[এই প্রবন্ধটি কোনো ধর্মকে বা ব্যক্তিগতভাবে কাউকে আঘাত করার উদ্দেশ্যে লেখা হয়নি]
স্রষ্টা অস্তিত্বহীন-১
জগৎ ও জীবনের যে কোন সত্য উদঘাটনের শ্রেষ্ঠ পন্থা হল তা নিয়ে গবেষণা, পরীক্ষা-নীরিক্ষা। পার্থিব অন্যান্য সকল বিষয়ের মতোন স্রষ্টা প্রসঙ্গেও কথাটি সমধিক ভাবে প্রযোজ্য। কিন্তু আমাদের চূড়ান্ত বিশ্বাসের স্থান স্রষ্টা-এর ক্ষেত্রে সাময়িক উত্তেজনার বসবর্তী হয়ে বিশ্লেষণ করা সম্ভব বা সমীচিন নয়। এক্ষেত্রে আমাদের দরকার কঠিন-কঠোর যুক্তি-তর্কের মাধ্যমে বিশ্বাস-এর বিশ্লেষণ আর তার জন্যে সর্বাগ্রে প্রয়োজন বিশ্বাসের ধরণ অনুধাবন।
মানুষ তার চিন্তার খোড়াকগুলোকে খুব স্বাভাবিক ভাবেই মতানৈক্য এবং মতের সম্মিলন এ দু'টো ভাগে দাড় করায়। আর এ মতের সম্মিলন থেকেই জন্ম নেয় বিশ্বাস। তবে সবসময়ই যে মতের এ সম্মিলন তৎক্ষনাৎ হয় তা কিন্তু নয়। অনু-পরমানুর বিশ্লষণে মানুষ চায় তার বিশ্বাসকে কষ্ঠি পাথরে যাচাই করতে, পরখ করতে। কিন্তু, এ যাচাই শতভাগ সঠিক না-ও হতে পারে। মানুষ তার ইচ্ছে শক্তির বলে অন্ধ ভাবে বিশ্বাসের অপরাধটা করেই ফেলে। আর এক-ই সাথে জন্ম দেয় এক বিপরীত মুখী প্রবল অবিশ্বাস, যা বস্তুতপক্ষে অযোগ্য মস্তিষ্কের-ই ফল।
বিশ্বাস, তাই, এক পর্যায়ের ভাবাবেগ, যা আর সকল ভাবাবেগের মতোই উত্তেজনার এক বিশেষ স্তরে বর্তমান।
উত্তেজনার স্তর তিনটি-
স্তর ১, যেক্ষেত্রে কাজ করে মস্তিষ্কপ্রসূত জ্ঞান এবং প্রমানের সর্বাধিক গুরুত্ত্ব।
স্তর ২, যেক্ষেত্রে মানুষ নিজস্ব অভিজ্ঞতার উপর ভিত্তি করে সিদ্ধান্ত গ্রহন করে থাকে।
স্তর ৩, এটির অবস্থান সর্বাপেক্ষা নিম্নে। এক্ষেত্রে মানুষ অন্যের অভিজ্ঞতার উপর নির্ভরশীল হয়ে থাকে।
মানব জীবনের সকল বিশ্বাসকে-ই এ তিনটি ভাগের যে কোনো একটি ভাগে বিভক্ত করা সম্ভব। আর এ তিনটি স্তরকে বাস্তবতা ও যুক্তির ঘাত-প্রতিঘাতে বিশ্লেষণ করেই আমাদের উচিৎ স্রষ্টার অস্তিত্ব অথবা অস্তিত্বহীনতায় বিশ্বাস স্থাপন করা।
এক্ষেত্রে প্রথমেই কিন্তু আসে স্রষ্টার অস্তিত্ব প্রমান। যদি স্রষ্টা আমাদের সামনে উপস্থিত হতেন এবং তাঁর অস্তিত্বের প্রমান দিতেন তবে নিঃসন্দেহে স্রষ্টার প্রতি বিশ্বাস হয়ে উঠতো অনস্বীকার্য। কিন্তু, দুঃখ জনক ভাবে এ বিশ্বাসবাদী স্রষ্টা জনসমক্ষে উপস্থিত হতে অপারগ।
দ্বিতীয়ত, এটা সকলেই মানে যে, পৃথিবী এবং মহাজগতের সকল বস্তুরই একটি সূচনা আছে বা তা চলে আসছে চিরকাল থেকে। তারা এ-ও জানে যে যা-ই চিরকালীন নয়, কোনো না কোনো কারণ রয়েছে তার গঠনের পেছনে। এই সরল-স্বাভাবিক সূত্রটাই যদি মহাজাগতিক ক্ষেত্রে প্রয়োগ করি তবে দেখতে পাই যে এটাই চিন্তা করা স্বাভাবিক যে মহাকাল সৃষ্টির আদি হতে চলে আসছে। তবে কেউ যদি সরল-সাধারন যুক্তির ব্যতিরেকে এভাবে চিন্তা করতে ভালবাসে যে, কোনো অসীম এবং অসম্ভবপ্রায় শক্তির দ্বারা এ জগৎ সৃষ্ট তবে আমি সেক্ষেত্রে নিশ্চুপ খাকাই শ্রেয় বোধ করব।
তৃতীয়ত, মানুষের সাথে রয়েছে শুধু তার সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনা লব্ধ জ্ঞান। অর্থাৎ তার অবস্থানপূর্ব বা জন্মের আগে ঘটে যাওয়া কোনো ঘটনা তার জানার কথা নয়। তবে হ্যা, উপযুক্ত সাক্ষ্য-প্রমান সাপেক্ষে কোনো ঘটনা হয়ে উঠতে পারে বিশ্বাসযোগ্য। কিন্তু, দুঃখজনক হলেও সত্যি স্রষ্টার অস্তিত্বের কোনো প্রমান আমাদের সামনে নেই। তাই স্রষ্টা যদি জনসম্মুখে হাজির হয়ে তাঁর প্রমান দিতেন, তবে ,মানুষ হতে পারত স্রষ্টিকর্তাকে অবিশ্বাস করার পাপ হতে মুক্ত। আর সেক্ষেত্রে কেউ-ই নরক যন্ত্রনা ভোগ না করে লাভ করতো আস্তিকের মতো স্বর্গসুখ। তাই স্রষ্টার কি উচিৎ ছিল না যে, গুটি কয়েক মানুষের কাছে দেখা দেওয়ার পক্ষপাতিত্ব না করে নিরপেক্ষভাবে সকলের সামনে উপস্থিত হওয়া?
উপরের যুক্তিজাল কিন্তু স্রষ্টার অস্তিত্ব প্রমানের একমাত্র যে হাতিয়ার দাড় করায় তা হচ্ছে অন্ধভাবে অন্যের কথায় বিশ্বাস করা। স্রষ্টাকে প্রাপ্তির যেহেতু কোনো সরাসরি পথ আমাদের সামনে খোলা নেই, তাই আমার ধারনা যে কোনো উর্ব্বর মস্তিষ্কের মানুষ-ই, শুধু মধ্যবর্তী মিডিয়ার মাধ্যমে নিজেকে প্রমাণ করতে সক্ষম স্রষ্টাকে, স্বীকৃতি দিতে অস্বীকৃতি জানাবেন।
আমরা যদি আরো বিচার বিশ্লষণ করতে যাই তাহলে দেখতে পাব, প্রকৃতপক্ষে, স্রষ্টা হচ্ছে একটি মতবাদ, যা অন্যসকল মতবাদের মতোই প্রমানের দাবি রাখে। স্যার আইজাক নিউটন এ প্রসঙ্গে বলেন, "Hypotheses non fingo, quicquid enim ex phaenomenis non deducitur hypothesis, vocanda est, et hypothesis vel metaphysicae, vel physicae, vel qualitatum occultarum, seu mechanicae, in philosophia locum non habent" (মতবাদ ঈশ্বর প্রদত্ত হতে হবে এমন কোন বাধ্যবাধকতা নেই। যে কোন ব্যক্তি তার যৌক্তিক এবং দার্শনিক শক্তির বলে, এমন কি দূর্ঘটনা ক্রমেও জন্ম দিতে পারে কোন মতবাদের। ঐশরিক ক্ষমতার সাথে মতবাদ-এর সম্পর্ক দূরগম্য।) আমাদের মহান স্রষ্টার সপক্ষের সকল যুক্তিই কিন্তু নিউটনের এ উক্তির মাধ্যমে করা যেতে পারে খণ্ডন।
দেখা যায় যে, প্রকৃতির বিভিন্ন শক্তিতে আমরা বিশ্বস তো করছি, কিন্তু তার প্রভাব সম্পর্কে আমরা স্বল্পমাত্রা-ই ওয়াকিবহাল। হাস্যকর হলেও সত্য আমাদের এ অজ্ঞতাই দেখা যায় আমাদের নিয়ে যায় আস্তিক্যবাদের দ্বারপ্রান্তে। বস্তুত 'স্রষ্টা' নামক মতবাদটির মাধ্যমে আমরা আমাদের অজ্ঞতাগুলোকে ঢেকে রাখার এক ব্যর্থ প্রয়াস চালাই মাত্র, যা শুধু আমাদের কল্পনাকে অতিরঞ্জিত করতেই সাহায্য করে।
[চলবে]
[মূল: The Necessity of Atheism(1811) by P.B.Shelley]