somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

প্রথম আলোর একটা সংবাদ না দিয়ে পারলাম না,চোখে পানি এসে যায় এই সব মানুষের জন্যে!!!

২৮ শে জুলাই, ২০১১ বিকাল ৫:১০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

সরওয়ার আলম

সরওয়ার আলম

রিকশায় উঠতেই টের পাই, চালক অন্য মানুষ। আচার-আচরণ, কথাবার্তা—সবই অন্য রকম। কৌতূহল নিয়ে নাম-পরিচয় জানতে চাই। মুচকি হেসে জবাব আসে, ‘সরওয়ার, সরওয়ার আলম; বাড়ি ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জ।’
পথ চলতে চলতে কয়েকটি পারিবারিক ছবি দেখছিলাম। হঠাৎ রিকশাচালক সরওয়ার পেছনে ফিরে একনজর ছবির দিকে তাকান। কিছুক্ষণ চুপচাপ, তারপর তাঁর ঝোড়ো মন্তব্য, ‘ছবির কম্পোজিশন ভালো না।’
অবাক হয়ে ভাবি, রিকশাচালক এই ‘কম্পোজিশন’ শব্দ জানল কী করে! বিস্ময় জাগে মনে। তারপর চলতে চলতে গল্প হয় সরওয়ারের সঙ্গে।
ছয় ভাইবোনের মধ্যে সরওয়ার দ্বিতীয়। ময়মনসিংহের তারাকান্দি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে ১৯৯৬ সালে পঞ্চম শ্রেণীর পড়ালেখা শেষ করেছেন। ১৯৯৭ সালে পেটের তাগিদে পরিবারের সঙ্গে ঢাকায় আসেন তিনি। প্রথমে শাকসবজির দোকানে কাজ করেছেন; পরে কুলিও খেটেছেন। ২০০৩ সাল থেকে রিকশা চালানো শুরু তাঁর। দীর্ঘশ্বাস ফেলে সরওয়ার বলেন, ‘ছোটবেলা থেকেই পড়ালেখার প্রতি ভীষণ আগ্রহ ছিল, কিন্তু সংসারের দায়িত্ব কাঁধে এসে পড়ায় তা আর হয়নি। তাই বলে পড়ালেখা থেকে একেবারে দূরেও থাকিনি।’
সরওয়ারের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, রিকশা চালানোর পাশাপাশি ২০০৫ সালে ইউসেপের একটি স্কুলে সপ্তম শ্রেণীতে ভর্তি হন তিনি। সেখান থেকে অষ্টম শ্রেণী পাস করেন। আনুষ্ঠানিকভাবে আর পড়ালেখা হয়নি তাঁর। তবে জ্ঞান আহরণের তীব্র তৃষ্ণা থেকে নিজে নিজেই অনেক কিছু শিখছেন। নজরুলের বিভিন্ন কবিতা, ম্যাক্সিম গোর্কির উপন্যাস মা, অরুন্ধতী রায়ের দ্য গড অব স্মল থিংকস, লেভ তলস্তয়ের ওয়ার অ্যান্ড পিস, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পদ্মা নদীর মাঝি, রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্প, উপন্যাসসহ অনেক কিছুই পড়েছেন তিনি। আর নিয়মিত পত্রিকা পড়ার অভ্যাসটা তো তাঁর বেশ পুরোনো। প্রিয় পত্রিকা প্রথম আলোর আদ্যোপান্ত তাঁর মুখস্থ। প্রথম আলোয় প্রকাশিত এবিএম মূসা, সৈয়দ আবুল মকসুদ, আসিফ নজরুলের কলাম পড়ার চেষ্টা করেন তিনি।
‘কেন এই পড়া?’ জানতে চাই সরওয়ারের কাছে। একটু ভেবে গম্ভীর কণ্ঠে সরওয়ার বলেন, ‘কত কিছু শেখা যায়, জানা যায়। নিজেকে গড়া, ভাষা-জ্ঞান জানা, মানুষ হওয়া—এসবের জন্যই পড়ি। জ্ঞান-বুদ্ধির ভারসাম্য না থাকলে মানুষ হওয়া যায় না।’
শিক্ষার গুরুত্বটা বোঝেন বলেই অন্য ভাইবোনদের পড়ালেখায় নিয়মিত উৎসাহ দেন সরওয়ার। তাঁর বাকি পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে চারজনই পড়ালেখা করছেন। তবে নিজের প্রাতিষ্ঠানিক পড়ালেখাটা বেশিদূর এগোয়নি বলে স্বপ্ন দেখা থেমে নেই সরওয়ারের। গল্প বলতে বলতে হঠাৎ স্বপ্নের জগতে হারিয়ে যান তিনি। গোধূলির আলো-আঁধারির মধ্যেও তাঁর চোখে-মুখে আলো খেলা করে। দূর আকাশের দিকে তাকিয়ে সরওয়ার বলতে থাকেন, ‘ছোটবেলা থেকেই গল্পের বই পড়তাম, ছবি আঁকতাম। এ পর্যন্ত ৫০টা কবিতা লিখেছি, গল্প আছে তিনটা। এখনো স্বপ্ন দেখি লেখক হব। আচ্ছা, এত কম পড়ালেখা নিয়ে কি লেখক হওয়া যায় না? নজরুল তো পড়ালেখা না করেও কত বড় কবি!’
কথা বলতে বলতে সরওয়ারের আরও অনেক সৃজনশীলতার সন্ধান মেলে। সাহিত্যের পাশাপাশি স্থাপত্যবিদ্যায়ও তাঁর আগ্রহ আছে ঢের। এক বছর ধরে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্যবিদ্যার শিক্ষক ফেরদৌস হাবিব খানের কাছে তিনি এ বিষয়ে পাঠ নিচ্ছেন। স্থাপত্যবিদ্যার প্রাথমিক জ্ঞান এখন তাঁর ঠোঁটে ঠোঁটে। প্রশ্ন করি, ‘কী হবে এসব শিখে?’ সরওয়ারের সহজ জবাব, ‘নিজের জন্য একটা খড়ের ঘর বানালেও তাঁর নকশাটা আমার হাতেই হবে।’
সরওয়ার আলম সম্পর্কে ফেরদৌস হাবিব খান বলেন, ‘ও আসলে আমার ভালো বন্ধু। আমি আমার জ্ঞান ওর মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করি। আবার ওর কাছ থেকেও আমি অনেক কিছু শিখি। সরওয়ার অসাধারণ প্রতিভার অধিকারী। জানার প্রতি তাঁর আগ্রহের তীব্রতা দেখে আমার অবাক লাগে। রিকশা চালিয়েও শেখার জন্য সে সময় দেয়। এটা সত্যিই বিরল।’
সরওয়ার জানান, একবেলা রিকশা চালিয়ে বাকি সময় জ্ঞান অর্জনের কাজে সময় দেন তিনি। এর মধ্যে সপ্তাহে তিন দিন সন্ধ্যার পর শেখেন স্থাপত্যবিদ্যা। আর অভিধান ঘেঁটে ইংরেজি শব্দ জানার চর্চাটাও করেন মাঝেমধ্যে। হাজার খানেক ইংরেজি শব্দ আছে তাঁর জ্ঞানভান্ডারে। যে কারও সঙ্গে ইংরেজিতে টুকটাক আলাপও করতে পারেন তিনি।
গন্তব্যস্থলের কাছাকাছি এসে সরওয়ারের কাছে জানতে চাই, ‘মানুষ হতে আর কত বাকি!’ সরওয়ারের মুখে লাজুক হাসি। ভেবেচিন্তে দার্শনিকের মতো জবাব দেন, ‘মানুষ হতে হলে আগে দরকার ভালো মানসিকতা। চেষ্টা করি মানুষ হতে, পারছি কিনা মানুষই জানে। মানুষ হওয়া কঠিন কাজ।’
সরওয়ারের কথা শুনে থমকে যাই। নিজেকে কাঠগড়ায় দাঁড় করাই। আমি নিজে মানুষ হতে পেরেছি তো! সরওয়ারের মতো মানুষ।
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে জুলাই, ২০১১ বিকাল ৫:১৩
৩৫টি মন্তব্য ১০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

হাদিকে গুলি করলো কে?

লিখেছেন নতুন নকিব, ১২ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১১:২৬

হাদিকে গুলি করলো কে?

ছবি অন্তর্জাল থেকে নেওয়া।

ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ঢাকা ৮ আসনের সম্ভাব্য স্বতন্ত্র প্রার্থী রাজপথের অকুতোভয় লড়াকু সৈনিক ও ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শরিফ ওসমান হাদিকে গুলিবিদ্ধ... ...বাকিটুকু পড়ুন

মানুষের জীবনের চেয়ে তরকারিতে আলুর সংখ্যা গণনা বেশি জরুরি !

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ১৩ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:১৭


বিজিবির সাবেক মহাপরিচালক জাহাঙ্গীর আলম স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে দেশবাসী একটা নতুন শব্দ শিখেছে: রুট ভেজিটেবল ডিপ্লোম্যাসি। জুলাই আন্দোলনের পর যখন সবাই ভাবছিল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে এমন... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইতিহাসের সেরা ম‍্যাটিকুলাস ডিজাইনের নির্বাচনের কর্মযজ্ঞ চলছে। দলে দলে সব সন্ত্রাসীরা যোগদান করুন‼️

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ১৩ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ ভোর ৪:৪৪



বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্ব নিকৃষ্ট দখলদার দেশ পরিচালনা করছে । ২০২৪-এর পর যারা অবৈধ অনুপ্রবেশকারী দিয়ে দেশ পরিচালনা করছে । তাদের প্রত‍্যেকের বিচার হবে এই বাংলার মাটিতে। আর শুধুমাত্র... ...বাকিটুকু পড়ুন

হাদির হত্যাচেষ্টা: কার রাজনৈতিক ফায়দা সবচেয়ে বেশি?

লিখেছেন শ্রাবণধারা, ১৩ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১০:১৮


হাদির হত্যাচেষ্টা আমাদের সাম্প্রতিক রাজনীতিতে একটি অশনি সংকেত। জুলাই ২০২৪ আন্দোলন-পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের দ্বিধাবিভক্ত সমাজে যখন নানামুখী চক্রান্ত এবং রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অন্তর্কলহে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও আয়-উন্নতির গুরুত্বপূর্ন প্রশ্নগুলো... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমি আর এমন কে

লিখেছেন রূপক বিধৌত সাধু, ১৩ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৪:১৩


যখন আমি থাকব না কী হবে আর?
থামবে মুহূর্তকাল কিছু দুনিয়ার?
আলো-বাতাস থাকবে এখন যেমন
তুষ্ট করছে গৌরবে সকলের মন।
নদী বয়ে যাবে চিরদিনের মতন,
জোয়ার-ভাটা চলবে সময় যখন।
দিনে সূর্য, আর রাতের আকাশে চাঁদ-
জোছনা ভোলাবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×