somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

সেন্ট মার্টিনঃ স্মৃতিতে মোড়ানো একটুকরো সবুজ দ্বীপ

০৫ ই আগস্ট, ২০১৫ বিকাল ৩:৩৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

“ভ্রমণ তোমাকে বাকরুদ্ধ করে ফেলে যায় আর তারপরই তুমি হয়ে উঠবে গল্পকথক” ইবনে বতুতার উক্ত বানীর সত্যতা মিলে যুগে যুগে যখন আমরা ভ্রমণ কাহিনী করি আর চোখ বন্ধ করে চোখের সামনেই সেই দৃশ্যগুলো দেখতে পাই। প্রকৃতির প্রতি মানুষের টান সেই সৃষ্টির শুরু থেকেই। হয়তো বাস্তবতার কষাঘাত এই সম্পর্কের মাঝে বাধা হয়ে দাড়ায় মাঝে মাঝে। তবে যুগে যুগে এই টান মানুষকে টেনে নিয়ে যায় প্রকৃতির একান্ত সান্নিধ্যে ।


“দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া ঘর হইতে দুই পা ফেলিয়া” রবীন্দ্রনাথের এই কথায় উৎসাহিত হয়ে বাস্তবতাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে গত ৩০শে এপ্রিল পাড়ি জমিয়েছিলাম বাংলাদেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ সেন্ট মার্টিনের উদ্দেশ্যে। যাত্রাটা একরকম সংগ্রাম করেই হয়েছিলো। ছায়াসঙ্গী তিথি দিনালোকে সাথে না পেয়ে খুব মন খারাপ হয়েছিল। তবে সেই খারাপ লাগা বেশি স্থায়ী হয়নি ইমরান ভাই আর ইমন ভাইয়ের সহচরজী পেয়ে। তিনজন গাবতলি বাস টার্মিনাল থেকে রওনা হয়েছিলাম সন্ধ্যা ছয়টায়। সায়েদাবাদ থেকে যোগ দিলেন আরো দুইজন সঙ্গী কিরন ভাই আর রাফি ভাই। শুরু হল স্বপ্নের যাত্রা। রাতের অন্ধকারের বুক চিরে হানিফ পরিবহনের বাসটি ছুটে চলছিল টেকনাফের উদ্দেশ্যে। সমুদ্রে হয়তো তখন মৃদু ঠাণ্ডা বাতাস বইছে, জানিয়ে দিচ্ছে আমাদের আগামন বার্তা।

১লা মে সকাল নয়টা। আমরা পৌঁছে গেলাম টেকনাফে। সেখানে আগে থেকে অপেক্ষা করেছিল ট্যুর গাইড “শুক্কুর” যাকে আমরা সবাই ফ্রাই ডে বলে ডাকতাম। সকাল সাড়ে নয়টায় চড়ে বসলাম সেন্ট মার্টিন যাওয়ার জাহাজ “কেয়ারি সিন্দাবাদে”। নাফ নদীতে সাতার কেটে আমাদের জাহাজ রওনা হয়ে গেলো স্বপ্নের দ্বীপে। বামপাশে মায়ানমারের উচু উচু পাহাড় আর ডানে দেখতে দেখতে শেষ হয়ে যাচ্ছিল বাংলাদেশের স্থল সীমানা। নাফ নদী পেরিয়ে যখন সমুদ্রে এসে পরলাম নিঃশ্বাস যেন বন্ধ হয়ে আসছিল সমুদ্রের বিশালতার সামনে। ঢেউয়ের মাথায় সাদা ফেনা আর নীলাভ পানি যেন দুইহাত তুলে ডাকছিল আমাদের। ছুটে যেতে ইচ্ছে করছিল যেই প্রান্তে যেখানে নীল আকাশ আর সমুদ্র এক হয়ে গেছে যেখানে। চারিদিকের এতো সৌন্দর্য কিছুই হারাতে চাইনি। সেই কাজটা করলেন আমাদের পেশাদার চিত্রগ্রাহক ইমরান ভাই। একের পর এক ছবি জমা পরতে লাগলো তার ক্যামেরায়। বলাই বাহুল্য এই ভ্রমনে তিনি আর পেশাদার ছিলেন না হয়ে গেলেন আমাদের ব্যক্তিগত চিত্রগ্রাহক।


দুপুর বারোটার দিকে জাহাজ ভিড়ল সেন্ট মার্টিন ঘাটে। জেটিতে তখন অনেক লোক। মুহুরমহু স্লোগান চলছিল। অনেকের হাতে দেখলাম ফুলের মালা। ইমরান ভাই তো ঘোষণাই দিলেন যে আমাদের আসা উপলক্ষেই এতো আয়োজন। পরে অবশ্য জানতে পারলাম আমাদের জাহাজেই কোন একজন রাজনৈতিক নেতা আসছেন। আমাদের অভ্যর্থনাও অবশ্য কম ছিল না। দ্বীপে ইমারান ভাইয়ের একটা হোটেল থাকার সুবাধে অনেক লোক তার পরিচিত। জেটিতে নামতেই একজন ডাব নিয়ে হাজির আমাদের জন্য। আমাদের হোটেলটা ছিল পশ্চিম দিকে সমুদ্রের একদম কাছাকাছি। জোয়ারের ঢেউ একবারে হোটেলের সিঁড়ি পর্যন্ত পৌঁছে যায়। সে এক অন্যরকম সৌন্দর্য। হোটেলের খাবার ঘরটা ছিল একেবারে বাইরে যেখান থেকে দেখা যায় দারুচিনি দ্বীপ।


দুপুরে ভাজা ইলিশ মাছ আর শুটকি ভর্তা দিয়ে ভরপেট খাওয়ার পর সিদ্ধান্ত হল আজকে আর সমুদ্রে নামা হবে না। কিন্তু সমুদ্র যে আমাদের ডাকছিল। সে ডাক উপেক্ষা করতে না পেরে আমি রাফি আরা কিরন ভাই ঝাপিয়ে পড়লাম সমুদ্রের বুকে। সন্ধ্যা পর্যন্ত চলতে থাকলো আমাদের দাপাদাপি। ততক্ষণে ইমরান ভাই আর ইমন ভাই বেড়িয়ে পড়েছিল পুরো দ্বীপটা ঘুরতে। রাতে সবাই গিয়ে বসলাম জেটিতে। সমুদ্রের ঠাণ্ডা বাতাস, হাতে গরম চায়ের কাপ আর আকাশে এক ফালি চাঁদ। সেই দৃশ্য আজো মন খারাপের সময় যেন টনিক হিসাবে কাজ করে।


২মে সকাল আটটা। সেন্ট মার্টিন থেকে বোটে করে রওনা দিলাম ছেঁড়াদ্বীপের উদ্দেশ্যে। দল আরো ভারি হল চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই সাবেক সাইদ ভাই আর বিজয় দাকে পেয়ে। চমৎকার হাসিখুশি দুইজন মানুষ। বোটে প্রায় চল্লিশজন লোক ছিল। ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই পৌঁছে গেলাম ছেঁড়াদ্বীপের অদূরে। কিন্তু প্রবল ঢেউ আর বড় বড় প্রবালের কারনে বোট উপকূলে ভিড়তে পারবে না। ছোট একটা নৌকায় করে তীরে উঠতে হবে। এমন সময় সিদ্ধান্ত হল আমরা নৌকায় না গিয়ে সাতরে তীরে উঠবো। ছেঁড়াদ্বীপের স্বচ্ছ ঐ জল যেন আমাদের চিন্তা শক্তি ভোতা করে দিয়েছিল। ভুলেই গিয়েছিলাম আসন্ন বিপদের কথা। নৌকার লোকজন অবশ্য অনেকবার নিষেধ করেছিল। ঝাপিয়ে পরার পরেই অবশ্য নিজেদের ভুল বুঝতে পেরেছিলাম। অত বড় ঢেউয়ের সাথে সংগ্রাম করে টিকে থাকা অসম্ভব ছিল। চোখের সামনে যেন মৃত্যু দেখতে পারছিলাম। ইমারান ভাইতো প্রায় ডুবেই গিয়েছিল। আমাদের দলের সেরা সাতারু ইমন ভাই তাকে টেনে তুলেছিল। প্রায় আধা ঘণ্টা প্রবল ঢেউ, ভাটার টান আর ছুরির মত ধারালো প্রবালের সাথে যুদ্ধ করে আমরা তীরে উঠতে পেরেছিলাম। ফলাফল সবার হাতে পায়ে অসংখ্য ক্ষত আর ব্যান্ডেজ। সেন্ট মার্টিনের নয়টা বিপদজনক জায়গা আছে। না জেনে অনেকেই এখানে নেমে পড়েন। আমরা অবশ্য সিদ্ধান্ত নিয়েছি জায়গাগুলোতে সতর্কীকরণ সংকেত টানিয়ে দিব।


২মে বিকাল চারটা। দুপুরের খাওয়ার পর কিরন ভাইয়ের পীড়াপীড়িতে বের হলাম ছবি তুলতে। ভ্রমনের পুরাটা সময় কিরন ভাইকে সামনে রেখে কাজ চালিয়েছি আমরা। ক্ষুধা লাগলেই কিরন ভাইকে উস্কানি দিতাম আর খাবার এসে পড়ত। যাইহোক সেদিন রাত পর্যন্ত চলছিল আমাদের ছবি তোলা।

রাতে হোটেলে ফিরে আয়োজন করা হল বারবিকিউ পার্টির। সমুদ্রের পাড়ে গোল হয়ে বসে গান চলতে লাগলো একের পর এক। স্থানীয় গাইড নূর আলমের কণ্ঠে চলছিল স্থানীয় গান। যেই আমি কখন গান গাইতে পারিনা সেই আমিও যোগ দিলাম গানের দলে। রাত তখন আনুমানিক একটা। ভাটার কারনে পানি নেমে গেছে অনেকদূর। একা একা দূর সমুদ্রের দিকে হেটে গিয়ে বসলাম বড় একটা প্রবালের উপরে। প্রান খুলে গল্প করলাম সমুদ্রের সাথে। সমুদ্র যেন আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। আমার সব খারাপ লাগা যেন টেনে নিয়ে গেলো নিজের দিকে। আমি ফিরলাম নতুন আশা আর নতুনভাবে বাঁচার প্রত্যয় নিয়ে।এরপর আরো দুইটা দিন ছিলাম। স্মৃতির পাতায় একের পর এক জমা হচ্ছিল অসাধারণ সব ভালো থাকা, ভালো লাগার মুহূর্ত। বেঁচে থাকার অনুপ্রেরণা।


৪মে বিকাল তিনটা। সেন্ট জেটি থেকে “কেয়ারি সিন্দাবাদের” সেই জাহাজে করে রওনা হলাম টেকনাফের উদ্দেশ্যে। মাত্র চারটি দিন। কিন্তু কি যেন এক অদৃশ্য মায়ায় বেধে রেখেছিল আমাদের। বিদায় জানাতে খারাপই লাগছিল। জাহাজ যত দূরে চলে যাচ্ছিল সেন্ট মার্টিন দ্বীপ তত ছোট হয়ে যাচ্ছিল। একসময় মিলিয়ে গেলো বঙ্গোপসাগরের বুকে। কিন্তু আমার মনের সাগরে আচমকা জেগে উঠলো নতুন দ্বীপ। সে দ্বীপ স্বপ্নের সেন্ট মার্টিন দ্বীপ।

টেকনাফ পৌঁছে রাফি ভাই আর কিরন ভাই চলে গেলো ঢাকার উদ্দেশ্যে। বাকীরা রওনা হলাম কক্সবাজার। থাকলাম আরো দুইদিন। উপভোগ করলাম সমুদ্র সৈকতে মাঘী পূর্ণিমার রাত। পরদিন ঘুরে আসলাম ইনানি বিচ আর হিমছড়ি পাহাড়ের সৌন্দর্য।


৬মে সকালে সবার থেকে বিদায় নিয়ে চলে আসলাম চট্টগ্রাম। সেখানে এক বন্ধুর সাথে থাকলাম একদিন। অসাধারণ সেদিনে পদধূলি দিয়েছিলাম ফয়েজ লেক, জিয়া পার্কসহ চট্টগ্রামের অলিগলি। জিয়া পার্কের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এখানে বাংলাদেশের সব ঐতিহাসিক স্থানগুলোর ক্ষুদ্র রেপ্লিকা আছে। বিশেষ করে আহসান মঞ্জিল, সংসদ ভবন, বড় কাটরা, ছোট কাটরা, ষাট গম্ভুজ মসজিদ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। ঘোরাঘুরির একফাকে আমরা সংসদ ভবনে বসে আইসক্রিম খেয়েছিলাম।



৭মে রাত দশটা। সোহাগ পরিবহনের বাসটি রওনা হল ঢাকার উদ্দেশ্যে। পেছনে ফেলে আসলাম হাজারো সুখের স্মৃতি। ঘুমে যখন এলিয়ে পড়ছিলাম কর্ণ কুহরে তখন শুধুই সমুদ্রের গর্জন। হু হু বাতাস নববধূর কণ্ঠের মত ফিসফিস করে যেন বলছিল “ এ সৌন্দর্য তোমার জন্য, এ দ্বীপ তোমার। ফিরে এসো আবার, ফিরে এসো...............”

সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই আগস্ট, ২০১৫ রাত ১০:৪২
৬টি মন্তব্য ৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

মিশন: কাঁসার থালা–বাটি

লিখেছেন কলিমুদ্দি দফাদার, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৯:২৭

বড় ভাই–ভাবীর ম্যারেজ ডে। কিছু একটা উপহার দেওয়া দরকার। কিন্তু সমস্যা হলো—ভাই আমার পোশাক–আশাক বা লাইফস্টাইল নিয়ে খুবই উদাসীন। এসব কিনে দেওয়া মানে পুরো টাকা জ্বলে ঠালা! আগের দেওয়া অনেক... ...বাকিটুকু পড়ুন

আওয়ামী লীগের পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামীকেও নিষিদ্ধ করা যেতে পারে ।

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:৪৫


বাংলাদেশে আসলে দুইটা পক্ষের লোকজনই মূলত রাজনীতিটা নিয়ন্ত্রণ করে। একটা হলো স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি এবং অন্যটি হলো স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি। এর মাঝে আধা পক্ষ-বিপক্ষ শক্তি হিসেবে একটা রাজনৈতিক দল... ...বাকিটুকু পড়ুন

J K and Our liberation war১৯৭১

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৯



জ্যাঁ ক্যুয়ে ছিলেন একজন ফরাসি মানবতাবাদী যিনি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের একটি বিমান হাইজ্যাক করেছিলেন। তিনি ৩ ডিসেম্বর, ১৯৭১ তারিখে প্যারিসের অরলি... ...বাকিটুকু পড়ুন

এবার ইউনুসের ২১শে অগাষ্ঠ ২০০৪ এর গ্রেনেড হামলার তদন্ত করা উচিৎ

লিখেছেন এ আর ১৫, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:৪০



এবার ইউনুসের ২১শে অগাষ্ঠ ২০০৪ এর গ্রেনেড হামলার তদন্ত করা উচিৎ


২০০৪ সালের ২১ শে অগাষ্ঠে গ্রেনেড হামলার কারন হিসাবে বলা হয়েছিল , হাসিনা নাকি ভ্যানেটি ব্যাগে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন ছায়াযুদ্ধ: R থেকে MIT—কুয়াশার ভেতর নতুন ক্ষমতার সমীকরণ

লিখেছেন এস.এম. আজাদ রহমান, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:৪৪



বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন ছায়াযুদ্ধ: R থেকে MIT—কুয়াশার ভেতর নতুন ক্ষমতার সমীকরণ

কেন বিএনপি–জামায়াত–তুরস্ক প্রসঙ্গ এখন এত তপ্ত?
বাংলাদেশের রাজনীতিতে দীর্ঘদিন ধরে একটি পরিচিত ভয়–সংস্কৃতি কাজ করেছে—
“র”—ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা নিয়ে রাজনীতিতে গুজব,... ...বাকিটুকু পড়ুন

×