বেড়ীবাধ দিয়ে অনেকটা সময় হাটছি। বুদ্ধিজীবি শহীদ মিনার থেকে একটা রিক্সা নিয়ে ভাবলাম আর ফিরবো না কখনো। চলতে থাকবো যতক্ষণ শ্বাস চলছে। মাথার চুল গুলো সব এলো মেলা, বিশালতা দিয়ে ঢাকতে চাইছে আমার চোখ। চুলগুলোর ইচ্ছা যেনো আমি একটু চোখ বন্ধ করি, দেখি একটা সুন্দর স্বপ্ন।
না, আমি তা করবো না।
নিজের উপর প্রচন্ড রাগ।ভাগ্যটাকে কেনো পাল্টাতে পারি না? রিক্সা ওয়ালা টানছে তো টানছেই তার রিক্সা, সামনে রাস্তা নস্ট, বায়ে শুকিয়ে যাওয়া তুরাগ নদী, চলছে ছোট বড় ট্রলার সাথে ছোট খাটো ব্যাস্ততা। আমি রিক্সা থেকে হুট করে নেমে পড়লাম, ভাড়া চুকিয়ে হাটা শুরু করলাম। হাটতে হাটতে থাকি একা একা, পাশ দিয়ে কিছু দলবেধে পোলাপান অথবা একা একা দিনমজুর হেটে চলেছে আপন মনে। পাশ দিয়ে চলে যায় প্রচন্ড গতির গাড়ী। রাস্তার পাশে দাড়িয়ে থাকা কড়ই গাছ গুলো সাড় বেধে মাথা নত দাড়িয়ে আছে, বোধ হয় আছরের নামাজ পড়বে দলবেধে। আমি হাসি, কারন আমার প্রার্থনা কবুল হয় না যেখানে গাছেদের প্রার্থনার অনেক মূল্য!
গত কাল রাতে স্বপ্ন দেখেছিলাম, ঠিক এখানটায় হাটছি ওর পাশ দিয়ে। ও মিটি মিটি হাসছে আর কি যেনো বলছে, আমি বুঝতে পারছি না। এক দৃস্টিতে দেখছিলাম সবুজ শাড়িতে ওকে কত সুন্দরই না দেখায়! বসন্তে কৃষ্ঞচূড়ায় আগুন ধরে আর আমার স্বপ্নে আগুন ধরেছে কপালের নীল টিপে। ভাবলাম আমার সাথে অপসরী হাটছে।
সকালে উঠেই খুব করে প্রার্থনা করলাম, অশ্রুগুলোয় আমার শার্ট ভিজে গেলো। মন চাইলো একটা ফোন দেই: ওর ওয়ারিদ নম্বর বন্ধ। ভাবলাম বাসার টিএন্ডটিতে ফোন দেই, পরক্ষণে ভাবলাম না থাক। যদি কপালে থাকে তাহলে এমনি পাবো তাকে, নইলে নয়।
এখনও হাটছি এ পথ দিয়ে, শুধু পার্থক্য একটাই, আমি একা। একটা জায়গায় বসলাম, খুজতে থাকলাম স্বপ্নের অলিগলি। না কেউ নেই, শুধু মোড়ে মোড়ে ওর ছবি। সূর্য্যটা রক্তিম নীলাভ দূরের সবুজ গ্রামে মুখ লুকাতে চায়। আর যতই সে মুখ লুকাতে চায় ততই তাকে সুন্দর দেখায়।
মায়া, পৃথিবীটা একটা বিশাল মায়ার জগৎ।
একটা ফোন আসলো
: তুমি কই?
: বেড়ীবাধে।
: ঐখানে কি করস? নৌকায় নাকি? কার সাথে?
: রাস্তার পারে বসে আছি, বাতাস খাচ্ছি।
: ওখানেই দাড়া, আমি আসছি!
রাসেল সেদিন এসেছিলো। রাতে ওর ফ্লাইট। একসাথে দুজন বসেছিলাম।
ও ওর গল্প বললো।
ক্লাস ফাইভে থাকতে ওর একবার হাত ভেঙ্গেছিলো। আম গাছে উঠে একটা আম লাফ দিয়ে ধরতে চেয়েছিলো। নীচে ধপাস করে পড়ে হাত ভেঙ্গে গেলো, শরীরের কোথাও কিছু হলো না। এখন ও বুঝতে পারছে গাছে উঠে লাফ দিতে নেই!
খালাতো বোনটা খুব ছোটকাল থেকেই হাসিখুশী। যে কোনো কিছু হলেই বলতো: ঐ রাসেল, ওকে একটু মেরে দে তো?
আর ও বুক ফুলিয়ে মার খেয়ে আসতো। ক্লাশ এইটে উঠে বললো," আমাকে আজ স্যার মেরেছে, যাতো ওনার বাসার চালে ইট মেরে আয়!"
ও ইট মেরেছিলো তবে বাসার চালে নয় , স্যারের টাকলা মাথায়!
ম্যাট্রিক পাশ করার পর ও খুলনা কলেজে ভর্তি হয়, বাগের হাট ছেড়ে আসে। তারপর বিআইটি। থার্ড ইয়ারে ও একবার একটা পরীক্ষা দিলো না। ক্লাশের সবাইকে বললো নেক্সট টার্মে পরের ব্যাচের সাথে পড়ে আবারো এই ক্রেডিটে ভালো গ্রেডিং তুলবে।
ঘটনা এটা না, ঘটনা একটু অন্যরকম। পরীক্ষার আগের দিন ক্যানটিন থেকে খেয়ে রুমে এসে চেক করে মোবাইলে ৩২ টা মিসড কল। ও ব্যাক করলো, খালাতো ফুপিয়ে বলছে," রাসেল দেখ, ওরা আমাকে দেখতে আসছে। আমার ভালো লাগছে না। আমি কিচ্ছু জানি না, তুই একবার আয়!"
ও চলে যায়, কিছুই করতে হয়নি ওর, অটোম্যাটিক্যালি বিয়েটা হয়নি, কারন পাত্রের বয়স খুব বেশী ছিল, সে তুলনায় ওর খালাতো বোন অপসরী (ওর ভাষায়)।
ওর ঐ খালাটা আবার সম্পদশালী। খালাতো ভাইটা ইংল্যান্ডে থাকে। বাগের হাটে বিশাল জায়গা আর কিছু কোল্ড স্টোরেজ আছে। এলাকায় বেশ প্রভাব ওদের। সে তুলনায় রাসেলের বাবা সাধারন রিটায়ার্ড পার্সন একটা সরকারী ব্যাংকের কর্মকর্তা থেকে।
পাশ করার পর ও খুব জব চেন্জ্ঞ করছিলো কারন শরীরে খুব একটা এ্যাডজাস্ট হচ্ছিলো না। এই ফাকে ওর খালাতো বোনের বেশ কয়েকটা সম্বন্ধ এসেছিলো। কিছুই জানায় নাই।
একসময় রাসেল আইএলটিএস দিবে বলে চাকরী বাকরী ছেড়ে পড়াশোনা করতে লাগলো: ইংল্যান্ড যাবে।৩ মাস পড়বার পর, বাসায় চলে গেলো। একদিন খালাতো বোনের সাথে পহেলা বৈশাখে ঘুরতে গেলো।
নদীর তীরে হঠাৎ হাতটা ধরে খালাতো বললো,"এই, তুই কি সারাজীবন বেশী বুঝে যাবি? আমাকে কোনোদিন বুঝবি না?”
: তোকে না বুঝার কি আছে? কিন্তু সব সময় কি সব কিছু হয়? তুই তো কিছুই ক্লিয়ার করিস না!
খালোতো কিছুক্ষণ চুপ করে তাকিয়ে থাকলো, তারপর একে দিলো গালে ছোট একটা চুম্বন। রাসেলের মাথার চুল কয়েক সেকেন্ড বাতাসে উড়লো, চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে গেলো, আর বুকে বইতে থাকলো বিশাল এক টর্নেডো।
: কেন তুই আগে বললি না?
রাসেল এটাই বললো সেদিন তারপর চলে আসলো! তখন ওর মাথা অনেকটা আউলে গেছে। হয়তো ওর মনে গভীরে এমনি কিছু একটা চাইছিলো, যেটা আজ ও বুঝতে পারছে। মনে হচ্ছিলো ওর মাথায় অসংখ্য বাজ পড়ছে!
কিন্তু বাস্তবতায় পরিস্হিতি একটু অন্যরকম! ওর খালাতো ভাই ওর টিউশন ফিস দিয়ে দিয়েছে।স্পন্সর ওর বাবার রিটায়ার্ড এ্যাকাউন্ট আর খালার এ্যাকাউন্টের সব লিকুইড টাকা।
ওর তখন চাকরি ছিলো না, হাতে নিজের বলতে কোনো টাকা নাই। ও তারপরের দিন রাতের বাসে উঠে পড়ে, কিন্তু ফরিদপুরের গোয়ালন্দের কাছে এ্যাক্সিডেন্ট করে ঐ বাসটা। ও যে গাড়ীতে উঠেছিলো সেটা একটা খাদে উল্টে যায়। ওর সামনে থাকা ভদ্রলোক মারা যান, পাশের লোকের হাত ভেঙ্গে গেছে। ওর অবস্হাও ভালো না। দুদিন পর হাসপাতাল থেকে ঢাকায় এসে পড়ে। শুধু খালাতো বোন কে একটা কথাই বলেছিলো এ্যাক্সিডেন্ট করবার কিছুক্ষন আগে:”একটু দোয়া করিস, যাতে আর না ফিরি, এই পথেই যেনো আমার ঠিকানা হয়।"
ও যখন ঢাকায় আসে, তখন ওর কেনো যেনো মনে হয়েছিলো আল্লাহর বোধ হয় অন্য একটা প্লান রেখেছে ওর জন্য!
এটুকু বলে ও কেদে দিলো। আমি বললাম," কি হইছে রে তোর? তোর তো কাজ হয়েই গেছে। পাশ করে আয়, তারপর বিয়ে করে ফেল!"
ও বললো," গতকাল ওর আক্বদ হয়ে গেছে।"
ওকে উঠিয়ে নিয়ে গেলাম ওর বাসায়। আমি বসেছিলাম আর ও ওর লাগেজ গুছাচ্ছিলো। ও একটা একটা করে শার্ট ভরছিলো আর কি যেনো ভাবছিলো!
আমার তখন নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে হয়েছিলো। সব সময়ই আমি একটা জিনিস ভাবতাম। যদি এমন একটা ক্ষমতা থাকতো, আমি এখানে বসেই আমার সেই সুপার ক্ষমতা দিয়ে যে কারো মনের কথা পড়ে নিতে পারতাম!
আসলেই আমি সৌভাগ্যবান, কারন ওর মনের কি অবস্হা তা জানতে পারলে আমার নিজেরও বাচতে ইচ্ছা করতো না তখন। এতটা বিশুদ্ধ আবেগের মুখোমুখি আর কখনোই হতে চাই না!
মাঝে মাঝে মনে হয় এই ধরনী খুব সুন্দর আবার নিস্ঠুরও। বুকে ধারন করে আছে এরকম কত না হাজারো ব্যাথা, ইতিহাসের সকল আবেগ এর কাছে অর্থহীন। ধরনীর কাজ হলো সব বইয়ে বেড়ানো, তাই সে বইছে অক্লান্ত ভাবে, ভাব লেষহীন।
ধরনী তুমি একটু রাগ করো
রাগ করো এই বাস্তবতার উপর
যার দোহাই দিয়ে হারিয়ে যায় হাজারো মন
একটু রাগ করো এই সময়ের উপর
যার অভাবে ধরা যায় না
ভালোবাসার শেষ সুযোগ
অথবা একটু রাগ করতে পারো সেই মিথ্যা আবেগের
যার মোহে পড়ে ভাঙছে কত না সংসার!
এরকম মহৎ হবার কোনো মানে হয় না, এরকম নিষ্ঠুর হবারও মানে হয় না!