somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আবুল হাসানের কবিতাঃ অন্ধকার সময়ের অসহায় কণ্ঠস্বর

৩০ শে মে, ২০১৩ বিকাল ৪:২২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


আবুল হাসান (১৯৪৭-৭৫)

উৎসর্গ
সাদিয়া ইসলাম বৃষ্টি
বন্ধু, বোন, সমসময়ে লেখালেখি করা একজন


"তবে কি সে মানুষের সাথে সম্পর্কিত ছিল, কোনোদিন
ভালোবেসেছিল সেও যুবতীর বামহাতে পাঁচটি আঙুল?
ভালোবেসেছিল ফুল, মোমবাতি, শিরস্ত্রাণ, আলোর ইশকুল?"

(আবুল হাসান/ আবুল হাসান)


যে-বছর সাম্প্রদায়িকতার ছুরিতে রূপসী বাংলাকে কেটে দুটুকরো করা হল, কবি আবুল হাসান জন্ম নিলেন ঠিক সেই বছরে। তাঁর জন্ম হল অজস্র মৃত্যুর মধ্যে, তাই তাঁর কবিতায় যে অসহায়তা দেখতে পাই তা অনেকটা জন্মদাগের মতো, এক প্রকারের মৃত্যুবোধ হয়তো তাঁকে তাড়া করে ফিরেছে আমৃত্যু। এই অসহায়তার সমাপ্তি ঘটল স্বাধীনতার ঠিক চার বছর পর।

আবুল হাসানকে 'বিষন্নতার কবি' বা 'নিঃসঙ্গতার কবি' হিসেবে চিহ্নিত করার একটি প্রবণতা খেয়াল করেছি, কিন্তু আমার তাঁকে গভীরভাবে রাজনীতিমনস্ক কবি বলেই মনে হয়, যদিও তিনি তাঁর বন্ধু ও বাংলা সাহিত্যের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কবি নির্মলেন্দু গুণের মতো 'তার আগে চাই সমাজতন্ত্র' ধরণের প্রচারণাসর্বস্ব সাহিত্যকর্ম তৈরি করার চেষ্টাও করেননি। সাহিত্য সমালোচনা করার কোনো যোগ্যতাই আমার নেই, তাই এই লেখাটি আবুল হাসানের কবিতার ব্যাপারে একান্তই আমার ব্যক্তিগত চিন্তা হিসেবে দেখার অনুরোধ করছি, কোনো গভীর বিশ্লেষণ এই লেখায় আশা না করাই ভালো। তিনি কবি হিসেবে কতোটা গুরুত্বপূর্ণ সেটা নিয়ে বিতর্ক থাকতে পারে, কিন্তু তিনি যেই সময়ের সন্তান সেই সময়টি বাংলাদেশের ইতিহাসে খুবই গুরুত্বপূর্ণ, তাই তাঁর কবিতাকে তাঁর সময়ের প্রেক্ষিতেই পাঠ করা প্রয়োজন এরকম একটা বিশ্বাস থেকেই এই লেখার অবতারণা।

রাজা যায় রাজা আসে

আবুল হাসানের প্রথম কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয় ডিসেম্বর ১৯৭২এ, স্বাধীনতার ঠিক পরের বছর। কাব্যগ্রন্থের নামঃ 'রাজা যায় রাজা আসে।' গ্রন্থটি তিনি উৎসর্গ করলেন তিনি তাঁর মাকে, এই লিখেঃ

"আমার মা
আমার মাতৃভূমির মতোই অসহায়"


সদ্যস্বাধীন একটি রাষ্ট্রের 'রাজা' ও তাঁর অনুসারীদের কর্মকাণ্ড একজন সংবেদনশীল কবিকে কি পরিমাণ হতাশ করলে সেই কবি দেশ স্বাধীন হওয়ার এক বছর পেরোতে না পেরোতেই তাঁর মাতৃভূমিকে 'অসহায়' মনে করতে পারেন সেটা কল্পনা করতেও ভয় লাগে।

'পাখি হয়ে যায় প্রাণ' কবিতায় তিনি লিখলেন,

"স্মরণপ্রদেশ থেকে এক একটি নিবাস উঠে গেছে
সরজু দিদিরা ঐ বাংলায়, বড়ভাই নিরুদ্দিষ্ট,
সাইকেলের ঘণ্টাধবনি সাথে কোরে নিয়ে গেছে গাঁয়ের হালট!"


সরজু দিদিরা শুধুমাত্র 'আপু' না হয়ে 'দিদি' হওয়ার 'অপরাধে'(?) ঐ বাংলায় চলে গেলেন। যাঁরা নিজভূমে ফিরে আসলেন ভারত থেকে, তাঁরা দেখলেন তাঁদের ঘরের ইট কাঠের টুকরোগুলো সুদ্ধ চুরি হয়ে গেছে, বা বেদখল হয়েছে। শুধু বাড়িঘর দখল করেই সন্তুষ্ট না থেকে স্বাধীনতার পর ক্ষমতায় যাওয়া দলটি 'সংখ্যালঘু' সম্প্রদায়ের মানুষদেরকে 'সংখ্যাগুরুদের' স্মৃতি থেকেও উঠিয়ে দিতে চাইলো, দেশ স্বাধীন হল, হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষেরা নিজভূমে পরবাসী হলেন। এই বেদনাটুকু খুব নিঃশব্দে এই কবিতায় ধরে রাখলেন আবুল হাসান।

'উচ্চারণগুলি শোকের' কবিতায় তিনি হাহাকার করে লিখলেন, এই কবিতাটা পড়তে গেলে কষ্টে নিশ্বাস আটকে আসে, যে তিনি লক্ষী বউটি আর কোথাও দেখেন না, হাঁটি হাঁটি শিশুটিকে কোথাও দেখেন না, ছোট ভাইটিকে আর নরম নোলক পড়া বোনটিকে কোথাও দেখেন না, রক্ত আর যুদ্ধের শেষে তিনি কিছু 'নরম শরীর ভরা রাজহাঁস' আর 'কতগুলি মুখস্ত মানুষ' দেখেন। এই মুখস্ত মানুষগুলো নিশ্চয়ই তারাই যারা 'গণতন্ত্র', 'সমাজতন্ত্র', 'জাতীয়তাবাদ', 'ধর্মনিরপেক্ষতা' এই ধরণের সুন্দর সুন্দর কিছু শব্দ শুধু মুখস্তই করেছিলো, আর তাঁদের মুখস্তবিদ্যা উল্লিখিত শব্দগুলির একটিকেও বাস্তবায়িত করতে না পারলেও প্রচুর 'নরম শরীর ভরা রাজহাঁস' তৈরি করতে পেরেছিলো, পুঁজির কোনো ভিত্তি গড়ে না তুলে 'সমাজতন্ত্রের' শ্লোগান দিয়ে রাষ্ট্রকে সরাসরি টাকা বানানোর যন্ত্র হিসেবে ব্যবহার করলে কিছু 'নরম শরীর ভরা রাজহাঁস' তো তৈরি হবেই! রাজহাঁসদের দেশপ্রেম তিনি অসহায়ের মতো দেখেন, 'কেবল পতাকা' আর 'তিমিরের বেদীতে উৎসব' দেখেন, হাহাকার-করা-কবি অংশ নিতে পারেন না তাঁর তীক্ষ্ণ আত্মমর্যাদাবোধের কারণেই।

'অসভ্য দর্শন' কবিতাটা খুব গুরুত্বপূর্ণ, কারণ আবুল হাসানকে 'রাজনীতিবিমুখ' প্রমাণ করার জন্য এই কবিতাটাই সাধারণত ব্যবহৃত হয়। আমার কাছে কিন্তু মনে হয়, আবুল হাসান কতোটা রাজনীতিলিপ্ত ছিলেন তা সবচেয়ে ভালো বোঝা যায় এই কবিতা থেকে, কারণ তিনি লিখলেন এই কবিতায় যেঃ দালান ওঠা-দালান ভাঙা, গোলাপ ফোটা-গোলাপ ঝরা, মানুষ জন্মানো-মানুষ মরা, পুরুষতন্ত্রের স্বর্গে রোদে মুখ নত করে নারীর বুকের ভ্রমর লুকিয়ে রাখা, তরুণদের অধঃপাতে যাওয়া, যুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন দেশ অর্জন করার পরও রাষ্ট্রীয় অত্যাচারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে বাধ্য হওয়া, হত্যা খুন আর ধর্ষণ, সমস্যার ছদ্মবেশে আবার আগুন উর্বর হয়ে ওঠা, তার পকেটে দুর্ভিক্ষ নিয়ে একা একা অভাবের রাস্তায় ঘোরা, জীবনের অস্তিত্বে ক্ষুধায় মরা, এবং সর্বোপরি বেদনার বিষবাষ্পে জর্জরিত সবার চতুর্দিকে খাঁ খাঁ, খল খল তীব্র এক বেদিনীর সাপ খেলা দেখা এই সবই "রাজনীতি।" যিনি এতো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে খেয়াল করেন তার সময় ও সমাজকে, তিনি 'রাজনীতিবিমুখ?'

কিন্তু কবি কি কোনো 'মুক্তাঞ্চলে' পালিয়ে যেতে চেয়েছেন। না। আব্দুল মান্নান সৈয়দকে উৎসর্গ করা 'শিকড়ে টান পড়তেই' কবিতায় তিনি লিখলেনঃ ''আমি সমুদ্রের কাছে গিয়ে পুনর্বার সমাজের কাছে ফিরে এসেছি!" 'ফেরার আগে' নামের আরেকটি অসাধারণ কবিতায় তিনি লিখলেনঃ

"যদি দেখি, না,-
পৃথিবীর কোথাও এখন আর যুদ্ধ নেই, ঘৃণা নেই, ক্ষয়ক্ষতি নেই

তাহলেই হাঁসতে হাঁসতে যে যার আপন ঘরে
আমরাও ফিরে যেতে পারি!
"

কিন্তু তেমনটা যেহেতু ঘটেনি, তাই কবি কোনো স্বর্গে প্রত্যাবর্তনের প্রত্যাশা রাখেননি। মানুষ অতীতকে ধারণ করতে পারে, কিন্তু অতীতে ফিরে যেতে পারে না, অতীতের অন্তঃসার আলোটুকু ধারণ করে মানুষকে অগ্রসর হতে হয় ভবিষ্যতের দিকে। তাই যুদ্ধ ঘৃণা আর ক্ষয়ক্ষতির পৃথিবীতে 'যার যার আপন ঘরে' ফিরে যাওয়ার সুযোগ নেই আপন অস্তিত্বের স্বার্থেই।

যে তুমি হরণ করো

১৯৭৪এ প্রকাশিত 'যে তুমি হরণ করো' আবুল হাসানের দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ। এই কাব্যগ্রন্থের সূচনাকবিতা 'কালো কৃষকের গান'-এ তিনি কোনো এক কবিকে, হয়তো নিজেকে, প্রশ্ন করেনঃ

"মাটির ভিতরে তুমি সুগোপন একটি স্বদেশ রেখে কেন কাঁদো
বৃক্ষ রেখে কেন কাঁদো? বীজ রেখে কেন কাঁদো? কেন তুমি কাঁদো?
নাকি এক অদেখা শিকড় যার শিকড়ত্ব নেই তাকে দেখে তুমি ভীত আজ?
ভীত আজ তোমার মানুষ বৃক্ষশিশু প্রেম নারী আর নগরের নাগরিক ভূমা?"


এই প্রশ্নের কোনো উত্তর নেই...

স্বাধীনতাপরবর্তী সেই টালমাটাল সময়ে মধ্যবিত্তের জীবনযাপন-কে আবুল হাসান কি চোখে দেখেছেন সেটা বোঝার জন্য সবচেয়ে ভালো কবিতা 'এই ভাবে বেঁচে থাকো, এই ভাবে চতুর্দিক।' এটি আক্ষরিক অর্থেই ব্যতিক্রম, কারণ আবুল হাসানের কবিতায় পরিহাস-প্রবণতা সাধারণত দেখা যায় না, কিন্তু এই কবিতাটি আদ্যোপান্ত পরিহাসময়। কবি লিখেছেনঃ

"বেঁচে থাকতে হলে এই বেঁচে থাকা? চূর্ণ গেরস্থালী তাতে
বসে থেকে উরুতে থাপ্পড় দিয়ে বলে ওঠা চাই হোক
শূন্য হোক, পূণ্য হোক খাঁ খাঁয় ভরপুর হোক সব কিছু
খঞ্জ ও খোঁড়ায় যেমন দেখতে পায় আমি ভালো আছি?"


এখনো এখানে আমরা যারা মধ্যবিত্ত তাদের জীবনযাপন অনেকটা এরকমই। আমরা শূন্য-পূণ্য-প্রাচুর্য অনেক কিছু চাই, 'উরুতে থাপ্পড় দিয়ে', কোনো কমবাইনড এফোর্ট ছাড়াই। আর কমবাইনড এফোর্ট ছাড়া যেহেতু কোনোকিছু অর্জন করা যায় না, তাই না পেয়ে 'কেন পাচ্ছি না' এই ভেবে ক্ষুব্ধ হয়ে আশেপাশের সবাইকে শত্রু ঠাউরে 'আমি ভালো আছি' ভাবতে ভাবতে নিজ সমাজ ও সময়ের বাইরে চলে গিয়ে ছোট ছোট অজস্র বৃত্ত তৈরি করে চতুর্দিকে।

এবং এই মধ্যবিত্ত মানুষেরা নির্বিকারতার কোন পর্যায়ে যেতে পারে, মানুষ নাম ধারণ করার যোগ্যতা হারিয়ে ফেলা পশুর স্তরে নেমে যেতে পারে, তার ভালো উদাহরণ 'নির্বিকার মানুষ' কবিতাটি যেখানে কবি জেসাসের মতো তার স্ব-শ্রেণীর পাপ ধারণ করে অবিশ্বাস্য নির্বিকারতার সাথে বলে ওঠেনঃ

"নদীর পারের কিশোরী তার নাভির নীচের নির্জনতা
লুট করে নিক নয়টি কিশোর রাত্রিবেলা
আমার কিছু যায় আসে না,
খুনীর হাতের মুঠোয় থাকুক কুন্দকুসুম কি আসে যায়?"


কিশোরেরা কিশোরীদের ভালবাসতে না শিখে ধর্ষণ করতে শিখছে, ব্যক্তিগত আর কাঠামোগত খুনীদের হাতে জিম্মি হয়ে যাচ্ছে একটি জনপদ ও সেই জনপদের মানুষেরা, কিন্তু কবির তাতে 'কিছু যায় আসে না?' না, আবুল হাসানের ঠিকই যায় আসে, না আসলে এই কবিতা লিখতেন না তিনি। এই কবিতার 'আমার' শব্দটি নির্দেশ করে না কবিকে, করে মধ্যবিত্তকে, চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের আদি পাপ যে এখনো বয়ে বেড়াচ্ছে তার চিন্তায় ও কর্মে।

'আমি অনেক কষ্টে আছি' কবিতাটা এই মধ্যবিত্ত জীবনের প্রতি একটি প্রতিক্রিয়া। পরিপার্শ্বের মানুষ নামধারীদের নির্বিকারতা দেখে স্তব্ধ হয়ে যাওয়া কবি প্রচণ্ড কষ্ট নিয়ে লিখছেনঃ

"কথাবার্তায় দয়ালু আর পোষাকে বেশ ভদ্র মানুষ
খারাপ লাগে,
এই যে মানুষ মুখে একটা মনে একটা...
খারাপ লাগে
খারাপ লাগে"


'কুরুক্ষেত্রে আলাপ' আমার কাছে আবুল হাসানের শ্রেষ্ঠ কবিতা। মহাভারতের রহস্যময় আবহকে স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশের রক্তময় বাস্তবতায় পুনর্নির্মাণ করে তিনি লিখলেনঃ

"আমার চোয়ালে রক্ত হে অর্জুন আমি জানতাম, আমি ঠিকই জানতাম
আমি শিশু হত্যা থামাতে পারবো না, যুবতী হত্যাও নয়!

ভ্রূণহত্যা! সেতো আরো সাংঘাতিক, আমি জানতাম হে অর্জুন
মানুষ জন্ম চায় না, মানুষের মৃত্যুই আজ ধ্রুব!

(...)

ভাই পলায়নে যাবে বোন তার বাসনা হারাবে আমি জানতাম
ফুল ফুটবে না, ফুল ফুটবে না, ফুল আর ফুটবে না, ফুল আর কখনো
ফুটবে না!

বকুল-বৃক্ষদের এইভাবে খুন করা হবে সব গীতিকার পাখিদের
এইভাবে গলা, ডানা স্বরলিপি শব্দের পালকগুলি
ভেঙে দেওয়া হবে আমি জানতাম

তিতির ও ঈগল গোত্রের সব শিশুদের এইভাবে ভিক্ষুক পাগল
আর উন্মাদ বানানো হবে
ভারতীয় যুদ্ধের উৎসবে আজ এই শুধু আমাদের
ধনুক ব্যবসা,আমি জানতাম, হে অর্জুন,- আমি ঠিকই জানতাম!"


পৃথক পালঙ্ক

'পৃথক পালঙ্ক' আবুল হাসানের তৃতীয় ও শেষ কাব্যগ্রন্থ। এই কাব্যগ্রন্থটি কবি উৎসর্গ করেন তাঁর বন্ধু ও কবি সুরাইয়া খানমকে, যিনি এই কাব্যগ্রন্থের কারণেই স্মরণীয় হয়ে আছেন, আমার জানামতে একটাই কবিতার বই বেরিয়েছিলো সুরাইয়ার যদিও বইটার নাম এই মুহূর্তে মনে পড়ছে না।

'অপেক্ষা' কবিতাটি অভিনব, শুরুতে মনে হয় কবি অপেক্ষা করছেন তাঁর প্রেমিকার জন্য, পরবর্তীতে যতোই এগোতে থাকি ততোই মনে হতে থাকে এই অপেক্ষা আসলে তার সমাজে ও পৃথিবীতে একটি পরিবর্তনের জন্য। কবি আকুল হয়ে জানতে চাইছেন যে সে আসছে না, সে আসছে না, তার কত হাজার বছর লাগবে আসতে! অসাধারণ কবিতাটি শেষ হয়েছে এভাবেঃ

"জলে ও ডাঙ্গায় আমি বাঁধ দেইঃ শরীরে ঠেকাই বন্যা, প্রতিঘাত,
স্বপ্নের ভিতর স্বপ্নের বিদ্ধ করি আবার আমাকে;
তবু তুমি আসছো না, তবু তুমি আসছো না, কেন আসছো না?"


'ঝিনুক নীরবে সহো' কবিতায় তিনি লিখলেনঃ

"ঝিনুক নীরবে সহো
ঝিনুক নীরবে সহো, ঝিনুক নীরবে সহে যাও
ভিতরে বিষের বালি, মুখ বুঁজে মুক্তা ফলাও!"


অন্ধকার এক সময়ে একজন কবি এর চেয়ে ভালো উপদেশ 'ঝিনুক'-কে আর কি-ই বা দিতে পারেন!!!

'এই নরকের এই আগুন' কবিতায় কবি নরককে করে তুলতে চাইলেন কিছুটা স্বর্গীয়, এভাবেঃ

"জোড়াখুন হোক একটু ভদ্র
কবিরা লিখুক দু'এক ছত্র প্রেমের গান!

হে মেঘ, প্লাবন বৃষ্টি দাও
গলাকাটা দিন সুদূরে সরাও-
নারীর মতোন পেটে তুলে নাও সুসন্তান!

ক্ষণিক আমরা, ভালোবাসা থাক
পথে পরাজিত হাওয়া সরে যাক
পাতা ঝরাদের দলীয় ঝগড়া, অসম্মান!"


আবুল হাসান নারীবাদী ছিলেন না সম্ভবত, কারণ নারীবাদীরা পুরুষতান্ত্রিক প্রবণতা হিসেবে যা যা চিহ্নিত করেন কবিতায় তার প্রায় সবই পাওয়া যাবে আবুল হাসানের কবিতায়। কিন্তু 'পৃথক পালঙ্ক'-এর শেষের কবিতার আগের কবিতা 'সম্পর্ক'-তে তিনি লিখলেনঃ

"এখন প্রেমিক নেই, যারা আছে তারা সব পশুর আকৃতি!"

আবুল হাসানের অগ্রন্থিত কবিতা

মুহম্মদ নূরুল হুদা, ফখরুল ইসলাম রিচি আর জাফর ওয়াজেদের সম্পাদনায় আবুল হাসানের লোকান্তরিত হওয়ার দশ বছর পর, ১৯৮৫ সালে বেরিয়েছিলো 'আবুল হাসানের অগ্রন্থিত কবিতা।' এই সংকলনে রয়েছে তার অসাধারণ কয়েকটি কবিতাঃ 'আমার হবে না, আমি বুঝে গেছি', 'রহস্য প্রধান এলাকা', 'আমার সঙ্গে কোনো মেয়ে নাই মুখরতা নাই', 'পরিত্রাণ', 'আগুনে পুড়বে ভস্ম ও শৃঙ্খল', 'ভালো লাগছে, রহস্যপ্রবণ লাগছে', 'সহোদরা', 'মেগালোম্যানিয়া', 'নিঃস্ব হাঁটুরিয়া', 'প্রেমিকের প্রতিদ্বন্দ্বী', 'নিজস্ব বাংলায়', 'প্রস্থান প্রসঙ্গ', 'আমি মোহাম্মদ আলী', 'কবিতা', 'ভাঙনের শব্দ', 'প্রাচীন বসতি ছেড়ে নতুন বসতি' ইত্যাদি।

এই কবিতাগুলির কয়েকটি সরাসরি সাক্ষ্য দেয় কবির রাজনীতিমনস্ক হওয়ার। এঁদের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বলে যেটিকে বিবেচনা করি সেটি 'মেগালোম্যানিয়া', যার আজকের বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতায়ও প্রাসঙ্গিক, সেটির অংশবিশেষ উদ্ধৃত করেছিঃ

"ক্রয়যোগ্য যদি তবে কিনে ফেলবো পণ্ডিতের মাথা-
দোয়াত, কলম, কালি, ছাপাখানা, তথ্যাগার, তাবৎ দলিল,
আমার নকশায় ফুটবে ইতিহাস, ঘটনাপ্রবাহ!

(...)

তোমাদেরও কিনে ফেলবো-যদি তোমরা প্রতিবাদ করো!"


আবুল হাসান বিপ্লবী কবি ছিলেন না, আবার 'বিষন্নতা কবি' বা 'নির্জনতার কবি'-ও ছিলেন না তিনি, তিনি ছিলেন আমাদের ইতিহাসের অত্যন্ত অন্ধকার এক সময়ের, স্বপ্নভঙের কালের, এক অসহায় কণ্ঠস্বর। তিনি সক্রিয় রাজনীতিতে জড়াননি তাঁর বন্ধু ও কবি হুমায়ুন কবিরের মতো, যেই হুমায়ুন কবির 'বেঈমানির' অভিযোগে খতম হয়ে গিয়েছিলেন তাঁর পার্টির কমরেডদের হাতেই, যদিও অনেকে মনে করেন সর্বহারা পার্টি খতমের সিদ্ধান্তটা বাতিল করলেও যাঁদের দেওয়া হয়েছিলো খতমের দায়িত্ব তাঁদের কাছে খতমের সিদ্ধান্ত বাতিল করার নতুন বার্তাটা পৌঁছেনি। কিন্তু আবুল হাসান রাজনীতিবিমুখ ছিলেন না, খুব গভীরভাবেই ছিলেন রাজনীতিমনস্ক, আর তা ছিলেন বলেই তাঁর কবিতায় কান পেতে রইলে শোনা যাবে তাঁর সমসময়ের বাংলাদেশের কান্নার সিম্ফনি।

নোটঃ লেখাটির জন্য ব্যবহার করেছি 'বিদ্যাপ্রকাশ' কর্তৃক প্রকাশিত 'আবুল হাসান রচনা সমগ্র'।
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে মে, ২০১৩ বিকাল ৪:৩৯
৮টি মন্তব্য ৬টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

খুন হয়ে বসে আছি সেই কবে

লিখেছেন জিএম হারুন -অর -রশিদ, ০৭ ই মে, ২০২৪ রাত ২:৩১


আশেপাশের কেউই টের পাইনি
খুন হয়ে বসে আছি সেই কবে ।

প্রথমবার যখন খুন হলাম
সেই কি কষ্ট!
সেই কষ্ট একবারের জন্যও ভুলতে পারিনি এখনো।

ছয় বছর বয়সে মহল্লায় চড়ুইভাতি খেলতে গিয়ে প্রায় দ্বিগুন... ...বাকিটুকু পড়ুন

জাম গাছ (জামুন কা পেড়)

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ০৭ ই মে, ২০২৪ সকাল ৯:০৩

মূল: কৃষণ চন্দর
অনুবাদ: কাজী সায়েমুজ্জামান

গত রাতে ভয়াবহ ঝড় হয়েছে। সেই ঝড়ে সচিবালয়ের লনে একটি জাম গাছ পড়ে গেছে। সকালে মালী দেখলো এক লোক গাছের নিচে চাপা পড়ে আছে।

... ...বাকিটুকু পড়ুন

অনির্বাণ শিখা

লিখেছেন নীলসাধু, ০৭ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:৩১



রাত ন’টার মত বাজে। আমি কি যেন লিখছি হঠাৎ আমার মেজো মেয়ে ছুটতে ছুটতে এসে বলল, বাবা একজন খুব বিখ্যাত মানুষ তোমাকে টেলিফোন করেছেন।

আমি দেখলাম আমার মেয়ের মুখ উত্তেজনায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

=ইয়াম্মি খুব টেস্ট=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ০৭ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:১৪



©কাজী ফাতেমা ছবি
সবুজ আমের কুচি কুচি
কাঁচা লংকা সাথে
ঝালে ঝুলে, সাথে চিনি
কচলে নরম হাতে....

মিষ্টি ঝালের সংমিশ্রনে
ভর্তা কি কয় তারে!
খেলে পরে একবার, খেতে
ইচ্ছে বারে বারে।

ভর্তার আস্বাদ লাগলো জিভে
ইয়াম্মি খুব টেস্ট
গ্রীষ্মের... ...বাকিটুকু পড়ুন

এশিয়ান র‍্যাংকিং এ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান !!

লিখেছেন ঢাবিয়ান, ০৭ ই মে, ২০২৪ রাত ৮:২০

যুক্তরাজ্যভিত্তিক শিক্ষা সাময়িকী 'টাইমস হায়ার এডুকেশন' ২০২৪ সালে এশিয়ার সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকা প্রকাশ করেছে। এশিয়ার সেরা ৩০০ তালিকায় নেই দেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়।তালিকায় ভারতের ৪০, পাকিস্তানের ১২টি, মালয়েশিয়ার ১১টি বিশ্ববিদ্যালয়... ...বাকিটুকু পড়ুন

×