুমন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

ধর্ম ও বিজ্ঞান

লিখেছেন এমএলজি, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৪:২৪

করোনার (COVID) শুরুর দিকে আমি দেশবাসীর কাছে উদাত্ত আহবান জানিয়ে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম, যা শেয়ার হয়েছিল প্রায় ৩ হাজারবার। জীবন বাঁচাতে মরিয়া পাঠকবৃন্দ আশা করেছিলেন এ পোস্ট শেয়ারে কেউ একজন... ...বাকিটুকু পড়ুন

তালগোল

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৩৫


তু‌মি যাও চ‌লে
আ‌মি যাই গ‌লে
চ‌লে যায় ঋতু, শীত গ্রীষ্ম বর্ষা
রাত ফু‌রা‌লেই দি‌নের আ‌লোয় ফর্সা
ঘু‌রেঘু‌রে ফি‌রে‌তো আ‌সে, আ‌সে‌তো ফি‌রে
তু‌মি চ‌লে যাও, তু‌মি চ‌লে যাও, আমা‌কে ঘি‌রে
জড়ায়ে মোহ বাতা‌সে ম‌দির ঘ্রাণ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

মা

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৩


মায়াবী রাতের চাঁদনী আলো
কিছুই যে আর লাগে না ভালো,
হারিয়ে গেছে মনের আলো
আধার ঘেরা এই মনটা কালো,
মা যেদিন তুই চলে গেলি , আমায় রেখে ওই অন্য পারে।

অন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

কপি করা পোস্ট নিজের নামে চালিয়েও অস্বীকার করলো ব্লগার গেছে দাদা।

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:১৮



একটা পোস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ আগে থেকেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। পোস্টটিতে মদ্য পান নিয়ে কবি মির্জা গালিব, কবি আল্লামা ইকবাল, কবি আহমদ ফারাজ, কবি ওয়াসি এবং কবি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×