যেভাবে ইসলাম বিকৃত হলো
রাসূল সাঃ অক্লান্ত পরিশ্রম করে সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে অারবের বুকে দীনুল হক বা সত্য জীবনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করলেন । তাঁর হাতে গড়া সীসাঢালা প্রাচীরের ন্যায় ঐক্যবদ্ধ উম্মতে মোহাম্মদী জাতিটির উপর বাকি পৃথিবীতে সত্য জীবনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব দিয়ে গেলেন । পূর্ববর্তী নবী-রাসূলদের অভিজ্ঞতার অালোকে, যাওয়ার অাগে তিনি অনেকবার সেই হাতে গড়া জাতিটিকে বিভিন্নভাবে সতর্কবাণী করে গেছেন, যাতে মর্মান্তিক ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি না হয় । রাসূল সাঃ বলেন, "নিশ্চয় ইসলাম উৎপত্তি লাভ করেছে অদ্ভূতজনক (গরিব, Strange) অবস্থায় এবং তা অচিরেই প্রত্যাবর্তন করবে অদ্ভূতজনক (গরিব, Strange) অবস্থায় । সুতরাং মোবারকবাদ ঐ দিন সেইসব অদ্ভূত মানুষদের (গোরাবা, Strangers) জন্য, যখন যামানা বিনষ্ট হয়ে যাবে। যাঁর হাতে আবূল কাসিমের জীবন! সেই সত্তার শপথ! ইসলাম এই দুই মসজিদের মধ্যবর্তী স্থানে প্রবেশ করবে, সর্প যেমন তার গর্তে প্রবেশ করে থাকে ।" (সা‘দ ইবনে আবী ওয়াক্কাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত, মুসনাদে আহমেদ(ইফা)- অধ্যায়ঃ ২, হাদিস নং ৯৯; মোসলেম) এই হাদিস থেকে স্পষ্টত বুঝা যায়, রাসূল সাঃ সন্দেহ করেছিলেন তাঁর প্রতিষ্ঠিত ইসলামটিতে অচিরেই বিকৃতি ঘটবে । মানুষ প্রকৃত ইসলাম থেকে সরে গিয়ে বিকৃত ইসলাম নিয়ে পড়ে থাকবে । সাপ যেমন প্রশস্ত ভূপৃষ্ঠ তার সরু গর্তে ঢুকে, প্রকৃত প্রশস্ত ইসলাম তেমনি সংকীর্ণ ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ হয়ে যাবে । অাইয়্যামে জাহেলিয়াত যুগে প্রকৃত ইসলামটি যেমন অদ্ভূতজনক (গরিব বা Strange) অবস্থায় উৎপত্তি লাভ করেছিলো অর্থ্যাৎ প্রকৃত ইসলামটির কথা শুনে যেমন সবাই অাশ্চর্য্য হয়ে গিয়েছিলো, তেমনি রাসূল সাঃ এর পরে সেই প্রকৃত ইসলামটির কথা শুনে সবাই অাশ্চর্য্য হয়ে বলবে, এ কোন গরিব কথা বলছো? এ কোন অদ্ভূত ইসলামের কথা বলছো । অর্থ্যাৎ বিকৃত ইসলামের অাড়ালে ঢেকে থাকা প্রকৃত ইসলাম দেখে সবাই অবাক হয়ে যাবে । রাসূল সাঃ এর অারেকটি হাদিসে তিনি বলেছেন, “অামার উম্মতের অায়ু হবে ৬০/৭০ বছর ।" (অাবু হুরায়রা রাঃ থেকে বর্ণিত, অাত তিরমিযীঃ৩৫৫০, ইবনে মাজাহ ৪২৩৬, সিলসিলাত অাস সাহীহ গ্রন্থে অালবানি হাদিসটিকে সহীহ বলেছেন) । অামরা সাধারণ এই হাদিসটিকে অামাদের জীবনায়ুর সাথে তুলনা করি । সত্যিকার্থে হাদিসটিতে তা বুঝানো হয় নি । রাসূল সাঃ যে উম্মতে মোহাম্মদীকে দায়িত্ব দিয়ে গেলেন, তারা রাসূল সাঃ এর ওফাতের মাত্র ৬০/৭০ বছরের মাথায় সহজ সরল ইসলামে ফেরকা-মাজহাবে বিভক্ত করে তারা রাসূল সাঃ এর উম্মত হওয়ার সৌভাগ্য হারালো । হারালো এই কারণে, কোরঅানে অাল্লাহ অনেকবার বলেছেন, সবসময় ঐক্যবদ্ধ থাকতে, ঐক্যহীন না হতে, বিভিন্ন দলে উপদলে বিভক্ত না হতে । সাবধান করে দিয়েছিলেন এই বলে যে, "তোমরা সকলে একত্রিত হয়ে আল্লাহর রজ্জুকে আঁকড়িয়ে ধর, সাবধান! বিচ্ছিন্ন হয়ো না।” (সূরা আল ইমরান-৩, আঃ ১০৩) শুধু তাই নয়, অাল্লাহ সরাসরি বলে দিয়েছেন, "যারা নিজেদের দ্বীনকে খন্ড খন্ড করে বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়েছে তাদের সাথে আপনার (হে রাসূল) কোন সম্পর্ক নেই।” (সূরা আনআম-৬, আঃ-১৫৯) যাদের সাথে রাসূল সাঃ-এর কোনো সম্পর্কই নেই, তারা কী করে রাসূল সাঃ-এর উম্মত হয়? এটা তো খুবই স্বাভাবিক কথা । সত্যি সত্যিই মাত্র ৬০/৭০ বছরের মাথায় রাসূল সাঃ -এর হাদিসটির সত্যায়ন ঘটলো । অামরা অার উম্মতে মোহাম্মদী রইলাম না । যতই দিন যেতে লাগলো ততই ইসলামের বিকৃতি ঘটতে থাকলো, দলে উপদলে বিভক্তি হতে লাগলো । রাসূল সাঃ এই পরিস্থিতিতে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ করার জন্য উপদেশ দিয়ে গিয়েছিলেন, "আমি তোমাদের নিকট দু’টা জিনিষ রেখে যাচ্ছি। যতক্ষণ পর্যন্ত তোমরা সে জিনিষ দু’টি আঁকড়িয়ে ধরে থাকবে, তোমরা পথভ্রষ্ট হবে না। এ দু’টা জিনিস হল আল্লাহর কিতাব ও তাঁর রাসূলের সুন্নাহ।” (মেশকাত শরীফ, ১ম খন্ড, হাদীস নং- ১৭৭ ) কিন্তু সে সুযোগও রাখলোনা একটা শ্রেণি । কালক্রমে জন্ম নিলো ধর্মব্যবসায়ী অালেম শ্রেণিটি । তারা পার্থিব স্বার্থে ধর্মকে ব্যবহার করতে শুরু করলো । তারা কোরঅান-হাদিস ও বিভিন্ন ফতোয়া-মাসলামাসায়েলের মাত্রাতিরিক্ত ব্যাখ্যা বিশ্লেষণে সেরাতুল মোস্তাকীম অর্থ্যাৎ সহজ সরল ধর্মটিকে কঠিন থেকে কঠিনতর করে ফেললো । দীনের অতি গুরুত্বপূর্ণ জিনিসগুলোকে কম গুরুত্বপূর্ণ অার কম গুরুত্বপূর্ণ জিনিসকে অতি গুরুত্বপূর্ণ করে তুললো । অথচ রাসূল সাঃ বলেছেন, "নিশ্চয়ই দীন সহজ। দীনকে যে কঠোর করতে যাবে, তা তার জন্য কঠোর হয়ে পড়বে। সুতরাং তোমরা মধ্যপন্থা অবলম্বন করো এবং মধ্যপন্থার নিকটবর্তী থাকো আর শুভ সংবাদ গ্রহণ কর এবং সকাল-সন্ধ্যায় ও রাতের শেষাংশে (ইবাদতের মাধ্যমে) আল্লাহর সাহায্য চাও।" (আবু হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, সহীহুল বুখারী: হা/৩৯)
অতিরিক্ত ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের ফলে ভারসাম্যপূর্ণ দীনটি ভারসাম্যহীন হয়ে গেলো, সাধারণ মানুষের কাছে দীনুল হক বা সত্য জীবনব্যবস্থা দুর্বোধ্যে ঠেকলো । কোনটা সঠিক সুন্নাহ অার কোনটি বেঠিক সুন্নাহ – বিভ্রান্তিতে পড়লো সাধারণ মুসলিমরা । তারা এক পর্যায়ে ধর্মব্যবসায়ী অালেম শ্রেণিটির উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়লো । অার অালেম শ্রেণিটি পার্থিব স্বার্থে ধর্মকে ব্যবহার করে জীবিকা নির্বাহ শুরু করলো, যেটা অাজ পর্যন্ত চলছে এবং ব্যাপক হারে । কিন্তু অাল্লাহ ও রাসূল সাঃ ধর্মের বিনিময় নেয়াটাকে চরম ভাবে নিষেধ করেছেন । কোরঅানে অাল্লাহ বলেন, “নিশ্চয় অাল্লাহ যা গ্রন্থে অবতীর্ণ করেছেন তা যারা গোপন করে ও তৎপরিবর্তে সামান্য মূল্যও গ্রহণ করে, নিশ্চয় তারা স্ব স্ব উদরে অাগুণ ছাড়া অন্য কিছু ভক্ষণ করে না এবং কিয়ামত দিবসে অাল্লাহ তাদের সাথে কথা বলবেন না, তাদেরকে পবিত্র করবেন না এবং তাদের জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি । তারাই সুপথের বিনিময়ে গোমরাহী বা কুপথ এবং ক্ষমার পরিবর্তে শাস্তি ক্রয় করেছে, অতঃপর জাহান্নামের শাস্তি সহ্য করতে তারা কতই না ধৈর্যশীল?” (সূরা বাকারাহঃ ১৭৪ থেকে ১৭৫) অার রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ “যে ব্যক্তি এমন কোন জ্ঞান অর্জন করল, যার দ্বারা আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টি লাভ করা যায়, তা সে কেবল পার্থিব স্বার্থ লাভের উদ্দেশ্যে অর্জন করল, কিয়ামতের দিন সে ব্যক্তি জান্নাতের সুগন্ধ পর্যন্ত পাবে না।” -(হযরত আবূ হুরায়রা রাদিআল্লাহু আনহু থেকে আবূ দাউদ) কী সাংঘাতিক কথা ! অথচ এ বিষয়গুলো বর্তমান যুগের এক শ্রেণির অালেমদের কাছে জানতে চাওয়া হলে তারা কথা ঘুরানোর চেষ্টা করেন । কিন্তু রাসূল সাঃ এদের সম্পর্কে বলেছেন, “যাকে ধর্মীয় জ্ঞান বিষয়ক কোন কথা জিজ্ঞাসা করা হয়, আর সে তা গোপন করে, কিয়ামতের দিন তাকে আগুনের লাগাম পরানো হবে।” (আবূ দাউদ, তিরমিযী, হাসান)
কালক্রমে যে ইসলামের বিকৃতি হবে, রাসূল সাঃ এর সুন্নাহতে বিকৃতি ঘটবে তা তিনি অনেক হাদিসের মাধ্যমে বলে গিয়েছেন । যেমন- রাসূল সাঃ বলেন, ''আমি অচিরেই লোকদের উপর এমন একটি সময় আসার আশংকা করছি, যখন কেবলমাত্র নাম ছাড়া ইসলামের আর কিছুই বাকি থাকবে না এবং কুরআনের লিখিত রূপটি ছাড়া তার বাস্তবায়ন থাকবে না। মসজিদগুলো চাকচিক্যে ভরপুর হলেও মানুষ হেদায়াত থেকে বঞ্চিত হবে। ঐ সময়কার আলেমরা হবে আসমানের নিচে বিচরণকারী সর্বনিকৃষ্ট জীব। তাদের থেকেই বিভিন্ন ফিতনা ছড়াবে এবং তারা নিজেরাও সেই ফিতনায় আবর্তিত হবে।'' -(হযরত আলী থেকে বর্ণিত, সুনানে বায়হাকী) অারেকটি হাদিসে বলেন,"ইসলামের রজ্জু একটা একটা করে ছিঁড়ে যাবে অর্থাৎ ইসলামের বিধান একটা একটা করে ছেড়ে দেয়া হবে। যখনই কোন একটি রজ্জু ছিঁড়ে যাবে, তখনই মানুষ এর পরবর্তী রজ্জু আঁকড়ে ধরবে। সর্বপ্রথম ছিড়ে যাবে, ‘হুকুম’ বা তওহীদ বা আল্লাহর সার্বভৌমত্ব । আর সর্বশেষ ছিড়ে যাবে সালাত। (আবূ উমামা আল-বাহিলী (রাঃ) থেকে বর্ণিত; ইবনু হাব্বান বলেন, হাদীসটির সনদ সহীহ; মুসনাদে আহমেদ (ইফা)- অধ্যায়ঃ ২, হাদিস নং ১০৫) অারেকটি হাদিসে রাসূল সাঃ বলেছেন, “আমার মনে হয় তোমরা আমার পরে তোমাদের মসজিদসমূহকে ইহুদিদের সিনাগোগ ও নাসারাদের গীর্জার ন্যায় বিশালাকার প্রাসাদরূপে তৈরি করবে । (ইবনে মাজাহঃ ৭৪০; আবু দাউদঃ ৪৪৮ নং হাদিস, রাবী ইবনু আব্বাস) শুধু তাই নয়, আনাস ইবুন মালিক রাঃ থেকে বর্ণিত । তিনি বলেন, রাসূল সাঃ বলেছেন, “যতক্ষণ পর্যন্ত লোকেরা মসজিদের সৌন্দর্য্য ও সুসজ্জিতকরণ নিয়ে পরস্পর গর্ব না করবে ততক্ষণ কেয়ামাহ সংঘটিত হবেনা” । (মেশকাত শরীফঃ ৭১৯ নং হাদিস; ইবনে মাজাহঃ ৭৩৯ নং হাদিস; আবু দাউদঃ ৪৪৯, ৪৭৫ নং হাদিস; আহমদঃ ১১৯৭১, ১২০৬৪, ১২১২৮, ১২৯৯১, ১৩৬০৬ নং হাদিস)
অর্থ্যাৎ হাদিসগুলো থেকে সারাংশে বলা যায়, রাসূল সাঃ -এর ওফাতের পর একটা শ্রেণি ধর্মকে বিকৃতি করে ফেলবে । অাকীদার বিকৃতি ঘটায় গুরুত্বপূর্ণ জিনিসগুলো গুরুত্বহীন হয়ে যাবে, অার গুরুত্বহীন জিনিসগুলো বেশি গুরুত্ব পাবে । যেমন তওহীদের ভিত্তিতে দীনুল হক প্রতিষ্ঠার চেয়ে গুরত্ব পাবে মসজিদগুলো চাকচিক্য করা, বাহ্যিক সুন্নত যেমন দাঁড়ি-টুপি রাখা ইত্যাদি । গুরুত্বের ওলটপালটে তাই সর্বপ্রথম ছিঁড়ে যাবে তওহীদ বা অাল্লাহর সার্বভৌম । এটা ছিঁড়ে যাবার ফলে মানুষ পরবর্তী গুরুত্বপূর্ণ যেমন সালাহকে অাঁকড়ে ধরবে । যারা সহজ সরল দীনটিতে এতো ক্ষতি ডেকে অানলো, তাদেরকে অাল্লাহ ও তাঁর রাসূল সাঃ অাসমানের নিচে সর্বনিকৃষ্ট জীব বলবেন না তো কী বলবেন?
দীনের দুর্বোধ্যতায় অাকীদাগত বিভ্রান্তিতে পড়ে ইসলাম দিনে দিনে বিকৃত হতে হতে প্রকৃত ইসলাম থেকে দূরে সরে যেতে লাগলো অার মুসলিম জাতিটি শতাধিক দলে উপদলে বিভক্ত হলো । এতে করে অামরা হারালাম প্রকৃত সহজ সরল ইসলাম, হারালাম উম্মতে মােহাম্মদী হবার দাবিদার, হারালাম জান্নাত । তবু কি অামাদের উপলব্ধি হবে না? অার কতদিন গাফেল হয়ে থাকবো?
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ বিকাল ৪:২৯