সাইকেল বা বাইসাইকেল বলতে আমাদের চোখে যে চিত্রটি ভেসে ওঠে তা হল দুইটা চাকা, প্যাডেল, চেইন, হ্যান্ডেল আর সিট। কিন্তু আজ আমরা যে বাইসাইকেল চিনি বা চালাই তা কিন্তু একদিনে এরকম রূপে তৈরি হয়নি। যুগে যুগে মানুষের হাতে কাঠ থেকে শুরু করে লোহা, অ্যালুমিনিয়াম, স্টিল, রাবারসহ বিভিন্ন ধাতুর সমন্বয়ে পরিবর্তিত হতে হতে আমরা আধুনিক যুগের বাইসাইকেল পেয়েছি।
বর্তমান শহরকেন্দ্রিক জীবনে বাইসাইকেল সবচেয়ে সাশ্রয়ী এবং স্বাস্থ্যসম্মত বাহন হিসাবে স্বীকৃত হয়ে আসছে। নারী, পুরুষ, শিশু যে কোন বয়সের মানুষ আজ স্বাধ ও সাধ্যের মধ্যে বাইসাইকেল কিনে সময় এবং অর্থ সাশ্রয় করতে পারছে, অন্যদিকে স্বাস্থ্য সুফলও পাচ্ছে। শহরে যানজট নিরসনেও বাইসাইকেল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। এছাড়াও জৈব জ্বালানী ব্যবহারের পরিমাণ কমাতে বাইসাইকেলের ভূমিকা না বললেই নয়। বাইসাইকেলকে তাই বলা হয় গ্রীণ ট্রান্সপোর্ট বা সবুজ পরিবহন।
বাইসাইকেলের ইতিহাস নিয়ে এমনিতেই বিতর্কের শেষ নাই! একেক জন একেক ভাবে একেক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে বাইসাইকেলের ইতিহাসকে বর্ণনা করেছে। কোথাও বলা হয়েছে ৬০০ বছর আগে সাইকেলের মতো বাহন ছিল। আবার কারো কারো মতে ২০০ বছর আগে প্রচলন শুরু হয় সাইকেলের। বাংলা ইন্টারনেট জগতে সাইকেলের ইতিহাস নিয়ে বেশ কিছু তথ্য সমৃদ্ধ লেখনী আছে। তা স্বত্বেও একজন সাইক্লিস্ট হিসাবে সাইকেলের ইতিহাস লেখালেখিটা অনেক দিন পর ব্লগে ফিরে আসার একটা প্রয়াস বলতে পারেন।
লিভসাইন্স ডট কমের সহযোগী সম্পাদক এলিজাবেথ পালের্মো এক প্রবন্ধে উল্লেখ করেছেন, চাকা চালিত প্রথম বাহন তৈরি করা হয় সাইকেলের আধুনিক রূপ আসার বহু আগে। ১৪১৮ সালে ইটালিয়ান ইঞ্জিনিয়ার জিওভান্নি ফন্টানা প্রথম মানবচালিত ৪ চাকা এবং গিয়ারের সাথে আটকানো দড়ি বিশিষ্ট বাহন আবিষ্কার করেন। (সূত্রঃ ইন্টারন্যাশনাল বাইসাইকেল ফান্ড)
চিত্রঃ জিওভান্নি ফন্টানার বাহন।
ফন্টানার বাহনটি আধুনিক বাইসাইকেলের মতো দেখতে না হলেও মূলত দড়ির সাথে গিয়ার আটকানোর কায়দা আর চাকার ব্যবহারই আজকের বাইসাইকেল আবিষ্কারের অনুপ্রেরণা হিসাবে ধরা হয়।
প্রখ্যাত সাইক্লিস্ট এবং লেখক ডেভিড ফিল্ডার তার এক প্রবন্ধে লিখেছেন, কাছাকাছি বাইসাইকেলের মতো দেখতে এমন বাহন প্রথম তৈরি করেন ফ্রান্সের শ্যাঁতে মি ডি সিভ্রস, ১৭৯০ সালে। এটা কাঠের ফ্রেমের সাথে একই মাপের কাঠের চাকা আটকানো এমন একটা বাহন ছিল যার কোন হ্যান্ডেল কিংবা প্যাডেল ছিল না।
ছবিঃ স্রেলেফা
ফরাসী ভাষায় স্রেলেফা নামের এই বাহনে বসে চালককে পা দিয়ে ঠেলা দিতে হতো। তারপর কিছুটা গতিপ্রাপ্ত হলে পা তুলে ভারসাম্য রক্ষা করে বসে থাকতে হতো, অনেকটা গ্লাইডারের মতো। স্রেলেফাকে প্রথম অ্যানিমাল ফ্রি বাহনও বলা হয়।
জিওভান্নি ফন্টানার বাহন তৈরির ৪০০ বছর পর ১৮১৭ সালে জার্মানীর কার্ল ভন ডেভিস স্রেলেফার একটি উন্নত সংস্করন তৈরি করেন যেটার সামনের চাকার সাথে স্টিয়ারিং মেকানিজম বা হ্যান্ডেল লাগানো ছিল। ডেভিস নিজের নামের সাথে মিল রেখে এর নাম রেখেছিল ড্রেসিয়ান। লোকে অবশ্য মজা করে একে ‘শখের ঘোড়া’ বলেও ডাকতো।
ছবিঃ কার্ল ভন ডেভিসের সাইকেল ড্রেসিয়ান।
কার্ল ভন ডেভিস ১৮১৮ সালে প্যারিসে তার বাইসাইকেলটি প্রদর্শনীর মাধ্যমে সবার সামনে উন্মুক্ত করেন। তবে এর ডিজাইনের সীমাবদ্ধতার কারনে সমান, সোজা এবং চওড়া রাস্তা ছাড়া এটা চালানো কঠিন ছিল। ড্রেসিয়ানকে অনেকে ড্যান্ডি হর্স বলতো।
টেকনিক্যালি দুই চাকার বাইসাইকেলের ইতিহাসের অংশ না হলেও ১৮২০ থেকে ১৮৫০ সালের মধ্যে আবিষ্কার হওয়া মানবচালিত বাহন গুলোর কথা না বললেই নয়। কার্ল ভন ডেভিসের বাইসাইকেলের মতো ব্যালান্স করার ব্যাপারটা না থাকলেও তিন চাকা (ট্রাইসাইকেল) অথবা চার চাকা (কোয়াড্রাসাইকেল) বিশিষ্ট এই বাহন গুলোতে প্যাডেল, চেইন, গিয়ার ইত্যাদির ব্যবহার ছিল। এই বাহন গুলো অতিরিক্ত ওজন, উচ্চতাম ঘর্ষণজনিত সমস্যার কারনে অতটা জনপ্রিয় হয়ে ওঠেনি প্রথম দিকে।
ছবিঃ কোয়াড্রাসাইকেল।
তবে ১৮৫০ সালে ইংল্যান্ডের উইলার্ড সয়্যার সফল ভাবে ৪ চাকা বিশিষ্ট কোয়াড্রাসাইকেল তৈরি করেন। যা পরবর্তীতে সারা বিশ্বে রপ্তানী হয়। (সূত্রঃ বাইসাইকেল: দি হিস্টরি; ডেভিড ভি হার্লি)
অনেক ইতিহাসবিদের মতে আবার প্যাডেল চালিত বাইসাইকেল আবিষ্কার করেন কার্কপ্যাট্রিক ম্যাকমিলান (১৮১২-১৮৭৮)। তিনি ছিলেন একজন স্কটিশ কামার। ১৮৩৯ সালের দিকে তিনি খেয়াল করেন যে লোকে বাইসাইকেল চালাচ্ছে পা দিয়ে ঠেলে। ম্যাকমিলান ভাবতে লাগলেন পায়ের বিকল্প অন্য কি করা যায়!
ছবিঃ কার্কপ্যাট্রিক ম্যাকমিলানের সাইকেল।
পরবর্তীতে নিজের পরিবারের সদস্যদের নিয়ে একাধিক গবেষণা করার পর প্রথম প্যাডেল সমৃদ্ধ বাইসাইকেল তৈরি করেন। এই বাইসাইকেল পা দিয়ে ঠেলে চালানো সাইকেলের চেয়ে অনেক আরামদায়ক ছিল। গবেষণালব্ধ জ্ঞান আর কামারের যন্ত্রপাতি কাজে লাগিয়ে ম্যাকমিলান এমন এক বাইসাইকেল আবিষ্কার করেন যা বাইসাইকেলের অগ্রযাত্রায় এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ হিসাবে চিহ্নিত করা যায়।
ম্যাকমিলানের বাইসাইকেলের ফ্রেম কাঠের হলেও এর কাঠের চাকার ভেতরে লোহার রিম ছিল। সামনের চাকার ডায়ামিটার ছিল ৩০ ইঞ্চি, যার সাথে ছোট একটা হ্যান্ডেল ছিল। আর পেছনের ৪০ ইঞ্চি চাকার সাথে লাগানো ছিল প্যাডেল। বাইসাইকেলটি সেই সময় জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। কার্কপ্যাট্রিক ম্যাকমিলান নিজে ৬৮ মাইল বাইসাইকেল চালিয়ে যখন তার ভাইয়ের বাড়িতে গেলেন তখন এই বাইসাইকেলটি আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়। বিভিন্ন কোম্পানীর এই বাইসাইকেলের কপি তৈরি করে বাজারে বিক্রি শুরু করে।
১৮৪৫ সালে গ্যাভিন ড্যালজেল নামের একজন ব্যবসায়ী ম্যাকমিলানের বাইসাইকেলের মতো একটি কপি তৈরি করেন। যদিও ড্যালজেল কখনোই নিজেকে আবিষ্কারক হিসাবে দাবী করেননি। গ্লাসগো মিউজিয়াম অফ ট্রান্সপোর্টে ড্যালজেলের সাইকেলের একটি রেপ্লিকা আছে।
ছবিঃ ড্যালজেলের সাইকেল।
এই বাইসাইকেলটিকে বিশ্বের সবচেয়ে পুরাতন বাইসাইকেল বলা হয়। ১৮৬৩ সালে আর্নেস্ট ম্যাশাঁও প্রথম বানিজ্যিক ভাবে সফল সাইকেল তৈরি করেন। তবে লোহার চাকা আর শক্ত কাঠামোর কারনে এই সাইকেল প্রচুর ঝাঁকি খেতো! মজা করে একে ‘হাড় কাঁপানি’ও বলা হতো।
ছবিঃ হাই হুইলার বাইসাইকেল।
ব্রিটিশ ইঞ্জিনিয়ার জেমস স্টেয়ারলি ১৮৬৬ সালে হাই হুইলার সাইকেল আবিষ্কার করেন। তবে অতিরিক্ত উচ্চতার কারনে এই হাই হুইলার তেমন জনপ্রিয়তা পায়নি। হাই হুইলার বাইসাইকেল তৈরির মাধ্যমেও প্রথম উপলব্ধি হয় যে চাকার ব্যাস বৃদ্ধির সাথে সাথে বাইসাইকেলের গতিও বৃদ্ধি পায়। একই বছর আমেরিকায় পিয়েরে লেলমেন্ট নামের এক ব্যাক্তি প্রথম বাইসাইকেলের প্যাটেন্ট করান।
১৮৬৮ সালে ক্লিমেট এডার রাবারের চাকার বাইসাইকেলের প্যাটেন্ট করান। ১৮৬৯ সালে ইংল্যান্ডের ট্রিডল বাইসাইকেল কোম্পানী প্যাডেল চালিত বাইসাইকেল উৎপাদন শুরু করে। ১৮৭৬ সালে ইংরেজ আবিষ্কারক ব্রোয়েট এবং হ্যারিসন বাইসাইকেলের ব্রেকের প্যাটেন্ট করান। (সূত্রঃ বাইসাইকেল: দি হিস্টরি; ডেভিড ভি হার্লি)
১৮৭৯ সালে হেনরি জে লসন পেছনের চাকার সাথে চেইন যুক্ত বাইসাইকেলের প্যাটেন্ট করান। তবে আধুনিক সাইকেলের যে রূপটি আমরা দেখে অভ্যস্ত তা আবিষ্কার করেন জন কেম্প স্টেয়ারলি।
ছবিঃ রোভার সেফটি বাইসাইকেল।
১৮৮৫ সালে আবিষ্কৃত স্টেয়ারলির এই বাইসাইকেলের ছিল সামনে পেছনে সমান দুটি চাকা, নীচু সিট আর শক্ত লোহার চেইন। এই বাইসাইকেলকে রোভার সেফটি বাইকও বলা হতো। লোহার রিমের উপর রাবারের চাকা ব্যবহারের ফলে এই বাইসাইকেল চালাতে কম শক্তির প্রয়োজন হতো। এছাড়াও এসময় উৎপাদন পদ্ধতির উন্নয়নের সাথে বাইসাইকেলের দামও কমতে শুরু করে। (সূত্রঃ ইভেলো ডট কম)
মোটামোটি বলা যায় উপরের ঘটনাগুলোর আবর্তে বাইসাইকেলের সোনালী যুগের শুরু হয়। সাধারণ মানুষ অবসর সময়ে বিনোদনের পাশাপাশি বাস্তবিক অর্থেও যানবাহন হিসাবে বাইসাইকেল চালানো শুরু করে। বর্তমানে বাজারে বিভিন্ন ধরণের বাইসাইকেল পাওয়া যায়। ব্যবহারের ধরণ অনুযায়ী সাইকেলকে নানা ভাগে ভাগও করা যায়। এই সাইকেল গুলোতে ১ থেকে ৩৩টি গিয়ার থাকতে পারে। হাইড্রোলিক ব্রেক, শক অ্যাবজরভার, লাগেজ ক্যারিয়ারের মতো অনেক আধুনিক সুবিধা যুক্ত হয়েছে বাইসাইকেলে।
ছবিঃ বিভিন্ন ধরণের বাইসাইকেল।
কোন কোন বাইসাইকেল ফোল্ড বা ভাঁজ করে বক্সে-ব্যাগে করেও বহন করা যায়। একসময় যে সাইকেলকে নারী স্বাধীণতার প্রতীক মনে করা হতো তা এখন সার্বজনিন ভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। বিশ্বাস করবেন কিনা জানি না, সারাবিশ্বে যে পরিমাণ গাড়ি আছে সাইকেল আছে তার দ্বিগুণ! প্রতিবছর সারাবিশ্বে ১০০ মিলিয়নেরও বেশি বাইসাইকেল উৎপাদিত হচ্ছে। এসব সাইকেল তৈরি হচ্ছে অ্যালুমিনিয়াম, টাইটেনিয়াম, কার্বন ফাইবার কিংবা কখনো কখনো বাঁশের মতো প্রাকৃতিক উপাদান ব্যবহার করে। বিশ্ব জুড়ে সাইক্লিংকে উৎসাহিত করা হচ্ছে একটি সবুজ পৃথিবীর জন্য।
আসুন বাইসাইকেল চালাই, পরিবেশকে দূষণের হাত থেকে রক্ষা করি, সময় এবং অর্থ দুটোই সাশ্রয় করি। হ্যাপ্পি সাইক্লিং!
বিঃ দ্রঃ বাইসাইকেল চালান বা মোটরসাইকেল, হেলমেট পরতে ভুলবেন না।
হাতে সময় থাকলে এটাও পড়ে ফেলতে পারেনঃ সিগারেটের ইতিহাস
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই অক্টোবর, ২০১৭ ভোর ৬:০৫