একটি নতুন মুঠোফোনের লোভে সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের বহনকারী ইঞ্জিনচালিত নৌকাটি নির্দিষ্ট স্থানে বন্ধ করে দেন মাঝি গুলজার মিয়া। যাতে স্থানীয় বখাটেরা নৌকায় থাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তিন ছাত্রীকে তুলে নিয়ে যেতে পারে।
১৬ ডিসেম্বর ওই বখাটেদের হাত থেকে তিন ছাত্রীকে রক্ষা করতে গিয়ে হামলার শিকার হন বিশ্ববিদ্যালয়ের পলিমার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র দীপঙ্কর ঘোষ (অনীক) ও খায়রুল কবীর। তাঁদের নদীতে ফেলে হত্যা করে বখাটেরা।
গ্রেপ্তার হওয়া মাঝি গুলজার মিয়া এসব কথা বলেছেন। হত্যাকাণ্ডের বর্ণনা দিয়ে গতকাল শুক্রবার তিনি সিলেটের মুখ্য বিচারিক হাকিম রুকনউদ্দিন কবীরের আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন।
এদিকে শিক্ষার্থীদের বহনকারী নৌকায় হামলা চালানো আরও দুই বখাটেকে পুলিশের কাছে সোপর্দ করেছেন তাদের অভিভাবকেরা। এ ব্যাপারে জালালাবাদ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সেলিম হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, গতকাল রাত নয়টার দিকে চেঙ্গেরখালের জৈন্তারকান্দি গ্রামের অভিভাবকেরা থানায় এসে সেলিম মিয়া (২০) ও আবদুল্লাহকে (২৬) থানায় সোপর্দ করেন। তাঁরা দুজনও নৌকায় হামলার সঙ্গে জড়িত বলে গুলজার মিয়ার জবানবন্দিতে জানা গেছে।
হত্যাকাণ্ডের দিন পুলিশ গুলজার মিয়াসহ দুজনকে গ্রেপ্তার করে। গত বৃহস্পতিবার এলাকাবাসী উদ্যোগী হয়ে ঘটনায় জড়িত সিলেটের নোয়াগাঁওয়ের ফাহিম (২০), আবদুস শহিদ (২১), আবদুর রউফ (২০), নলকূট গ্রামের জামাল (২২), শাহিন (২০) ও সায়েমউদ্দিন (২০) নামের ছয় বখাটেকে পুলিশে সোপর্দ করে। ওই দিন রাতে ছইল মিয়া (২২) নামের আরেক বখাটেকে পুলিশে দেওয়া হয়।
ঘটনায় জড়িত বখাটেরা ধরা পড়েছে জেনে মাঝি গুলজার গতকাল স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিতে রাজি হন বলে পুলিশ সূত্র জানায়। বিকেল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত তাঁর জবানবন্দি রেকর্ড করা হয়। গুলজার পুরো ঘটনার একজন প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে জবানবন্দি দেন।
জবানবন্দিতে গুলজার বলেন, ১৬ ডিসেম্বর সন্ধ্যাবেলা তিনজন ছাত্রী ও পাঁচজন ছাত্র মিলে তাঁর নৌকাটি ২০০ টাকায় ভাড়া নেন। চেঙ্গেরখালে বেড়ানোর জন্য ছাত্রছাত্রীরা নৌকা ভাড়া নিচ্ছে দেখে নলকূট গ্রামের জামাল তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করেন। জামাল, শাহিন, সায়েম ও ছইল নৌকার মাঝিকে বলেন, নৌকায় ভার্সিটির ‘পুইরাইন’ (ছাত্রীরা) আছে। ওদেরকে ধরে নিয়ে যেতে হবে। জামাল সঙ্গীদের নিয়ে এ কথা বললে গুলজার আপত্তি জানান। তখন তাঁকে মুঠোফোনের একটি নতুন সেট কিনে দেওয়ার লোভ দেখান জামাল। জামালের সঙ্গে তখন নয়জনের একটি দল ছিল।
গুলজার জবানবন্দিতে উল্লেখ করেন, নতুন মুঠোফোন পাওয়ার লোভে তিনি জামালদের কথা অনুযায়ী ছাত্রছাত্রীদেরসহ নৌকাটি চেঙ্গেরখালের পুটিখালে নিয়ে যান। নৌকা ছাড়ার পর জামাল আরও দুবার গুলজারের মুঠোফোনে কল দেন। জামালরা আরেকটি স্টিলবডির নৌকা নিয়ে এলে নির্দেশ মোতাবেক নিজের নৌকার ইঞ্জিন বন্ধ রাখেন গুলজার। এ সময় জামাল, শাহিন, ছইল, সায়েম নৌকায় থাকা ছাত্রীদের ধরে টানাহেঁচড়া শুরু করেন। তখন ছাত্রীদের সঙ্গীরা বাধা দিলে এলোপাতাড়ি মারধর করে দুজনকে (দীপঙ্কর ও খায়রুল) নদীতে ফেলে দেন। এর পরও অন্য ছাত্ররা বাধা দিলে নৌকায় রাখা ছাত্রছাত্রীদের মুঠোফোন, মানিব্যাগ ও ছাত্রীদের ভ্যানেটি ব্যাগ নিয়ে তাঁরা নয়জন ঘটনাস্থল ত্যাগ করেন।
দুই ছাত্রকে পিটিয়ে নদীতে ফেলা ও ঘটনাস্থল থেকে ফেরা প্রসঙ্গে জবানবন্দিতে গুলজার বলেন, চেঙ্গেরখালের দক্ষিণ দিকে এ ঘটনা ঘটে। উত্তর দিকে নৌকা ভিড়িয়ে তিন ছাত্রীসহ ছয়জনকে নদীতীরে তুলে দেন। পরে দুই ছাত্র তাঁকে নিয়ে আবার নদীতীরে যান। সেখানে তাঁরা অনীক (দীপঙ্কর ঘোষ) ও খায়রুলের নাম ধরে ডাকেন। কিন্তু দীপঙ্কর ও খায়রুলকে না পেয়ে ছয় ছাত্রছাত্রী বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্দেশে রওনা দেন।
জবানবন্দির শেষ পর্যায়ে গুলজার তাঁর পালানো প্রসঙ্গে বলেন, ‘ছাত্রছাত্রীরা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে যেতে চাইলে নদীতীরে কে একজন পুলিশ পুলিশ বলে চিৎকার করে। আমি তখন নৌকা রেখেই পালিয়ে যাই।’
যোগাযোগ করলে জালালাবাদ থানার ওসি সেলিম হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ঘটনার পরপরই মাঝি গুলজারকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরে তাঁর দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে অভিযুক্তদের চিহ্নিত করা হয়েছিল। শেষে এলাকাবাসী উদ্যোগী হয়ে অভিযুক্তদের ধরে পুলিশে সোপর্দ করায় গুলজার স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিতে রাজি হন।
মুঠোফোন উদ্ধার: পুলিশে সোপর্দ করা ছয়জনের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে নিহত এক ছাত্রের মুঠোফোন উদ্ধার করা হয়েছে। গত বৃহস্পতিবার গভীর রাতে কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা সদরের একটি পরিত্যক্ত স্থান থেকে মুঠোফোনটি উদ্ধার করে পুুলিশ।
বিষয়টি নিশ্চিত করে জালালাবাদ থানার উপপরিদর্শক (এসআই) সঞ্জিত দাস জানান, ছয়জনকে জিজ্ঞাসাবাদের ভিত্তিতে হত্যার আলামত উদ্ধারে পুলিশ সচেষ্ট রয়েছে।