somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

সংক্ষিপ্ত যাত্রা বিরতি

১৫ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৩ রাত ৮:২৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

৪ বছর পর নিজের একমাত্র মেয়েকে দেখছে সোহানা। মেয়ের সাথে এভাবে দেখা হয়ে যাবে এটা কল্পনাও করেনি ও। রাত একটায় ঢাকা এয়ারপোর্টে ল্যান্ড করেছে ওরা। এয়ারপোর্ট থেকে সোজা গ্রামের বাড়ি নাটোরের দিকে রওনা দিয়েছিলো। এয়ারপোর্টে তাড়াহুড়ার কারনে ফ্রেশ হতে পারেনি আর তাছাড়া দীর্ঘ জার্নির পর পেটের ভেতর যেন ইদুর দৌড়াচ্ছিল! তাই যমুনা ব্রিজ পার হয়ে হাই ওয়ের পাশের এই হোটেলটাই থামিয়েছে ওদের গাড়ি। বেশ বড়সড়ো হোটেল, এই ভোর রাতেও মানুষ গম গম করছে। বড় বড় বাস এসে ঢুকছে, পিঁপড়ার মত পিল পিল করে মানুষ বের হচ্ছে সেই সব বাস থেকে! কত রকম মানুষ! কারো চোখে ঘুম, কেউ বা বিরক্ত, কেউ কেউ আবার ওয়াশ রুমের দিকে দৌড় দিচ্ছে। গাড়ি থেকে নেমে হোটেলের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে ওরা। ওরা মানে ও, জামিল, ওদের ছেলে রেহান আর ওদেরকে নিতে আসা মেজ মামা। বয়সের তুলনাই রেহান খুবই দুষ্টু আর দুরন্ত প্রকৃতির। চারিদিকে এত শব্দ আর মানুষের ভিড়ে রেহানের হাত ধরে না রাখলে যে কোন সময় হারিয়ে যাবে! এত কিছুর মধ্যে একটা বাচ্চা মেয়ের খিল খিল হাসির শব্দ কানে বেজে উঠলো সোহানার! খুব চেনা হাসিটা...খুবই চেনা, ওর একমাত্র মেয়ে হিয়ার হাসি। নিজের কানকেই বিশ্বাস করতে পারছিলো না! হাসির উৎসের সন্ধানে বাঁ দিকে তাকাতেই দেখলো ও ভুল শোনেনি। ওটা সত্যিই হিয়ার হাসি। হিয়া, ওর প্রথম সন্তান।

কত বড় হয়ে গেছে মেয়েটা! ওর বাবার সাথে বসে আছে চেয়ারে পা ঝুলিয়ে। দুজনের হাতেই কোন আইসক্রিম। হিয়ার বাবা একেকবার আইসক্রিমে কামড় দিচ্ছে আর চোখ বন্ধ করে গালে হাত দিয়ে দাঁতে ব্যাথা পাওয়ার অভিনয় করছে। আর সেটা দেখে মেয়েটা হেসেই কুটিকুটি! বাবা আর মেয়ের এই কাণ্ড আসেপাশের সবাই বেশ উপভোগ করছে। হিয়া অবিকল পুতুলের মত দেখতে। সবাই ওকে আদর করে প্রিন্সেস বলে ডাকে। এতদিন পর মেয়েকে দেখে কি করবে ঠিক বুঝতে পারছে না সোহানা। ওর খুব ইচ্ছা করছে দৌড় দিয়ে যেয়ে হিয়াকে বুকের ভেতর জড়িয়ে ধরে, চুমুই চুমুই ভরিয়ে দেয় ছোট্ট মুখটা! কিন্তু ওর পা দুটো যেন ফ্লোরের টাইলসের সাথে আটকে আছে! মনের ভেতর প্রচণ্ড তোলপাড় হচ্ছে! গত চারটা বছর প্রতিটা মুহূর্ত হিয়ার কথা মনে করে কষ্ট পেয়েছে ও। প্রায় রাতেই ঘুম ভেঙ্গে গেলে চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছা হত। কিন্তু ছেলে আর স্বামীর ঘুম ভেঙ্গে যাওয়ার ভয়ে কাঁদতেও পারেনি। অনেক বার চেষ্টাও করেছে ফোনে হিয়ার সাথে একটু কথা বলার জন্য। কিন্তু রাশেদের সব নাম্বারই বন্ধ পেয়েছে। বাসায় লোক পাঠিয়েছিলো, কিন্তু বাসা চেঞ্জ করে ওরা কোথায় গেছে সেটা পরিচিত কেউ বলতে পারেনি। অথচ এখন এই হোটেলে চোখের সামনে হিয়াকে দেখে নিজেকে নিকৃষ্ট অপরাধীর মত লাগছে সোহানার। হিয়াকে ওর বাবার কাছে রেখে জামিলের হাত ধরে যখন জার্মানি চলে গেছিলো সোহানা হিয়ার বয়স তখন মাত্র দুই বছর। কিন্তু তখন সেটা ছাড়া আর উপায় ছিলো না ওর হাতে!

একটা মিসকলের সুত্র ধরে জামিলের সাথে পরিচয় হয়। পরিচয় থেকে ফোনে কথা তারপর একসময় দেখা। মনের অজান্তেই জামিলকে ভালো লেগে গিয়েছিলো প্রথম দিনই। আর সেই ভালোলাগা ভালোবাসাতে পরিণত হতে সময় লাগেনি বেশী দিন। হিয়ার বাবা রাশেদের ঠিক উল্টা চরিত্র জামিল। শান্ত, কথা কম বলে আর সব কিছুতেই একটা কেয়ারিং ভাব আছে। একটা সময় রাশেদের সাথে থাকতে অসহ্য লাগা শুরু করে ওর। সারাক্ষণ মেজাজ খিটখিটে হয়ে থাকতো, কিছু ভালো লাগতো না। বিশেষ করে রাতের বেলা রাশেদ যখন শারীরিক মিলনের জন্য কাছে টানতো তখন প্রচণ্ড ঘৃণা লাগতো! গাঁ গুলিয়ে উঠতো ওর! একটা রক্ত মাংসের পিণ্ড হয়ে পড়ে থাকতো বিছানায়। এত দিন এক সাথে সংসার করেও রাশেদকে তখন মনে হত অচেনা কোন মানুষ যে কোন রকম অধিকার ছাড়াই তার দেহে বিচরন করছে! অবশেষে নিজের সাথে অনেক যুদ্ধ করে সিদ্ধান্ত নেয় হিয়ার বাবার সাথে আর থাকবে না সে। যেখানে ভালবাসা নেই সেখানে বেঁচে থাকা যায় না। তাই এক বিকেলে হিয়ার বাবার অফিস থেকে ফেরার কিছু আগে হিয়াকে ল্যাপটপে কার্টুন দেখতে বসিয়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে গিয়েছিলো সোহানা। যাওয়ার আগে মেয়ের কপালে শেষ একটা চুমু দিয়েছলো। ছোট্ট হিয়া তখন বুঝতেও পারেনি মায়ের আদর তার ভাগ্যে আর জুটবে না। আগেই ওর আর জামিলের পাসপোর্ট ভিসা রেডি ছিলো। তারপর সোজা জার্মানি, আবার বিয়ে, সংসার...বছর ঘুরতেই রেহানের জন্ম হলো। একটু একটু করে মনের মত ঘুছিয়ে নিলো ওরা সব কিছু।

হিয়াকেও সাথে করে নিয়ে আসতে পারতো সোহানা। কিন্তু মায়ের চেয়ে বাবাকেই বেশী ভালবাসতো হিয়া। বাবার সাথে এক অদ্ভুত সম্পর্ক মেয়েটার। ওর বাবার ঘড়ি, মোবাইল, ল্যাপটপ কোন কিছুতে হাত দিলে ধমক দিয়ে বলতো, "ঐ, বাবা বকপে! রাখো! হাত দিও না, হাত দিও না! বাবা, ছব নিয়ে নিচ্চে!" অফিস থেকে ওর বাবা ফিরলেই লাফ দিয়ে কোলে উঠে যেত। তারপর ভাঙ্গা ভাঙ্গা বাক্যে বাবাকে সারাদিনের গল্প শোনাত। রাতে বাবার গায়ে গা ঘেঁষে না শুলে ঘুমাত না। বাবার প্রতি হিয়ার ভালোবাসা দেখে ওকে আর ওর বাবার কাছ থেকে আলাদা করতে পারেনি। বুকে বিশাল পাথর চাপা দিয়ে কঠিন সিদ্ধান্তটা নিতে হয়েছিলো সোহানাকে।

"চাঁপাই-রাজশাহী থেকে ছেড়ে আসা ঢাকাগামী হানিফ এন্টারপ্রাইজের সম্মানিত যাত্রীবৃন্দ, আপনাদের ২০ মিনিটের সংক্ষিপ্ত যাত্রা বিরতি শেষ। অনুগ্রহ করে আপনারা নিজ নিজ সিটে আসন গ্রহণ করুন। আর অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দিবো। চাঁপাই-রাজশাহী থেকে ছেড়ে আসা......।"

কিছুক্ষণের জন্য অতীতে চলে গিয়েছিলো সোহানা, কিন্তু হঠাৎ লাউড স্পিকারের কর্কশ শব্দ ওকে বাস্তবে ফিরিয়ে আনলো। সম্ভবত এই বাসেই যাচ্ছে হিয়া আর ওর বাবা। এতক্ষণে ওদের আইসক্রিম শেষ। আর বসে থাকতে পারলো না সোহানা, ছুটে যেয়ে হিয়াকে কোলে তুলে নিলো। নিজের নাড়ি ছেঁড়া সন্তানকে এত বছর পর পেয়ে আনন্দে কখনো হেসে উঠলো, আবার কখনো কেঁদে উঠলো। সোহানার এরকম আচরন দেখে সবাই অবাক! কিন্তু হিয়া ছিটকে তার মার কাছ থেকে সরে গেলো। বাবাকে জড়িয়ে ধরে প্রচণ্ড রাগে চিৎকার করে বলতে লাগলো, "তুমি চলে যাও, তুমি চলে যাও! তুমি আমাদের কেউ না! তুমি আমাকে কোলে নিবা না! বাবা চলো, এখানে আমরা থাকবো না...চলো!"

এত দিন পর মেয়েকে কাছে পেয়েও মেয়ের মুখে এই কথা শুনে সোহানা পুরাই স্তব্ধ হয়ে গেলো! ছয় বছরের একটা বাচ্চার ক্রোধ আর অভিমানের কাছে নিজেকে তুচ্ছ মনে হতে লাগলো ওর। যখন হিয়ার মাকে সব চেয়ে বেশী দরকার ছিলো, তখন সে ওকে ছেড়ে চলে গিয়েছিলো নিজের পাওয়া না পাওয়ার হিসাব মেলানোর জন্য। বড়্ স্বার্থপরের মতো আচরন করেছে সে নিজের মেয়ের সাথে। মায়ের ভালবাসা থেকে বঞ্চিত করার শাস্তি হিসাবে আজ তাই ওকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতে হচ্ছে হিয়া আর রাশেদের চলে যাওয়া।

শেষ রাতের ঘোলাটে অন্ধকারে মেয়েকে কোলে নিয়ে বাসের দিকে হাটা শুরু করলো রাশেদ। হিয়া তখনো মায়ের দিকে তাকিয়ে, হিয়ার চোখে তখনো জ্বল জ্বল করছে ক্রোধ আর অভিমান।

উৎসর্গ: সেই সব হিয়াদের উদ্দেশ্যে বাবা-মায়ের একটা ভুলের জন্য যাদের শৈশব-কৈশোরের আনন্দ হারিয়ে গেছে।
২০টি মন্তব্য ১৮টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

মব রাজ্যে উত্তেজনা: হাদির মৃত্যুতে রাজনৈতিক পরিস্থিতি অগ্নিগর্ভ

লিখেছেন কলিমুদ্দি দফাদার, ১৯ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সন্ধ্যা ৬:৪২

রোম যখন পুড়ছিল নিরো নাকি তখন বাঁশি বাজাচ্ছিল; গতরাতের ঘটনায় ইউনুস কে কি বাংলার নিরো বলা যায়?



বাংলাদেশ প্রেক্ষাপটে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পদটি সবসময় ছিল চ্যালেঞ্জিং।‌ "আল্লাহর... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইন্টেরিম সরকারের শেষদিন : গঠিত হতে যাচ্ছে বিপ্লবী সরকার ?

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ২০ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:২২


ইরাক, লিবিয়া ও সিরিয়াকে ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত করার আন্তঃদেশীয় প্রকল্পটা সফল হতে অনেক দিন লেগে গিয়েছিল। বাংলাদেশে সে তুলনায় সংশ্লিষ্ট শক্তিসমূহের সফলতা স্বল্প সময়ে অনেক ভালো। এটা বিস্ময়কর ব্যাপার, ‘রাষ্ট্র’... ...বাকিটুকু পড়ুন

মব সন্ত্রাস, আগুন ও ব্লাসফেমি: হেরে যাচ্ছে বাংলাদেশ?

লিখেছেন শ্রাবণধারা, ২০ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৩:৫২


ময়মনসিংহে হিন্দু সম্প্রদায়ের একজন মানুষকে ধর্মীয় কটূক্তির অভিযোগে পুড়িয়ে মারা হয়েছে। মধ্যযুগীয় এই ঘটনা এই বার্তা দেয় যে, জঙ্গিরা মবতন্ত্রের মাধ্যমে ব্লাসফেমি ও শরিয়া কার্যকর করে ফেলেছে। এখন তারই... ...বাকিটুকু পড়ুন

তৌহিদি জনতার নামে মব সন্ত্রাস

লিখেছেন কিরকুট, ২০ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১১:৫৪




ছবিঃ অনলাইন থেকে সংগৃহীত।


দেশের বিভিন্ন স্থানে সাম্প্রতিক সময়ে ধর্মের নাম ব্যবহার করে সংঘটিত দলবদ্ধ সহিংসতার ঘটনা নতুন করে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। বিশেষ করে তৌহিদি জনতা পরিচয়ে সংঘবদ্ধ হয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুখ গুজে রাখা সুশীল সমাজের তরে ,,,,,,,,

লিখেছেন ডঃ এম এ আলী, ২০ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৪:০৫


দুর্যোগ যখন নামে আকাশে বাতাশে আগুনের ধোঁয়া জমে
রাস্তা জুড়ে কখনো নীরবতা কখনো উত্তাল প্রতিবাদের ঢেউ
এই শহরের শিক্ষিত হৃদয়গুলো কি তখনও নিশ্চুপ থাকে
নাকি জ্বলে ওঠে তাদের চোখের ভেতর নাগরিক বজ্র
কেউ কেও... ...বাকিটুকু পড়ুন

×