somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ছোটদের সাথে কেমন আচরণ করা উচিৎ, একজন ছাত্র-ছাত্রী বা সন্তানকে যেভাবে মানুষ করা যায়.।

০৩ রা ফেব্রুয়ারি, ২০১৪ রাত ৩:০১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

“ভয় দেখিয়ে যা করা যায় ৩দিনে; উৎসাহ দিয়ে তা একদিনেই করা সম্ভব”। হুমায়ুন আহমেদের উক্তিটি দিয়েই শুরু করতে চাই। এ কথাটা দিয়ে শুরু করলাম এ কারণে, হুমায়ুন আহমেদ মূলত আমার মনের কথাটাই বলেছেন। যদি বলি উক্তিটি আমার তাহলে নিশ্চয় আপনার কাছে খুব একটা গ্রহণযোগ্যতা পাবোনা। আমি মূলত কোন উপদেশ দেয়ার জন্য এই নিবন্ধ লিখিনি। আমার চোখে যে আচরণগুলো বালি হয়ে থাকে সেগুলো পরিস্কার করার চেষ্টা করেছি কেবল। মূলত আমার পার্শ্বস্থ লোকদেরকে উদ্দেশ্য করেই আমার এই রচনা।

আমি কখনো দেখিনি কোন শিক্ষক তার ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে বা কোন বড় ভাই তার ছোট ভাইয়ের কাছে ভয়ের দ্বারা সমাদৃত হয়েছে। কারো কারো ভাবটাই এমন থাকে; যেন তিনি শিক্ষকের সংজ্ঞাটাই এভাবে বুঝেন যে, শিক্ষক মানে সব সময় ভাব ধরে গম্ভীর হয়ে থাকতে হবে। যা হুকুম করবে ছাত্র-ছাত্রীদের তাই মানতে হবে। নিজে যেমনই হোক না কেন ছাত্র-ছাত্রীদেরকে সোনার মানুষে পরিণত করতে হবে। আমি বলতে চাই এই চকিদারি দায়ীত্ব আপনারে দিলো কেডা? ছাত্র-ছাত্রীকে সোনার মানুষ হিসেবে পেতে চান? আগে নিজে ভালো হয়েযান। ছাত্র-ছাত্রী দেখে দেখে শিখবে। উপদেশ কেবল শুনার জন্য আর শুনানোর জন্য। আর দৃষ্টান্ত হলো শিখানোর জন্য। ছাত্র-ছাত্রী যদি কথা না শুনে অনেকের প্যাস্ট্রিজে বাধে। আবার কেউ কেউ ছাত্র-ছাত্রীদের দ্বারা খেদমত পাওয়াটা নিজের অধিকার মনেকরেন। আর সেই অধিকার কড়ায় গন্ডায় আদায়ের জন্য বিবেকের জলাঞ্জলীও দিয়ে থাকেন। অনেকে ছোটদের সব সময় ভয়ে রাখতে পছন্দ করেন। এই ভয়টাকে আমি দু’ভাবে ব্যাখ্যা করবো। এক হচ্ছে বাঘের ভয়। আরেক হচ্ছে ভালোবাসার ভয়। বাঘকে মানুষ কেবল ভয়ই পায়। এই ভয়ের মধ্যে মূলত কোন মহত্ম নেই। আছে ঘৃণা। অন্যদিকে মানুষ নিজের মাকেও কিন্তু ভয় পায়। সেই ভয়ে আছে ভালোবাসা। মা যদি সন্তানকে আস্ত করেও মেরে দেন সন্তান কিন্তু ঘুরে ফিরে মায়ের আচলেই এসে জড়ায়। গ্রামের মুরুব্বীদের কথা স্মরণ করা যাক। সপ্তাহে একদিন জুমার নামায পড়তে মসজিদে আসে। ভাবখানা থাকে আসমানে আর জমিনে। ঘটনাক্রমে ছোট ছেলে-পুলে যদি মসজিদে শোর-চিৎকার বা দুষ্টুমি করে ফেলে তখন তাদের মুরুব্বিয়ানা আচরণ দেখাযায়। তারা বাচ্ছাদের মারধর করে। ঘাড় ধাক্কিয়ে মসজিদ থেকে বের করে দেয়। আরো কতো রকম নির্মম আচরণ করে বাচ্চাদের সঙ্গে। আমার জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করে এ বয়সে তিনি কেমন ছিলেন?

কিছুদিন আগের কথা। লক্ষ্মীপুরে একটা নূরানী মাদরাসায় কোন এক কারণে আমাকে কিছুদিন শিক্ষকতা করতে হয়েছে। একদিন একজন অভিভাবক তার সন্তানকে নিয়ে এসে বলে “কোন কথা শুনেনা; একদম মেরে হাড় গুড়ো করে দিয়েছি”। আমি বল্লাম, কি বলেন; আমিতো কোন দিন মেরে হাড় গুড়ো করিনি। সে আমার কথাতো কোন দিন অমান্য করেনি। বরং বলার আগেই বুঝতে চেয়েছে। তিনি বল্লেন, আপনিতো শিক্ষক। আপনাকে ভয় করে। আমি বল্লাম, আমাকে ভয় করেনা ভালোবাসে। আর আপনাকে করে ভয়। ভয় আর ভালোবাসার দুরত্বটাই আপনি বুঝতে পারেননি। তিনি আশ্চর্য হলেন; শিক্ষক কখনো মাইরের ব্যাপারে অভিভাবকের বিরুদ্ধাচারণ করে।

আমার একটা বদ অভ্যাস আছে। আমার সামনে বন্ধুদের কেউ যদি তার ছাত্র-ছাত্রীদের সাথে শিক্ষকশুলব আচরণ করতে ব্যর্থ হয় আমি তাৎক্ষণিক অনধিকার চর্চা করে বসি। অবশ্য আগে অনুমতি নেই। না ভেবেই অনুমতি দিয়ে ফেলে। পরেই বুঝে কতো ধানে কতো চাল। এই কথাগুলো আমি যখন কোন বন্ধুকে বলি; সে আমার সাথে তর্কে জড়িয়ে পড়ে। আমি শুধু বলি ভাই, আমিও তোর মতোই একজন ছাত্রশিক্ষক। তোর ছাত্র-ছাত্রীগুলো যেই মাটির তৈরী আমার ছাত্র-ছাত্রীগুলোও একই মাটির তৈরী। আমি তর্কে জড়াতে চাইনা। কারণ এ ব্যাপারটা তর্কস্বাপেক্ষ নয়; বরং অনুভবস্বাপেক্ষ। আমার মতে শিক্ষক হবে একজন ছাত্রের প্রকৃত বন্ধু। যার সামনে নিজের সকল সমষ্যার কথা অকপটে মনখুলে বলা যাবে। ভেতরে কোন সংশয় কাজ করবেনা। শিক্ষক হবে খেলার সাথী। সুখ ও দুঃখের অংশীদার।

যখন আমি দেখি কোন শিক্ষক তার ছাত্র-ছাত্রীদের সাথে রুঢ় আচরণ বা খারাপ ভাষা ব্যবহার করছে আমার মন চায় তাকে কানে কানে গিয়ে বলি শিক্ষক হওয়ার জন্য তোকে ছাত্র হওয়া দরকার। ভালো ডিগ্রি থাকাই শিক্ষক হওয়ার জন্য যথেষ্ট নয়। মনেরাখবেন, ভাষা আপনার পরিচায়ক। আপনার ভেতরটা বাইরে ফুটিয়ে তুলবে আপনার ভাষা। কারো কপালে লেখা থাকেনা মানুষহিসেবে সে কেমন। তবে বুঝা যায়; তার ভাষা থেকে। যদি আপনি ছাত্র-ছাত্রীদের সাথে খারাপ ভাষা ব্যবহার করেন ছাত্র-ছাত্রীদের কোন পরিবর্তনতো আসবেনা বরং একটা ব্যাপার স্পষ্ট হয়ে যাবে। তাহলো আপনি অভদ্র। শিক্ষক হওয়ার জন্য বাড়তি কিছু যোগ্যতা থাকা চাই। কাদামাটি যখন নরম থাকে তা দিয়ে আপনি যা খুশি বানাতে পারেন। বাসন, পাতিল, কলসি বা হাড়ি। যেভাবে খুশি নকশা করতে পারেন। ঠিক তেমনি একটি শিশুর বাল্যকালকে কাদামাটির সাথে তুলনা করা যেতে পারে। এ সময়ে তাকে আপনি যা শিখাবেন সে তাই শিখবে। যা বুঝাবেন সে তাই বুঝবে। আপনি তাকে গালি দিবেন! সেও গালি দিবে। আমি কসম করে বলতে পারি; আপনার গালি সে হুবহু নকল করবে। কুত্তা, হারামি, অঘা, বোকা, গাধা ও বেকুব। যা কিছুই বলেননা কেন সেও তাই বলবে। আপনাকে না হোক অন্য কাউকে বলবে। এখন না বলুক, ভবিষ্যতে বলবে। তার সাথে গরম মেজাজ দেখাবেন! সেও বদ মেজাজী হবে। কাদামাটির সূত্র মনে আছেতো! পারিপার্শ্বিক প্রভাব মানুষকে সব সময়ই প্রভাবিত করে। বাল্যকালে একটা শিশুর মানসিকতায় পারিপার্শ্বিক প্রভাব খুব বেশি পড়ে। একে সমাজ বিজ্ঞানের ভাষায় বলে ‘সামাজিকীকরণ’। সামাজিকীকরণের উপাদানগুলোর মধ্যে বন্ধু, পরিবার, খেলার সাথী, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, টেলিভিশিন ও চলচ্ছিত্র উল্লেখযোগ্য। এজন্যই সচেতন মা-বাবা সন্তানের জন্মের পর গ্রাম ছেড়ে শহরে চলে যান শুধু পরিবেশ বদলের জন্য।

মনেপড়ে আমি যখন হেফজুখানায় পড়ি; দু’জন শিক্ষক ছিলেন। তাম্মধ্যে একজন মারতো যেখানে সেখানে। যা আমি একদম সহ্য করতে পারতামনা। তিনি যখন মারতেন আমি ঠিক চিংড়ি মাছের মতো লাফাতাম। ঠিক একই সময়ে অপর যে শিক্ষক ছিলেন; তিনি মারতেন হাতের বাহু বা মাংশপেশীতে। ব্যাথা পেতাম বটে কিন্তু সেই মাইর কোন রকম বাড়াবাড়ীর পর্যায়ে ছিলোনা। তখন আমি ইচ্ছা করেছিলাম- যদি কখনো হেফজুখানার শিক্ষক হই তবে অবশ্যই ছাত্রদেরকে দেখেশুনে মারবো। আর হাতের বাহুতে মারবো। যদি সেদিন আমি দেখতাম, সেই শিক্ষক না মেরে ছাত্রদেরকে সুন্দর কথা আর ভালোবাসা দিয়ে পড়া আদায় ও নিয়ন্ত্রণ করে; তাহলে নিশ্চয় আমিও ইচ্ছা করতাম আমার ছাত্রদেরকে আদর আর ভালোবাসা দিয়ে পড়াবো। আমি যে পরিবেশে বড় হয়েছি তা আদৌ এই নিবন্ধে উল্লেখিত পরিবেশের মতো ছিলোনা। অনাদর, অবহেলা, গোঁড়ামীসহ যতোগুলো খারাপ দিক এই নিবন্ধে আমি উল্লেখ করেছি তা মূলত আমার অভিজ্ঞতা থেকেই। আমার মা-বাবা, শিক্ষক-মুরুব্বী, বড় ভাই যারা ছিলেন; সবাই আন্তরিক ও সদিচ্ছুক ছিলেন বটে। কিন্তু পদ্ধতিগত ভূল ছিলো। যা আমি আজ মর্মে মর্মে উপলদ্ধি করছি। আমার আজকের এই পরিবর্তন মূলত দু’টো পরিবেশ থেকে। এক হলো ভার্সিটি জীবন। আরেক হলো শিক্ষক জীবন। আমি সবচেয়ে বেশি ঋণী ভার্সিটি ভর্তি কোচিং ‘কমিটমেন্ট’ ও লক্ষ্মীপুরে আমার টিউশনির ছাত্র সিয়াম ও মিদুলের কাছে। কোচিং এ গিয়েই মূলত আমি বিভিন্ন জেলার, বিভিন্ন প্রকৃতির আর বিভিন্ন পরিবেশের মানুষের সাথে মিশেছিলাম। একই মেসে একই রুমে থেকেছি আর জেনেছি যা কিছু আমার অজানা ছিলো। সে থেকেই শুরু হয় আমার জীবনে পরিবেশভ্রমন। সেই ভ্রমনে আজও আমি মুসাফির। আর আমার দু’জন ছাত্র যাদের কথা ইতিপূর্বে উল্লেখ করেছি। তাদেরকে আমি পড়িয়েছি ২০০৮ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত। টানা ৪ বছর। খুব ছোট থেকেই তাদেরকে পড়াতে শুরু করি। দেখতে দু’জনই খুব মায়াবি ছিলো। খুব সুন্দর করে সাজিয়ে গুছিয়ে কথা বলতো। খুব মায়া লাগতো তো; তাই কখনো খারাপ আচরণ বা মারধরও করতে পারতামনা। তাদেরকে আদর সোহাগ আর ভালোবাসা দিয়ে পড়াতে গিয়েই আমি শিখেছি কীভাবে ছোটদেরকে ভালোবাসতে হয়। সংশোধন আর শাসন কীভাবে করতে হয় তারাই আমাকে শিখার সুযোগ করে দিয়েছে। এককথায় রবীন্দ্রনাথের ভাষায় বলতে পারি, “তোমারে যা দিয়েছিনু সে তোমারি দান”।

“শাসন করা তারই সাজে; সোহাগ যে করতে জানে”। কিছু শিক্ষক আছে যারা ছাত্র-ছাত্রীদেরকে শাসনই করতে জানে। আদর করতে জানেনা। আদর বলতে যে তাকে ধরে চুমু খেতে হবে। বা জড়িয়ে ধরতে হবে; এমননা। ভালো কথা বলা, একটু হেঁসে কথা বলা, একটু আধটু দুষ্টুমি করা, গল্প করা, কাছে ডাকা, কিছু কিনে খাওয়ানো; এভাবেও কিন্তু আদর করা যায়। আবার কিছু অভিভাবক আছে শখ করে সন্তানের জীবন ধ্বংস করে। সেই শখটা হচ্ছে ‘অতি আদর’। সন্তানকে মানসিক চাপ সৃষ্টি করে খাওয়ায়। তাতে খাবারের প্রতি তার একটা ঘৃণা আর অভক্তি জন্মে। ফলে খাবার দেখলেই তার বমি আসে। একদিনেই আস্ত বিদ্বান বানিয়ে ফেলতে চায়। সারাদিন পড়ার টেবিলে জোর করে বসিয়ে রাখে। ফলে পড়ালেখা তার কাছে বিষের মতো মনেহয়। কোন কাজ করতে দেয়না। পুতুল বানিয়ে রাখে সন্তানকে। সমবয়সী ছেলে মেয়েদের সাথে মিশতে দেয়না। ফলে বোকা আর বলদ টাইপের হয়ে বেড়ে উঠে। আর সারাদিন টেনে টেনে বলে বেড়ায়- আমার ছেলে দূর্বল, ও এখনো ছোট, পারবেনা, ও এখনো অতো চালাক হয়নি, ওকি কিছু বুঝেনি ইত্যাদী ইত্যাদী। আমি বলি ও পারবে কীভাবে? আপনিইতো তাকে বোকা বানিয়ে রেখেছেন। তাকে সারাক্ষণ বুঝিয়েছেন তুই পারবিনা। তুই বোকা। তুই ছোট। তুই দূর্বল। কখনোকি বলেছেন- তুই-ই পারবি? এটা খুবই সহজ; চেষ্টা করলেই পারবি। অন্য সবাই যদি পারে তুই পারবিনা কেন? সাহস যুগিয়েছেন কখনো? মনেরাখবেন, মানুষ তার চিন্তার সমান বড়। যে যত বড় চিন্তা করতে জানে সে ততো বড়। এটা আমার কথানা; মনীষীদের কথা। কিছু মহিলা এমন আছে যারা আমার এই নিবন্ধ পড়েও তর্ক করতে চাইবে। আপনিতো আর আমার সন্তান সম্পর্কে জানেননা। আমার সন্তানকে আমিই ভালো জানি। সে এমন. এমন.. এমন...।

অনেকে আবার ক্ষমা করতে জানেনা। ছাত্র-ছাত্রী বেয়াদবী করেছেতো! তাকে গালি দিয়ে রসাতলে পৌছাতে হবে। কটু কথা বলতে হবে সারাদিন। বেতের বাড়ীতো অবধারিত। এতো ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ! মনেরাখবেন, ছাত্র-ছাত্রী শিখবে আপনার কাছ থেকে। আপনি যদি আদর করেন; সে আদর করা শিখবে। আপনি যদি ক্ষমা করেন, সে ক্ষমা করা শিখবে। তার মানে আমি বলছিনা তার বেয়াদবীমূলক আচরণকে একেবারে এড়িয়ে যেতে হবে। তবে অবশ্যই রুঢ় আচরণ বা খারাপ ভাষা ব্যবহার করবেননা। তাতে অনুশোচনা বা পরিবর্তনতো আসবেইনা। উল্টো আপনার প্রতি অভক্তি জন্ম নিবে। তার আচরণে আপনি ব্যাথা পেয়েছেন এটা তাকে বুঝাতে হবে। যদি সঠিক পন্থায় বুঝাতে পারেন তবেই কেল্লা ফতে। দেখেন কতো দ্রুত কাজ হয়। পরিবর্তন আসে কিনা তাই দেখুন। সেজন্য যেটা করতে হবে- কিছুক্ষণের জন্য আপনি তার সামনে মন খারাপ করে থাকতে পারেন। একটা দীর্ঘশ্বাঃস ফেলে বলতে পারেন, আমি তোমার কাছে এমনটা আশা করিনি। তোমাকে আমি এতোটা ভালো জানতাম। সেই তুমি আমার সাথে এই আচরণ করলে? ইত্যাদী, ইত্যাদী। গ্যারান্টি দিচ্ছি। পরিবর্তণ আসবে। যদি আপনি সঠিক ভঙ্গিমা প্রকাশ করতে পারেন। যখন বুঝবেন তার ভেতর অনুশোচনা এসেছে; এবার নছীহত করুন। দেখো, আমি তোমার খারাপ চাইনা। তোমার ভালোর জন্যই বলি। তবে লক্ষ রাখুন। মন খারাপ করতে গিয়ে আবার যেনো বদদোয়া না চলে আসে। যখন নিশ্চিত হলেন আপনার নছীহত সে মনোযোগ দিয়ে শুনছে। এবং ভালোভাবে নিচ্ছে। কথা শেষে একটু আদর করুন। তার মানে সে বুঝতে পারলো আপনি এখন আর তার উপর রাগ নেই। তাকে মাফ করে দিয়েছেন। এতে সে আপনার সাথে দ্রুত স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসতে পারবে। মাঝেমধ্যে কিছু কিছু উপদেশও দিতে পারেন। ‘হটমুড’এ নয়; ঠান্ডা মাথায়। উপদেশ দিবেনতো! দৃষ্টান্তসহকারে দিন। কাজে আসবে। কথায় আবেগ থাকতে হবে। আর থাকবে ভালোবাসা।

ছাত্র-ছাত্রী পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট করুক, সব কাজে সফল হোক চান। তাইনা? কখনো সাহস যুগিয়েছেন? যোগাননি নিশ্চয়। মাদার গাছ রোপন করে আম খাওয়ার ইচ্ছা করে বসে আছেন। কোন কাজে ভালো করলে, আপনার কথা ঠিকমতো মান্য করলে, সুন্দর করে বাড়ীর কাজ করে দিলে কিংবা ভালো কোন আচরণ করলে কোন দিন বাহবা দিয়েছেন? পিঠ চাপড়ে বলেছেন, বেঁচে থাকো! বেঁচে থাকো!! অনেক বড় হও...। তুমিতো অনেক ভালো করেছো। মা’শাআল্লাহ, মা’শাআল্লাহ। আমি বলেছিলামনা, তুমি পারবে? দেখেছো, আমার কথা ঠিক হয়েছে? কোনদিন কি দু’একটা চকোলেট বা সুইঙ্গাম কিনে খাইয়েছেন? আরে একটা চকোলেট খুব নগন্য একটা উপহার হতে পারে। কিন্তু আপনি শিক্ষক হিসেবে ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য এটা অনেক কিছু! তাও আবার চকোলেট দিচ্ছেন পুরুস্কার হিসেবে। ###কখনো আত্মবিশ্বাস যুগিয়েছেন? বলেছেন, এটাতো খুবই সহজ কাজ। তুমি চেষ্টা করলেই পারবে! যারা পারে তারাতো তোমার মতোই একজন। তারা চেষ্টা করে তাই পারে। তুমিও চেষ্টা করো; পারবে। সফলতার স্বপ্ন তাকে কোনদিন দেখিয়েছেন? যারা সফল হয়েছে তাদের গল্পগাঁথা কখনো শুনিয়েছেন?

জনমভর ছাত্রের দোষই গেয়ে গেলেন। কোন দিন তার প্রশংসা করেছেন? মা’শাআল্লাহ তোমার এই দিকটা ভালো, এই দিকটা ভালো। তোমার এই কাজটা আমার ভীষণ পছন্দ। তবে এই কাজটা এইভাবে না করে এইভাবে করলে আরো ভালো হতো! দেখুন, আপনি কিন্তু দু’ একটা গুণের কথা বলার পর দোষের কথাও বলে ফেল্লেন। কিন্তু সেটা ছিলো গুণের ছদ্মাবরণে। এইভাবে মাঝেমধ্যে একটু আধটু প্রশংসা করুন। দেখুন আপনার ছাত্র-ছাত্রী কতোটা উৎসাহ পায়। কতো দ্রুত খারাপ অভ্যাসগুলো ত্যাগ করে। পরবর্তী সময়ে দেখবেন সে আপনার সামনে এই আচরণগুলো করতে লজ্জাবোধ করবে। যদি এই বদ অভ্যাস পরিহার করতো নিছ্ক বেতের ভয়ে; তবে সেটা হতো সাময়ীক সময়ের জন্য।

ছাত্র-ছাত্রী কথায় কথায় মিথ্যা বলে? কঠিন ও জটিল সমস্যা। মারাত্মক বদ অভ্যাসও বটে। এই বদ অভ্যাস দুর করতে চান? কিছুদিন এমন সব পথ এড়িয়ে চলুন; যে পথে গেলে মিথ্যা বলার সম্ভাবনা থাকে। আপনি জানেন সে এই অন্যায় কাজ করেছে। জিজ্ঞেস করলে অস্বীকার করবে। আপাততো জিজ্ঞেস করার দরকার নেই। কথার প্রসঙ্গে, ভাব ভঙ্গিতে অথবা ইশারা ইঙ্গিতে বুঝাতে চেষ্টা করুন আপনি ব্যাপারটা জেনেগেছেন। ভাবটা এমন দেখান যদিও এখনও কিছু বলছেননা; যেকোন সময় বলতে পারেন। তবে সাবধান এরুপ বুঝানোর পর কিন্তু ভুলেও জিজ্ঞেস করে বসবেননা। তাতে সে পরিকল্পিতভাবে মিথ্যা বলবে। আর যদি চুপ থাকেন, কিছু না বলেন; তখন সে বুঝবে যা কিছু করি শিক্ষকতো জেনে যাচ্ছে। কোনদিন না জানি একসাথে ধরে বসে! এই ভয় সব সময় তার ভেতর কাজ করবে। মিথ্যা বলা মহাপাপ। মিথ্যা সকল পাপের উৎস। কথাগুলো তাকে বলুন। মিথ্যার ভয়াবহ খারাপ দিকগুলো তুলে ধরে মিথ্যা পরিহার করার ব্যাপারে নছীহত করুন। সর্বোচ্ছ দুই কি একবার একটা প্রক্রিয়া অবলম্বন করে দেখতে পারেন। বড় কোন অপরাধের কথা জিজ্ঞেস করুন। যদি মিথ্যা বলে তবে অপরাধের কথা তাৎক্ষণিক ভূলে যান। আর মিথ্যার জন্য শায়েস্তা করুন। তাতে সে বুঝবে মিথ্যা অপরাধের চেয়েও বড় অপরাধ। তবে সাবধান! Keep yourself under control. আমার কথা ধরে বাড়াবাড়ী করলে কিন্তু আমার আত্মা কষ্ট পাবে।

একটু ভেবে দেখুন, এই অতীব গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো কখনো করেছেন কিনা? যদি না করে থাকেন তবে আমি বলছি। আপনি চাইলে লিখে রাখতে পারেন। আপনি তাকে শিক্ষা দিচ্ছেন অশিক্ষা। সে গোঁড়া হচ্ছে। হচ্ছে ত্যাড়া, বোকা, অমনোযোগী, দুষ্টু প্রকৃতির ও দুঃচরিত্রের অধিকারী। এবার সাহস থাকলে আমাকে আবার বলুন, “আমার ছাত্র-ছাত্রী এমন. এমন.. এমন...। কোন কথা শুনেনা। সেজন্যই মারি”। আমি বলবো তাকেতো এমন. এমন.. এমন... করেছেন আপনি। দোষতো তাদের না। দোষ আপনার। শাস্তিতো আপনার হওয়া উচিৎ।

আপনার ছাত্র-ছাত্রী ভালো ও আদর্শবান হোক তা চান। কখনো তার জন্য অন্তর থেকে দোয়া করেছেন? আন্তরীকভাবে তার ভালো কামনা করেছেন? তার কোন দুঃখে আপনার মন কেঁদেছে কি? অথবা তার কোন আনন্দের সংবাদে আপনি আত্মহারা হয়েছেন কোন দিন? আসলে দোয়া কেবল হাত তুলে করলেই করা হয়না। দোয়া আসে অন্তর থেকে। আন্তরীকতা থেকে। ভালোবাসা থেকে। এতোক্ষণে যেই ব্যাপারটা বেরিয়ে এলো সে হলো ছাত্র-ছাত্রীদের প্রতি আপনার ভালোবাসা থাকতে হবে অঘাধ। ছাত্র-ছাত্রীদেরকে দেখতে হবে নিজের ছোট ভাই-বোনের মতো করে। কিংবা নিজ সন্তানের মতো। সব কথার মূল কথা হলো ভালোবাসা। তা যদি না থাকে তাহলে আমার এই লেখাকে উলু বনে মুক্তা ছড়ানোর মতো মনেকরতে পারেন।

এবার আসেন শিক্ষকহিসেবে ইচ্ছতর ডিগ্রিতে যাই। ছাত্র-ছাত্রীকে আপনার মতোই একজন সুন্দর মনের মানুষ হিসেবে দেখতে চান? সহজ সমাধান! একজন সংস্কৃতমনা মানুষ হিসেবে গড়েতুলুন। মানে অর্থসহ কোরান পাঠ। ইসলামি গান, কবিতা ও সাধারণ গান শুনা ও পাঠ করা। গল্প, উপন্যাস ও দর্শন ইত্যাদি সাহিত্যিক বই পাঠ। বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেয়া। ফেইসবুক ব্যবহার করা। চলচ্ছিত্র, শর্টফিল্ম, নাটক, ও ডকুমেন্টারি ইত্যাদি দেখা। বিভিন্ন রকম প্রতিযোগীতা ও সংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে যোগদান। বক্তৃতা, বিতর্ক, শুদ্ধভাষা ও অঙ্কন শিখা ও চর্চা করা। এ ছাড়াও সংস্কৃতিক অঙ্গনে যতো রকম আয়োজন এসবের সাথে সম্পৃক্ত করে দিন। দিনে দিনে তার মানসিকতায় পরিবর্তন আসবে। সে ভাবুক ও চিন্তাশীল হবে। সকল কাজে মানসিক ভারসাম্য তৈরী হবে। নিজকে ও অপরকে মূল্যায়ন করতে শিখবে। চালাক, বুদ্ধিমান ও মেধাবী হবে। উদার মনের অধিকারী ও মিশুক প্রকৃতির হবে। মেধার বিকাশ ঘটবে। সচেতনতা সৃষ্টি হবে। নতুন নতুন প্রতিভা তৈরী হবে। মনেরাখবেন, এটা পরীক্ষিত সত্য যে, সংস্কৃতি মানুষের মনকে উদার করে। এ ছাড়াও সংস্কৃতি মানুষকে এমন কিছু দেয় যা অন্য কেউ দিতে পারেনা। এ পর্যায়ে বিজ্ঞানের একটা সূত্র উল্লেখ করছি। “Every action has reaction”। যার অর্থ হলো, প্রতিটি ক্রিয়ারই প্রতিক্রিয়া আছে। ঠিক তেমনি সংস্কৃতির যেমন কতগুলো ভালো দিক আছে খারাপ দিকও আছে ভুরেভুরে। একটুখানি অসচেতনতার দরুন মারাত্মক দূর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে। সংস্কৃতিক অঙ্গনে গিয়ে কেউ হয় সোনার মানুষ আর কেউ চরম খারাপ। ঔষধের ক্ষেত্রে এন্টিবায়োটিক যেমন। এবার আসুন, ভালো খারাপ দু’টো দিকই যেহেতু আছে। আমাদের সেদিকে যাওয়া উচিৎ হবে কিনা? আমি জিজ্ঞেস করি আপনি বিদ্যুৎ ব্যবহার করেন? শক খেয়েছেন কোনদিন? খেয়েছেন বুঝি! বিদ্যুতের শক খেয়ে মানুষ মরেযায় জানেন? তাহলে কেন ব্যবহার করেন? -উপকার পেয়েছেন তাই ব্যবহার করেন। আর সারাক্ষণ সতর্ক থাকেন। আমি কি ঠিক বলেছি? ব্যাপারটা ঠিক এরকম আরকি! এবার আসুন এই অঙ্গনে না গেলে ক্ষতি আছে? -অবশ্যই ক্ষতি আছে। একটা উদাহরণ দেই; সহজে বুঝবেন। বাঁধা গরু ছাড়া পেলে কী করে দেখেছেন কোনদিন? অভিজ্ঞতা আছে নাকি? -সব ধ্বংস করে দেয়। এককথায় বেপরোয়া হয়ে যায়। আরেকটা উদাহরণ দেই। আমার জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে বলছি। আমার অনেক কওমী মাদরাসায় পড়ুয়া বন্ধুকে দেখেছি। সারাদিন থাকে চার দেয়ালের ভেতর ধর্মীয় পরিবেশে। বাহির জগতের আবহাওয়া যাদের গায়ে লাগেনা। ভূলক্রমে একদিন যদি আমাদের মতো ভালো-খারাপের মিশ্রিত কোন পরিবেশে আসে; আমরা সারা জীবনে যা করিনি তারা একদিনেই তা করে দেখায়। এর একমাত্র কারণ, বাহির জগৎ থেকে তার বিচ্ছিন্ন জীবন। এসবের সাথে সে যদি আগ থেকেই পরিচিত থাকতো, তাহলে হয়তো এতটুকু বেপরোয়া হতোনা। একটা অভিজ্ঞতার কথা বলছি। আমার খুব কাছ থেকে পাওয়া অভিজ্ঞতা। প্রথম দেখায় একটা মেয়ে আমাকে পছন্দ করে। আমার সাথে ছিলো যে ছেলেটা; কওমী মাদরাসার ছাত্র। পরণে পাঞ্জাবী, পাজামা আর টুপি। তার নাকি মেয়েটাকে ভীষণ পছন্দ হয়েছে। সম্পর্ক গড়তে চায়। আমার সহযোগীতা প্রয়োজন। মেয়েটা যদিও আমার বেলায় সিরিয়াস আমি কিন্তু তার বেলায় ততটুকু সিরিয়াস নই। সুতরাং বন্ধুটিকে সাহায্য করতে আমার কোন বাধা নেই। কিন্তু সমস্যাটা বাধলো অন্যখানে। মেয়েটা হুজুর পছন্দ করেনা। ছেলেটা আমাকে নিশ্চিত করলো; প্রয়োজনে সে জামা-টুপি, দাঁড়ি ছেড়ে দিয়ে পেন্ট-শার্ট ধরবে। যা আমি পারিনি ১০বছরে সে নাকি তা পারবে মাত্র ১ঘন্টার আলো-বাতাসে। উল্লেখ্য, বিশেষ এক কারণে সেদিন আমি প্যান্ট আর গেঞ্জি পরে বেরিয়েছিলাম। রুমমেটের কাছ থেকে ধার করে। আর মেয়েটা মূলত আমার পোশাক নয় কথা দিয়েই প্রভাবিত হয়েছিলো। যে কথা বলছিলাম- আপনার ছাত্র-ছাত্রীকে ভালো খারাপ দু’টোরই সুযোগ দিতে হবে। যেহেতু সে মানুষ; খারাপ পথে তা প্রবৃত্তি যাবে এটাই স্বাভাবিক। প্রথমে যেতে দিন। তারপর এ পথের খারাপিগুলো তাকে দৃষ্টান্তসহ চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিন, প্রমাণ দিয়ে বুঝাতে চেষ্টা করুন। এর ভয়াবহতা বর্ণনা করুন। ভালো দিকগুলোকে তার সামনে আরো ভালো হিসেবে ফুটিয়ে তুলুন। তবে মনেরাখবেন, কোন কাজেই হুট করে খুব বেশি সিরিয়াস হয়েযাবেননা কিন্তু! তাহলে বিপদ হতে পারে। আমার প্রধান থিমটা মনেআছে? সব কাজেই কিন্তু ভালোবাসা লাগবে।

ছাত্র-ছাত্রীর সাথে খুব মিশুন। গল্প করুন। গল্প শুনান; শুনুন। সম্ভব হলে তাদের সাথে খেলাধুলা করুন। একটু আধটু দুষ্টুমিও করতে পারেন। কোন কাজ করার আগে পরামর্শ চাইতে পারেন তাদের কাছে। যদিও তাদের পরামর্শে আপনি কাজ করবেননা তবুওতো তারা বুঝবে আপনি তাদের খুব কাছের কেউ। বন্ধুর সাথে মিশেও এতো মজা পাবেননা; ছোটদের সাথে মিশে যতোটা পাবেন। বিশ্বাস না হয় তো পরীক্ষা করেই দেখুন। যে ব্যাপারটা আপনি সবচেয়ে বেশি উপলব্ধি করবেন তাহলো, ছোটদের মাঝে আপনি নিজের ছেলেবেলাকে খুঁজে পাবেন। ছোটদের মধ্যে আপনি আবিস্কার করবেন আপনার বাল্যকালের অস্তিত্বকে। ###যতদুর সম্ভব আর মানায় অভিভাবকের ভূমিকা পালন করুন। এই ধরুন, ঠিকমতো পড়ে কিনা খোঁজ নিন। পছন্দ, লক্ষ্য নির্ধারণ, ভর্তি, চলফেরাসহ প্রাথমিক সবক্ষেত্রে খোজ নিতে পারেন। পরামর্শ দিতে পারেন। ###তাদের জন্য স্মরণীয় কিছু করুন। তাদের নিয়ে কোথাও বেড়াতে যেতে পারেন। ফটো সেশনে সবার সাথে অংশ নিতে পারেন। পিকনিকের আয়োজন বা গল্পের আসর জমাতে পারেন। এর ফলে আপনি কোনদিন হারিয়ে যেতে পারেন পৃথিবী থেকে। কিন্তু তাদের মন থেকে হারাবেননা। নিশীদিন তারা আপনার জন্য কেঁদেযাবে। সারা জীবন তারা আপনাকে মনেরাখবে। আপনি হয়তো ভূলে যাবেন। তারা ভূলবেনা। কারণ আপনি তাদের বাল্যকালের স্মৃতির সাথে মিশে আছেন। আপনিকি পেরেছেন বাল্যকালকে ভূলেযেতে? সারা জীবন তারা আপনার ডোল বাজিয়ে বেড়াবে। আপনার গুণগান গাইবে। আপনাকে মানুষের কাছে পরিচিত করে তুলবে। আর দোয়া! সেতো মন থেকে স্বয়ংক্রিয়ভাবেই চলে আসবে।

এবার আসি আমার বাস্তব জীবনে। জীবনে অনেক শিক্ষকের কাছে পড়েছি। অনেক শিক্ষককে দেখেছি। সবার মাঝেই কিছু ভালো আর কিছু খারাপ দিক পেয়েছি। কিন্তু এমন কয়েকজন শিক্ষক পেয়েছি; আদর্শ শিক্ষক বলতে আমি যা বুঝি তাই পেয়েছি তাদের মাঝে। এই আদর্শ শিক্ষকের সংখ্যা কিন্তু একদম কম নয়। আমার চোখে দেখা বেশ কয়েকজন আদর্শ শিক্ষকের মধ্য থেকে মাত্র ২জনের কথা উল্লেখ করতে চাই; যাদের আচরণ এই নিবন্ধের সাথে অনেকটা মিলে যাবে। আদর্শ শিক্ষক নির্ণয়ের মাপকাঠি হিসেবে আমি কেবল শাসন পদ্ধতিকেই অগ্রাধিকার দিয়েছি। অর্থাৎ, আমার দৃষ্টিতে যে শিক্ষক ছাত্র-ছাত্রীদের সাথে আচরণে যতো ভালো শিক্ষক হিসেবে তিনি ততোটা আদর্শবান। মাননির্ণয়ের এই প্রক্রিয়ায় পাঠদানকে আমি প্রাধান্য দিইনি। কারণ আমার মতে পাঠদান ও পাঠগ্রহণ হলো কেবলই একটা গতানুগতিক ধারা। বা প্রথা রক্ষা বলা যেতে পারে। শিক্ষা দ্বারা আমি মূলত নৈতিক শিক্ষাটাকেই বুঝি। যে শিক্ষাটা তার চরিত্রের সাথে মিশে যায়। তা ভালো হোক কিংবা খারাপ।
প্রথমতঃ টুমচর মাদ্রাসার শাহেদ হুজুর। তিনি আমার দেখা একজন শিক্ষক; যাকে বেত হাতে নিতে খুব একটা দেখিনি আমি। কিন্তু ছাত্ররা তাকে জম্মের ভয় পায়। শুধু ভয়ই পায়না। ভালোও বাসে তাকে। ছাত্ররা ভয় পায় তার মুখের ভাষাকে। তিনি যে ছাত্রদের শাসন করার জন্য অভদ্র বা অমার্জিত ভাষা ব্যবহার করেন তা কিন্তু নয়। কেবল একটু বুদ্ধির মাইর প্যাচ! শুধু কি তাই! ছাত্ররা তার ভাষায় লজ্জাতো পায়; আরো পায় বিনোদন। হেঁসে ফেলেছেন নিশ্চয়! গাঁজাখুরে গল্পের মতো মনেহচ্ছে তাইনা! একই সাথে কীভাবে লজ্জা ও ভয় পায়! উদাহরণ হিসেবে ধরতে পারেন আপনার গায়ে জ্বর। তাপমাত্রা ১০৩ ডিগ্রি। কিন্তু আপনি শীত অনুভব করছেন। কাঁথা মুড়ি দিয়েছেন ৩টা। অথবা ধরুন, আপনি ভাত এবং পাট শাক ভাজার সঙ্গে একটা কাঁচা মরিচ কামড়ে খাচ্ছেন। ঝালে হাঁফাচ্ছেন। মানে কষ্ট হচ্ছে আপনার! তবুও কেন খাচ্ছেন? জানেননা? -মজা পাচ্ছেন; তাই খাচ্ছেন। এবার আমাকে বলুন, একই সাথে ঠান্ডা ও গরম লাগা কীভাবে সম্ভব? আর কীভাবে সম্ভব একই সাথে কষ্ট ও মজা পাওয়া? উত্তর দিতে হবেনা। বুঝে নিলেই হবে। ঠিক এভাবেই সম্ভব একই কথা দিয়ে কাউকে লজ্জা ও বিনোদন দেয়া। এছাড়াও টুমচর মাদরাসার প্রতিজন শিক্ষক আমার দৃষ্টিতে এক একটা কারণে স্বতন্ত্র। প্রতিজন শিক্ষকের মাঝেই আমি এক একটা স্বকীয় বৈশিষ্ট্য খুজে পেয়েছি। আবার সেই মাদরাসাতেই একজন শিক্ষক আমি পেয়েছি যিনি কিনা আমার দেখায় শ্রেষ্ঠ খারাপ শিক্ষক। উনার নাম চাইলে গ্রিনীচবুকেও উঠতে পারে।
দ্বিতীয়তঃ একজন শিক্ষক যার কাছে আমি স্পোকেন ইংলিশ ক্লাস করেছিলাম। সময় অল্প কিছুদিন মাত্র। তিনি মূলত পেশাগত শিক্ষক ছিলেননা। ছিলেন আমার মতোই একজন অনিয়মীত ছাত্র। পড়তেন IIUC তে। তার ভাষাশৈলী, ছাত্র-ছাত্রীদের সাথে মিশার অভ্যাস, বড়ভায়ের মতো আচরণ সত্যি আমাকে মুগ্ধ করতো। একদিন তাকে বলেই ফেলেছিলাম তার প্রতি আমার দূর্বলতার কথা। “শিক্ষক হিসেবে আমি আপনার মতো হতে চাই। বলেন কীভাবে হতে পারি”। তিনি খুশি হলেন। আর আমাকে বল্লেন, “Good student isn’t a good teacher”। যার অর্থ দাড়ায়- ভালো ছাত্র হলেই ভালো শিক্ষক হওয়া যায়না। তার কথাটা আমার খুব পছন্দ হয়েছে। কথাটি আমি নিজকে দিয়েই বুঝেছি। কারণ যদিও আমি ক্লাসে ভালো ছাত্র না; শিক্ষক হিসেবে ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে আমি বেশ প্রিয়!

এই নিবন্ধের ইতি টানতে চাই আমার শিক্ষক জীবনের মানচিত্র দিয়ে। দু’দিনের এই ছাত্র জীবনে শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা আমার খুবই কম। তবে যতটুকু আছে; সমৃদ্ধ। সর্বশেষ শিক্ষকতা করেছিলাম গত বছরের এপ্রিলের ১৬ তারিখ থেকে ১৫ অক্টোবর ২০১৩ইং পর্যন্ত। মাত্র ৬ মাস। যদিও সময় অল্প; তবুও আমি গড়েছি আমার জীবনের স্মরনীয় একটা অধ্যায়। শুধু আমার জীবনের নয়; অনেকগুলো জীবনের সাথেই আমি মিশেগেছি চিরদিনের জন্য। আমি তাদের সাথে খুব মিশতাম। প্রায় সময় তাদেরকে গান ও কবিতা শুনাতাম। তারাও আমাকে শুনাতো। আমি তাদের সাথে গল্প করতাম। তারাও করতো। ঐ প্রতিষ্ঠানে একই সময়ে আরো ২জন শিক্ষক ছিলেন বটে। কিন্তু ছাত্র-ছাত্রীরা সব সময়ই আমার ছিলো। মানে আমাকেই সবচে কাছের জানতো। আমার কাছেই আসতো। আমাকে পেলে তারা ভূলেযেতো আজ ছুটির দিন। তাদের কাছে আমি ছিলাম ছুটির চেয়েও প্রিয়। তাদের সবার বয়স গড়ে ৬-১২বছর। যাদেরকে বলে শিশু। শিশুদের কাছে ছুটির চেয়েও প্রিয় হওয়া, চারটিখানি কথা নয় কিন্তু! একদিনের কথা। ক্লাসের ভেতর মেয়ে একটাকে দেখলাম গুনগুনিয়ে কি যেন গাচ্ছে। একটু আধটু শরীরও নাড়ছে। তখন আমি আমার ক্লাসে লেকচার! দিচ্ছিলাম। এ অবস্থা দেখে চট করে যে কারো মাথা গরম হয়েযেতে পারতো। আমার মাথা কিন্তু গরম হয়নি। বরং তাকে সামনে ডাকলাম। জিজ্ঞেস করলাম, তুমি নাচতে জান নাকি? সে চুপ থাকলো। বল্লাম নেচে দেখাওতো! সে নাচতে শুরু করলো। আপনি আশ্চর্য হয়েছেন কিনা জানিনা। তবে আমি হয়েছিলাম। কারণ, এটুকুন একটা মেয়ে এতো সহজে ভয়কে জয় করে শিক্ষকের সামনে নাচতে পারলো! তাও আবার মাদরাসার শিক্ষক। সেদিন আমি আশ্বস্ত হলাম, আমি তাদের খুব কাছে যেতে পেরেছি। আজ আমি তাদেরকে পড়াইনা। আমি অনেক দুরে আছি। যদিও আজ আমার অস্তিত্ব অনেক দুরে; আমি তাদের মনোজগতে সদা বিরাজমান এক প্রাণ। তারা আজো আমাকে ফোন করে। খোজ খবর নেয়। এলাকায় গেলে ছুটে আসে আমাকে দেখতে। আর ঐ যে বলেছিলাম সিয়াম আর মিদুলের কথা। তারাও কিন্তু এর ব্যতিক্রম নয়। আমার বিশ্বাস; আমার যারা ছাত্র-ছাত্রী যদি কখনো তাদের কাউকে রচনা লিখতে দেয়া হয় ‘প্রিয় শিক্ষক’ অথবা যদি তাদেরকে কোন অনুষ্ঠানে প্রিয় শিক্ষকের স্মৃতিচারণ করতে দেয়া হয় তবে অবশ্যই আমার নামটা সেখানে ফুটে উঠবে। সর্বশেষ আমার সংগৃহিত একটি জীবনশিক্ষার চাট দিয়েই নিবন্ধটি শেষ করতে চাই। তাহলো,

..................................
শিশুরা জীবন থেকে যা শিখে
::::::::::::::::::::::::::::::::::
০১। সমালোচনার মাঝে শিশু বেঁচে থাকলে সে কেবল নিন্দা করতে শিখে।
০২। শত্রুতার মাঝে শিশু বেঁচে থাকলে সে কেবল হানাহানি করতে শিখে।
০৩। বিদ্রুপের মাঝে শিশু বেঁচে থাকলে সে কেবল লাজুক হতে শিখে।
০৪। কলংকের মাঝে শিশু বেঁচে থাকলে সে কেবল অপরাধবোধ শিখে।
০৫। ধৈর্যের মাঝে শিশু বেঁচে থাকলে সে সহিষ্ণুতা শিখে।
০৬। উদ্দীপনার মাঝে শিশু বেঁচে থাকলে সে আত্মবিশ্বাসী হতে শিখে।
০৭। প্রশংসার মাঝে শিশু বেঁচে থাকলে সে মূল্যায়ন করতে শিখে।
০৮। নিরপেক্ষতার মাঝে শিশু বেঁচে থাকলে সে ন্যায়পরায়ণতা শিখে।
০৯। অনুমোদনের মাঝে শিশু বেঁচে থাকলে সে নিজকে ভালোবাসতে শিখে।
১০। স্বীকৃতি আর বন্ধুদের মাঝে শিশু বেঁচে থাকলে সে পৃথিবীতে ভালোবাসা খুঁজেপেতে শিখে।
৩টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

জীবন চলবেই ... কারো জন্য থেমে থাকবে না

লিখেছেন অপু তানভীর, ০২ রা মে, ২০২৪ সকাল ১০:০৪



নাইমদের বাসার ঠিক সামনেই ছিল দোকানটা । দোকানের মাথার উপরে একটা সাইনবোর্ডে লেখা থাকতও ওয়ান টু নাইন্টি নাইন সপ ! তবে মূলত সেটা ছিল একটা ডিপার্টমেন্টাল স্টোর। প্রায়ই... ...বাকিটুকু পড়ুন

যুক্তরাষ্ট্রে বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিলিস্তিনের পক্ষে বিক্ষোভ ঠেকাতে পুলিশি নির্মমতা

লিখেছেন এমজেডএফ, ০২ রা মে, ২০২৪ দুপুর ১:১১



সমগ্র যুক্তরাষ্ট্র জুড়ে ফিলিস্তিনের পক্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসগুলোতে বিক্ষোভের ঝড় বইছে। যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিলিস্তিনের পক্ষে বিক্ষোভ কর্মসূচী অব্যাহত রয়েছে। একাধিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বিক্ষোভ দমনের প্রচেষ্টা চালালেও তেমন সফল... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছাঁদ কুঠরির কাব্যঃ ০১

লিখেছেন রানার ব্লগ, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ৯:৫৫



নতুন নতুন শহরে এলে মনে হয় প্রতি টি ছেলেরি এক টা প্রেম করতে ইচ্ছে হয় । এর পেছনের কারন যা আমার মনে হয় তা হলো, বাড়িতে মা, বোনের আদরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

হিটস্ট্রোক - লক্ষণ ও তাৎক্ষণিক করণীয়

লিখেছেন ঢাকার লোক, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:০৭

সাধারণত গরমে পরিশ্রম করার ফলে হিটস্ট্রোক হতে পারে। এতে দেহের তাপমাত্রা অতি দ্রুত বেড়ে ১০৪ ডিগ্রী ফারেনহাইট বা তারও বেশি হয়ে যেতে পারে।

হিটস্ট্রোক জরুরি চিকিৎসা প্রয়োজন। চিকিৎসা... ...বাকিটুকু পড়ুন

আল্লাহকে অবিশ্বাস করার সংগত কোন কারণ নাই

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:৪৩



সব কিছু এমনি এমনি হতে পারলে আল্লাহ এমনি এমনি হতে সমস্যা নাই। বীগ ব্যাং এ সব কিছু হতে পারলে আল্লাহও হতে পারেন। সব কিছুর প্রথম ঈশ্বর কণা হতে পারলে আল্লাহও... ...বাকিটুকু পড়ুন

×