খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দীতে হেগেসিয়াস নামের এক দার্শনিক ছিলেন যে কিনা সক্রেটিসের শিষ্য। তিনি আলেকজ্রান্দ্রিয়ায় তার অনুগামীদের মধ্যে প্রচার করা শুরু করলেন সুখ ব্যাপারটা হলো একটা ভ্রম, মায়া। এর পেছনে ছোটার কোনো অর্থ নেই। কারন আমাদের অস্তিত্বটাই হলো নিরর্থক। এ জীবনের কোনো মূল্য নেই। তার বুক অব স্টারভেশনে আত্মহত্যাই হলো একমাত্র পথ সেটার পেছনে বিশাল বক্তব্য পেশ করলেন। করবেনই বা কেন, কারন তখনকার ধর্মপ্রনেতা, ধর্ম গুরুরা মানববিমুখ হয়ে গিয়ে ক্ষমতাসীন ওপরতলার মানুষের পদলেহনে ব্যাস্ত হয়ে পড়েছিলেন। তার মতাদর্শে অনুপ্রানীত হয়ে হতাশাগ্রস্থ অনুগামীরা দলে দলে আত্মহত্যা শুরু করে। রাজা টলেমী অবস্থা বেগতিক দেখে হেগেসিয়াসকে আলেক্সান্দিয়ায় নিষিদ্ধ করেন। এভাবেই শুরু হয় হতাশাবাদী দর্শন তত্বের জন্ম।
পল সাত্রে সেক্ষেত্রে নিজের অস্তিত্বকে বিশাল একটা কিছু বানিয়ে তার অস্তিত্ববাদী মতবাদ চালু করলেন। যেমনটা ধরা যাক এই যে ছাত্রদের আন্দোলন। কিছু দিন আগে ছিলো কোটা, এখন সহপাঠিদের মৃত্যুর বিচারে পুরো সিস্টেম শুদ্ধির একটা দাবী। ধরা যাক এসব ছাত্র ছাত্রীরা মনে করলো তাদের অস্তিত্ব সব কিছুই ঈশ্বরের দ্বারা নির্ধারিত। ফলে যা হবার হবেই। যারা মারা গেছে তাদের মৃত্যু পুননির্ধারিত, তারা মরবেই, যত চেস্টাই করি না কেন। সিস্টেম বদলালেও তারা মরতো, তাই না? আসলেই কি তাই? তাহলে এতো আন্দোলন কেন? মাত্র দুদিনের আন্দোলনে ঢাকার রাস্তার চার লেনের সড়কে একটা ইমের্জেন্সি লেন চালু হয়েছে। আজকে ছাত্রদের বদৌলতে জানতে পারলাম খোদ পুলিশ, দুদক, এমনকি মন্ত্রি মিনিস্টার প্রশাসনের গাড়ী এবং তাদের চালকের কাগজ পত্র ঠিক নেই। যে কাওরান বাজারে লেন হিসাব তো পরে, গাড়ীর জ্যামে রাস্তার অস্তিত্ব খুজে পাওয়া যেতো না সেখানে সবাই সারিবদ্ধ। আজকে যদি ছাত্ররা না নামতো তাহলে এই শৃঙ্খলা ফিরে আসতো? না, আসতো না। এই শৃঙ্খলা ফিরে না আসলে এই যে নীরিহ ছাত্র ছাত্রী সহ আরও কত মানুষ প্রতিদিন সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যাচ্ছিলো, সেগুলো বন্ধ হতো না।
ঈশ্বর বলতে আসলেই কি কেউ নেই! আমরা আমাদের চেতনার দ্বারা বস্তুজগতের সবকিছু আবিস্কার করছি। আমাদের জন্য পূর্ব নির্ধারিত কিছুই নয়। আজ যদি কার্বন নিঃসরন নিয়ন্ত্রন হীনভাবে করি তাহলে ৫ বছরের মাথায় বাংলাদেশ ডুবে যাবে। আর এখন যেভাবে নিয়ন্ত্রন করছি তাহলে ২০৩৬ পর্যন্ত আমাদের দেশ জেগে থাকবে। আর কার্বন নিঃসরন আজকে থেকেই বন্ধ করি তাহলে ২০৬০ সাল। এটাই বাস্তবতা। আমাদের ভবিষ্যত আমরাই গড়ছি। এটাই রূপতত্বের মিশেলে অস্তিত্যবাদের মূল কথা। এজন্য আপনাকে স্ট্রিং থিওরী জানতে হবে না, আপনার ওপর ওহী নাযিলের কোনো প্রয়োজন নেই।
সমস্যা হলো আমরা কল্পনার জগতে একটা ইউটোপিয়া নিয়ে বাস করছি। পল সাত্রে সেই ইউটোপিয়াকে বারবার আঘাত করতেন। ফ্রান্সের কবল থেকে স্বাধীনতা পাবার জন্য আলজেরিয়ার সবাই লড়ছিলো তখন তিনি আলজেরিয়ার পক্ষে অবস্থান নিলেন। তার বিরুদ্ধে সামরিক আদালত বসলো, গ্রেফতারী পরোয়ানা জারী হলো, তাকে ডাকা হলো বিচারে। তিনি না এসে একটা হাতে লেখা চিঠি দিলেন। সেখানে তিনি বললেন আলজেরিয়া স্বাধীন হবেই, আজ হোক, কাল হোক, অথবা ৫ বছর পর। সমস্যা হলো তখন ফ্রান্সে কি গনতন্ত্র থাকবে? নাকি এভাবে সেনা বাহিনী বা রাস্ট্রিয় রক্ষী বাহিনী দিয়ে পুরো ফ্যাসিস্ট রাস্ট্রে পরিনত হবে।
সরকার নড়ে গিয়েছিলো এই এক চিঠিতে। এর কিছু কাল পরেই শিক্ষানীতি পরিবর্তনের নীতিমালার জন্য অসহযোগ আন্দোলন করলো ছাত্ররা। প্রশাসন এই আন্দোলনের পিছে পল সাত্রেকে দায়ী করে বসলো। আন্দোলন তখন এতটা বেগবান হলো প্রেসিডেন্টের পর্যন্ত টনক নড়লো। পুলিশ কমিশনারকে ডেকে বললেন তোমরা ভলতেয়ারকে আটকে রাখতে পারো না। পল সাত্রে মুক্ত হলেন, ছাত্রদের দাবী মেনে নিলো সরকার। অথচ তারই সমসাময়িক আলজেরিয়ার আরেক দার্শনিক বলতেন, তুমি আমার পেছনে হেটো না কারন আমি জানি না কোথায় যাচ্ছি। আমার সামনে হেটো না কারন তোমাকে অনুসরন করবো না। আমার পাশে হাটো, আমরা বন্ধু হই। তিনিও হেগেসিয়াসের মতো ভাবতেন জীবনটা অনর্থক, অর্থহীন!
এই পল সাঁত্রে নিজের লেখক সত্বাকে কলুষমুক্ত করতে ফ্রান্সের সর্বোচ্চ সম্মান থেকে শুরু করে নোবেল পুরস্কার পর্যন্ত নিতে অস্বীকৃত জানান। এই লোকটি দেখিয়েছিলেন শোষিত মানুষকে ইউটোপিয়ার স্বপ্ন থেকে কিভাবে জাগতে হয়, নিজের অধিকারের জন্য নিজেকে কিভাবে সংগ্রাম করতে হয়। ন্যায্য অধিকারের জন্য হতাশাবাদী না হয়ে কিভাবে নিজের জীবনকে অর্থব হ করতে হয়।
বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ আজকে ভাবে লীগের বদলে আমরা কাকে বেছে নিবো। সব রশুনের তো একই গোড়া। আমরা যেনো মেনে নিয়েছি সব বিচার আল্লাহ করবে। আল্লাহকে বিশ্বাস করা না করা প্রতিটা মানুষের জন্মগত অধিকার কিন্তু শুধু এই এক ভাবনার কারনে আমরা আমাদের মৌলিক চাহিদাকে ছুড়ে ফেলে দিতে পারি না। ফলাফল একই হবে, অনাহার, শোষিত অথবা গুম হত্যা বা কোনো ক্ষমতাশালী মালিকের গাড়ীর চাপায় পিষ্ট হবে আমারি সন্তান। আমি নিজের অস্তিত্বকে মূল্যহীন ভাবি বলেই আজকে মাত্র ২০ লাখ টাকার বিনিময়ে গাড়ি চাপায় মৃত সন্তানের বাবা মা চুপ হয়ে যায়, মানুষের জীবনের মূল্য নির্ধারন করতে পারে এক ফ্যাসিবাদী রাস্ট্র। যেখানে রাস্ট্র অভিভাবক হয়ে প্রজাদের আগলে রাখবে সেখানে রাস্ট্র নিজেই হত্যাকারীর ভূমিকায়।
আর আমরা সব হেগেসিয়াসের অনুসারী হয়ে ইউটোপিয়া আর ফ্যালাসীর মধ্যে নিপতিত হয়ে সবকিছু পরমেশ্বর নামক এনটিটির ওপর ছেড়ে দিয়ে বহন করছি নিজের সন্তানের বিকৃত লাশ।
আর কত?
এসব অথর্ব মুর্খ নিদ্রা ভাঙ্গাতে আসলেই একজন পল সাঁত্রের খুব দরকার। জানি না কখন শুনি এমন নিস্পাপ ছাত্রদের ওপর কখন ডান্ডাবেড়ীর আঘাত দিয়ে যৌক্তিক দাবীগুলোকে থামিয়ে দিবে এই ফ্যাসিবাদী রাস্ট্র।
আর হ্যা! আমার মতো পুজিবাদী ভক্ত দাঁতাল শুয়োর সর্বদাই বলে আসছে,"দর্শন ইজ আ পিস অব শিট!"