somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

প দা তি ক

০৬ ই আগস্ট, ২০১৬ সকাল ১১:০৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


লিংক--পদাতিক/১০


১১
কল্পনাথ চলে যেতেই সুবোধ একটু মুচকি হেসে নিজের অবস্থানে চলে গেল আবার। এসব এলাকার আবার নিজস্ব আইন থাকে। সুবোধ ঐ আইনটাকে রক্ষা করে, প্রয়োগ করে। প্রয়োজনে শাস্তিও দেয়। আলো অন্ধকারের এমন একটা আড়াল সুবোধ এই সন্ধ্যা এবং রাত্রির জন্য বেছে নেয়। বেছে নেয় তার মূল কারণ ঊর্মিলা, ঊর্মিলার নিরাপত্তা, কিংবা যে কোনো মাতলামির মাত্রা বা অচেনা কোন গতিবিধি,--সবই যেন সে লক্ষ্য করতে পারে। এ-ছাড়া যেটা এই অবস্থানের পক্ষে সবচেয়ে জরুরী, তা হলো পুলিশ।

ঊর্মিলার বিক্রি এখন শেষের দিকে। সন্ধ্যে নামার পর থেকেই তার এই রোজকার তৎপরতা। কেন্দ্রবিন্দু সেই ঊর্মিলা। দূর থেকে ঊর্মিলাকে লক্ষ্য করার মধ্য দিয়ে প্রায়ঃশই সুবোধের ভেতর অদ্ভুত এক জাগরণ ঘটে। তখন আর ঊর্মিলার দিকে সে খুব বেশি তাকিয়ে থাকতে পারে না। নিজের কাছে ব্যাখ্যাতীত এক জীবনের পালা সূচিত হয়ে পড়ে। অথচ এই জীবনতো সে চিনতো না কোনোদিন। না-চেনা রাত্রির এই বাস্তবতা আজ কেমন করে তার কাছে অমোঘ হয়ে উঠলো! এহেন বাস্তবতা সে উপেক্ষা করবে কী ভাবে—জানে না।

দমবদ্ধ ভাবটা বোধহয় এই জন্যই উদয় হয় মাঝে মাঝে। তার মধ্যেই কখনো হঠাৎ একটা নদী, একটা মানুষ,একটা জনপদ তাকে ঘিরে ফেলে। প্রশ্ন করে—
--কী নাম ছিল তোমার?
--সুবোধ মুস্তাফি
--বাবার নাম?
--করুণানিধান মুস্তাফি।
--ঠিকানা?
--গ্রামঃ অতিথপুর। জেলাঃ ময়মনসিংহ।
--ভৌগলিক অবস্থান?
--কংস নামের এক নদ ঘেরা জনপদ। নাবাল জমির ভেজা মাটির গন্ধ—যেখান থেকে উত্তরে তাকালে গারো পাহাড় চোখে পড়ে। তার উত্তরে কী আছে—ছোট বেলায় কাউকে এই প্রশ্ন করলে রহস্য করে বলা হতো ‘তর মামার বাড়ি’। একসময় মনে হতো শীত গ্রীষ্ম বর্ষায় খিদের মোচড়ে নুয়ে থাকা এই জীবনের ঘেরাবন্দির বাইরে বোধ হয় আর যাওয়া হবে না। কিন্তু আমার যে খুব যেতে ইচ্ছে করতো!
--শিক্ষা?
--বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষ।
--দেশত্যাগের কারণ?
--রাষ্ট্রশক্তির অপছন্দ। অপছন্দের তালিকায় যে রাজনীতি থাকে তার সঙ্গে কার্য-কারণে যুক্ত হওয়া। পুলিশের চোখে পড়া। একে নামে হিন্দু তায় আবার বামপন্থী! নিশ্চই হিন্দুস্থানের দালাল। পেছনে লাগানো যায় দু’তিনটে মার্ডার কেস। তারপর একটু চাপ। ব্যাস্‌, সীমানা পার। আপদ বিদায়। রয়ে গেল সম্পত্তি। কাফের ছেঁটে ফেলার এই এক জলচল রাস্তা। বেশ লাভ।

সুবোধ জানে এরপর তার বাবাকে নিয়ে চলবে টানা হ্যাঁচড়া। স্কুল মাষ্টারী টিকবে কিনা কে জানে! যদিও বাবা অভিজ্ঞ। তবু এখন তার বয়স হয়েছে। এক সময়কার মুক্তিযুদ্ধের কর্মীর সামাজিক পরিচিতির শেকড়টা মাটির একটু বেশি গভীরে প্রোথিত। তবু রাষ্ট্রের গোপন এজেন্ডা বাস্তবায়নের হাত তাকে রেহাই দেবে কিনা কে জানে! সারাজীবন এক শিক্ষামুখী মানুষ হিসেবেই কাটিয়েছেন জীবন। লোভনীয় সহায় সম্পত্তি বলে কিছু নেই। বরং এখনও তাঁর জীবনে মানুষ এবং মানুষ নির্ভর এক উজ্জ্বল সারবত্তা জেগে আছে। ফলে এ-যাবৎ কায়েমী শক্তিকে তার কাছ থেকে কিছুটা ব্যর্থতা নিয়েই ফিরে যেতে হয়েছে। কিন্তু ক্রমাগত গাছটার শাখা প্রশাখা ছাঁটতে থাকলে গাছটার মৃত্যু ত্বরাণ্বিত হবে বৈ কি।
১২
মানুষ তার প্রত্নসুত্র সঙ্গে নিয়েই ঘোরে। যেন বা এই বিশ্বাসে সাদা পোশাকে কল্যান সেন নিয়ম মাফিক এই অঞ্চলে আসে । সঙ্গে কেউ না কেউ থাকে। এখানে এসে একটু দাঁড়ানো, এক আধটা সিগারেট খাওয়া বা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই কোনোদিন এক কাপ চা খাওয়া এবং চলে যাওয়া—এই তার রুটিন। ইদানীং দেবেনের হোটেলটার প্রতি তার নজর।হোটেলতো দিনের বেলায়। সন্ধ্যা নামতেই সেটা মদের দোকান। আজকাল তার ভেতর একটা দলকে দেখা যায়। তারা মদ খেতেই আসে। তবে শুধু মদ খাওয়া নয়, সঙ্গে চলে তুমুল আড্ডা, তর্ক বিতর্ক। তবে একটা অদৃষ্ট নিয়ন্ত্রণ আছে যেন। সাধারণ মাতলামী তারা করে না। এ অঞ্চলের সাধারণ খদ্দেরদের সঙ্গে এদের কথাবার্তা নেই তেমন। ভাষা বা চেহারাতেও অমিল বেশ। এরা ঊর্মিলার কাছে ভিড় করে না। সামান্য খোঁজ খবরে জানা গেছে যে এরা কেউ কেউ লেখক কবি নাট্যকার—ইত্যাদি। কিন্তু এরা এখানে কেন?—কল্যান সেন মেলাতে পারেন না। বে-আইনী মদের দোকানের সুত্রে এদের একদিন তুলবে কিনা সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না । সুবোধের কাছ থেকে একদিন এদের নামগুলো জেনে নিয়েছেন। সার্চ করে এদের সঙ্গে কোনো রাজনৈতিক ঘটনা দুর্ঘটনার সুত্র তেমন মিলছে না। সোর্স লাগিয়ে সংগ্রহ করা এদের লেখাপত্র কিছু পড়ে দেখার চেষ্টা করেছে।কিন্তু অর্থহীন দুর্বোধ্যতা ছাড়া আর কিছু পাওয়া যায় নি। তাতে অবশ্য এদের সম্পর্কে কৌতুহল কমেনি বরং বেড়ে গেছে।
যদিও এ-বিষয়ে বাহাত্তর সনের অভিজ্ঞতা তার রয়েছে। তখন নতুন চাকরি। বহুবার লেখক কবিদের মুখোমুখি হতে হয়েছে তখন। কিন্তু কিছুটা খোঁচাখুঁচির পর বেরিয়ে পড়তো সেই রাজনীতি। তখন আর সাহিত্য নিয়ে মাথা ঘামানোর দরকার হতো না। রাজনীতির সুত্রেই হাড় মাংস আলাদা করা যেতো।
সুবোধের হাতে একদিন কুড়ি টাকার একটা নোট গুঁজে দিলেন কল্যান সেন। বললেন ওখানে কী কথাবার্তা হয় শুনতে হবে। শুধু দেখলে হবে না।পারলে পাশে বসে কথাবার্তায় যোগ দিতে হবে। মনে রাখতে হবে মার্কস, লেনিন, মাও, ইয়েনান ফোরাম, শ্রেণীশত্রু, শ্রেণী সংগ্রাম—এই জাতের শব্দগুলো কথাবার্তায় আসে কি না। এ-ছাড়াও যদি খুব আন-কমন কোনো কথা কানে লাগে তো ওটাও ক্যাচ করতে হবে।–কী পারবি না?
সুবোধ চোখে চোখ রাখে না কল্যান সেনের। মাটির দিকে তাকিয়ে শোনে সব কথা, মাঝে মাঝে একটা আশংকা তার ভেতরে মোচড় দ্যায় শুধু।মনে মনে ভাবে পান দোকানের সুবল ঐ দিন উপকার করতে গিয়ে এই স্যারের কাছে তাকে ভিড়িয়ে না দিলেই পারতো।
প্রায় বিনা ভূমিকায় এমনই একদিন রাতের দিকে সে যখন সুবলের দোকানের পাশে দাঁড়িয়ে সুবলের সঙ্গেই গল্প করছিল তখন কল্যান সেন এলেন সিগারেট নিতে। সুবলের পান দোকান আর দেবেনের হোটেল রাস্তার এপার ওপার—প্রায় মুখোমুখি। কল্যান সেনের তাই এখানকার সিগারেটই বেশি পছন্দ। সেদিন সুবোধের উপকারের উদ্দেশ্যে সে কল্যান সেন’এর কাছে একটা আর্জি জানায়।
--স্যার, দিন না আমার এই শালাবাবুকে একটা কাজে লাগিয়ে। ছেলে ভাল স্যার। পড়াশোনাও জানে একটু আধটু।
কথা শুনে উত্তর দেয়ার আগেই সুবোধের আপাদমস্তক পুলিশি চোখে জরিপ করে নিলেন। তারপর বললেন—
--কোথায় থাকে?
--এখানেই স্যার। ঊর্মিলার ভাই। ওর কাছেই থাকে।
--হু, দেখি।
ব্যাস্‌, এইটুকুই। তারপর থেকেই আলাপ। কিন্তু যেহেতু পুলিশ, কল্যান সেন’এর মুখোমুখি হলে সুবোধ এখনও কেমন জড়সড় হয়ে থাকে।
--কী, মনে থাকবে-তো?
--আজ্ঞে হ্যাঁ স্যার।
--এক সপ্তাহ পর রিপোর্ট নেব।
বলেই কল্যান সেন চলে গেলেন। সাধারণত বেশিক্ষণ দাঁড়ান না। খুব বেশি হলে পাঁচ সাত মিনিট। আজ তাই সুবোধ লক্ষ্য করলো। লক্ষ্য করলো তার ভরাট গলার আওয়াজ। চমৎকার স্বাস্থ্য। হাফ শার্ট পরা। কোমড়ে নিশ্চিত পিস্তল আছে। সঙ্গে ছায়ার মত দু একজন থাকে। তবে বেশ তফাতে। উনি চলে গেলে ছায়ারাও মিলিয়ে যায়।

সুবোধ তারপরও অনেকক্ষণ এদিক ওদিক দাঁড়িয়ে শুধু এই লোকটার কথা ভাবে। ঐদিনের ঐটুকু কথা—তারপর থেকেই এখানকার সব খবরাখবরের জন্য লোকটা তাকেই নির্দিষ্ট করে বেছে নিল! জিজ্ঞাসা না করেও নামটা কী করে জেনে নিল! ঊর্মিলার ভাই—তাকে কি সত্যিই পুলিশি চোখে ঊর্মিলার ভাই বলেই মনে হয়? অথচ কোথা থেকে সে এসেছে, এখানে কি সত্যি কাজ খুঁজতে এসেছে, না অন্য কিছু—কোন কিছুতেই যেন তার কৌতুহল নেই। নাকি সবই সে জানে। মনে মনে ভাবে বিষয়টা একদিন ঊর্মিলাকে বলতে হবে। (ক্রমশঃ)
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই আগস্ট, ২০১৬ সকাল ১১:০৩
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

সবুজ চোখের মানুষের ধাঁধা

লিখেছেন করুণাধারা, ৩০ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:২৯



এই ধাঁধার নাম সবুজ চোখের মানুষের ধাঁধা; নিচের লিংকে এটার ভিডিও আছে।

স্বৈরশাসকের বন্দী

এই ধাঁধাটি আমার ভালো লেগেছিল, তাই অনেক আগে আমার একটা পোস্টে এই ধাঁধাটি দিয়েছিলাম। কিন্তু সেই পোস্টে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বৃদ্ধাশ্রম।

লিখেছেন নাহল তরকারি, ৩০ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:১৬



আগে ভিডিওটি দেখে নিন।

মনে করেন, এক দেশে এক মহিলা ছিলো। একটি সন্তান জন্ম দেবার পর তার স্বামী মারা যায়। পরে সেই মহিলা পরের বাসায় কাজ করে সন্তান কে... ...বাকিটুকু পড়ুন

টের পেলে

লিখেছেন সাইফুলসাইফসাই, ৩০ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:৫৭

টের পেলে
সাইফুল ইসলাম সাঈফ

টের পেলে গুটিয়ে যায় লজ্জাবতী/ পরিপূর্ণ যৌবনে যুবতীর নিখুঁত অনুভূতি। আমার চাওয়া, ইচ্ছে, স্বপ্ন! আমার পছন্দ বুঝদার, সুন্দর হৃদয়ের রূপ! সৌন্দর্য সুন্দর যা চিরন্তন সত্য। কিন্তু সেটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইসলামের চার খলিফার ধারাবাহিকতা কে নির্ধারণ করেছেন?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ৩০ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১০:৩৭




সূরাঃ ৩ আলে-ইমরান, ২৬ নং আয়াতের অনুবাদ-
২৬। বল হে সার্বভৈৗম শক্তির (রাজত্বের) মালিক আল্লাহ! তুমি যাকে ইচ্ছা ক্ষমতা (রাজত্ব) প্রদান কর এবং যার থেকে ইচ্ছা ক্ষমতা (রাজত্ব)... ...বাকিটুকু পড়ুন

প্রতিদিন একটি করে গল্প তৈরি হয়-৩৭

লিখেছেন মোঃ মাইদুল সরকার, ০১ লা মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৫১




ছবি-মেয়ে ও পাশের জন আমার ভাই এর ছোট ছেলে। আমার মেয়ে যেখাবে যাবে যা করবে ভাইপোরও তাই করতে হবে।


এখন সবখানে শুধু গাছ নিয়ে আলোচনা। ট্রেনিং আসছি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×