ড. ইশা মোহাম্মদ : ইরাকে নতুন করে যুদ্ধ শুরু হয়েছে। সাদ্দামের অতৃপ্ত আত্মা কি এখনও ঘুরে বেড়ায় ইরাকে? বেশ কয়েকজন মুসলমান বেঈমানী করেছিল সাদ্দামের সাথে। সে সময়েই শিয়া-সুন্নী বিরোধ ছিল। ছিল গোত্র বিরোধ। কুর্দিদেরকেও অনেকে পছন্দ করে না ইরাকে। এত সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক বিরোধ থাকা সত্ত্বেও মুসলমানদের মধ্যে একটা অন্য রকম ঐক্য ছিল। সাদ্দামের সময়ে ধর্মীয় কারণে কাউকে হত্যা করা হয়নি। ইসলাম ধর্মের উদারতার অনুশীলন ছিল তার সময়ে। কিন্তু দেশটাকে খতম করার জন্য সা¤্রাজ্যবাদীরা বিভিন্ন রকম কলাকৌশল করে ধর্মভিত্তিক ঐক্য বিনষ্ট করে দেয়। ইরাক দেশটা বেশ বড় এবং প্রাকৃতিক সম্পদও বিশাল। তার মধ্যে আবার জ্বালানিতে ভরপুর। সা¤্রাজ্যবাদের দৃষ্টি ছিল প্রথম থেকেই। কিন্তু একমাত্র জ্বালানির জন্যই সাদ্দামকে টার্গেট করেনি তারা। সাদ্দাম ছিলেন রুশঘেঁষা। যেহেতু আধুনিক গণতন্ত্র স্বৈরতন্ত্রবিরোধী। কিংবা বলা যায়, একনায়কতন্ত্রবিরোধী তাই সুযোগ পেয়ে সাদ্দামবিরোধীরা বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সাধারণ মানুষকে বোঝাতে সক্ষম হয় যে, সাদ্দাম একনায়ক এবং মানবতাবিরোধী কাজ-কারবার করছে। সাদ্দামকে এতদিন ধরে একই আসনে বসে থাকার বিষয়টি অনেকেরই পছন্দ হয়নি। দ্বিতীয় যে সমস্যা ছিল তা পুরোপুরি ধর্মীয়। সাদ্দামকে সা¤্রাজ্যবাদীরা সমাজতন্ত্রী এমনকি কম্যুনিস্ট বলেও প্রচারণা চালিয়েছিল। সমাজতন্ত্রী কিংবা কম্যুনিস্টদের কট্টর মুসলমানরা নাস্তিক কিংবা দুর্বল ইমানদার মনে করে। এদের অনেকের মুখেই শুনেছি যে, সাদ্দাম ইসলামবিরোধী। যদিও সাদ্দাম গরিব মুসলমানদের দুবেলা খাওয়ার ব্যবস্থা করে দিয়েছিল তবুও তাকে অপচয়কারী ও বিলাসী বলেও বদনাম নিতে হয়েছিল। যখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সাদ্দামের দেশে আক্রমণ করেছিল তখনও একশ্রেণীর মুসলিম জোরেশোরেই বলত সাদ্দাম ‘শয়তান’। এর বিপরীতে খুবই ক্ষীণকণ্ঠে শোনা যেত ‘বাপের ব্যাটা সাদ্দাম’। সাদ্দামকে ব্যক্তি হিসেবে এবং সাদ্দামের সিস্টেমকে ইসলামবিরোধী আখ্যা দিয়ে তা সউদী সরকার ধ্বংস করতে চেয়েছিল। ইরাক আক্রমণের সময় সউদীরা মার্কিন বাহিনীকে মদদ দিয়েছিল। এসব বিষয় সবারই জানা। যেটি সবার জানা নেই তা হচ্ছে সাদ্দামকে ধ্বংস করার সর্বদৃষ্ট উদ্দেশ্য হচ্ছে গণতন্ত্র, মানবাধিকার ইত্যাদি। আর প্রকৃত গোপন উদ্দেশ্য হচ্ছে মুসলিম শক্তিকে খর্ব করা।
বহুভাবেই মার্কিন উদ্দেশ্য সম্পর্কে বহুবার বলাবলি করা হয়েছে। সাদ্দাম নিজেই বলেছিলেন, ইরাকের তেলভা-ার লুটপাট করার জন্য মার্কিনি এবং ইহুদিরা তৎপর। তাদের লোভাতুর চোখ জ্বালানি খনির দিকে। সাদ্দামের কাছে মারণাস্ত্র আছে বলে যে অপপ্রচার করা হয়েছিল তাও ‘মিথ্যে’ প্রমণিত হয়েছে। এখন তো বিশ্বাস করাই যায় যে, সাদ্দামের কথাই সত্য। আমার মনে হয় সত্য আরো আছে। ইরাককে কয়েক টুকরা করার কুপরিকল্পনা আছে সা¤্রাজ্যবাদের। তাদের ধারণা হয়েছে যে, যে কোনো মুসলিম দেশ যদি বড় হয়, জনসংখ্যায় এবং প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ হয়-তবে কোনো এক সময় তা শক্তিশালী রাষ্ট্র হয়ে উঠতে পারে। সাদ্দামের দেশটা বেশ বড় এবং প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ। সাধারণ মানুষ দুবেলা খাচ্ছিল। অর্থাৎ গরিব মুসলমানরা প্রয়োজনীয় পুষ্টি পাচ্ছিল। এরকম অবস্থা দীর্ঘদিন চলতে থাকলে এক সময় মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে শক্তিশালী দেশ হয়ে উঠবে ইরাক। ইরাককে শক্তিহীন করার জন্য দেশটাকে অস্থির করা দরকার। প্রয়োজনে ভেঙে ফেলা দরকার। ভাঙার জন্য তারা এখন শিয়া-সুন্নী দ্বন্দ্বকে কাজে লাগাচ্ছে। সেখানে কুর্দিদের জন্য আলাদা রাষ্ট্রের দাবিও আছে। হিসাব মতো ইরাক তিনভাগে ভাগ হওয়ার আশঙ্কা আছে।
সাদ্দাম বেঁচে থাকলে, ক্ষমতায় থাকলে ইরাক ভেঙে দু’তিন টুকরা করা সম্ভব হতো না। তাই সাদ্দামকে হত্যার পর ইরাক ভাঙার আয়োজন হচ্ছে। তিনটি দেশ হলে প্রতিটি দেশই দুর্বল হবে। তারা পরস্পরের সাথে নিয়ত যুদ্ধরত থাকবে। তাদের প্রত্যেকেরই মুরুব্বী হবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। তারা জাতীয় উন্নয়নকে গুরুত্ব না দিয়ে কয়েকজন ধনীকে আরো ধনী বানানোর চেষ্টা করবে। তারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অনুগত লুম্পেন রাষ্ট্র হবে। বিশ্বব্যাপী মুসলিম উম্মার পুনরুত্থানকে অংকুরেই বিনষ্ট করার জন্য ইরাককে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন করা তাদের খুবই প্রয়োজন। আর এ কাজে তারা শিয়া-সুন্নীদের মধ্যে যুদ্ধ বাধিয়ে দিয়েছে। শোনা যাচ্ছে, আলামতও পাওয়া গেছে-ইরান শিয়াদের পক্ষ নিয়ে যুদ্ধ করবে। সবচেয়ে বড় ভয় এটাই। ইরাক-ইরান য্দ্ধু হতে পারে। ইহুদিরা এটাই চাচ্ছে। ইরাক-ইরান যুদ্ধ হলে ইহুদিদের মূল পরিকল্পনা ইরান আক্রমণ, তা অনেকটা প্রাকটিবিলিটি পাবে। এখন যে অবস্থা তাতে ইরানকে সরাসরি আক্রমণ করা যাচ্ছে না। কিন্তু শিয়া-সুন্নী যুদ্ধে ইরান শিয়াদের পক্ষ নিলে সুন্নীরা ক্ষেপে গিয়ে ইরানের মূল ভূখ-ে আক্রমণ করতে পারে। একবার ইরানের মূল ভূখ-ে যুদ্ধ সম্প্রসারিত হওয়ার পর তাকে আগুন দিয়ে বাড়িয়ে অনেকদূর নিয়ে যাওয়া যাবে। আর যদি ইরান বিমান আক্রমণ শুরু করে তবে ইসরাইলী বিমান বাহিনী সুন্নীদের পক্ষ নিয়ে দু’চারটবোমা ইরানে মারবে। ইসরাইলী বিমান বাহিনীর মূল উদ্দেশ্য হবে ইরানের পারমাণবিক চুল্লিগুলোকে ধ্বংস করা। কিন্তু কোনো ইহুদি বিমান ইরানের আকাশসীমা অতিক্রম করতে পারবে না। কিন্তু ইরাকের সুন্নী মুসলমানরা যদি বিমান হামলা চালায় তবে মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য মুসলিম দেশ ইহুদিদের সন্দেহ করবে না। ইহুদিরা এটাই চায়।
শিয়া-সুন্নী দ্বন্দ্বে ইসলামী উম্মাহ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। মুসলমান বিশ্ব এক অর্থে দরিদ্র। তাদের প্রাকৃতিক সম্পদ আছে। কিন্তু উন্নয়নের কাজে লাগাতে পারে না। যেমন বাংলাদেশের কথাই বলা যায়। বাংলাদেশ প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর। কিন্তু তার প্রাকৃতিক সম্পদের পরিমাণ কত তা সে নিজেই জানে না। জানলেও কাজে লাগাতে পারছে না। কারণ উন্নত প্রযুক্তি সা¤্রাজ্যবাদের হাতে। ইতোমধ্যেই রটে গেছে যে, বঙ্গোপসাগরে যে বিশাল তরলরত্ন ভা-ার রয়েছে তা লুটপাট করার জন্য জলদস্যুরা উঠেপড়ে লেগেছে। প্রকৃত অর্থে সব মুসলিম দেশের একই অবস্থা। উন্নত প্রযুক্তির বিরুদ্ধে সামাজিকভাবে দেশগুলো অবস্থান গ্রহণ করে। ফলে বিজ্ঞান মনস্কতার চর্চা হয় না। কোন আবিষ্কারই নেই, সব কিছুর জন্যই সা¤্রাজ্যবাদের মুখাপেক্ষী থাকতে হয়। তারা গরিব দেশগুলোকে ‘কলামুলা’ দেখিয়ে দিনের পর দিন গরিব করে রাখে। এসব গরিব দেশে আবার তাদের সৃষ্ট লুম্পেন বুর্জোয়াদের দখল আছে। যারা নির্দ্বিধায় দালালি করে যাচ্ছে। অনেক সময় আয়েশ-খায়েশের জন্য সরকারও দালাল হয়ে যায়। প্রাকৃতিক সম্পদের বিজ্ঞানমনস্ক ব্যবহার করা হলে গরিব দেশগুলো অচিরেই ধনী হয়ে যাবে। তৃতীয় বিশ্বের যে কোনো দেশ জাতীয় অর্থনীতিতে বেগবান ভাব দেখালেই তারা বিভিন্ন শর্ত চাপিয়ে দিয়ে উন্নয়ন রহিত করে। কিংবা সরকার পরিবর্তন করে নৈরাজ্য তৈরি করে। মুসলিমদের মধ্যে ধর্মের নামে ধর্মান্ধতা ঢুকিয়ে দিয়ে যুদ্ধ বাধিয়ে দেয়। পাকিস্তানে যেমন শিয়া-সুন্নী দ্বন্দ্ব বাধানোর সুযোগ না থাকায় আল কায়দা দিয়ে গ-গোল করানো হচ্ছে। প্রতিটি মুসলিম দেশই কোনো না কোনো সময়ে সা¤্রাজ্যবাদের কূটকৌশলে নাস্তানাবুদ হবেই।
সা¤্রাজ্যবাদের কূটকৌশলের বিপরীতে মুসলিম উম্মার বাঁচার পথ একটাই। ধর্মসহিষ্ণুতা। আল্লাহই হেদায়াতের মালিক-এই ভাবনার সম্প্রসারণ করা। জোর করে মুসলমানদের মুসলমান বানানোর চেষ্টা বন্ধ করা এবং বিজ্ঞানমনস্কতার চর্চা করা। পবিত্র কোরআন মজিদে বারবার বিজ্ঞানচর্চার কথা বলা হয়েছে। যারা বৈরী জীবনযাপন করে, তারা বিজ্ঞানমনস্কতা পছন্দ করে না। বিজ্ঞানমনস্ক সমাজই ধর্মসহিষ্ণু সমাজ। ধর্মের কারণে সামাজিক হানাহানি ইসলামে নেই। এই চৈতন্যের ব্যাপক প্রচার করাই এখন মুসলিম উম্মাহর প্রধান কাজ হবে। মুসলমানরা নিজেদের মধ্যে লড়াই করে ব্যাপক জানমালের ক্ষতি সাধন করুক এটাই সাম্রাজ্যবাদের মূল উদ্দেশ্য হলে তার বিপরীতে মুসলমানদের উচিত হবে সামাজিক শান্তি বজায় রাখা এবং নিজেদের মধ্যে যুদ্ধ না করা।
মধ্যপ্রাচ্যে নিয়ত অস্থিরতা এবং যুদ্ধ ইসলামী মূল্যবোধকে ম্লান করবে। সাধারণ মানুষ ইসলামকেই সন্দেহ করা শুরু করবে। বিশ্বব্যাপী মুসলমানদের উচিত হবে ইরাকের রাষ্ট্রীয় সংহতি বজায় রাখার জন্য উদ্যোগ নেয়া। ধর্মীয় কারণে পরস্পরের সাথে যুদ্ধ না করা এবং ধর্মসহিষ্ণু সমাজ বিনির্মাণে বিজ্ঞানমনস্কতার চর্চা করা।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, জাতীয় বিশ্ববিদ্যাল-collected